![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
রিয়েল আবদুল্লাহ, সম্পাদক, লিটল ম্যাগ রূপান্তর ময়মনসিংহ
উপক্রমণিকাঃ
---------
মাতৃভাষা বাংলায় সাহিত্যচর্চা ও সাংবাদিকতায় আত্মনিবেদিত প্রাণ, কুসংস্কার ও গোঁড়ামীর বিরোধী সোচ্চার কন্ঠ এবং মানবতাবাদী ,পাকিস্তানের স্বৈরাচারি শাসকদের চরিত্র উন্মোচনে শক্তহাত ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে আকুণ্ঠ প্রতিবাদী সাংবাদিক আবুল কালাম শামসুদ্দীন বিশশতকের বিশের দশকে বাংলা সাংবাদিকতার ভূবনে আবির্ভাব হন সাংবাদিকতার দিকপালদের গগণের অন্যতম নক্ষত্র হয়ে। সাংবাদিকতার পাশাপাশি তিনি দু’য়েকটি গল্প-উপন্যাস অনেক লেখা লিখেছেন । তিনি ছিলেন মূলত প্রাবন্ধিক এবং সূক্ষ্মদর্শী ও নির্ভীক সাহিত্য সমালোচক সর্বপরি একজন সফল রাজনীতিবিদ।
জন্ম
---
সাংবাদিক আবুল কালাম শামসুদ্দীন ১৮৯৭ সালের ৩ নভেম্বর ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশালের ধানীখোলা গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন।
শৈশব কাল ও কৈশোরকালঃ
-----------------
আবুল কালাম শামসুদ্দিনের শৈশবকাল সম্বন্ধে তেমন কিছু জানা যায় না ।
শিক্ষাজীবনঃ
-----------------
আবুল কালাম শামসুদ্দীন ১৯১৯ সালে ঢাকা কলেজ থেকে আই.এ পাস করার পর কলকাতার রিপন কলেজে বি.এ শ্রেণীতে ভর্তি হন। কিন্তু ভারতীয় উপমহাদেশে দুইটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক আন্দোলন ১৯২০ সালে খিলাফত আন্দোলন ও ১৯২১ সালে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হলে তিনি তাতে যোগ দেন এবং বি.এ পরীক্ষা অংশ নিতে ব্যর্থ হন। পরে তিনি ১৯২১ কলকাতার গৌড়ীয় সুবর্ণ বিদ্যায়তন থেকে “উপাধি” পরীক্ষা পাস করেন।
কর্মজীবনঃ
-----------------
বর্ণাঢ্য সাংবাদিকতা আর লেখা-লেখি আবুল কালাম শামসুদ্দীনের জীবনের মূখ্য বিষয় হলেও তার জীবনকে মোটামুটি তিন ভাগে ভাগ করা যায়-
১। সাংবাদিক জীবন
২। রাজনৈতিক জীবন
৩। সাহিত্যিক জীবন
পেশা হিসাবে পত্রিকায় সাংবাদিকতা করলেও পাশাপশি সাহিত্য চর্চা এবং গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, নিবন্ধ ইত্যাদি বিষয়ে তিনি লিখেছেন অনবরত । এর পাশাপাশি তিনি ছিলেন রাজনীতিবিদ ও পাকিস্তানের পার্লামেন্টারিয়ান ছিলেন।
সাংবাদিক জীবন
-----------------
বৃটিশ আমলে ও বিভাগ পূর্বকালে ১৯২২ সালে মাসিক মোহাম্মদী পত্রিকার সহযোগী সম্পাদক হিসেবে তাঁর সাংবাদিক জীবন শুরূ হয়। এরপর তিনি একে একে সাপ্তাহিক মোসলেম জগৎ, দি মুসলমান, দৈনিক সুলতান, মাসিক মোহাম্মদী প্রভৃতি পত্রিকা সম্পাদনা করেন। ১৯৩৬ সালে দৈনিক আজাদে যোগদান করেন এবং পরবর্তিতে তিনি ১৯৪০-১৯৬২ সাল পর্যন্ত এর সম্পাদক হিসেবে যোগদান করে দায়িত্ব পালন করেন সুনিপুণভাবে। সর্বশেষ তিনি ১৯৬৪ সালে ‘প্রেস ট্রাস্ট অব পাকিস্তান’ পরিচালিত দৈনিক পাকিস্তানের সম্পাদক নিযুক্ত হয়ে সেখান থেকে তিনি ১৯৭২ সালে অবসর গ্রহণ করেন।
রাজনৈতিক জীবনঃ
-----------------
আবুল কালাম শামসুদ্দীন মূলত সাহিত্যিক-সাংবাদিক হলেও তিনি ছিলেন রাজনীতি সচেতন, স্বদেশ ও স্বজাতিপ্রেমিক এবং মাতৃভাষা বাংলার প্রতি ছিল তাঁর গভীর অনুরাগ।
প্রথম জীবনে ছাত্রাবস্থায় মহাত্মা গান্ধীর আদর্শে প্রাণিত হয়ে জাতীয় কংগ্রেসে যোগ দিয়েছিলেন। কারণ পাঞ্জাবের জালিয়ান ওয়ালাবাগ হত্যাকান্ডের ঘটনা তার মনে গভীরভাবে দাগ কাটে । তিনি রাজনৈতিক ভাবে সচেতন হয়ে উঠেন ।জাতীয় কংগ্রেসে যোগ দেন। তিনি কংগ্রেসের রাজনীতি এবং অসহযোগ ও খেলাফত আন্দোলনে অংশ নিলেও, পরবর্তীকালে ১৯২৭ সালে আবুল কালাম শামসুদ্দীন মুসলিম লীগ ও পাকিস্তান আন্দোলনের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পৃক্ত হন। ১৯৪২ সালে কলকাতায় পূর্ব-পাকিস্তান রেনেসাঁ সোসাইটি গঠিত হলে তিনি এর সভাপতি রূপে পাকিস্তান আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন।
১৯৪৬ সালে মুসলিম লীগের মনোনয়ন নিয়ে তিনি ময়মনসিংহ থেকে কেন্দ্রীয় আইন পরিষদের সদস্য (এমএলএ) নির্বাচিত হন। আবুল কালাম শামসুদ্দীন পাকিস্তান আমলে ১৯৪৮ সালে ভারত বিভাগ আন্দোলনে ব্যাপক ভুমিকা রাখেন ।
ভাষা আন্দোলনে তার ভূমিকাঃ
-----------------
আবার ১৯৫২ সালের ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলন চলাকালে তিনি সাহসী ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ভাষা আন্দোলনে তার সম্পাদিত 'দৈনিক আজাদ' পত্রিকা ইতিবাচক ভূমিকাও রাখে। দৈনিক আজাদ' পত্রিকায় বাংলা ভাষার দাবি সংক্রান্ত সম্পাদকীয় প্রকাশ করতেন নিয়মিত। আস্তে আস্তে ভাষা আন্দোলনের দাবি যখন তুঙ্গে উঠে- ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারী ছাত্র জনতার মিছিলে পুলিশের গুলিবর্ষণ করে তাতে সালাম বরকত রফিক জব্বার নামে কয়েকজন ছাত্র জনতা নিহত হন এবং এই কয়েকজনকে হত্যার প্রতিবাদে আবুল কালাম শামসুদ্দীন প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যপদে ইস্তফা দেন এবং মুসলিমলীগ সংসদীয় পার্টি হতে পদত্যাগ করেন । তিনি প্রচণ্ড পরিমাণে আইয়ুব খানের বিরোধী একজন ছিলেন।
তৎকালীন গভর্ণরের কাছে পাঠানো পদত্যাগ পত্রে তিনি লিখেছেনঃ “বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবী করায় ছাত্রদের উপর পুলিশ যে বর্বরতার পরিচয় দিয়েছে তাহার প্রতিবাদে আমি পরিষদের আমার সদস্যপদ হইতে পদত্যাগ করিতেছি। যে নুরুল আমীন সরকারের আমিও একজন সমর্থক-এ ব্যাপারে তাহাদের ভূমিকা এতদূর লজ্জাজনক যে, ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকিতে এবং পরিষদের সদস্য হিসাবে বহাল থাকিতে আমি লজ্জাবোধ করিতেছি।”
এর জন্য আজাদ সম্পাদক জনাব আবুল কালাম শামসুদ্দিন অভিনন্দিত হন। ব্যবস্থা পরিষদের সদস্য পদে এস্তেফা দেওয়ায় আজাদ সম্পাদক জনাব আবুল কালাম শামসুদ্দিনকে অভিন্দন জানিয়ে আগা মসিহ লেনের জনাব কাজী হেদায়েত উদ্দিন তার কাছে একটি পত্র লিখেন-‘‘এই বর্তমান সন্ধিক্ষণে আপনি পূর্ব বঙ্গ ব্যবস্থা পরিষদের সদস্যপদ ত্যাগ করিয়া যে মমত্তবোধ ও কর্তব্যজ্ঞাণের পরিচয় দিয়াছেন তা বাস্তবিকই অতুলনীয় । আপনার এই সাহসিকতাপূর্ণ কাজের জন্য উপযুক্ত শোকর-গোজারী করার ভাষা আমার নাই। খোদার কাছে প্রার্থনা তিনি যেন আপনাকে সুস্থ্য শরীরে দীর্ঘ্যজীবি করেন এবং জনগনের সংকটের দিনে তাহাদের পশ্চাদে দাড়াইবার তওফিক দেন।’’
১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারি ও ২২ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান পুলিশের ভয়ংকর হত্যাযজ্ঞের পর ২২ ফেব্রুয়ারী ১৯৫২ সনে ভাষা আন্দোলনকালীন দৈনিক আজাদের “তদন্ত চাই” শিরোনামের সম্পাদকীয়তে লিখেন-“ গতকল্য ঢাকার বুকে বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিক্যাল কলেজের নিকটে যে শোচনীয় দুর্ঘটনা ঘটিয়াছে তাহা যেমন মর্মভেদী,তেমনি অবাঞ্ছিত । আইন অমান্য নিয়ম ভঙ্গ । উচ্ছৃংখলতা সমর্থন যোগ্য নহে।কিন্ত এই সঙে একথাও সত্য যে আইন অমান্য হওয়ার মতো ক্ষেত্র সৃষ্টি করাও কোন গণতান্ত্রিক সরকারের উচিত নয় ।’’
আবার ২৩ ফেব্রুয়ারী “ভুলের মাশুল” শিরোনামে লিখেন, ‘‘সে যাই হোক বর্তমান মন্ত্রীসভার বিচার দেশের জনসাধারনই করিবে।কিন্তু আজ তাহারা যে জটিল পরিস্থিতি সৃষ্টি করিয়াছেন ,তার সমাধান তাদেরই করিতে হইবে।এখন তাদেরই ভুলে যে অবাঞ্ছিত পরিস্থিতির উদ্ভব হইয়াছে ,উহাদের সমাধানের জন্যই তাদেরই অগ্রসর হওয়া কর্তব্য। এটা তাদের ভুলেরই মাসুল এবং তা দেওয়া হইবে যদি তারা অহেতুক প্রেস্টিজ ত্যাগ করিয়া অনতিবিলম্বে ১৪৪ ধারা প্রত্যাহার করেন এবং উচ্চ পর্যায়ের নিরপেক্ষ ও জনসাধারণের আস্থাভাজন তদন্ত কমিটি নিয়োগ করেন।শান্তি শৃঙ্খলা রক্ষাকল্পে এবং দেশের কল্যাণের জন্য এ ছাড়া অন্য কোন পথ আছে বলিয়া মনে করি না ।
১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারি ও ২২ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান পুলিশের ভয়ংকর হত্যাযজ্ঞের পর ২৩ ফেব্রুয়ারী গভীর রাতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ ব্যারাক হোস্টেলের ১২ নং গেইটের সামনে কলেজের সম্মিলিত ছাত্রদের পরিশ্রমে নির্মিত হয় প্রথম শহীদস্মৃতিস্তম্ব । যার উচ্চতা ১০ ফুট এবং চওড়া ৬ ফুট ২৪ ফেব্রুয়ারী তা সদ্য ভাষাশহীদ শফিউরের বাবা অনানুষ্ঠানিক ভাবে ঐ শহিদ স্তম্বের উদ্বোধন করেন ।
এরপর ২৬ ফেব্রুয়ারী ১৯৫২ রোজ মঙ্গলবার ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ প্রাঙনে স্থাপিত প্রথম শহীদ মিনার তথা স্মৃতিস্তম্ভ আবুল কালাম শামসুদ্দিন নিজে আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেন।অবশ্য পরে পুলিশ তা ভেঙ্গে দেয়।
সাহিত্য চর্চাঃ
-----------------
১৯৪৩ সালে ঢাকা মুসলিম হল মিলনায়াতনে পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সংসদের প্রথম বার্ষিক অধিবেশনে পঠিত সভাপতির অভিভাষনে সাহিত্যের দিক নিরদেশনা দিয়ে নানা কথা প্রসঙ্গে তিনি প্রথমেই বলেন-বাংলা ভাষার বানান ও বর্ণমালা সম্পর্কেও মুসলমান সাহিত্যিকদের চিন্তা করার অবকাশ আছে বলে আমরা মনে করি।যে সব আরবি-ফারসী শব্দ ইতিমধ্যেই বাংলা ভাষায় অংগীভূত হয়ে গেছে এবং পরেও যেসব শব্দের বাংলা ভাষায় প্রয়োগ অবশ্যম্ভাবী,তাদের সুষ্ঠু বানান সম্পর্কে মুসলমান সাহিত্যিকদের দায়িত্ব অনেকখানি।বানান বিভ্রাট ইতিমধ্যেই দেখা দিয়েছে।’’
তিনি আরও বলেন-‘‘বাংলা সাহিত্যে মুসলমানদের দেবার এত কিছু আছে যে ,তার ফলে সাহিত্যের সম্পদ ও সৌন্দর্য বহুগুনে বেরে যেতে পারে।আত্মশক্তি সম্বন্ধেও এতদিন সচেতন ছিলোনা বলেই মুসলমান সাহিত্যিকদের দানে বাংলা সাহিত্য সমৃদ্ধ হতে পারেনি। ......কিন্তু মুসলমান সাহিত্যিক আজ সচেতন এই জন্যই সাহিত্যে রেঁনেসার বাণী কণ্ঠে নিয়ে পূর্ব-পাকিস্তান সাহিত্য সংসদের আত্ম-প্রকাশ।মুসলমানের দানে বাংলা সাহিত্যে রেঁনেসা আসবেই-নবসৃষ্টিতে বাংলা সাহিত্য অপরূপ নবকলেবর লাভ যে করবেই,সে সম্পর্কে বিন্দুমাত্র সংসয় নেই।’’(পাকিস্তান আন্দোলন ও মুসলিম সাহিত্য-সম্পাদক,সরদার ফজলুল করিম,অধ্যক্ষ,সংস্কৃতি বিভাগ,বাংলা একাডেমি,১৯৬৮ সন)।
এই ছিল তার স্বপ্ন যা আজ বাস্তবে পরিণত হয়েছে।
অর্ধ-শতাব্দীরও অধিককালের সাংবাদিক ও সাহিত্যজীবনে তিনি সাহিত্য সংস্কৃতি বিষয়ে বহুসংখ্যক প্রবন্ধ রচনা করেছেন। তাঁর ‘কাব্য সাহিত্যে বাঙালি মুসলমান’, ‘মহাশ্মশান কাব্য’, ‘সাহিত্যে সাম্প্রদায়িকতা’, ‘আমাদের সাহিত্য’, ‘বাংলা ভাষায় নয়া শব্দ’, ‘সাহিত্য গুরুর বাঙালি প্রীতি’ এবং ব্যঙ্গ্ রচনা ‘একটি জনসভার রিপোর্ট’ সময়কালীন সময়ে ব্যাপক সাড়া জাগায়। ছাত্রজীবনে আবুল কালাম শামসুদ্দীন বিদেশী সাহিত্যের-বিশেষত ইংরেজি ও রুশ সাহিত্যের অনুরাগী পাঠক ছিলেন। সাহিত্যিক-সাংবাদিক আবুল কালাম শামসুদ্দীনের সাহিত্য-চিন্তা ও দৃষ্টিকোণের পরিচয় তাঁর বিভিন্ন রচনায় স্বাক্ষরিত।এইসব অসাধারণ রচনা সমূহ এখনো পাঠকমনে বিপুল সারা জাগায়।যা এখন কালের পরিক্রমায় গবেষনার বস্তুতে পরিণত হয়েছে।
সাহিত্য ইতিহাস লেখকঃ
-----------------
আবুল কালাম শামসুদ্দীন ছিলেন বাংলা সাহিত্যের অঙ্গনে সাহিত্য ইতিহাস লেখক। তিনি সাংবাদিকতার পাশাপাশি সাহিত্যের নানা বিষয় নিয়ে ইতিহাস রচনা করেন। “দৃষ্টিকোণ” তার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ । সামান্য দুটি ঊদাহরণ তুলে ধরা হলো-
‘‘বাঙালি মুসলমান কর্তৃক সংবাদপত্র প্রকাশের সত্যকার চেষ্টা হয় সম্ভবতঃ ১৮৮৯ খৃস্টাব্দে। তখন কয়েকজন উদ্যমশীল মুসলমান সাহিত্যিকের আবির্ভাবহয়-যাদের সমাজ- হিতৈষণা মুসলিম বাংলার ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। এই সমাজপ্রাণ ও সাহিত্যিকগোষ্ঠী হচ্ছেনঃ মুন্সী মোহাম্মদ রিয়াজউদ্দীন আহমদ, পন্ডিত রেয়াজউদ্দীন মাশহাদী, মৌলভী মেরাজুদ্দীন, মুন্সী মোহাম্মদমেহেরুল্লাহ, মীর্জা মোহাম্মদ ইউসুফ আলী, শেখ আবদুর রহীম এবং শান্তিপুরের কবি মোজাম্মেল হক। .. এদেরই চেষ্টায় ‘সুধাকর' প্রকাশিত হয়। মুন্সী মোহাম্মদ রিয়াজউদ্দীন আহমদ এই সাপ্তাহিক পত্রের সম্পাদক পদে বরিত হন। [দৃষ্টিকোণ-পৃ-১৬৯-আবুল কালাম শামসুদ্দীন]
মিহির ও সুধাকর- মীর মোশাররফ হোসেনের সমসাময়িককালে শেখ আবদুর রহীমের সম্পাদনায় ‘মিহির’ নামের একখানা মাসিক পত্রিকা প্রকাশিত হয়। পরবর্তীতে মিহির ও সুধাকর এই উভয় পত্রিকা যুক্ত হয়ে নতুন সাপ্তাহিক ‘মিহির ও সুধাকর' জন্ম লাভ করে। ‘‘মিহির ও সুধাকরই সম্ভবতঃ মুসলিম বাঙলার প্রথম সাপ্তাহিক সংবাদপত্র যার দীর্ঘস্থায়িত্ব সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। ‘মিহির ও সুধাকর' ১৮৯৪সাল থেকে ১৯১০ সাল পর্যন্ত চলেছিল।’’ [দৃষ্টিকোণ-পৃ-১৬৯, আবুল কালামশামসুদ্দীন]।
নজরুল সমালোচকঃ
-----------------
সাহিত্যিক ও সাংবাদিক জীবনের সূচনাতেই তিনি একজন সাহিত্য রসবোদ্ধা ও গভীর অন্তর্দৃষ্টি সম্পন্ন সাহিত্য সমালোচক হিসেবে খ্যাতি ও প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। মুসলিম বাংলা সাহিত্যের নব-মূল্যায়নে বিশেষ করে নজরুল কাব্যের মূল্যায়নে তাঁর ভূমিকা ও অবদান সেকালেই স্বীকৃতি লাভ করে। এ প্রসঙ্গে ১৩৩৩ সালের দ্বিবার্ষিক সংখ্যা ‘সওগাত’ পত্রিকায় বলা হয়ঃ ‘‘তিনি (আবুল কালাম শামসুদ্দীন) এই তরুণ বয়সেই বাংলার মুসলমান সাহিত্যিক সমাজে অদ্বিতীয় কাব্যরসগ্রাহী প্রতিভাশালী সমালোচকের স্থান দখল করিয়াছেন। ‘সাহিত্য’, ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা’, ‘সওগাত’, ‘প্রতিভা’ প্রভৃতি সাময়িকপত্রে তাঁর বহু প্রবন্ধ প্রকাশিত হইয়াছে।....ফলত সমালোচক হিসেবে উত্তরকালে তিনি বাংলা সাহিত্যে যে বিশিষ্ট স্থান অধিকার করিবেন কইতেই তাহার পরিচয় পাওয়া যাইতেছে।” উল্লেখযোগ্য যে, আবুল কালাম শামসুদ্দিন বিশ শতকের বিশের দশকে অর্থাৎ ১৯২৭ সালেই নজরুল- কাব্যের আলোচনা প্রসঙ্গে বিদ্রোহী কবিকে বাংলার জাতীয় কবি এবং মাইকেল মধুসূদন দত্ত ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পর বাংলা সাহিত্যের তৃতীয় যুগস্রষ্টা কবিরূপে আখ্যায়িত করেন। নজরুল যে ভবিষ্যতে তাঁর প্রাপ্যসাহিত্য-সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হবেন সেই ভবিষ্যতবাণীও করেন। [‘কাব্য সাহিত্যে বাঙালি মুসলমান’ সওগাত, ১৩৩৩-৩৪]–তাঁর এই অগ্রিম চিন্তাও আজ সুপ্রতিষ্ঠিত । কবি কাজী নজরুল এখন বাংলা সাহিত্যাঙ্গনে উজ্জ্বল নক্ষত্র।
প্রকাশিত গ্রন্থঃ
-----------------
আবুল কালাম শামসুদ্দীন রচিত ও অনূদিত কয়েকটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হলোঃ রুশ-ঔপন্যাসিক তুর্গেনিভের ‘ভার্জিন সয়েল’-এর অনুবাদ গ্রন্থ প্রকাশ করেন দু’দফায়। প্রথমে ‘পোড়োজমি’ এবং পরবর্তিকালে ১৯৩৮ সালে ‘অনাবাদী জমি’ নামে।
ত্রিস্রোতা- (১৯৩৯),খরতরঙ্গ-(১৯৫৩),দৃষ্টিকোণ-(১৯৬১),নতুন চীন নতুন দেশ(১৯৬৫),দিগ্বিজয়ী তাইমুর-(১৯৬৫)ইলিয়ড-(১৯৬৭),পলাশী থেকে পাকিস্তান-(১৯৬৮)অতীত দিনের স্মৃতি-(১৯৬৮) ইত্যাদি।
এছাড়া বাংলা আত্মজীবনী হিসেবে ‘অতীত জীবনের স্মৃতি’ তাঁর উৎকৃষ্ট রচনা । দেশ, সমাজ ও সংস্কৃতি সম্পর্কে তাঁর এ গ্রন্থ প্রত্যক্ষদর্শীর দলিল হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে।বাংলা একাডেমী কর্তৃক তিনখন্ডে প্রকাশিত হয়েছে আবুল কালাম শামসুদ্দীনের ‘রচনাবলী’।
সম্মাননা ও প্রদকঃ
-----------------
আবুল কালাম শামসুদ্দীন বিভিন্ন সময়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বিভিন্ন সম্মাননা ও প্রদক প্রাপ্ত হয়েছেন। তিনি তৎকালিন পাকিস্তান সরকার কর্তৃক ১৯৬১ সালে সিতারা-ই-খিদমত এবং ১৯৬৭ সালে সিতারা-ই-ইমতিয়াজ উপাধিতে ভূষিত হন। কিন্তু ১৯৬৯ সালে গণঅভ্যুথানের সময় ‘দৈনিক পাকিস্তান’-এর সম্পাদক থাকা সত্ত্বেও স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ এবং গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সমর্থনে তিনি সরকার প্রদত্ত এ দু’টি খেতাব বর্জন করেন। ১৯৭০ সালে তিনি বাংলা একাডেমী পুরস্কার লাভ করেন এবং ১৯৭৬ সালে একুশে পদক প্রাপ্ত হন ।
মৃত্যুঃ
-----------------
১৯৭৮ সালের ৪ মার্চ ঢাকায় বাংলা সাংবাদিকতা জগতের এই দিকপালের মৃত্যু হয়।
শেষঃ
-----------------
ভাষার প্রতি গভীর মমত্ত্ববোধ আমাদেরকে আজও মোহিত করে । এমন একজন মহৎ ব্যক্তির এ বছরই পূর্ণ হবে ১২০ বছর । তার প্রতি আমাদের রইলো গভীর শ্রদ্ধা । আফসোস তার জন্য আমরা অত্র ময়মনসিংহের ত্রিশালে আজোও কিছু করতে পারিনি । যার সাহিত্যের প্রতি আছে এতো ভালোবাসা, এত মমতা তার থেকে অনেক কিছু শেখার আছে । তার জীবন আমাদের এই শিক্ষাই দেয় যে মাতৃভাষার কাছে সব কিছুই তুচ্ছ । এর জন্য মন্ত্রীত্বও ছাড়া যায় । বীর শহীদানের মত জীবনও দেয়া যায় । উপমহাদেশের একজন প্রখ্যাত সাহিত্যিক-সাংবাদিক হওয়া সত্ত্বেও আবুল কালাম শামসুদ্দীন অহমিকাবোধে কখনো আচ্ছন্ন হননি, অত্যন্ত সরল ও সাদাসিধা জীবন যাপন করেছেন, যশ ও খ্যাতির পেছনে কিংবা বিত্ত বৈভব গড়ে তোলার লক্ষ্যে কখনো প্রচেষ্টা চালাননি।খুব নিভৃতচারীর মতো কেবলি সাহিত্যে সংষ্কৃতিতে সামাজিক বিষয়গুলোতে অবদান রেখে গেছেন।
আমাদের শিক্ষার তাগিদে বোধের খুব কাছ থেকে দেখার জন্য কবি সাহিত্যিক সাংবাদিক আবুল কালাম শামসুদ্দিনের কোন বিকল্প নেই ।তার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ।
তথ্যসূত্র
-----------------
১। রেখাচিত্র যাঁদের হারিয়ে খুঁজি- মোহাম্মদ মাহ্ফুজউল্লাহ
২। পাকিস্তান আন্দোলন ও মুসলিম সাহিত্য-সম্পাদক,সরদার ফজলুল করিম,অধ্যক্ষ,সংস্কৃতি
বিভাগ, বাংলা একাডেমি,১৯৬৮ সন)
৩। আবুল কালাম শামসুদ্দীনের কয়েকটি বই
৪। দৃষ্টিকোণ ।
৪। বাংলাপিডিয়া
৫। উইকিপিডিয়া
৬। পুরাতন দৈনিক আজাদ পত্রিকা,ইত্তেফাক প্রভৃতি পত্রিকার কলাম।
৭। অনলাইনে পাওয়া প্রবন্ধ
©somewhere in net ltd.