নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
ছোটগল্প লিখি। গান শুনি। মুভি দেখি। ঘুরে বেড়াই। আর সময় পেলে সিলেকটিভ বই পড়ি।
১৫ ফেব্রুয়ারি বইমেলায় যাইনি। সারাদিন পল্টনে আমার বইয়ের পেস্টিং, প্লেট, পজেটিভ, প্রেস, এগুলো নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম। সন্ধ্যায় শিল্পকলা একাডেমিতে ছিল আমাদের নাটকের দল পালাকারের নাটক 'নারীগণ'। ১৭৫৭ সালের ৩ জুলাই উপমহাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের প্রতীক নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে হত্যা করা হয়। এই হত্যার মাধ্যমে ভারতীয় উপমহাদেশ দুইশো বছর ব্রিটিশদের গোলামিতে পরিনত হয়। নবাব সিরাজউদ্দৌলার মৃত্যুর পর তাঁর পরিবারের নারীদের কী হয়েছিল, সেটাই এই নাটকের মূল বিষয়বস্তু। এই পটভূমিকায় সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক রচনা করেন 'নারীগণ' নাটকটি। এটি বৈচিত্র্য সন্ধানী নাট্যদল পালাকারের নতুন প্রযোজনা। নাটকটির নির্দেশনা দিয়েছেন মঞ্চসারথী আতাউর রহমান।
নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে হত্যার পর নবাব মহলের অন্তপুরে বন্দি নারীদের নানান উপলব্ধি- নবাব সিরাজের বন্দি নানি, মা, পত্নীর জবানে নাটকটিতে উঠে আসে তাদের জীবনে ঘটে যাওয়া নানান ঘটনা। রাজনীতিতে নারীদের অংশগ্রহণ, নারীর মর্যাদা ও ইচ্ছার স্বাধীনতাসহ অনেক বিষয়ে অবমাননার হাত থেকে বাঁচতে এই বন্দি নারীরা আত্মহত্যাও করতে পারে না। কারণ তাদের আত্মহননের পথও বন্ধ করে দেওয়া হয়। অঙ্গুরির বিষ কেড়ে নেওয়া হয়। কেড়ে নেওয়া হয় খঞ্জর। প্রহরীর রূঢ় হাত তাদের শরীর স্পর্শ করে। তাদের বন্দি করার মাধ্যমেই ঘটনার শেষ হয় না। ক্ষমতা পাকাপোক্ত করতে এবং বিদ্রোহের পথ রুদ্ধ করতে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে এসব নারীদের হত্যাও করা হয়। এসব ঘটনা নিয়েই গড়ে উঠেছে 'নারীগণ' নাটকটি। নাটকটির প্রধান প্রধান চরিত্রগুলো হল নবাব সিরাজের নানী, মা, পত্নী, খালা ঘষেটি বেগম, সিরাজের বাইজি, নবাব সিরাজ, নবাব সিরাজ ও মীরজাফরের লোক লস্কর। বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেছেন ফারহানা মিঠু, দীপ্তা রক্ষিত লাভলী, তানিয়া হোসাইন, ফাহমিদা মল্লিক শিশির, জয়িতা মহলানবীশ, মুনিরা অবনী, তিথী দাশ সাথী, কাজী ফয়সাল, শাহরিয়ার খান রিন্টু, তাপস তপু, আমিনুর রহমান মুকুল প্রমুখ। নাটকটির আলোক পরিকল্পক ছিলেন ঠাণ্ডু রায়হান, সঙ্গীত নির্দেশনা দিয়েছেন অজয় দাস, সেট করেছেন অনিকেত পাল। এটি পালাকারের সপ্তম প্রযোজনা। 'নারীগণ' নিয়ে বিস্তারিত পরে কোথাও লিখব।
১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৫, সোমবার। অমর একুশে বইমেলায় যাই দুপুর তিনটায়। প্রথমে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ঢু মেরে চলে যাই বাংলা একাডেমির লিটল ম্যাগ প্রাঙ্গন প্রিয় বহেড়াতলায়। শিল্পী চারু পিন্টু ও কবি কাজী টিটোকে নিয়ে চা খেতে বাইরে আসি। আবার গিয়ে লিটল ম্যাগ প্রাঙ্গনে বসতেই আসেন লেখক স্বকৃত নোমান। নোমানের কাছে শুনলাম- ইরানের লেখক আলি দস্তি'র 'টোয়েন্টি থ্রি ইয়ার্স: এ স্ট্যাডি অব দ্য প্রোফেটিক ক্যারিয়ার অব মুহাম্মদ' বইটির এবার বাংলায় অনুবাদ করেছেন আবুল কাশেম ও সৈকত চৌধুরী। বইটি প্রকাশ করেছিল রোদেলা প্রকাশনী। হেফাজতে ইসলাম বইটি প্রকাশ করার দায়ে রবিবার বিকেলে বাংলাবাজারে রোদেলার অফিসে তালা ঝুলিয়ে দিয়েছে। হেফাজত মহাসচিব মাওলানা জুনায়েদ বাবুনগরী ও সাংগঠনিক সম্পাদক মাওলানা আজিজুল হক ইসলামাবাদি বইটি নিষিদ্ধ এবং ‘নাস্তিকদের পৃষ্ঠপোষক’ রোদেলা প্রকাশনীকে নিষিদ্ধ করার দাবি জানিয়ে গণমাধ্যমে বিবৃতি দিয়েছে। এমনকি প্রকাশক রিয়াজ খানকে ফোন করে হত্যার হুমকি দেওয়া হচ্ছে। ‘নবি মুহাম্মদের ২৩ বছর’ নামে বাংলায় বইটি প্রকাশ করায় রোদেলা প্রকাশনীর ওয়েবসাইট হ্যাক করেছে একটি ইসলামি হ্যাকার গ্রুফ। ইতোমধ্যে বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষ অমর একুশে গ্রন্থমেলায় রোদেলা প্রকাশনীর স্টল বন্ধ করে দিয়েছে এবং আগামী বছর রোদেলাকে বইমেলায় অযোগ্য ঘোষণা করেছে।
যদিও রোদেলা প্রকাশনীর প্রকাশক রিয়াজ খান বইমেলার স্টল এবং বাংলাবাজারের অফিস থেকে সরিয়ে নিয়েছেন। বইটি আর বিক্রি করবেন না বলে ঘোষণা দিয়েছেন এবং বলেছেন ‘বইটিতে নবী মুহাম্মদের বিরুদ্ধে কোনো কথা থাকতে পারে এমনটি আমার ধারণায় ছিল না। যেহেতু ভুল করেছি, তাই অপরাধ স্বীকার করে আমি বইটি প্রত্যাহার করে নিচ্ছি।’ তারপরেও রোদেলা প্রকাশনীর উপর বাংলা একাডেমি এভাবে কর্তৃত্ব দেখানোর পেছনে কারণ কি?
গত দুইদিন এই বইটি নিয়ে দেশের প্রধান প্রধান সংবাদ মাধ্যম বলতে গেলে নিরব ছিল। বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষ এখন পর্যন্ত বইটি পড়েনি। কিন্তু তারা হেফাজতের সঙ্গে সুর মিলিয়ে রোদেলা প্রকাশনীকে শুধু বইমেলা থেকে বহিস্কার করেনি, আগামী বছরের জন্যও নিষিদ্ধ করেছে। আসলে বাংলা একাডেমি এখানে সরকারের পুতুল হিসেবে কাজ করেছে। কারণ হেফাজত হুমকি দিয়েছে, যদি রোদেলাকে নিষিদ্ধ করা না হয়, তাহলে তারা শাপলা চত্বরের সমাবেশের মত আবারো রাজপথ দখল করবে। সরাকারের কোনো মহলও এই বইটি এখনো পড়েনি। বিএনপি ও তাদের ২০ দলীয় জোটের টানা অবরোধ ও হরতালের মধ্যে নতুন করে আবার হেফাজতের রাজপথ দখলের হুমকিকে সরকার গুরুত্ব দিয়েই বাংলা একাডেমিকে যা নির্দেশ করেছে, বাংলা একাডেমি এখানে তা শুধু পুতুলের মত পালন করেছে। সবচেয়ে আশ্চার্যের বিষয়, বইটি কিন্তু সরকারিভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়নি। কিন্তু হেফাজতের দাবিকে মানতে গিয়ে এভাবে রোদেলা প্রকাশনীকে বইমেলায় নিষিদ্ধ করায় বাংলা একাডেমি যে একটি নপুংসক প্রতিষ্ঠান তা আবারো প্রমাণ করল।
খোদ ইরানে আলী দস্তি'র এই বইটি মোটেও নিষিদ্ধ নয়। পৃথিবীর বহু ভাষায় এই বইটি প্রকাশ পেয়েছে। কোথাও বইটি নিষিদ্ধ নয়। ওয়েবসাইটে বইটির ইংরেজি ভার্সান যে কেউ এখনো ডাউনলোড করে পড়তে পারে। অথচ হেফাজতকে সামাল দিতে সরকার যে সিদ্ধান্ত নিল আর বাংলা একাডেমি প্রকাশকদের অভিভাবক হিসেবে যে কাজটি করল, তা নিসন্দেহে দুঃখজনক। রোদেলা প্রকাশনীতে এই বইটি ছাড়াও আরো তিন চারশো লেখকের বই আছে। সেসব লেখকদের কি অপরাধ? তাদের বই কেন আমরা কিনতে পারব না? রোদেলা বিতর্কিত বইটি তুলে নিয়েছে, এখানেই বিষয়টির মিমাংসা হয়ে গেলে সেটি জাতির জন্য সভ্য আচরণ হতো। কিন্তু হেফাজতকে ম্যানেজ করতে গিয়ে সরকার ও বাংলা একাডেমি যা যা করল, তা বাংলাদেশের যে কোনো লেখক, কবি, সাহিত্যিক, লেখালেখির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তি এবং প্রকাশনার সঙ্গে যুক্ত যে কোনো প্রকাশকের জন্য একটি বড় ধরনের অশনিসংকেত। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগতে পারে এমন অযুহাতে যদি কোনো বই নিষিদ্ধ করা হয়, তাহলে স্বয়ং বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত অনেক বই, গবেষণা, প্রবন্ধ, বাংলা একাডেমিতে চাকরি করেন বা করেছেন এমন অনেক লেখকের বই, ক্লাস টেনে এখনো যে সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ'র 'লাল সালু' পড়ানো হয়, সেই বইগুলো তো হেফাজতের মানার কথা নয়।
তাহলে কি বাংলাদেশে মুক্তবুদ্ধির চর্চা কার্যত নিষিদ্ধ করা হয়েছে? কারণ এখানে হেফাজত আছে। সংবিধানে আমাদের রাষ্ট্রের ধর্ম ইসলাম আছে। হেফাজতের রাজপথ দখল করার হুমকি আছে। তাহলে সরকার এখন যা যা করতে পারে-
১. বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক হিসেবে হেফাজতের কোনো মুফতিকে দায়িত্ব দেওয়া হোক। বাংলা একাডেমি ইসলামী চিন্তাবিদদের দিয়ে ঢেলে সাজানো হোক।
২. বাংলাদেশের সকল প্রকাশকদের প্রকাশিতব্য বইগুলো হেফাজত কর্তৃক যাচাই বাছাই করার পর প্রকাশযোগ্য ছাড়পত্র নেওয়ার ব্যবস্থা করা হোক।
৩. বাংলাদেশের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে হেফাজত কর্তৃক নতুন করে সিলেবাস ও পাঠযোগ্য বিষয়বলী নির্ধারণ করা হোক।
যদি এই তিনটি কাজ করা না যায়, তাহলে সরকার রাজনৈতিক কারণে যে সিদ্ধান্তটি নিয়েছে, এটি লেখক ও প্রকাশকদের জন্য একটি বড় ধরনের অশনিসংকেত। আমরা চাই শিঘ্রই রোদেলা প্রকাশনার স্টলটি বইমেলায় উন্মুক্ত করা হবে। বিতর্কিত বইটি কর্তৃপক্ষ যাচাই বাছাই করে যা করার সিদ্ধান্ত দিক। কিন্তু একজন প্রকাশকের উপর এমন ঢালাউ শাস্তি কোনোভাবেই প্রকৃত লেখক সমাজ বা প্রকাশনার সঙ্গে জড়িত কেউ মেনে নিতে পারে না। রোদেলা থেকে প্রকাশিত অন্য বইগুলো পাঠক যাতে কিনতে পারে, সেই ব্যবস্থা করা হোক। পাশাপাশি রোদেলা প্রকাশনীর প্রকাশক রিয়াজ খানকে যথাযথ নিরাপত্তা দেওয়া হোক।
বইমেলায় এটিই ছিল মূলত আলোচনার বিষয়। আজ আর আমি ঢালাউভাবে বইমেলার বর্ণনা লিখব না। অনেকের সঙ্গে দেখা হয়েছে, আড্ডা হয়েছে। যারা প্রতিষ্ঠানের দালালি করে নিজেদের বড় লেখক ভাবেন, তাদের প্রায় সবাইকে দেখলাম বাংলা একাডেমির কথিত বইমেলার নীতিমালার দোহাই ঝাড়তে। প্রকুত বিষয়টি বা কেন এমন হল তা নিয়ে কোনো আগ্রহ নেই। অনেকটা আপনি বাঁচলে বাপের নাম অবস্থা। বাংলা একাডেমি যে একটি অন্যায় সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করেছে, এটি নিয়ে কথা বলায় তাদের আগ্রহ নেই। সাধু সাধু।
ভেড়া চুরি করার জন্য নয় বরং ভবিষ্যতে যাতে আর কোনো ভেড়া চুরি না হয়, সেজন্য কাউকে সাজা দেওয়াকে কি বলা যায়? এটি হয়তো প্রতিরোধাত্মক শাস্তি। ধর্মীয় অনুভূতিতে ভবিষ্যতে যাতে কেউ আঘাত দিতে না পারে, সেজন্য সরকার ব্যবস্থা নিচ্ছে। আমাদের সঙ্গে খোদ সৌদিআরব ও ইরানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক আছে। সৌদিআরব ও ইরানের সঙ্গে এই বইটি নিয়ে কি সরকার এখন একটু কথা বলবে? কেন তাদের দেশে এই বইটি নিষিদ্ধ নয়? তা কি একটু খতিয়ে দেখবে? তাহলে হেফাজতের দাবিকে সমর্থন করে সরকার এই বইটি নিষিদ্ধ করলে ইসলামের নামে ধর্মীয় অনভূতিতে আঘাত লাগার অযুহাত কতোটা যুক্তিযুক্ত, তা কি আমরা অনুধাবন করতে পারছি?
সবকিছু দেখে মনে হচ্ছে, বাংলাদেশ সত্যিই চায় না এখানে মুক্তবুদ্ধির চর্চা হোক। বিতর্কিত বিষয়ে জানার আগ্রহ বা সুযোগ রাখার পক্ষেও নয় রাষ্ট্র। হেফাজত কোনো বিষয়ে নোটিশ করলেই তা বন্ধ করার এই মানসিকতায় হয়তো তাৎক্ষণিক দায় এড়ানো সম্ভব হবে, কিন্তু যে ভয়ংকর সাপ পুষতে পুষতে রাষ্ট্র অন্ধকারের দিকে হাঁটছে, সেই অন্ধকার থেকে আলোর দিকে আর কোনো দিনও হাঁটা সম্ভব হবে না। তাহলে কি আমরা দিনদিন আলো থেকে অন্ধকারের দিকে যাচ্ছি! কিসিঞ্জার সাহেব ১৯৭১ সালে যে কথাটি বলেছিলেন, সেই কথা নতুন করে আবার বিশ্লেষন করার সময় এসেছে। বাংলাদেশ ধীরে ধীরে একটি ব্যর্থ রাষ্ট্রের দিকে যাচ্ছে। আমাদের সরকার বাহাদুর যদি বিষয়টি অনুধাবন করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে এর জন্য বাংলাদেশকে ভবিষ্যতে আরো কঠিন মূল্য দিতে হবে।
.................................
১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৫
ঢাকা
©somewhere in net ltd.
১| ১৮ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ সকাল ১০:৩৬
মহান অতন্দ্র বলেছেন: যারা প্রতিষ্ঠানের দালালি করে নিজেদের বড় লেখক ভাবেন, তাদের প্রায় সবাইকে দেখলাম বাংলা একাডেমির কথিত বইমেলার নীতিমালার দোহাই ঝাড়তে
ভাল লাগলো।