নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

বাংলাদেশ আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা...

বাংলাদেশ আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা...

রেজা ঘটক

ছোটগল্প লিখি। গান শুনি। মুভি দেখি। ঘুরে বেড়াই। আর সময় পেলে সিলেকটিভ বই পড়ি।

রেজা ঘটক › বিস্তারিত পোস্টঃ

ধুনক ধুনারি ধোনকার...

১০ ই অক্টোবর, ২০১৩ দুপুর ২:২২

আমাদের গ্রামে একটা পাড়া ছিল যেখানে অনেকের পেশা ছিল তুলা ধোনা। তুলা ধুনে যিনি লেপ তোশক বালিশ ইত্যাদি বানান তাদের বলা হয় ধুনক বা ধুনারি। আমাদের গ্রামে তাদের বলা হত ধোনকার। তুলা ধুনা করেন যিনি তিনি আসলে ধুনক। অনেক সময় তাকে ধুনরি বা ধুনুরি বা ধুনারিও বলা হয়। কিন্তু আমরা চিনতাম ধোনকারকে। বন্দুকের মত দেখতে একটা যন্ত্র নিয়ে আমাদের সেই ধোনকারগণ সকালে বাড়ি থেকে বের হতেন। তাদের ঘাড়ে থাকতো সেই লম্বা ধুনাচি। ছোটবেলায় আমি সেই সব ধোনকারদের দেখলে ভারী ভয় পেতাম। মনে হত তাদের ঘাড়ে কোনো মিসাইল টাইপ কোনো মারাত্মক অস্ত্র বুঝিবা সেটা। আর মজার ব্যাপার হল, তাদের গায়ে থাকতো খাকি শার্ট। দেখতে অনেকটা পুলিশ পুলিশ। রাস্তা দিয়ে সেই সব ধোনকাররা যখন হেঁটে যেতেন, দূর থেকে তাদের দেখেও মনের মধ্যে আমার একটা ভয় কাজ করতো। কি জানি, ওই যন্ত্র দিয়ে দূর থেকে হয়তো গুলি করা যায়! আমার তখন মনে হত, ওদের কাছে তীরও আছে। হয়তো ছোট ছোট ছেলেপেলেদের দেখলে সেই তীর ছোড়ে ওরা। আমি ওদের দেখামাত্র পজিশান নিতাম। পজিশান নিতাম কোনো গাছের আড়ালে। অথবা রাস্তার ঢালে। অথবা মাঠের মধ্যে উঁচু কোনো ঢিবি'র আড়ালে।

ধোনকারদের দেখে আমি যে এভাবে পালাই তা কেউ জানতো না। একদিন সেই ধোনকার আমাদের রাস্তা দিয়ে আমাদের বাড়ির দিকে আসছে। আমি যতোই লুকিয়ে তাকে দেখতে থাকি, ধোনকার ততোই আমাদের বাড়ির কাছে আসতে থাকলো। এক সময় আমি আর দিশা না পেয়ে মাকে বললাম যে, পুলিশ আসতেছে!

জবাবে মা বললো, পুলিশ আসলি আমি কি করব? কোথায় পুলিশ?

আমি রাস্তার দিকে দেখিয়ে বললাম, ওই যে এদিকেই আসতেছে...

মা আগন্তুককে দেখে স্বভাবসুলভ ভাবে বললো, ও তো ধোনকার। আমাদের লেপ বানাতে আসতেছে।

আমি কিছুটা আতংকিত কিছুটা স্বস্থির মিশ্রণে কিছুক্ষণ দোল খেলাম। এক সময় ধোনকার আমাদের উঠোনে পৌঁছলেন। আমি ঘরে ঢুকে টেবিলের নিচে লুকালাম। লুকিয়ে লুকিয়ে দেখলাম, মা দুইটা হোগলার পাটি উঠোনে বিছিয়ে দিলেন। তার একপাশে ধোনকার তার ধুনাচি রেখে আয়েস করে বসলেন। তারপর মা তুলার বস্তা দেখিয়ে দিয়ে ঘরে ঢুকলেন ধোনকারের জন্য পান নিতে। দেখলাম মা ধোনকারকে পান দিয়ে তার সঙ্গে আমার কথা বলছেন। তক্ষুণি ধোনকার আমাকে ডাক দিল।

আমি ভয়ে ভয়ে ধোনকারের কাছে গেলাম। ধোনকার ধুনাচি হাতে নিয়ে বললেন, এটা তুমি ধরে দেখো। তাইলে আর ভয় করবে না।

তারপর কিছুক্ষণ ধুনাচি নিয়ে গবেষণা করার পর আমি দেখে নিলাম ধোনকারের কারবার। পরে সারা দিন ধোনকারের আমি যোগ্য এসিসট্যান্ট হয়ে তুলা ধুনায় ধোনকারকে সহযোগিতা করতে লাগলাম। বিকেলে স্কুল থেকে ফিরে মেজো আপা বললো, তোর চুল তো সব সাদা হয়ে গেছে, কি করছিলি?

তারপর মেজো আপা বললো, আব্বা আসার আগে শিগ্গির গোসল করতি চল। নইলে তোরেই তুলা ধুনা করবেনে...

ধোনকারদের যে পাড়ায় বাড়ি ওটাকে সবাই ডাকতো বাজাদার পাড়া। কারণ, ওখানের সবার ঘরেই ঢোল আছে। পূজার সময় তারা মন্দিরে মন্দিরে ঢোল বাজানোর অর্ডার পায়। বাজাদার পাড়ার ছেলে বুড়ো গুড়ো সবাই ঢোল বাজাতে জানতো। কিন্তু বারো মাসে তেরো পূজার বাইরে তাদের আরো অনেক পেশা ছিল। কেউ তুলা ধুনতো। কেউ গরু-ছাগলের চামড়া ছুলতো। কেউ বাজারে মুচি'র কাজ করতো। কেউ বাঁশ দিয়ে মাছ ধরার গড়া বানাতো। কেউ মাছ ধরার জাল বুনতো। কেউ মুরগি আটকানোর বাশেঁর খাঁচা বানাতো। এমন বিচিত্র সব কাজ করতো বাজাদার পাড়ার মানুষজন।

কিন্তু বাজাদার পাড়ার কেউ স্কুলে যেতো না। ছোটবেলা থেকেই তারা বড়দের সঙ্গে এসব কাজ করতো। আর যাদের বিশেষ করে মহিলাদের ছেলেমেয়ে বা স্বামী নেই, তারা পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে ঘুরে ভিক্ষা করতো। ভারী হরেকরকম কাজের সুনসান ছিল বাজাদার পাড়ায়।

তো সেই ধোনকারকে আমি এক ফাঁকে জিজ্ঞেস করলাম তার নাম। জবাবে তিনি বললেন, কলিমউদ্দিন। আমি ঘরে ঢুকে মাকে জিজ্ঞেস করলাম, ওনারা কি মুসলমান? মা বললো, হু।

তখন আমার মনের মধ্যে ভারী খচখচ করতে লাগলো। তাহলে ওনারা ঈদের সময় মুসলমানদের বাড়িতে আসে না কেন?

বড় হয়ে জানলাম, ওরা আসলে কাদিয়ানী মুসলিম। হিন্দুদের পূজায় ঢোল বাজায় বলে ওদের মুসলমানেরা তেমন নিজেদের মনে করতো না। এছাড়া ঋষি-মুচি-চামাড়ের কাজ করে বলে ওদের তেমন কেউ সামাজিক কাজ-কারবারে ডাকে না। বিশেষ করে মুসলমানেরা। অথচ তারা আমাদের গ্রামের প্রায় সকল কাজে লাগতো। লেপ বানাতে ওদের ডাক পড়তো। পূজায় ঢাক বাজাতে ওদের ডাক পড়তো। মাছ ধরার জাল বুনাতে ওদের ডাক পড়তো। কিন্তু কারো বিয়ে সাধি বা শ্রাদ্ধে ওদের কেউ ডাক পেতো না।

একই গ্রামে বাজাদার পাড়ার মানুষগুলো অনেকটা উচ্ছিষ্ট'র মতো ছিল। সমাজের এই যে শ্রেণীকরণ, এটা কিন্তু একদিনে তৈরি হয়নি। ছোটবেলা থেকে দেখা সেই বাজাদার পাড়াটি আমার কিন্তু সবচেয়ে বেশি ভালো লাগতো। কারণ সেখানে অনেক চমক। কেউ কেউ বসে বসে তাস খেলছে। কেউ জাল বুনছে। কেউ ঢোল বাজাচ্ছে। কেউ খাঁচা বুনছে। কেউ তুলা ধুনছে। সে এক দেখার মতো পাড়া। যা আমাদের গ্রামের অন্য কোথায় এমন বৈচিত্র্যময় ছিল না।

এখনো আমি বাড়িতে গেলে ওই বাজাদার পাড়া থেকে একটা ঘুরা দেই। বাজাদার পাড়ায় ঘুরতে আমার খুব ভালো লাগে...

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.