নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
ছোটগল্প লিখি। গান শুনি। মুভি দেখি। ঘুরে বেড়াই। আর সময় পেলে সিলেকটিভ বই পড়ি।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আগামী ৬ ও ৭ জুন দু'দিনের জন্য বাংলাদেশ সফর করবেন। মোদির এই সফরকালে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে প্রায় এক ডজন চুক্তি সাক্ষরিত হবে। যাত্রী ও পণ্য পরিবহনে ট্রানজিট সংক্রান্ত একাধিক চুক্তি সাক্ষর হবে। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে দু'দেশের মান নিয়ন্ত্রণ সংস্থার মধ্যে চুক্তি হবে। সংশোধিত বাণিজ্য চুক্তি এবং সংশোধিত নৌট্রানজিট প্রটোকল সাক্ষর হবে। উপকূলীয় জাহাজ চলাচলে পৃথক একটি চুক্তি সাক্ষর হবে। মানব পাচার, জলবায়ু পরিবর্তন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও দিল্লির জামিয়া মিল্লিয়া ইসলামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে সহযোগিতা সংক্রান্ত একাধিক চুক্তি, সমঝোতা স্মারক ও প্রটোকল সাক্ষর হবে। এছাড়া নতুন একটি ঋণ চুক্তি স্বাক্ষর হতে পারে। ভারতের প্রধামন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে যৌথভাবে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে ভারত ও বাংলাদেশ সীমান্তের ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার কসবা উপজেলার তারাপুর সীমান্তের ২০৩৯ নং পিলার সংলগ্ন সীমান্ত হাটের উদ্বোধন করবেন। এছাড়া তিনি রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের হাত থেকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখার জন্য ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারি বাজপেয়িকে দেওয়া সম্মাননা পদক গ্রহন করবেন। পাশাপাশি বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ওপর বক্তৃতা দিবেন। । বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সম্পাদিত সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সংবিধান সংশোধনী বিল ভারতের পার্লামেন্টে পাস হওয়ার পর মোদির উপস্থিতিতে ঢাকায় এই চুক্তির অনুসমর্থন সম্পন্ন করা হবে। তবে মোদির এই সফরে বহুল আলোচিত তিস্তা পানি চুক্তি হচ্ছে না।
গত বছর মে মাসে ভারতের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হবার পর এটাই হবে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির প্রথম বাংলাদেশ সফর। ক্ষমতায় আরোহনের পর থেকেই মোদি প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের উপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। মোদি এই এক বছরে প্রতিবেশী ভুটান, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, মিয়ানমার ছাড়াও পূর্ব এশিয়ার সিঙ্গাপুর, জাপান, চীন, মাঙ্গোলিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া; দক্ষিণ আমেরিকার ব্রাজিল; উত্তর আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা; ইউরোপের ফ্রান্স ও জার্মানি এবং অস্ট্রেলিয়া সফর করেছেন। এর আগে গত বছর সেপ্টেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে এবং নেপালে অনুষ্ঠিত সার্ক শীর্ষ সম্মেলনের সময় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে মোদির সাক্ষাত হয়েছে। দু'বারই বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তাকে বাংলাদেশে আসার আমন্ত্রণ জানান।
কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, ভারতের প্রধানমন্ত্রীর এই সফরে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বেশ কয়েকটি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের প্রস্তুতি প্রায় চূড়ান্ত। এর মধ্যে দীর্ঘ ৬৮ বছরের সীমান্ত জটিলতা দূর করতে ঐতিহাসিক স্থল সীমান্ত চুক্তি উভয় দেশের সম্পর্কে একটি নতুন মাইলফলক রচনা করবে। স্থল সীমান্ত চুক্তির আওতায় উভয় দেশের মধ্যে ১৬২টি ছিটমহল বিনিময় হবে। যার মাধ্যমে ছিটমহলবাসীরা নাগরিকত্ব সুবিধা পেতে যাচ্ছেন। এছাড়া এই চুক্তির আওতায় উভয় দেশের মধ্যে বিরোধপূর্ণ সীমান্ত এলাকার বিষয়েও স্থায়ী নিষ্পত্তি হবে। এছাড়া উভয় দেশের দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতাকে আরও নিবিড় করতে কিছু নতুন প্রকল্প বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত হতে পারে। বিশেষ করে নেপাল ও ভুটানে ভারত যেভাবে বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করে, এবার বাংলাদেশেও তারা একই ধরনের প্রকল্প শুরু করতে আগ্রহী। কুমুদিনী ট্রাস্টের একটি পানি প্রকল্পের মাধ্যমে হয়তো এর শুভ সূচনা হবে।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরকালে যাত্রী ও পণ্য পরিবহনে ট্রানজিট সংক্রান্ত একাধিক চুক্তির অংশ হিসেবে ঢাকা-কলকাতা-আগরতলা সরাসরি বাস চলাচল এবং ঢাকা-সিলেট-শিলং-গৌহাটির মধ্যে যাত্রীবাহী বাস চলাচল সংক্রান্ত চুক্তি হবে। এই চুক্তির খসড়া গতকাল বাংলাদেশের মন্ত্রিসভা অনুমোদন করেছে। এছাড়া বাংলাদেশ ও ভারতের মান নিয়ন্ত্রণ সংস্থার মধ্যে 'এগ্রিমেন্ট বিটুইন বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইন্সটিটিউশন (বিএসটিআই) অ্যান্ড ব্যুরো অফ ইন্ডিয়ান স্ট্যান্ডার্ডস (বিআইএস) অন কোঅপারেশন ইন দি ফিল্ড অব স্ট্যান্ডার্ডাইজেশন অ্যান্ড কনফরমিটি অ্যাসেসমেন্ট-চুক্তির খসড়াও অনুমোদন করেছে মন্ত্রিসভা। এই চুক্তি সাক্ষরের পর উভয় দেশের সংস্থা দুটি পণ্যের মান সংক্রান্ত একে অন্যের সনদ গ্রহণ করবে। এছাড়া পরস্পরের মধ্যে ঠিক করা নির্ধারিত সময়ে পণ্যের মান নির্ণয় করবে। একই সঙ্গে একে অপরের মান নির্ণয়ের পদ্ধতি সমন্বয় করবে, যাতে পণ্যের মান একই ধরনের হয়। এ চুক্তি কার্যকর হলে উভয় দেশের মধ্যে বাণিজ্য আরও বৃদ্ধি পাবে। পাশাপাশি ফলে বাংলাদেশের রফতানির ক্ষেত্রে অশুল্ক বাণিজ্য বাধা অনেকাংশে দূর হবে।
গত বছর এপ্রিলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাত করে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বহুপক্ষীয় ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিষয়ক সচিব সুজাতা মেহতা দ্বিতীয় মেয়াদে সহজ শর্তে এক বিলিয়ন ডলার ঋণের প্রস্তাব করেছিলেন। যার ভিত্তিতে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) ১১টি উন্নয়ন প্রকল্পের একটি খসড়াও ইতোমধ্যে তৈরি করেছে। এছাড়া মোদির সফরের সময় বাংলাদেশে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বাড়াতে ভারতকে একটি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল নির্দিষ্ট করে দেওয়ার বিষয়েও আলোচনা হবে। সংশোধিত বাণিজ্য চুক্তি এবং সংশোধিত নৌট্রানজিট প্রটোকল সংক্রান্ত দুটি চুক্তির আওতায় বাংলাদেশ ও ভারতের বাইরে তৃতীয় দেশ হিসেবে নেপাল ও ভুটানে পণ্য পরিবহন করার সুযোগ রাখা হবে। উপকূলীয় জাহাজ চলাচল চুক্তির আওতায় ভারতের তিনটি সমুদ্রবন্দর বিশাখা পত্তম, প্যারাদ্বীপ ও হলুদিয়া সমুদ্র বন্দরের সঙ্গে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম ও মংলা সমুদ্র বন্দরের মধ্যে উপকূল ঘেঁষে ছোট ও মাঝারি জাহাজ চলাচল করবে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার কসবা উপজেলার তারাপুর সীমান্ত হাট চালু হলে এটি হবে ভারত ও বাংলাদেশ সীমান্তের মধ্যে চতুর্থ সীমান্ত হাট। এর আগে ভারত-বাংলাদেশ সরকারের চুক্তি অনুযায়ী, কুড়িগ্রামের রাজীবপুর উপজেলার বালিয়ামারী, সুনামগঞ্জ সদরের ডলোরা এবং ফেনী ছাগলনাইয়ার পূর্ব মধুগ্রাম-ছয়ঘরিয়ার মধ্যবর্তী স্থানের সীমান্তে তিনটি সীমান্ত হাট চালু হয়েছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে এসব চুক্তির মাধ্যমে ট্রানজিট সুবিধা আরো বিস্তৃত হবে। এসব চুক্তির আওতায় উভয় দেশের মধ্যে সড়ক, রেল, নদী, সমুদ্রপথে এবং বিদ্যুৎ সংযোগের মাধ্যমে কানেকটিভিটি শক্তিশালী করতে ট্রানজিট সুবিধা বাড়ানো হবে। ট্রানজিট শব্দটি স্পর্শকাতর হওয়ায় বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ক্ষেত্রে কৌশলে কানেকটিভিটি শব্দ ব্যবহার করা হবে। পরিবর্তিত বিশ্ব পরিস্থিতিতে নরেন্দ্র মোদি প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন ও শক্তিশালী করার যে নতুন কৌশল গ্রহণ করেছেন, তা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে পরাস্পরিক সম্পর্ক নিঃসন্দেহে আরও দৃঢ় করবে। ওয়ান ইলেভেনের পর গোটা বিশ্বে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন জোট এককভাবে যেভাবে বাজার অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করে আসছিল, তার বিপরীতে চীন ও ভারতের মধ্যে নতুন সম্পর্ক উন্নয়নের যে পূর্বাভাস দেখা যাচ্ছে, তা কেবল এশিয়া অঞ্চলেই বাজার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠিত করবে না, বরং গোটা বিশ্বে মার্কিন আধিপত্যকে নতুন চ্যালেঞ্জ জানাবে। দক্ষিণ-এশিয়ায় ভারতের একক বাজারের বিপরীতে প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি দূরীকরণে ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক উন্নয়নে ছোট দেশগুলোকে ভারতের গুরুত্ব দেওয়ায়, এই অঞ্চলে শান্তি ও পরাস্পরিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠায় মোদির কূটনৈতিক তৎপরতা ভবিষ্যতে সুদূরপ্রসারী প্রভাব বিস্তারে সক্ষম হবে।
ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বিশাল বাণিজ্য ঘাটতি সত্ত্বেও ভৌগলিক অবস্থানগত সুবিধার কারণে ভারত বর্তমানে বাংলাদেশের সাথে অনেক ইস্যুতেই নমনীয় আচরণ করছে। বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব সীমান্তে ভারতের সাতটি প্রদেশের অবস্থান। ভারতের অন্যান্য এলাকার চেয়ে এই সাতটি প্রদেশ অর্থনৈতিক দিক দিয়ে অনেকটা পিছিয়ে। তাছাড়া সেখানে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের অনেকটাই নিয়ন্ত্রণের বাইরে। বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনকে দমাতে হলে এই সাতটি প্রদেশে কেন্দ্রীয় সরকারের আরও নিয়ন্ত্রণ জরুরী। জবরদস্তিমূলক নিন্ত্রয়ণ নীতি এই সাতটি প্রদেশকে ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন করতে পারে, সেই আশঙ্কায় মোদি সেখানে উন্নয়ন কর্মসূচি জোড়দার করতে ইচ্ছুক। সেজন্য বাংলাদেশের ভেতর থেকে স্থল, নৌ ও আকাশপথে সেখানে নানান প্রকল্প বাস্তবায়ন এখন ভারত সরকারের মুখ্য বিষয়।
মোদির বাংলাদেশ সফরে ঐতিহাসিক স্থল সীমান্ত চুক্তি স্বাক্ষরের আড়ালে ভারতের প্রধান টার্গেট ট্রানজিট সুবিধা এবং চট্টগ্রাম ও মংলা সমুদ্র বন্দর ব্যবহারের সুবিধা। ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে সীমান্ত বিরোধ মিটিয়ে ট্রানজিট ও বন্দর ইস্যুতে সুবিধা নিতে চায়। ইতোমধ্যে কলকাতা-ঢাকা-আগরতলা সরাসরি বাস সার্ভিস এবং ঢাকা-সিলেট-শিলং-গৌহাটির মধ্যে যাত্রীবাহী বাস সার্ভিসের পরীক্ষামূলক উদ্ভোধন হয়েছে। ভবিষ্যতে এই দুটি পথেই ট্রেন সার্ভিস চালুর চিন্তাও করছে ভারত। এছাড়া শিলং-তমাবিল-চট্টগ্রাম, চট্টগ্রাম-কুমিল্লা-আগরতলা, দার্জেলিং-পাটগ্রাম-ঢাকা-কলকাতা, সিকিম-বাংলাবান্দা-সোনামসজিদ-কলকাতা- এমন অনেক রুটে পণ্য চলাচল ও যাত্রীবাহী বাস সার্ভিস চালুর পরিকল্পনা রয়েছে ভারতের। এছাড়া কলকাতা-যশোর-মংলা রুট দিয়ে মংলা বন্দর ব্যবহারের ইচ্ছাও ভারতের পরিকল্পনায় রয়েছে। আবার মংলা বন্দর থেকে ঢাকা-সিলেট-শিলং রুটে পণ্য চলাচল সুবিধার চিন্তাও রয়েছে ভারতের।
এক ডজন চুক্তির আড়ালে কে কী পাচ্ছে?
১. বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকা সীমান্ত জটিলতার একটি স্থায়ী সমাধান হতে যাচ্ছে। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে মোট ১৬২টি ছিটমহল। যার মধ্যে ভারতের ভূ-খণ্ডে বাংলাদেশের রয়েছে ৫১টি ছিটমহল, যার মোট আয়তন ৭ হাজার ১১০.০২ একর এবং লোকসংখ্যা প্রায় ৭০ হাজার। আর বাংলাদেশের ভূ-খণ্ডে ভারতের রয়েছে ১১১টি ছিটমহল, যার মোট আয়তন ১৭ হাজার ১৫৮.০৫ একর এবং লোকসংখ্যা প্রায় এক লাখ। ১৬২ ছিটমহলের মোট আয়তন ২৪ হাজার ২৬৮.০৭ একর। ছিটমহল বিনিময়ে বাংলাদেশ ভারতের তুলনায় বেশি পাচ্ছে প্রায় ১০ হাজার ১৪৮.০৩ একর ভূমি। পাশাপাশি ছিটমহলের বাসিন্দাদের জন্য নাগরিকত্বের সুবিধা উন্মুক্ত থাকায় এক্ষেত্রে বাংলাদেশ কিছুটা লাভবান হবে। কারণ ভারতের প্রায় এক লাখ মানুষের বিপরীতে বাংলাদেশে যুক্ত হচ্ছে ৭০ হাজার মানুষ।
২. সংশোধিত নৌট্রানজিট প্রটোকল এবং উপকূলীয় জাহাজ চলাচল চুক্তির আওতায় বেশি সুবিধা পাচ্ছে ভারত। মায়ানমার ও ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশ সমুদ্রসীমা জয়ের পর তড়িঘড়ি করে যেভাবে সমুদ্র ও যৌথ নদীগুলোতে ভারতকে বেশি সুবিধা প্রদান করেছে, তা বাংলাদেশের জন্য এক ধরনের কূটনৈতিক পরাজয় ছিল। রায়মঙ্গল ও হাড়িয়াভাঙ্গা নদীর উপর বাংলাদেশের একক আধিপত্য ভারতের কাছে বাংলাদেশ বিসর্জন দিয়েছে। সমুদ্রে ভারতীয় নৌবাহিনীকে অবাধ চলাচলের সুবিধা দিতে গিয়ে ইতোমধ্যে আমরা ভারতের কাছ থেকে সুন্দরবন ধ্বংসের রামপাল কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প গ্রহণ করেছি। যা বাংলাদেশের জন্য একটি বড় ধরনের বুমেড়াং প্রকল্প। এই প্রকল্প বাংলাদেশের সুন্দরবনকে আগামী বিশ-ত্রিশ বা পঞ্চাশ বছরের মধ্যে পুরোপুরি ধ্বংস করে দেবে। ইতোমধ্যে সুন্দরবন অঞ্চলে নৌ দুর্ঘটনার যে হিরিক পড়েছে, এটা সুন্দরবন ধ্বংসের নীলনকশারই প্রতিফলন। যে ঘটনায় প্রতিবারই বাংলাদেশের মানুষকে সরকার বারবার ভুল ব্যাখ্যা দিচ্ছে।
নতুন করে উপকূলীয় জাহাজ চলাচল চুক্তির আওতায় ভারতের তিনটি সমুদ্রবন্দর বিশাখা পত্তম, প্যারাদ্বীপ ও হলুদিয়া সমুদ্র বন্দরের সঙ্গে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম ও মংলা সমুদ্র বন্দরের মধ্যে উপকূল ঘেঁষে ছোট ও মাঝারি জাহাজ চলাচলের কথা বলা হলেও, আসলে বঙ্গোপসাগরে ভারতীয় নৌবাহিনীর অবাধ ও নিছিদ্র নিরাপত্তা নিশ্চিত করতেই নতুন করে এই উপকূলীয় জাহাজ চলাচল চুক্তি। শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে ভারত এই চুক্তির আওতায় নিশ্চিত বেশি লাভ ঘরে তুলবে।
৩. স্থল, জল ও আকাশ পথে অবাধ অবাধ যোগাযোগের লক্ষ্যে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে যে ট্রানজিট চুক্তি হতে যাচ্ছে, সেখান থেকে বাংলাদেশ যদি ভারতীয় পণ্যের উপর যথার্থ শুক্ল আদায় করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে ট্রানজিটের নামে ভারত বাংলাদেশের ভূ-খণ্ড ব্যবহার করে বেশি লাভবান হবে। একদিকে ভারত পূর্বাঞ্চলের সাতটি প্রদেশের বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন নিয়ন্ত্রণের আড়ালে নানান কিসিমের উন্নয়ন কৌশলের কথা বলছে। কিন্তু প্রয়োজনীয় মুহূর্তে ভারত যদি পণ্যের নামে এসব অঞ্চলে সামরিক সরঞ্জাম আনা নেওয়া করে, তাহলে চুক্তিতে বাংলাদেশের জন্য রক্ষাকবজ কি তা এখনো সুস্পষ্ট নয়। পুরোপুরি ব্যবসা বাণিজ্যের জন্য ট্রানজিট হলে তাতে বাংলাদেশের লাভ হবে। কিন্তু ট্রানজিটের সুযোগে ভারত যদি এসব রুটে সামরিক গোলাবারুদ ও ভারতীয় সেনা আনা নেওয়া করে তাহলে বাংলাদেশের জন্য তা এক ধরনের নতুন নিরাপত্তা হুমকি তৈরি করবে।
কারণ স্থল সীমান্তের জটিলতা দূর হলেও এখনো ভারতীয় বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্সের (বিএসএফ) গুলিতে প্রতিদিন বাংলাদেশীদের মৃত্যুর খবর আসছে। সীমান্তে ভারতীয় বিএসএফ গুলি চালানো যে একেবারে বন্ধ করবে, তার গ্র্যান্টি কি? তাহলে উভয় দেশ যখন সীমান্ত জটিলতা নিরসনে এতদূর অগ্রসর হল, এই সময়েও কেন বিএসএফের গুলিতে বাংলাদেশীদের মৃত্যু হচ্ছে? উভয় দেশের মধ্যে সীমান্ত বিরোধ মিটলেও সীমান্তে গুলি বিনিময় বন্ধ না হলে, এই ঐতিহাসিক চুক্তি কতটুকু সুফল বয়ে আনবে?
৪. স্থায়ী মেয়াদে না হলেও স্বয়ংক্রিয়ভাবে নবায়নের সুযোগ রেখে বাংলাদেশ-ভারত সংশোধিত বাণিজ্য চুক্তির খসড়া অনুমোদন করেছে আমাদের মন্ত্রিসভা। এতে চুক্তির মেয়াদ তিন বছরের পরিবর্তে পাঁচ বছর করা হয়েছে। সংশোধিত বাণিজ্য চুক্তির খসড়ায় ভারত সম্মত হয়েছে। গত ৩১ মার্চ বাংলাদেশ-ভারত বাণিজ্য চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়। ফলে চুক্তির ধারাবাহিকতায় ১ এপ্রিল থেকে সংশোধিত চুক্তি কার্যকর হবে। কিন্তু বাণিজ্য চুক্তির আওতায় বাংলাদেশ কি কি পণ্যের উপর ভারতে শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার পাচ্ছে তা এখনো সুস্পষ্ট নয়। তবে বিদ্যমান চুক্তিতে সমঝোতার ভিত্তিতে বাংলাদেশ ও ভারত বাণিজ্য বৃদ্ধির জন্য একে অন্যের স্থল, নৌ ও রেলপথ ব্যবহার করতে পারে। এখন নতুন এই বিধান অনুযায়ী, তৃতীয় দেশ হিসেবে নেপাল ও ভুটান যুক্ত হওয়ায় আপাত দৃষ্টিতে বাংলাদেশের বাণিজ্য সম্প্রসারণ হবে। এ চুক্তির আওতায় ভারতের স্থল, নৌ ও রেলপথ ব্যবহার করে দেশ দুটির সঙ্গে বাংলাদেশ বাণিজ্য সম্প্রসারণ করতে পারবে। কিন্তু ভারতে বাংলাদেশী পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার কতোটা গুরুত্ব পাচ্ছে, তার উপর এই বাণিজ্য সম্প্রসারণের বিষয়টি ঝুলে থাকবে।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঘনিষ্ঠ শিল্পগোষ্ঠী আম্বানীদের অর্থানুকুল্যে চলা থিঙ্ক ট্যাঙ্ক – অবজার্ভার রিসার্চ ফাউন্ডেশন সম্প্রতি ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের দু'পাশে ৩০ কিলোমিটার এলাকায় বিশেষ সীমান্ত অঞ্চল গড়ে তোলার প্রস্তাব করেছে। যেখানে উভয় দেশের যৌথ প্রশাসনিক ব্যবস্থার কথা বলা হয়েছে। সীমান্ত এলাকার মানুষদের জন্য ওয়ার্ক পার্মিটের পাশাপাশি ভারত থেকে বাংলাদেশে গরু পাচার বন্ধ করার জন্যই এই উদ্যোগ, যা ভারত সরকার এখন বিশেষভাবে বিবেচনা করছে। বাংলাদেশে গরুর মাংসের চাহিদা ক্রমবর্ধমান থাকায় ওই প্রস্তাবে ভারত থেকে গরু পাচারের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার কথাও বলা হয়েছে। প্রস্তাবিত সীমান্ত হাটগুলির মাধ্যমে গরু রপ্তানিকে আইনী সিলমোহর দেওয়ার কথা ভাবছে ভারত। যা থেকে ভারতের রাজস্ব আদায় যেমন হবে তেমনি সীমান্তে চোরাচালান বন্ধ হবে। যা ভারতের জন্য সুফল বয়ে আনবে।
৫. বাংলাদেশ ও ভারতের মান নিয়ন্ত্রণ সংস্থার মধ্যে 'এগ্রিমেন্ট বিটুইন বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইন্সটিটিউশন (বিএসটিআই) অ্যান্ড ব্যুরো অফ ইন্ডিয়ান স্ট্যান্ডার্ডস (বিআইএস) অন কোঅপারেশন ইন দি ফিল্ড অব স্ট্যান্ডার্ডাইজেশন অ্যান্ড কনফরমিটি অ্যাসেসমেন্ট-চুক্তির আওতায় লাভের পাল্লা ভারতের দিকে। কারণ বিএসটিআই অনুমোদিত অনেক পণ্যের মান স্বয়ং বাংলাদেশের দেশীয় ভোক্তাদের কাছেই এখন পর্যন্ত মান উত্তীর্ণ হতে পারে নি। বিএসটিআই-এর বিদ্যমান মান নিয়ে ভারতের বিআইএস-এর সঙ্গে পাল্লা দেবার আড়ালে দুর্নীতিকে আরো শক্তিশালী করার একটি উপায় হতে পারে। সেক্ষেত্রে ভারত ইচ্ছে করলে যে কোনো ইস্যুতে এই মান নিয়ে প্রশ্ন তুলে বাংলাদেশী পণ্যের ভারতে অবাধ চলাচলের উপর কড়াকড়ি আরোপ করতে পারে। যতদিন না আমরা বিএসটিআই-কে মান উত্তীর্ণ পর্যায়ে নিয়ে যেতে না পারব, ততদিন এই চুক্তি হয়তো কাগজে কলমে কেবল শ্রীবৃদ্ধি করবে, কাজের কাজ কিছুই হবে না।
৬. ভারত বাংলাদেশে বিদ্যুৎ রপ্তানি করার নামে পূর্বাঞ্চলের সাতটি প্রদেশে বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশিচত করতে চায়। ইতোমধ্যে কুস্টিয়ার ভেড়ামাড়া বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মাধ্যমে বাংলাদেশ ভারত থেকে যে পরিমাণ বিদ্যুৎ আমদানি করছে, তার হিসাব নিকাশ এখনো সাধারণ মানুষের কাছে ততোটা স্বচ্ছ নয়। সেক্ষেত্রে ভারতীয় বিনিয়োগে রামপাল কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প যেমন বাংলাদেশের জন্য সুন্দরবন ধ্বংসের উপলক্ষ্য হয়েছে, তেমনি নিজেদের বিদ্যুৎখাতে স্থায়ী সমাধানের বিষয়ে চিন্তা না করে ভারত থেকে যে কোনো ধরনের বিদ্যুৎ আমদানিতে একটা বড় ধরনের শুভংকরের ফাঁকির ব্যাপারটি মোটেও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। ভারতের এই বিদ্যুৎ বাংলাদেশের শিল্প-কলকারখানার চেয়ে কিছু ভারতপন্থী ব্যবসায়ীদের পকেট মোটাতাজাকরণে ব্যবহার হবার ঝুঁকি উড়িয়ে দেওয়া যায় না। কারণ, আমরা ইতোমধ্যে কুইক রেন্টালের কুফল হারে হারে টের পাচ্ছি। মানুষ অতিরিক্ত দামে বিদ্যুৎ কিনছে। কিন্তু দুর্ভোগ মোটেও কমছে না। মাঝখান থেকে লাভের মৌ পিঁপড়ায় খেয়ে যাচ্ছে।
৭. দ্বিতীয় মেয়াদে সহজ শর্তে ভারত বাংলাদেশকে এক বিলিয়ন ডলার ঋণের প্রস্তাব দিয়েছে। যার ভিত্তিতে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) ১১টি উন্নয়ন প্রকল্পের একটি খসড়াও ইতোমধ্যে তৈরি করেছে। বাংলাদেশে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বাড়াতে ভারতকে একটি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল নির্দিষ্ট করে দেবে বাংলাদেশ। এটি বাংলাদেশের জন্য লাভবান হবে। তবে এক বিলিয়ন ডলার ঋণের শর্তগুলো মিডিয়ায় তেমন আলোচনা না হওয়ায় এর মধ্যে কোনো শুভংকরের ফাঁকির কথা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
৮. ভারত এখন পর্যন্ত গঙ্গার পানির ন্যায্য হিস্যা বাংলাদেশকে দেয় না। শুষ্ক মৌসুমে ভারত মাঝে মাঝে এক তরফাভাবে ফারাক্কা থেকে পানি প্রত্যাহার করে। আবার বর্ষা মৌসুমে ভাগিরথী নদী উপকূলে বন্যা আশংকা দেখা দিলে বাংলাদেশের উপর বন্যা চাপিয়ে দৈয় ভারত। ফলে গঙ্গার পানি চুক্তি যতোটা কাগজে কলমে বাস্তবে ভারত তা এখনো পুরোপুরি মানে না। বরং প্রায়ই অনিয়ম করে। অথচ গঙ্গা পানির ন্যায্য হিস্যা বিষয়ে বাংলাদেশ সরকার মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছে। মোদি'র বাংলাদেশ সফরের সময়ও গঙ্গায় পানির ন্যায্য হিস্যা নিয়ে বাংলাদেশ কোনো প্রসঙ্গ তুলছে না। যা বাংলাদেশের জন্য এক ধরনের কূটনৈতিক পরাজয়।
৯. ২০১১ সালের ৬ ও ৭ সেপ্টেম্বর ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং বাংলাদেশ সফর করেন। মনমোহন সিং-এর বাংলাদেশ সফরের সময় তিস্তা নদীর পানি বণ্টন চুক্তি হবার কথা ছিল। তখন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর সফর সঙ্গী হিসেবে বাংলাদেশের সংলগ্ন পাঁচটি ভারতীয় রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীদের আসার কথা থাকলেও শেষ মূহুর্তে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায় প্রস্তাবিত তিস্তা চুক্তির বিষয়ে প্রবল আপত্তি জানিয়ে ঢাকায় আসেন নি। ফলে তখন তিস্তা পানি চুক্তি হয়নি। যে কারণে বাংলাদেশ ট্রানজিট চুক্তি থেকে পিছিয়ে গিয়েছিল। তিস্তা চুক্তি না করার আড়ালে ওটা ছিল স্রেফ একটি ভারতীয় কূটনৈতিক চালাকি।
এবার প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি'র বাংলাদেশ সফরে বহুল আলোচিত তিস্তা চুক্তি হতে যাচ্ছে, এমনটি শুরু থেকে শোনা গেলেও শেষ সময়ে সেই মমতা বন্দোপাধ্যায় আবারো এটি আটকে দিলেন। আর আশ্চার্যজনকভাবে বাংলাদেশ সরকারও অনেকটা ভারতীয় প্রদেশের মত নমনীয় আচরণে তা মেনে নিল! এবার মমতা বন্দোপাধ্যায় শর্ত দিয়েছেন তিস্তা নিয়ে কোনো কথা হলে তিনি বাংলাদেশে আসবেন না। বাংলাদেশ যাতে তিস্তা নিয়ে মোদি'র সঙ্গে কোনো আলোচনা না তোলে সেজন্য এবার মমতা বন্দোপাধ্যায় ঢাকায় আসবেন ৫ জুন আর ৬ জুন চলে যাবেন। নরেন্দ্র মোদি'র মুখ রক্ষা আর ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলাদেশ সফরের সময় পদ্মার ইলিশ খাওয়ার সৌজন্যতা দেখাতে মমতা ঢাকায় আসবেন। কিন্তু এটা যে ভারতের সেই পুরানো কৌশল এটা বাংলাদেশ বুঝেও কেন মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছে। তার মানে ভাপরত সুস্পষ্টভাবে যেটা বলতে চায় সেটা হল তিস্তা পানি চুক্তি সহসা হচ্ছে না। তাহলে কখন হবে তিস্তা পানি চুক্তি?
তিস্তার উজানে ভারতের সিকিম রাজ্য সরকার একাধিক বাঁধ দিয়ে বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছে। তিস্তার উজানে যতদিন ভারতের একাধিক বাঁধ সম্পন্ন না হচ্ছে, ততদিন ভারত যে কোনো অযুহাতে তিস্তা পানি চুক্তি এড়িয়ে চলবে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় হল ভারতের কৌশলের একটি ঘুটি মাত্র। কিন্তু বাংলাদেশ কিন্তু তিস্তা চুক্তি না করেই সেই ট্রানজিট দিয়ে দিচ্ছে। বরং এবার ট্রানজিটের আওতা আরো বিস্তৃত হয়েছে। ফারাক্কা বাঁধের পর ভারত যেমন নামকাওয়াস্তে গঙ্গা পানি চুক্তি করেছে, তিস্তার বেলায়ও ভারত একই কৌশল নিয়েছে। যা মেনে নেওয়া মানে বাংলাদেশের বিশাল কূটনৈতিক পরাজয়।
তিস্তার উজানে সিকিম সরকারের এসব প্রকল্প অব্যাহত থাকলে আগামীতে ভারতের সঙ্গে কাগজে কলমে তিস্তা চুক্তি হলেও বাংলাদেশের তেমন কোনো লাভ হবে না। তিস্তার উজানে ভারতের চলমান প্রকল্পগুলোর সুদূরপ্রসারী নেতিবাচক ফলাফল ভবিষ্যতে বাংলাদেশকেই বহন করতে হবে। অন্যদিকে হিমালয় থেকে উৎপন্ন হওয়া ব্রহ্মপুত্রের উজানে বাঁধ দিয়ে চীন সরকার দুই হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্প বাস্তবায়নে উদ্যোগ নিয়েছে। এ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে ভারত ও বাংলাদেশে বন্যা ও নদী ভাঙনের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হবে। উজানের যে কোনো আন্তর্জাতিক নদীতে ভারত ও চীনের কোনো প্রকল্প বাস্তবায়নে ভাটি অঞ্চলের বাংলাদেশের ক্ষয়ক্ষতি সবচেয়ে বেশি হবে। এসব বিষয় যথাযথভাবে বিবেচনায় না রাখলে, দীর্ঘমেয়াদে বাংলাদেশে নদী অববাহিকার দু’পাশের জনগণের অপূরণীয় ক্ষতি হবে। উজানে পানি প্রত্যাহার করা হলে ভাটি অঞ্চলের জীববৈচিত্র্যও নষ্ট হবে। আন্তর্জাতিক নদী ইস্যুতে বাংলাদেশের কূটনৈতিক ব্যর্থতা এবং তোষামোদিতাই মূলত এজন্য দায়ী।
১০. ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং এর বাংলাদেশ সফরের সময় ফেনী নদীর পানি বণ্টনের ব্যাপারেও কোনো চুক্তি হয়নি। এবারো নরেন্দ্র মোদি'র বাংলাদেশ সফরে ফেনি নদীর পানি বণ্টন নিয়ে কোনো আলোচনা হচ্ছে না। এমন কি ভারতের পানি সম্পদমন্ত্রী মোদি'র সঙ্গে ঢাকায় আসছেন না। ফলে নদী ও পানি প্রশ্নে বাংলাদেশের পকেটে এবারো ফলাফল শূণ্য। আন্তর্জাতিক নদীগুলোর ব্যবস্থাপনার জন্য নদীর উৎসস্থল থেকে সমুদ্র পর্যন্ত সব দেশের অংশগ্রহণে যৌথ নদী কমিশন গঠন করতে হবে। এটা না করলে প্রতিবেশী দেশগুলোর আস্থার সংকট বাড়তে থাকবে। আন্তর্জাতিক নদীতে কোনো একক দেশের ইচ্ছায় কোনো নদীর উজানে পানি প্রত্যাহার করলে সংশ্লিষ্ট এলাকার জনগণ সাময়িকভাবে উপকৃত হলেও ভাটির অঞ্চলের জনগণের সম্মতি ছাড়া এ ধরনের প্রকল্প বাস্তবায়ন যাতে কেউ ঘটাতে না পারে, সে বিষয়ে বাংলাদেশকে আরো জোড়ালো ভূমিকা পালন করতে হবে। কারণ এ ধরনের প্রকল্প বাস্তবায়নের ফলে উজান ও ভাটি অঞ্চলের জনগণের মধ্যকার আস্থার সংকটে যে ক্ষতি হবে, ভবিষ্যতে তা কোনোভাবেই পূরণ করা সম্ভব হবে না। বর্ষা মৌসুমে পানি ধরে রাখার জন্য যৌথ উদ্যোগে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া না হলে বাংলাদেশ ও ভারতের অভিন্ন নদীগুলো শুষ্ক মৌসুমের তিস্তার মত করুণ দশায় পতিত হবে। বাংলাদেশকে এই বিষয়গুলো নিয়ে শুধু ভারত নয় চীনের সঙ্গেও জোড়ালো কূটনৈতিক তৎপরতা চালাতে হবে।
১১. বাংলাদেশের হাতে এখন একটি মাত্র পয়েন্ট। কক্সবাজারের অদূরে সোনাদিয়া গভীর সমুদ্র বন্দর। কারণ ভারত ও চীন উভয়েই এখন বাংলাদেশের কক্সবাজারের অদূরে সোনাদিয়া গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণের কাজটি পেতে চায়। একই প্রকল্প পেতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, সিঙ্গাপুর, বৃটেনসহ অনেকেই একপায়ে দাঁড়ানো। বাংলাদেশের উচিত হবে আন্তর্জাতিক নদীগুলোতে পানির ন্যায্য হিসাব কড়ায় গণ্ডায় বুঝে নিয়ে তবেই এসব বিষয়ে দক্ষ পদক্ষেপ নেওয়া। সেক্ষেত্রে সোনাদিয়া গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণে কোনো একটি দেশকে একক দায়িত্ব না দিয়ে একেক দেশকে একেক ধরনের দায়িত্ব দিয়ে বাংলাদেশের উচিত হবে ‘আসল চাবিটি’ নিজেদের হাতে রাখা। কারণ, ভারত বাংলাদেশকে পানির হিসাব পুরোপুরি না বুঝিয়ে দিয়ে বিভিন্ন বাণিজ্য সুবিধা আর ঋণ চুক্তির আড়ালে ট্রানজিটসহ অন্যান্য সুবিধা নিয়ে যাচ্ছে। তিস্তা চুব্তি না করেই বাংলাদেশ এবার ভারতকে ট্রানজিট দিতে রাজি হয়েছে। আগামীতে হয়তো টাকার অংকের হিসাব নিকাশে পদ্মা সেতুর মত সোনাদিয়া গভীর সমুদ্র বন্দর প্রকল্পও বাংলাদেশ যে কাউকে না বুঝেই দিয়ে দেবে। যদি এমনটি হয়, তা হবে বাংলাদেশের জন্য চরম কূটনৈতিক ব্যর্থতা।
১২. ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আসন্ন সফর বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কূটনৈতিক হিসাব নিকাশে এক চুলও ছাড় দিলে তা হবে ভবিষ্যতে বাংলাদেশকে ভারতের একটি প্রদেশে পরিণত হওয়ার চূড়ান্ত নীলনকশা। তাই সরকার বাহাদুরকে প্রতিটি চালই বুঝে শুনে হিসাব কষে দিতে হবে। মোদি'র ঢাকায় আসার আগেই তিস্তা ইস্যুতে বাংলাদেশের পিছু হাঁটা নীতি মোটেও শুভ লক্ষণ নয়। ভারতের সঙ্গে কূটনৈতিক যুক্তিতর্ক ছাড়াই তিস্তা ইস্যু থেকে বাংলাদেশের পিছিয়ে আসা বাংলাদেশের নতজানু পররাষ্ট্র নীতিরই প্রতিফলন। তিস্তা প্রশ্নে এবারো ট্রানজিট বিষয়ে বাংলাদেশের অনড় থাকার কৌশল হতে পারত সঠিক কূটনৈতিক দক্ষতার প্রতিফলন। সেক্ষেত্রে ভারত হয়তো আরো নমনীয় হতে চেষ্টা করত। ভারতকে সেই স্বার্থযুদ্ধের দিকে ঠেলে না নিয়ে মমতাকে দেখিয়ে আবারো শেষ মুহূর্তে তিস্তা চুক্তি আটকে দেওয়ার ভারতীয় কৌশলের কাছে বাংলাদেশ পুরোপুরি পরাজয় স্বীকার করেছে। বাচ্চা না কাঁনলে স্বয়ং মমতাময়ী মা অনেক সময় দুধ দেয় না। সেখানে ভারতের মত পরাশক্তিকে দরকষাকষি করার মত সকল অস্ত্র যদি এভাবে বাংলাদেশ একে একে হাতছাড়া করে, তাহলে তা হবে অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশের জন্য চরম ক্ষতির কারণ। যা হয়তো ক্ষমতাসীন সরকার পুরোপুরি বোঝারও চেষ্টা করেনি।
আমাদের আরেকটি জিনিস পরিস্কারভাবে মনে রাখতে হবে যে, মোদি বাংলাদেশে আসছেন গোটা ভারতের সকল দলের যৌথ মতামত ও সিদ্ধান্তকে পকেটে পুরে। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার এখনও কোনো ইস্যুতেই দেশের অন্যান্য বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কোনো আলোচনাই করেনি। ভারতের সঙ্গে যে কোনো ইস্যুতে চুক্তি করার আগে সরকারের উচিত ছিল এসব বিষয় নিয়ে মোদির পথ অনুসরণ করেই সকল রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে নেওয়া। নইলে ভারতের সঙ্গে যে কোনো চুক্তিতে বাংলাদেশের চুল পরিমাণ পরাজয়ের দায়ও কিন্তু বর্তমান সরকারকেই বহন করতে হবে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার বিরোধীদলগুলোর সঙ্গে কোনো ধরনের আলোচনা ছাড়াই ভারতের সঙ্গে যে এক ডজন চুক্তি করতে যাচ্ছে, যার মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি চুক্তিতে ভারত চুক্তির আগেই হিসাব নিকাশে এগিয়ে আছে। অন্য চুক্তি গুলো ভারত যে পুরোপুরি অনুসরণ করবে তারও কোনো গ্র্যান্টি নাই। ফলে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি'র বাংলাদেশ সফরে ডজনখানেক চুক্তি হবার সম্ভাবনা থাকলেও বাংলাদেশের কূটনৈতিক পরাজয়ের সুস্পষ্ট আভাস এই বার্তা দিচ্ছে যে, সুদূর ভবিষ্যতে এসব চুক্তির ফলে বাংলাদেশের চেয়ে ভারতই বেশি সুফল ভোগ করবে। পররাষ্ট্রনীতিতে বাংলাদেশের এই দুর্বল অবস্থান ও নতজানু নীতি হয়তো সরকারি দলকে ক্ষমতায় থাকতে সহায়তা করবে, কিন্তু তা বাংলাদেশকে সত্যিকারের সাবলম্বি হিসেবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে পিছিয়েই রাখবে।
....................................
৩ জুন ২০১৫
ঢাকা
©somewhere in net ltd.
১| ০৩ রা জুন, ২০১৫ সকাল ৭:০৩
চাঁদগাজী বলেছেন:
ভালো