নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

রাতের আকাশের নাম না জানা একটি অজানা তারা.........................

রাত জাগা তারা ও আমি

রাত জাগা তারা ও আমি › বিস্তারিত পোস্টঃ

প্রাণ হাতে মধুর খোঁজে.........।

২৩ শে এপ্রিল, ২০১৮ বিকাল ৫:৪৬



সুন্দরবন...। কোথাও বাঘের ভয়। কোথাও কুমীরের। তার মাঝেই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মধু সংগ্রহে বেরিয়ে পড়া। কারও হাত যায়, কারও প্রাণ। একের পর এক পরিবার হয়ে যায় পুরুষবর্জিত। তাও তাঁরা বেরিয়ে পড়েন। প্রাণের মায়া ছেড়ে। মধুর খোঁজে...।

বামফ্রন্ট জমানার সুন্দরবন উন্নয়ন বিষয়ক মন্ত্রী কান্তি গঙ্গোপাধ্যায় গুরু মেনেছিলেন শবর সম্প্রদায়ের এক কাঁকড়াশিকারী নিশিকান্ত ভক্তাকে। পাথরপ্রতিমা থানার গরিব আদিবাসী পল্লি পশ্চিম দ্বারকাপুর। নিশিকান্ত ভক্তার নেতৃত্বে সাতজনের একটি দল গিয়েছেন কাঁকড়া শিকারে। সুন্দরবন ব্যাঘ্র প্রকল্পের মধ্যে বিজিড়িয়া জঙ্গলে। তাতে রয়েছেন সত্যবতী, রাম, অঞ্জলি, সুদর্শন, বিমলা, মুচি ভক্তা। সকলে একই পরিবারের। আত্মীয়। তিনজন সস্ত্রীক। একলা নৌকোয় রয়েছেন কেবল মুচি ভক্তা। সকলে আঙড়ি ও খোন্তার সাহায্যে কাঁকড়া ধরছেন, আর ব্যাগে পুরছেন। আঙড়ি শবরদের ভাষ্যে লোহার শিক, কাঁকড়াকে গর্ত থেকে খুঁচিয়ে বের করার মোক্ষম অস্ত্র। খোন্তা কাঠের হাতলওয়ালা তিন চার ফুটের হালকা শাবল। গনে কাঁকড়ার প্রাচুর্যে উৎফুল্ল সবাই। ছোট ছোট ঝোপঝাড়ে ঢাকা পড়েছেন সকলে, কেউ কাউকে দেখতে পাচ্ছেন না, কিন্তু কথা চালাচালি চলছে। চলছে হাসি-ঠাট্টা-মস্করা। রোদঝলমলে দিন। মৃদুমন্দ জোলো হাওয়া বইছে। হঠাৎ নিশিকান্তবাবুর স্ত্রী সত্যবতীর আর্ত চিৎকার। পড়িমরি করে ছুটলেন সকলে; সত্যবতীকে বাঘে ধরেছে। টেনে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে জঙ্গলে। পুরুষ-মহিলা নির্বিশেষে আঙড়ি-শাবল নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। অসম যুদ্ধ। বাঘ সত্যবতীকে ছেড়ে ভয়ঙ্কর জখম করল দুই পুরুষ-সঙ্গীকে। সমবেত মানুষের প্রতিরোধ-চিৎকারে রণে ভঙ্গ দিয়ে বাঘ দুলকি চালে জঙ্গলে ঢুকে গেল। খানিকক্ষণ অপেক্ষার পর বিপদ কেটেছে ভেবে নিশিকান্তবাবু আহত দুই পুরুষ সঙ্গীকে নিয়ে আগে নৌকোয় রেখে আসবেন বলে ঠিক করলেন। কারণ তাদের আঘাত গুরুতর, অবিরাম রক্তক্ষরণ হয়ে চলেছে। তাঁর স্ত্রীও অচৈতন্য। কিন্তু আঘাত অতটা গুরুতর নয়। কাঁধে করে দুই মৃতপ্রায় সঙ্গীকে নৌকোয় রেখে স্ত্রীকে নিয়ে যাওয়ার জন্য পা বাড়িয়েছেন; তখন দেখলেন বাঘ বেরিয়ে স্ত্রীকে মুখে নিয়ে বিদ্যুৎ-গতিতে জঙ্গলে মিলিয়ে গেল। আহতেরা চিকিৎসায় সুস্থ হলেন। সাতজনের দল নিয়ে বেরিয়েছিলেন, ফিরলেন যখন... খোয়া গিয়েছেন স্ত্রী। এতগুলো বছর তাঁর একমেবাদ্বিতীয়ম সুখ-দুঃখের ভাগীদার। স্ত্রীর বিপদের কথা তুচ্ছ করে তাকে শমনের মুখে চিরকালের জন্য ছেড়ে এসে দুই সঙ্গীকে বাঁচিয়ে যে দৃষ্টান্ত নিশিকান্তবাবু স্থাপন করেছিলেন, নিঃসন্দেহে তা আজকের নবকুমারোত্তর যুগে বিরল। কান্তিবাবুর ওই শ্রদ্ধেয় মানুষটিকে গুরু না মেনে উপায়ই বা কি?
১০২টি দ্বীপ নিয়ে সুন্দরবন। ৫৪টি দ্বীপের জঙ্গল সাফা করে গড়ে উঠেছে বসতি। ৪২৬৪ বর্গকিমি ম্যানগ্রোভ অরণ্য দুটো ভাগে বিভক্ত। ২৫৮৫ বর্গকিমি (৬১%) ব্যাপী সুন্দরবন টাইগার রিজার্ভ ফরেস্ট ও ১৬৭৯ (৩৯%) বর্গকিমি দক্ষিণ ২৪ পরগনা ডিভিশন। জাতীয় উদ্যান (১৩৩০ বর্গকিমি) ও সজনেখালি অভয়ারণ্যে (৩৬২ বর্গকিমি) মধু ভাঙা নিষিদ্ধ। মধু ভাঙতে যাওয়া যাবে ৮৯৩ বর্গকিমি ব্যাপী সুন্দরবনের বাফার এলাকায়। ২৪ পরগনা ডিভিশনে লোথিয়ান অভয়ারণ্য (৩৮ বর্গকিমি) ও হ্যালিডে অভয়ারণ্যে (০৬ বর্গকিমি) মধুভাঙা দণ্ডনীয় ও নিষিদ্ধ। অনুমোদিত এলাকা অবশিষ্ট ১৬৩৫ বর্গকিমির পুরোটাই ম্যানগ্রোভ অরণ্য।
সাতজেলিয়া পৌঁছনো
দিনটা ২০১৭’র দীপাবলির। কলকাতা থেকে বারুইপুর, সেখান থেকে বাসে ক্যানিং। মাতলা সেতু পেরিয়ে সোনাখালি হয়ে হোগল সেতু উজিয়ে বাসন্তী। তারপর গদখালি। আবার নদী পেরনো... বিদ্যাধরী। গোসাবা বাজার। অটোতে রাঙাবেলিয়া উজিয়ে আমরা জ্যোতিরামপুর ঘাটের দিকে চলেছি। অটো চলেছে নাচতে নাচতে। বারুইপুর থেকে আমাদের সাথী সাতজেলিয়ার তাপস। সে আমাদের সুন্দরবনের অন্তরমহলের পথপ্রদর্শকও। একটি স্কুলের ভূগোলের শিক্ষক তাপস। অটো থেকে নেমে মিনিট দশেকের হাঁটাপথ জ্যোতিরামপুর ঘাট। ভাটা চলছে। অন্ধকারে তাপস হঠাৎ থেমে গিয়ে একটা জায়গা বেশ খানিকটা নীচে আঙুল দিয়ে দেখাল। এক সায়াহ্নে মহিলা কণ্ঠের গোঙানি তাপসের কানে এসেছিল, ঠিক আমরা যেখানটায় দাঁড়িয়ে। সেদিনও সন্ধে ঘনাতেই নিঝুম চারিধার। মোবাইলের টর্চ জ্বালতেই ভয়ে বিবর্ণ হয়ে গিয়েছিল তাপস। এক মহিলার কোমরের নীচের এক খাবলা মাংস নেই, কামট নিয়ে গিয়েছে। অবিরাম রক্তক্ষরণে মৃত্যুর ঘণ্টাধ্বনি শুনছে তাপস। তাপসের আসুরিক ভয়ার্ত চিৎকারে আশপাশ থেকে লোকজন ছুটে এসেছিল। জোয়ারের জল সরতেই সহৃদয় মানুষের সহায়তায় তড়িৎগতিতে হাসপাতাল; প্রাথমিক চিকিৎসার পর কলকাতা, অতঃপর ভেলোর। প্রাণে বেঁচে যান মহিলা। সাতজেলিয়া খেয়াঘাটে যখন পৌঁছলাম, ঘড়িতে সাড়ে সাতটা। ঘাটে সদ্য নদী থেকে ধরা নানারকম মাছের বিকিকিনি চলছে। সুঠাম মাছ বিক্রেতা এক হাতে মাছ বিক্রি করছে। বাঁহাতটি কনুইয়ের নীচে থেকে কাটা। তাপস আলাপ করিয়ে দিল মাছ বিক্রেতা বিমানবাবুর সঙ্গে। মাছ ধরতে গিয়ে ব্যাঘ্রাচার্য বৃহল্লঙ্গুলের কামড়ে বিমানবাবু তাঁর বাম হাতটি খুইয়েছেন।
পরদিন সকাল। গোমর নদীর জোয়ারের জলে ম্যানগ্রোভ ঝুঁকে পড়েছে। মাঝি বলে চলেছেন, গত সপ্তাহে একটা ভেটকি ধরেছেন ৪২ কেজি ওজনের। হাত দিয়ে ম্যানগ্রোভের একটা সোঁতা দেখিয়ে বললেন, ওখানে আজ সকালেই একটা কুমীর ঢুকেছে। কুমীর আছে প্রচুর, আছে কামট। আর আছে বিশালকায় শঙ্কর মাছ। জালে পড়ে, বাজারে ভালও দামও মেলে।
লট নং-৪, লকগেটের উপরে দাঁড়িয়ে আমরা। নীচে নদী ফুঁসছে। লকগেটের ধারেই প্লাস্টিকের তিনটে জরাজীর্ণ কুটীর, জল এক বিগত বাড়লেই ভেসে যাবে। তিনটি পরিবারের বাস। আদম বাগদী নেতা-গোছের, বলিয়ে কইয়ে মানুষ। ঢেউ খেলানো বাবরি চুল, বনবিবির পালায় মূল গায়েন। তিনিই পরিচয় করালেন কুটীরের বাসিন্দাদের সঙ্গে। পুরুষ বর্জিত। প্রায় বারোটা বাজে। তোলা উনুনে সবে আগুন দেওয়া হয়েছে। ধোঁয়ায় জ্বলছে চোখ। স্বামীর সঙ্গে সকলেই মাছ, কাঁকড়া বা মধু আনতে জঙ্গলে গিয়েছিলেন। বাঘের আক্রমণে মারা গেছেন সবার স্বামী। কচি কচি কোলের শিশুদের নিয়ে অকুল পাথারে পড়েছেন আমাদের দেশের সর্বংসহা নারীকুল। সরকারি সাহায্যের কথা শুনেছেন... কিন্তু পাননি কিছুই। এখন কোনওরকম বিপদেই তাদের আর বুক কাঁপে না। রাতে বাঘ হামেশাই প্লাস্টিকের চাদরের দেওয়ালে ‘হাঁকড়ায়’।
বিপন্ন সুন্দরবনের ডাঁশ মৌমাছি
মৌমাছির চাক ভেঙে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যাঁরা নিয়মিত মধু আনেন, বিক্রি করেন, তাদের বলা হয় মৌলে। মধু বিক্রির টাকাতেই তাঁদের সংসার প্রতিপালিত। কাঁকড়ামারা-মাছমারা-মীনশিকারি-কাঠুরেদের মতোই মৌলে অতি প্রাচীন ও পৃথিবীর সবচেয়ে বিপজ্জনক পেশা। সুন্দরবনের সবথেকে নিকটবর্তী থানা গোসাবা-হিঙ্গলগঞ্জ-সন্দেশখালি-বাসন্তী-কুলতলিতেই অধিকাংশ মৌলের বাস। তাঁরা সুন্দরবনের দরিদ্রতম। মৌলে কোনও বিশেষ জাত বা সম্প্রদায়ভিত্তিক পেশা নয়। হিন্দু-মুসলমান, আদিবাসী-অনাদিবাসী সকলেই মৌলে।
সুন্দরবনে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন গাছে ফুল ফোটে। খলসি-গরাণ-কেওড়া-পশুর-সুন্দরী গাছে ফুল ফোটে ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসের মধ্যে। গেঁও-কাঁকড়া-বাইন প্রভৃতি গাছে ফুল ফোটার সময় জুন মাস। ডাঁশ মৌমাছি (এপিস ডরসাটা) সুন্দরবনের বিস্তৃত অঞ্চল জুড়ে মধু খায়, উড়ে বেড়ায়। এরা সাধারণ মধুপের (এপিস মেলিফেরা) তুলনায় আকারে বড়। আকারে বড় হলেও বুনো ডাঁশ মৌমাছি কিন্তু গৃহস্থালী বা বাগানের আনাচে কানাচের মৌচাকের ছোট মৌমাছিদের ভয় পায়। প্রায়শই ছোট মৌমাছিদের সঙ্গে বড় ডাঁশেদের মারামারি হয়। গোহারা হারে বড় ডাঁশেরা। কৃত্রিম মৌমাছি পালনের ফলে সুন্দরবনে মধুর লোভে ঢুকে পড়ছে ছোট এপিস মেলিফেরা। তারা ঝাঁকে-ঝাঁকে যেমন বড় ডাঁশেদের তাড়িয়ে দিচ্ছে, তেমনি একটা ফুলের উপর সদলবলে হামলে পড়ছে।
মৌলেদের রোজনামচা
দল বেঁধে মধু ভাঙতে যাওয়াই রেওয়াজ। দলে পাঁচ থেকে ন’জন থাকেন। আদিবাসীদের দলে সাধারণত মহিলারা থাকেন, মহিলারা পুরুষের থেকে নাকি সচেতন বেশি। আর মধু ভরা হলে অ্যালুমিনিয়ামের বড় হাঁড়ি নিয়ে তাঁরা যাতায়াতেও স্বচ্ছন্দ। পুরুষেরা ভাঙা মধু মাথায় করে হাঁড়িতে বয়ে নিয়ে যান। তাতে অনেক সময়েই দৃষ্টি আচ্ছন্ন হয়, লতাপাতায় হাঁড়ি জড়িয়ে অসতর্ক-অসাবধানী হয়ে পড়ার সম্ভাবনা থাকে। সেই সুযোগটাই খোঁজে বাঘ। নৌকোয় দলের একজনকে সবসময় থাকতে হয়। তাকে বলা হয় ‘গাঙনেয়ে’ বা ‘ভুড়ো’। দলের পরিচালককে বিভিন্ন নামে ডাকা হয়। যেমন দাহাসি/সাজন/সাজনদার/মহাজন ইত্যাদি। সাধারণত জঙ্গলে যাঁর অভিজ্ঞতা বেশি, তিনিই হন ‘গুনিন’। যাকে ‘বহরদার’ বা ‘বাউলে’ও বলা হয়। জঙ্গলে প্রবেশের দিন বাড়ি থেকে বেরনোর পর গুনিনকে বনবিবির নাম জপে সবসময় ডান পা আগে ফেলে হেঁটে যেতে হয়। নৌকোর পিছনের দিকে দাঁড়িয়ে গুনিন বলেন : ‘ভাটি গাঙের চাটিয়া/ পাঁচ ফুট দরিয়া/ গাজি গঙ্গা বদর বদর’। গুনিনের আদেশে একজন মৌলেকে গলুইতে দাঁড়িয়ে বলতে হয়: ‘বনবিবির নাম করে আল্লা আল্লা বল/ সত্যপীরের নাম করে হরি হরি বল/ রায় ঠাকুরের নাম করে হরি হরি বল’।
ভূপতিবাবু প্রাজ্ঞ মৌলে। অনেক অনুনয়ের পর আরও কিছু অবশ্যপালনীয় আচারের কথা বলেছিলেন। প্রত্যেক মৌলে হাতে বা কোমরে বেলগাছের শিকড় বেঁধে রাখেন। শনি/মঙ্গলবারে হাঁড়ি/কলসির ভাঙা টুকরো, বগি পোড়া মন্ত্রপূত করে ন্যাকড়াতে জড়িয়ে হাতে বাঁধা হয়। বনবিবির ‘জহুরনামা’ এবং সত্যপীরের পাঁচালি ভক্তিভরে প্রত্যহ নৌকোতে পাঠ করা হয়। প্রদীপ জ্বালিয়ে বাতাসা সম্প্রদান করে চলে নিত্য নৈমিত্তিক পূজার্চনা। পাথরপ্রতিমা থানার শবর আদিবাসীরা জঙ্গলে ঢোকার আগে তিনটে কাদার তাল বা মূর্তি গাছতলায় রেখে সিঁদুর-আলতা লেপে ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বরের রূপকল্পে পুজো করেন। উপকরণ হিসেবে ব্যবহৃত হয় তেল-গামছা-মালা-ঘুনসি-আয়না-চিরুনি-লোহার বালা-ফুলের মালা-ভিজে ছোলা-সন্দেশ প্রভৃতি। পুজো শেষে একটি মোরগকে আদর আপ্যায়ন করে প্রথম প্রসাদ খেতে দেওয়া হয়। মোরগ প্রসাদ খেলে ইষ্টদেবতা প্রসন্ন হয়েছেন ও জঙ্গল যাত্রার অনুমতি দিচ্ছেন বলে ধরে নেওয়া হয়।
জঙ্গলে প্রবেশের পর শুরু হয় মৌচাক খোঁজার পালা। চাক খোঁজার পদ্ধতি অনুযায়ী মৌলেরা তিন শ্রেণীতে বিভক্ত—কাঁধের মৌলে, ছাটার মৌলে আর চোখের মৌলে। চেনা পরিচিত চাকগুলোকে যে মৌলেরা ভাঙবেন বলে ঠিক করেছেন, তাদের বলে কাঁধের মৌলে। ছাটার মৌলেরা নতুন চাক খুঁজে বের করবেন আর সেই চাক থেকে মধু সংগ্রহ করবেন। চোখের মৌলেরা উড়ন্ত মৌমাছির চলন দেখে বুঝতে পারেন কোথায় মৌমাছিরা চাক বেঁধেছে। মৌলেরা তাদের অভিজ্ঞতা থেকে জানেন, একই গাছে একই জায়গায় ডাঁশ মৌমাছি চাক বাঁধে। মৌমাছি যদি সারিবদ্ধ ভাবে বাসায় ফেরে, তবে তাদের পেট মধুতে ভর্তি আর যদি বিক্ষিপ্ত ভাবে ওড়াওড়ি করে তার মানে, তারা মৌ-পিয়াসী অলির ঝাঁক। মৌমাছিরা, মানুষের গায়ের গন্ধ এমনকী নিচুস্বরে কথাবার্তা শুনেই তেড়ে এসে হুল ফোটায়। তাঁরা বলেন: অমিতপরাক্রমী বাঘ কখনও সামনে থেকে আক্রমণ করে না। অসতর্ক মুহূর্তে পিছন থেকে আক্রমণ করে, তাই মৌলেরা বাঘকে ধোঁকা দিতে মাথার পিছনে মানুষের মুখোশ লাগিয়ে রাখেন। বাকি মৌলেরা লাঠিসোঁটা হাতে পাহারায় থাকেন। কারণ একাগ্রচিত্তে সকলেই যে যার কাজে ব্যস্ত। সতর্ক পাহারা না থাকলে বাঘ যে কোনও সময় লাফিয়ে পড়বে।
কোথায় চাক
চাকের সন্ধান মিললে মৌলেরা যে যার নিজের মতো কাজ শুরু করেন। গাছে উঠে ধারালো দা দিয়ে চাক কাটবেন ‘গাছি’, ‘আড়িদার’ গাছের তলায় নিক্তি মেপে আড়ি (অ্যালুমিনিয়ামের হাঁড়ি) ধরবেন, কাটা চাককে দক্ষ খেলুড়ের মত জায়গা বদল করে হাঁড়ির মধ্যে লুফে নেবেন। এক অথবা দুজন চাকের কাছে বোড়ে (মশাল) ধরে থাকেন। ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসে যে চাক মাটির কাছাকাছি থাকে, তাতে মধুর পরিমাণ কম, সর্বাধিক ১০ কেজি। মরশুমের শেষে বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ (মে-জুন) মাসে সুন্দরবনের ডাঁশ মৌমাছি মাটি থেকে ৩০ ফুট উঁচুতেও চাক বাঁধে। অভিজ্ঞ মৌলেরা বলেন, ডাঁশ মৌমাছি সবচেয়ে বেশি চাক বাঁধে গেঁও-সুন্দরী-গর্জন-বান-কাঁকড়া-পশুর-ধুধুল-কেওড়া-বকুল-হেঁতাল-ওরা-তরা প্রভৃতি গাছে। যে ফুল মৌমাছিরা সবথেকে বেশি পছন্দ করে সেগুলি হল খলসি-গরাণ-কাঁকড়া-কেওড়া-বান-হেঁতাল-গেঁও-ওরা-তরা প্রভৃতি। কারণ এসমস্ত ফুল থেকে বা পুষ্পরস বা নেকটার মেলে সর্বাধিক।
কয়েকজন মৌলে
পাথরপ্রতিমা থানার সত্যদাসপুর আদিবাসী-পাড়ার বাসিন্দা ৫৭ বছরের রাম ভক্তা। ৩৭ বছর নিরবচ্ছিন্ন ‘মহাল’ (জঙ্গলে মধু ভাঙতে যাওয়া) করছেন। তাঁর মতে বৃষ্টি হলে মধুর পরিমাণগত মান বাড়ে। হেঁতাল-গরাণ-চাঁপা ফুলের মধু নাকি লাল, খোলসে ও বান ফুলের মধু সাদা। গেঁও গাছের মধু তেতো। সমশেরনগরের জহর গাজি খুব ছোটবেলা থেকে জঙ্গলে যাচ্ছেন মধু ভাঙতে, কাঁকড়া ধরতে। যে সময়টা বনদপ্তর মধু ভাঙতে অনুমতি দেয়, সেই সময়টাতে কাঁকড়া মারা নিষিদ্ধ। মধু ভাঙার মরশুম ১৫ চৈত্র থেকে ১৫ জ্যৈষ্ঠ। যদিও শুক্লা পঞ্চমীতে অভিজ্ঞ মৌলে প্রদীপ জ্বালিয়ে দেখে নেন হাওয়ার গতির অভিমুখ, মৌমাছি সেই অভিমুখেই মিলবে। তাই সরস্বতী পূজোর পরেই লুকিয়ে, বিনা অনুমতিতে মধুর খোঁজে বনে গমন করেন অনেক মৌলেই! ৪৫ থেকে ৬০ দিনের ‘পাস’ ইস্যু করে বনদপ্তর। সবথেকে অভিজ্ঞ মৌলেরাও ২০ থেকে ২৫ দিনের বেশি কখনওই মধু ভাঙতে পারেন না। প্রত্যেকটা নৌকোকে ‘বোট লাইসেন্স সার্টিফিকেট’ বা বিএলসি নিতে হয়। মূল্য ৬০ টাকা। প্রত্যেক মৌলেকে মধু ভাঙতে যাবার আগে স্ব স্ব গ্রামের জয়েন্ট ফরেস্ট ম্যানেজমেন্ট কমিটির কাছে আবেদন করতে হয়। করতে হয় ১০০ টাকার ‘জনতাবিমা’। সচিত্র পরিচয়পত্র, বিমা, নৌকোর জিনিষপত্রের খুঁটিনাটি বিবরণ, ও অন্যান্য কাগজপত্র যথাযথভাবে দাখিলের পরে বনদপ্তর থেকে নৌকাসহ মৌলেদের ফটো তুলে রাখা হয়। তারপরে সজনেখালি বা বাগনা বিট অফিস থেকে নৌকাগুলোকে রওনা করিয়ে দেওয়া হয়। জহর গাজি, ২০১৩ সালে সাতজনের দলে ৭ কুইন্টাল মধু ভেঙেছিলেন। তারা পিছেখালি-নটবরখালি-আড়বেশে (১)-দক্ষিণ চড়া-বুড়িরদ-হরিনভাঙা-চরকাখালি-কর্পূর প্রভৃতি অনুমোদিত জঙ্গলে প্রথমে মধু ভাঙতে যান। আশানুরূপ মধু না মেলায় তারা নিষিদ্ধ জঙ্গল যেমন চামটা-রাজাখালি-পিরখালি-গাজিখালি-বঙ্কা প্রভৃতিতেও ঢুঁ মারেন, প্রচুর মধু মেলে। যে জঙ্গলে ছানবিন কম হয়েছে, পবিত্রতা রয়েছে, সেখানে শান্তিতে মৌমাছিরা বাসা বাঁধতে চায়, নিষিদ্ধ অঞ্চল মানে সেটা খোদ বাঘের ডেরা। এই সমস্ত অঞ্চলে বাঘের হাতে মৃত্যুর সংখ্যাও সর্বাধিক। কোনও সরকারি ক্ষতিপূরণ তো মিলবেই না, উপরন্তু জেল-জরিমানা অবশ্যম্ভাবী। পেট বড় বালাই, দুটো বেশি টাকার টানে প্রাণ হাতে করে তাই নিষিদ্ধ গমন। শুধু বাঘে রক্ষা নেই দোসর গাঙ ডাকাত ও বাংলাদেশি জলদস্যু। হিঙ্গলগঞ্জের কালীপদ বিশ্বাস বহু বছর ধরে মধু ভাঙতে যাচ্ছেন। তিনিও একবার ডাকাতদের কবলে পড়েছিলেন। মধু ও নৌকার যাবতীয় জিনিসপত্র লুট করেও ডাকাতরা ক্ষান্ত হয়নি, কালীপদবাবুকে বেদম মার মেরে অচৈতন্য অবস্থায় ফেলে রেখে গিয়েছিল। সত্যদাসপুর আদিবাসীপাড়ার আর এক মৌলে মনোরঞ্জন ভুঁইঞা; ১০ বছর বয়স থেকে জঙ্গলে মধু ভাঙতে যান। তিনি বিজারিয়া-কলস-বাই ঝিনঝিরা-চুলকাটি-কাঁটাবনি-ভুবনেশ্বর-ভাঙরমারি-ফারসামারি-ঢুলিবাসা-বেনিফুলি-লতাবেড়-বৈঠাভাঙি-বাতচিরা প্রভৃতি অনুমোদিত জঙ্গলে যান। তাঁরও মত, পুব বা পশ্চিমের নিষিদ্ধ বাদায় না ঢুকলে মন মতো মধু মেলে না। ধরা পড়লে বনরক্ষীরা পাস কেড়ে নেবে, মারধর-লাঞ্ছনা করবে, জেল জরিমানাও হতে পারে। মনোরঞ্জনবাবুর দলে পরপর দু’বছর বাঘ পড়েছিল। দু’বারই দু’জন বাঘের আক্রমণে প্রাণ হারান। একটা চাক ভাঙতে দু’-তিনটে মশাল লাগে। বাঘের আক্রমণে নিহত হতভাগ্য বড়িয়া (মশাল) তৈরি করবে বলে বগড়া জঙ্গলে বগড়া অর্থাৎ হেঁতাল পাতা সংগ্রহ করতে গিয়েছিলেন। হেঁতাল পাতা নিয়ে আর ফেরা হয়নি।
মধুর বিকিকিনি
সুন্দরবনে মৌলেরা কী পরিমাণ মধু সংগ্রহ করবেন, তা পরোক্ষে নির্ধারিত হয় ওয়েস্ট বেঙ্গল ফরেস্ট ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন দ্বারা। তারা যে পরিমাণ মধু কিনবে, ‘বনদপ্তর’ সেই পরিমাণ মধু মৌলেদের কাছ থেকে কিনবে। বাজারের অর্ধেক দামে সরকারি তরফে মধু কেনা হয়।
মধু ভাঙার পেশা বা মৌলেবৃত্তি পৃথিবীর আদিমতম পেশাগুলোর অন্যতম। এখনও মৌলেদের মধু ভাঙার সময় পরনের কাপড় জোটে না। খালি পায়ে, খালি গায়ে ডাঁশ মৌমাছির তীব্র বিষাক্ত হুল-যাতনা সহ্য করে যুগের পর যুগ তাঁরা মধু ভেঙে চলেছেন। সম্পন্ন স্বাস্থ্য-সচেতন শহুরে মানুষর শ্রী বজায় রাখতে অথচ তাদের ঘরে আলো জ্বলে না, দু’বেলা দু’মুঠো ভাত জোটে না। সন্তানের মুখে এক গ্রাস ভাত তুলে দিতে বাবা-মা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পাড়ি দিচ্ছেন গহীন জঙ্গলে। যাত্রা তাদের স্ব-ইচ্ছেয়, ফেরাটা বনবিবির। এই অসহায় প্রান্তিক নিম্নবর্গীয় মানুষগুলোর প্রতি সরকার বা বৃহত্তর সমাজের কোনই দায়বদ্ধতা নেই? অনাদর-অবহেলা ছাড়া তাদের পোড়াকপালে নতুন দিনের ভোর কি ধন্য আশা কুহকিনী হয়েই থাকবে? শুভ্র সমুজ্জ্বল ‘হেরিটেজ’ তকমার গায়ে তবে মলিন ধূলার সিঞ্চন যে অবশ্যম্ভাবী!

মন্তব্য ১ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (১) মন্তব্য লিখুন

১| ২২ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৮ রাত ১০:৩৪

সনেট কবি বলেছেন: কিছুটা পড়লাম।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.