নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
ছোটগল্প লিখি। গান শুনি। মুভি দেখি। ঘুরে বেড়াই। আর সময় পেলে সিলেকটিভ বই পড়ি।
এক.
ছোটবেলায় বেজি পালতাম। বেজি পালার কারণে স্কুলের আর পাড়ার দুষ্টু ছোকরারা এক সময় আমার নামের সঙ্গে বেজি উপাধি জুড়ে দিল। কামালের লগে বেজি যুক্ত করে বানাল বেজিকামাল। এই নিয়ে অনেকের সাথেই তখন ছোটখাটো মারামারি বা হামলা পাল্টা হামলার ঘটনা ঘটল। সেই ঘটনা বাবার কানে পৌঁছালে, বাড়িতে বাবা আমার জন্য হঠাৎ রেড এলার্ট জারি করলেন। বেজি নাকি ছেড়ে দিতে হবে। নইলে আমার ভাত বন্ধ। কিন্তু মুশকিল হল, এত কষ্ঠে পোষা বেজি কেমনে ছাড়ি! দু'একদিন নানান কিসিমের তালবাহানা ফন্দিফিকির ছলচাতুরি করলাম। বেজি আর ছাড়লাম না। পোলাপাইনেও আমারে সুযোগ পাইলেই বেজিকামাইল্যা ডাইকা মস্করা করা ছাড়ে না। কিন্তু এভাবে লুকিয়ে পালিয়ে কোনো লাভ হল না। একদিন সত্যি সত্যিই বাবার নির্দেশে আমার সেই পোষা বেজি ছেড়ে দিতে হল। সেই কথায় পরে আসছি। তার আগে শোনো, কিভাবে আমার এই বেজি পালা শুরু হল।
ছোটবেলায় গ্রামে রোজ অহরহ বেজি দেখতাম। মুরব্বিরা বলতো, বেজি মানুষের জন্য উপকারী প্রাণী। কারণ বেজি সাপ তাড়াতে ভূমিকা রাখে। বেজির সাথে সাপের সাপে-নেউলে সম্পর্কের কথা আমরা বইয়ের পাতায় পড়তাম, কিন্তু কখনো চেখে দেখিনি তখনো। আমরা পথে ঘাটে কোথাও বেজি দেখলেই তাই একটু অতিরিক্ত সতর্ক হতাম এই ভেবে যে, হয়তো আশেপাশে কোথাও বিষধর কোনো সাপ আছে। বেজি কোনদিকে যাচ্ছে, কেন যাচ্ছে, কত দ্রুত যাচ্ছে বা কতোটা ধীর গতিতে যাচ্ছে, আমাদের উপস্থিতি টের পেয়েও তার দিক পরিবর্তনের কোনো লক্ষণ আছে কিনা ইত্যাদি কিছু বিষয় অনেকটা চট করেই আমরা অনুমান করে সাপের অস্তিত্ব সম্পর্কে কাল্পনিক একটা ধারণা করতাম। আর তখন কি করনীয় তাও অনেকটি তাৎক্ষণিক প্রস্তুতিতেই নিতাম আমরা। কিন্তু বেজি'র লক্ষ্যকে ঠিকঠাক না বোঝা পর্যন্ত কৌতুহলী আমরা কেউ কেউ দূরে কোথাও ওৎ পেতেও থাকতাম। দেখতাম, বেজি কি করে?
প্রায় সময়ই আমরা বেজির কর্মকাণ্ড পর্যবেক্ষণ করতে গিয়ে সাপ দেখা থেকে বঞ্চিত হতাম বটে। কারণ ওটা থাকতো বেজির নিয়মিত চলাচল বা ডেইলি ওয়াকিং। শিকার করতে যাওয়া, বা বেড়াতে যাওয়া, বা বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে যাওয়া বা একটু নিজের টেরিটরিতে ঘোরাফেরা করা এমন সব নিয়মিত ব্যাপার স্যাপার থাকতো বেজির। কখনো একা একা, কখনো বা প্রেয়সিকে নিয়ে, কখনোবা পুরো পরিবার বউ বাচ্চাকাচ্চাসহ আমরা বেজি দেখার সুযোগ পেতাম। তাই ছোটবেলা থেকেই বেজি সম্পর্কে আমার একটা আলাদা আগ্রহ তৈরি হয়েছিল।
তখন ক্লাস সিক্সে পড়ি। প্রাইমারিতে যেখানে আমরা ছিলাম সবচেয়ে সিনিয়র; দুষ্টামি করা হোক, খেলাধুলা হোক, বলেশ্বরে সাঁতার কেঁটে এপার-ওপার যাওয়া হোক, বিশ্বাসদের জঙ্গলে গিয়ে গাছে উঠে বসে থাকা হোক, কিংম্বা জোট বেধে কোথাও কোনো উদ্দেশ্যে যাওয়ার জন্যেই হোক, রোজ আমরা চলতে ফিরতে কোথাও না কোথাও বেজি দেখতাম। গ্রামের আমাদের পাড়ায় যেখানে প্রায় সবকিছুতেই নেতৃত্ব দিতাম আমরা। সে বেজি দেখা হোক আর সাপের বিষ নামানো দেখাই হোক। কিংম্বা রাঙা নানার লাঠি খেলা দেখাই হোক। সবখানে আমাদের মত ছোকরাদের তখন একচেটিয়া রাজত্ব।
কিন্তু হুট করে হাইস্কুলে এসেই আমরা হয়ে গেলাম গোটা স্কুলের সবচেয়ে জুনিয়র ছোকরাদের দল। নয়া রাজ্যে অনেকটা সেকেন্ড ক্লাস নাগরিকের মত তখন আমাদের দশা। বিশেষ করে স্কুল টাইমে। কারণ সেভেন, এইট, নাইন-টেনের বড়রা আমাদের তেমন পাত্তাই দিত না। কিন্তু দুষ্টামিতে যারা একটু অলরাউন্ডার গোছের, মাঝে মধ্যে তাদের দু'একজনকে একটু আলাদা খাতির করত বটে। সেই সূত্রেই ক্লাস নাইনের এক বড় ভাইয়ের সঙ্গে আমার ঘটনাচক্রে খুব খাতির হল। জুবেরী ভাই। পুরো নাম জুবেরী আলম। জুবেরী ভাই'র ছোটভাই ফারুক আমাদের সঙ্গে পড়ত। আর জুবেরী ভাই'র বড় বোন জোছনা আপা পড়তেন ক্লাস টেনে। জুবেরী ভাই খুব ভালো ফুটবল খেলতেন। গোলরক্ষক হিসেবে খুব সুনাম ছিল তার। সেই জুবেরী ভাই বেজি পালতেন। তো ফারুকের কাছে জুবেরী ভাই'র বেজি পালার গল্প শোনার পর থেকেই সেই পোষা বেজি দেখার খুব ইচ্ছে হল আমাদের।
এমনিতে স্কুল থেকে ফারুকদের বাড়ি প্রায় দুই-আড়াই মাইল দূরে। কুমারখালী গ্রামে। পথে হরিপাগলা-মালিবাড়ির কাছে ফারুকদের একটা বিশাল বাগানবাড়ি ছিল। সেই বাগানবাড়িতেই জুবেরী ভাইয়ের নেতৃত্বে ফারুকরা পিঠেপিঠি চারভাই থাকত আর পড়াশুনা করত। আর কুমারখালী মেইন বাড়িতে ফারুকদের পরিবারের অন্যরা থাকত। ফারুকদের সেই বিশাল বাগানবাড়িটা স্কুল থেকে মাত্র মাইল খানেকের পথ। ওই বাড়িতে কখনো রান্নাবান্না হতো না। সবসময় রান্না করা খাবার আসত ফারুকদের মেইন বাড়ি থেকে। আমাদের চেয়ে দুই-চার বছরের বড় প্রিন্স সেই খাবার নিয়ে আসত। প্রিন্স ফারুকদের বাড়িতে কাজ করত। ওদের পারমানেন্ট কাজের ছেলে সে। প্রিন্সের বাবাও ফারুকদের বাড়িতে কাজ করতেন তখন। কিন্তু জোছনা আপা বাড়ি থেকেই স্কুলে আসতেন। ফারুকদের আস্তানা পর্যন্ত এসে তারপর ওদের সঙ্গেই বাকি পথটুকু হেঁটেহেঁটে স্কুলে আসতেন। আবার স্কুল ছুটির পর ওই বাগানবাড়িতে পৌঁছে খাওয়া দাওয়ার পর প্রিন্সের সঙ্গে কুমারখালী মেইন বাড়িতে যেতেন জোছনা আপা।
ফারুকদের সেই বাগানবাড়িটায় ছোট্ট একটা দোচালা ছনের ঘর ছিল। উত্তর মুখো ঘরের ভেতরে দুইটা কক্ষ। একটা ছিল জুবেরী ভাইয়ের অন্যটা ফারুকদের তিনজনের। বাড়ির দক্ষিণ পাশে একটা ঝুল বারান্দাও ছিল। সেই বারান্দার সামনেই বেশ বড় একটা পুকুর। পুকুরের চারপাশেই নানান জাতের গাছগাছালি। আমরা দুষ্টামি করে নাম দিয়েছিলাম ফারুকদের মোকাম। এক সময় জুবেরী ভাইয়ের পোষা বেজির সূত্রেই আমরা নিয়মিত ওই মোকামে যাওয়া আসা শুরু করলাম।
তখন আমাদের স্কুলের বড়দের মধ্যে যারা প্রেম-পিড়িতি করত, বা জুবেরী ভাইয়ের যারা বন্ধুবান্ধব, বা জুবেরী ভাইয়ের আস্কারা পাওয়া অনেকেই তখন ফারুকদের সেই মোকামে প্রায়ই স্কুল কামাই দিয়ে ঘুরঘুর করত। ওই সময় আমাদের মত ছোকরাদের জন্য ফারুকদের মোকামে প্রবেশ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ছিল। এমনিতে মাঝে মাঝে সকালে স্কুলে যাবার আগে ঘুরপথে ফারুকদের মোকামে আমরা নানান অছিলায় উকিঝুঁকি দিতাম। আর বড়দের নানান কাণ্ডকীর্তি দেখার সৌভাগ্য হতো। পরে সেই ঘটনা রাষ্ট্র হলে ফারুকদের মোকামে সেই জুটির চলাফেরা অনেকটাই কমে যেত। এছাড়া বাগানবাড়ির ভেতরের আসল রহস্য পুরোপুরি ফারুক কখনোই আমাদের কাছে স্বীকার করত না। তাই ওই বাগানবাড়ির সকল গোপন রহস্য উন্মোচন করাও আমাদের কাছে তখন নেশার মতই হয়ে গিয়েছিল। ফারুকের কাছে শুধু শুনতাম জুবেরী ভাই বেজি পালেন। কিন্তু আমরা সেই বেজি দেখার নাম করে গেলেও প্রায়ই জুবেরী ভাইয়ের কোপানালে পড়তাম। জুবেরী ভাইয়ের পোষা বেজি আর দেখা হতো না। বাড়ির দরজা থেকেই বিদায় নিতে হতো।
একসময় ব্যাপারটা আমাদের কাছে অনেকটা জিদের মত হয়ে গেল। যে করেই হোক জুবেরী ভাইয়ের পোষা বেজি দেখা চাই। নইলে গুজব রটানোর জন্য ফারুককে আমরা দলবল মিলে আচ্ছামত ধোলাই দেব। আমাদের ঘোষণা শুনে ফারুক একটু ভয় পেল। স্কুল ছুটির পর ফারুক বাড়ির দিকে দক্ষিণমুখো না হেঁটে উত্তরমুখো ক্লাস টেনের দিকে হাঁটা ধরল। জুবেরী ভাই আর জোছনা আপার সাথেই সেদিন ফারুক বাড়ি গেল। পরদিন স্কুলে টিফিনের সময় হঠাৎ জুবেরী ভাই আমাকে ডাকলেন। জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা নাকি ফারুককে মারার হুমকি দিয়েছ? ঘটনা কি? ক্যাচাল কি নিয়া?
জুবেরী ভাইয়ের হাত থেকে বাঁচার জন্যে চট করেই বললাম, কই নাতো, ফারুককে কেন মারব? আমরা আপনার পোষা বেজি দেখতে চাইছিলাম আরকি। ফারুক না করেছে... তাই...। জুবেরী ভাই হেসে বললেন, ও তাই বুঝি? মারামারির ক্যাচাল না থাকলে একদিন আসো, আমার পোষা বেজি দেখে যাও। কিন্তু আমাকে কথা দিতে হবে, তোমরা ফারুককে কেউ কিছু বলবে না। বললাম, ঠিক আছে। ফারুকের কাছে জানাব কখন যাবো আমরা। জবাবে জুবেরী ভাই বললেন, এই শুক্রবারেই আসো, যে যে দেখতে চাও, আসো। আর ফারুককে তোমরা মারলে কিন্তু তোমাদেরও খবর আছে, বুঝলা?
পরের শুক্রবার আমরা আগ্রহী একদল ফারুকদের সেই মোকামে গেলাম। আমাদের ফারুকের পড়ার ঘরে বসিয়ে রেখে জুবেরী ভাই বললেন, একজন একজন করে বারান্দায় আসবা। যার দেখা শেষ হবে, সে ফিরে এসে আরেকজনকে পাঠাবা। আমরা একজন একজন করে ফারুকের পড়ার ঘর থেকে পুকুরের দিকের ঝুল বারান্দায় উকি দিলাম। সেখানে জুবেরী ভাই শিষ বাজালেই তার পোষা বেজি ভো দৌড়ে পুকুরের পাশের ঝোপ থেকে এসে হাজির হয়। কিছুক্ষণ ঘুরঘুর করে আবার ঝোপের দিকে চলে যায়। এভাবে পালা করে আমরা জুবেরী ভাই'র পোষা বেজি দেখলাম। আর মনে মনে জুবেরী ভাইকে অনেক ধন্যবাদ দিলাম। আমরা যারা সেদিন বেজি দেখতে গিয়েছিলাম, সবাই জুবেরী ভাই'র অমন ভেলকি দেখে একেবারে সাক্ষাৎ টাসকি খেলাম। মনে মনে ভাবলাম, তাহলে বেজিকে এভাবে পোষ মানানো সাম্ভব?
মূলত সেদিন থেকেই বেজি পোষার একটা খায়েস জাগল মনে। যে করেই হোক বেজি পালতে হবে। কিন্তু সমস্যা হল ফারুকদের বাগানবাড়ির মত অমন আলাদা কোনো মোকাম আমাদের নেই। বাড়িতে পুষতে গেলে বাবা'র হাতে ধরা খাওয়ার সম্ভাবনাও ব্যাপক। তুবও মনের সেই ইচ্ছাকে একদিন সাহস করেই বাস্তবায়নে লেগে গেলাম। দীর্ঘদিন ধরে আমাদের বাগানের গর্তে একটা বেজি পরিবার ছিল। একবার এক হাটের দিন বিকালে বাড়ির বয়স্ক পুরুষদের সবাই যখন হাটে, তখন আমরা ছোকরারা মিলে সেই বেজি পরিবারের এক পিচ্চিকে দীর্ঘ দুই-আড়াই ঘণ্টা তাড়িয়ে তাড়িয়ে অবশেষে পাকরাও করতে সক্ষম হলাম। মাঝারি সাইজের ইঁদুরের চেয়ে সেই বেজিটা ছিল একটু বড়। লেজসহ লম্বায় চার-পাঁচ ইঞ্চি হবে।
আমাদের দলের ছোরাফ ছিল মাছ ধরার সময় কুঁইচা আর ঢোরা সাপ ধরায় দারুণ ওস্তাদ। সেই ছোরাফ-ই পাটের বস্তার সাহায্যে খপ করে সেই বেজি'র ছাও ধরে ফেলল। তার আগে হাটে কবুতর বিক্রি করার জন্য যে ছোট্ট বাঁশের খাঁচা ব্যবহার করতাম, সেই খাঁচার চারপাশে কৈয়া জাল পেচিয়ে বেজি'র জন্য আমরা খাঁচা রেডি করলাম। তারপর বেজি'র ছাওকে কবুতরের সেই খাঁচায় বন্দি করা হল। সূর্য ডোবা পর্যন্ত আমরা সেই বেজি নিয়ে সেদিন মহানন্দে মেতেছিলাম।
বাজার থেকে বাবা ফেরার আগেই আমরা সেই খাঁচা বন্দি বেজিকে একটা বড় বেতের ধামা দিয়ে ঢেকে রাখলাম। মা-চাচিরা কেউ কেউ হুশিয়ারী দিলেন, বেজি'র ছাও ধামা চাপায় মারা যাবে। যদি বাতাস পাস না হয় তাহলে ওটা মরবে! তো টুনি দিয়ে ছোট্ট একটা গর্ত করা হল ধামার বাহির থেকে ভেতর পর্যন্ত। যাতে খাঁচার বেজি টুনির ফাঁপা নল দিয়ে বাতাস পায়। কেউ কেউ বলল, কৈয়া জাল কেটে বেজি খাঁচা থেকে বের হবে। আর ওই টুনি ঠেলে রাতে ঠিকই পালিয়ে যাবে।
সমস্যা হল, বেজিকে ওভাবে ধামার নিচে আটকে রেখে আমরা কেউ আর সেই রাতে ভালোমত ঘুমোতে পারলাম না। আমাদের কাচারি ঘরের খাটের নিচেই বেজির ধামা রেখেছিলাম। কাচারি ঘরেই তখন আমার পড়ার টেবিল। আর রাতে শোবার খাটে আমার ছোটভাই জামাল আমার ঘুমানোর সময়ের পার্টনার। কখনো কখনো আমার চাচাতো ভাইয়েরা কুদ্দুচ, কালাম, নাসির, আলাম, রিপন, আজগরও আমার সাথে ঘুমায়। সেই রাতে আমরা চার-পাঁচ ভাই মিলে সেই বেজির ছাও পাহারা দিলাম।
সকালে খেয়াল করলাম, বেজির ঘটনা জানাজানির পরেও বাবা আমাদের তেমন কিছু বললেন না। বরং বেজিকে কিভাবে খাবার দিতে হবে, সে বিষয়ে মাকে কিছু বাড়তি পরামর্শ দিলেন, যাতে মা সেই পরামর্শগুলো আমাদের শোনাতে পারে। সকালে বেজির খাঁচার উপর থেকে ধামা সরিয়ে দেখা গেল- খাঁচার এককোনে বেজির ছাওটা চুপচাপ মরার মত শুয়ে আছে। কবুতরের খাবার আর পানি খাওয়ার জন্য খাঁচার ভেতরে এককোনে ছোট্ট একটা টিনের কৌটা আর একটা নারকোলের মালা বাধা ছিল। সেই কৌটায় পানি দেওয়ার সময় বেজিটা একটু মিটমিট করে আমাদের দেখল। কৌটায় পানি দেবার পর সে উঠে চুকচুক করে পানি খেল। আর খাঁচার ফাঁক দিয়ে বাইরে আসার জন্য একটু একটু দাপাদাপি করল। তারপর নারকেলের মালায় রান্না করা মাছ আর পান্তা ভাত দিলাম। মাছ মুখে নিয়ে আবার ফেলে দিল। পান্তা ভাত নাক দিয়ে একটু শুঁকে আর ধরল না। কেউ কেউ বলল, রান্না করা মাছ ও খাবে না। ওকে দিতে হবে মরা বা তাজা মাছ।
আমাদের উঠানে কলাগাছের উপর বিশেষ কায়দায় একটা নৌকায় তখন পুকুর থেকে ধরা বিভিন্ন ধরনের মাছ জিয়ানো থাকত। নৌকা ভরতি পানির মধ্যে খেজুরের পাতা, নিমের ডাল, আমের ডাল আর কলার পাতার ভেতর সেই মাছ সাঁতার কাটত নতুবা চুপচাপ লুকিয়ে থাকত। যেগুলো আগে মরত সেহুলো আগে রান্না করার নিয়ম ছিল। সেই নৌকা থেকে একটা টাকি মাছ ধরে অর্ধমৃত করে কবুতরের খাঁচার নারকেলের মালায় দেওয়া হল। বেজি সেই মাছ দেখা মাত্রই ছো মেরেই খেয়ে ফেলল। এভাবে দুই তিনটা মাছ খাওয়ানোর পর, বড়দের কেউ কেউ নিষেধ করলো- আর মাছ না দিতে। কারণ বেজির ছাওয়ের পেট নাকি ভারী ছোট।
দুপুর নাগাদ আমাদের মাথায় বুদ্ধি আসল, কৈয়া জালের উপর আর ভরসা করা ঠিক হবে না। যে কোনো সময় বেজি জাল কেটে পালিয়ে যেতে পারে। তখন উপায়? কারণ আমাদের দাদী ঠাট্টা কইরা তখন কইছিল, খাঁচা রাইখা তোরা সরলিই বেজি জাল কাইটা পালাবে, আরনলি বেজির বাপ আইসা ওরে উদ্ধার করে নেবেনে। সাবধান!!! যারা বেজির ছাও ধরছো, সগোলরি কিন্তু ওই বুড়া বেজি কামড়াবে এখন!!! আমাদের মনে তখন একদিকে বুড়া বেজির কামড় খাওয়ার ভয়। অন্যদিকে ছাও বেজির পালিয়ে যাবার আশংকা। আমাদের মধ্যে কেউ একজন বাজারে গিয়ে গুনা নিয়ে আসল। দুপুরের পর গোটা বিকাল বসে বসে আমরা কবুতরের খাঁচার চারপাশ গুনা দিয়ে মুড়িয়ে দিলাম। বেজির ছাও আর পালাতে পারল না। আর দাদীর কথা মত বুড়া বেজিও আমাদের কিন্তু কামড়াতে আসল না। উল্টো আমরা খেয়াল করলাম, পুরো বেজি তার পরিবার নিয়েই বাগান থেকে উধাউ।
সারা গ্রামে আমাদের সেই বেজি ধরার কাহিনী মুহূর্তে কিভাবে যেনো রাষ্ট্র হয়ে গেল। পরদিন দশগ্রাম থেকে আমাদের বন্ধুদের সবাই বেজি দেখতে আসল। কি কি খাবার দেওয়া উচিত সেই বিষয়ে পরামর্শ দিল কেউ কেউ। কেউ জানতে চাইল, বেজি দিয়ে কি করব? বললাম, বেজি পোষ মানাবো। কেউ কেউ ছোরাফকে উৎসাহিত করল, ধরা সূত্রে বেজির মালিক যেহেতু ছোরাফ। তাই ছোরাফ বেজি নিয়ে গেলে আমার পেস্টিজের কিছুটা হাম্পার হয়। আবার আমার মাস্তানির উপরও কিছুটা খবরদারি করা যায়। কোনো রহস্যময় কারণে ছোরাফ কিন্তু বেজি ছিনিয়ে নিতে আর উৎসাহ পেল না। কিন্তু রোজ বেজিটাকে দেখার জন্য ছোরাফ তখন সকাল বিকাল আমাদের বাড়িতে প্রায়ই ঘুরঘুর করত।
দুই-আড়াই সপ্তাহ এভাবে কবুতরের খাঁচায় বন্দি থাকল সেই বেজির ছাও। ওই সময়ের মধ্যে বেজিকে এক ধরনের সিগন্যাল দিয়ে দিয়ে একটা সাংকেতিক ভাষা বোঝানোর চেষ্টা করলাম আমরা। অনেক সময় আমরা নারকেলের মালায় মাছ না দিয়ে খাঁচার অন্য পাশ দিয়ে হাতে হাতেই দিতাম। আর এভাবে বেজিটা এক সময় হাত থেকে খাবার খাওয়ায় অভ্যস্থ হয়ে উঠল। একদিন সকাল বেলায় আমরা প্রস্তুতি নিলাম বেজিকে খাঁচার বাইরে বের করব। কিন্তু যাতে ছুটে পালাতে না পারে সেজন্য উঠানের ঠিক মাঝখানে চারপাশে ছোকরা সৈন্যদের প্রস্তুত রেখে বেজিকে খাঁচা থেকে ছাড়া হল। আমরা হাতে মাছ নিয়ে যেদিকে মাছ ধরি, বেজি দৌঁড়ে সেদিকে আসে। আমরা হাঁটলে বেজি আমাদের পিছু পিছু হাঁটে।
রশির মাথায় কাপড়ের সঙ্গে মাছ বেধে আমরা উঠানে বসে ঘুরাতাম, আর বেজিটা সেই মাছকে অনুসরণ করে দৌঁড়াত। আমরা যেদিকে ঘুরাতাম বেজি সেদিকে দৌঁড়াত। একসময় মাছ আলগা করে ঘুরালেই বেজি সহজেই মাছ ধরতে পারত। এভাবে নানান উপায়ে কঠোর ট্রেনিং দিয়ে মাস দুয়েকের মধ্যেই সেই বেজির ছাওকে আমরা পুরপুরি পোষ মানিয়ে ফেললাম। আমরা যখন মাঠে খেলতে যেতাম তখন বেজিকে সেই খাঁচায় বন্দি করে রেখে যেতে হতো। নইলে বেজি আমাদের পেছনে পেছনে মাঠে গিয়ে হাজির হতো। আর স্কুলে যাবার সময়ও ওকে খাঁচায় আটকে যেতাম।
................................চলবে
ঢাকা
২ বৈশাখ ১৪২২
২| ১৬ ই এপ্রিল, ২০১৫ বিকাল ৩:৪৩
কম্পমান বলেছেন: চলবে
©somewhere in net ltd.
১| ১৬ ই এপ্রিল, ২০১৫ সকাল ১০:৩২
আরণ্যক রাখাল বলেছেন: বিরক্তিকর লেখা। মাঝপথেই থেমে গেলাম শেষ আর করতে পারলাম না।
হতে পারে আমি ভালো পাঠক নই