নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
ছোটগল্প লিখি। গান শুনি। মুভি দেখি। ঘুরে বেড়াই। আর সময় পেলে সিলেকটিভ বই পড়ি।
৭ জানুয়ারি ২০১৫, বুধবার, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি'র জাতীয় নাট্যশালায় অনুষ্ঠিত হল পালাকার প্রযোজিত 'বাংলার মাটি বাংলার জল' নাটকের চব্বিশতম শো। নাটকটি রচনা করেছেন সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক। নির্দেশনা দিয়েছেন বিশিষ্ট নাট্যব্যক্তিত্ব আতাউর রহমান। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সার্ধশত জন্মবার্ষিকী উপলক্ষ্যে এটি একটি পালাকার প্রযোজনা। ইতোমধ্যে পালাকার 'বাংলার মাটি বাংলার জল' নাটকটির কলকাতায় দুটি শো করেছে।
উনিশ শতকের শেষের দিকে বিশেষ করে ১৮৮৭ থেকে ১৮৯৫ সময়কালে, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যখন পূর্ববঙ্গে পারিবারিক জমিদারি দেখাশোনার জন্য শিলাইদহ-শাহজাদপুর ও পতিসরে অবস্থান করেন, তখন তাঁর অল্প বয়সী ভ্রাতুষ্পুত্রী, মেজ ভাই সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের মেয়ে শ্রীমতি ইন্দিরা দেবীকে চিঠি লিখতেন। যেগুলো পরবর্তী সময়ে 'ছিন্নপত্র' নামে পরিচিতি পায়। সেখানে মোট চিঠির সংখ্যা ২৪৪। ছিন্নপত্রের চিঠিগুলোকেই অনুসঙ্গ হিসেবে নিয়ে নাট্যকার সৈয়দ শামসুল হক রচনা করেন নাটক 'বাংলার মাটি বাংলার জল'।
ছিন্নপত্রের বেশির ভাগ চিঠি রবীন্দ্রনাথ তাঁর চেয়ে বারো বছরের ছোট ভ্রাতুষ্পুত্রী ইন্দিরা দেবীকে লিখলেও, তিনি আসলে চিঠিগুলো লিখেছেন নিজেকেই। একটি চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ভারতীয়দের চরিত্রের দুটি দিক আছে—গৃহী এবং সন্ন্যাসী। সেই সন্ন্যাসীর জন্য তিনি আসলে এসব লিখেছেন। সেই চিঠিগুলোতে রবীন্দ্রনাথ আসলে কী লিখেছেন? লিখেছেন পূর্ববঙ্গের অপরূপ সৌন্দর্যের কথা, দোর্দণ্ড প্রতাপশালী পদ্মা নদী ও চরের কথা, শান্ত-শ্যামল পল্লী ও বাংলার সহজ-সরল মানুষের কথা, সবুজে ঘেরা পৃথিবী ও অসীম আকাশের কথা, এক ঋতু থেকে অপর ঋতুতে, সকাল-দুপুর-সন্ধ্যা-গোধূলীতে রূপ বদল করা প্রকৃতির কথা। নিজের বোটে ঘুরে ঘুরে রবীন্দ্রনাথ পল্লীর সহজ-সরল মানুষ, নিরন্ন কৃষক আর প্রজাদের দেখে দেখে যে ভাবনা তাঁর অন্তরে তখন খেলা করেছিল, তার সবই তিনি ছিন্নপত্রের পাতায় পাতায় তুলে ধরেছেন। এই ঘুরে বেড়ানোর কারণে মূলত জমিদার পরিবারের বাইরে যে জীবনের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হলো তা বাকি জীবন রবীন্দ্রনাথ অন্তরে গভীর ভাবে লালন করেছেন। মূলত কবির মানসপটে এই দেখাই তাঁর অন্তরচক্ষুকে খুলে দিয়েছিল।
পদ্মার রূপ বর্ণনায় তিনি লিখেছেন,
'...হে পদ্মা আমার,
তোমায় আমায় দেখা শত শত বার।
একদিন জনহীন তোমার পুলিণে,
গোধুলির শুভলগ্নে হেমন্তের দিনে,
সাক্ষী করি পশ্চিমের সূর্য অস্তমান
তোমারে সঁপিয়াছিনু আমার পরান।
অবসানসন্ধ্যালোকে আছিলে সেদিন
নতমুখী বধুসম শান্ত বাক্যহীন;
সন্ধ্যাতারা একাকিনী সস্নেহ কৌতুকে
চেয়ে ছিল তোমাপানে হাসিভরা মুখে।
সেদিনের পর হতে, হে পদ্মা আমার,
তোমায় আমায় দেখা শত শত বার।...'
বাংলার রূপ বর্ণনায় রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন,
'... ঐ-যে মস্ত পৃথিবীটা চুপ করে পড়ে রয়েছে ওটাকে এমন ভালোবাসি- ওর এই গাছপালা নদী মাঠ কোলাহল নিস্তব্ধতা প্রভাত সন্ধ্যা সমস্তটা-সুদ্ধ দু’হাতে আঁকড়ে ধরতে ইচ্ছা করে... মনে হয় পৃথিবীর কাছ থেকে আমরা যে-সব পৃথিবীর ধন পেয়েছি এমন কি কোনো স্বর্গ থেকে পেতুম?... ...স্বর্গ আর কী দিত জানি না, কিন্তু এমন কোমলতা দুর্বলতা-ময়, এমন সকরুণ আশঙ্কা-ভরা, অপরিণত এই মানুষগুলির মতো এমন আপনার ধন কোথা থেকে দিত!... ...আমাদের এই মাটির মা, আমাদের এই আপনার পৃথিবী, এর সোনার শস্যক্ষেত্রে এর স্নেহশালিনী নদীগুলোর ধারে, এর সুখদুঃখময় ভালোবাসার লোকালয়ের মধ্যে এই সমস্ত দরিদ্র মর্ত হৃদয়ের অশ্রুর ধনগুলিকে কোলে করে এনে দিয়েছে।... ...আমরা হতভাগারা তাদের রাখতে পারি নে, বাঁচাতে পারি নে, নানা অদৃশ্য প্রবল শক্তি এসে বুকের কাছ থেকে তাদের ছিঁড়ে ছিঁড়ে নিয়ে যায়। কিন্তু বেচারা পৃথিবীর যতদূর সাধ্য তা সে করেছে... আমি এই পৃথিবীকে বড় ভালোবাসি।...'
একটি চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন,
'......শিলাইদহের অপর পারে একটা চরের সামনে আমাদের বোট লাগানো আছে। প্রকাণ্ড চর- ধু ধু করছে- কোথাও শেষ দেখা যায় না- কেবল মাঝে মাঝে এক এক জায়গায় নদীর রেখা দেখা যায়- আবার অনেক সময়ে বালি’কে নদী বলে ভ্রম হয়।... গ্রাম নেই, লোক নেই, তরু নেই, তৃণ নেই- বৈচিত্রের মধ্যে জায়গায় জায়গায় ফাটল-ধরা ভিজে কালো মাটি, জায়গায় জায়গায় শুকনো সাদা বালি।... ...পূর্ব দিকে মুখ ফিরিয়ে চেয়ে দেখলে দেখা যায় উপরে অনন্ত নীলিমা আর নীচে পাণ্ডুরতা। আকাশ শূণ্য এবং ধরণীও শূণ্য, নীচে দরিদ্র শুষ্ক কঠিন শূণ্যতা আর উপরে অশরীরী উদার শূণ্যতা। এমনতর desolation কোথায়ও দেখা যায় না।......হঠাৎ পশ্চিমে মুখ ফেরাবামাত্র দেখা যায় স্রোতোহীন ছোট নদীর কোল, ও পারে উঁচু পাড়, গাছপালা, কুটির। সন্ধ্যাসূর্যালোকে আশ্চর্য স্বপ্নের মতো। ঠিক যেন এক পারে সৃষ্টি এবং আর এক-পারে প্রলয়।...
পদ্মায় ভয়াল ঝড়কে স্মরণ করে রবীন্দ্রনাধ লিখেছেন,
'...কাল পনের মিনিট বাইরে বসতে না বসতে পশ্চিমে ভয়ানক মেঘ করে এল। খুব গাঢ় আলুথালু রকমের মেঘ, তারই মাঝে মাঝে চোরা আলো পড়ে রাঙা হয়ে উঠেছে।... ...গাছগুলো হাউহাউ শব্দে একবার পূর্বে একবার পশ্চিমে লুটিয়ে লুটিয়ে পড়তে লাগল। ঝড় যেন সোঁ সোঁ করে সাপুড়ের মতো বাঁশি বাজাতে লাগল। আর জলের ঢেউগুলো তিন লক্ষ সাপের মতো ফণা তুলে তালে তালে নৃত্য আরম্ভ করে দিলে।... ..কালকের সে যে কী কাণ্ড সে আর কী বলব! বজ্রের যে শব্দ সে আর থামে না- আকাশের কোন্খানে যেন একটা আস্ত জগৎ ভেঙে চুরমার হয়ে যাচ্ছে। বোটের খোলা জানালার উপর মুখ রেখে প্রকৃতির সেই রুদ্রতালে আমিও বসে বসে মনটাকে দোলা দিচ্ছিলাম। সমস্ত মনের ভিতরটা- যেন ছুটি-পাওয়া স্কুলের ছেলের মতো বাইরে ঝাঁপিয়ে উঠেছিল।... '
পূর্ণিমার অপরূপ শোভা বর্ণনায় রবীন্দ্রনাধ লিখেছেন,
'...কোজাগর পূর্ণিমার দিন নদীর ধারে ধারে আস্তে আস্তে বেড়াচ্ছিলুম- আর মনের মধ্যে কথোপকথন চলছিল; ঠিক ‘কথোপকথন’ বলা যায় না, বোধ হয় আমি একলাই বকে যাচ্ছিলুম আর আমার সেই কাল্পনিক সঙ্গীটি অগত্যা চুপ্চাপ করে শুনে যাচ্ছিল।... ...কিন্তু কী চমৎকার হয়েছিল, কী বলব! কতবার বলেছি, কিন্তু সম্পূর্ণ কিছুতেই বলা যায় না। নদীতে একটি রেখামাত্র ছিল না; ও-ই সেই চরের পরপারে যেখানে পদ্মার জলের শেষ প্রান্ত দেখা যাচ্ছে সেখান থেকে আর এ পর্যন্ত একটি প্রশস্ত জ্যোৎস্নারেখা ঝিক্ ঝিক্ করছে।... ...মনে হয়, যেন একটি উজাড় পৃথিবীর উপরে একটি উদাসীন চাঁদের উদয় হচ্ছে, জনশূণ্য জগতের মাঝখান দিয়ে একটি লক্ষ্যহীন নদী বহে চলেছে, মস্ত একটা পুরাতন গল্পেই পরিত্যক্ত পৃথিবীর উপরে শেষ হয়ে গেছে। আজ সেই-সব রাজা রাজকন্যা পাত্র মিত্র স্বর্ণপুরী কিছুই নেই, কেবল সেই গল্পের ‘তেপান্তরের মাঠ’ এবং ‘সাত সমুদ্র তেরো নদী’ ম্লান জ্যোৎস্নায় ধু ধু করছে। ... আমি সেই মুমূর্ষ পৃথিবীর একটিমাত্র নাড়ীর মতো আস্তে আস্তে চলছিলুম।... '
গ্রামীণ-পল্লী'র সৌন্দর্য বর্ণনায় রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন,
'...আমার সামনে নানারকম গ্রাম্য দৃশ্য দেখতে পাই, সেগুলো আমার দেখতে বেশ লাগে। ঠিক আমার জানলার সুমুখে, খালের ওপারে, একদল বেদে বাখারির উপর খানকতক দর্মা এবং কাপড় টাঙিয়ে দিয়ে তারই মধ্যে আশ্রয় গ্রহণ করেছে। গুটিতিনেক খুব ছোট ছোট ছাউনি মাত্র- তার মধ্যে মানুষের দাঁড়াবার জো নেই। ঘরের বাইরেই তাদের সমস্ত গৃহকর্ম চলে।... ...অনেক কাল বোটের মধ্যে বাস করে হঠাৎ সাজাদপুরের বাড়িতে এসে উত্তীর্ণ হলে বড়ো ভালো লাগে। বড়ো বড়ো জানলা দরজা, চারিদিক থেকে আলো বাতাস আসছে... যেদিকে চেয়ে দেখি সেই দিকেই গাছের সবুজ ডালপালা চোখে পড়ে এবং পাখির ডাক শুনতে পাই।... ..এখানে যেমন আমার মনে লেখবার ভাব ও ইচ্ছা আসে এমন কোথাও না। বাইরের জগতের একটা সজীব প্রভাব ঘরে অবাধে প্রবেশ করে। ...আলোতে আকাশে বাতাসে শব্দে গন্ধে সবুজহিল্লোলে এবং আমার মনের নেশায় মিশিয়ে কত গল্পের ছাঁচ তৈরি হয়ে ওঠে!... ...বিশেষত এখানকার দুপুর বেলাকার মধ্যে একটা নিবিড় মোহ আছে। রৌদ্রের উত্তাপ, নিস্তব্ধতা, নির্জনতা, পাখিদের- বিশেষত কাকের ডাক, এবং সুন্দর সুদীর্ঘ অবসর- সবসুদ্ধ আমাকে উদাস করে দেয়। ...কেন জানি নে মনে হয়, এইরকম সোনালি রৌদ্রে ভরা দুপুর বেলা দিয়ে আরব্য উপন্যাস তৈরি হয়েছে।...আমার এই সাজাদপুরের দুপুর বেলা গল্পের দুপুর বেলা। মনে আছে, ঠিক এই সময়ে এই টেবিলে বসে আপনার মনে ভোর হয়ে পোস্ট্মাস্টার গল্পটা লিখেছিলুম।... ...যখন ভেবে দেখি এ জীবনে কেবলমাত্র ৩২ টি শরৎকাল এসেছে এবং গেছে, তখন ভারি আশ্চর্য বোধ হয়! অথচ মনে হয়, আমার স্মৃতিপথ ক্রমশই অস্পষ্টতর হয়ে অনাদিকালের দিকে চলে গেছে।... ...এই বৃহৎ মানসরাজ্যের উপর যখন মেঘমুক্ত সুন্দর প্রভাতের রৌদ্রটি এসে পড়ে তখন আমি যেন আমার এক মায়া-অট্টালিকার বাতায়নে বসে এক সুদূর বিস্তৃত ভাবরাজ্যের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে থাকি এবং আমার কপালে যে বাতাসটি এসে লাগতে থাকে সে যেন অতীতের সমস্ত অস্পষ্ট মৃদু গন্ধপ্রবাহ বহন করে আনতে থাকে।... '
চরাচরের অপরূপ বর্ণনায় রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন,
'...আমি আলো ও বাতাস এত ভালোবাসি! গেটে (Goethe) মরবার সময় বলেছিলেনঃ More light! ...আমার যদি সে সময় কোনো ইচ্ছা প্রকাশ করবার থাকে তো আমি বলিঃ More light and more space! ......অনেকে বাংলাদেশকে সমতলভূমি বলে আপত্তি প্রকাশ করে; কিন্তু সেইজন্যেই এ দেশের মাঠের দৃশ্য, নদীতীরের দৃশ্য আমার এত বেশি ভালো লাগে। যখন সন্ধ্যার আলোক এবং সন্ধ্যার শান্তি উপর থেকে নামতে থাকে তখন সমস্ত অনবরুদ্ধ আকাশটি একটি নীলকান্তমণির পেয়ালার মতো আগাগোড়া পরিপূর্ণ হয়ে উঠতে থাকে, যখন স্তিমিত শান্ত নীরব মধ্যাহ্ন তার সমস্ত সোনার আঁচলটি বিছিয়ে দেয় তখন কোথাও সে বাধা পায় না।... ...চেয়ে চেয়ে দেখবার এবং দেখে দেখে মনটা ভরে নেবার এমন জায়গা আর কোথায় আছে!... ...কাল থেকে হঠাৎ আমার মাথায় একটা হ্যাপি থট এসেছে। আমি চিন্তা করে দেখলুম, পৃথিবীর উপকার করব ইচ্ছা থাকলেও কৃতকার্য হওয়া যায় না; কিন্তু তার বদলে যেটা করতে পারি সেইটে করে ফেললে অনেক সময় আপনিই পৃথিবীর উপকার হয়, নিদেন যা হোক একটা কাজ সম্পন্ন হয়ে যায়। আজকাল মনে হয়, যদি আমি আর কিছুই না করে ছোট ছোট গল্প লিখতে বসি তা হলে কতকটা মনের সুখে থাকি এবং কৃতকার্য হতে পারলে হয়তো পাঁচজন পাঠকেরও মনের সুখের কারণ হওয়া যায়। ...গল্প লেখবার একটা সুখ এই, যাদের কথা লিখব তারা আমার দিনরাত্রির সমস্ত অবসর একেবারে ভরে রেখে দেবে, আমার একলা মনের সঙ্গী হবে, বর্ষার সময় আমার বদ্ধ ঘরের সংকীর্ণতা দূর করবে।... '
শরতের সৌন্দর্য বর্ণনায় রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন,
'...এই সুবিস্তীর্ণ জলরাজ্যের মধ্যে শরতের উজ্জ্বল রৌদ্রে আমি জানালার কাছে এক চৌকিতে বসে আর-এক চৌকির উপর পা দিয়ে সমস্ত বেলা কেবল গুন্গুন্ করে গান করছি। ...রামকেলি প্রভৃতি সকালবেলাকার সুরের একটু আভাস লাগবামাত্র এমন একটি বিশ্বব্যাপী করুণা বিগলিত হয়ে চারি দিককে বাষ্পাকুল করছে যে এইসমস্ত রাগিণীকে সমস্ত আকাশের সমস্ত পৃথিবীর নিজের গান বলে মনে হচ্ছে। এ একটা ইন্দ্রজাল, একটা মায়ামন্ত্র।... ...এখানে আমি একলা খুব মুগ্ধ এবং ত গত চিত্তে অর্ধনিমীলিতনেত্রে গেয়ে থাকি এবং পৃথিবীটা একটি সূর্যকরোজ্জ্বল অতি সুক্ষ্ম অশ্রুবাষ্পে আবৃত হয়ে, সাতরঙা ইন্দ্রধনু-রেখায় রঞ্জিত হয়ে দেখা দেয়।... '
ইন্দিরা দেবীকে আরেকটি চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন,
'...তোকে আমি যে-সব চিঠি লিখেছি তাতে আমার মনের সমস্ত বিচিত্র ভাব যে রকম ব্যক্ত হয়েছে এমন আমার আর কোনো লেখায় হয় নি। ...তোকে আমি যখন লিখি তখন আমার এ কথা কখনো মনে উদয় হয় না যে, তুই আমার কোন কথা বুঝবি নে, কিম্বা ভুল বুঝবি, কিম্বা বিশ্বাস করবি নে, কিম্বা যেগুলো আমার পক্ষে গভীরতম সত্য কথা সেগুলোকে তুই কেবলমাত্র সুরচিত কাব্যকথা বলে মনে করবি। সেই জন্যে আমি যেমনটি মনে ভাবি ঠিক সেই রকমটি অনায়াসে বলে যেতে পারি।... '
রবীন্দ্রনাথ যখন শিলাইদহে আসেন তখন তাঁর ছিল বয়স মাত্র সাতাশ বছর। দীর্ঘ আট বছর পূর্ববঙ্গের রূপ ও সৌন্দর্যে মুগ্ধ রবীন্দ্রনাথ অনেক সমৃদ্ধ হয়েছেন। রবীন্দ্রনাথের শিলাইদহের বাড়িতে তখন ডাক পৌঁছে দিতেন গগণ। গগণ হরকরা। যিনি লালনের একজন ভাবশিষ্য। বাড়ি বাড়ি ডাক পৌঁছে দিতে দিতে তিনি গান করতেন। ভারী মরমীয়া কণ্ঠ ছিল তাঁর। গগণের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের তখন ভারী এক অন্তরঙ্গ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। অবসর পেলেই গগণ এসে রবীন্দ্রনাথকে গান শুনিয়ে যেতেন। আমাদের জাতীয় সঙ্গীত 'আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি...রবীন্দ্রনাথের গানটি গগণের কাছে শোনা 'আমি কোথায় পাব তারে..গানটির একই সুরে লেখা। নাটকে চরিত্রটি করেছেন দোস্ত মোহাম্মদ নূরী শাহ।
প্রজাদের দুঃখ রবীন্দ্রনাথকে দারুণভাবে আলোড়িত করেছিল। এ নিয়ে ইংরেজদের শাসনের প্রতি তাঁর প্রচণ্ড ক্ষোভ ছিল। তিনি তখন কৃষকদের জন্য নানান সমাজকল্যান মূলক কর্মকাণ্ডে নিজেকে সম্পৃক্ত করেছিলেন। মূলত ছিন্নপত্রের চিঠিগুলোতে রবীন্দ্রনাথ এক নতুন বাংলাদেশের স্রষ্ঠা। যেখানে ক্ষুধা, দারিদ্র্য, সহজ-সরল মানুষগুলোর দৈনন্দিন সুখ-দুঃখের এক অভিন্ন চিত্র তিনি ছিন্ন ছিন্ন লেখায় ভিন্ন ভিন্ন চিঠিতে নানাভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। এই সময়ে রবীন্দ্রনাথ গান লেখায় মনযোগী হয়েছিলেন। লিখেছেন এমন অসংখ্য গান,
'... ...ছিন্ন পাতার সাজাই তরণী, একা একা করি খেলা–
আন্মনা যেন দিক্বালিকার ভাসানো মেঘের ভেলা॥
যেমন হেলায় অলস ছন্দে কোন্ খেয়ালির কোন্ আনন্দে
সকালে-ধরানো আমের মুকুল ঝরানো বিকালবেলা॥
যে বাতাস নেয় ফুলের গন্ধ, ভুলে যায় দিনশেষে,
তার হাতে দিই আমার ছন্দ–কোথা যায় কে জানে সে।
লক্ষ্যবিহীন স্রোতের ধারায় জেনো জেনো মোর সকলই হারায়,
চিরদিন আমি পথের নেশায় পাথেয় করেছি হেলা॥ ...'
নির্দেশক আতাউর রহমান 'বাংলার মাটি বাংলার জল' নাটকে রবীন্দ্রনাথের সেই সময়ের অনেক চিত্রকে নানাভাবে এক্সপারিমেন্ট করেছেন। প্রতিটি শোতেও রয়েছে নানান মাত্রার নতুন নতুন এক্সপারিমেন্ট। নাটকে রবীন্দ্রনাথ চরিত্রে অভিনয় করেছেন শামীম সাগর। নাট্যমহলে যিনি এখন এই চরিত্রে মনলোভী অভিনয়ের জন্য সবার কাছেই পরিচিত। আতাউর রহমান ডাকঘরের রতন আর পোস্টমাস্টারকেও নাটকে হাজির করেছেন। নাটকে পোস্টমাস্টার চরিত্রটি করেছেন আমিনুর রহমান মুকুল। রতনের কাছ থেকে যখন পোস্টমাস্টার বিদায় নেয়, সেই দৃশ্য দর্শকের অন্তরকে সত্যি সত্যিই ভিজিয়ে দেবার মত। রতন চরিত্রটি করেছেন রোদ। নাটকে চিত্রাঙ্গদা চরিত্রে শর্মী মালা এক নতুন সৌন্দর্য ফুটিয়ে তোলেন। যা দর্শকদের মুগ্ধ করে। পাশাপাশি বরুণ চরিত্রে অনিকেত পাল বাবু আমাদের কাছে পুরাণের সৌম্য পৌরুষকে হাজির করেন। মাভৈ মাভৈ...
রবীন্দ্রনাথ ওই সময়কালে রচনা করেছিলেন তাঁর 'সমাপ্তি', 'ছুটি', 'পোস্টমাস্টার', 'ক্ষুধিত-পাষাণ', 'চিত্রাঙ্গদা' প্রভৃতি রচনাগুলো। যা ছোটো ছোটো দৃশ্যে নির্দেশক 'বাংলার মাটি বাংলার জল' নাটকে দৃশ্যায়ন করেছেন। নাটকে অন্যান্য বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেছেন, শাহরিয়ার খান রিন্টু, দোস্ত মোহাম্মদ নূরী শাহ, সেলিম হায়দার, ফাহমিদা মল্লিক শিশির, মোহাম্মদ আলী পারভেজ, লিয়াকত লিকু, ইউসুফুল হক শুভ, জাহিদ হাসান, রাশেদ খান মেনন, আরিফুল হক চঞ্চল, প্রণব দাশ বাবু, রনি খান, ইমরান হোসেন, রোদ, অরিত্র প্রমুখ।
নাটকে সেট ডিজাইন ও কোরিওগ্রাফি করেছেন অনিকেত পাল বাবু। আলোক প্রক্ষেপণ করেছেন নাসিরুল হক খোকন। সঙ্গীত নির্দেশনা দিয়েছেন অজয় দাশ। কস্টিউম ডিজাইন করেছেন লুসি তৃপ্তি গোমেজ। এছাড়া 'বাংলার মাটি বাংলার জল' নাটকে নির্দেশকের প্রধান সহায়ক হিসেবে কাজ করেছেন পালাকারের অধিকারী আমিনুর রহমান মুকুল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সার্ধশত জন্মবার্ষিকী উপলক্ষ্যে এটি একটি পালাকার প্রযোজনা।
.......................................
৮ জানুয়ারি ২০১৫
ঢাকা
২| ০৮ ই জানুয়ারি, ২০১৫ দুপুর ১:৩২
ঘোর বলেছেন: বাংলাদেশের প্রথম সামাজিক গণমাধ্যম
http://madeinbangladesh.biz
ক্লিক করুন, সঙ্গে থাকুন
©somewhere in net ltd.
১| ০৮ ই জানুয়ারি, ২০১৫ সকাল ১১:৩৯
কাল্পনিক_ভালোবাসা বলেছেন: আমার খুব দেখতে যাবার ইচ্ছে ছিল, কিন্তু পারলাম না!
আপনার লেখা পড়ে দুধের স্বাধ ঘোলে মেটালাম।