নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

বাংলাদেশ আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা...

বাংলাদেশ আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা...

রেজা ঘটক

ছোটগল্প লিখি। গান শুনি। মুভি দেখি। ঘুরে বেড়াই। আর সময় পেলে সিলেকটিভ বই পড়ি।

রেজা ঘটক › বিস্তারিত পোস্টঃ

।। ভালো লাগা শব্দমালা বনাম ভালো না লাগা বৈরীশব্দ ।।

২৮ শে জুলাই, ২০১৩ রাত ৮:৫৭

আমাদের বাড়ি গোটা গ্রামের মাঝখানে। চারপাশে খোলা মাঠ। বর্ষাকালে সেই মাঠে শুধু থৈ থৈ জল। গ্রামের সাথে একমাত্র সংযোগ কাঁচা রাস্তাটিও বর্ষাকালে মাঝে মাঝে তলিয়ে যেতো। বাইরে যাবার উপায় তখন নৌকা বা কলাগাছের ভেলা। আমাদের বাড়ির সবচেয়ে নিকট প্রতিবেশী হল মোন্তাজ দাদু। মোন্তাজ দাদু'র দুই ছেলে। আমির আর জুমির। আমরা ডাকি আমর দুদু আর জুমির দুদু। বর্ষাকালে দুই দুদু-ই ছোট নৌকায় করে বাড়ির আশে পাশে মাছ ধরতেন। তো, বর্ষাকালে বাবা প্রায়ই বাজার থেকে ফিরতেন রাত করে। আর তখন হালদার বাড়ির উলুবনের পাশে এসে অথবা করিম খাঁদের বাড়ির সামনের ব্রিজের কাছে এসে বাবা হাঁক ছাড়তেন-ওওওওওওওওওও জুমির.....। এপাশ থেকে জুমির দুদুও তখন পাল্টা হাঁক দিতেন- আসতিছিইইইইই....। ছোটবেলায় শোনা বর্ষাকালের এই নিয়মিত শব্দদুটো খুব ভালো লাগতো।

আর বৃষ্টি আসার আগে বৃষ্টির আক্রমন দূর থেকে দেখে খুব ভালো লাগতো। কুমারখালী, হরেঙ্গা, দীঘিরজান গ্রামের পার গ্রাম ভিজিয়ে ফাঁকা মাঠ পারি দিয়ে আমাদের বাড়ি পর্যন্ত আসতে বৃষ্টির অনেক সময় লাগতো। সেই দৃশ্য আসলে লিখে বোঝানো যাবে না। বৃষ্টি শাসন করতে করতে আসতো। তখন আমরা বৃষ্টির একটা শো শো শব্দ শুনতাম। ভারী মুগ্ধ করা সেই শব্দ-সুরের লহরী। উড়ে উড়ে ঘুরে ঘুরে সেই শব্দ আমাদের অন্তর ছুঁয়ে কোন অজানায় যেনো আমাদের হারিয়ে নিয়ে যেতো বৃষ্টির সেই হৃদয় ভোলানো সুর। আর টিনের চালের ঘরে বসে শুয়ে বৃষ্টির মাতম করা রিমঝিম সুরে তো এককথায় আমরা হারিয়ে যেতাম। বৃষ্টির নিজস্ব একটি শব্দ আছে। সেই শব্দটি মন কেড়ে নেবার মতো ভারী অবাক করা এক শব্দ। শব্দটি শুনিয়ে শুনিয়ে ভারী ব্যাকুল করে সে আবার হঠাৎ একসময় দূর গাঁয়ের দিকে রওনা দিতো। কিসের যেনো একটা তাড়া তার। কিসের তাড়া বৃষ্টিকন্যার? বৃষ্টির সেই সব মন মাতানো শব্দগুলো ভারী ভালো লাগতো। কিন্তু মেঘের গর্জন শুনলে হঠাৎ বুক ধরফর করতো। কেমন যুদ্ধের কামানের গোলার মতো গুড়ুম গুড়ুম ভয়ংকর সেই শব্দ।

গ্রামে কোনো বাড়িতে বিয়ের অনুষ্ঠান থাকলে সেই বাড়িতে মাইক বাজতো। দিনে সেই মাইকের গান ভারী বিরক্ত লাগতো। কিন্তু রাতের বেলায়? জগন্ময় মিত্র যখন গেয়ে উঠতেন- তুমি আজ কতো দূরে, তুমি আজ কতো দূরে...কিংম্বা লতা মুঙ্গেশকার যখন গাইতেন- হাসি হাসি পড়বো ফাঁসি, দেখবে ভারতবাসী...একবার বিদায় দে না ঘুরে আসি...অথবা হেমন্ত মুখোপাধ্যায় যখন গাইতেন- রানার ছুটেছে ওই ঝুমঝুম ঘণ্টা বাজছে রানার....যা শুনতে শুনতে কোথায় যেনো এক অজানা রাজ্যে হারিয়ে যেতাম। ভারী চিত্তহারা সেই সব রাতের সেই সব ভূবনময়ী শব্দযুগল।

প্রয়োজন ছাড়া আমার হাটে যেতে একদম ভালো লাগতো না। হাটের ভিড়টা আমার একদম অসহ্য লাগতো। কিন্তু হাটে না গেলে তুহিন আর আমি যখন সারা বিকেল আমাদের ফাঁকা রাস্তায় বসে বসে দুনিয়ার সব গপ্পো করে করে সূর্যাস্ত দেখতাম, ভারী মজা লাগতো। সেই সময় হাটের শব্দে আমরা প্রায়ই কান পাততাম। ভারী একটা দুর্বোদ্ধ শব্দ সেই হাটের শব্দে। যার তর্জমা করার জন্য কোনো পণ্ডিৎ বুঝিবা এখনো জন্মগ্রহন করেনি। দূর থেকে সেই হাটের শব্দ ভারী ভালো লাগতো। কিন্তু হাটে গিয়ে সেই বিশেষ শব্দ সারা হাটের কোথাও খুঁজে পাওয়া যেতো না। সে এক ভারী অবাক করা বিস্ময়!

পাখির কিচিরমিচির শব্দ আমার ভারী পছন্দ। গ্রামের বাড়িতে খুব সকালে ঘুম থেকে উঠলে সেই শব্দ যতো পরিস্কার শোনা যেতো, দিনের আলো বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তা যেনো অন্যান্য শব্দের মধ্যে কোথায় হারিয়ে যেতো। কিন্তু দুপুরের ঠা ঠা রোদে সবাই যখন বিশ্রামে যেতো তখন বাগান থেকে হঠাৎ শোনা যেতো ঘুঘুর ডাক। আহা, তখন কি আর আমাদের মতো লিলিপুটদের তখন বিশ্রাম নেওয়া সাজে? বড়দের কোনোমতে ফাঁকি দিয়ে আমরা ছোটরা তখন ঘুঘু খুঁজতে ছুটতাম। সে এক অমর বাল্যকাল বটে।

আমাদের হরিসভার ঠিক পাশেই বিপদ ভঞ্জন বৈরাগী'র বাড়ি। বিপদ ভঞ্জন বৈরাগীকে আমরা ডাকতাম দাদু। সাড়ে ছয় ফুট লম্বা বিশাল দেহের বিপদ দাদু খুব সুন্দর গান গাইতেন। এক ছেলে বিনয় আর তিন মেয়ে নমিতা, সবিতা আর কবিতা এবং গাঁয়ের বিন্দু'দা, মনোজ কাকা, মরাই দা, আর ভজনকে নিয়ে বিপদ দাদু'র ছিল এক কীর্তনের দল। প্রতিবছর হরিসভায় মাঘ/ফাল্গুন মাসে কীর্তন হতো। বাইরে থেকে দ্বীজেন বাবু'র দল, বিজয় সরকারের দল, হরিদাসী'র দল আর নীলকান্ত বাবু'র দল কীর্তন গাইতে আসতেন। তখন বিপদ দাদু'র দলও দুই/তিন পালা কীর্তন করতেন। আহা সেই শব্দ যে কতো মধুর তা লিখে বোঝানো যাবে না। এছাড়া প্রায়ই রাতের বেলায় বিপদ দাদু ঘরের দাওয়ায় বসে বসে একমনে ঢোল বাজাতেন। সেই ঢোলের শব্দ শুনে আমার পড়া ছুটে যেতো। অংকের হিসেবে ভুল হতো। বিপদ দাদু ঢোলের সাথে এমনভাবে খেলতেন যে কখনো দাদরা, কখনো কেহারবা, কখনো ত্রিতাল, কখনো ভৈরবী, সেই শব্দের ঘোরে পড়ার ঘরে টেকা ভারী কষ্ট। বিপদ দাদু হারমোনিয়াম, ঢোল, খোল, আর মন্দিরা বাজাতে জানতেন। বিনয় হারমোনিয়াম, ঢোল, মন্দিরা আর বাঁশি বাজাতে জানতো। বিন্দু'দা খোল, ঢোল আর মন্দিরা বাজাতে পারতেন। মনোজ কাকু বাজাতেন হারমোনিয়াম। বিপদ দাদু'র তিন মেয়েই ভালো গাইতেন। হারমোনিয়াম আর মন্দিরা বাজাতে পারতেন তারা। মরাই দা বাজাতেন বাঁশি অথবা মন্দিরা। আর ভজন বিপদ দাদু'র কাছে খোল বাজানো শিখতো। এর মধ্যে ভজন আর বিনয় ছিল আমার ক্লাশফ্রেইন্ড। এক সময় বিপদ দাদুরা ইন্ডিয়া চলে গেলেন। আহা সেই ঢোল আর শুনি না কোথাও।

এখন নাগরিক জীবনে গাড়ির হর্ন খুবই বিরক্তি লাগে। বিশেষ করে মেজাজ খারাপ হয় যখন বড়লোকের হাইব্রিড পোলাপাইনরা গাড়ির বাম্পার খুলে রেখে ধানমন্ডি, বনানী, গুলশান, বারিধারার রাস্তায় রেস করে মাতিয়ে বেড়ায়, সেই শব্দ শুনলে। গ্রামে বসে উড়োজাহাজের শব্দ শুনতে ভালোই লাগতো। কিন্তু শহরে বসে উড়োজাহাজের শব্দ শুনলে ভারী বিরক্তি লাগে। কাঁঠালবাগানে সকালের দিকে এক মহিলা গলিতে গলিতে একটা চিৎকার দিতেন- ছাই নিবেন নি ছা-আ-আ-আই? ভারী ভালো লাগতো সেই শব্দ। আর কলাবাগান লেকসার্কাসে এক ফেরিওয়ালা ছিল, যিনি বিরল সব আইটেম ফেরি করতেন। প্রায় রোজই তিনি হাঁক দিতেন- ওই বরই। ওই চালিতা-বরই। ওই কাঁচা বরই। লাগবে বরই? ভারী ভালো লাগতো সেই শব্দ। আগে আমরা ঢাকায় আসতাম লঞ্চে। তো মাঝরাতে লঞ্চ ভিড়তো চাঁদপুর। তখন কিছু ফেরিওয়ালা লঞ্চে উঠতো বিরতী সময়ে। লঞ্চ ঘাট ছাড়ার মুহূর্তে তারা আবার নেমে যেতো। তারা বিচিত্র সব শব্দ করতো। ওই ডিম। ওই গরম ডিম। ওই ডিম ডিম। ওই ডিম আছে। অথবা চানচুররররররর বলে কারো লম্বা চিৎকার, সঙ্গে একটা ঝুনঝুনির শব্দ। হঠাৎ গোটা লঞ্চ যেনো ভারী ব্যস্ত হয়ে উঠতো। ভারী ভালো লাগতো মাঝরাতের চাঁদপুর লঞ্চঘাটের সেই বিচিত্র শব্দ।

শব্দ কখনো ভালো লাগা তৈরি করে। আবার শব্দ কখনো বিরক্তি'র উদয় ঘটায়। সকল শব্দ উড়ে উড়ে ঘুরে ঘুরে মহাশূন্যের মহাকোঠরে গিয়ে জমা হয়। মাঝরাতে গির্জার ঢং ঢং শব্দ শুনতে ভারী ভালো লাগে। ভোরবেলায় দূর মসজিদ থেকে ভেসে আসা 'আস-সালাতু খায়রুর মিনান নাউম' শুনতে ভারী ভালো লাগে। কিন্তু দিনের বেলায় একসঙ্গে চারপাশের মাইক থেকে যখন এক সাথে আযান হয়, সেই শব্দে কোন আযানই ঠিক মতো শোনার জো থাকে না। শব্দের আচরণই হয়তো এমন, দূরে গেলে সে মায়া তৈরি করে। কাছে আসলে সে বিরক্তির সৃষ্টি করে। কি জানি! শব্দবিজ্ঞানীরা হয়তো ভালো বলতে পারবেন। তবু শব্দরা ভালো লাগা তৈরি করে আবার শব্দরা বিরক্তি লাগায়। আমরা শব্দের বাইরে নির্জনে যেতে পারি না। শব্দরা আমাদের নিয়ে বেঁচে থাকে।

মন্তব্য ১ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (১) মন্তব্য লিখুন

১| ০১ লা আগস্ট, ২০১৩ ভোর ৪:৪৩

ভূতাত্মা বলেছেন: শিরোনামের পাশে আপনের নাম না দেখলে আজকাল বিভ্রান্ত হৈ, মনে হয় কেউ আপনার নামে ফেইক নিক খুলেছে।

দয়া করে আমাদের বিভ্রান্ত করবেন না, আগের ট্রেডিশনে ফিরে আসুন। রেজা ঘটক :-< :-<

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.