নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

বাংলাদেশ আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা...

বাংলাদেশ আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা...

রেজা ঘটক

ছোটগল্প লিখি। গান শুনি। মুভি দেখি। ঘুরে বেড়াই। আর সময় পেলে সিলেকটিভ বই পড়ি।

রেজা ঘটক › বিস্তারিত পোস্টঃ

বন্ধুদের আমলনামা-৪ : : পুরোপুরি কানাডার নাগরিক প্রকাশ চন্দ্র মণ্ডল ।। রেজা ঘটক

২২ শে জুন, ২০১৩ রাত ১১:২৮

প্রকাশ আমার পাঠশালা থেকে বন্ধু। তারপর একসাথে এইচএসসি পর্যন্ত পড়াশুনা। তারপর আমি ভর্তি হলাম অর্থনীতিতে অনার্স আর প্রকাশ সিটি কলেজে বি.কম. ভর্তি হল। বিকম শেষ করে প্রকাশ আবার সিএ ভর্তি হল। সিএ প্রিলিমিনারি শেষ করে আবার ম্যানেজমেন্টে মাস্টার্স শেষ করলো জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। ১৯৯৬ সালের ঘটনা। আমার মাস্টার্স পরীক্ষা তখন শেষ। আমি, কমল, আমার কাজিন সালাউদ্দিন আল মামুন আর সাংবাদিক অভি চৌধুরী থাকি কাঁটাবন ঢালে এক ব্যাচেলর বাসায়। অভি চৌধুরীর আবার একজন এসিট্যান্ট আছে সুমন। সুমনও আমাদের সঙ্গে থাকে। তখন অভি চৌধুরীর সঙ্গে প্রায়ই আমাদের বাসায় আসতো সঞ্জীব চৌধুরী, কবি সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল সহ অনেকেই। অভি ভাই বাসায় ঢুকলেই আমি কমল আর মামুন টিএসসিতে চলে যেতাম আড্ডা মারতে। কারণ, ওনারা তখন বাসায় নিজেদের মতো পান করবেন। আজিজ সুপার মার্কেটে অভি 'দার একটা ছোট্ট অফিস ছিল। সেই অফিসে বসতো হাসান। হাসানও ধীরে ধীরে আমাদের বন্ধু হয়ে উঠলো। আমাদের বাসার পাশের বাসায় তখন থাকতেন লালন সম্রাজ্ঞী ফরিদা পারভিন। আপাকে রোজ আমরা দেখতাম বাচ্চাদের স্কুল থেকে নিয়ে আসতে নিয়ে যেতে। আমাদের বাসার সামনে একটা চায়ের দোকান। তার ঠিক উল্টোপাশেই একটা মুদি দোকান। মুদি দোকানি'র বাড়ি চট্টগ্রাম। আমরা ডাকতাম বদ্দা। বদ্দাও আমাদের খুব ভালো জানতেন। একদিন রাতে চাল আর ডিম কেনার সময় বদ্দা জানতে চাইলেন, আপনাদের মধ্যে কেউ কি একাউন্টিংয়ে মাস্টার্স করা আছে? জানতে চাইলাম কেন? বদ্দা বললেন, দুবাইতে তার শ্যালক শাহজাহান থাকেন। বদ্দাও সেখানে ৩৮ বছর ছিলেন। তো শাহজাহান সাহেব আগামী মাসে দেশে আসবেন। সঙ্গে কিছু ভিসা আনবেন। শাহজাহান সাহেবের নিজের অফিসে একাউন্টিংয়ে পারদর্শী একটা ভালো ছেলে লাগবে। চাল ডিম নিয়ে বদ্দাকে বললাম, কাল জানাব।

প্রকাশ তখন চাকরি করে মোহাম্মদপুরের ইকবাল রোডে নোরাডের অর্থায়নে একটি এনজিওতে। সেখানে প্রকাশের কলিগ ফয়েজ নূর আর লেনীনও আমাদের বন্ধু। আমি তখনো বেকার। তাই প্রায়ই প্রকাশের ইকবাল রোডের মাঠের পাশের সেই অফিসে গিয়ে আড্ডা পিটাই। বিশেষ করে ফয়েজ নূর তো আমার তখন রীতিমত বস। ডেইলি সন্ধ্যায় বিয়ার খায় ফয়েজ নূর। মাঝে মধ্যে আমারেও ডাকেন। এই ফাঁকে বলে রাখি আমিও ফয়েজ নূরের মতো বিয়ারের একনিষ্ঠ ভক্ত। আমার বন্ধু শ্যামল মিত্রও বিয়ারের ভক্ত। তো প্রায়ই আমরা লেনীন আর প্রকাশকে বাদ দিয়ে ফয়েজ নূর, শ্যামল আর আমার সান্ধ্য-বৈঠক হতো ফার্ম গেইটের হোটেল সালিমারে।

প্রকাশকে সকালে ফোন করে জিজ্ঞেস করলাম, দুবাই যাবি নাকি? বেতন ভালো দেবে। পরিচিত লোক। লাঞ্চের সময় লেনীন আর প্রকাশ আমাদের ব্যাচেলর কোয়ার্টারে হাজির। লেনীনের বক্তব্য, বস, আমারেও পাঠান। এই চাকরি আর ভালো লাগে না। ততোদিনে প্রকাশ, লেনীন আর ফয়েজ নূর কানাডায় ইমিগ্র্যান্টের জন্য আবেদন করেছে একসাথে। লেনীন ভাইভা'র জন্য সিঙ্গাপুর আর ফয়েজ নূর আর প্রকাশ দিল্লী অফিসে পছন্দ দিয়েছে। ওরা লেনীনের মামার মাধ্যমে একজন কানাডিয়ান আইন উপদেষ্টাও নিয়োগ করেছে। তাকে ওদের তিনজনের কানাডায় ইমিগ্র্যান্ট হয়ে গেলে তিন কিস্তিতে তিন হাজার করে মোট নয় হাজার কানাডিয়ান ডলার পে করতে হবে। ইমিগ্রেশান গতে দুই তিন বছর সময় লাগবে। প্রকাশকে বললাম, তুই দুবাই গিয়ে ইন দ্য মিন টাইম এই টাকাটা আয় করে নিয়ে আয়। তাহলে আমি, বন্ধু মামুন আর শ্যামলও আবেদন করতে পারবো। প্রকাশ বিনাবাক্যে রাজী হল।

এর মধ্যে বদ্দা'র শ্যালক শাহজাহান সাহেব দেশে আসলেন। প্রকাশের পাসপোর্ট দেখলেন। ঠিক হল আপাততঃ ৩৫ হাজার টাকা বেতন দেবেন। ছয় মাস পরে ৪৫ হাজার দেওয়া যাবে। শুরু হল আমার আর প্রকাশের দৌড় ছাপ। সোনারগাঁও রোডে এক টাইলসের দোকানে শাহজাহান সাহেবের এক প্রতিনিধি প্রকাশের ভিসা আর কাগজপত্র সব ঠিক করে দেবেন। ইতোমধ্যে আমরা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে প্রকাশের কাগজপত্র সত্যায়িত করাতে গেলাম। সেখান থেকে বলা হল আগে কাউকে দিয়ে সত্যায়িত করাতে হবে। সময় বাঁচাতে আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার ডিপার্টমেন্টে ঢু মারলাম। ইকোনমিক্সের নাসরিন ম্যাডামকে সামনে পেয়ে বললাম, ম্যাডাম, আমার বন্ধুর সার্টিফিকেট গুলো একটু সত্যায়িত করে দেন। আপা কেমুন মুডে ছিলেন বুঝলাম না। বললেন, ইকোনমিক্স ছাড়া অন্য কোনো সাবজেক্টের সত্যায়িত তিনি করান না। আমরা কমার্স ফ্যাকাল্টিতে গেলাম। যে স্যারকে পাই, তিনি কোনো না কোন অজুহাত দেখান। মেইন সার্টিফিকেট সঙ্গে আছে। তা দেখে সত্যায়িত করতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সেদিন ১৪ হাত দেখাল। শেষে মেজাজ খারাপ করে সিদ্ধান্ত নিলাম নীলক্ষেত গিয়ে নিজেরা সিল বানিয়ে নিজেরাই সত্যায়িত করে পররাষ্ট্র সন্ত্রণালয়ে যাব। ওই সময় ম্যানেজমেন্টের মান্নান স্যার কি মনে করে আমাদের কাঁর রুমে ডাকলেন। কাগজপত্র দেখলেন। কেন সত্যায়িত করতে হবে তা জানতে চাইলেন। আমরা সত্য কথাই বললাম। মান্নান স্যার বললেন, আমার ব্যাগে তো মনে হয় আমার সিল নেই। তোমরা কষ্ট করে ডিপার্টমেন্ট থেকে সিল মেরে নিও। আমি সত্যায়িত করে দিচ্ছি। মান্নান স্যারকে অনেক ধন্যবাদ দিয়ে আমরা ডিপার্টমেন্ট থেকে সিল মেরে আবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে গেলাম। তারা কাগজপত্র রেখে দিল। বললো, আড়াইটার পর আসেন।

ওদিকে শাহজাহান ভাইয়ের প্রতিনিধি জানালেন আগামীকাল সবার ফ্লাইট। রাত আট টায়। রাত বারোটায় যেনো আমরা নাখালপাড়া এমপি হোস্টেলের গেইটে যাই। মুরাদ ভাই ভিসা আমাদের হাতে দিয়ে সবকিছু বুঝিয়ে দেবেন। আমরা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে কাগজপত্র নিয়ে গেলাম তেজগাঁও থানায়। পুলিশ সার্টিফিকেট নিতে। পাঁচশো টাকার বিনিময়ে মাগরিবের পর পুলিশ সার্টিফিকেট হাতে পেলাম। মামুন আর শ্যামল গেল বঙ্গবাজার। প্রকাশের জন্য কিছু জামা বাপড় কিনতে। প্রকাশরা পাঁচ ভাই। প্রকাশের বড় ভাই অজিত কুমার মণ্ডল লালবাগ কেমিক্যালের জিএম। দ্বিতীয় রনজিৎ মন্ডল গ্রামের বাড়ির ম্যানেজার। তিন নাম্বার জন রেবতী কুমার মন্ডল তখন আসাদে গেইটে হাজী মকবুলের অক্সফোর্ড কলেজে ইংরেজি পড়ায়। চার নাম্বার জন প্রভাস মন্ডল রাশিয়ায় উচ্চ শিক্ষার জন্য আট বছর ধরে আছে তখন। একমাত্র বোন শোভা নাজিরপুরের পরিবার পরিকল্পনা অফিসার। মামুন আর শ্যামল কেনা কাটা শেষ করে অজিত মন্ডলের ইন্দিরা রোডের বাসায় ফিরলো। সেখানে গ্রাম থেকে রনজিৎ মন্ডল আর শোভা প্রকাশের মা সহ আগেই এসেছে। প্রকাশের বাবা আমার বাবার বাল্যবন্ধু। প্রকাশের বাবা মারা যায় আমরা যখন ক্লাশ টুতে পড়ি তখন। সেই থেকে প্রকাশদের পরিবারের সকল গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত দেন আমার বাবা। বলতে গেলে বাবাই প্রকাশদের তখন অভিভাবক। রনজিৎ মন্ডল আমাকে বাইরে ডেকে কইলো, ভাতিজা, দাদা তো তোমার উপর খুব রেগে আছেন। ভিসা না দেখে প্রকাশকে দুবাই যাবার অনুমতি দাদা দেবেন না বলে দিয়েছেন।

রনজিৎ আর রেবতী আমার আর প্রকাশের সঙ্গে সিগারেট খায়। রেবতী তখন থাকে মিরপুর দশ নাম্বারে। রেবতীকে অজিত মন্ডল জরুরী তলোপ করেছেন প্রকাশের ভিসা কাগজপত্র চেক করার জন্য। পরিবারের কেউ প্রকাশকে দুবাই পাঠাতে রাজী নয়। কেবল রেবতী কইলো, ভালো না লাগলে চলে আসবি। যা দেখে আয়। কি হয়। আর রনজিৎ আমাকে কানে কানে বললো, পাঠাতে পারলে পাঠাও। ঢাকায় প্রকাশকে এতো টাকা কে দেবে শুনি? প্রকাশের মাকে আমি ডাকি দিদি। দিদি বললো, আমি এসবের তো কিছু বুঝি না। তোরা কোন ঝামেলা বাধাইস কে জানে। অজিত তো রাজী না।

যাক শেষ পর্যন্ত পরদিন সন্ধ্যায় অজিত মন্ডল একটু নরম হল। রেবতী'র দুতিয়ালীতে। এয়ারপোর্ট যাবার জন্য অফিস থেকে গাড়ি পাঠালেন। আর ঘোষণা দিলেন, তোমরা এয়ারপোর্ট যাও। আমি যাচ্ছি না। আর ওই বান্দরটারে আটকাই রাখো। আগামীকাল আবার এয়ারপোর্ট থেকে প্রকাশকে যেনো রিসিফ করে। তখন শোভা পিসি'র হুংকারে কাজ হল। আমরা সবাই প্রকাশকে নিয়ে এয়ারপোর্টে গেলাম। সেখানে অনেক কান্নাকাটি হল। ইমিগ্রেশান হবার পর অজিত কাকু আর আমি তার পরিচিত লোকের মাধ্যমে প্রকাশের ইমিগ্র্যান্ট পর্যন্ত গেলাম। প্রকাশকে বিদায় দিয়ে আমরা সংসদ ভবনের পূর্ব পাশে আমাদের একটা আড্ডার জায়গায় আড্ডা দিতে লাগলাম। রাতে অজিত মন্ডলের বাসায় সবাইকে থাকতে হবে। বিশেষ করে আমাদের তিনজনের। শ্যামল, মামুন আর আমার। আমরা রনজিৎকে বললাম, কাগু তোমরা যাও, আমরা আড্ডা শেষে খাবার সময় ফিরবো।

সংসদ ভবনের পূর্ব পাশে আমাদের তিন বন্ধুর তখন একটি এডিটিং প‌্যানেল ছিল। নাম সাউন্ড এ্যান্ড ভিশন। রফিক, শাহেদ আর ইফতেখার ডন সেই এডিটিং প‌্যানেলের মালিক। আমরা ডনদের সঙ্গে রাত এগারোটা পর্যন্ত আড্ডা মারলাম। তারপর অজিত বাবুর ইন্দিরা রোডের বাসায় গেলাম। কথা ছিল প্রকাশ দুবাই পৌঁছে এয়ারপোর্ট থেকে ফোন করবে। বিমানের হিসাব সৌদি এয়ার লাইন্সের হিসেব অনুযায়ী, রাত আড়াইটা তিনটার দিকে প্রকাশ ফোন করবে ল্যান্ড ফোনে। আমরা ফোন সামনে নিয়ে বসে আড্ডা দিচ্ছি। প্রকাশের ফোন আসে না। রাত যতো বাড়ে আমার আর রনজিৎকে ততোই ক্ষেপানো শুরু করলো রেবতী, শ্যামল আর মামুন। কারণ, ওরা সবাই এখন রনজিৎ আর আমাকে বানালো প্রকাশের দুবাই যাবার জন্য একমাত্র সমর্থক। সকাল নাগাদ সবাই অজিত মন্ডলের দলে ভিড়লো। রনজিৎ মন্ডল আর আমি তখন বাসা থেকে পালানোর পথ খুঁজতে লাগলাম। সকাল সাড়ে ছয়টায় অজিত মন্ডল অফিসে যাবার সময় মুনমুনের মা (অজিত মন্ডলের স্ত্রী)কে বললেন, রেজা আর রনজিৎরে এয়ারপোর্ট গিয়ে প্রকাশের খবর নিতে বলো।

তখনকার দিনে রাম শ্যাম যদু মধু সবার হাতে মোবাইল ফোন ছিল না। কেবল এক্সিকিউটিবদের হাতেই থাকতো মোবাইল ফোন। অজিত মন্ডল তেজগাঁও লালবাগ কেমিক্যালের অফিসে ঢোকার মুহূর্তে তার মোবাইল বেজে উঠল। বাইরের কোড দেখে খুব আতংকিত ভাবেই অজিত মন্ডল ফোন রিসিপ করলেন। ওপাশে প্রকাশ। দুবাই এয়ারপোর্ট থেকে- হ্যালো, দাদা। আমি পৌঁছাইছি। অফিসের গাড়ি এসেছে আমাকে নিতে। ওরা জানালো, আমার থাকার জায়গা ওেরা ঠিক করেছে। আপাতত এক ইন্ডিয়ান মিস্টার রোনাল্ডের সঙ্গে আমার থাকতে হবে। আগামী মাসে আমার আলাদা রুম হয়ে যাবে। বাসার ফোনে চেষ্টা করেও লাইন পাচ্ছিলাম না। কলম্বো এয়ারপোর্টে আমাদের ফ্লাইট তিন ঘণ্টা লেইট ছিল। পরে একটি কুয়েত এয়ারওয়েজের বিমানে আমাদের দুবাই যাবার ব্যবস্থা করেছে। যে কারণে আমি আর ফোন করার সুযোগও পাইনি। মাকে জানাও। যেনো টেনশান না করে। আর রেজা, শ্যামল, মামুন ওরা যেনো মা যতোদিন ঢাকায় থাকে একটু মাকে সময় দেয়।

সাড়ে সাতটায় অজিত মন্ডল বাসায় ফোন করলেন। মুনমুনের মা আমাকে ডেকে বললেন, তোমার কাকু ফোন করেছে। আমি ভয়ে ভয়ে রিসিভার কানে ধরলাম। কাকু বললেন, প্রকাশ ফোন করেছিল। ল্যান্ড ফোনে ট্রাই করে পায় নাই। পরে আমার মোবাইলে করেছিল। ভালো ভাবে পৌঁছেছে। প্রকাশের থাকার ব্যবস্থাও ফাইনাল হয়েছে। রোনাল্ড নামে এক ইন্ডিয়ানের সঙ্গে এখন এক রুমে থাকবে। আগামী মাসে আলাদা রুম পাবে। আগামীকাল অফিসে জয়েন করবে। তোমরা দুপুরে খাওয়া দাওয়া করে যেও। আর শোনো, বৃহস্পতিবার চলো, কুমিল্লা মাছ ধরতে যাচ্ছি। অনেক বড় পুকুর। আমরা মাইক্রো নিয়ে যাবো। এক হাজার টাকা টিকেট। তুমি, মামুন আর শ্যামল গেলে খুব এনজয় করবা। শুনেছি. অনেক বড় বড় মাছ আছে ওই পুকুরে।

ছয় মাস পর প্রকাশ ঈদের ছুটিতে দেশে আসলো। প্রকাশের মালিক প্রকাশকে বাংলাদেশী টাকায় ৭০ হাজার টাকা দিয়েছে পরিবারের সঙ্গে ঈদ করার খরচ। আর বাংলাদেশে আসা যাওয়ার এয়ার টিকেট। আসার সময় প্রকাশ আমাদের জন্য আবদুল্লাহ সিগারেট, বিয়ার, ব্রান্ডি, বন্ধুদের সবার জন্য রিস্ট-ওয়াচ, আর গান শোনার জন্যে বিশাল সাইজের একটা ডিভিডি প্লেয়ার নিয়ে এল। আহা কি আনন্দ আকাশে বাতাসে...।

এক মাস ছুটি কাটিয়ে প্রকাশ আবার দেশে আসলো। তখন প্রকাশের কানাডা ইমিগ্র্যান্টের ভাইভার জন্য দিল্লী যেতে হবে। আমরা কানাডিয়ান সেই আইন উপদেষ্টাকে অনুরোধ করে দিল্লীর পরিবর্তে কলকাতা বানালাম ভেনু। প্রকাশ কলকাতা গেল ভাইভা দিতে। সঙ্গে গেল শ্যামল। ফয়েজ নূরকে পরিবার সহ যেতে হল। ফয়েজ নূর আর প্রকাশ দু'জনেরই কানাডায় ইমিগ্র্যান্ট হয়ে গেল। আমরা সবাই খুশি। লেনীনকে যেতে হল সিঙ্গাপুর। লেনীনেরও হয়ে গেল। সবার আগে কানাডা গেল ফয়েজ নূর। গিয়ে ওখানের অবস্থা সব জানালো আমাদের। তারপর প্রকাশ গেল। তারপর প্রায় এক বছর বা নয় মাস পর লেনীন গেল। পরে লেনীন অবশ্য কানাডায় আর থাকেনি। তিন বছর থাকার পর লেনীন আমেরিকা সেটেলড হয়েছে। আর ফয়েজ নূর আর প্রকাশ টরেন্টোতে সেটেলড হয়েছে।

কানাডায় যাবার আগে প্রকাশ আর অজিত মন্ডলের সম্পর্কের অবনতি ঘটল। আমরা বন্ধুরা একটা উদ্দ্যোগ নিলাম। অজিত মন্ডল পাত্তা দিলেন না। অজিত মন্ডলের ছোটবেলার শিক্ষক ফনি মাস্টার। ফনি বাবু কলকাতায় থাকেন। ফনি বাবু অজিত বাবু খুব শ্রদ্ধা ভক্তি করেন। আমরা বুদ্ধি পাকালাম ফনি বাবুকে ঢাকায় নিয়ে আসার। ফনি বাবু ঢাকায় আসলেন, রনজিৎ মন্ডল, প্রকাশের মা সবাই ঢাকায় আসলেন। অজিত মন্ডলের ইন্দিরা রোডের বাসায় বিশাল মিটিং। অজিত মন্ডল আমাদের প্রস্তাব মানলেন না।

আমরা মিটিং থেকে বেরিয়ে প্রকাশকে কানাডায় দ্রুত পাঠানোর জন্য উদ্দ্যোগ নিলাম। আমাদের সাত বন্ধ'র একটা সমিতি ছিল। আমার নামের টাকা পয়সা প্রকাশ জমা দিত। আমি, প্রকাশ, শ্যামল, মামুন, হেলাল, বনা আর উমাদি মিলে সেই সমিতি। আমরা সমিতিতে জমা হওয়া ৪০ হাজার টাকা প্রকাশের জন্য খরচ করলাম। আমাদের এক বন্ধু শিউলি কানাডায় যাবে। শিউলি'রও ইমিগ্র্যান্ট হয়ে গেছে। শিউলি'র হাজব্যান্ড ওন্টারিও থাকে। ঠিক হল প্রকাশ আর শিউলি একসঙ্গে ফ্লাই করবে। শিউলি আমাকে টাকা দিল বিমান টিকেট করার জন্য। প্রকাশ আর শিউলি'র পাসপোর্ট নিয়ে ধানমন্ডির বেল টাওয়ারে গেলাম। সেখানে আমাদের বন্ধু শিমুলের আরেক বন্ধু ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের এজেন্ট। টিকিট বুকিং দিলাম দুইটা। ৩ অক্টোবর ১৯৯৭। টাকা দিলাম একটার নগদ। প্রকাশের টিকেটের টাকা পরিশোধ। শিউলি'র টা বাকী। পরদিন শিউলিকে গ্রিন রোডের ভোজন বিলাসে নাস্তা খেতে বললাম, শিউলি এই নাও তোমার পাসপোর্ট। আর একটা ভুল হয়ে গেছে। প্রকাশের টিকেটের টাকা পরিশোধ হয়েছে। তোমারটি বাকী আছে। কালকের মধ্যে টাকা দিতে হবে। শিউলি'র মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। প্রকাশ আর আমি বুঝালাম যে, ভুলটা আমি করেছি। এখন তুমি আবার টাকা ম্যানেজ করে দাও। শিউলি খুব রাগ হল। বললো, একথা পিন্টুকে জানানো যাবে না। পিন্টু শিউলি'র স্বামী। পরে শিউলির সোনার গহনা বিক্রি করে শিউলির বিমানের টিকেটের টাকা জোগার করা হয়েছিল। কারণ, বিষয়টা শিউলি আর পরিবারের কাউকে জানাতে চায়নি। শিউলি আর প্রকাশ ঢাকা থেকে ৩ অক্টোবর ১৯৯৭ একসঙ্গে ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের বিমানে ফ্লাই করেছিল। কানাডা যাবার পর শিউলি আর একবারের জন্যও আমাকে হ্যালো বলেনি। হয়তো প্রকাশের জন্য করা আমার সেই অপরাধের কথা সে এখনো মনে রেখেছে।

যাবার আগের দিন প্রকাশের যাবতীয় জিনিসপত্র আমরা মিরপুর দশ নাম্বারে রেবতীর বাসায় জড়ো করলাম। প্রকাশের মা রেবতীর বাসায় উঠলেন। অজিত মন্ডলের বউকে আমি ডাকি কাকী। কাকীকে আমি একটা অনুরোধ করলাম। প্রকাশ যাবার আগে আপনি আমার শেখানো একটা উদ্ধোগ নেবেন। না পারলে প্রকাশ আর অজিত মন্ডলের সম্পর্ক তখনই শেষ। বিকালে কাকী মুনমুন আর মুমুকে নিয়ে (অজিত মন্ডলের দুই মেয়ে) রেবতীর বাসায় যাবে। আমরা তখন থাকবো টিএসসিতে। প্রকাশের শেষ আড্ডা বন্ধুদের সঙ্গে। আমার শেখানো বুদ্ধিতে মুনমুনের মা রেবতীর বাসা থেকে ফেরার পথে প্রকাশের সব জিনিসপত্র সঙ্গে নিয়ে ইন্দিরা রোডের বাসায় আসল। আমরা রাতে সবাই প্রকাশকে নিয়ে গ্রিন কর্নারে শ্যামলদের বাসায় থাকবো। রাত এগারোটায় প্রকাশ আর আমি গেলাম মিরপুর রেবতীর বাসায় আরো কিছু জিনিস রাখতে। গিয়ে প্রকাশের মাথা নষ্ট। মুনমুনের মা সকল লাগেজ নিয়ে গেছে। রেবতী, রেবতীর বউ সোমা, আর প্রকাশের মায়ের উপর প্রকাশ ক্ষোভ ঝাড়লো। আমি রেবতীকে বললাম, ভিসার কাগজপত্র কই? রেবতী আলমারী খুলে আমার হাতে ফাইল দিল। বললাম, এটাও এখন মুনমুনের মায়ের কাছে দিয়া আসব। আসল জিনিস তো সে নেয় নাই।

প্রকাশের পাসপোর্ট, টিকেট, ভিসা, সনদ সব ওই ফাইলে। রেবতী বললো, সাবধানে যাও। গিয়া আমারে জানাও। পথে কি একটু রিক্স হবে? আমি বললাম, লোকাল বাসে যাবো। বোনো অসুবিধা হবে না। তারপর প্রকাশের উপর আমি চড়াও হলাম। প্রকাশের মাকে বললাম, দিদি তুমি জীবিত থাকতে দুই পোলার ঝামেলা মেটাতে পারলা না। এখন আমি কি করি দেখো? প্রকাশকে বললাম, এই তোর সব কাগজপত্রের ফাইল। এটা আমি মুনমুনের মায়ের কাছে দিতে যাচ্ছি। তুই আমার কথা না শুনলে তোর কানাডা যাওয়া আর হবে না। আর আমি তোর সবকিছু নষ্ট করে ফেলব। আমার অমন অভিনয় বন্ধু আমার কোনো দিন দেখেনি। একটু ভরকে গেল। আমার পেছন পেছন প্রকাশও আসল।

ইন্দিরা রোডে এসে মুনমুনের মায়ের হাতে ফাইল দিয়ে বললাম, সিংহ মশাইয়ের মেয়ে, আসল ফাইল না নিয়া অভিযান করেছেন। নেন এটা। কাজগপত্র যেনো কেউ না উল্টায়। আর অজিত কাকুকে একটু ইমিগ্র্যান্ট কাগজটা দেখাবেন। আর স্বেচ্ছায় আত্মসমর্পনের পর বললাম, প্রকাশের তিন হাজার ডলার লাগবে। ডলার না হলেও ওকে আমরা পাঠিয়ে দেব। গেলাম। মুনমুনের মা গেইটের বাইরে এসে প্রকাশকে নিয়ে রাতে খেয়ে যাবার অনুরোধ করলেন। আমরা শ্যামলের বাসায় রিক্সা নিলাম।

সকালে মুনমুনের মায়ের ফোন। আমাদের সকল প্রস্তাব অজিত মন্ডলের সংসদে পাস হয়েছে। আমরা যেনো সকালের নাস্তা করতে ইন্দিরা রোডে যাই। আর আমি যেনো অজিত কাকুকে একটা ফোন করি। আমরা হৈ হৈ করে উঠলাম। শ্যামলের বউদিও খুব খুশি। আমরা সবাই মিলে ইন্দিরা রোডে আসলাম। প্রকাশ আর মামুনেক লাগেজ গোছানোর দায়িত্ব দিয়ে আমি আর শ্যামল অজিত কাকুর তেজগাঁও অফিসে গেলাম। আমাদের জন্য আরো সুখবর। অজিত মন্ডল চার হাজার ইউএস ডলার রেডি করেছেন। আমরা ডলার নিয়ে কাকুকে বললাম, চারটার মধ্যে আপনি বাসায় আসবেন। কাকু বললেন, ডন, রফিক, শাহেদ ওদেরও দুপুরে বাসায় ডাকো তোমরা। আর আমাদের বন্ধু খোকন অজিত মন্ডলের অফিসের একাউন্ট্যান্ট। কাকু বললেন, খোকনকে লাঞ্চের আগে পাঠিয়ে দেব। সন্ধ্যায় আমরা চার গাড়ি আর এক কারে করে সবাই এয়ারপোর্ট গেলাম। রাত আটটায় প্রকাশ আর শিউলি ঢাকা ত্যাগ করলো।

২০০৩ সালে প্রকাশ দেশে ফিরে বিয়ে করলো। প্রকাশের বউয়ের নাম টপি সাহা। রাজবাড়ির মেয়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রসায়নে মাস্টার্স। প্রকাশ-টপি'র এক ছেলে। ছেলের নাম নীল প্রকাশ। নীলের বয়স এখন সাত বছর। এ বছর প্রকাশ ঢাকায় এসেছিল ফেব্রুয়ারি মাসে। আমি ব্যস্ত ছিলাম আমার চতুর্থ গল্পগ্রন্থ 'ভূমিপুত্র' প্রকাশনা নিয়ে। বন্ধু আমার ফোনে কথা বললো। দেখা করার সময় পেল না। আমার বাসায়ও আসলো না। আমাকেও বাসায় যেতে বললো না। আহা বন্ধু আমার। মাত্র ১৪ বছরে এভাবে কানাডিয়ান হয়ে গেলি। আর আগে বাথরুমেও একসাথে যেতাম। একসাথে একই ঝর্নায় গোসল করতে দু'জনের কারোরই কোনো সমস্যা হতো না। আর এখন? দুনিয়া কি সত্যি এভাবে বদলে যায়? আমি বিশ্বাস করতে চাই না....



মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.