নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

বাংলাদেশ আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা...

বাংলাদেশ আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা...

রেজা ঘটক

ছোটগল্প লিখি। গান শুনি। মুভি দেখি। ঘুরে বেড়াই। আর সময় পেলে সিলেকটিভ বই পড়ি।

রেজা ঘটক › বিস্তারিত পোস্টঃ

কিভাবে পালাকার নাট্যদল গঠিত হল: কিছু সত্য কথন। পর্ব আট। রেজা ঘটক

০৪ ঠা জুন, ২০১৩ দুপুর ১:৪১

আমি নিজে কোনো দিন সত্যিকারের নাট্যকর্মী ছিলাম না, দাবীও করি না। নাটক ভালো লাগে। পালাকারের সঙ্গে জড়িত। একটু আধতু এটা ওটা করতাম। মঞ্চে অভিনয় কখনোই নয়। নাটকের একজন ভক্ত হিসেবে একজন সংস্কৃত কর্মী হিসেবে নিজেকে মনে করতাম। পালাকারের সঙ্গে যুক্ত হয়ে সংস্কৃতি অঙ্গনেও যে রাজনীতি আছে তা টের পেলাম। যে রাজনীতি ছাত্রজীবনে ছাত্র ইউনিয়ন করলেও পরে আর করিনি নোংরা পলিটিক্স দেখার পর। সংস্কৃতি চর্চা করতে গিয়ে সেখানেও রাজনীতি দেখলাম। আসল রাজনীতির চেয়ে সংস্কৃতি অঙ্গনের রাজনীতি আরো ভয়াবহ, আরো হিংসা এবং জেলাসে পরিপূর্ণ। কি সেই রাজনীতি সেই আলাপে যাবার আগে চলুন একটা গান গাই-

আজ ধানের ক্ষেতে রৌদ্রচায়ায় লুকোচুরি খেলা–

নীল আকাশে কে ভাসালে সাদা মেঘের ভেলা॥

আজ ভ্রমর ভোলে মধু খেতে– উড়ে বেড়ায় আলোয় মেতে,

আজ কিসের তরে নদীর চরে চখা-চখীর মেলা॥

ওরে, যাব না আজ ঘরে রে ভাই, যাব না আজ ঘরে।

ওরে, আকাশ ভেঙে বাহিরকে আজ নেব রে লুট করে।

যেন জোয়ার-জলে ফেনার রাশি বাতাসে আজ ছুটেব হাসি,

আজ, বিনা কাজে বাজিয়ে বাঁশি কাটবে সকল বেলা॥



পালাকারের 'ডাকঘর' প্রযোজনায় আমরা সবাই এই গানটি গাইতাম। এই গানের মধ্যে একটি সত্যিকারের মায়া আছে। কোথায় যেনো সি টেনে নিয়ে যায়? আমাদের কোথায় নিয়ে যায় রবীন্দ্রনাথ এই গান দিয়ে? কবিগুরু লহো প্রণাম। তুমি সত্যিই কবিশ্রেষ্ঠা হে মহাকবি। যে মানুষটির কথা পালাকারকে সব চেয়ে বেশি মনে রাখতে হবে তাঁর নাম গোলাম সফিক। পালাকারের বিভিন্ন পর্যায়ে নানাভাবে গোলাম সফিক নিরবে নিভৃতে কাজ করে গেছেন। পালাকারের সকল শুভ কাজের সঙ্গে এই মানুষটি অনেক কাজ করেছেন। স্যালুট গোলাম সফিক। পালাকারের সকল অর্জনের জন্য আমিনুর রহমান মুকুলই প্রধান সৈনিক। পালাকারের সকল স্বপ্ন বাস্তবায়নে মুকুলের অবদান সবচেয়ে বেশি। পালাকারের জন্ম থেকে তাই এখনো আমরা পালাকারের নের্তৃত্ব মুকুলের হাতেই রেখেছি। একমাত্র মুকুলই পালাকারের অপ্রতিদ্বন্দ্বী অধিকারী। এ বিষয়ে আমি এখনো শতকরা ১০০ ভাগ বিশ্বাস করি। আমার মতো যারা বসন্তের কোকিল তাদের দিয়ে পালাকারের আর যা হোক অন্তঃত সাংগঠিক কাজ গুছিয়ে এতোদূর আসা সম্ভব হতো না। তাই মুকুলকে আমার অন্তরের স্যালুট এবং পালাকার বলতে আমরা সবাই মুকুলকেও বুঝি আসলে। পালাকারের সকল স্বপ্ন পূরণে মুকুলই মাথার ঘাম পায়ে ফেলে আজ এ পর্যায়ে নিয়ে এসেছে। তাই পালাকার সম্পর্কে কিছু বলতে গেলে মুকুলের কথা না বললে বেঈমানী করা হবে। মুকুল শতকরা ১০০ ভাগ পালাকার অন্ত-প্রাণ। আর বাদ বাকি যারা এরা আসলে পালাকারের শুভাকাঙ্খী। বা পালাকারের সুহৃদ। বা পালাকারের বন্ধু। বা পালাকারের সভ্য। বা পালাকারের প্রতিনিধি। পালাকারের সর্বময় ক্ষমতাও তাই আমরা মুকুলের হাতেই সমর্পণ করেছি। কারণ স্বপ্নটি মুকুলের ছিল। আমরা সেই স্বপ্নে সামান্য সহযোগিতা করেছি মাত্র। জয়তু মুকুল। জয়তু পালাকার।

পালাকার প্রথম যে নাটকটি দিয়ে পাবলিক শো করেছিল সেটির নাম ছিল 'মায়াজাল'। কিছু অতিথি শিল্পী এবং পালাকারের নাট্যকর্মীরা সেই নাটকে অভিনয় করেছিল। বন্ধু নাছিম সেই নাটকে রাজার চরিত্রে অভিনয় করেছিল। আহা আমিন নিলয়ের সেই দিনগুলো। হাঁটতে বসতে উঠতে সারাক্ষণ আমরা নাছিমের অভিনয় দেখে মুগ্ধ হতাম। নাছিম সারাক্ষণ রাজা সেজেই আমিন নিলয়ে রিহার্সাল করতো। আজ নাছিমের কথা খুব মনে পড়ছে।

২০০৪ সালের ২৬ নভেম্বর নাছিম হঠাৎ হার্ট এ্যাটাকে মারা গেল। রেজাউল কবীর নাছিম কবিও ছিল। নাছিম রেজা নামে কবিতা লিখতো। নাছিমের হাতে লেখা কবিতাগুলো এখনো আমার কাছে আছে। নাছিমকে উৎসর্গ করে ৩২ দিলু রোডে পালাকারের কার্যালয়ে প্রথম এক সপ্তাহের একক নাট্যমেলা আয়োজন করেছিল পালাকার। মুকুল আমার কাছ থেকে নাছিমের একটা ছবি সংগ্রহ করেছিল। ছবিটি পেয়েছিলাম নাছিমের চাকরির আইডি কার্ডে। ওটাই মুকুল বড় করে একটা বিশাল সাইজের পোস্টার বানিয়েছিল।

আমরা তখন ১০০ কাঁঠালবাগানের চিলেকোঠায় থাকি। রিয়াজ, মনি'দা, নাছিম আর আমি। সারা রাত নাছিম আর আমি ছাদে সিগারেট ফুকলাম আর দুনিয়ার আলোচনা করলাম। কখনো সাহিত্য। কখনো ব্যক্তিগত জীবন। কখনো প্রেম। কখনো বেকারত্ব। কখনো নীল আকাশ। কখনো রূপালী চাঁদের অলৌকিক সৌন্দর্য। কখনো মেস লাইফ। কখনো নেশার আলাপ। কখনো পেশার আলাপ। কখনো জীবন বদলে দেয়ার আলাপ। আমাদের আলাপ যেনো সেরাতে আর ফুরায় না। নাছিম কি জানতো ওটাই আমার সাথে ওর শেষ আড্ডা?

২৩ নভেম্বর ঈদ উপলক্ষে নাছিম ফেনী গেল। ডাক্তারপাড়ায় নাছিমের অসুস্থ মা, বড় ভাই আর ছোট ভাই রোমান থাকতো। নাছিমরা তিন ভাই। নাছিমকে প্রথম বিয়ে করানো হল। নাছিমের বিয়ের বয়স তখন নয় মাস। ২০০৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আমি তখন গোপালগঞ্জের মোকসেদপুরে ঢাকা-মংলা এসআরএনডিপি প্রজেক্টে এডিবি'র টাকায় বিসিএল থেকে একটি গবেষণার কাজে। দীর্ঘ ছয় মাস আমরা মংলা টু ঢাকা হাইওয়ের দু'পাশে হাইওয়েতে যাদের জমি গেছে সেইসব পারিবারের নালিশ সংগ্রহ করছিলাম। মহাসড়কে যাদের জমি গেল তারা কি পরিমাণ ক্ষতিপূরণ পেল তা জানার জন্যে এডিবি ওই রিসার্স করিয়েছিল। রাত বারোটায় নাছিম ফোন করলো। বন্ধু এখন কোথায়? টুঙ্গিপাড়া নাকি গোপালগঞ্জ? জবাবে বললাম, মোকসেদপুর। তারপর বলো কি অবস্থা? জবাবে নাছিম বললো, বিয়ে করতে রওনা হলাম। একটু পরে আকথ হবে। দোয়া করো। বললাম, মাশাল্লা। নাছিম, তুমি তো কাঁঠালবাগানের ব্যাচেলর জীবনের ইতি ঘটাতে যাচ্ছো? নাছিম বললো, আরে সেরকম কিছু না। বউ মা'র সাথে ফেনীতে থাকবে। আমি ছুটি ছাটায় এক-দু'বার ঢু মারবো। ব্যাচেলর লাইফ আগের মতোই থাকবে। মাকে সেবা যক্ন করার কেউ নাই। আমার বউ যে হবে তাকে একটা শর্ত দিয়েছি। আমার মা চলাফেরা করতে পারে না। তাকে খাওয়াতে হয়। গোসল করাতে হয়। কাপড় পড়িয়ে দিতে হয়। গত তিন বছর ধরে বিছানায় প‌্যারালাইজড। তার সেবা যত্ন যে করতে পারবে, তাকে আমি বিয়ে করবো। বড় ভাইয়ের জন্য আমরা মেয়ে দেখছিলাম। কিন্তু বড় ভাই বিয়েতে এখনো রাজী না। তাই আমিই বিয়ে করতে যাচ্ছি। দোয়া করো। রাখলাম রেজা।

নাছিম মনে প্রাণে ছিল সত্যিই রাজা। পকেটের চিন্তা কোনোদিন করেনি। বন্ধুদের জন্য সর্বস্ব দিতে পারতো এক নিমেষে। ছোটবেলায় বাবা মারা যাবার পর তিন ছেলেকে মানুষ করেছে নাছিমের মা। আমাদের সবার মা। সেই মায়ের সেবাযত্নের জন্য নাছিম বিয়ে করলো সম্পূর্ণ অচেনা এক মেয়েকে। এক কথায়। ঢাকা থেকে বন্ধুদের মধ্যে তারেক যেতে পেরেছিল। ফেনীতে আমাদের যারা বন্ধু আহসান ওরা সবাই ছিল নাছিমের বিয়েতে। বিয়ের একদিন পর নাছিম আবার যথারীতি ঢাকায় আসলো। নাছিমের বিয়ের সময় আমরা থাকতাম ৭ কাঁঠালবাগানে। আমরা তখন রাজীব নূর, রিয়াজ, নাছিম, মনি'দা আর আমি থাকি একসাথে। ১৯ কাঁঠালবাগান ছিল আমাদের ব্যাচেলর জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়। ১৯ কাঁঠালবাগান ডেভলপারদের দেওয়ার পর পুলক চলে গেল কাজীপাড়া। পবন ১৭ কাঁঠালবাগানে। খোকন কায়সার চট্টগ্রমে বদলি। আর মামু মাসুদ শ্যামলীতে। বিয়ে করে নাছিম ঢাকায় এসে রাজীব নূর বলার পর, রাজীব দা একটা ধমক দিল। অন্তঃত মেয়েটির জন্য নাছিম আপনার তিনটা দিন ফেনীতে থাকা উচিত ছিল। জবাবে নাছিম বলেছিল, রাজীব দা, অসুবিধা নাই, বৃহস্পতিবার আবার যাবো। রাজীব দা বলেছিল, অন্তঃত রবিবার সক্কালের আগে যেনো ঢাকায় না আসেন, নাছিম?

ক্লাশ ফাইভ থেকে রিয়াজ, পুলক আর নাছিম ক্লাশফ্রেন্ড। অবশ্য তার আগে পুলক আর রিয়াজ কক্সবাজার থেকে ক্লাশ টু থেকেই ক্লাশ ফ্রেন্ড। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার আগে রিয়াজ আর জায়েদ ছিল কমার্স কলেজে একসাথে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার পর আরো বন্ধু জুটলো। মুকুল, মঈনুল বিপ্লব, নয়ন মনি চৌধুরী, নাছিম এরা সবাই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের। আমি ঢাকায় থাকলেও রিয়াজের মাধ্যমে এদের কারো কারো সঙ্গে আমার তখন থেকেই বন্ধুত্ব। বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শেষ করে রিয়াজ ঢাকায় আসলে পুলক, উত্তম, নাহিদ, জনি, তুহিনদের সাথেও আমার বন্ধুত্ব হল রিয়াজের মাধ্যমে।

পুলক আর উত্তম থাকতো শুক্রাবাদ। সেখানেই ছুটির দিনে বন্ধুরা বিশাল জুয়ার আসর মেলাতো। আমি থাকতাম দর্শক। আর চা নাস্তা সিগারেট সাপ্লাই দেবার এসিসট্যান্ট। জুয়া খেলায় আমি নাহিদ বা জনি'র পক্ষে ওদের পাশে একেক দিন বসতাম। আহা যৌবনের সেই মাতাল দিনগুলি। বন্ধু নাছিম হঠাৎ হারিয়ে গেল আমাদের ছেড়ে। কিন্তু আমার স্মৃতি একটুও হারায়নি বন্ধু। গ্রিনরোডের বাসার ১৯৯৬ সাল থেকে নাছিম আমার রুমমেট কখনো বেডমেট কখনো নেশামেট কখনো খাবারমেট, কখনো খামাখা ধানমন্ডির লেকের পারে বাদাম খাওয়া ও মানুষ দেখার সহযাত্রী। বন্ধু নাছিম, তোরে খুব মিস করি রে। ২০০৪ সালের ২৩ নভেম্বরের পর আর নাছিমের সঙ্গে আমার দেখা হয়নি। ২৬ নভেম্বর নাছিম মারা গেল। তুই যেখানেই থাকিসরে বন্ধু রাজার মতো হাসিখুশি থাকিসরে। তোরে খুব মিস করছি, নাছিম।।

......................চলবে......................................









মন্তব্য ০ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.