নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

বাংলাদেশ আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা...

বাংলাদেশ আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা...

রেজা ঘটক

ছোটগল্প লিখি। গান শুনি। মুভি দেখি। ঘুরে বেড়াই। আর সময় পেলে সিলেকটিভ বই পড়ি।

রেজা ঘটক › বিস্তারিত পোস্টঃ

হিমালয় কন্যার দেশে সাত রজনী। পর্ব তিন ।। রেজা ঘটক

১৪ ই জুলাই, ২০১৩ বিকাল ৩:২২

চলুন আমার 'মা' উপন্যাসের অধ্যায় ষোল থেকে আপনাদের নেপালের একটু ইতিহাস সম্পর্কে ঘুরিয়ে নিয়ে আসি-

হিমালয় কন্যা নেপাল দেশে সবচেয়ে প্রভাবশালী দুইটি পরিবার হলো শাহ পরিবার আর রানা পরিবার। এই দুই পরিবারের মধ্যে যেমন আছে চির শক্রুতা তেমনি আবার দুই পরিবারের মধ্যে ছেলেমেয়েদের বিয়ের ব্যাপারটি বেশ নজর কাড়ার মতো। পৃথ্বী নারায়ন শাহ হলেন ‘দ্রব্য শাহ’ পরিবারের নবম জেনারেশান। যাঁর হাতে আধুনিক নেপালের জন্ম। বাবা রাজা নর ভূপাল শাহের কাছ থেকে ক্ষমতা পাবার পরে পৃথ্বী নারায়ন শাহ ১৭৪৩ সালে গুর্খা রাজা নিযুক্ত হন। নতুন গুর্খা রাজা পৃথ্বী নারায়ন শাহ ১৭৪৪ সালে নোয়াকুট দখল করেন। পরের বছর তিনি কাঠমুণ্ডু ভ্যালী দখল করেন। আর ১৭৫৬ সালে তিনি তিব্বতের সঙ্গে কাঠমুণ্ডু ভ্যালীর ব্যবসায়িক যোগাযোগ বন্ধ করে দেন। ঠিক পরের বছর তিনি কীর্তিপুর দখল করেন। ওই সময় কীর্তিপুরের নারী ও শিশু ব্যতিত সকল পুরুষের তিনি নাক ও ঠোঁঠ কাটার নির্দেশ দেন। যারা তাঁর নির্দেশ অমান্য করেছিল তাদের তখন গণহারে হত্যা করা হয়েছিল।



১৭৬৯ সালে রাজা পৃথ্বী নারায়ন শাহ কাঠমুণ্ডুকে নেপালের রাজধানী হিসেবে ঘোষণা করেন। ১৭৭৩ সালে তিনি সেনা রাজ্য চৌচণ্ডি দখল করেন। এরপর তিনি বিজয়পুর দখল করেন। রাজা পৃথ্বী নারায়ন শাহের নেপাল বর্তমান নেপালের চেয়ে অন্তঃত দ্বিগুন বড় ছিল। তখন ভারতের পাঞ্জাব থেকে সিকিম পর্যন্ত নেপালের বিস্তৃতি ছিল। ১৭২৩ সালে রাজা পৃথ্বী নারায়ন শাহের প্রিম্যাচুরি জন্মের কারণে তাঁর মা কৌশল্যবতী শাহের পরিবর্তে তাঁকে প্রতিপালন করেন তাঁর বড় মা চন্দ্র প্রভাবতী শাহ। আর তখন তাঁর বাবা রাজা নর ভূপাল শাহ প্রায়ই মন্দিরে প্রার্থণা করে কাটাতেন। তাই ছোটবেলা থেকেই রাষ্ট্রীয় ব্যাপার স্যাপারে পৃথ্বী নারায়নকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হলো। ১৭৪৩ সালে রাজা নর ভূপাল শাহের মৃত্যু হলে গুর্খার নতুন রাজা হন পৃথ্বী নারায়ন শাহ। তখন পৃথ্বী নারায়ন শাহের বয়স মাত্র ২০ বছর। ৩২ বছর প্রচণ্ড প্রতাপে গুর্খা (১৭৪৩ থেকে ১৭৬৯) ও নেপাল (১৭৬৯ থেকে ১৭৭৫) রাষ্ট্র শাসনের পর ১৭৭৫ সালে মাত্র ৫২ বছর বয়সে রাজা পৃথ্বী নারায়ন শাহ মারা যান।



রাজা পৃথ্বী নারায়ন শাহের মৃত্যুর পর নেপালের নতুন রাজা হলেন তাঁর বড় ছেলে প্রতাপ সিং শাহ। রাজা প্রতাপ সিং শাহ ১৭৫১ সালে জন্মগ্রহন করেন। মাত্র ২৪ বছর বয়সে নেপালের রাজা হলেও মাত্র দুই বছর পরে ১৭৭৭ সালে তাঁর অকাল মৃত্যুর কারণে নেপালের নতুন রাজা হন মাত্র দুই বছর বয়সি প্রতাপ সিং শাহের ছেলে রানা বাহাদুর শাহ। নতুন রাজা বয়সে একদম ছোট হওয়ায় রাজ দায়িত্ব পালন করেন তাঁর মা রানী রাজেন্দ্র লক্ষী। ১৭৮৫ সালে রাজা রানা বাহাদুর শাহের মা রাজেন্দ্র লক্ষী মারা গেলে রাজ দায়িত্ব পালনের ভার পরে শিশু রাজা রানা বাহাদুর শাহের চাচা বাহাদুর শাহের উপর।



বাহাদুর শাহ তখন নেপালের আয়তন আরো বড় করেন। তিনি ভারতের গারোয়াল ও কুমাউন এলাকা দখল করেন। বাহাদুর শাহ ১৭৯৯ সালে নেপালের নতুন রাজা হিসেবে তাঁর নাবালক শিশুপুত্র গিরভান যুদ্ধ বিক্রম শাহ দেব-এর নাম ঘোষণা করেন। এই নিয়ে তখন রাজ পরিবারে শুরু হয় অসস্তোষ। ১৮০৫ সালে বাহাদুর শাহ তাঁর সৎভাই শের বাহাদুর শাহের হাতে খুন হন। রাজা গিরভান যুদ্ধ বিক্রম শাহ দেব নাবালক হওয়ায় রাজ দায়িত্ব পরিচালনা করেন রানী মাতা ললিত ত্রিপুরা সুন্দরী ও প্রধানমন্ত্রী ভীমসেন থাপা। মাত্র ১৯ বছর বয়সে ১৮১৬ সালে রাজা গিরভান যুদ্ধ বিক্রম শাহ দেব মারা গেলে নেপালের নতুন রাজা হন তাঁর শিশুপুত্র রাজেন্দ্র বিক্রম শাহ দেব। তখনো নেপাল শাসন করেন মূলত রানী মাতা ললিত ত্রিপুরা সুন্দরী ও প্রধানমন্ত্রী ভীমসেন থাপা। এমনকি রাজ দরবারের বাইরেও রাজা রাজেন্দ্র বিক্রমের যাবার অনুমতি মিলতো না তখন। ১৮৩২ সালে রাজা রাজেন্দ্র প্রধানমন্ত্রী ভীমসেন থাপা ও ভীমসেন থাপার ভাতিজা মাতবর সিংকে ছুরিকাঘাত করেন। জনশ্রুতি রয়েছে যে, ভীমসেন ও মাতবর সিং মিলে রাজা রাজেন্দ্র’র বড় মা’র ছোট ছেলেকে বিষপানে খুন করেছিল। পরে প্রধানমন্ত্রী ভীমসেন থাপা ১৮৩৯ সালে জেলে থাকাকালীন সুইসাইড করেন। ১৮৪৩ সালে রাজা রাজেন্দ্র বিক্রম ঘোষণা করেন যে, একমাত্র ছোট রানী লক্ষী দেবী তাঁকে রাষ্ট্রীয় কাজে উপদেশ দিতে পারবেন। আর সব নির্দেশ এমন কি নিজ পুত্র সুরেন্দ্র বিক্রমকেও মানতে হবে। এই নিয়ে রাজ পরিবারে তখন আবারো দ্বন্দ্ব সংঘাত শুরু হয়। জং বাহাদুর তখন নেপালের প্রধানমন্ত্রী। তাঁর নের্তৃত্বে ১৮৪৬ সালে রাজ দরবারে আবারো অভ্যুত্থান হয়। রাজা রাজেন্দ্র ও রানী লক্ষী দেবীকে গ্রেফতার করে বেনারশীতে জেলে পাঠানো হয়। জেলে থাকা অবস্থায় রাজা রাজেন্দ্র বিক্রম ক্ষমতা ফেরত পাবার চেষ্টা করেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী জং বাহাদুর প্রিন্স সুরেন্দ্র বিক্রম শাহকে রাজা ঘোষণা করেন এবং জেল থেকে জোরপূর্বক রাজা রাজেন্দ্র বিক্রমের সম্মতিপত্র আদায় করেন। পরে রাজা রাজেন্দ্র বিক্রমকে ভক্তপুর জেলে নির্বাসনে পাঠানো হয়। নতুন রাজা সুরেন্দ্র বিক্রম শাহ ১৮৪৭ সালে নেপাল শাসনের সুযোগ পান। তিনি ১৮৮১ সাল পর্যন্ত রাজা হিসাবে নেপাল শাসন করেন।

রাজা সুরেন্দ্র’র ছেলে প্রিন্স ত্রিল বীর বিক্রম শাহ প্রধানমন্ত্রী জং বাহাদুরের দুই মেয়েকে বিয়ে করেন। কিন্তু ১৮৭৮ সালে প্রিন্স ত্রিল বীর বিক্রম শাহ মারা গেলে ক্ষমতার উত্তরাধীকার হন তাঁর ছেলে প্রিন্স পৃথ্বী বীর বিক্রম শাহ। প্রিন্স পৃথ্বী বীর বিক্রম শাহ ১৮ আগস্ট ১৮৭৫ সালে জন্মগ্রহন করেন। রাজা পৃথ্বী বীর বিক্রম শাহ’র বড় মেয়ে প্রিন্সেস রয়্যাল লক্ষী দেবী শাহ বিয়ে করেন ফিল্ড মার্শাল কায়ছার এসজেবি রানাকে। এবং লক্ষী দেবী নতুন রানী হবার জন্য ক্রাউন পড়েন। তখন পর্যন্ত রাজা পৃথ্বীর চারটি সন্তানই মেয়ে। এরপর তাঁর পুত্র সন্তান হয়। তাঁর নাম প্রিন্স ত্রিভূবন বীর বিক্রম শাহ দেব। ১৯১১ সালের ১১ ডিসেম্বর রাজা পৃথ্বী বীর বিক্রম শাহ দেব মারা গেলে নতুন রাজা হন তাঁর ছেলে ত্রিভূবন বীর বিক্রম শাহ দেব।



২৩ জুন ১৯০৬ সালে রাজা ত্রিভূবন বীর বিক্রম শাহ দেব জন্মগ্রহন করেন। মাত্র পাঁচ বছর বয়সে ১১ ডিসেম্বর ১৯১১ সালে তাঁর বাবা রাজা পৃথ্বী বীর বিক্রম শাহ দেব মারা গেলে ত্রিভূবন বীর বিক্রম শাহ দেব নেপালের নতুন রাজা হন। ২০ ফেব্রুয়ারি ১৯১৩ সালে তিনি মায়ের কাছ থেকে রাজার মুকুট পড়েন। তরুণ রাজা ত্রিভূবন ও প্রধানমন্ত্রী এইচএইচ শ্রী শ্রী চন্দ্র শমসের জং বাহাদুর রানা তখন আবারো কলহে জড়িয়ে পড়েন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে প্রধানমন্ত্রী চন্দ্র শমসের জং বাহাদুর রানা বৃটেনকে সমর্থন করেন। ওদিকে রাজা ত্রিভূবন তখন প্রজা পরিষদের নের্তৃত্ব দিতেন। কিন্তু তরুন রাজাকে প্রজাদের সমর্থণ প্রধানমন্ত্রী চন্দ্র শমসের জং মানতে চাননা। তিনি রাজা ত্রিভূবনের পিছনে লাগলেন। এক পর্যায়ে ক্ষমতা বলে রাজা ত্রিভূবনকে সপরিবারে ভারতে নির্বাসনে পাঠান। এরপর নেপালে নতুন প্রধানমন্ত্রী হন মোহন শমসের। তিনি রাজা ত্রিভূবনের সঙ্গে আলোচনা করে তাঁকে দেশে ফিরিয়ে আনেন। ১৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৫১ সালে রাজা ত্রিভূবন আবারো নেপালের ক্ষমতা ফেরত পান। ১৯৫৫ সালের ১৩ মার্চ রাজা ত্রিভূবন মারা যান। তখন নেপালের নতুন রাজা হন প্রিন্স মহেন্দ্র বীর বিক্রম শাহ দেব।



১৯২০ সালের ১১ জুন রাজা মহেন্দ্র বীর বিক্রম শাহ দেব জন্মগ্রহন করেন। ১৯২০ সালে তিনি বিয়ে করেন জেনারেল হরি শমসের রানার মেয়ে ইন্দ্র রাজ্যলক্ষী দেবীকে। রাজা মহেন্দ্র বীর বিক্রম শাহ দেব ও রানী ইন্দ্র রাজ্যলক্ষী শাহ দেব-এর তিন ছেলে বীরেন্দ্র, জ্ঞানেন্দ্র ও ধীরেন্দ্র আর তিন মেয়ে শান্তি, শারদা ও শোভা। ২৮ ডিসেম্বর ১৯৪৫ সালে তাঁদের প্রথম সন্তান বীরেন্দ্র বীর বিক্রম শাহ দেবের জন্ম হয়। ১৯৫০ সালে রানী ইন্দ্র রাজ্যলক্ষী মারা যান। ১৯৫২ সালে রাজা মহেন্দ্র আবার রানী ইন্দ্র’র ছোট বোন রত্না রাজ্যলক্ষী দেবীকে বিয়ে করেন।



১৯৭২ সালে রাজা মহেন্দ্র বীর বিক্রম শাহ দেব ভাতপুরে শিকার করার জন্য যান। সেখানে ৩১ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে তিনি মারা যান। জনশ্রুতি রয়েছে যে, রাজা মহেন্দ্র শিকারের নামে আসলে সুইসাইড করেছিলেন। এরপর রীতি অনুযায়ী নেপালের নতুন রাজা হন রাজা মহেন্দ্র’র বড় ছেলে বীরেন্দ্র বীর বিক্রম শাহ দেব। রাজা বীরেন্দ্র হলেন নেপালের প্রথম রাজা যিনি ফরমাল এডুকেশানের জন্য বিলেত গমন করেছিলেন। তিনি দার্জিলিং-এর সেন্ট যোসেফ কলেজে পড়াশুনা করেছিলেন। ১৩ মার্চ ১৯৫৫ সালে তাঁর দাদুভাই রাজা ত্রিভূবন মারা গেলে তাঁর বাবা মহেন্দ্র বীর বিক্রম শাহ দেব নেপালের নতুন রাজা হন। আর তিনি পড়েন প্রিন্স মুকুট। তারপর তিনি ১৯৫৯ সাল থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত বৃটেনের এটন কলেজে পড়াশুনা করেন। তারপর তিনি ১৯৬৭ সাল থেকে ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হার্বার্ডে রাজনীতির উপর পড়াশুনা করেন। এর আগে তিনি কিছু দিন জাপানের টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়েও পড়াশুনা করেন।



২৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৭০ সালে পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে জাকজমক উৎসবের মাধ্যমে বিয়ে করেন প্রিন্স বীরেন্দ্র বীর বিক্রম শাহ দেব। জেনারেল কেন্দ্র শমসের জং বাহাদুর রানা’র বড় মেয়ে ঐশ্বরিয়া রাজ্যলক্ষী রানাকে। তাঁদের দুই ছেলে এক মেয়ে। বড় ছেলে প্রিন্স দীপেন্দ্র ২৭ জুন ১৯৭২ সালে জন্মগ্রহন করেন। তারপর ১৫ অক্টোবর ১৯৭৬ সালে জন্মগ্রহন করেন প্রিন্সেস শ্রুতি। আর প্রিন্স নির্জনের জন্ম ৬ নভেম্বর ১৯৭৭ সালে।



প্রিন্স দীপেন্দ্র ইংল্যান্ডের এটন কলেজে ভর্তি হন ১৯৮৭ সালে। ইংল্যান্ডে প্রিন্স দীপেন্দ্র’র লোকাল গার্ডিয়ান তখন রাজা বীরেন্দ্র’র বন্ধু বর্নট জেরেমি বাগ। জেরেমি’র ছেলে চার্লস আর মেয়ে শেলীও তখন এটন কলেজে পড়াশুনা করতো। শেলী’র খুব ঘনিষ্ঠ বান্ধবী তখন নেপালের আরেক রানা দিব্যানী। জেরেমি’র ইংল্যান্ডের নরফোক হোমের বাড়িতে প্রিন্স দীপেন্দ্র আর রানা দিব্যানীর প্রথম পরিচয় ঘটে। সেই থেকে তাঁদের মধ্যে শুরু হয় প্রেম। আর তখন প্রিন্স দীপেন্দ্র দিব্যানীকে বিয়ের প্রস্তাব দেন।



প্রিন্স দীপেন্দ্র ১৯৯০ সালে দেশে ফিরে পরিবারকে তাঁর পছন্দের কথা জানান। কিন্তু প্রিন্স দীপেন্দ্র’র মা রানী ঐশ্বরিয়া রাজ্যলক্ষী রানা এই বিয়েতে অমত দেন। তখন থেকেই রাজ পরিবারে নতুন করে আবারো শুরু হয় পারিবারিক অসন্তোষ। এই খবর প্রিন্স দীপেন্দ্রর চাচা প্রিন্স জ্ঞানেন্দ্র খুব ভালো করেই জানতেন। তখন থেকেই শুরু হয় প্রিন্স জ্ঞানেন্দ্র’র কুট কৌশল। প্রিন্স দীপেন্দ্রকে তিনি নানাভাবে রাজা বীরেন্দ্র ও রানী মাতা সম্পর্কে ক্ষেপিয়ে তোলেন। আর আড়ালে ভারতের ইনটেলিজেন্স এজেন্সি 'র' (রিসার্স এ্যান্ড এনালাইসিস উইং)-এর সঙ্গে সম্পর্ক করেন প্রিন্স জ্ঞানেন্দ্র।



১ জুন ২০০১ সাল, শুক্রবার। নেপালের নারায়নহিতি রাজ প্যালেসে তখন সবাই মিলে সন্ধ্যার ডিনারের টেবিলে বসেছেন। প্রিন্স দীপেন্দ্র তখন অত্যাধিক পরিমাণে মদ্য পান করে খুব মাতাল অবস্থায়। এই সময় প্রিন্স দীপেন্দ্র রাজ পরিবারের এক অতিথির সঙ্গে অসৌজন্য আচরণ করেন। ওই অতিথি তখন সেই ঘটনার নালিশ দেন রাজা বীরেন্দ্র’র কাছে। রাজা বীরেন্দ্র তখন ডিনার পার্টি থেকে প্রিন্স দীপেন্দ্রকে চলে যাবার নির্দেশ দেন। রাজা বীরেন্দ্র’র ছোট ছেলে প্রিন্স নির্জন ও প্রিন্স জ্ঞানেন্দ্র’র ছেলে প্রিন্স পরশ তখন প্রিন্স দীপেন্দ্রকে ধরে তাঁর ঘরে পৌঁছে দেন।



এক ঘণ্টা পর প্রিন্স দীপেন্দ্র আবার ওই ডিনার পার্টিতে ফেরত আসেন। সঙ্গে আনেন একটি এমপি-৫কে স্বয়ংক্রিয় মেশিনগান ও একটি এম-১৬ স্বয়ংক্রিয় পিস্তল। প্রিন্স দীপেন্দ্র ডিনার পার্টিতে ঢুকে প্রথমে একটি ফাঁকা আওয়াজ করেন। তারপর তিনি তাঁর বাবা রাজা বীরেন্দ্রকে গুলি করেন। তারপর তাঁর ফুফু শান্তিকে গুলি করেন। এই সময় প্রিন্স দীপেন্দ্রকে থামাতে এগিয়ে আসেন তাঁর ছোট চাচা প্রিন্স ধীরেন্দ্র। প্রিন্স দীপেন্দ্র প্রিন্স ধীরেন্দ্র’র বুকে অস্ত্র ঠেকিয়ে গুলি করেন।

ওই সময় প্রিন্স জ্ঞানেন্দ্র’র ছেলে প্রিন্স পরশ আহতাবস্থায় তিনটি শিশুকে সোফার আড়ালে লুকিয়ে রাখতে সক্ষম হন। ওদিকে রানী ঐশ্বরিয়া রাজ্যলক্ষী আর প্রিন্স নির্জন তখন দৌড়ে বাগানে আশ্রয় নেন। কিন্তু প্রিন্স দীপেন্দ্র তখন বাগানে গিয়ে তাঁদের গুলি করে হত্যা করেন। তারপর প্রিন্স দীপেন্দ্র রাজ প্যালেসের ভেতরের সাঁকোর উপর ওঠেন এবং নিজের বুকেও গুলি চালান। পরে ৪ জুন তিনি হাসপাতালে মারা যান।



১ জুন ২০০১ সালের নেপালের ওই রাজ পরিবারের হত্যাযজ্ঞে মোট ১০ জন রাজ পরিবারের সদস্য নিহত হন। আহত হন ৫ জন। নিহত রাজ পরিবারের সদস্যরা হলেন রাজা বীরেন্দ্র বীর বিক্রম শাহ দেব, রানী ঐশ্বরিয়া রাজ্যলক্ষী রানা শাহ দেব, প্রিন্স দীপেন্দ্র বীর বিক্রম শাহ দেব, প্রিন্স নির্জন, প্রিন্সেস শ্রুতি, প্রিন্স ধীরেন্দ্র বীর বিক্রম শাহ দেব, প্রিন্সেস জয়ন্তী (রাজা বীরেন্দ্র’র কাজিন), প্রিন্সেস শান্তি (রাজা বীরেন্দ্র’র বোন), প্রিন্সেস শরাদা (রাজা বীরেন্দ্র’র বোন), কুমার খাদগা ( প্রিন্সেস শারদার স্বামী)। আর আহত রাজ পরিবারের সদস্যরা হলেন প্রিন্সেস শোভা (রাজা বীরেন্দ্র’র বোন), কুমার গোরখ (প্রিন্সেস শ্রুতি’র স্বামী), প্রিন্সেস কমল (প্রিন্স জ্ঞানেন্দ্র’র স্ত্রী), প্রিন্সেস কেটাকী চেষ্টার (রাজা বীরেন্দ্র’র কাজিন) ও প্রিন্স পরশ ( প্রিন্স জ্ঞানেন্দ্র’র ছেলে)।

ওই সময় নেপালের মাওবাদী কমুনিস্ট পার্টির চেয়ারম্যান এক জনসভায় দাবী করেন যে, ভারতের ষড়যন্ত্রে নেপালের রাজ পরিবারে হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। প্রকৃত জনশ্রুতি হলো, প্রিন্স জ্ঞানেন্দ্র বীর বিক্রম শাহ দেব নিজে রাজা হবার জন্য ভারতের 'র’-এর সহায়তায় নেপালের রাজ পরিবারে অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে হত্যাযজ্ঞ ঘটিয়েছেন। কারণ, ওই সময় রাজা হবার জন্য প্রিন্স জ্ঞানেন্দ্র ছিলেন তিন নম্বরে। তিনি রাজা বীরেন্দ্র’র মেজো ভাই। রাজা বীরেন্দ্র’র ছেলে প্রিন্স দীপেন্দ্র তখন রাজা হবার যোগ্য। এক ঢিলে দুই পাখি মারা যাবার পর তিন নম্বর অপশান তখন তাঁর জন্যে উন্মুক্ত হয়। কারণ, প্রিন্স দীপেন্দ্রকে রাজ প্যালেসের যে সাঁকোর নীচ থেকে উদ্ধার করে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় হাসপাতালে নেওয়া হয় তখন সেখানে কোনো স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র পাওয়া যায়নি। আর ওই সময় নেপালে প্রিন্স জ্ঞানেন্দ্র ও তাঁর ছেলে প্রিন্স পরশের উপর নেপালের জনগণের প্রচণ্ড ক্ষোভ ছিল। জনগণের সঙ্গে তাঁরা দু’জনেই খুব খারাপ ব্যবহার করতেন।



নেপালের সাংবাদিক কৃষ্ণ ভট্টরাই রাজ পরিবারের ওই হত্যাকাণ্ড নিয়ে দীর্ঘ দিন গবেষণা করেছেন। তিনি রাজ পরিবারের ওই হত্যাকাণ্ডের একজন প্রত্যক্ষ সাক্ষীর বর্ণনা শুনে একটি ঐতিহাসিক উপন্যাস লিখেছেন। যা ২০০৮ সালে আমেরিকা থেকে প্রকাশিত হয়। সাংবাদিক কৃষ্ণ ভট্টরাই নিজের নাম পাল্টে ওই বইয়ে লেখক হিসেবে ছদ্মনাম ব্যবহার করেন। তিনি লেখক হিসাবে কৃষ্ণ অবিরাল নাম নেন। বইয়ের নাম দেন 'রক্তকুণ্ড'। 'রক্তকুণ্ডে' নেপালের রাজ পরিবারের হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে রাজ পরিবারের আয়া শান্তার বর্ণনা হুবহু লিপিবদ্ধ করা হয়। শান্তা রানী মাতা রত্না রাজ্যলক্ষী রানা শাহ দেব-এর আয়া ছিলেন। ওই ঘটনা তিনি সরাসরি প্রত্যক্ষ করেন। শান্তা যাতে মিডিয়ার কাছে কোনো তথ্য ফাঁস করতে না পারে সেজন্যে তার উপর সব সময় নিষেধাজ্ঞা জারী ছিল খোদ রাজ পরিবার থেকেই। ওই হত্যাকাণ্ডে শান্তার স্বামী ত্রিলোচন আচার্যও প্রাণ হারান। তিনিও রাজ পরিবারে চাকরি করতেন।



শান্তা’র ভাষ্য অনুযায়ী, প্রিন্স দীপেন্দ্র নিজের ঘরেই মাতাল অবস্থায় পরে ছিলেন। প্রিন্স দীপেন্দ্র’র ইউনিফর্ম পরিহিত দুইজন লোক ওই সময় ডিনার পার্টিতে স্বয়ংক্রিয় মেশিনগান নিয়ে হামলা চালায়। প্রিন্স জ্ঞানেন্দ্র ওই সময় শহরের বাইরে পোখরায় অবস্থান করছিলেন। প্রিন্স দীপেন্দ্রকে গুলি করে পরে তাঁকে সাঁকোর নিচে ফেলে রাখা হয়। রাজা বীরেন্দ্র নিহত হবার পর অটোমেটিক রাজা তখন গুলিবিদ্ধ প্রিন্স দীপেন্দ্র বীর বিক্রম শাহ দেব। আহত প্রিন্স দীপেন্দ্র পরে ৪ জুন ২০০১ হাসপাতালে প্রাণ হারালে প্রিন্স জ্ঞানেন্দ্র নিজেকে নেপালের পরবর্তী রাজা হিসেবে ঘোষণা দেন।



রাজা জ্ঞানেন্দ্র বীর বিক্রম শাহ দেব ১৯৪৭ সালের ৭ জুলাই জন্মগ্রহন করেন। সৌভাগ্যবশত শিশু জ্ঞানেন্দ্র তিন বছর বয়সে একবার নেপালের রাজা হয়েছিলেন। রানা পরিবারের ষড়যন্ত্রে ১৯৫০ সালের ৭ নভেম্বর নেপালের রাজ পরিবারে হামলা চালানো হলে রাজা ত্রিভূবন বীর বিক্রম শাহ দেব তখন পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ভারতে নির্বাসিত হন। নেপালের প্রধানমন্ত্রী তখন চন্দ্র শমসের জং বাহাদুর রানা। তিনি রাজা ত্রিভূবনকে ভারতে নির্বাসনে যেতে বাধ্য করেন এবং রাজা ত্রিভূবনের নাতী শিশু জ্ঞানেন্দ্রকে নতুন রাজা হিসেবে ঘোষণা দেন। উল্লেখ্য তখন রাজা ত্রিভূবনের সঙ্গে তাঁর ছেলে প্রিন্স মহেন্দ্র, নাতী প্রিন্স বীরেন্দ্র ও নাতী প্রিন্স জ্ঞানেন্দ্রও রাজ পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের সঙ্গে ভারতে নির্বাসিত হন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী চন্দ্র শমসের জং বাহাদুর শাহ তখন প্রিন্স জ্ঞানেন্দ্রকেই রাজা নির্বাচিত করেছিলেন।



পরবর্তীতে প্রধানমন্ত্রী রানা মোহন জং বাহাদুরের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে রাজা ত্রিভূবন বীর বিক্রম শাহ দেব সপরিবারে আবার ১৯৫১ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি নেপালে ফেরত আসেন এবং রাজার দায়িত্ব পালন করতে শুরু করেন। ১৩ মার্চ ১৯৫৫ সালে রাজা ত্রিভূবনের মৃত্যু হলে নতুন রাজা হন তাঁর ছেলে প্রিন্স মহেন্দ্র বীর বিক্রম শাহ দেব।



নেপালের রাজ পরিবারে ১ জুন ২০০১ সালের ওই নৃসংশ হত্যাযজ্ঞের পর আবারো ৪ জুন ২০০১ সালে জ্ঞানেন্দ্র নিজেকে নেপালের পরবর্তী রাজা হিসেবে ঘোষণা দেন। রাজ পরিবারের হত্যাকাণ্ড তদন্তের জন্য তিনি দুই সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেন। নেপালের সুপ্রিম কোর্টের তখনকার প্রধান বিচারপতি কেশব প্রসাদ উপাধ্যায় ও নেপালের সংসদের হাইজ অব রিপ্রেজেন্টেটিভ-এর স্পিকার তারানাথ রানাভাটকে ওই তদন্ত কমিটির সদস্য করা হয়। তাঁরা তদন্ত শেষে রাজ পরিবারে হত্যাকাণ্ডের জন্য প্রিন্স দীপেন্দ্র’র বিয়ে নিয়ে জটিলতা সংক্রান্ত রাজ পরিবারের অসন্তোষকেই দায়ী করেন। প্রিন্স দীপেন্দ্র ওই সময় অধিক পরিমাণে মদ্য পান করেছিলেন এবং রাজ পরিবারের নারায়নহিতি প্যালেসের ডিনার পার্টিতে তিনি স্বয়ংক্রিয় মেশিনহগানের সাহায্যে সবাইকে গুলি করে হত্যা করেন এবং পরে নিজেকেও গুলি করে আত্তাহুতি দেবার চেষ্টা করেন। তিনিও তিন দিন পর হাসপাতালে মারা যান।



রাজা জ্ঞানেন্দ্র বীর বিক্রম শাহ দেব ২০০২ সালের অক্টোবর মাসে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী শের বাহাদুর দেউবাকে বরখাস্ত করেন। তিনি রাষ্ট্রের সকল ক্ষমতা নিজে কুক্ষিগত করেন। এরপর তিনি ২০০৫ সালের ১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এককভাবে নেপাল শাসন করেন। ওই সময়ে গোটা নেপালে চরম অব্যবস্থাপনা শুরু হয়। রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনের দাবীতে ধর্মঘট শুরু করে। মাওবাদী কমুনিস্ট পার্টি তখন নেপালী সেনাবাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পরে। গোটা হিমালয় জনপদ তখন অশান্ত হয়ে যায়। ২০০৬ সালের এপ্রিলে মাওবাদীরা রাজধানী কাঠমুণ্ডুর নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার জন্য সরাসরি রাজা জ্ঞানেন্দ্র’র বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। ২১ এপ্রিল ২০০৬ সালে রাজা জ্ঞানেন্দ্র ঘোষণা দেন যে, তিনি রাজনৈতিক দলগুলোর পছন্দের কাউকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মনোনয়ন দিতে চান। যাতে নেপালের গণতন্ত্র রক্ষা পাবে। গিরিজা প্রসাদ কৈরালাকে তখন অর্ন্তবর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ২৪ এপ্রিল ২০০৬ সালে রাজা জ্ঞানেন্দ্র এক টেলিভিশন ভাষণে ১৯৯৯ সালের সংসদকে কার্যকর ঘোষণা দেন। ১০ জুন ২০০৬ সালে গিরিজা প্রসাদ কৈরালার নের্তৃত্বে নেপালের সংসদ সর্বসম্মতিক্রমে রাজার সকল ক্ষমতা অপসারণ করেন। সংবিধানের ১৬৭ নম্বর অনুচ্ছেদ সংশোধনের মাধ্যমে ওই দিন নেপালে ২৩৯ বছরের রাজতন্ত্রের অবসান ঘটে।



..........................চলবে..............

মন্তব্য ৩ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (৩) মন্তব্য লিখুন

১| ১৪ ই জুলাই, ২০১৩ বিকাল ৩:২৫

পরিবেশ বন্ধু বলেছেন: সুন্দর হিমালয় কন্যার বিবরন
আর কথন
ভাল লাগল অভিনন্দন

১৪ ই জুলাই, ২০১৩ বিকাল ৪:১৭

রেজা ঘটক বলেছেন: ধন্যবাদ আপনাকে

২| ০৫ ই অক্টোবর, ২০১৩ রাত ৯:৫০

েবনিটগ বলেছেন: ওঁম মেনে পাদমে হোম

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.