নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

বাংলাদেশ আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা...

বাংলাদেশ আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা...

রেজা ঘটক

ছোটগল্প লিখি। গান শুনি। মুভি দেখি। ঘুরে বেড়াই। আর সময় পেলে সিলেকটিভ বই পড়ি।

রেজা ঘটক › বিস্তারিত পোস্টঃ

বাংলা গানে মান্না দে এক কালজয়ী অধ্যায়!!!

২৩ শে ডিসেম্বর, ২০১৪ সন্ধ্যা ৭:১৬

কলকাতার যে বাড়িতে মান্না দে জন্মগ্রহন করেন, সেই বাড়িতে সকাল থেকে রাত বারোটা পর্যন্ত একটানা গান বাজত। মান্না দে'র বাবা পূর্ণচন্দ্র দে ছিলেন ব্যাংকার। মান্না দে'র মেজো কাকা হেমচন্দ্র দে ছিলেন প্রকৌশলী। আর সঙ্গীতাচার্য কৃষ্ণচন্দ্র দে হল মান্না দে'র ছোট কাকা। কলকাতার এক একান্নবর্তী পরিবার। মান্না দে'র ছোট কাকা কৃষ্ণচন্দ্র দে মাত্র তেরো বছর বয়সে অন্ধ হয়ে যান। উনি ব্যাচেলর ছিলেন। সারাদিন বাড়িতে বাচ্চাদের সবার দেখাশোনা করতেন। মাত্র আঠারো বছর বয়সে কৃষ্ণচন্দ্র দে একজন পূর্ণাঙ্গ সঙ্গীতশিল্পী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। কৃষ্ণচন্দ্র দে গান শুরু করার আগে মান্না দে'র পরিবারের কেউ সারেগামাও জানত না।

মান্না দে'র এক আত্মীয় হরেন্দ্রনাথ শীল ছিলেন কলকাতার বিরাট জমিদার। তিনি কৃষ্ণচন্দ্রকে নিজের বাড়িতে নিয়ে গেলেন। অন্ধ কৃষ্ণচন্দ্র মাত্র পাঁচ বছরে ওস্তাদের কাছে সব ধরনের গানের তালিম নিলেন।

নাট্যকার শিশির কুমার ভাদুরীর 'সীতা' নাটকে কৃষ্ণচন্দ্র দে বৈতালিকের গান করতেন। 'জয় সীতাপতি সুন্দর প্রজারন্ধন কারী, রাবন রামচন্দ্র সত্যব্রত ধারী...'। 'অন্ধকারের অন্তরেতে অশ্রুবদল চলে...'। কৃষ্ণচন্দ্র দে'র কণ্ঠে এই গান শুনে লোকে তখন কাঁদত। কলকাতায় নাটকে এই দুটি গান করে কৃষ্ণচন্দ্র দে রাতারাতি সবার হৃদয় জয় করেন।

কলকাতায় তখন ছেলেমেয়েদের কম্বাইন্ড কলেজ ছিল মাত্র একটি। স্কটিস চার্জ কলেজ। মান্না দে সেই স্কটিস কলেজের ছাত্র ছিলেন। স্কটিস ডক্টর আকুয়াড ছিলেন স্কটিস কলেজের প্রিন্সিপাল। কলেজের ছেলেমেয়েরা একদিন প্রিন্সিপালকে গিয়ে ধরলেন, আমাদের এক বন্ধু আছে, ও খুব ভালো গান করে, ও ইন্টারকলেজে নাম দেবে না কেন? প্রিন্সিপাল মান্না দেকে ডেকে পাঠালেন। জিজ্ঞেস করলেন, তুমি গানে নাম দিচ্ছ না কেন? জবাবে মান্না দে বললেন, আমার কাকা গান করতে দেবে না। জবাবে প্রিন্সিপাল বললেন, কেন, কেন? মান্না দে জবাবে বললেন, কাকা বলেছেন, ওরা তোমাকে দু'একটা মেডেল বা কাপ দেবে, ওটা তোমার মাথা ঘুরিয়ে দেবে। তুমি গাইয়ে হয়ে যাবে। তারপর আর তোমার গান হবে না। আই হ্যাভ ডিফারেন্ট থিংস ইন মাই মাইন্ড ফর ইউ। আগে লেখাপড়া শেষ কর। তারপর দেখা যাবে।

মান্না দে স্কটিস কলেজে গানের দশ বিষয়ে টানা তিন বছর ফার্স্ট হয়েছিলেন। ধ্রুপদী, খেয়াল, ঠুমরি, ভজন, গজল, টপ্পা, বাংলা মর্ডান, বাউল, ভাটিয়ালি ও কীর্তন। পরপর তিন বছর মান্না দে টানা ফার্স্ট হওয়ায় ফোর্থ ইয়ারে তাঁকে আর ছোট কাকা কৃষ্ণচন্দ্র গাইতে দেননি। কাকা বলেছিলেন, ইউ আর দ্য চ্যাম্পিয়ন। তোমার আর গান গাইতে হবে না। ইউ সুড নট গো টু পার্টিসিপেট।

এই ঘটনার পর মান্না দে মনে মনে ভাবতেন, নিশ্চয়ই আমি একদিন গাইয়ে হব। কিন্তু মান্না দে'র বাবা ও মেজো কাকা চাইতেন, ও একজন ভালো উকিল হবে। মেজো কাকা হেমচন্দ্র বলতেন, আমাদের পরিবারে একজন বড় উকিল নেই। তুমি ভালো করে পড়াশুনা কর। তোমাকে লন্ডনে ব্যারিস্টারি পড়তে পাঠাব। তুমি ব্যারিস্টারি পাস করে বড় উকিল হবে। মান্না দেরা চার ভাই। মান্না দে সেজো। বড় প্রণব, প্রকৌশলী। মেজো প্রকাশ, ডাক্তার। মেজো কাকা প্রকাশকে বলেছিলেন, তুমি ডাক্তারি পড়বে। এবং প্রকাশ দে ডাক্তারি পড়েছিলেন। মান্না দে সেজো। মান্নাকে বললেন, আমাদের পরিবারে কোনো লয়্যার নেই। তুমি ল পড়েব। কিন্তু মান্না দে মনে মনে একজন গাইয়ে হতে চাইতেন। স্কটিশ চার্চ কলেজে অধ্যয়নকালে তিনি তার সহপাঠীদের গান শুনিয়ে আসর মাতিয়ে রাখতেন। শুরুতে ছোট কাকা কৃষ্ণচন্দ্র দে'র কাছে এবং পরে ওস্তাদ দাবির খানের কাছ তিনি সঙ্গীতে তালিম নেন। ১৯৪৩ সালে মান্না দে স্কটিস কলেজ থেকে গ্রাজুয়েশান করেন। কলকাতায় কয়েকটি স্টুডিওতে তখন সঙ্গীতে কাজ করতেন।

১৯৪৩ সালে মান্না দে ছোট কাকা কৃষ্ণচন্দ্র দে'র সঙ্গে বোম্বে বেড়াতে যান। সেখানে শুরুতে তিনি কৃষ্ণ চন্দ্র দে’র অধীনে সহকারী হিসেবে এবং তারপর শচীন দেব বর্মণের অধীনে কাজ করেন। পরে অন্যান্য স্বনামধন্য গীতিকারের সান্নিধ্যে আসেন। এভাবে এক সময় স্বাধীনভাবে নিজেই কাজ করতে শুরু করেন। ঐ সময় তিনি বিভিন্ন হিন্দি চলচ্চিত্রের জন্য সঙ্গীত পরিচালনার পাশাপাশি ওস্তাদ আমান আলি খান ও ওস্তাদ আবদুর রহমান খানের কাছে হিন্দুস্তানী শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে তালিম নেন। ছোট কাকার সঙ্গে বোম্বে বেড়াতে গিয়েই তাঁর সহকারী হিসেবে কাজ শুরু করে টানা পাঁচ বছর সেখানে কাজ করেছিলেন মান্না দে।

ওস্তাদ আমান আলি খান মারা যাবার পর ওস্তাদ আবদুর রহমানের কাছে গান শিখতেন। ওস্তান আবদুর রহমান মারা গেলে তার শিষ্য তুলসী দাসের মা'র কাছে গান শিখতেন মান্না দে। তিনি মারা গেলে ওস্তাদ গোলাম মোস্তফা খানের কাছে গান শিখতেন। মান্না দে'র ইচ্ছে ছিল শুধু রবীন্দ্রসঙ্গীত বা নজরুল সঙ্গীতে তিনি সীমাবদ্ধ থাকবেন না। সঙ্গীতের সকল শাখায় বিচরণ করবেন। সব ধরনের গান শিখবেন। তাই তিনি ধ্রুপদী থেকে সঙ্গীতের সকল শাখায় নানাভাবে গান শিখলেন।

সময় বড় পালোয়ান। সময় হচ্ছে সবচেয়ে বড় নিয়ামক। সময় বদলের সাথে সাথে গানের, মানুষের শোনার রুচি ও পছন্দে বদল আসে। একজন সফল শিল্পী সময়ের এই গতিকে যখন আত্মস্থ করতে পারেন, তখন তিনি হয়ে যান কালের, মহাকালের শিল্পী। মান্না দে এমনই একজন মহাকালের শিল্পী। যাকে কোনো একটা বিশেষণে ঠিক বিশ্লেষণ করা যাবে না।

কৃষ্ণচন্দ্র দে প্রথম যেদিন মান্না দেকে নিয়ে ওস্তাদ আমান আলি খানের কাছে গেলেন, উনি কিছুতেই গান শেখাবেন না। ছোট কাকা কৃষ্ণচন্দ্র বললেন, ওস্তাদজি, ইয়ে হামারি ভাতিজি হে। ওর শিখতে যাতাহে। ইসলিয়ে ইয়ে কলকাতা ছে বোম্বে আয়া হে। বড় স্বপ্ন দেখিয়ে হে।

ওস্তাদজি বললেন, ঠিক হে, ঠিক হে। তানপুরা মিলাও। মান্না দে তানপুরা নিয়ে মিলালেন। তারপর ওস্তাদকে জিজ্ঞেস করলেন, কিয়া শুনাও? কী গাইব? ওস্তাদের এটা ভালো লাগে নি। তিনি বললেন, মুলতানি শোনাও। তো মান্না দে 'আ...' বলে যখনই আওয়াজ দিলেন, ওস্তাদ বললেন, ভকবাজ বনধ কর। মান্না দে'র ওস্তাদের কথা তখন একদম ভালো লাগেনি। মান্না দে কুস্তি করতেন, বক্সিং শিখতেন। তরুণ বয়স। মাথা গরম অবস্থায় জানতে চাইলেন, খারাপ কি হইল? ওস্তাদ বললেন, ভকবাজ বনধ কর। মান্না দে রাগ করে টানপুরা রেখে দিলেন। তারপর ওস্তাদ বললেন, দেখো বেঠে, সুর লাগানা এক এইছি চিস হে, এক সুর লাগাও তো, হামকু মালুম বড়জায়ে কিসখিত কি মুলিও। ওস্তাদের এই কথায় মান্না দে'র সেই যে শিক্ষা আরম্ভ হল, আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। মান্না দে সেই থেকে এক নতুন গানের জগত খুঁজে পান। ওস্তাদের কাছে সুর নিয়ে বুঝতে লাগলেন, সঙ্গীতকে। সঙ্গীতের ভেতরের সুরকে। তালকে, লয়কে। গানের কথাকে।

ভালো গান করার জন্য ভালো ওস্তাদের কাছে তালিম নেওয়াটা সবচেয়ে বেশি জরুরী। তিনিই রাস্তা দেখিয়ে দেন যে, এভাবে গাও, এভাবে গেও না। মান্না দে ছোট কাকা কৃষ্ণচন্দ্র দে'র কারণে সেই সুযোগটি পেয়েছিলেন। জীবনে ভালো ভালো ওস্তাদের কাছে গান শিখেছিলেন।

গানের কথা, গানের সুর আর গান গাইয়ে এই তিন জিনিসের মিলন ঠিকঠাক না হলে সেই গান মানুষের অন্তর ছুঁয়ে যায় না। শচীন দেব বর্মণও কৃষ্ণচন্দ্র দে'র সাগরেদ ছিলেন। শচীন কর্তার গান একটু নাকে গাওয়া ঘরানার। তো, শচীন কর্তার সর্দি না হওয়া পর্যন্ত তিনি কোনো গান রেকর্ড করতেন না। সর্দি হলেই ওঁনার পারফেক্ট নাকে গাওয়াটা নাকি বের হতো। পারফেক্ট না হওয়া পর্যন্ত উনি গান রেকর্ড করতেন না। নিশীতে যাইও ফুল বনে ও ভ্রমরা....শুনলে আমরা সে কথার প্রমাণ পাই।

সাধারণত যারা গান করেন, তারা গান করার সময় গরম জল পান করেন। এমনটি দেখা যায়। গলা সতেজ রাখার জন্য নাকি এই ব্যবস্থা। কিন্তু সামসাদ ভাই নামে একজন গাইয়ে করতেন এর ঠিক উল্টো। তিনি ফ্রিজের জলের মধ্যে বরফ ভিজিয়ে রাখতেন। গানের সময় সেই বরফ জল না হলে তাঁর গলার আওয়াজ বের হতো না। মান্না দে'র ধারণা, গানের ব্যাপারে রেওয়াজ হল আসল কথা। খাবারের বিষয়ে এসব হল মনের ভ্রম। মান্না দে সবকিছু খাইতেন। লতা মুঙ্গেশকার খাবারের বিষয়ে কোনো বাছবিচার করেন না। মোহাম্মদ রফি খাবারের বিষয় কিছুই মানতেন না। মান্না দেও খাবার নিয়ে কোনো বাছবিচার করতেন না। ওঁনারা সবাই নিয়মিত রেওয়াজ করতেন। যা সঙ্গীতের জন্য সবচেয়ে জরুরি বিষয়। আজকাল আমাদের শিল্পীদের কোনো রেওয়াজ নেই। দু'তিন লাইন গাইতে পারলেই টেলিভিশন চ্যানেলে গিয়ে হাজির হন। আহা মরি মরি!!

মান্না দে আধুনিক বাংলা গানের যত গান করেছেন, তার প্রায় সবই তাঁর বন্ধু পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা। মান্না দে তখন বোম্বেতে চলচ্চিত্রের প্লেব্যাক নিয়ে ভারী ব্যস্ত। একটা গানের রেকর্ড করার ঠিক আগ মুহূর্তে ডাকযোগে পুলকের পোস্ট কার্ডে পাঠানো একটি গান হাতে পেলেন। 'এতো রাগ নয় গো, এ যে অভিমান। এ শুধু তোমায় চাওয়া, আরো বেশি কাছে পাওয়া, ছল ভরা গান, এ যে অভিমান'। মান্না দে যে গানটি তখন রেকর্ড করতে যাচ্ছিলেন, সেটি বাদ দিয়ে তিনি এই গানে সুর করে এটি তখন রেকর্ড করেছিলেন। গানের কথাই মান্না দেকে এই কাজটি করতে উদ্ধুদ্ধ করেছিল।

মান্না দে সবসময় সুরের মধ্যে বৈচিত্র্য খুঁজতেন। পুলকের লেখা 'কী দেখলে তুমি আমাতে...' গানটা মান্না দে একটু গজলের সুরে সুর করে গাইলেন। মান্না দে বেশি পছন্দ করতেন মাটির গান। সলিল চৌধুরীর লেখা 'আমায় ডুবাইলি রে, আমায় ভাসাইলি রে, অকুল দরিয়ার বুঝি কুল নাই রে...' গানটি রেকর্ড করার সময় মান্না দে'র টিমে অ্যাকোর্ডিয়ান যিনি বাজাতেন, বোম্বের মিস্টার মুরকি, তিনি বলেছিলেন, মান্নাদা, মাটির গান তোমার গলায় খুব ভালো লাগে। বিশেষ করে ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া গান। মুরকি যখন এসব কথা বলছিলেন, তখন মান্না দে হাতে পেলেন পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা 'আমি ফুল না হয়ে কাঁটা হয়েই বেশ ছিলাম, জানিনা কোন ভুলে তোমার আঁচলে জড়ালাম, আমি সুখ না হয়ে দুঃখ হয়েই বেশ ছিলাম...' গানটি। মান্না দে তখন এই গানটি ভাটিয়ালি সুরে করলেন। এই গানের ভেতরে যে একটি না বলা অভিমান আছে, মান্না দে গানের সুরে ও গায়োকিতে সেই বিষয়টি তুলে ধরার চেষ্টা করলেন।

কথাসাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় ও তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায় এর গল্প দিয়ে কথাসাহিত্যিক ও চলচ্চিত্র নির্মাতা শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায় অনেক ছবি বানিয়েছেন। তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায় এর ডাক হরকরা গল্প দিয়ে শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়ের ডাক হরকরা ছবিতে 'ওগো তোমার শেষ বিচারের আশায় আমি বসে আছি, রাজ কাচারির দেউরিতে, শেষ বিচারের আশায়...' গানটি মান্না দে একতারায় করেছিলেন। শৈলজানন্দ যখন মারা যাচ্ছেন, তখন তিনি বললেন, মান্না দে'র ওই গানটি বাজাও। 'তোমার শেষ বিচারের আশায় আমি বসে আছি...'। মান্না দে'র ছোট কাকা সঙ্গীতাচার্য কৃষ্ণচন্দ্র দে যখন মারা যাচ্ছেন, তখন তিনি বললেন, মান্না'র ওই গানটা বাজাও- 'ওগো তোমার শেষ বিচারের আশায় আমি বসে আছি, রাজ কাচারির দেউরিতে, শেষ বিচারের আশায়...'।

‘তামান্না’ চলচ্চিত্রে গায়ক হিসেবে মান্না দে‘র অভিষেক ঘটে ১৯৪৩ সালে। সুরাইয়া’র সাথে দ্বৈত সঙ্গীতে গান এবং সুরকার ছিলেন ছোট কাকা কৃষ্ণচন্দ্র দে। ঐ সময়ে গানটি ভীষণ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। ১৯৫০ সালে 'মশাল' ছবিতে শচীন দেব বর্মণের গীত রচনায় ‘ওপার গগন বিশাল’ নামে একক গান গেয়েছিলেন। গানের কথা লিখেছিলেন কবি প্রদীপ। ১৯৫২ সালে মান্না দে বাংলা এবং মারাঠী ছবিতে একই নামে এবং গল্পে ‘আমার ভূপালী’ গান করেন। এই গান তাঁকে প্রতিষ্ঠিত করে এবং গায়ক হিসেবে সঙ্গীতপ্রেমীদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন।

মজার বিষয় হল বোম্বেতে গান করে যখন মান্না দে খুব জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন, তখনো তাঁকে কেউ বাংলা গান করতে ডাকেনি। তারপর বাংলাদেশের সুধীন দাস প্রথম মান্না দেকে দিয়ে রেকর্ড করালেন 'কে প্রথম কাছে এসেছি, কে প্রথম ভালোবেসেছি...' গানটি। তারপর আর মান্না দেকে পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। কণ্ঠ দিয়েই তিনি বাঙালির হৃদয় জয় করেছেন।

মান্না দে ভীমসেন জোসি’র সাথে একটি জনপ্রিয় দ্বৈত গান ‘কেতকী গুলাব জুহি’ গান। এছাড়াও তিনি কিশোর কুমারের সাথে আলাদা গোত্রের দ্বৈত গান হিসেবে ‘ইয়ে দোস্তী হাম নেহী তোরেঙ্গে (শোলে)’ এবং ‘এক চতুর নার (পদোসান)’ গান। এছাড়াও, তিনি শিল্পী ও গীতিকার হেমন্ত মুখোপাধ্যায় (হেমন্ত কুমার)সহ আরো বেশকিছু গীতিকারের সাথে বাংলা ছবিতে গান গেয়েছিলেন। দ্বৈত সঙ্গীতে লতা মুঙ্গেশকরের সাথে ‘কে প্রথম কাছে এসেছি (শঙ্খবেলা)’ গান করেছেন। রবীন্দ্র সঙ্গীতসহ প্রায় ৩৫০০ গান গেয়েছেন মান্না দে।

কেরালার মেয়ে সুলোচনা কুমারীনির সঙ্গে প্রেম করেছিলেন মান্না দে। বোম্বেতে একটা অনুষ্ঠানে মান্না গান করতে গিয়েই তাঁর সঙ্গে পরিচয়। খুব ভালো স্টুডেন্ট। বোম্বে ইউনিভার্সিটির ইংরেজি সাহিত্যের মাস্টার্সে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট। একটা কলেজে পড়াতেন। চার বছর তাঁরা প্রেম করেন। ১৯৪৯ সাল থেকে ১৯৫৩ সাল। তারপর তাঁরা বিয়ে করেছিলেন ১৯৫৩ সালের ১৮ ডিসেম্বর। বিয়েতে পরিবারের কেউ রাজী না। অবাঙালি মেয়েকে কেউ মেনে নিতে চাইল না। কিন্তু মান্না দে'র মা বললেন, তুই পছন্দ করে বিয়ে করেছিস, তুই ভালো থাকলেই ভগবানের কৃপা। তারপর সবাই সেই বিয়ে মেনে নিল। তাঁদের দুই কন্যা শুরোমা (জন্ম- ১৯ অক্টোবর ১৯৫৬ সালে) এবং সুমিতা (জন্ম- ২০ জুন ১৯৫৮ সালে)। মান্না দে পঞ্চাশ বছরেরও বেশী সময় বোম্বে বা এখনকার মুম্বাইয়ে কাটানোর পর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ব্যাঙ্গালোরের কালিয়ানগর শহরে বসবাস করেছেন। এছাড়াও তিনি কলকাতায়ও মাঝেমাঝে এসে বাস করতেন।

প্রবোধ চন্দ্র দে যাঁর ডাকনাম মান্না দে ১৯১৯ সালের ১ মে কলকাতায় জন্মগ্রহন করেন। ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যতম সেরা সঙ্গীত শিল্পীদের তিনি একজন। হিন্দি, বাংলা, মারাঠি, গুজরাটিসহ অজস্র ভাষায় তিনি ষাট বছরেরও অধিক সময় সঙ্গীত চর্চা করেছিলেন। বৈচিত্র্যের বিচারে তাঁকেই হিন্দি গানের ভুবনে সবর্কালের সেরা গায়ক হিসেবে স্বীকার করেন অনেক বিশেষজ্ঞ সঙ্গীতবোদ্ধারা। মৃত্যুর কিছুদিন পূর্বেও তিনি বিভিন্ন সঙ্গীতবিষয়ক অনুষ্ঠানে যোগ দিতে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণ করেছিলেন। মান্না দে গায়ক হিসেবে ছিলেন আধুনিক বাংলা গানের জগতে সর্বস্তরের শ্রোতাদের কাছে ব্যাপকভাবে জনপ্রিয় একজন সফল সঙ্গীত ব্যক্তিত্ব। পাশাপাশি তিনি হিন্দি এবং বাংলা সিনেমায় গায়ক হিসেবে বিশেষ সুনাম অর্জন করেছেন। মোহাম্মদ রফি, কিশোর কুমার, মুকেশের মতো তিনিও ১৯৫০ থেকে ১৯৭০ এর দশক পর্যন্ত ভারতীয় চলচ্চিত্র জগতে সমান জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন। সঙ্গীত জীবনে তিনি সাড়ে তিন হাজারেরও বেশি গান রেকর্ড করেন। সঙ্গীত ভুবনে তাঁর এ অসামান্য অবদানের কথা স্বীকার করে ভারত সরকার ১৯৭১ সালে তাঁকে পদ্মশ্রী, ২০০৫ সালে পদ্মবিভূষণ এবং ২০০৯ সালে দাদাসাহেব ফালকে সম্মাননায় অভিষিক্ত করে। ২০১১ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকার তাঁকে রাজ্যের সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মান 'বঙ্গবিভূষণ' প্রদান করে।

মান্না দে'র গাওয়া জনপ্রিয় গান অনেক। 'কফি হাউজের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই', 'আবার হবে তো দেখা, এ দেখা শেষ দেখা নয় তো', 'এই কূলে আমি, আর ওই কূলে তুমি', 'তীর ভাঙা ঢেউ আর নীড় ভাঙা ঝড়', 'যদি কাগজে লেখো নাম', 'সে আমার ছোট বোন', 'তুমি এলে, অনেক দিন পরে যেন বৃষ্টি এলো', 'ক ফোঁটা চোখের জল ফেলেছ যে তুমি', 'দীপ ছিল শিখা ছিল', 'সবাই তো সুখী হতে চায়', 'খুব জানতে ইচ্ছে করে', 'আমি তার ঠিকানা রাখিনি', ' জানি তোমার প্রেমের যোগ্য আমি তো নই', 'তুমি অনেক যত্ন করে', ' আমি যে জলসা ঘরে', ' এরই নাম প্রেম', 'তুমি নিজের মুখে বললে যেদিন', ' পৌঁষের কাছাকাছি রোদ মাখা সেই দিন', ' স্বপন যদি মধুর এমন', ' ও চাঁদ সামলে রাখো জোছনাকে', ' ও আমার মন যমুনার', ' এই তো সেদিন তুমি আমারে বোঝালে', ' যখন কেউ আমাকে পাগল বলে', ' হাজার টাকার ঝার বাতিটা', ' গহন মেঘের ছায়া', 'দরদি গো, কি চেয়েছি আর কি যে পেলাম', 'হৃদয়ের গান শিখেতো গায় তো সবাই, ক'জনা হৃদয় দিয়ে গাইতে জানে' সহ অনেক আধুনিক বাংলা গান মান্না দে'র কণ্ঠে কালজয়ী। এসব গান কোনো দিন পুরনো হবে না বলেই আমি বিশ্বাস করি।

২০০৫ সালে বাংলাভাষায় তাঁর আত্মজীবনী ‘জীবনের জলসাঘরে’ আনন্দ প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয়। পরে এটি ইংরেজিতে ‘মেমরীজ কাম এলাইভ’, হিন্দীতে ‘ইয়াদেন জি ওথি’ এবং মারাঠী ভাষায় ‘জীবনের জলসাঘরে’ নামে অনুদিত হয়েছে। মান্না দের জীবন নিয়ে ‘জীবনের জলসাঘরে’ নামে একটি তথ্যচিত্র ২০০৮ সালে মুক্তি পায়। বর্তমানে মান্না দে সঙ্গীত একাডেমি মান্না দে’র সম্পূর্ণ আর্কাইভ বিকশিত ও রক্ষণাবেক্ষণ করছে। পাশাপাশি রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয় ও কলকাতা সঙ্গীত ভবন মান্না দে’র সঙ্গীত সংরক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছে।

২০১৩ সালের ৮ই জুন ফুসফুসের জটিলতা দেখা দেওয়ায় মান্না দেকে ব্যাঙ্গালোরে একটি হাসপাতালের আইসিইউ তে ভর্তি করা হয়। ৯ই জুন, ২০১৩ সালে তাঁর মৃত্যুর গুজব ছড়িয়ে পড়লে ডাক্তাররা এই গুজবের অবসান ঘটান এবং নিশ্চিত করেন যে তিনি তখনও বেঁচে আছেন। তবে তার অবস্থার বেশ অবনতি হয়েছে এবং আরও কিছু নতুন জটিলতা দেখা দিয়েছে। পরে ডাক্তাররা জানান তাঁর অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়েছে। ২০১৩ সালের ২৪শে অক্টোবর ৯৪ বছর বয়সে ব্যাঙ্গালোরে এই মহান শিল্পী পরলোকগমন করেন। যতদিন বাংলা ভাষা থাকবে, যতদিন বাংলা ভাষার মানুষ গান শুনবে, ততদিন পৃথিবীর এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত মান্না দে আমাদের হৃদয়ে বেঁচে থাকবেন।

......................................

২৩ ডিসেম্বর ২০১৪

ঢাকা





মন্তব্য ৫ টি রেটিং +২/-০

মন্তব্য (৫) মন্তব্য লিখুন

১| ২৩ শে ডিসেম্বর, ২০১৪ রাত ৮:১৭

সুমন কর বলেছেন: যতদিন বাংলা ভাষা থাকবে, যতদিন বাংলা ভাষার মানুষ গান শুনবে, ততদিন পৃথিবীর এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত মান্না দে আমাদের হৃদয়ে বেঁচে থাকবেন।

চমৎকার জীবনী তুলে ধরেছেন। অনেক কিছু জানা গেল। অামার অন্যতম প্রিয় শিল্পী। একটা সময় উনার গান ছাড়া কিছুই শুনতাম না। এখনো শুনে যাই....

ভাল লাগা রেখে গেলাম।

গত বছর উনার মৃত্যুর দিনে একটি স্মৃতিময় পোস্ট তৈরি করেছিলাম।

মান্না দের মৃত্যুদিন, আমার জন্মদিন এবং উনাকে নিয়ে আমার কিছু স্মৃতি!!!

২| ২৩ শে ডিসেম্বর, ২০১৪ রাত ৯:১৫

রাতুল_শাহ বলেছেন: কিছুটা পড়লাম, উনার সম্পর্কে খুব একটা জানা ছিলো না।

৩| ২৩ শে ডিসেম্বর, ২০১৪ রাত ১০:৩০

সকাল রয় বলেছেন:
যখন কেউ আমাকে পাগল বলে, তার প্রতিবাদ করি আমি
যখন তুমি আমায় পাগল বলো ধন্য যে হয় সে পাগলামী
------------------------------
ধন্য আমি ধন্য হে, পাগল তোমার জন্য হে....

মান্না দে একজনই

৪| ২৩ শে ডিসেম্বর, ২০১৪ রাত ১১:৪৬

বঙ্গভূমির রঙ্গমেলায় বলেছেন:
সুমন কর বলেছেন: যতদিন বাংলা ভাষা থাকবে, যতদিন বাংলা ভাষার মানুষ গান শুনবে, ততদিন পৃথিবীর এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত মান্না দে আমাদের হৃদয়ে বেঁচে থাকবেন।

৫| ২৪ শে ডিসেম্বর, ২০১৪ রাত ১২:১৭

আলম দীপ্র বলেছেন: সকাল রয় বলেছেন:
যখন কেউ আমাকে পাগল বলে, তার প্রতিবাদ করি আমি
যখন তুমি আমায় পাগল বলো ধন্য যে হয় সে পাগলামী
------------------------------
ধন্য আমি ধন্য হে, পাগল তোমার জন্য হে....

মান্না দে একজনই


াআসলেই মান্না দে একজনই !

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.