নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
ছোটগল্প লিখি। গান শুনি। মুভি দেখি। ঘুরে বেড়াই। আর সময় পেলে সিলেকটিভ বই পড়ি।
১৯৯৩ সালের জুন-জুলাই মাস। বাইরে প্রচণ্ড বৃষ্টি। তখন প্রায়ই আমি ধানমন্ডির জার্মান কালচারাল সেন্টারে (গ্যাটে ইনস্টিটিউট) সিনেমা দেখতে যেতাম। জহির রায়হান চলচ্চিত্র সাংসদ প্রায়ই সিনেমা দেখানোর আয়েজন করত। সাব্বির ভাই আমাকে সিনেমা দেখতে যাবার জন্য বলতেন। সেদিন বাইরে খুব বৃষ্টি। আমি জার্মান কালচারাল সেন্টারে আশ্রয় নিয়েছি। ছাদে আদনান ভাইয়ের সাথে দেখা। আদনান ভাই বললেন, একটা মজার ছবি চলতাছে। বললাম, নোটিশ বোর্ডে তো কিছুই দেখলাম না। আদনান ভাই জবাবে বললেন, সব জিনিস নোটিশ বোর্ডে থাকে না মিঞা। সেই সিনেমার নাম আমার মনে নাই। একটা জার্মান সিনেমা ছিল। আমি আদনান ভাই'র রুমে বসে কিছুটা দেখছিলাম। হলের ভেতর তেমন দর্শকও নাই। বৃষ্টির কারণে কোথাও যাওয়াও যাচ্ছে না। অগত্যা আমরা ছাদে গিয়ে চা-সিগারেট খেয়ে আবার সিনেমা দেখা শুরু করলাম। এবার হলের ভেতরে বসেছি। মাত্র চার পাঁচ জন দর্শক। আমার সারিতে একজন। তিনটা চেয়ার বাদ দিয়ে যিনি বসে ছিলেন তিনিই তারেক মাসুদ।
সিনেমা শেষে আবার ছাদে গিয়ে চা-সিগারেট। তখন তারেক ভাইয়ের সঙ্গে টুক টাক আলাপ হল। তখনো তারেক ভাইয়ের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে আমার ধারণা নাই। সেদিনের পর থেকে জার্মান কালচারাল সেন্টারে যতবার সিনেমা দেখতে গেছি, ততবার তারেক ভাইকে মনে মনে খুঁজেছি। কেমন যেন খুব অল্প কথায় তিনি আমার ভেতরে একটা গভীর আকর্ষনবোধ তৈরি করেছেন। এখনো জার্মান কালচারাল সেন্টারে সিনেমা দেখতে গেলে মনে মনে আমি তারেক ভাইকে খুঁজি।
তারপর 'মুক্তির গান' নিয়ে তারেক ভাই যখন আসলেন, তখনো রাশিয়ান কালচারাল সেন্টারের বাইরের রাস্তায় লম্বা লাইনে আমি নিজেকে খুঁজে পেলাম। তরুণদের ভেতরে একটা অসম্ভব আকর্ষনবোধ তৈরি করার ক্ষমতা তারেক ভাই অর্জন করেছিলেন। এরপর যখনই তারেক ভাইয়ের নতুন কোনো সিনেমা আসতো, দর্শক সারিতে আমি নিজেকে খুঁজে পেতাম।
২০০৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে শুটিং করার জন্য জার্মান কালচারাল সেন্টারের ছাদ আমরা সারা দিনের জন্য ভাড়া নিলাম। বন্ধু টোকন ঠাকুরের প্রথম চলচ্চিত্র 'ব্ল্যাকআউট'-এর শুটিং। একটা সিকোয়েন্স করার জন্য আমরা ওই ছাদ ভাড়া করেছি। জার্মান কালচারাল সেন্টারের ছাদে আমি প্রেমিকা নিয়ে অনেক ঘুরেছি। ওই ছাদে আমার অনেক স্মৃতি। একই ধরনের স্মৃতি টোকন ঠাকুরেরও। কিন্তু তখন আমরা কেউ কাউরে চিনতাম না।
'ব্ল্যাকআউট'-এর একটা সিকোয়েন্স এরকম-
আর্টিস্ট রাফি আর তার প্রেমিকা মিটি ওই ছাদে একটা জরুরী মিটিং করছে। রাফি জানে না যে এটা এত জরুরী মিটিং। কিন্তু মিটি জানে। মিটি মূলত রাফিকে আজ বলতে এসেছে যে, একটা মডেলিংয়ের শুটিংয়ের জন্য সে নির্বাচিত হয়েছে। শীঘ্রই সে তার স্বপ্নের তাহিতি দ্বীপে যাচ্ছে। রাফি কিছুতেই রাজি না। কারণ তাহিতি দ্বীপে মিটি গেলে রাফির খুব কষ্ট হবে। মন থেকে সে পুরো বিষয়টা মানতে পারছে না। এই নিয়ে দু'জনার ঝগড়া।
সেই ঝগড়ার এক পর্যায়ে রাফির বন্ধু রাহুল সেখানে হাজির। রাহুল ওদের ঝগড়ার বিষয়ে একদম জানতো না। রাহুল এর আগে ধানমন্ডি লেকে রাফির সঙ্গে মিটিকে একবার দেখেছিল। রাফিকে অনেক খোটাও মেরেছিল। তো জবাবে রাহুল বলল যে, আজ সে সেদিনের ঘটনার জন্য ক্ষমা চাইতে এসেছে। কিন্তু রাফি মিটির উপরে জমতে শুরু করা রাগ-ক্ষোভ মিলিয়ে বন্ধু রাহুলের উপর সেই রাগ প্রচণ্ড আক্রোশ ছুড়ে দেয়। সেদিনের আকাশটা ছিল ভারী সুন্দর। কিন্তু রাফি আর মিটির ঝগড়াটা ছিল ভারী কষ্ট পাবার মত।
তো সিনেমা, জার্মান কালচারাল সেন্টার, তারেক ভাই এই তিনটা বিষয় কেমন করে যেন আমার মধ্যে একসঙ্গে এখনো আটকে আছে। তারেক ভাইয়ের সঙ্গে আমার সর্বশেষ আলাপ হয়েছিল সম্ভবত ২০১১ সালের জুলাই মাসে। আমাদের নাটকের দল পালাকার রবীন্দ্রনাথের ষার্ধশত জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে নতুন নাটক 'বাংলার মাটি বাংলার জল' মঞ্চে এনেছে। রবীন্দ্রনাথের চিঠি ছিন্নপত্র অবলম্বনে সৈয়দ শামসুল হক রচনা করেছেন 'বাংলার মাটি বাংলার জল'। নাটকটি নির্দেশনা দিয়েছেন আতাউর রহমান। নাটকটির মিডিয়া ও প্রচার সেলের দায়িত্ব তখন আমার উপর। শিল্পকলা একাডেমিতে যেদিন নাটকের শো থাকে সেদিন বিশেষ বিশেষ কিছু ব্যক্তিকে আমরা আমন্ত্রণ করি। তো সামনের শুক্রবারের শো তে তারেক ভাই আসতে পারবে কিনা সেটা জানার জন্য তারেক ভাইকে ফোন করলাম। তারেক ভাই জবাবে বললেন, ভীষণ ব্যস্ত এখন। 'কাগজের ফুল'-এর কাজ শুরু করেছি। এখনো লেকেশান দেখা শেষ হয়নি। তুমি শো-এর দিন আরেকটা ফোন দিও। আমি ঢাকায় থাকলে যাতে আসতে পারি। আর তুমি গল্প দাও না কেন? আমাকে না তোমার একটা ভালো গল্প দেওয়ার কথা!
তারপর তারেক ভাই ফোন ছেড়ে দেন। পরের শুক্রবার শো-এর দিন দুপুরে যথারীতি আমি তারেক ভাইকে মনে করিয়ে দেবার জন্য ফোন করি। কিন্তু তারেক ভাই ঢাকায় নেই। তারেক ভাইয়ের আর 'বাংলার মাটি বাংলার জল' দেখা হয় না। আমার সাথেও আর দেখা হয় না। তারপর সেই ২০১১ সালের আগস্ট মাসের ১৩ তারিখ সবকিছু শেষ।
দেখতে দেখতে মাঝখান থেকে চারটা বছর নেই। তারেক মাসুদ-মিশুক মুনির জুটির কথা শতবছরেও আমাদের ভুলে যাবার সুযোগ নাই। এক্কেবারে নাই। অন্তত সিনেমা পাগল আমার মত তরুণের তো নেই-ই। আজ তারেক মাসুদ-মিশুক মুনির জুটির চতুর্থ মৃত্যু বার্ষিকী। মানিকগঞ্জে এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় ২০১১ সালের ১৩ আগস্ট আরো তিনজন চলচ্চিত্র কর্মী সহ বাংলাদেশের এই দুই সূর্যসন্তান সেদিন চিরতরে না ফেরার দেশে চলে যান। যতবার আগস্ট আসে, ঝাঁক বেধে বাংলার শোকগাঁথা নিয়ে আসে।
আগস্ট মাসে বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হন। আগস্ট মাসে ডক্টর হুমায়ুন আজাদকে হত্যা করা হয়। আগস্ট মাসে শামসুর রাহমানের মৃত্যু। আগস্ট মাসে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মৃত্যু। আগস্ট মাসে কাজী নজরুল ইসলামের মৃত্যু। পুরো আগস্ট মাসজুড়ে বাংলার শ্রেষ্ঠ সন্তানদের এক শোকগাঁথা রচিত যেন! আগস্ট আসলেই তাই মনের কোনে রক্তজমা এক শীতল কষ্ট হু হু করে ওঠে। বাংলার ঘরে ঘরে সেই কষ্টের দাগ কখনো শুকাবার নয়। তারেক ভাই যেখানে থাকো ভালো থেকো। মিশুক ভাই যেখানে থাকো ভালো থেকো।
...................................
১৩ আগস্ট ২০১৫
ঢাকা
©somewhere in net ltd.