নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
ছোটগল্প লিখি। গান শুনি। মুভি দেখি। ঘুরে বেড়াই। আর সময় পেলে সিলেকটিভ বই পড়ি।
আগামীকাল ১৬ ডিসেম্বর ২০১৫ তারিখে বাংলাদেশ ৪৪তম বিজয় দিবস ঊদযাপন করবে। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পৃথিবীর মানচিত্রে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রের আবির্ভাব ঘটেছিল। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিকাল ৪টা ৩১ মিনিটে ঢাকার ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ইস্টার্ন কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজী আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশ-ভারত মিত্রবাহিনীর ইস্টার্ন কমান্ডের কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা'র কাছে পাকিস্তানের আত্মসমর্পণের দলিলে সাক্ষর করেন। জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী, বাংলাদেশ ভূখণ্ডে পাকিস্তানের ৯৩ হাজার পাকিস্তানী সেনা-নৌ-বিমানবাহিনীর সদস্যসহ সকল প্যারামিলিটারি ও আর্মস সদস্যসহ তাদের স্থানীয় কোলাবরেটরস রাজাকার-আলবদর-আলশামসের আত্মসমর্পণের ওই মুহূর্তটি বাংলাদেশের তখনকার সাড়ে সাত কোটি বাঙালির জন্যে ছিল একটি ঐতিহাসিক দিন। এখনো সারাবিশ্বের নানান প্রান্তে বসবাসরত ষোল কোটি বাংলাদেশীদের জন্য ১৬ ডিসেম্বর আমাদের বিজয়ের দিন, গৌরবের দিন, পৃথিবীর বুকে মাথা উচু করে দাঁড়াবার দিন। নতুন স্বপ্ন গড়ার লক্ষ্যে নতুন করে দীপ্ত শপথ নেবার দিন।
১৯৭২ সালের ২ জুলাই ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী ও পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টো সিমলা চুক্তি সাক্ষর করেন। সিমলা চুক্তি অনুযায়ী, ভারত থেকে পাকিস্তান ৬,৫০০ যুদ্ধবন্দি ফিরিয়ে নিতে রাজী হয়। বাংলাদেশ তখন সিমলা চুক্তিকে স্বাগত জানায়। সিমলা চুক্তি হয়েছিল ২৫ বছরের জন্য। সিমলা চুক্তিকে কার্যকর করতে ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ ১৯৭৩ সালের ২৮ আগস্ট আরেকটি ত্রিদেশীয় দিল্লী চুক্তি সাক্ষর করেছিল। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্মরণ সিং, পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আজিজ আহমেদ ও বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. কামাল হোসেন ত্রিদেশীয় দিল্লী চুক্তিতে সাক্ষর করেন। দিল্লী চুক্তি অনুযায়ী, জাতিসংঘ উদ্বাস্তু বিষয়ক হাইকমিশনের তত্ত্বাবধানে পাকিস্তান থেকে ১ লাখ ২১ হাজার ৬৯৫ জন বাঙালি অফিসার ও সেনা সদস্য বাংলাদেশে ফেরত আসে। বাংলাদেশ থেকে ১ লাখ ৮ হাজার ৭৪৪ জন নন-বাঙালি পাকিস্তানী অফিসার ও সেনা সদস্য পাকিস্তানে ফেরত যায়। ভারতে থেকে ৬,৫০০ যুদ্ধবন্দি পাকিস্তানে ফেরত যায়। বাংলাদেশ ও ভারতে যে সকল পাকিস্তানী সেনা যুদ্ধবন্দি হিসেবে জেলে ছিল, তারাও পাকিস্তানে ফেরত যায়। চুক্তি অনুযায়ী, দেশে ফিরিয়ে নিয়ে এসব যুদ্ধবন্দিসহ ১৯৫ জন মানবতাবিরোধী যুদ্ধপরাধীদের আন্তর্জাতিক আদালতে বিচার করার কথা ছিল পাকিস্তানের। যা তারা বিগত ৪৪ বছরেও করেনি। কার্যত পাকিস্তান বাংলাদেশের সঙ্গে একাত্তরের যুদ্ধে পরাজিত হবার পর কোনো চুক্তি বা প্রতিশ্রুতি ঠিকমত পালন করেনি। বরং বিগত ৪৪ বছর তারা বাংলাদেশকে আবারো পাকিস্তানের দিকে ফিরিয়ে নিতে নানান কাসুন্দি করতে তৎপর।
পাকিস্তান দ্বিপক্ষীয় সিমলা চুক্তি ও ত্রিদেশীয় দিল্লী চুক্তি সুস্পষ্টভাবেই লঙ্ঘন করেছিল। যে কারণে পরবর্তী সময়ে পাকিস্তান থেকে সাড়ে তিন লাখ থেকে সাড়ে চার লাখ বাঙালিকে বাংলাদেশ ফেরত আনলেও পাকিস্তান বাংলাদেশে বসবাসরত সাড়ে চার লাখ নন-বাঙালি বিহারী পাকিস্তানীদের ফিরিয়ে নেয়নি। এখনো বাংলাদেশের জেনেভা ক্যাম্পগুলোর অস্তিত্বই প্রমাণ করে যে পাকিস্তান চুক্তি ও প্রতিশ্রুতি লঙ্ঘন করেছে। এমনকি পাকিস্তানের কাছে বাংলাদেশের পাওনা কয়েক হাজার কোটি টাকাও তারা ফেরত দেয়নি। বরং বাংলাদেশ ১৯৭২ সালে কমনওয়েলথের সদস্যপদ লাভ করলে, পাকিস্তান প্রতিবাদস্বরূপ কমনওয়েলথ ত্যাগ করেছিল। পরবর্তী সময়ে পাকিস্তান, চীন ও সৌদি আরবের নেতৃত্বে মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলো যাতে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি না দেয়, সেজন্য তারা সম্মিলিতভাবে জোর কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালিয়েছিল। বাংলাদেশ যখন জাতিসংঘের সদস্যপদের জন্য আবেদন করে তখন পাকিস্তানের মিত্র চীন জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ভেটো প্রদান করেছিল। পরবর্তী সময়ে ১৯৭৪ সালের ২২ থেকে ২৪ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের লাহোরে অনুষ্ঠিত হয় মুসলিম দেশগুলোর ওআইসি'র দ্বিতীয় শীর্ষ সম্মেলন। পাকিস্তান বাংলাদেশকে ওআইসি শীর্ষ সম্মেলনে যোগদানের জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে আহবান জানায়। ওআইসি'র সাত সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় আসে শেখ মুজিবকে আনুষ্ঠানিকভাবে নিমন্ত্রণ জানাতে। গাম্বিয়ার প্রেসিডেন্ট টাংকু আবদুর রহমান একটি বিশেষ বিমান পাঠান মুজিবকে পাকিস্তানে নেওয়ার জন্য। পাকিস্তানের সঙ্গে বন্ধুত্বের নিদর্শন হিসেবে শেষ পর্যন্ত মুজিব বাংলাদেশের জেলে বন্দি একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন এবং পরদিন বিকালে সেই বিশেষ বিমানে সাত সদস্যের বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলসহ লাহোর গমন করেন। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী বিমানবন্দরে মুজিবকে স্বাগত জানান এবং ২২ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৪ সালে ওআইসি শীর্ষ সম্মেলনে শুরুর কয়েক মিনিট আগেই আনুষ্ঠানিকভাবে পাকিস্তান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানের আত্মসমর্পণের পর ২২ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৪ সালে আবার পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের আনুষ্ঠানিক পথচলা শুরু। পরবর্তী সময়ে একই বছর জুলাই মাসে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো বাংলাদেশ সফর করেন এবং সাভারের জাতীয় স্মৃতি সৌধে মুক্তিযুদ্ধে নিহতদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করেন। ভুট্টো তখন বাংলাদেশে বসবাসরত সাড়ে চার লাখ বিহারী পাকিস্তানীদের ফিরিয়ে নেবার প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু ঢাকা সফর শেষ করে পাকিস্তানে ফিরেই আবার বাংলাদেশ থেকে বিহারীদের ফিরিয়ে নেবার কথা অস্বীকার করেন ভুট্টো। এমনকি একাত্তরের ১৯৫ জন মানবতাবিরোধী যুদ্ধপরাধীদের বিচার নিয়েও তালবাহানা শুরু করেন। যে সমস্যা বিগত ৪৪ বছরেও সমাধান হয়নি।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর থেকে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট মুজিবকে সপরিবারে হত্যা করা পর্যন্ত ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখা যায় যে, ভুট্টো মুজিবের সঙ্গে নানান সময়ে নানাভাবে বন্ধুত্ব রক্ষার প্রতিশ্রুতি দিয়েও বারবার তা ভঙ্গ করেছেন। ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ থেকে বাংলাদেশের কার্যত আবার পাকিস্তানমুখী যাত্রা শুরু হয় খোন্দকার মোশতাক ও জেনারেল জিয়ার নেতৃত্বে। পাকিস্তানের প্রধানমিত্র জামায়াতে ইসলামীর আমীর গোলাম আযমকে জেনারেল জিয়া আবার বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনেন। আর জেনারেল জিয়ার বিধবা স্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া গোলাম আযমকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদান করেন। পাশাপাশি কুখ্যাত যুদ্ধপরাধী জামায়াতে ইসলামীর আমীর মতিউর রহমান নিজামী ও জামায়তের সেক্রটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদকে নিজের মন্ত্রীসভায় ঠাই দেন বেগম জিয়া। সুস্পষ্টভাবেই জেনারেল জিয়ার বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বা বিএনপি পাকিস্তানপন্থী একটি রাজনৈতিক দল। বাংলাদেশে পাকিস্তানের এজেন্ডা পালন করাই এই দলটির প্রধান লক্ষ্য।
দীর্ঘ ২১ বছর ক্ষমতার বাইরে থেকে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গিয়ে জেনারেল জিয়ার প্রবর্তিত বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার বিচার রোহিতকরণ ব্লাসফেমি আইন বাতিল করে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার বিচার শুরু করে। পরবর্তী সময়ে ২০০৮ সালের নির্বাচনী মেনুফেস্টিতে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গেলে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের পুনরায় বিচার শুরু করার প্রতিশ্রুতি দেয়। ২০০৮ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় এসে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার বিচার শেষ করে (এখনো বঙ্গবন্ধু হত্যার আসামী বিভিন্ন দেশে পালিয়ে থাকলেও তাদের দেশে ফিরিয়ে এনে আইন কার্যকর করার ক্ষেত্রে সরকারের দীর্ঘসূত্রিতা সুস্পষ্টভাবেই প্রতীয়মান) এবং একাত্তরের মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু করে আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে। কিন্তু এবার বিএনপি শুরু থেকেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচারপ্রক্রিয়াকে বাধা প্রদান করতে নানান কিসিমের তালবাহানা শুরু করে। তাদের দৈনিক পত্রিকা আমার দেশ থেকে নানান গুজব ছড়ানোর চেষ্টা করে। একাত্তরের মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধের ফাঁসির দাবিতে গড়ে ওঠা শাহবাগ গণজাগরণ মঞ্চকে বিএনপি গণহারে নাস্তিক আখ্যা দেয়। অথচ শাহবাগ গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনে সারা দেশের ষোল কোটি মানুষের স্বতস্ফূর্ত সমর্থন ছিল। বিএনপি তখন তাদের জোটের জামায়াত নেতাদের বাঁচাতে ইসলামকে ব্যবহার করে শফি হুজুরের নেতৃত্বে হেফাজতে ইসলামের নামে মতিঝিলের শাপলা চত্বরে ৫ মে ২০১৩ সালে পাল্টা ইসলামী সমাবেশ করে। ৫ মে হেফঅজতে ইসলাম গোটা ঢাকায় নিশংস জ্বালাও পোড়াও লুটপাট চালায়। খালেদা জিয়া তখন ঢাকাবাসীকে হেফাজতের পাশে দাঁড়াতে আহবান জানান। শেষ পর্যন্ত পুলিশি অভিযানে হেফাজতের সমাবেশ পণ্ড হয়। পাশাপাশি গণজাগরণ মঞ্চকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করার চেষ্টা করে। সেই চেষ্টা যখন ব্যর্থ হয়, তখন তারা গণজাগরণ মঞ্চকে দু'ভাগ করে দেয়। যে কারণে বর্তমানে গণ জাগরণ মঞ্চ সক্রিয় থাকলেও সেখানে দেশের ষোল কোটি মানুষের সেই স্বতস্ফূর্ততা আর চোখে পড়ে না।
১২ ডিসেম্বর ২০১৪ তারিখে রাত ১০টা ১ মিনিটে কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর হবার পর পাকিস্তান তাদের পার্লামেন্টে যুদ্ধপরাধীর ফাঁসি দেওয়ার জোরালো প্রতিবাদ করে। ২০১৫ সালের ১১ এপ্রিল আরেক মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধী মুহম্মদ কামরুজ্জামানের ফাঁসি কার্যকর করলেও পাকিস্তান আবারো তাদের পার্লামেন্টে তার জোরালো প্রতিবাদ করে। সর্বশেষ চলতি বছর ২২ নভেম্বর অপর দুই যুদ্ধাপরাধী বিএনপি নেতা ও খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক উপদেষ্টা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী এবং জামায়াত নেতা ও বিএনপি সরকারের মন্ত্রী আলী আহসান মুহম্মদ মুজাহিদের ফাঁসি কার্যকর করার পরেও পাকিস্তান একইভারে জোরালো প্রতিবাদ করে প্রমাণ করেছে, বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামী ও বিএনপি'র রাজনীতির সঙ্গে পাকিস্তানের স্বার্থের সঙ্গে সুস্পষ্ট সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। পাকিস্তান কার্যত বিগত ৪৪ বছরেও একাত্তরের সেই পরাজয়ের গ্লানি ভুলতে পারেনি বরং নানাভাবে বাংলাদেশকে অকার্যকর রাষ্ট্র পরিণত করার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। যে কারণে এখন সবচেয়ে বড় যে প্রশ্নটি সামনে আসছে, তাহল বাংলাদেশের কী আদৌ পাকিস্তানের সঙ্গে কোনো ধরনের কূটনৈতিক সম্পর্ক রক্ষা করাটা জরুরি? যদি না হয়, তাহলে কখন কীভাবে পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশ সকল ধরনের সম্পর্ক ছিন্ন করবে? যদি পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশ সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন না করে, তাহলে আর কত মাসুল দেবে বাংলাদেশ? সেটিই এখন নতুন করে চিন্তার বিষয়। স্বাধীনতার ৪৪ বছর গেলেও এখনো পাকিস্তানী জুজু বাংলাদেশের পিছু ছাড়েনি। এমনকি বাংলাদেশের কোনো শাসক সেই জুজুকে বিচ্ছিন্ন করার কোনো উদ্যোগ নেয়নি। যা কার্যত বাংলাদেশকে ধীরে ধীরে একটি অকার্যকর রাষ্ট্রের দিকেই নিয়ে যাচ্ছে। বর্তমান সময়ে নতুন করে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসের ছদ্মবেসে সেই চিন্থ এখন বাঙলাদেশেও সুস্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে। ইরাক, আফগানিস্তান, লিবিয়া, সিরিয়া, পাকিস্তান যেভাবে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসের বিস্তারের ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে, ভবিষ্যতে বাংলাদেশকেও সেদিকে নেবার একটি আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টা এই মুহূর্তে সক্রিয়। যা বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ বুঝলেও আমাদের শাসকশ্রেণীরা এটাকে নিজেদের ক্ষমতায় থাকার খুটি হিসেবে পাল্টা যুক্তি দিচ্ছে। তাহলে কী স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তীর আগেই বাংলাদেশ কার্যত একটি ব্যর্থ রাষ্ট্র হতে যাচ্ছে? এই আশংকাটাই এই নিবন্ধের শিরোনাম হওয়া উচিত। কিন্তু স্বাধীনতার ৪৪ বছর পূর্তির এই নিবন্ধে সেই বিশ্লেষরনের সুযোগ নেই।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের পর তখনকার আওয়ামী লীগ সরকার দৃশ্যত যে ভুলগুলো করেছিল, তার মধ্যে প্রধান ভুল ছিল একাত্তরের মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের ক্ষমা করে দেওয়া। পাকিস্তানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করা। বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতি নিষিদ্ধ না করা। স্বাধীনতা বিরোধীদের এদেশে মৌলবাদী ব্যবসায়িক কার্যক্রম চালাতে দেওয়া ইত্যাদি। সেই সুযোগে এসব স্বাধীনতা বিরোধী শত্রুরা পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই-এর সরাসরি সহায়তায় মুজিবকে সপরিবারে হত্যা করে বাংলাদেশে পাকিস্তানপন্থীদের ক্ষমতায় যাবার সিঁড়ি তৈরি করেছিল। সেই স্বাধীনতা বিরোধী শক্তিই এখনো স্বাধীনতার ৪৪ বছর পরেও বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্চ। পরবর্তী সময়ে সামরিক স্বৈরাচার এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের সময় স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়া আওয়ামী লীগ, জামায়াতের সঙ্গে পুনরায় আতাত ও আপোষ করে দ্বিতীয়বার ভুল করেছিল। পরবর্তী সময়ে ১৯৯৬ সালে খালেদা জিয়ার সরকারের পতন আন্দোলনের সময় তৃতীয়বার জামায়াতের সঙ্গে আতাত করে আওয়ামী লীগ পুনরায় ভুল করেছিল। এখনো আওয়ামী লীগের ভেতরে-বাইরে প্রচুর মুখোশধারী জামায়াতে ইসলামীর সদস্য রয়েছে। যাদের প্রভাবে আওয়ামী লীগ বাংলাদেশ থেকে জামায়াতে ইসলামী'র রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে এখনো গড়িমসি করছে। ২০১১ সালে আওয়ামী লীগ সরকার বিশ্বকাপ ক্রিকেটে জামায়াতপন্থী ইসলামী ব্যাংককে বিশ্বকাপ ক্রিকেটের স্পনসর করেছিল। অর্থনীতিবিদ প্রফেসর আবুল বারকাতের এক গবেষণা রিপোর্ট থেকে জানা যায়, ইসলামী ব্যাংকের মতো মৌলবাদী আদর্শে পরিচালিত বাংলাদেশে বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের এখন বার্ষিক মুনাফার পরিমাণ ২ হাজার ৪৬৪ কোটি টাকা। আর ১৯৭৫ থেকে ২০১৪—এই ৪০ বছরে মৌলবাদের অর্থনীতির মোট পুঞ্জীভূত মুনাফার পরিমাণ ২ লাখ কোটি টাকা।
অথচ বাংলাদেশে একাত্তরের বীরশ্রেষ্ঠদের পরিবারের সদস্যরা, মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারগুলো এখনো যেখানে অভুক্ত থাকে, সরকারের সারা বছরেও সময় হয় না তাদের খোঁজখবর নেওয়ার; সেখানে বারবার ক্ষমতাসীন দলের জামায়াতের সঙ্গে আতাত বা তাদের সঙ্গে আপোষের রাজনীতির কারণেই, বাংলাদেশে একাত্তরের পরাজিত শত্রুরা দেশের সাধারণ মানুষের চেয়ে কয়েকশো গুণ অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছে। মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়ার ধীরগতিও আওয়ামী লীগের সেই আতাত বা আপোষ করার রাজনীতির আরেকটি কৌশলের সমতুল্য। নইলে বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতি নিষিদ্ধ করার মত সিদ্ধান্ত নিতে কেন সরকার এত গড়িমসি করবে?
স্বাধীন দেশে যেখানে সবার আগে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের তালিকা করার কথা, সেখানে ৭২ সালের আওয়ামী লীগ সরকার দেশে মুক্তিযোদ্ধাদের একটা বিতর্কিত তালিকা করল। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ভাঙ্গিয়ে আওয়ামী লীগ সহ কিছু রাজনৈতিক দল দেশের অনেক সম্পদ লুটপাট করে ফুলে ফেঁপে উঠেছে। এমনকি জামায়াতের অনেককেও এরা আত্মীয়তার সূত্রে মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট দিয়েছে। সেই ৭২ সালেই এসব অপরাধীর কঠোর বিচার করলে বাংলাদেশকে ৪৪ বছর ধরে এই গ্লানি টানতে হয় না। এসব রাজনৈতিক ভুল সিদ্ধান্তের কারণে এখনো জামায়াতের সঙ্গে নানান সময়ে নানান কিসিমের আতাত ও আপোষের যে সংস্কৃতি চালু হয়েছে, তা বাংলাদেশকে আরো অনেকদিন দাবিয়ে রাখবে।
৪৪ বছর পর স্বাধীন বাংলাদেশের ষোল কোটি মানুষের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বিচার বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, একাত্তরে যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধীতা করেছিল, বাংলাদেশে সেই সব কতিপয় কুলাঙ্গাররা অর্থনৈতিকভাবে এখন সবচেয়ে সাবলম্বী। আর যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য নামমাত্র কোঠা চালু করে সেখানে আরেক দুর্নীতির আকড়া বানানো হয়েছে। সরকারের সকল সেক্টরে দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির যে সংস্কৃতি চালু হয়েছে, যাকে সরকার কর্তৃক প্রকাশ্যে নানাভাবে স্বীকৃতিও দেওয়া হচ্ছে, যা স্বাধীন বাংলাদেশের ষোল কোটি সাধারণ মানুষের কল্যানের ঠিক বিপরীত চিত্র। বাস্তবতা হলো, বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর কোটি কোটি টাকা বিদেশে পাচার হচ্ছে। সরকার মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ করতে কার্যত ব্যর্থ। বাংলাদেশ থেকে সম্পদ চুরি করে বিদেশে এক্সিকিউটিভ ভিসা লাগিয়ে সেখানে বিলিয়ন ডলার ইনভেস্ট করে, নতুন দেশে সেকেন্ড হোম বানাচ্ছে এদেশেরই একদল দুর্বৃত্ত। সরকারের প্রশ্রয় পেয়েই এসব দুর্বৃত্ত এসব করার সুযোগ পাচ্ছে। মুখে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার শ্লোগান দিয়েও অনেক দুর্বৃত্ত বাংলাদেশকে মনে করছে অর্থ উপার্জনের ঘাঁটি। আর নিজেদের পরিবার ও সংসার পাতছে বিদেশের কোনো তৃতীয় দেশে। যাকে তারা প্রকাশ্যে বলছে সেকেন্ড হোম।
৪৪ বছর হয়ে গেছে বাংলাদেশের স্বাধীনতার। অথচ এখনো বাংলাদেশের স্বাধীনতায় যারা বিশ্বাস করে না সেই রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামী প্রকাশ্যে রাজনীতি করছে এদেশে, তাদের দাবি পূরণ না হলে হরতাল দিচ্ছে, জ্বালাও পোড়াও করছে। আর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের নামে আরেকটি দীর্ঘমেয়াদী মূলা বাংলাদেশের সামনে ঝুলিয়ে একশ্রেণীর দুর্বৃত্তরা প্রকাশ্যে লুটপাট করছে। আর এসব অনাচারের বিরুদ্ধে কোন কথা যাতে বলা না যায়, সেজন্য নানান কিসিমের সেন্সরসহ আইসিটি আইনের ৫৭ ধারার মত কালো আইন চালু করা হয়ছে। ৪৪ বছরের স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনীতি বিশ্লেষণ করলে যে সত্যটি বেড়িয়ে আসে, তা হলো, ক্ষমতায় যাবার পর সে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের হোক আর বিপক্ষের হোক কোনো দলই খাঁটি দেশপ্রেম দেখায় না। লুটপাট, চুরি দুর্নীতি করে অর্থলোপাট করাই তাদের প্রধান ধ্যানজ্ঞানে পরিনত হয়। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকে দীর্ঘায়িত করার কৌশলের পেছনেও এসব চুরি-লুটপাট, দুর্নীতিকে লালনপালন করার প্রচেষ্টা হিসাবে দেখা যায় বৈকি। বাংলাদেশকে সোনার বাংলা গড়ার কথাটি কেবল নেতাদের মুখেই শোভা পায়। বাস্তবে কর্মক্ষেত্রে রাষ্ট্রের কোনো প্রতিষ্ঠানকে সঠিক পথে পরিচালনায় এদের কারোরই কোনো আগ্রহ নেই। যা থেকে এদের সেকেন্ড হোম সম্পর্কে তীব্র দেশপ্রেমের ব্যাপারটি সামনে আসে এখন। কার্যত বাংলাদেশের রাজনীতিবিদের সেকেন্ড হোম এখন বাংলাদেশ। আর বাংলাদেশ থেকে চুরিচামারি লুটপাট, দুর্নীতি করে সম্পদ সরানোর হয় তাদের সত্যিকারের ফার্স্ট হোমে। এটাই ৪৪ বছর পর বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে চরম সত্য বাস্তবতা।
একটি ভালো কথা বলে বা একটি ভালো কাজকে সামনে রেখে এক হাজারটি কুকর্মকে জায়েজ করার নাম এখন বাংলাদেশে রাজনৈতিক ব্যবসা। বাংলাদেশে বিগত ৪৪ বছরে সবচেয়ে সফল হয়েছে দুর্বৃত্তদের নষ্ট রাজনৈতিক ব্যবসা। বাংলাদেশে এখন বাড়ি গাড়ি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিক বলতে গেলেই সবাই দুর্বৃত্ত। এদের সহযোগিতা করেছে ৪৪ বছর ধরে সকল সরকার। বাংলাদেশে মাত্র ৯০ লাখ দুর্বৃত্ত গোটা বাংলাদেশের সম্পদকে নাড়াচাড়া করে, ক্ষমতা ভোগ করে, ক্ষমতার বাহাদুরি করে, এটাই চরম সত্য। ষোল কোটি মানুষের দেশে মাত্র ৯০ লাখ দুর্বৃত্ত সবকিছুর মালিক। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস এখন ইতিহাসের পাতায় ঠাই নিয়েছে। সেই ইহিহাসও সঠিক ভাবে বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরার জন্য সরকারিভাবে কার্যত কোনো উদ্যোগ নাই। বাহান্নের ভাষা আন্দোলনের রক্তে গড়া বাংলা একাডেমি যেমন বিগত ৬৩ বছরে একটি অথর্ব প্রতিষ্ঠানে পরিনত হয়েছে, তেমনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিক্রি করে কিছু গোষ্ঠী বাংলাদেশে সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলছে। মাঝখানে সাধারণ মানুষকে ব্যস্ত রাখা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ ও বিপক্ষ নামে দুইটি গ্রুপে ভাগ করে। যেন ব্যাপারটা এমন- তোমরা সাধারণ আমজনতা কুতর্কে সময় নষ্ট কর। আমরা দুর্বৃত্তরা যা কামানোর কামিয়ে লই। এই হলো আসল সূত্র। একাত্তরে বাংলাদেশ একটি পতাকা পেলেও বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের ভাগ্যোন্নয়ের পথে এখনো সুদূর পথ পাড়ি দিতে বাকি। অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য নব্য গড়ে ওঠা দুর্বৃত্ত সিন্ডিকেটকে গুড়িয়ে দিতে না পারলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা কেবল নামেই থাকবে। বাস্তবে এদেশের সাধারণ মানুষের কল্যাণের দেখা পাওয়া বরং সুদূর পরাহত। ৪৪ বছর পরেও যে দেশে কার্যত কোনো স্বাস্থ্য সেবা গড়ে ওঠেনি, যে দেশের রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীকে বিদেশে জনগণের ট্যাক্সের পয়সায় চিকিৎসা সেবা নিতে যেতে হয়, সেদেশের শাসন কাঠামোর সিস্টেমে যে বড় একট গলদ আছে, সেই গলদ যতদিন ঠিক না হবে, ততদিন স্বাধীনতা মানে কেবল কাগজে কলমের প্রতীকি স্বাধীনতা। সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য আরেকটি মুক্তিযুদ্ধ করতে হবে। সেই যুদ্ধটি দুর্বৃত্তদের জন্য বাংলার মাটিতে কবর খোড়ার যুদ্ধ। কেবল যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করলেই সেই যুদ্ধের সমাপ্তি হবার কোনো লক্ষণ নেই। অতএব সাধু সাবধান।
..............................
১৫ ডিসেম্বর ২০১৫
©somewhere in net ltd.