নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

বাংলাদেশ আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা...

বাংলাদেশ আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা...

রেজা ঘটক

ছোটগল্প লিখি। গান শুনি। মুভি দেখি। ঘুরে বেড়াই। আর সময় পেলে সিলেকটিভ বই পড়ি।

রেজা ঘটক › বিস্তারিত পোস্টঃ

বাড়িওয়ালা আংকেল যেখানে থাকেন ভালো থাকেন...

২৭ শে অক্টোবর, ২০১৩ সন্ধ্যা ৭:০৬

আমরা তখন গ্রিন রোডে থাকি। পুরাতন সমরিতা হাসপাতাল যেখানে ছিল, ঠিক তার পাশের বাড়িতে। আমরা ছয় তলা বিল্ডিংয়ের ছয়তার উত্তরপাশের ব্যাচেলর সাইডে। তখনো ওই বাড়ির সাত তলা'র কাজ শুরু হয় নি। কিন্তু ছাদের একটা কক্ষে বাড়ির দারোয়ান করিম থাকে। একেবারে নিচতলায় থাকেন বাড়িওয়ালা। উভয় পাশের ইউনিটেই বাড়িওয়ালা'র পরিবার। পাঁচতলা পর্যন্ত উভয় পাশেই ফ্যামিলি বাসা। আর ছয় তলায় উভয় পাশেই ব্যাচেলর থাকে। তিন তলায় তখন থাকতেন জাতীয় সঙ্গীত শিল্পী আবদুল জব্বার। ওনার দরজার সামনে একটা সাইনবোর্ড ছিল। সেখানে লেখা ছিল, জাতীয় কণ্ঠশিল্পী আবদুল জব্বার। পাঁচ তলায় থাকতেন একজন বিশিষ্ট গীতিকার।

তো রোজ রাতে একটা মজার কাণ্ড ঘটতো ওই বাড়িতে। রাত বারোটা থেকে একটার মধ্যে শুরু হত সেই চিৎকার আর গালাগালি। অনেক সময় হাতাহাতি পর্যায়েও যেতো। কি নিয়ে কাহিনী? বাড়িওয়ালা আবুল কালাম আংকেল আর সঙ্গীত শিল্পী আবদুল জব্বার দু'জনেই মদ্যপ। দু'জনে প্রায় রোজ একসঙ্গে মদ থেতেন। খেতেন কোনো বারে বসে। অথবা বাড়িওয়ালা আংকেলের টঙ্গি'র ফ্যাক্টরি অফিসে বসে। কোথায় বসে তারা খাবেন, তা আগেই ঠিক করতেন। তারপর দু'জনে অনেক রাত পর্যন্ত গলা ভেজাতেন। সমস্যা শুরু হত বাসার সামনে আসার পর।

বাড়িওয়ালা আংকেল বলতেন, তোর মত জাতীয় সঙ্গীত শিল্পী আমার অনেক দেখা আছে, হু? জবাবে আবদুল জব্বার হয়তো বলতেন, তোর মত বাড়িওয়ালাও আমার দেখা আছে। এই নিয়ে মহাক্যাচাল শুরু হত। বাড়িওয়ালা হয়তো বলতেন, তুই আমার বাড়িতে সাইনবোর্ড লাগাইছিস, ওটা আমি ভেঙে দেব। জবাবে আবদুল জব্বার বলতেন, সাইনবোর্ড ভাঙতে আসলে আমি তোর হাত ভেঙে দেব। তারপর সেই ঝগড়ার এক পর্যায়ে হয়তো দারোয়ান করিম এসে বাড়িওয়ালা আংকেলকে ধরে নিয়ে ভেতরে যেত। অথবা তিন তলা থেকে কবি জোহরা জব্বার নিচে নেমে মদ্যম স্বামীকে ধরে তিন তলায় ওঠাতেন। তখন সিড়িতে বসে চলতো ঝগড়ার বাকি অংশ। এটা ছিল প্রায় রোজ রাতের কমন দৃশ্য।

দারোয়ান করিম ছিল বাড়িওয়ালা আংকেলের সার্বক্ষণিক খাদেম। আংকেলের কখন কি লাগবে, কিভাবে কখন তা জোগাড় করতে হবে, সবই করিম সামলাতো। আংকেল যেদিন রাতে বাইরে না যেতেন, সেদিন ঘরে বসে বিয়ার খেতেন। করিম বিয়ারের কেচ আগে থেকে সংগ্রহ করে রাখতো। করিমকে সিগারেট ঘুষ দিয়ে আমরা মাঝে মাঝে সেই বিয়ারে ভাগ বসাতাম। কখনো আংকেল বিয়ারের ক্যান শেষ না করে করিমকে দিয়ে দিত, তুই খা। করিম ইচ্ছে হল খেত। ইচ্ছে না হলে উপরে এসে আমাদের ডেকে ছাদে নিয়ে যেত। তাছাড়া আমরা রাতে দেরি করে ফিরলে, করিমের সঙ্গে একটা এক্সট্রা সম্পর্ক ছিল, রাস্তায় এসে একটা শব্দ করলে, করিম উপর থেকে উকি দিত। পরের শব্দে করিম ম্যাচের আগুন জ্বালিয়ে সংকেত দিত। ওয়েট করেন, আসতেছি। অথবা করিম আংকেলের সেবায় ব্যস্ত থাকলে আমরা দোকানের সামনে আড্ডা দিতে থাকতাম। করিম এসে আমাদের গেইট খুলে নিয়ে যেত।

বাড়িওয়ালা আংকেলের একটা সেরমখানা ছিল। যেখানে বাড়িওয়ালী আন্টি'র পর্যন্ত প্রবেশাধীকার ছিল না। একমাত্র করিম সেই ঘরের সবকিছু গুছগাছ করে রাখত। সেখানে বসে আংকেল পান করতেন। কখনো আবদুল জব্বারের সেখানে গানের আসর বসতো। কখনো সেখানে আংকেল বমি করতেন। কখনো কখনো আংকেল নিচের বারান্দায় পায়চারি করতেন। যেদিন আংকেল পায়চারী করবেন, তার আগে করিম সেই বারান্দা ধুয়ে মুছে চকচকা করে রাখতো। আর আমাদের সংকেত দিত, না আসার জন্য। হয়তো কোনো রাতে আমরা বাসায় ফুকতে পারছি না। কারণ, আংকেল বাসায় ঢোকার সেই বারান্দা পথে পায়চারি করছেন। ঢুকলেই ধরবেন। আর পরদিন সকালে নির্ঘাত বাড়ি ছেড়ে দিতে হবে। সেরকম হলে রাতে আর আমরা বাসায় ঢুকতাম না। আমাদের এক বন্ধু ধানমন্ডি'র জাহাজ বাড়ির সামনে একটা সাইবার ক্যাফে দিয়েছে। সেখানে সারারাত তখন আমাদের সাইবারে কাটানোর নিয়ম।

বাড়িওয়ালা আংকেলের পাঁচ মেয়ে এক ছেলে। সবার ছোট ছেলে। বয়স বারো তেরো। তারপর দুই আড়াই বছর করে প্রত্যেকটা মেয়ে সেই ছেলের চেয়ে বড়। একেবারে বড় মেয়ের বিয়ে হয়েছে আমরা ওই বাড়িতে যাবার আগেই। বাকি চারজনই মোটামুটি সেইরাম দুষ্টু। একেবারে ছোট দুইটা সবচেয়ে বেশি দুষ্টু। তার চেয়ে বড় দুইটা একটু রিজার্ভ কিন্তু তলে তলে শয়তান। আমরা ব্যাচেলররা কে কি করি, আমাদের সবার সব কর্ম হিস্ট্রি তাদের মুখস্থ। অথচ ওদের কারো সাথেই আমরা কেউ কথা বলিনা। কথা বলার প্রশ্নও ওঠে না। কারণ, আংকেল টের পেলে অবশ্যই বাসা ছাড়তে হবে। করিমের সুবিধার কথা বিবেচনা করে আমরা দরজায় একটা মিউজিক্যাল কলিংবেল লাগালাম। আংকেলের ছোট দুই মেয়ে সেই কলিংবেল নিয়ে রোজ দুপুরে শুরু করলো উৎপাত।

কলিংবেল চেপেই হয় তারা দৌড়ে ছাদে চলে যায়। নতুবা দৌড়ে নিচে নেমে যায়। দরজা খুলে কাউরে আর পাওয়া যায় না।

উৎপাত হাতে নাতে ধরার জন্য একবার দরজার আড়ালে চুপ করেই দাড়িয়ে রইলাম। লুকিং গ্লাস দিয়ে দেখলাম, ছোট দুই মেয়ের বড়টা এসে কলিংবেল চাপছে, আর দু'জনেই দৌড়ে ছাদে চলে গেল। দশ মিনিট পরে আবার ছোট মেয়ে কলিংবেল চেপে দৌড়ে নিচে নেমে গেল। পনের মিনিট পরে আবার ছোটটার বড়টা কলিংবেল চেপে দৌড়ে নিচে নেমে গেল। দশ মিনিট পরে আবার কলিংবেল চেপে দু'জনেই দৌড়ে সরাসরি ছাদে। বুঝলাম, এই কলিংবেল চাপাটা তাদের দুষ্টামি আর খেলার অংশ হয়ে গেছে। নালিশে কাজ হবে না। উল্টো উৎকো ঝামেলা হতে পারে। যা করার সরাসরি করতে হবে। ভেতর থেকে ছিটকানি খুলেই রেখেছিলাম। ছোটটার বড়টা কলিংবেলে চাপ দেওয়ার আগেই হাতেনাতে ধরে ফেললাম।

তারপর জিজ্ঞাসাবাদে জানা গেল আমার যতো চিঠি মুখ খোলা বা ছেড়া পাই, সেসব চিঠি'র পাঠিকা ওরা চার বোন। কখনো কখনো চিঠির মধ্যে বেনামে চিঠিও থাকে। সেই চিঠি'র প্রেরকের নাম থাকে না। ভূতের চিঠি! জানতে চাইলাম, চিঠি'র মধ্যে চিঠি কে লেখে বল, নইলে আজ আর ছাড়ব না। নিজেকে বাঁচাতে বড় বোনের নাম করে ছাড়া পেয়েই ভো দৌড়। এরপর কলিংবেল বিড়ম্বনা বন্ধ হলেও শুরু হল আরেক উৎপাত।

আমরা যখন বাসায় না থাকি, দরজায় নানা কার্টুন একে লাগিয়ে রাখে। কার্টুনিস্টের কোনো নাম থাকে না। কিন্তু কার্টুনে আমাদের নামে নানান ঢঙের ডায়লগ থাকে। কি করা যায়? আমরা বুদ্ধি পাকিয়ে একবার করিমকে হালকা করে একটু নালিশ দিলাম। করিম ভাই, কার্টুনের জ্বালায় তো আমরা অস্থির। কি করা যায়, বুদ্ধি দেন? দারোয়ান করিম কইলো, খবরদার, ওইগুলঅ বজ্জাতের হাড্ডি। লেখাপড়ায় এক্কেরে বিচ্ছিড়ি। যেনোতেনো কইরা কারোর গলায় ঝুলতে পারলেই বাঁচে। বড়ুগ্গা কিন্তু এই কইরাই একজনের গলায় ঝুলছে। সাবধান থাইকেন! আর আংকেল শুনলে কিন্তু ঘটিবাটি সব হারাইবেন!!

করিমের কথা খুব গুরুত্ব দিয়েই আমরা বিবেচনায় নিলাম। বিপদ-আপদ থেকে দূরে থাকাই ভালো। আর ইমান ধরে রাখা যে কোনো মুসলমানের জন্য উত্তম। আমরা একেবারে আর ওই দুষ্টুদের পাত্তা দিলাম না। এরমধ্যে এক রাতে আংকেল মদ্যপ অবস্থায় মেইন গেইটের সামনে পেড়ে গেছেন। গেইটের বাইরে দেহের পেছনের অংশ আর গেইটের ভেতরে দেহের সামনের অংশ। এই অবস্থায় আংকেল সারারাত সেখানে ঘুমিয়েছিলেন। করিমকে বাড়িওয়ালী আন্টি বড় মেয়ের বাড়িতে পাঠায়েছিলেন। করিম আর রাতে ফেরে নাই। সকালে প্রতিবেশীদের চিৎকারে সবার সেদিকে দৃষ্টি যায়। তারপর আংকেল খুব লজ্বা পেলেন। সারাদিন আর বাইরে বের হন না। আন্টি বললেন, তুমি ঢাকার বাইরে কোথাও থেকে ঘুরে আসো। আংকেল এক মাসের জন্য ভারত গেলেন।

করিমের কাছে আমরা প্রায়ই আংকেলের খবর নেই। করিম জানায়, আংকেল দেশে আইছেন। নোয়াখালীতে আংকেলের গ্রামের বাড়িতে আছেন। আমরা আংকেল আর আবদুল জব্বারের সেই রাতের ঝগড়া শুনতে না পেয়ে কেমন একঘেয়ে হয়ে উঠেছি প্রায়।

হঠাৎ একদিন সকালবেলায় শুনলাম নিচে খুব চিৎকার চেচামেছি কান্নাকাটি। করিম-ই আমাদের খবরটি পৌছায়। আংকেলের গ্রামের বাড়িতে কে বা কারা যেনো সম্পত্তির লোভে আংকেলকে খুন করেছে। গ্রামের বাড়ির পুকুরের কচুরিপানার মধ্যে আংকেলের লাশ পাওয়া গেছে। গোটা বাড়িতে যেনো অন্ধকার নেমে আসলো। করিম গেইটের দায়িত্ব আমাদেরকে বুঝিয়ে দিয়ে আন্টি ও সেই দুষ্টু মেয়েদের নিয়ে একটা মাইক্রোবাসে নোয়াখালী রওনা হল।

তিনদিন পর আংকেলের মিলাদে করিমের সঙ্গে বাড়িওয়ালী আন্টি উপরে এসে আমাদের নিমন্ত্রণ করে গেলেন। দুপুরে যেনো আমরা সবাই মিলাদে অংশগ্রহন করি। আমার ঢাকার মাইগ্রেশান জীবনে সেই একবার মাত্র কোনো বাড়িওয়ালার পক্ষ থেকে মিলাদের নিমন্ত্রণ পেয়েছিলাম। আমরা সবাই মিলাদে অংশও নিয়েছিলাম। আর আবুল কালাম আংকেলের জন্য মন থেকে দোয়া করেছিলাম...

পরবর্তী দুই মাসের মধ্যে আমাদের সেই ব্যাচেলর সাইড উঠিয়ে দিলেন বাড়িওয়ালী আন্টি। তারপর থেকে আর আমরা কেউ আংকেলের সেই দুষ্টু মেয়েগুলোর খবর জানি না...

মন্তব্য ২ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ২৭ শে অক্টোবর, ২০১৩ রাত ৯:০৮

সাইদুল পবন বলেছেন: ভাই ভালো লাগলো আপনার এই স্মৃতি রোমান্থন।ভালো থাকুন নিরন্তর,,,,

২| ২৭ শে অক্টোবর, ২০১৩ রাত ৯:২৮

আলাপচারী বলেছেন: মাতলামী ছাড়া এ জাতীয় লোকের আর কোনো দোষ থাকে না।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.