নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
ছোটগল্প লিখি। গান শুনি। মুভি দেখি। ঘুরে বেড়াই। আর সময় পেলে সিলেকটিভ বই পড়ি।
নেপালের ক্ষমতাসীন দল সিপিএন-ইউএমএল (কমিউনিস্ট পার্টি অব নেপাল- ইউনাইটেড মার্কসিস্ট লেনিনিস্ট)-এর ভাইস চেয়ারপার্সন বিদ্যা দেবী ভান্ডারিকে নতুন প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত করেছে নেপালের পার্লামেন্ট। বিদ্যা দেবী ভান্ডারি (৫৪) হলেন নেপালের ইতিহাসে প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট। ২৮ অক্টোবর ২০১৫, বুধবার নেপালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিপক্ষ নেপালি কংগ্রেস দলের কুল বাহাদুর গুরুংকে পরাজিত করে জয়লাভ করেন বিদ্যা দেবী ভান্ডারি।
নেপালের কনস্টিটিউট অ্যাসেম্বলির (পার্লামেন্ট) মোট সদস্য সংখ্যা ৬০১ জন। কিন্তু ভোটপর্বে অংশ নেবার কথা ৫৯৭ জন সদস্যের। গতকালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ভোটাভুটিতে মোট ৫৪৯ জন সংসদ সদস্য অংশগ্রহণ করেন। যার মধ্যে ক্ষমতাসীন সিপিএন-ইউএমএল-এর বিদ্যা দেবী ভান্ডারি পান ৩২৭ ভোট। আর তাঁর প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী নেপালি কংগ্রেস দলের কুল বাহাদুর গুরুং পান ২১৪ ভোট। ৮ জন সাংসদের ভোট বাতিল করা হয়। একজনের ভোট সাসপেন্ড করা হয়। এছাড়া ৪৭ জন সদস্য পার্লামেন্টে অনুপস্থিত ছিলেন। প্রেসিডেন্ট হবার জন্য বিদ্যা দেবী ভাণ্ডারির প্রয়োজন ছিল ২৯৯টি ভোট। কিন্তু তিনি প্রয়োজনের চেয়ে ২৮ ভোট বেশি পান। উল্লেখ্য ৬০১ সদস্যের নেপালি কনস্টিটিউট অ্যাসেম্বলির ৪টি ভোট (প্রেসিডেন্ট, ভাইস-প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী ও স্পিকার) প্রয়োজন না পরলে ভোটদানে অংশগ্রহণ করার কথা নয়।
নেপালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফল ঘোষণা করেন পার্লামেন্টের প্রথম নির্বাচিত নারী স্পিকার ওনসারি ঘারতি মাগার। ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট পার্টি অব নেপাল (ইউনিফাইড মার্কসিস্ট লেনিনিস্ট)-এর ভাইস চেয়ারপার্সন বিদ্যা দেবী ভান্ডারি এর আগে ২০০৯ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত নেপালের প্রতিরক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। তিনি নেপালের প্রয়াত বিশিষ্ট কমিউনিস্ট নেতা মদন ভান্ডারির বিধবা স্ত্রী।
এর আগে ২০০৭ সালে নেপালে রাজতন্ত্রের অবসানের পর নেপালের বর্তমান প্রেসিডেন্ট নেপালি কংগ্রেস দলের রামবরণ যাদব প্রথম গণপরিষদ নির্বাচনের পর ২০০৮ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন। গত ২০ সেপ্টেম্বরে নেপালে নতুন সংবিধান ঘোষণার পর দেশটিতে আবার নতুন করে প্রেসিডেন্ট, ভাইস প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী, পার্লামেন্ট স্পিকার এবং ডেপুটি স্পিকার নির্বাচন করতে হচ্ছে। যার ধারাবাহিকতায় গতকাল অনুষ্ঠিত হলো নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। ১১ অক্টোবরে নেপালের নতুন প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছেন ক্ষমতাসীন সিপিএন-ইউএমএল দলের কে পি শর্মা অলি (খাদগা প্রসাদ শর্মা অলি)।
১৯৬১ সালের ১৯ জুন নেপালের ভোজপুর জেলার মনেভঞ্জং-এর গুরানসে গ্রামে বিদ্যা দেবী ভান্ডারি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবার নাম রাম বাহাদুর পাণ্ডে ও মায়ের নাম মিথিলা পাণ্ডে। ছাত্রজীবনেই বিদ্যা দেবী ভান্ডারি'র রাজনীতিতে হাতেখড়ি। নেপালের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসিস্ট লেনিনিস্ট)-এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য মদন ভান্ডারি'র সঙ্গে ১৯৮২ সালে তাঁর বিয়ে হয়। ১৯৯১ সালের সাধারণ নির্বাচনে নেপালের কমিউনিস্ট পার্টি (ইউনাইটেড মার্কসিস্ট লেনিনিস্ট)-এর নেতৃত্ব দেন নেপালের সবচেয়ে তরুণ উদীয়মান কমিউনিস্ট নেতা মদন ভাণ্ডারি। ওই নির্বাচনে ২১০ সদস্যের নেপালি পার্লামেন্টে নেপালি কংগ্রেস দল কৃষ্ণ প্রসাদ ভট্টরাই-এর নেতৃত্বে ১১০টি আসন পেয়ে বিজয়ী হয়েছিল। প্রধান বিরোধী দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিল নেপালের কমিউনিস্ট পার্টি। মদন ভাণ্ডারি'র নেতৃত্বে তাঁর দল তখন পেয়েছিল ৬৯টি আসন। কিন্তু ১৯৯৩ সালের ১৬ মে নেপালের দাসদুঙ্গা চেতওয়ানে এক রহস্যময় গাড়ি দুর্ঘটনায় মাত্র ৪০ বয়সে মদন ভাণ্ডারি মৃত্যুবরণ করেন। মদন ভাণ্ডারির মৃত্যু রহস্য আজ পর্যন্ত উন্মোচিত হয়নি।
মদন ভাণ্ডারি'র গাড়ি দুর্ঘটনায় মৃত্যুকে নেপালবাসী আজও মেনে নিতে পারেননি। নেপালিরা মনে করেন ওটা ছিল একটা পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। দাসদুঙ্গা চেতওয়ানে সেদিন গাড়িতে ছিলেন তিনজন। মদন ভাণ্ডারি ও দলের আরেক সিনিয়র নেতা জীভ রাজ অশ্রিত। আর গাড়ির ড্রাইভার ছিলেন অমর লামা। দুর্ঘটনার তিন দিন পর মদন ভাণ্ডারি ও জীভ রাজ অশ্রিতের লাশ উদ্ধার করা হয়েছিল। আর ওই দুর্ঘটনায় একমাত্র জীবিত ব্যক্তি অমর লামাকে ঠিক ১০ বছর পর ২০০৩ সালে কীর্তিপুরে প্রকাশ্য দিবালোকে অজ্ঞাত বন্দুকধারীরা গুলি করে হত্যা করেছিল। মদন ভাণ্ডারি ছিলেন আধুনিক নেপালের সবচেয়ে প্রতিশ্রুতিশীল কমিউনিস্ট নেতা।
স্বামী মদন ভাণ্ডারি'র মৃত্যুর পর স্ত্রী বিদ্যা দেবী ভান্ডারি কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে আসেন। স্বামী মদন কুমার ভাণ্ডারির মৃত্যুতে পার্লামেন্টের শূন্য আসনে ১৯৯৪ সালের উপ-নির্বাচনে তিনি নেপালের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী কৃষ্ণ প্রসাদ ভট্টরাইকে পরাজিত করে প্রথম নেপালের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন এবং এক বছর সংসদ সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এরপর তিনি ১৯৯৪ সালের নির্বাচনে পুনরায় কৃষ্ণ প্রসাদ ভট্টরাইকে পরাজিত করে নির্বাচিত হন। এবং ১৯৯৯ সালের পার্লামেন্ট নির্বাচনে তিনি নেপালি কংগ্রেসের প্রভাবশালী নেতা ডামানাথ দুঙ্গানাকে পরাজিত করে পুনরায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। যদিও ২০০৮ সালের নির্বাচনে তিনি পরাজিত হয়েছিলেন। কিন্তু মাধব কুমার নেপাল-এর কেবিনেটে ২৫ মে ২০০৯ থেকে ২০১১ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তিনি নেপালের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী'র দায়িত্ব পালন করেন। এর আগে নব্বইয়ের শেষ দশকে কিছুদিনের জন্য তিনি পরিবেশ ও জনসংখ্যা মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৮ সালে নেপালের কনস্টিটুয়েন্ট অ্যসেম্বলি নির্বাচনে কাঠমান্ডু-৪ নির্বাচনী এলাকা থেকে বিদ্যা দেবী ভাণ্ডারি নেপালি কংগ্রেস দলের প্রার্থী সুপ্রভা ঘিমিরী'র কাছে পরাজিত হন। কিন্তু ২০১৩ সালে কনস্টিটিউট রাইটিং-এর জন্য অনুষ্ঠিত কনস্টিটুয়েন্ট অ্যসেম্বলি নির্বাচনে তিনি প্রোপারশনাল রিপ্রেজেনটেটিভ [Proportional Representation (PR)] কোঠায় পুনরায় সাংসদ হিসেবে পার্লামেন্ট সদস্য হন। বিদ্যা দেবী ভাণ্ডারি নেপালি উইমেন অ্যাসোসিয়েশনের গত দুই দশক ধরে নেতৃত্ব দিচ্ছেন।
১৯৭৮ সালে নেপালি কমিউনিস্ট পার্টির ইয়ুথ লিগের একজন তরুণ কর্মী হিসেবে ভোজপুরে বিদ্যা দেবী ভান্ডারি রাজনীতি শুরু করেন। ১৯৭৯ থেকে ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত তিনি নেপালের পূর্বাঞ্চলের তরুণ কমিউনিস্টদের নেতৃত্ব দেন। ১৯৮০ সালে তিনি কমিউনিস্ট পার্টির পূর্নাঙ্গ সদস্য পদ লাভ করেন। স্কুলের পড়াশুনা শেষ হলে বিদ্যা দেবী মহেন্দ্র মোঢ়াং আদর্শ কলেজে ভর্তি হন। সেখানে তিনি ফেডারেশন অব স্টুডেন্ট ইউনিয়নের কোষাধাক্ষ্য নির্বাচিত হন। নেপালের কমিউনিস্ট পার্টির মহিলা উইয়িংয়ের প্রধান হিসাবে তিনি ১৯৯৩ থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত দলে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে অষ্টম সাধারণ কনভেনশনে বিদ্যা দেবী ভাণ্ডারি দলের ভাইস চেয়ারপার্সন নির্বাচিত হন। ২০১৪ সালের জুলাই মাসে নবম সাধারণ কনভেনশনে তিনি পুনরায় দলের ভাইস চেয়ারপার্সন নির্বাচিত হন। ১৯৯৮ সালের ষষ্ঠ সাধারণ কনভেনশন থেকে তিনি নেপাল কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য। বর্তমানে নেপালের কমিউনিস্ট পার্টির চেয়ারম্যান হলেন দেশের ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রী কে পি শর্মা অলি (খাদগা প্রসাদ শর্মা অলি)।
বিদ্যা দেবী ও মদন ভাণ্ডারি'র দুই সন্তান। ক্ষমতাসীন দল নেপালের কমিউনিস্ট পার্টির (ইউএমএল) উপপ্রধান বিদ্যা দেবী ভান্ডারি বিদায়ী প্রেসিডেন্ট রামবরণ যাদবের স্থলাভিষিক্ত হবেন। এর আগে গত ১৬ অক্টোবর ওনসারি ঘারতি মাগার নেপালের প্রথম নারী স্পিকার নির্বাচিত হন। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় তিনি স্পিকার নির্বাচিত হয়েছেন। দীর্ঘদিন ধরে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতায় আক্রান্ত নেপালে দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর গত মাসে ঐতিহাসিক নতুন সংবিধান গৃহীত হয়। যদিও হিমালয় কন্যা নেপালের প্রেসিডেন্ট রাষ্ট্রের আলংকারিক প্রধান মাত্র। আর নেপালের রাজনীতিতে নারীর উপস্থিতি খুবই বিরল। বিদ্যা দেবী ভাণ্ডারি হলেন নেপালের প্রথম নির্বাচিত নারী প্রেসিডেন্ট এবং রামবরণ যাদবের পর দ্বিতীয় নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট। জয়তু বিদ্যা দেবী ভাণ্ডারি। জয়তু হিমালয় কন্যা নেপাল।
................................
২৯ অক্টোবর ২০১৫
ঢাকা
©somewhere in net ltd.