নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

বাংলাদেশ আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা...

বাংলাদেশ আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা...

রেজা ঘটক

ছোটগল্প লিখি। গান শুনি। মুভি দেখি। ঘুরে বেড়াই। আর সময় পেলে সিলেকটিভ বই পড়ি।

রেজা ঘটক › বিস্তারিত পোস্টঃ

বন্ধুদের আমলনামা-৬ : : গোসাই'র হাটের ফেরিওয়ালা সুনীল কুমার মন্ডল ।। রেজা ঘটক

২৪ শে জুন, ২০১৩ দুপুর ২:৪৮

সুনীল খাবার সময় একদম কথা বলতো না। আমরা সুনীল সুনীল সুনীল...করে গলা ফাটিয়ে ফেললেও সুনীলের কোনো সাড়া শব্দ নেই। সুনীলের মা উঠোনে নেমে কইতো, সুনীল খাইতেছে। সুনীলের মাকে আমি ডাকি দিদি আর সুনীলের বাবাকে ভাই। সেই হিসেবে সুনীল হল আমার ভাতিজা। সুনীল খুব ভালো ফুটবল খেলোয়ার। আমাদের লেফট ব্যাক। সুনীল না থাকলে লেফট ব্যাকের দুর্বলতা নিয়ে বিপক্ষ দল আমাদের জালে গোল দিয়ে দিত। আমাদের নিয়মিত একাদশ ছিল মোটামুটি এরকম। নিশিকান্ত বালা গোলকিপার। নিশি অনুপস্থিত থাকলে প্রকাশ চন্দ্র মন্ডল গোলকিপার। বীরেন বিশ্বাস স্ট্রপার ব্যাক। সুখময় মজুমদার বীরেনের সামনে মেইন ব্যাক। সুনীল কুমার মন্ডল লেফট ব্যাক। লঙ্কেশ্বর সিংহ রাইট ব্যাক। মাঝমাঠে বিমল কৃষ্ণ হিরা। সুনীলের সামনে লেফট উয়িং রেজাউল করিম মিঠুল। লঙ্কেশ্বরের সামনে রাইট উয়িং দিলীপ কুমার মন্ডল। মিঠুলের সামনে লেফট ফরোয়ার্ডে সুবোধ চন্দ্র বৈরাগী। দিলীপের সামনে রাইট ফরোয়ার্ডে শেখ মোহাম্মদ এনায়েত। আর মেইন ফরোয়ার্ডে আমি। কখনো আমি মাঝমাঠে খেললে বিমলা হিরা মেইন ফরোয়ার্ডে খেলতো। কখনো মিঠুল লেফট ফরোয়ার্ডে খেললে সুবোধ লেফট উয়িংয়ে চলে যেতো। কখনো দিলীপ রাইট ফরোয়ার্ডে খেললে এনায়েত রাইট উয়িংয়ে চলে যেতো। কখনো বীরেন সামনের ব্যাকে খেললে সুখময় মেইন স্ট্রপার ব্যাকে খেলতো। বিপক্ষ দলের অবস্থা বুঝেই আমরা এই কম্পিনেশান করতাম। আমাদের নাজিরপুর থানায় আমাদের দল ছিল সেরা ফুটবল টিম। থানা লেভেলে খেলতে গেলে আমরা কিছু সিনিয়র খেলোয়ার নামাতাম। তখন মেইন স্ট্রপার ব্যাকের দায়িত্ব গড়াতো আমার মেঝো ভাই এমদাদের উপর। সুখময় চলে যেতো রাইট উয়িংয়ে। দিলীপ চলে যেতো রাইট ফরোয়ার্ডে। লঙ্কেশ্বরের জায়গায় রাইট ব্যাকে শেখ ছলেমান। এবার আর কে পারে আমাদের সাথে। বিমল-মিঠুল-সুখময় বল বানিয়ে কোনোভাবে দিলীপ-আমি বা সুবোধকে দিতে পারলেই বিপক্ষ দলের গোলকিপারের চোখে শর্সে ফুল ঝড়তো। মাঝে মাঝে আমরা লেফট ফরোয়ার্ডে টিরিপকে নামাতান। টিরিপ ছিল কর্নার কিকে সেরা। কখনো টিরিপের কর্নার কিক বাক খেয়ে এমনিতেই গোল হয়ে যেতো। আমাদের যে কোনো প্লান্টি কিক নিতো এমদাদ, বিমল বা সুনীল। কখনো মিঠুলও নিতো। আর খেলা টাইব্রকারে গড়ালে আমি থাকতাম খুব ঝামেলায়। কারণ শেষ কিক মানে পঞ্চম কিকটি আমার ভাগ্যে গড়াতো মেইন ফরোয়ার্ড হিসেবে। আমি গোল করতে পারলে দল জিততো। আমার কিক বাইরে গেলে আমরা হেরে বসতাম।

আমাদের দলের লেফট ব্যাক সুনীল, লেফট উয়িং মিঠুল, লেফট ফরোয়ার্ড সুবোধ আর আমি ছিলাম বাম পায়ের খেলোয়ার। আমাদের বাম পায়ের কিকই মেইন ভরসা ছিল। আর বাকিদের ডান পা। এছাড়া থ্রোইনে আমার ভাই এমদাদ ছিল দারুণ পটু। ফরোয়ার্ডে আমরা কোনো থ্রোইন পেলে এমদাদ ভাই এতো জোরে বল ছুড়ে মারতো যে সেটা কিকের মতোই বিপক্ষ দলের সরাসরি ডিবক্সে আমাদের উদ্দেশ্যে। সেটাও অনেক গোলের ব্যাপারে কার্যকর ছিল। বীরেন বা সুখময় অসুস্থ থাকলে আমরা গৌতমকে হায়ার করতাম। গৌতম ছিল স্ট্রপার ব্যাক । কিন্তু গৌতম সাইজে খাটো হওয়ার কারণে অনেক সময় হেড দিয়ে বিপক্ষ দল কিছুটা সুবিধা বাগিয়ে নিতো। তাই এমদাদ ভাই মেইন স্ট্রপারের দায়িত্ব নিলে গৌতম তার সামনের ব্যাক পসিশানে খেলতো।

সুনীলের একটা দোষ ছিল হ্যান্ড বল করার। আমারা সবাই বেশি উপরে চলে যাওয়া মুহূর্তে যদি বিপক্ষ দল বল পেয়ে আমাদের ডিবক্সে আক্রমন চালাতো, সুনীল তখন ইচ্ছাকৃত হ্যান্ডবল বানাতো ডিবক্সের বাইরে। এ নিয়ে সুনীল রেফরির কাছ থেকে অনেক হলুদ কার্ডও পেয়েছে। কখনো সুনীলও বল নিয়ে সামনে এগিয়ে সবাইকে অবাক করে দিয়ে হঠাৎ গোল করে দিতো।

ছাত্র হিসেবে সুনীল ছিল ঠেলা পাস মার্কা গোছের। অনেক সময় স্যারদের করুণা নিয়ে পরের ক্লাশে আমাদের সঙ্গে উঠতো। ইংরেজি, অংক আর ভূগোল সুনীলের মাথায় একদম ঢুকতো না। বীজগণিতে তো সুনীল পারলে হাগু করে দিতো। জ্যামিতি সুনীল মুখস্থ করতো। তো আমাদের সঙ্গে এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে সুনীল তিন পেপারে ডাব্বা মারলো। সুনীলের বাবা আই জারী করলেন, এখন থেকে খেলা বন্ধ। সুনীল বই নিয়ে বারান্দায় বসে থাকে। আমরা সুনীল বলে একটা চিক্কর মেরেই ওদের বাড়ির সামনের রাস্তা পার হতাম। আমরা মাঠে এসে বুট জার্সি পড়ে দু'দলে ভাগ হবার মধ্যেই সুনীল হাজির হতো। সুনীলের পেছন পেছন সুনীলের ইমিডিয়েট বড় ভাই শুকু আসতো সুনীলকে ডাকতে। আমরা শুকু'র কথায় পাত্তা না দিয়ে খেলতে থাকতাম। শুধু কখনো সুনীলের বাবা মানে আমার দাদু ভাই আসলে সুনীল নিজেই খেলা ছেড়ে দিয়ে দৈমন্তীর বাগান ভিটার দিকে ভো দৌড়।

আমরা ১৯৮৬ সালে এসএসসি পাশ করলাম। সুনীল, সুবোধ, হরিপদ, স্বপন এরা ফেল করায় পরের বছর আবার পরীক্ষা দিল। কিন্তু পরীক্ষার জন্য এরা হরিপদ দা'র পরামর্শে বানড়িপাড়ার বাইশারী স্কুল থেকে ফরম ফিলাপ করলো। কারণ বাইশারী স্কুলে তখন সেন্টার হতো। আর সেখানে খুব নকল করার প্রচলন ছিল। সুনীল, সুবোধ, হরিপদ, স্বপনদের ঠিকমতো নকল সাপ্লাই দেবার জন্য এসিট্যান্ট হিসেবে গেলাম আমি, প্রকাশ আর কাইউম। প্রকাশ কাইউম আর আমি মিলে ডামি হ্যান্ডে স্পেড ট্রাম খেলি। আর ওরা পড়াশুনা নিয়ে ব্যস্ত। প্রথম দিন বাংলা পরীক্ষা। বাইশারী স্কুলের সেন্টারে তখন গার্ড দিতে আসলেন রনজিৎ ঘোড়াই নামে এক ত্যাজী ম্যাজিস্ট্রেট। যার কাছেই রনজিৎ ঘোড়াই নকল পায়, তাকেই এক্সপেল্ট করে। পরীক্ষা শুরু হবার পনের মিনিটের মধ্যে প্রশ্নপত্র বাইরে আমাদের কাছে চলে আসলো। আমরা উত্তরপত্র রেডি করে ভিতরে পাঠানো শুরু করলাম। যে সকল পিয়ন ছাত্রদের জল খাওয়ান, তাদের কাউরে দশ টাকা ধরিয়ে দিলেই সে নকল ঠিকমত পৌঁছে দেয়। এটাই নিয়ম। সুবোধ আর সুনীলের সিট এক রুমে। হরিপদ আর স্বপনের রুম আলাদা আলাদা রুমে। সবারই বাইশারী স্কুলের দোতলায় সিট পড়েছে। আড়াই ঘণ্টা শেষ তখন। 'লাল সালু'র মজিদের দ্বিতীয় স্ত্রী রহিমার উপরে প্রশ্ন একটু ঘুরিয়ে এসেছিল। আমরা উত্তরপত্র রেডি করে ভেতরে পাঠালাম। সুবোধ লেখা শেষ করে সুনীলকে দিল। ঠিক সেই মুহূর্তে রনজিৎ ঘোড়াই সুনীলের রুমে সুনীলকে মার্ক করলেন। সুনীল কিছু লেখার আগেই ধরা খেল। সুনীলের সঙ্গে আর কোনো নকল ছিল না। খাতায় তো নকলের কোনো প্রমাণ নেই। সুনীল অনেক হাত পা ধরলো। কিন্তু রনজিৎ ঘোড়াই পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন হৃদয়ের মানুষ। পরীক্ষা শেষ হবার পনেরো মিনিট আগে সুনীল মুখ ব্যাজার করে বাইরে আসল। সুনীল এক্সপেল্ট। বিকালে বাংলা দ্বিতীয় পত্রে হরিপদ'র দশাও সুনীলের মতো এক্সপেল্ট।

রাতে আমাদের স্পেড ট্রামে আর খেলোয়ার ঘাটতি রইলো না। সুনীল আমাদের সঙ্গে খেলতে চাইলো না। কিন্তু না খেলেও উপায় নেই। কারণ, পরীক্ষার মাঝপথে বাড়িতে গেলে সবাই জানবে যে সুনীল এক্সপেল্ট হয়েছে। সুনীল আর হরিপদ তাই পরীক্ষা শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমাদের সঙ্গেই থেকে গেল। সুনীল আমার পার্টনার। প্রকাশ আর কাইউম পার্টনার। আমরা যে বাড়িতে পরীক্ষার জন্য ভাড়া নিয়েছি সেটা একটি হিন্দু ব্রাহ্মণ বাড়ি। সেই বাড়িতে পৌঁছে আমার নতুন নাম হল তপন। মুসলিম ছেলে ব্রাহ্মণের বাড়িতে খাচ্ছে থাকছে টের পেলেই সর্বনাশ। সুবোধদের তখন থাকার জন্য নতুন বাড়ি কুঁজতে হবে। তাস খেলার মাঝে সুনীল হঠাৎ ভুল করে আমাকে রেজা ডেকে ফেললো। পাশের রুমে সেই বাড়ির অরুণ'দার স্ত্রী আমাদের সকলের ভারী কাছের বৌদি সেই ডাক শুনতে পেলেন। কিন্তু পাশের রুম থেকে দেখা যায় না বলে ঠাওর করতে পারলেন না কে মুসলিম? সুবোধদের পরীক্ষা বাড়তি সাবধনতার সঙ্গে ভালোমতোই শেষ হল। আমরা আসার দিন বৌদিকে চুপিচুপি বললাম, আমিই রেজা। আর কাইউমও তার রবীন নাম ফেলে দিয়ে আসল নাম বললো। আমার দৃঢ় বিশ্বাস আজ পর্যন্ত সেই সুন্দরী বৌদি আমাদের নাম গোপন করে রেখেছেন।

পরীক্ষার ফলাফল বের হল। স্বপন পাস করলো। সুবোধ আবার ইংরেজিতে গ্যারাইছে। আজ পর্যন্ত সুনীলের ফেলের রহস্য আমরা আর ছাড়া কেউ জানে না। সুনীলের আর পরীক্ষা দেওয়া হল না। মাঠের কাজেই ভিড়ে গেল। সুনীল বিয়ে করেছে। চিংড়ি মাছের খামার করেছে। খামারের ভেরিতে নানা জাতের শবজির চাষ করছে। আর বাড়ির সামনে একটা মুদি দোকান দিছে। সেখানে গোটা গ্রামের রাজনৈতিক সচেতন মহল সন্ধ্যায় বিবিসি শুনতে ভিড় করেন। সুনীলের এক ছেলে। আমি বাড়িতে গেলে সুনীলের দোকানেই এখন মেইন আড্ডা হয়। সুনীলের দোকানে এক সেট দাবা আছে। তাই নিয়ে আমরা বসে যাই। সুনীলের দোকানে গোল্ড লিফ হল হাইয়েস্ট সিগারেট ব্র্যান্ড। বাড়িতে গেলে সুনীল আমার জন্য সেই সিগারেট এনে রাখে। কখনো আমরা সুনীলের চিংড়ির ঘেরের পাশে মাছ দেখার জন্য ঘুরতে যাই। সুনীল এখনো একটুও পাল্টায়নি। আর আমরা যারা নব্য শহুরে হয়ে গেছি, আমরা কতো বদলে গেছি...। সুনীল যেখানেই থাকিস, ভালো থাকিস।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.