নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

বাংলাদেশ আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা...

বাংলাদেশ আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা...

রেজা ঘটক

ছোটগল্প লিখি। গান শুনি। মুভি দেখি। ঘুরে বেড়াই। আর সময় পেলে সিলেকটিভ বই পড়ি।

রেজা ঘটক › বিস্তারিত পোস্টঃ

কিভাবে পালাকার নাট্যদল গঠিত হল: কিছু সত্য কথন। পর্ব সাত। রেজা ঘটক

০৩ রা জুন, ২০১৩ রাত ৯:০৭

২০০৯ সালের জুলাই মাসে আমাকে পান্থপথের বাসা ছেড়ে দিতে হল। আমাদের পরিকল্পনা ছিল কাজী ফয়সাল, ইকতারুল ইসলাম আর আমি আগস্ট মাসে একত্রে নতুন বাসায় উঠবো। সে অনুযায়ী আমরা তিন জন মিলে ব্যাচেলর বাসা খুঁজতে লাগলাম। টোকন ঠাকুরের নাটকে তখন আমাদের সঙ্গে কাজ করতো হাবিব সরকার। হাবিব বললো, রেজা ভাই আমার ফ্লাটের দোতলায় রুম খালি আছে, ব্যাচেলর দেবে আপনি এক রুম নিয়ে নেন। হাতিরপুলের সেই বাসার তিন তলায় হাবিব থাকে। হাবিবের মাধ্যমে রুম দেখে পছন্দ হল। হাবিবকে বললাম, ১৫ তারিখ অ্যাডভান্স ভাড়া দেব। বাড়িওয়ালাকে বলে তুমি আমাদের জন্য রুমটা রাখার ব্যবস্থা করো। হাবিব বললো, ঠিক আছে ওস্তাদ। আপনারে কাছে পাইতাছি, যা কন সব হবে। আপনি উঠবেন কিনা সেইটা নিয়াই আমি টেনশান করতাছি। হাবিবকে বললাম, সত্যি সত্যিই আমি বাসা ছেড়ে দিয়েছি আর তোমার ওখানে উঠবো। তিন চার দিন পর, ফয়সালের পরামর্শে আবার একটু রুমটা দেখার জন্য হাবিবকে ফোন করলাম। ওই সময় রাজীব নূর কিছু বকেয়া টাকা দিয়েছিল, ইচ্ছে সেদিনই অ্যাডভান্স করে দেবো। হাবিব ফোন রিসিপ করে বললো, ওস্তাদ, আপনারে তো একটা কথা বলতে ভুলে গেছি। ওই রুমে তো পানির কলে লাইন নাই। আপনাকে উপরে আমার বাথরুম ব্যবহার করতে হবে অথবা নিচে দারোয়ানের বাথরুম। তারপরেও আমি আর ফয়সাল আবার রুমটা দেখলাম। পানির কল আছে মাগার বাট লাইনে পানি নাই। বাড়িওয়ালার কোনো একটা ঝামেলা আছে বটে! শেষ পর্যন্ত হাবিব সরকারের ওখানে আর আমাদের ওঠা হল না।

পরদিন ইকতার ফোন করে জানালো, দাদা, পালাকারের উপরে এক রুম খালি হবে। ভাড়া একটু বেশি চায়। আমি বললাম, তুই এখনই ওই রুম বুকিং দে। আর সময় নাই রুম খোঁজার। তাছাড়া নিচেই পালাকারের কার্যালয়। মগবাজার গাবতলার পালাকারের ওই কার্যালয়ের উপরে ব্যাচেলররা থাকে। কিন্তু যে রুমটি ভাড়া হবে তার জীর্ণ করুণ দশা। অন্য পাশ দিয়ে দোতলা ওঠার একটা সিড়ি ছিল। সেই সিড়ি ঘরে বিশেষ কায়দায় কাঠের পাটাতন দিয়ে ছোট্ট ওই রুম বানানো হয়েছে। দরজা খুলে আগে সবাই ওই পথে নামতো। এখন সেখানে একটি থাকার রুম। ফ্লোর আবার পূর্ব পশ্চিম অ্যাঙ্গেল করা। পশ্চিম পাশ পূর্ব পাশের চেয়ে ফুট খানেক উঁচু। সহজে সূর্যোদয় দেখার বিশেষ সুবিধা। বাটে পরে সেই রুমেই উঠলাম। ফয়সাল শাহজাহানপুরের আগের মেসেই থেকে গেল। ইকতার তখন পালাকারের কার্যালয়ের রিহার্সাল রুমেই থাকতো।

১ লা সেপ্টেম্বর ২০০৯ আমি তল্পি-তল্পাসহ সেই সিড়ি ঘরেই উঠলাম। আমার সম্বল বলতে বেশ কিছু বই। একটা জাজিম। আর একটা বুক সেলফ। শুধু জাজিমটা সেই সিড়ি ঘরে তুললাম। বইপত্র সব পালাকারে রাখলাম। সেপ্টেম্বর-অক্টোবর-নভেম্বর তিন মাস আমি সম্পূর্ণ বেকার। তিন মাস ওই সিড়ি ঘর আমার আবাস। রাজীব নূরের সঙ্গে অভিমান করে চলে এসেছি। টোকন ঠাকুরের ২৬ পর্বের ধারাবাহিক নাটক 'ফুলগুলি-ভুলগুলি' সুটিং করতে ঝিনাইদহে গিয়েছিলাম এপ্রিল মাসে। তখন থেকেই রাজীব নূরের সঙ্গে সম্পর্কের ফাঁটলের শুরু। ঠাকুরের নাটকটিও টেলিভিশন চ্যানেল থেকে অর্ধেক টাকা দেওয়ার পর আর টাকা দিল না। আমরা তিনটি সিঙ্গেল নাটকও একই সাথে করব। তাই সুটিং সিডিইল সেভাবে পরিকল্পনা করেছিলাম। চ্যানেল থেকে আমরা টাকা পেয়েছিলাম ছয় পর্বের। আমরা কাজের সুবিধার জন্য ধার করে মোট ১১ পর্বের সুটিং শেষ করে ঢাকায় ফিরলাম মে মাসে। রাজীব নূরের সঙ্গে আমার ধীরে ধীরে সম্পর্কে একটা ফাঁটল থেকেই গেলো। আমি যোগসূত্র ছেড়ে দিলাম। পাঠসূত্র ছেড়ে দিলাম। যোগসূত্র-পাঠসূত্রের মালিক রাজীব নূরকেও ছেড়ে দিলাম। কিন্তু রাজীব নূরের সঙ্গে শুধু বন্ধুত্বটা ধরে রাখলাম। জুন মাস থেকে রাজীব নূর আমাকে দিয়ে কন্ট্রাকে কাজ করান। কোনো নতুন প্রজেক্ট প্র্রপোজাল আমাকে দিয়ে লেখাতে হলে নগদ ৫ হাজার টাকা দিতে হবে। নইলে নাই। আর টেকনিক্যাল রিপোর্টের জন্য ১০,০০০ টাকা। রাজীব নূর দর কষাকষিতে ওস্তাদ। আমার ট্রিটমেন্টও ভালো করেই জানেন। শেষ পর্যন্ত পিপি'র জন্য পাঁচ আর টিআরের জন্য সাড়ে সাত দিবে এমুন নতুন দরদাম ফয়সালা হল।

একটু আগের কথা বলে রাখি, আমার বন্ধু রিয়াজ (খালাতো ভাই) জানুয়ারি মাস থেকে তখন বেকার। অটবি ছাড়ার পর প্রত্যেক মাসে রিয়াজ চাকরি অনেকগুলো বদল করলো। কোথাও ধাতু হচ্ছে না। রিয়াজের বউ তখন অন্তঃসত্ত্বা। চট্টগ্রামে শ্বাশুড়ির কাছে থাকে। রামপুরায় বন্ধু জায়েদের (জায়েদউদ্দিন) বাসার সামনে দুই রুমের ছোট্ট ফ্ল্যাটে রিয়াজ থাকতো তখন। বেকারত্বের কষাঘাতে কয়েক মাসের বাড়ি ভাড়া রিয়াজের তখন বকেয়া পরলো। রিয়াজ গা ঢাকা দিতে প্রায়ই তখন পান্থপথে আমার সঙ্গে থাকতো। আমি খাই রাজীব নূরের অফিসে। রিয়াজ আসলে রাজীব নূর আর আমার খাবার তিন জনে ভাগ করে খাই তখন। রিয়াজও সেই সুযোগে রাজীব নূরের হাতের কাজ এটা ওটা লেখার কাজ ফ্রি করে দেয়। আমি রাজীব নূরের অফিসে কাজ করার কারণে আমাদের প্রধান আড্ডার কারখানা তখন রাজীব নূরের পান্থপথের অফিস। সন্ধ্যায় অন্য বন্ধুদের অফিস ছুটির পর একে একে সেখানে আসে বন্ধুরা। তারা হল জাফর আহমদ রাশেদ, সত্যজিৎ পোদ্দার বিপু, মোবাশ্বির আলম মজুমদার, এসআই হুমায়ূন কবির, টোকন ঠাকুর (মাঝে মাঝে), নাসরুল্লাহ মোহাম্মদ নাহিদ, পুলক বিশ্বাস, শাহিনুর রহমান-ডাক্তার কল্লোল চৌধুরী-গোলাম রসুল ত্রিরত্ন (মাঝে মাঝে), আহসান কবির সহ অনেকে। আসে ছোটদের একটা বিশাল গ্রুপ ইফতেখার লেনিন, মোকাররম হোসেন শুভ, তন্ময় ইমরান জনি, ইমন অঞ্জন, ও ওদের বন্ধুরা। যোগসূত্রে অফিস আওয়ার শেষ হলে শুরু হয় আড্ডা আওয়ার অফিস।

সেপ্টেম্বর মাসে হুট করে মগবাজার বাসা নিয়ে চলে আসলেও সারাদিন থাকি পান্থপথে রাজীব নূরের অফিসে। কনট্রাক কাজ করি। কাজ না থাকলে আড্ডা মারি। ওই সময় অটবি থেকে রিয়াজ চাকরির সুবাদে কিছু বকেয়া টাকা এককালীন ফেরত পেল। তা দিয়ে রামপুরার বাড়িওয়ালার ভাড়া মিটিয়ে বাসা ছেড়ে দিল। জিনিসপত্র সব উত্তরায় নিজেদের বাসায় রিয়াজের ছোট ভাই সুজনকে দিয়ে ট্রাক ভাড়া করে পাঠিয়ে দিয়ে কিছু জামাকাপড় নিয়ে রিয়াজ চলে আসল আমার কাছে। আমি ততোদিনে বেকারত্বের কারণে দোতলার সিড়ি রুম ছেড়ে দিয়ে নিচে পালাকারের রিহার্সাল রুমে রাত কাটাই। মুকুলের সঙ্গে কথা বলেই আমি পালাকারে তখন আশ্রয় নিয়েছিলাম। আমি আর ইকতার রিহার্সাল রুমে ঘুমাই। রিয়াজ এসে আমাদের সঙ্গে জুটলো। এবার আমরা তিন জন। ততোদিনে ইকতার বাড়ির ঝামেলা মিটিয়ে পরিবারের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক পুনঃস্থাপন করেছে। ইকতার ওর আপার বাসায় চলে গেল। রিয়াজ আর আমি পালাকারে থাকা শুরু করলাম। মাঝে মধ্যে কাজের সুবিধার জন্যে অজয় আর ফয়সালও আমাদের সঙ্গে রাত কাটায়।

মূলত ডিসেম্বর ২০০৯ সাল থেকে আমি পুরোপুরি পালাকারের রিহার্সাল রুমের রাতের বাসিন্দা। আমার সঙ্গে রিয়াজ এক/দুই/তিন দিন আসার পর থাকার পর থেকেই রিয়াজও গ্রুপে নিয়মিত থাকা শুরু করলো। আর রিয়াজের রামপুরার বাসা ছেড়ে দিয়ে তো রীতিমত পাকাপাকিভাবেই পালাকারে থাকা শুরু করলো। ওই সময় পালাকারের নতুন প্রযোজনা 'বাংলার মাটি বাংলার জল'-এর কাজু শুরু হল। রচনা সৈয়দ শামসুল হক আর নির্দেশনা আতাউর রহমান। আমি পালাকারে অবস্থান করায় বাংলার মাটির মিডিয়া ও প্রেসের দায়িত্ব আমার উপর পরলো। আমরা 'বাংলার মাটি বাংলার জল' নিয়ে সবাই খুব ব্যস্ত। ওই সময় ২৭ মার্চ ২০১০ সালে গুলাশানের একটি মিউজিক স্কুলে এক ভায়োলিন সন্ধ্যায় গান শুনতে গেলাম আমি আর মিজান। সেখানে পরিচয় হল মায়া লোহানীর সঙ্গে। সেই পরিচয় থেকেই আমাদের প্রথমে প্রেম পরে একসঙ্গে বসবাস এবং প্রণয়। মায়া'র বাড়ি বসনিয়ায় ও হারজেগোভিনায়। মায়া'র মা বসনিয়ান আর বাবা নেপালি। ওর তখনকার স্বামীও একজন বাংলাদেশী। মায়ার এক মেয়ে ও এক ছেলে। থাকে উত্তরায়। 'বাংলার মাটি বাংলার জলে'র সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আমাদের প্রেমও আগাতে লাগলো। ২০১০ সালের জুন মাসের ১ তারিখ আমরা (মায়া আর আমি) বনানী নতুন বাসা নিলাম। আমার পালাকারে অবস্থান পর্বের ইতি ঘটলো এভাবে ২০১০ সালের মে মাসের ৩১ তারিখ।



১৪ এপ্রিল ২০১০ সালের ১লা বৈশাখে শিল্পকলা একাডেমীতে পালাকারের নতুন সিইও-র দায়িত্ব পেল শামীম সাগর। তখন 'ডাকঘর', 'মৃত্তিকাকুমারী', 'তিনকন্যা' আর 'বাংলার মাটি বাংলার জল'-এর মিডিয়া ও প্রেসের কাজের পাশাপাশি কয়েকটিতে অজয়কে মিউজিক টিমে রিদমে আমি হালকা পাতলা সাপোর্ট দিতাম। আমি মায়া'র সঙ্গে বনানী চলে যাওয়ায় পরেও পালাকারের সকল কর্মকান্ডে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলাম। শিল্পকলায় শো থাকলে বা গ্রুপে মিটিং থাকলে বা রিহার্সাল থাকলে আমি নিয়মিত উপস্থিত থাকতাম।

মায়া'র ছেলেমেয়েরা ভারতে পড়াশুনা করে। বছরে ৩/৪ বার তারা বাংলাদেশে আসে। বাংলাদেশে অবস্থানকালীন তারা বাবা-মার কাছে সমান ভাগ হয়ে থাকে। বাবার কাছে কয়েকদিন, মা'র কাছে কয়েকদিন। আমার কথা জানলেও তারা যখন প্রথম প্রথম আমাদের বনানীর বাসায় আসতো, আমি তখন সেই কয়েকটা দিন বাইরে থাকতাম। কারণ, বাচ্চাদের সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর একটা পর্ব তখন। মায়া ধীরে ধীরে বাচ্চাদের ম্যানেজ করতে থাকলো। তাই বাচ্চারা আসলে আমি তখন কখনো পালাকারের গ্রুপে রিয়াজের সঙ্গে, কখনো বা টোকন ঠাকুরের বাসায় ওই কটা দিন থাকি। আমি বনানী চলে আসায় গ্রুপে মূলত জুন ২০১০ সাল থেকে রিয়াজ একাই রাতের বাসিন্দা। রিয়াজ আবার রাতে পালাকারে না ফিরলে পান্থপথে সত্যজিৎ পোদ্দার বিপু'র বাসায় থাকতো। আমরা বনানী চলে আসার পর ছেলেমেয়েরা প্রথম আসলো ২০১০ সালের জুন মাসেই। তখন আমি গ্রুপে এক সপ্তাহ রিয়াজের সঙ্গে আর ঠাকুরের সঙ্গে থাকলাম। দ্বিতীয় বার ছেলেমেয়েরা বাংলাদেশে আসলো ২০১০ সালের অক্টোবর মাসে। তখনো প্রায় এক সপ্তাহ গ্রুপে রিয়াজের সঙ্গে আর ঠাকুরের সঙ্গে থাকলাম। তৃতীয়বার ছেলেমেয়েরা আসলো ২০১০ সালের ডিসেম্বর মাসে। তখনো আমি গ্রুপে রিয়াজের সঙ্গে থাকার জন্য গেলাম।

সেদিন ছিল ১৬ ডিসেম্বর। রিয়াজকে ফোন দিলাম। রিয়াজ বললো, বেইলি রোডে আছি। সঙ্গে মুকুলও আছে। আমি ছবিরহাট থেকে ফোন করেছিলাম। রিয়াজ বললো, তুমি বেইলি রোডে চলে আসো। জবাবে বললাম, রাতে তোমার সঙ্গে গ্রুপে থাকবো। তুমি আর মুকুল বরং ছবিরহাটের দিকে আসো। ওরা জানালো আসতেছি। কিন্তু ওরা কেউ আসলো না। আমি রাত এগারোটার দিকে পালাকারে গেলাম।

রিয়াজ জানালো চট্টগ্রাম যাবে এই সপ্তাহে। ট্রেনের টিকেটও সংগ্রহ করতে হবে। রিয়াজের বউ ছেলে তখন চট্টগ্রামে। তখন প্রায় প্রতি সপ্তাহে রিয়াজ চট্টগ্রাম যায়। রাতে আমরা বাইরে খেয়ে অনেক রাত পর্যন্ত আড্ডা দিলাম। পারস্পরিক আপডেটমূলক আড্ডা। রিয়াজ তখন বিজয়নগর নতুন একটা অফিসে জয়েন করেছিল। বলছিল যে এলিট পেইন্টে ইন্টারভিউ দিছে। ওখানে হয়ে গেলে চলতি চাকরিটাও ছেড়ে দেবে। সকালে আমরা ঘুম থেকে উঠে নাস্তা খেয়ে প্রথমে ফকিরাপুল তারপর কমলাপুর গেলাম। রিয়াজ ১৮ বা ১৯ বা ২০ বা ২১ তারিখের একটি টিকেট নিল। তারিখটা ঠিক মনে নেই। তারপর আমরা রিয়াজের একটা বইয়ের সন্ধানে নীলক্ষেত গেলাম। সেখানে বই কিনলাম ও লাঞ্চ করলাম। তারপর সন্ধ্যা পর্যন্ত ছবিরহাটে আড্ডা মেরে পান্থপথে গেলাম। সেখান থেকে গ্রুপে ফিরতে রাত এগারোটা সাড়ে এগারোটা বাজলো। পরদিন ১৮ তারিখ রিয়াজ অফিসে গেল। সকালে আমরা একসঙ্গে বের হবার পথে রাস্তায় আলাউদ্দিন ভাইয়ের সঙ্গে আমাদের দেখা হল। রিয়াজ আমার থেকে আলাদা হয়ে আলাউদ্দিন ভাইয়ের সঙ্গে কিছু শলাপরামর্শ করলো।

বুঝলাম, এই শলাপরামর্শ টাকা পয়সা লেনদেন সংক্রান্ত। কারণ, রিয়াজ মাঝে মাঝে আলাউদ্দিন ভাইয়ের থেকে ধার দেনা করতো। আলাউদ্দিন ভাইও রিয়াজের থেকে ধার দেনা করতো। এটা ফয়সালও জানতো। আলাউদ্দিন ভাই হল পালাকারের একাউন্ট্যান্ট। দু'জনেই একাউন্ট্যান্ট হওয়ায় রিয়াজের সঙ্গে তার খুব গলায় গলায় খাতির। আলাউদ্দিন ভাইয়ের থেকে বিদায় নিতে নিতে রিয়াজ বলছিল, আমি অফিসে গিয়ে আবার আপনাকে ফোন করবো। আমরা নাস্তা খেয়ে ফকিরাপুল গেলাম। সেখান থেকে রিয়াজ বিজয়নগরের অফিসে ঢুকে গেল আর আমি শাহবাগ চলে আসলাম। সারাদিন শাহবাগে বন্ধু সুমন শামস আর নুরউদ্দিন রানার সঙ্গে আড্ডা মেরে ভারী ক্লান্ত। প্রায় সারা দিন তামুক খেলাম। রাত দশটার দিকে আমি রিয়াজকে ফোন করলাম। রিয়াজ বললো তুমি গ্রুপে যাও, আমি আসতেছি। আমি সাড়ে দশটা বা পোনে এগারোটার দিকে গ্রুপে পৌঁছালাম। রিয়াজ আসলো এগারোটা সোয়া এগারোটার দিকে। ওই দিন গ্রুপে কোনো রিহার্সাল ছিল না। মাগরিবের নামাজ পড়ে আলাউদ্দিন ভাই গ্রুপে তালা মেরে চলে গেছেন। আমি গ্রুপে ঢুকে কম্পিউটার অন করে তাস খেলতেছিলাম। রিয়াজ আসলে আমরা ডিনারের জন্য বের হব। রিয়াজ আসার পর আমরা সিগারেট খেয়ে সাড়ে এগারোটা পোনে বারোটার দিকে মগবাজার মোড়ে ডিনারের জন্য গেলাম। ফিরে এসে আমরা দুই কম্পিউটারে অনেকক্ষণ তাস খেললাম। রাত একটা সোয়া একটার দিকে আমি ঘুমানোর জন্য রিহার্সাল রুমে গেলাম। রিয়াজ তখনো তাস খেলতেছিল।

সকালে আমি তখনো ঘুমাচ্ছিলাম। রিয়াজ আগেই অফিসে চলে গেছে। আলাউদ্দিন ভাই পালাকারে ঢুকে অফিস রুমে প্রবেশ করেই চিৎকার করে উঠলেন। রিহার্সাল রুমের দরজা খুলে ঘুম থেকে আমাকে জাগালেন। ব্যাপার কি? আলাউদ্দিন ভাই'র টেবিলের ড্রয়ার ভাঙা। ড্রয়ারে নাকি ৫০ হাজার টাকা ছিল, সেটা তখন নেই। রহস্যজনক এক চুরি!!! আমি ফোন করে অজয় আর ফয়সালকে জানালাম। কিছুক্ষণ পরে শামীম সাগর আসলো। মুকুলকে আমি জানালাম, শামীম সাগরও জানালো। ফয়সাল আসার পর আমি আর ফয়সাল নাস্তা খেতে বের হলাম। অজয় আর শিশির আসলো। সেলিম আসলো। গ্রুপে ইতোমধ্যে টাকা চুরির জন্য জরুরী মিটিং কল করা হল সন্ধ্যা ৬ টায়। সারা দিন আমরা গ্রুপে থাকলাম।

সন্ধ্যায় কয়েক মিনিটের মিটিং। ঘটনা শুধু আলাউদ্দিন ভাই আর শামীম সাগর বর্ণনা করলো। রিয়াজ মিটিংয়ে আসতে পারবে না জানালো। বললো, গ্রুপে একবার লাগেজ নিতে যাবে। রাতেই রিয়াজ চট্টগ্রাম যাবে। গ্রুপের মিটিং শেষে রমনা থানায় সাধারণ ডায়েরি করার কথা। আমরা সবাই যাবো। কিন্তু পরে মুকুল, শামীম সাগর আর আলাউদ্দিন ভাই গেল!!! আর সবার কাছ থেকে চাবি কেড়ে/চেয়ে নেওয়া হল।

মিটিংয়ে পুরো ঘটনার কোনো বর্ণনা কেউ শুনলো না। আলাউদ্দিন ভাই গ্রুপ থেকে মাগরিবের পর বের হলে আমিই প্রথম ঢুকেছিলাম, এমনটি সবাই জানালো। এখানে একটি কথা বলে রাখা উচিত, গ্রুপের চাবি তখন পর্যন্ত অনেকের কাছেই ছিল। আমার কাছে একটা, রিয়াজের কাছে একটা, আলাউদ্দিন ভাইয়ের কাছে একটা, অজয়ের কাছে একটা, ফয়সালের কাছে একটা, আর এমার্জেন্সি মোকাবেলার জন্য শুভ বা দলের জুনিয়র কোনো সদস্যের কাছে একটা। যাদের কাছে চাবি ছিল, তাদের যে কেউ ওই সময়ের মধ্যে গ্রুপে অনায়াসে প্রবেশ করতে পারতো। আলাউদ্দিন ভাই যে টাকা গ্রুপের ড্রয়ারেই রেখেছিলেন তার একমাত্র সাক্ষি তিনি নিজে। আর কেউ তা জানেন না। আলাউদ্দিন ভাই ড্রয়ারে তালা মেরেছিলেন কিনা তাও তিনি ছাড়া আর কেউ জানে না। টাকাটা সত্যি সত্যিই ড্রয়ারে ছিল কিনা তাও আলাউদ্দিন ভাই ছাড়া আর কেউ জানে না। কিন্তু পালাকারের ৫০ হাজার টাকা ওইভাবে চুরি হল। সেদিন থেকই গ্রুপের সবাই আমার দিকে একটু অন্য নজরে তাকানো শুরু করলো। সেই তাকানোর অর্থ বোঝার মত বয়স, বুদ্ধি, মেধা, জ্ঞান সবই আমার আছে।

আমি একটি কথা সুস্পষ্ট করেই বলতে চাই, যে গ্রুপে আমার অন্তঃত ১০ বছরে একটু হলেও কনট্রিবিউশান আছে, যে গ্রুপটির স্বপ্ন শুধু মুকুল নয় সেই আদি ১৫ জনের সবাই দেখেছে এবং এখনো দেখে, যে গ্রুপ আমাদের সবার অনেক পরিশ্রমের ফসল, সেই গ্রুপ থেকে অন্তঃত গ্রুপের কেউ টাকা চুরি করতে পারে বলে আমি এখনো বিশ্বাস করি না। নাম্বার দুই, ইকতার আর আমি যখন গ্রুপে থাকতাম তখন গ্রুপের ড্রয়ারে অন্তঃত ৩/৪ লাখ টাকা থাকতো, তখন তো কিছু হল না। আমি যখন টানা প্রায় নয় মাস গ্রুপে এবং উপরে আশ্রয় নিয়েছিলাম তখন তো টাকা চুরি হল না। আমি যখন আমার বাসার টেকনিক্যাল কারণে (ছেলেমেয়েদের জন্য) গ্রুপে কয়েক দিনের জন্য থাকতে গেলাম, তখন টাকাটা চুরি হল। চুরি হল খুবই রহস্যজনকভাবেই। আলাউদ্দিন ভাই একাই ওই টাকা চুরি হবার সাক্ষি। যদি শর্ট লিস্ট কেউ করে আমি, রিয়াজ আর আলাউদ্দিন ভাই সেই তালিকায় থাকার কথা। যদি কেউ আরেকটু লম্বা লিস্ট করে তাহলে যাদের কাছে চাবি ছিল তারাও তালিকায় থাকতে পারে। আর যদি কারো একটু মেধা থাকে, একটু বুদ্ধি আমাদের থাকে তাহলে তালিকা আরো ছোট হয়ে সরাসরি আলাউদ্দিন ভাই সেই তালিকায় পরে।

পালাকারের সঙ্গে তারপর ধীরে ধীরে সম্পর্কটা শীতল হয়ে গেল। আমি আগের মতোই পালাকারে যেতাম। শো হলে শিল্পকলায় যেতাম। কিন্তু শিল্পকলায় আমাকে ডিবি পুলিশ শো চলাকালীন ফলো করতে থাকলো। বাংলার মাটি বাংলার জলে'র সেদিনের শোতে গ্রুপের সবাই একটু অন্যরকম আচরণ করলো। আমরা যাওয়ায় শুধু মুকুল খুব খুশি হয়েছিল। মুকুল আমাকে বললো, তুমি একটু ওদের নিয়ে গেট আর গেস্ট সামাল দাও। আগেও এটা আমি করতাম। সবই এ্যাজ ইট ইজ। আমি গেটে সবাইকে সেট করে উপরে গেলাম অজয়ের কাছে সিগারেট খাবো বলে। রিন্টু ভাই তার মেয়েকে মায়া'র সঙ্গে ট্যাগ করে দিলেন। কারণ, রিন্টু ভাই পারফর্মার। মায়া আর রিন্টু ভাইয়ের মেয়েকে উপরে দোতলায় বসিয়ে দিয়ে শিবলুকে সাউন্ডের দায়িত্বে রেখে অজয় আর আমি গেলাম সিগারেট খেতে। দ্রুত সিগারেট টেনে অজয় দোতলায় সাউন্ডের জন্য গেল। আমি নিচে গেলাম সৈয়দ হক আর আনোয়ারা হককে বসিয়ে দিতে। গিয়ে দেখলাম সফিক ভাই ওনাদের নিয়ে ঢুকছেন। গেস্টদের বসিয়ে দিয়ে সফিক ভাইকে বললাম, আর কোনো গেস্ট আসলে আপনি সামাল দিয়েন। আমি উপরে গেলাম। জুয়েলকে মেইন গেটে বলে রাখলাম। কোনো গেস্ট আসলেই যেনো সফিক ভাইয়ের কাছে পাঠায়। আমি দোতলায় চলে গেলাম। গিয়ে দেখি মায়ার পাশে শিবলির ছোট বোন আর রিন্টু ভাইয়ের মেয়ে বসেছে। আমি গেটে একজন জুনিয়ারকে রেখে মায়াদের পেছনের সারিতে বসলাম। শো শুরু হল। কিছুক্ষণ পর চার জন লোক ঢুকলো। তাদের কারো টিকেট নাই। আমি টিকেট দেখতে চাইলাম। তারা বললো, তারা ডিবি পুলিশের লোক। তাদের তিনজন আমার বামপাশের সারিতে বসলো। একজন আমার পেছনে বসলো। জিজ্ঞেস করলাম, আপনারা টিকেট ছাড়া কিভাবে ঢুকলেন? জবাবে ওনারা বললেন, আমরা সরকারি কাজেই এসেছি। সময় মতো চলে যাব। আমাদের টিকেট লাগে না। আমি একটু পরে উঠে অজয়ের কাছে গেলাম। একেবারে পেছনের শেষ সারি। পরে আবার আগের সিটে এসে বসেছি। আমার পেছনের ডিবি'র লোকটি তখন উঠে আমার পাশে এসে বসে ঝিমোচ্ছিলেন। শো শেষে আমি রিন্টু ভাইয়ের মেয়েকে নিয়ে গ্রিন রুমে গেলাম। মুকুলকে বললাম, এখনই যাবো। মায়া'র সকালে স্কুল আছে। মুকুলের থেকে বিদায় নিয়ে মায়াকে ফোন করলাম। মায়া বললো, ওরা একেবারে সামনের মেইন গেটের সিড়িতে আছে। রিন্টু ভাইকে বললাম আপনি কি গাড়ি আনছেন? রিন্টু ভাই বললো হ্যা আনছি। বললাম আমাদের নামিয়ে দেন। রিন্টু ভাই বললো এখনই আমার সঙ্গে যেতে পারলে চলেন। আমি রিন্টু ভাই'র সঙ্গে ভেতরের সিড়ি দিয়ে নামলাম। মায়াকে ফোন করে গাড়ি স্ট্যান্ডে আসতে বললাম। আমরা রিন্টু ভাইয়ের গাড়িতে বনানী চলে আসলাম।

কিন্তু পরে মায়াও আমাকে বললো, সবার আচরণ কেমন একটু সন্দেহজনক ছিল। জানি না কি হল? গ্রুপের সবার সেদিনকার আচরণ সত্যিই একটু রহস্যজনক ছিল। সেদিন থেকে আমি আর গ্রুপে যাই না। এক আলাউদ্দিন ভাই কি আমার হৃদয় থেকে পালাকার মুছতে পারবে? মোটেই না। একটি রহস্যজনক চুরি কি পালাকারকে ভালোবাসতে আমাকে দ্বিধায় ফেলবে? মোটেই না। আমি পালাকারের ফাউন্ডার মেম্বার। দম্ভ নিয়ে এখনো পালাকারকে ভালোবাসি। কারো দয়ায় বা কুনজরে কেউ আমার হৃদয় থেকে পালাকারকে দূরে ঠেলতে পারবে না। কিন্তু রহস্যজনক চুরির বিষয়ে আমাকে দল থেকে আর কোনো আপডেট জানালো হল না। সেটাও রহস্য হয়েই থাকলো। মুকুলের কাছে আমার একটি ছোট্ট প্রশ্ন আছে? রেজা ঘটককে মুকুল যতোটুকু চেনে সেখানে কোনোদিন কোথাও কোনো একটাকা চুরির ঘটনা আছে কি? যদি না থাকে তাহলে মানুষ চিনতে আরো সময় এবং আরো পরীক্ষা আমাদের সবার জীবনেই দিতে হবে। রিয়াজ, মুকুল দু'জনের জন্যই সেই পরীক্ষার একটি প্রশ্ন আমি করতে চাই? বন্ধু এক জীবনে আসে, চলে গেলে আর আসে না। সামান্য ৫০ হাজার টাকার রহস্যময় চুরির ঘটনায় আমরা কেমন নিজেদের একটুও কি আড়াল করে রাখছি না, মুকুল বা রিয়াজ??? আমাদের জীবনে কি ওই রহস্যময় চুরির পর থেকে একটু আড়াল-আবডাল ব্যাপার যোগ হয় নি? কেন, কেন, কেন এসব হচ্ছে, মুকুল, রিয়াজ??? আমাদের বন্ধুত্বে কি এমন একটি ফাঁটল কখনো ছিল? ভবিষ্যতে কি সেই ফাঁটল থাকবে??? জবাব চাই মুকুল আর রিয়াজের কাছে???

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.