নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আমি নৃত্য-পাগল ছন্দ,আমি আপনার তালে নেচে যাই, আমি মুক্ত জীবনান্দ। আমার এই পথ চাওয়াতেই আনন্দ ....

রাজজাকুর

রাজজাকুর › বিস্তারিত পোস্টঃ

#ইফতারি...

০৯ ই জুলাই, ২০১৫ রাত ১০:৩২

লম্বাপথ অতিক্রম করে ভীষণ ক্লান্ত সফিক। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই ইফতারি, রোজা রেখে লম্বা সময় গাড়ি চালানো কষ্টকর। যে বেগে সফিকের গাড়ি চলছে তাতে মিনিট দশেকের মধ্যেই সামনের বাজারে পৌঁছতে পারবে। কিন্তু হঠাৎ করেই গাড়ির ষ্টাট বন্ধ হয়ে গেল! অনিচ্ছাসত্ত্বে পাশে একটা কড়াই গাছের নিচে গাড়ি পার্ক করতে হলো।

প্রচন্ড ক্ষুদায় যেন পেটের ভিতরে কামড় দিচ্ছে! ইফতারের আর আট নয় মিনিট আছে, সুনসান নিরব এই যায়গাটায় খাবার পাবে কোথায়? গাড়িতে অবশ্য একটা মামের বোতল আছে! যায়গাটায় একটা প্রাথমিক বিদ্যালয় দেখা যাচ্ছে। স্কুলে নিশ্চয় নলকুপ থাকবে, এইভেবে এগিয়ে গেল সফিক...

নলকুপের ঠান্ডা পানিতে হাতমুখ ধুতে না ধুতেই আযান পড়ে গেল। দুই ঢোক পানি গিলেই আজকের ইফতারি সারতে হচ্ছে যা আগে কখনো ঘটে নাই। আজ ভিন্ন রকমের একটা অনুভুতি স্পর্শ করে যাচ্ছে! কিছুক্ষণ আগের প্রচন্ড ক্ষুদা যেন উবে গেছে।

কী অদ্ভুত নীরব যায়গটা! স্কুলের মাঠে ঘাসের উপর দিয়ে হাঁটতে ভালই লাগছে...স্কুলের বারান্দায় একজন আধাপাঁকা লোক কি যেন খাচ্ছেন। লোকটা আন্তরিক ভাবে ডাকলেন, ইফতারি খাবার জন্য। কি মনে করে যেন ও এগিয়ে গেল....

: ভাই, ইফতারি নেন। নেন..
: জী, জী...

হায় হায়! এ কি! একটা ময়লা প্লাষ্টিকের ব্যগে সাদা মুড়ি আর কিছুই নেই! সফিক রুচি হারিয়ে ফেলেছে...! জনৈক ব্যক্তিকে আংকেল ডাকতে গিয়ে থেমে গিয়েছিল, জী জী বলেই চালিয়ে দিয়েছে। কিন্তু লোকটার এত সাহস হল কি করে হল, সামান্য মুড়ি খাবার জন্য এমন সহাস্য বদনে ডাকলেন। একটু কৌতুহলী হয়ে উঠল ও। এমন সময় আবার তাগাদা....

: নেন ইফতারি নেন?
: না, না। খান। আমি খাব না।
: আরে ভয়ের কিছু নাই, বাড়িতে ভাজা মুড়ি। খান...
: না ধন্যবাদ। আপনি খান...
: ও আচ্ছা! গরীবের খানা রুচিতে বাঁধে? হা হা হা

ভীষণ রকমের অপমানিত হয়ে নিজেকে সামলে উঠার চেষ্টায় দু বার ঢোক গিলল ও! আর হাসি হাসি মুখ করে বলতে থাকল...

: না না। আসলে তা নয়....

ওর কান গরম হয়ে গেছে....লোকটার কথার স্পষ্টতায় প্রমানিত হয় তিনি ভিক্ষুক নন। পোশাকের মলিনতা থাকলেও শরীরের দৃঢ়তা ও কন্ঠে জড়তা না থাকায় জিজ্ঞেস করার সাহস হল না, কি করেন? লোকটা এমনভাবে তাঁকিয়ে আছে, যেন দেখছেন সফিক কি করবে খাবে নাকি খাবে না বা এই বিষয়ে আরো কিছু শুনতে চান....!

কিন্তু সফিক কি বলবে! ও গত মাসে জার্মানি থেকে পি এইচ ডি করে ফিরেছে, দেশিবিদেশী অনেক মানুষসাথে ও মিশেছে! ও ভাবত, সে দারুন কথা বলতে পারে। কিন্তু কি এক অজানা কারনে, এই লোকটার সামনে ইতস্তত করায় যেন তার ভেতরকার হীনমন্যতা ও দূর্বলতা প্রকাশিত হয়ে গেছে। নিজেকে ছোট মনে হচ্ছে!! বিবেক প্রশ্ন তৈরী করেছে, কেন ও পোঁটলা থেকে একমুঠ মুড়ি মুখে দিতে পারবে না? কেন মলিন পোশাকের কাউকে আংকেল বলতে ভেতর থেকে বাঁধা আসবে....? ও ভাবছে এই শৃঙ্খল থেকে বেরিয়ে আসতেই হবে...

অনিচ্ছাসত্ত্বে একমুঠ মুড়ি নিল সফিক, লোকটা তাঁকিয়ে আছে, হয়তো দেখার জন্য কিভাবে অহংকারের পতন হয়! লোকটার তৃষ্ণার্ত দৃষ্টির কাছে পরাজিত হয়েও ইতস্ততভাবে কয়েক সেকেন্ড পার করেছে! এবার ও নিরবতা ভেঙে মুখের ভেতর মুঠিভরা মুড়ি চালান করে দিল....
মুড়ির টেষ্ট কেমন ভুলে গেছে ও, শুধু একমুঠো খেতে পারলেই মুক্তি, তাই চিবাতে থাকল। কয়েকবার চিবানোর পরও মুড়ির টেষ্ট বুঝতে না পারলেও ধীরে ধীরে জড়তা যেন কাটতে শুরু করল....

: আংকেল, সাদা মুড়ি কেন?
: গত ১২টা রোজার ইফতারি তো সাদা মুড়ি দিয়াই করলাম।

লোকটার দ্বিধাহীন, সংকোচহীন উত্তর কাঁটার মতন বিদ্ধ করল। লোকটার মুখের ভঙিতে বোঝা যায় কথাটা আন্তরিকভাবেই বলছেন, কটাক্ষ করবার জন্য বলেন নাই। অথচ তার উত্তরের শানিত কটাক্ষ সফিককে দারুনভাবে আহত করল। লোকটার চেহারায় একধরনের স্নিগ্ধতা আছে, যা সামান্য কয়েকজন সফল ধনী বৃদ্ধের চেহারায় দেখা যায়! সফিক আরো দু 'চারটা প্রশ্ন করল...

সমাজে একটা শ্রেনী আছে যাদের সহজে প্রশ্ন করা যায়, উত্তরও পাওয়া যায় সহজে। যেমন রিকশাচালক!
কি মিয়া, নাম কি? বাড়ি কই? রিকশা নিজের, নাকি ভাড়ায়? দিনে কত হয়? ইত্যাদি!
কিন্তু এই রিকশাচালক কখনই প্রশ্ন করতে পারবে না, মিয়া ভাই, কি কাম করেন? কত পান? এটাই কি শ্রেণী বৈষম্য!?

এই লোকটা সমাজের সেই শ্রেনীর হলেও তাকে সহজে সব প্রশ্ন করা যায় না। সতর্ক থাকতে হয়, কারন তার উত্তরের শানিত শ্রোত সবকিছুকে অনায়াসে চুবিয়ে ঢুবিয়ে দেয়। এদের কিছু দিতে চাইলে অনুমুতি নিতে হয়....

: আংকেল যদি কিছু মনে না করেন, তবে কিছু দিতে চাই।

এতো বিনয়ের সাথে প্রশ্ন করার পরও লোকটার মুখের চেহারা তাৎক্ষণিক পরিবর্তন হয়ে গেল। চোখের পানি টলমল করছে! দাঁতে শক্ত কামড় দিলেন, ঢোক চিপলেন, গালের চামরার উপর দিয়ে বোঝা যায় চোয়াল ফুলে উঠছে.....

: না। ভিক্ষা করি না।

আরেকমুঠ মুড়ি মুখে দিলেন। তিনি যা ভাবছেন মোটেও তা নয়.... বিষয়টি সুন্দর করে ব্যাখ্যা করবে সফিক....কিন্তু লোকটার মুখের বিরক্তি, আলো আধারের সন্ধিক্ষণে, স্নিগ্ধতার নিরবতায় তাকে প্রজ্ঞাবান করে তুলেছে। তার নিরবতাই বলে দিচ্ছে, এই ছেলে, তুমি কি বোঝাতে চাও! তোমার কি এখনো মনে হয়, এসব আমাকে বলে বোঝাতে হবে? যাও গিয়ে ষ্টাডি করো।

: আমি কিন্তু আপনার অনুমুতি চেয়েছিলাম...। তো আংকেল আসি। ভালথাকবেন।

আবার কান গরম হয়ে আসছে...পৃথিবী অন্ধকার হয়ে আসছে... তারাতাড়ি ফেরা দরকার। একটা ব্যবস্থ্যা করে ও ফিরবে কিন্তু আজকের রাতে রাজ্যের ক্লান্তি নিয়ে আর ঘুম আসবে কি না সন্দেহ....

আত্মোসমালোচনায় আত্মসুদ্ধির পথ খুজতে গিয়ে ও ভাবনায় তলিয়ে যায়। আচ্ছা রমজান মাস সংযমের মাস। তো খানাপিনায় সংযম কোথায়? ইফতারের আযান পড়লেই গোগ্রাসে গেলা শুরু করি সেহেরীর আযান পর্যন্ত অবিবেচকের মত গিলি, গিলতেই থাকি! আর একটা শ্রেনীর গিলার মত কিছুই নেই!! জেনে বুঝেও তো আমাদের গোগ্রাসে গেলার স্বভাবটা যাচ্ছে না! রমজান মাসে সকালে খেতে হয় না, দুপুরে খেতে হয় না তবুও এ মাসে পরিবার গুলোর ব্যয় বৃদ্ধি পায় কারন তাহলে কি একটাই সংযম ছাড়াই খানা? আত্মসুদ্ধি কিভাবে হয়? এ মাস শুধু উপবাস থাকার জন্য তো নয়, এটি তো সাধনার মাস, আত্মসুদ্ধির মাস, বেহুদা কাজ থেকে নিজেকে বিরত রাখার মাস। তাহলে কেমনে কি.......

বিকাল ৬:১০ মি, কাঁধে একটা ব্যাগ নিয়ে হেঁটে যাচ্ছে সফিক। আজ তার ব্রান্ড নিউ গাড়িটা নিয়ে আসে নি। যদিও গাড়ি ছাড়া বের হবার প্রশ্নই আসে না, তবুও হেঁটেই! ওর ব্যগে এখনো কয়েক পোঁটলা ইফতারি...! রাস্তায় অনেক সুবিধা বঞ্চিত মানুষ ঘোরাফেরা করে, যাকে পছন্দ হয় তাকে ও এক পোঁটলা ইফতারি দিয়ে দেয়...।

ইফতারের আযান পড়ে গেছে, বন্ধ দোকানের সামনে ভিক্ষুক মহিলা তার পাঁচ' ছ বছরের মেয়ে নিয়ে বসে আছেন। সেখনে গিয়ে আন্তরিকভাবে পাশে বসে পড়ল। ব্যাস্ততা নিয়ে ইফতারির পোঁটলা খুলছে কাগজের ঠোঙ্গার একটা ছোলা, একটাতে জিলাপি, একটাতে বেগুনী, একিটাতে পিঁয়াজি.... আশ্চার্য মুড়ি নিতে ভুলে গেছে... একটা খেজুর মুখে দিতে দিতে বলল.....

: এই, নেও নেও....নেও...খালা খান....

বাচ্চাটা একটু দেখে একটা লাল টকটকে বেগুনীর চপ তুলে নিয়ে বেশ দ্রুত খাচ্ছে.... দেখলে মায়া হয়...

: কি নাম তোমার?

কি যেন বলল, ঠিক বোঝা গেল না! এবার একটা জিলাপি নিয়েছে, কামড় দেয়ার সাথে জিলাপির রস ঝরে পড়ল জামায়। তাড়াহুড়ো করতে গলায় সামান্য আঁটকে যাওয়ার কেশে উঠল বাচ্চাটা...
মহিলা শাড়ির আঁচল দিয়ে নিজের মুখ চেপে ধরলেন, কিছুই বললেন না। ডান হাতের খেজুরটা মুখে দিলেন। মহিলার চোখ ছলছল করছে.....এখানে কারো মুখের দিকে তাঁকাতে নেই.... এখানে থাকার মানে হয় না... উঠে দ্বাড়াল সফিক....
সফিক হাঁটছে....ইফতারের এই সময়টুকুতে রাস্তায় কেউ থাকে না। গাড়িও নেই বললেই চলে, তাই নেই কোন কোলাহল। সমস্ত রাস্তা শুন্য! সফিক একা... পিঠে একটা ব্যাগ...

ধীরে রাত্রির অন্ধকার নেমে আসছে... নিয়ন আলোর চকচকে পথে আবারো নেমে আসছে কোলাহল। সফিক হাঁটছে তো হাঁটছেই....

এই সফিক দ্বাড়াও, আমাকেও সাথে নাও। আমিও তোমার সাথে যাব.....

(চলবে ও ইডিট হবে)

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.