নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

বাংলাদেশ আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা...

বাংলাদেশ আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা...

রেজা ঘটক

ছোটগল্প লিখি। গান শুনি। মুভি দেখি। ঘুরে বেড়াই। আর সময় পেলে সিলেকটিভ বই পড়ি।

রেজা ঘটক › বিস্তারিত পোস্টঃ

হিমালয় কন্যার দেশে সাত রজনী। পর্ব ছয়।। রেজা ঘটক

১৫ ই জুলাই, ২০১৩ সকাল ১১:০৩

পরদিন ৯ এপ্রিল সকালে আমরা গাইয়াতে নাস্তা করে একটু এদিক সেদিক ঘুরলাম। এগারোটায় প্রতীক আসলো। আমরা যাবো পশুপতিনাথ মন্দিরে। ডেনিস নাক্সাল থেকে সরাসরি পশুপতিনাথ মন্দিরে গিয়ে আমাদের সঙ্গে মিলিত হবে। মায়া, প্রতীক আর আমি একটা ট্যাক্সি নিয়ে রওনা হলাম। কাঠমুন্ডু থেকে ১১ কিলোমিটার পূর্বে একেবারে শহরের পূর্ব সীমান্তে বাগমতী নদীর তীরে পশুপতিনাথ মন্দির। এটি পৃথিবীর সবচেয়ে পুরাতন হিন্দু মন্দির। এখন এটি ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজের অংশ। এটিকে বলা হয় মহাশ্রষ্ঠা শিবের মন্দির। পশুপতিনাথ হলেন ভগবান শিব। পশুপতি হলেন বানর। বাগমতি নদীর উভয় পাশে এই মন্দিরকে ঘিরে হাজার হাজার বানরের বসতি। হিন্দু ধর্মের মানুষদের শেষকৃর্ত্য এই পশুপতিনাথ মন্দিরে বাগমতি নদীর তীরে অনুষ্ঠিত হয়।

মায়া'র বাবা ডাক্তার সুরেন্দ্র লোহানী ২০০৯ সালের ২৫ মে মারা গেলে, তার শেষকৃর্ত্যানুষ্ঠানও এখানে হয়েছিল। জায়গাটি সবার কাছে ভারী পবিত্র স্থান। বাগমতী নদী এখন অনেকটা মরে গেছে। কিন্তু এখানেই রোজ নেপালের হিন্দুদের শেষকৃর্ত্য অনুষ্ঠিত হয়। পশুপতিনাথ মন্দিরের সঙ্গে নেপালের সকল হিন্দু মানুষের পূর্বপুরুষদের স্মৃতি জড়িত। এখানেই মৃত সবাইকে দাহ করা হয়েছে। মূল মন্দিরটি আগে ছিল গোটা্টাই স্বর্ণের। এখনো মন্দিরে অনেক কিছুই স্বর্ণের। বিশেষ করে ভগবান শিবের মূর্তি। ধারণা করা হয়, খ্রিষ্টপূর্ব ৪০০ বছর আগে থেকে ভগবান শিব, যিনি পশুদের পিতা, স্বর্গ থেকে এখানে এসে প্রথম বসবাস করেছিলেন। সেই থেকে এখানে এই মন্দিরের অস্তিত্ব। প্রকৃত জনশ্রুতি হল, ভগবান শিব একবার মৃগ সেজে এখানে বাগমতী নদীর পূর্ব তীরের জঙ্গলে খেলা করছিলেন। মৃগ বা হরিণ হল ভগবান শ্রীকৃষ্ণের বাহন। তখন তিনি মহাশ্রষ্ঠা ভগবান বিষ্ণু'র কাছে ধরা পড়েন। তখন তার সিং ভেঙে যায়। সেই ভাঙা সিং এই বাগমতী নদীতে ফেলা হয়। আর ভগবান শিবকে জোরপূর্বক আগের ফরমে ফিরিয়ে নেয়া হয়। কয়েকশো বছর পর এক রাখাল দেখেন যে তার গাভী এই বাগমতী নদীতে দুধ ফেলে দিচ্ছে। দুধ কুড়াতে গিয়ে সে ভগবান শিবের সেই ছদ্মবেশী মৃগের সিং খুঁজে পায়। তখন থেকেই এখানে গ্রামবাসী মিলে ভগবান পশুপতিনাথের নামে এখানে একটি মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন।

আরেকটি জনপ্রিয় জনশ্রুতি হল, ভগবান শিব আর দেবী প্রভাতী কাঠমুন্ডু ভ্যালীতে বেড়াতে এসেছিলেন। তারা বাগমতী নদীতে স্নান করার সময় ওপারের জঙ্গলের সৌন্দর্য দেখে ভগবান শিব আপ্লুত হয়ে পড়েন। তারপর তারা ওই জঙ্গলে ঘুরে বেড়ানোর জন্য দু'জনেই মৃগ সাজলেন। তারপর স্থানীয় গ্রামবাসী ও ভগবান এদের খুঁজতে লাগলেন। কিন্তু প্রভাতীকে পাওয়া গেলেও ভগবান শিব মৃগ ফরমেই রয়ে যান। প্রভাতী'র বাবা ভগবান শিবকে তেমন পছন্দ করতেন না। পরে তাকে ধরতে গেলে তার সিং ভেঙে যায়। আর শিবকে আগের ফরমে জোরপূর্বক বদল করা হয়। সেই সিং এই বাগমতী নদীতে ফেলা হয়। যে কারণে বাগমতী নদী হিন্দুদের কাছে খুবই পবিত্র নদী। আর তখন থেকেই সবার সমাধী হয় এই নদীতে। ধারণা করা হয় পরবর্তীতে ভগববান শিব পশুতে রূপান্তরিত হয়ে এই জঙ্গলেই বসবাস করেন।

আরেকটি জনশ্রুতি হল, প্রভাতী'র বাবা মোটেও ভগবান শিবকে পছন্দ করতেন না। কিন্তু শিব প্রভাতীকে খুব ভালোবাসতেন। তাই ভগবান শিব পৃথিবী মাথায় নিয়ে স্বর্গ থেকে পাতালে রওনা দিলেন। প্রভাতী তখন সতী নামে ভগবান শিবের সঙ্গে অবতরণ করলেন এই বাগমতী নদীর তীরে। পাতালে আসার সময় যেখানে যেখানে শিবের পিঠ থেকে পৃথিবীর খণ্ড ছুটে পড়েছে সেখানেই শিবমন্দির তৈরি হয়েছে। আর মেইন শিব মন্দিরটি এই বাগমতী নদীর তীরে পশুপতিনাথ মন্দির।

বর্তমান মন্দিরটি সপ্তদশ শতকে রাজা ভূপেন্দ্র মাল্লা নির্মাণ করেন। চৌদ্ধদশ শতকে এখানে কয়েকটি বৈষ্ণব মন্দির ও কয়েকটি রাম মন্দিরও নির্মান করা হয়। অষ্টাদশ শতকে আদি শংকরাচার্য্য গোটা ভারতবর্ষে একই নিয়মে শেসকৃর্ত্যানুষ্ঠানের একটি নিয়ম চালু করেছিলেন। মৃতব্যক্তির লাশ চারজন পুরোহিতই কেবল স্পর্শ করতে পারবে। সেই নিয়মে বাগমতী নদীর তীরে শেষকৃর্ত্যানুষ্ঠান হতো। কিন্তু পরবর্তী সময়ে সেই নিয়ম আর অনুসরণ করা হয় না।

আরেকটি জনপ্রিয় জনশ্রুতি হল, ভগবান বিষ্ণু বুদ্ধের রূপ ধারণ করে সৌরাষ্ট্রা থেকে মান্দিহাতু পর্বতের মাঝখানে এসে ধ্যান করছিলেন। তখন তার চারপাশে চারটি আগুনের শিখা ছিল। আর মাথায় ছিল সূর্য। ভগবান বিষ্ণু'র সেই প্রগাঢ় ধ্যানের সময় সৃষ্ট ঘাম থেকেই মনিমতি নদীর উৎপত্তি। এই সময় প্রভাতী দেবী ভগবান বিষ্ণু'র বৌদ্ধ ধ্যানে খুশি হয়ে নিজেও বৌদ্ধ দেবী ভজরাওগিনি সেজে ভগবান বিষ্ণু'র কাছে আশির্বাদ প্রার্থণা করেন। তখন ভগবান বিষ্ণু এই মর্মে আশির্বাদ ঘোষণা করেন যে, বৌদ্ধ ধর্মের মানুষ এই কাঠমুন্ডু ভ্যালী'র পবিত্র জায়গায় শান্তিতে বসবাস করবেন। তখন প্রভাতী দেবীও একটি বর দেন যে, নেপালের এই পবিত্র ভূমিতে শিবের অনুসারীরা আর বৌদ্ধের অনুসারীরা পাশাপাশি শান্তিতে বসবাস করবে। তখন ভগবান বিষ্ণু এই বাগমতী আর মনিমতি নদীর তীরে একটি বিষ্ণু মন্দির আর একটি বৌদ্ধ স্তূপা তৈরি করে দেন। আর এই ভ্যালী তখন থেকেই স্বর্ণ আর রুবীতে ভরে যায়। যে কারণে এই ভ্যালী'র আরেকটি নাম হল পশুপতিপুরী বা ঐশ্বর্যপুরী। শিব মন্দির কেন্দ্রে রেখে এর চারপাশ তখন সোনা আর রুবীতে ভরে ওঠে। আর মন্দির নির্মাণ শেষ হলে ভগবান বিষ্ণু আবার স্বর্গে গমন করেন।

প্রতি মঙ্গলবার পশুপতিনাথ মন্দিরে সূর্যাস্তের পর থেকে অনেক রাত পর্যন্ত কীর্তন হয়। পশুপতিনাথ মন্দিরে এবং বাগমতী নদীর দু'পারে সে এক অভাবনীয় দৃশ্য এবং আবহ সৃষ্টি হয়। আমরা যখন মন্দিরের বেদিতে প্রবেশ করলাম তখন পাশেই চারটি লাশের সৎকৃর্ত্য চলছিল। তাদের আত্মীয়স্বজনরা সেখানে আনুষ্ঠানিকতা করছিল। মায়া বললো, তাতা'র শেষকৃর্ত্যানুষ্ঠানে সকল আনুষ্ঠানিকতা মায়া আর প্রতীককে করতে হয়েছিল। কারণ, ডেনিস তখন চীনে ছিল। আর ডেনিসের মেডিকেল পরীক্ষা চলছিল। বাবাকে মায়া, প্রতীক, ডেনিস আর ডেভিড তাতা ডাকে। ডেনিস আর ডেভিড তখন ওখানে ছিল না। ডেনিস থাকে নেদারল্যান্ড। মায়া আর প্রতীক তখন এই পশুপতিনাথ মন্দিরে বাবার শেষযাত্রায় উপস্থিত ছিল।

খুবই আশ্চার্যের ব্যাপার হল, আমরা চারজন যখন মন্দির রেখে বাগমতী নদীর ব্রিজ পেড়িয়ে ওপারে গিয়ে পাহাড়ের সাথে বানানো সুন্দর বসার জায়গায় বসে পশুপতিনাথ মন্দিরের এক্টিভিটিজ দেখছিলাম, তখন সবাই নিজের মতো চুপচাপ। কারণ, জায়গাটি খুব পবিত্র আর সবার পূর্বপুরুষের সঙ্গে এটি মিশে আছে। আমার তখন বারবার মনে হচ্ছিল, আমি তাতাকে ওপারে দেখেছি। বেশ সুন্দর সুটেট বুটেট যেমনটি তিনি সব সময় থাকতেন। আর আমাদের চারজনকে দেখে তিনি মিটমিট করে হাসছেন। রাতে আমরা হোটেলে ফিরে মায়া আর ডেনিস, প্রকীককে সে কথা বলায়, ওরাও স্বীকার করলো, তাতাকে তারাও দেখেছে। তাতা খুব খুশি। বিশেষ করে সূর্যাস্তের সময় যখন সেখানে সূর্যের শেষ কিরণের বিচ্ছুরন অমন প্রকৃতির সঙ্গে এক ঘোরলাগা আলোর খেলা করছিল, তখন ওরাও নাকি তাতাকে স্পষ্টভাবেই নদীর ওপারে দেখেছে। আর মায়া তো ওই বাগমতী নদীর কাছে গেলেই তাতাকে ফিরে পায়। তাতা'র সঙ্গে মায়া'র শেষ স্মৃতি যে এই নদীর তীরে এই পশুপতিনাথ মন্দিরের সামনে।

সূর্যাস্তের পর নদীর পূর্বপাশে আমরা যেখানে পাহাড়ের উপরে বসেছি, সেখানটার ঠিক নিচে বসলো কীর্তনের আসর। আর নদীর দু'পাড়ে তখন হাজার হাজার মানুষ। কীর্তনের সুরে সুরে সবাই যখন হাতে শব্দ করছিল, তখন এক অভাবানীয় অলৌকিক যাদু তৈরি হয়েছিল সেখানে। পাহাড়, বাগমতী নদী, মন্দিরের আলোকসজ্বা, হাজার হাজার মানুষ নদীর দু'পারে আর তাদের কীর্তনের তালে হাততালি, আর সেই শব্দের প্রতিধ্বনি সব মিলে সেখানে যেনো এক অন্য র্পথিবীর গান হচ্ছিল। সেখানে ধর্মের কোনো ভেদাভেদ ছিল না। সেখানে হিন্দু বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান, মুসলমান সবাই সেই সুর-লহরীতে ধর্মের আবরণ ফেলে এক অন্য জগতে একাকার হয়ে গিয়েছিল।

রোজ পশুপতিনাথ মন্দিরে হাজার হাজার পর্যটক আসেন। আর মঙ্গলবার একটু বেশি। তারা সবাই সেই সুরে তখন পূর্বপুরুষ আর উত্তরপুরুষ, স্বর্গ আর পাতাল, জাগতিক আর মহাজাগতিক সুরের এক অপূর্ব ঘোরলাগা ভূবনে হারিয়ে গিয়েছিল। কীর্তন যখ শেষ হল তখন রাত দশটা। আমি সেই কীর্তনের অনেকটাই ভিডিও করেছিলাম। ক্যামেরার চার্জ ফুরিয়ে যাওয়ায় শেষের দিকে আর রেকর্ড করতে পারিনি। তাতা'র সঙ্গে পশুপতিনাথ মন্দিরের পাশে বাগমতী নদীর পারে এভাবে দেখা করে আমরা একটা ট্যাক্সি নিয়ে থামেলের হোটেলে ফিরলাম।



..................চলবে............................

মন্তব্য ৩ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (৩) মন্তব্য লিখুন

১| ১৫ ই জুলাই, ২০১৩ সকাল ১১:২৮

পরিবেশ বন্ধু বলেছেন: সুন্দর লিখেন
চালিয়ে যান
শুভকামনা

১৫ ই জুলাই, ২০১৩ সকাল ১১:৩০

রেজা ঘটক বলেছেন: ধন্যবাদ আপনাকে

২| ১৬ ই জুলাই, ২০১৩ রাত ১১:১৫

রিমন০০৭ বলেছেন: আপনাদের ভগবান কয়টা? মানে আপনাদের ভগবান বা ঈশ্বরের নাম কি শিব? না কি শিব ছাড়াও আরো ভগবান আছে?

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.