নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

বাংলাদেশ আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা...

বাংলাদেশ আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা...

রেজা ঘটক

ছোটগল্প লিখি। গান শুনি। মুভি দেখি। ঘুরে বেড়াই। আর সময় পেলে সিলেকটিভ বই পড়ি।

রেজা ঘটক › বিস্তারিত পোস্টঃ

হোসে মুজিকা দ্য লাস্ট হিরো অব পলিটিক্স !!!

২৯ শে মে, ২০১৫ রাত ৩:১৫

২০১০ সালের ১ মার্চ থেকে ২০১৫ সালের ১ মার্চ পর্যন্ত উরুগুয়ের প্রেসিডেন্ট ছিলেন হোসে আলবার্তো পেপে মুজিকা কর্ডানো। উরুগুয়ের মানুষ তাদের প্রিয় এই নেতাকে ভালোবেসে ডাকেন 'এল পেপে'। হোসে মুজিকাকে মিডিয়া ব্যাঙ্গ করে প্রচার করেছিল পৃথিবীর দরিদ্রতম প্রেসিডেন্ট হিসেবে। ২০১২ সালে তিনি সংবাদ শিরোনাম হয়েছিলেন ‘বিশ্বের সবচেয়ে গরীব প্রেসিডেন্ট’ হিসেবে। তবে গোটা বিশ্বের মিডিয়া তাঁকে গরীব প্রেসিডেন্ট বললেও নিজেকে কিন্তু মোটেও গরিব ভাবেন না মুজিকা। আল জাজিরাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘আমার কাছে গরীব হচ্ছে তারাই যারা খুবই বেশি বেশি চায়। কারণ যাদের চাওয়া অনেক বেশি, তারা কখনোই তৃপ্ত হয় না।’ হোসে মুজিকা ছিলেন উরুগুয়ের চল্লিশতম প্রেসিডেন্ট। ১ মার্চ ২০১৫ সালে তাঁর প্রেসিডেন্টিয়াল মেয়াদ শেষ হলে তিনি রাজনীতি থেকে অবসর নেন।

কে এই হোসে মুজিকা?
ল্যাতিন আমেরিকার একটি দেশ উরুগুয়ে। দক্ষিণ আমেরিকার দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলে ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনার মধ্যে অবস্থিত এই দেশটি দক্ষিণ আমেরিকার দ্বিতীয় ক্ষুদ্রতম দেশ। ১৯৩৫ সালের ২০ মে উরুগুয়ের মোন্তেভিদিও'র এক গ্রামে এই মহানায়কের জন্ম। বাবার নাম দেমেত্রিও মুজিকা। মায়ের নাম লুসি কর্ডানো। মুজিকার বাবা ছিলেন উরুগুয়ের স্প‌্যানিশ শাসিত বাস্কি আদিবাসিদের বংশধর। পেশায় একজন কৃষক। আর মা লুসি ছিলেন এক ইতালীয় ইমিগ্র্যান্ট পরিবারের মেয়ে। ১৯৪০ সালে বাবা দেমেত্রিও মুজিকা যখন মারা যায়, তখন লুসির পরিবারে একটি কানাকড়িও ছিল না। তাই পাঁচ বছরের মুজিকাকে নিয়ে লুসি বাবার বাড়িতে আশ্রয় নেন।

ইতালীর উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের লিগুরিয়া থেকে লুসির পরিবার উরুগুয়ের কারমেলোতে আসে। সেখানে লুসির বাবা পাঁচ একর জমি কিনে ভিনেগার চাষ শুরু করেন। কারমেলো হল উরুগুয়ের পশ্চিমাঞ্চলের স্প‌্যানিশ কলোনিয়াল গ্রামের একটি। যেখানে প্রচুর পরিমাণে ভিনেগার উৎপন্ন হয়। ভিনেগার দিয়ে তৈরি করা হয় ওয়াইন। বালক মুজিকা লুসির সঙ্গে নানাবাড়িতে বড় হতে থাকেন।

মুজিকা'র শৈশব ও কৈশোর:
ছোটবেলায় হোসে মুজিকা মাত্র আট বছর বয়সে স্থানীয় এক বেকারির দোকানে ডেলিভারি বয় হিসেবে কাজ শুরু করেন। পাশাপাশি তিনি হোটেল বয় হিসেবেও কাজ করতেন। এছাড়া নানাবাড়ির পিছনে বয়ে যাওয়া খাঁড়ি থেকে অ্যারাম লিলি ফুল তুলে বিক্রি করতেন। যা দিয়ে মা ও ছেলের সংসারের খরচ চলত। ডেলিভারি বয় হিসেবে কাজ করতে গিয়ে মুজিকা সাইকেল চালানোতে খুব পারদর্শী হয়ে ওঠেন। এসময় তিনি স্থানীয় বিভিন্ন ক্লাবের সাইকেল চালানো প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহন করে অনেক পুরস্কার জেতেন। এভাবেই দারিদ্র্যের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বড় হতে থাকেন মুজিকা। খুব ছোটবেলা থেকেই মুজিকা বাম রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন। তখন তিনি ন্যাশনাল পার্টির নেতা এনরিকে এরোর খুব ঘনিষ্ঠ সহচর ছিলেন। মাত্র সতেরো বছর বয়সে তিনি বাম চরমপন্থী নেতা হিসেবে উরুগুয়ের ত্রাস হয়ে ওঠেন।

মুজিকার মত তরুণ গেরিলা সদস্যরা তখন দলবেঁধে বিভিন্ন ধনিক শ্রেণীর আস্তানায় হানা দিতেন। লুটপাট ডাকাতি করে যে টাকা পয়সা পেতেন, তা তারা গরীবদের মধ্যে বিতরণ করতেন। এক সময় এই গেরিলারা আর্জেন্টিনার বিপ্লবী নেতা আর্নেস্টো চে গুয়েভারার সংস্পর্শে আসে। তখন তাদের চিন্তা-চেতনা ও কাজকর্মে আমূল পরিবর্তন ঘটতে শুরু করে। পঞ্চাশের দশকের শেষ দিকে উরুগুয়েতে চরম মুদ্রাস্ফীতির কারণে রুগ্ন অর্থনীতি মহাসঙ্কটে পড়ে যায়। তখন চে-র ভাবাদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে নতুন কিছু করার তাগিদ অনুভব করেন মুজিকা ও তার সঙ্গীরা।

গেরিলা জীবন:
নতুন কিছু করার তাড়না থেকেই মুজিকা ও তার সঙ্গীরা শোষণের বিরুদ্ধে লড়াই করা শুরু করেন। রাউল সেনডিকের নেতৃত্বে এসব গেরিলা মিলে গঠন করেন টুপামারোস ন্যাশন্যাল লিবারেশান মুভমেন্ট বা সংক্ষেপে এনএলএম-টি। পেরুর কিংবদন্তী বিপ্লবী চরিত্র দ্বিতীয় টুপাক আমারুর নামানুকরণে এই গেরিলা বাহিনী তাঁদের দলের নাম রাখেন। আর এসব গেরিলাদের তখন বলা হতো ‘টুপামারো’। টুপামারো গেরিলাদের প্রধান নীতি ছিল অত্যাচারীর নিধন ও দরিদ্রের পালন। যে কারণে রাতারাতি টুপামারো গেরিলারা উরুগুয়ের নিম্ন ও মধ্যবিত্ত সমাজে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করে। ১০০ জনেরও কম মানুষ নিয়ে তাঁরা সেসময় উরুগুয়ের অত্যাচারী শাসকদের কাঁপন ধরিয়ে দিয়েছিলেন। টুপামারো গেরিলারা ব্যাংক লুট করে বিত্তশালীদের অবৈধ অর্থ দরিদ্রদের উন্নয়নে ব্যয় করতেন। ধনী ব্যবসায়ীদের খুন করে তাদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করতেন। দামি ক্যাসিনো দখল করে প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের টাকা পাঠাতেন। যে কারণে ১৯৬৯ সালে টাইমস ম্যাগাজিন তাদেরকে ‘রবিন হুড গেরিলা’ নামে আখ্যায়িত করেছিল। ১৯৬০-এর দশকের মাঝামাঝি থেকে ১৯৭০-এর দশকের শুরুর সময় পর্যন্ত স্থায়ী উরুগুয়ের শহরভিত্তিক তাদের এই গেরিলা বিদ্রোহ কার্যক্রম অব্যাহত ছিল।

কারাবন্দী জীবন:
১৯৬৮ সালের জুন মাসে উরুগুয়ের প্রেসিডেন্ট জর্জ পাসেকো আরেকো অব্যাহত শ্রমিক ধর্মঘট প্রতিরোধে দেশে জরুরী আইন জারী করেন। সংবিধান ও নাগরিকের মৌলিক অধিকার স্থগিত ঘোষণা করেন। তখন সেনাবাহিনী এসব চরমপন্থী গেরিলাদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করে। অব্যাহত সেনা অভিযানের ফলে টুপামারো গেরিলাদের মধ্যে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। পাশাপাশি সমাজের মঙ্গল করার বদলে কেবল মানুষ অপহরণ ও খুনের কারণে টুপামারো গেরিলারা জনপ্রিয়তা হারাতে শুরু করে। একারণে গতি হারায় তাদের বিপ্লব। ভাঙন শুরু হয় তাদের মধ্যে। ১৯৭০ সালের মার্চ মাসে এক পানশালায় পুলিশের সঙ্গে বন্দুক যুদ্ধের পর গ্রেপ্তার হন এল পেপে। পেটে মোট ৬টি গুলিবিদ্ধ অবস্থায় গ্রেফতার হন মুজিকা। গ্রেপ্তারের পর মন্টেভিডিও শহরের পান্টা ক্যারেটাস কারাগারে তার ঠাঁই হয়। সেখান থেকে দু’বার পালিয়ে গিয়েও ১৯৭২ সালে ফের ধরা পড়েন মুজিকা। ১৯৭৩ সালের জুন মাসে এক মিলিটারি ক্যুয়ের মাধ্যমে সেনাবাহিনী উরুগুয়ের ক্ষমতা দখল করে। যার পরিণতি হিসেবে জেলেবন্দী টুপামারো গেরিলাদের জন্য অপেক্ষা করছিল ভয়াবহ বিভীষিকা। নয়জন বিশেষ টুপামারোসকে বিশেষভাবে সনাক্ত করে ছুঁড়ে ফেলা হয় সলিটারি সেলে। যাদের মধ্যে ছিলেন রাউল সেনডিক, ফারনান্দেজ হুইদোব্রো, হোসে মুজিকা, হেনরি এংলার, মাউরিসিও রোসেনকফ প্রমুখ। অন্ধকারাচ্ছন্ন, দমবন্ধকর পরিস্থিতিতে বছরের পর বছর থাকতে থাকতে এই সময়ে কেউ কেউ উন্মাদ হয়ে গিয়েছিল। এ সময়ে মিলিটারি জান্তা প্রচুর সংখ্যক কমিউনিস্ট পার্টির নেতাকর্মীকে হত্যা করেছিল।

বন্দি জীবনের অবসান ও নতুন রাজনৈতিক জীবনের শুরু:
১৯৮০ সালে উরুগুয়ের জনসাধারণ মিলিটারি ডেকটেটর থেকে গণতন্ত্রে ফেরার জন্য গণভোটে অংশ নেয়। গণভোট গনতন্ত্রে পক্ষে গেলে সেনাপ্রধান গ্রেগরিও কনরাডো আলভারেজ ১৯৮১ সালের ১ সেপ্টেম্বর নিজেকে উরুগুয়ের প্রেসিডেন্ট হিসেবে ঘোষণা দেন। এ সময়ে আলভারেজ উরুগুয়ের কমিউনিস্ট ও টুপামারোসদের ব্যাপকহারে নিধন করেন। এক সময় আলভারেজের জনপ্রিয়তায় ব্যাপক ধ্বস নামে। এমন কি সেনাবাহিনীর মধ্যেও তার জনপ্রিয়তা ব্যাপকহারে হ্রাস পায়। ১৯৮৪ সালের নভেম্বর মাসে তিনি সাধারণ নির্বাচন দিতে বাধ্য হন। নির্বাচনে কলরাডো পার্টির জুলিও মারিয়া সাংগুয়েনেট্টি জয়ী হন। উরুগুয়ের ঐতিহ্য অনুযায়ী দেশের প্রেসিডেন্ট শপথ নেন ১লা মার্চ। তার আগে ১২ ফেব্রুয়ারি স্বৈরশাসক গ্রেগরিও কনরাডো আলভারেজ পদত্যাগ করেন। অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট হিসেবে তখন শপথ নেন সুপ্রিম কোর্টের প্রেসিডেন্ট রাফায়েল আদ্দিয়েগো।

দীর্ঘ ১৪ বছর কঠোর বন্দি জীবনের পর ১৯৮৫ সালে মুক্তি পান হোসে মুজিকা। জেল থেকে মুক্ত হওয়ার পর টুপামারোস গেরিলারা মিলে বামপন্থী রাজনৈতিক দল ব্রোড ফ্রন্ট করেন। ১৯৭৩ সালে এই দলটি গঠিত হলেও উরুগুয়েতে স্বৈরশাসনের অবসানে ব্রোড ফ্রন্ট দলটি আবার কার্যক্রম শুরু করে। এই দল থেকে খুব দ্রুতই জনপ্রিয় রাজনীতিবিদ হয়ে ওঠেন হোসে মুজিকা। জনপ্রিয় হয়ে ওঠার পেছনে মুজিকার পুরোনো দিনের রবিন হুড গেরিলা ভাবমূর্তিও ভূমিকা রাখে। ৮০ ও ৯০-এর দশকে উরুগুয়ে শাসন করে কলরাডো পার্টি। ১৯৯৪ সালের নির্বাচনে জয়ের কাছাকাছি এসেও হার মানে ব্রোড ফ্রন্ট। তবে ৯৯ জন সাংসদের পার্লামেন্টে তখন দু’জন প্রাক্তন টুপামারো নেতা নির্বাচিত হন। এদেরই একজন ছিলেন হোসে মুজিকা। ১৯৯৯ সালে মুজিকা সিনেটর নির্বাচিত হন। ২০০৫ সালের নির্বাচনে উরুগুয়ের প্রভাবশালী কলোরাডো ও ন্যাশনাল পার্টির জোটকে হারিয়ে বামপন্থী জোট ব্রড ফ্রন্ট ক্ষমতায় আসে। প্রেসিডেন্ট পদে অভিষিক্ত হন তাবারে ভাসকুয়েজ। হোসে মুজিকা ২০০৫-২০০৮ সাল পর্যন্ত তাবারে ভাসকুয়েজের কেবিনেটে পশুসম্পদ, কৃষি ও মৎস্য মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। পরে তিনি মন্ত্রী হিসেবে পদত্যাগ করে সিনেটর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৯ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ব্রোড ফ্রন্টের প্রার্থী হিসেবে হোসে মুজিকা উরুগুয়ের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। ১ মার্চ ২০১০ সালে তিনি উরুগুয়ের চল্লিশতম প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেন ও দায়িত্বভার গ্রহন করেন।

প্রেম-ভালোবাসা এবং বিয়ে:
দীর্ঘ বিপ্লবী জীবনে হোসে মুজিকারও প্রেম এসেছিল। বিপ্লবী সতীর্থ লুসিয়া টোপোল্যানস্কির সঙ্গে মন দেয়া-নেয়া হয় হোসে মুজিকার। দীর্ঘ বিশ বছর প্রেমের পর ২০০৫ সালে তাঁরা বিয়ে করেন। মন্টেভিডিও'র এক শহরতলীতে তারা এক কৃষি ফার্মের ভেতর একেবারে অরডিনারি টিনের ঘরে বসবাস করেন। স্ত্রী লুসিয়া টোপোল্যানস্কিও একজন টুপামারো গেরিলা ও কৃষক। তাঁরা দু'জনে মিলে শবজি ও ফুলের চাষ করেন। নিঃসন্তান এই দম্পতির তিন পায়া একটি খোঁড়া কুকুর আছে। যার নাম ম্যানুয়েলা। এই দম্পতির সবচেয়ে দামি সম্পত্তি হলো ১৯৮৭ সালে কেনা মাত্র এক হাজার আটশো ডলারের একটি গাড়ি পুরাতন ভোক্সওয়াগন বিটল মডেলের গাড়ি। মুজিকা নিজেই এটি চালান।

প্রেসিডেন্ট এল পেপে:
২০১০ সালের ১ মার্চ থেকে ২০১৫ সালের ১ মার্চ পর্যন্ত গোসে মুজিকা এল পেপে উরুগুয়ের চল্লিশতম প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি উরুগুয়ের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েও নিজের গ্রামের বাড়িতে বসবাস করেছেন। উরুগুয়ের বিশাল জনপ্রিয়তার পিছনে রয়েছে তাঁর ঠোঁটকাটা কথা, আদর্শবাদী ভাবমূর্তি এবং সহজ-সরল জীবন-যাপন। তার অনুসারীদের মতে, এল পেপে মুখে যা বলেন, কাজেও তা করে দেখান। সাধারণ পোষাকে চলতি ভাষায় অবিশ্রান্ত গালাগালিতে ভরপুর তাঁর বক্তৃতা রাতারাতি জনপ্রিয়তা পায়। জীবনেও তিনি গলাবন্ধ টাই পড়েননি। মুজিকার সমালোচকরা বলেন, আসলে তিনি এক পাগলাটে, বাতিকগ্রস্ত বুড়ো যিনি বন্দুক ও বিপ্লব দুটিকেই সরিয়ে রেখেছেন। নিন্দুকদের কথায় অবশ্য আদৌ আমলে নেন না প্রেসিডেন্ট। বরং স্পষ্টভাষী হিসেবে বরাবরই বিতর্ক উস্কে দিয়েছেন তিনি। ক্ষমতায় এসে তিনি দেশে গাঁজার চাষ ও বিপণনকে বৈধতা দিয়েছেন। এছাড়া গর্ভপাত এবং সমকামী বিবাহকে তিনি আইনগতভাবে অনুমোদন করেছেন। জাতিসঙ্ঘের সাধারণ অধিবেশনের সভায় ভাষণ দিতে গিয়ে সদস্যদের মুজিকা বলেন, ‘বিপুল অর্থব্যয়ে আয়োজিত বৈঠকে যাওয়া বন্ধ করুন। এখানে কাজের কাজ কিছুই হয় না।’

অনাড়ম্বর জীবনযাপন:
শৈশব থেকেই চরম দারিদ্রের কষাঘাতে জর্জরিত হোসে মুজিকা দেশের প্রেসিডেন্ট হওয়ার পরও বদলাননি তাঁর জীবনযাপনের ধরন। ১৯৯৪ সালে উরুগুয়ের পার্লামেন্ট মেম্বার নির্বাচিত হবার পর থেকে নিজের ভোক্সওয়াগন বিটলে চেপেই পার্লামেন্টে যাতায়াত করতেন। ২০০৫ সালে বিয়ের পর ফুলের বাগান ঘেরা শহরতলির তিন কামরার টিনের চালওয়ালা ভাঙাচোরা বাড়িতে কুকুর-বিড়াল-মুরগি আর ভেড়াদের নিয়েই তাঁর সুখে সংসার। প্রতিবেশীরা বেশির ভাগই সমবয়সী বৃদ্ধ-বৃদ্ধা। কোন সশস্ত্র দেহরক্ষী নেই সেখানে। চোখ ধাঁধানো লিম্যুজিন বা সালোঁ নয়, ঘোরাফেরার জন্য তার নিত্যসঙ্গী ২৫ বছরের পুরনো ভোক্সওয়াগান বিটল। উরুগুয়ের প্রেসিডেন্ট হিসেবে তাঁর মাসিক বেতন ছিল ১২ হাজার ডলার। যার ৯০ ভাগই তিনি দান করে দিতেন রাষ্ট্রীয় কোষাগারে। যা ব্যয় করা হতো গরীবদের সহায়তা এবং ছোট বিনিয়োগের উদ্দেশ্যে দেশের সামাজিক সেবামূলক সংস্থায়। নিজের বেতনের মধ্য থেকে তিনি নিজের জন্য রাখতেন মাত্র ৭৭৫ ডলার। এই অনাড়ম্বর জীবন যাপনের জন্য সারা বিশ্বে তিনি পরিচিত বিশ্বের দরিদ্রতম প্রেসিডেন্ট হিসেবে।

উরুগুয়ে প্রশাসনের সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর হলেও মুজিকার বসবাসের খামার বাড়িটি দেখলে যে কেউ ভূতেরবাড়ি বলে ভুল করতে পারে। বিলাসবহুল প্রাসাদে থাকার বদলে তিনি বেছে নিয়েছেন নিতান্তই এক সাধারণ জীবন। এখনো কর্দমাক্ত পথ পেরিয়েই নিজের খামার বাড়িতে পৌঁছাতে হয় তাঁকে। মজার ব্যাপার হল, এই অর্ধ-পরিত্যক্ত খামার বাড়ির মালিক কিন্তু তিনি নন, বাড়িটির মালিক তাঁর স্ত্রী লুসিয়া টোপোল্যানস্কি। প্রেসিডেন্ট হওয়ার পরেও মুজিকা খামারে স্ত্রীর সঙ্গে নিয়মিত কৃষিকাজ করতেন। খামারে চাষ করছেন বিভিন্ন রকমের ফুল। বিশ্বের সবচেয়ে দরিদ্র এই প্রেসিডেন্টের নিরাপত্তার জন্য নিয়োজিত ছিল মাত্র দু'জন পুলিশ আর ম্যানুয়েলা নামের একটি কুকুর। নিজেকে সব সময় ঋণমুক্ত রেখেছেন মুজিকা। বামপন্থি টুপামারোস এই গেরিলা নেতার নামে কোনো ঋণ নেই। এমনকি তাঁর কোনো ব্যাংক অ্যাকাউন্টও নেই। সবসময় নিজেকে একজন কৃষক হিসেবে পরিচয় দিতেই সবচেয়ে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন মুজিকা। মাথায় ভরা এলোমেলো ধূসর চুল, ক্ষুদে ক্ষুদে চোখ, কাঁচাপাকা পুরু গোঁফ, দশাসই চেহারা দেখে মুজিকার বয়সটা অনুমান করা মুশকিল। দেশের সর্বোচ্চ পদে আসীন হয়েও নিজের জীবন যাপনের ধারা বদলাতে রাজি হননি তিনি। যে কারণে বিলাসবহুল আড়ম্বর ছেড়ে নিজের পুরনো বাড়ি-গাড়ি-খামার নিয়েই দিব্যি ভালোই আছেন মুজিকা। দেশবাসী যাঁকে আদর করে ডাকেন ‘এল পেপে’।

প্রতিবছর উরুগুয়ের কর্মকর্তাদের সম্পদের বিবরণী প্রকাশ করা বাধ্যতামূলক। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১০ সালে প্রেসিডেন্ট হিসেবে মুজিকা তাঁর সম্পদের পরিমাণ দেখান এক হাজার ৮০০ মার্কিন ডলার। যা কিনা তাঁর ১৯৮৭ মডেলের ভোক্সওয়াগন বিটল গাড়িটির দাম। ২০১২ সালের সম্পদের বিবরণীতে স্ত্রীর অর্ধেক সম্পদ যুক্ত করেন পেপে। এই সম্পদের মধ্যে ছিল জমি, ট্রাক্টর ও বাড়ির দাম। এতে তাঁর মোট সম্পদ দাঁড়িয়েছিল দুই লাখ ১৫ হাজার ডলার। যা তাঁর ভাইস প্রেসিডেন্টের ঘোষিত সম্পদের মাত্র দুই-তৃতীয়াংশ।

গাড়িটিও বিক্রি করতে চান পেপে:
মুজিকার অন্যতম সম্পদ ভোক্সওয়াগন বিটল কার। এখন বোধহয় ওটাও আর থাকবে না পেপের কাছে। ওই কারের জন্য ১০ লাখ ডলারের অফার পেয়েছেন তিনি। আর খুশিতে তিনি ওটা বেঁচেও দিতে চান! বাসকোয়েডা ম্যাগাজিনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে পেপে বলেছেন, কারটি বিক্রি করলে ১০ লাখ ডলার পাবেন। এক আরব শেখ তাকে এ অফার দিয়েছেন। তিনি অফারটি গ্রহণ করবেন কিনা ভাবছেন। আর যদি সত্যিই তিনি কারটি বিক্রি করতে পারেন, তাহলে প্রাপ্ত টাকা তিনি গরীবদের সাহায্যে বিলিয়ে দেবেন। মুজিকা বলেন, 'গাড়ির সঙ্গে আমার এমন কোনো প্রতিশ্রুতি নেই যে তা বিক্রি করা যাবে না। বরং হাসি মুখেই গাড়িটি বিক্রি করতে চাই। আর সেই টাকা বিলিয়ে দিতে চাই আশ্রয়হীনদের জন্য, যেন তারা মাথা গোঁজার একটা ঠাঁই পান'। অবশ্য মজা করে মুজিকা বলেন, গাড়িটি অবশ্য আমার প্রিয় কুকুর ম্যানুয়েলার জন্য রেখে দিতে চেয়েছিলাম হা হা হা...।

এল পেপের অবসর জীবন:
একটি দেশের প্রেসিডেন্ট হয়েও যে নিতান্ত সাধারণ জীবনযাপন করা সম্ভব সেটি দেখিয়েছেন এ বছর ২০ মে ৮০ বছরে পর্দাপন করা উরুগুয়ের সদ্য সাবেক হওয়া প্রেসিডেন্ট হোসে মুজিকা। গত ১ মার্চ তিনি নব নির্বাচিত উরুগুয়ের প্রেসিডেন্ট তাবারে ভাসকুয়েজের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। সারা জীবন চরম দারিদ্যের সঙ্গে যুদ্ধ করা এই মানুষটি দেশের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হবার পরেও কখনো বিলাসিতা করেননি। গোটা পৃথিবীর সকল দেশের শাসকগণ যদি হোসে মুজিকার পথ অনুসরণ করতো, তাহলে হয়তো কোনো দেশেই প্রেসিডেন্ট বা প্রধানমন্ত্রীকে নিরাপত্তা দেবার জন্য আলাদা কোনো বাহিনীর প্রয়োজন হতো না।

অবসর জীবনও দারুভাবে উপভোগ করছেন এল পেপে। বিভিন্ন দেশের বড় বড় সাংবাদিকদের তিনি নিজের বাড়িতে ও কৃষিখামারে বসে সাক্ষাৎকার দিচ্ছেন। বসনিয়া-হার্জেগোভিনার সঙ্গীত শিল্পী এমির কুস্তরিকা মুজিকার জীবন নিয়ে তৈরি করেছেন একটি ডকুমেন্টারি ফিল্ম। এমির তার ফিল্মের নাম দিয়েছেন 'দ্য লাস্ট হিরো অব পলিটিক্স'। বিবিসি'র রিও ডিও'র সাংবাদিক উইরে ডেভিসকে এক সাক্ষাৎকারে মুজিকা বলেন, ১৪ বছরের বন্দি জীবনে ওরা আমাকে সলিটারি সেলে আটকে রেখেছিল। যেখান থেকে আমি জীবনের এক কঠিন শিক্ষা পেয়েছি। এখন দিনের বেলায় এই যে কাঠের সোফায় বসতে পারছি, এটাইতো এক জীবনে অনেক কিছু। সলিটারি সেল আমাকে মানসিকভাবে শক্ত হতে সাহস যুগিয়েছে। এমন কি সাত-আট বছর আমি কোনো বই পর্যন্ত পড়তে পারিনি। মুজিকা বলেন, "This world is crazy, crazy! People are amazed by normal things and that obsession worries me!" প্রেসিডেন্ট হিসেবে কেন উরুগুয়েতে গাঁজার অবাধ ব্যবহারের অনুমোদন দিয়েছিলেন, এমন প্রশ্নের জবাবে মুজিকা বলেন, "Marijuana is another plague, another addiction. Some say its good but no, that's rubbish. Not marijuana, tobacco or alcohol - the only good addiction is love! But 150,000 people smoke [marijuana] here and I couldn't leave them at the mercy of drugs traffickers. It's easier to control something if it's legal and that's why we've done this."

অবসরে কি করবেন? জবাবে মুজিকা বলেন, "I have no intention of being an old pensioner, sitting in a corner writing my memoirs - no way! I'm tired of course, but I'm not ready to stop. My journey's ending and every day I'm a little closer to the grave."

আহা বাংলাদেশের শাসকগণ যদি হোসে মুজিকার মত এমন নির্লোভ ও সাধারণ হতো, তাহলে হয়তো আমাদের এত হাজার হাজার সমস্যা থাকতো না। আমাদের শাসকদের অন্তত এল পেপে'র জীবন পাঠ করা উচিত। পৃথিবীতে এতো লোভ যে একদিন কোনো কাজে লাগবে না, সেই শিক্ষা এদের হয়তো কোনোদিনই হবে না। হোসে মুজিকাকে জন্য গোটা পৃথিবীর মানুষ সারা জীবন মনে রাখবে। এই পৃথিবীর জন্য এক বিরল দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবেন টুপামারো এই গেরিলা নেতা এল পেপে।

.................................
২৯ মে ২০১৫
ঢাকা




মন্তব্য ১ টি রেটিং +৩/-০

মন্তব্য (১) মন্তব্য লিখুন

১| ২৯ শে মে, ২০১৫ ভোর ৫:৫৩

চাঁদগাজী বলেছেন:



ভালো মানুষকে নিয়ে ভালো পোস্ট লিখেছেন।
বিশ্বের বড় মানবদের একজন হচ্ছেন মুজিকা

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.