নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
ছোটগল্প লিখি। গান শুনি। মুভি দেখি। ঘুরে বেড়াই। আর সময় পেলে সিলেকটিভ বই পড়ি।
আমার বাবা মারা গেছেন সেই ১৯৯৬ সালে। ডিসেম্বর মাসের ৬ তারিখ। এরও চার বছর আগে বন্ধু তুহিনের বাবা মারা যায় ১৯৯২ সালে। সেটাও কী ডিসেম্বর মাসের ১২ তারিখে? নাকি নভেম্বর মাসে? তারও আগে বন্ধু প্রকাশের বাবা মারা যায়। সেটাও ডিসেম্বর মাস ছিল। বছরটা ঠিক মনে পড়ছে না, দিনটা ছিল ১৮ তারিখ। আমরা তখন প্রাইমারি স্কুলে পড়ি। আমাদের বন্ধুদের মধ্যে সবার আগে বাবাকে হারিয়েছিল প্রকাশ। আমার বড় ভাইয়ের শ্বশুর, মানে আমার নিরু ভাবী'র বাবা মারা যান ১৯৯৩ সালের ১১ ডিসেম্বর। গত ১৩ ডিসেম্বর মারা গেছে বন্ধু মুকুলের বাবা। আজ মারা গেল বন্ধু আসমানী'র বাবা। গোটা ডিসেম্বর মাস জুড়ে আমার স্মৃতিতে অনেক বাবা হারানোর ঘটনা কেবল বারবার মনে পড়ছে কয়েকদিন ধরে। ডিসেম্বর মাসে আমি বাবাকে খুব মিস করি। কোনো বন্ধু'র বাবা মারা গেছে এই খবরটি সঙ্গে সঙ্গে আমার বাবাকে মনে করিয়ে দেয়। আর তখন বাবার সঙ্গে আমার হাজার হাজার স্মৃতি ঝাঁকে ঝাঁকে দল বেধে মনের বারান্দায় এসে হাজির হয়।
এখনও বাবা'র একটি সাদা মাফলার আমার কাছে স্মৃতি হিসেবে আছে। বাবার কথা মনে পড়লে আমি সেই মাফলারটা বের করে বাবাকে স্পর্শ করি। বাবাকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখি। তাতে আমার মন ভালো হয়ে যায়। কিন্তু মুশকিল হলো বাসা বদলের পর বাবার সেই স্মৃতির ধন আমি যে কোন কার্টুনে বা ব্যাগে রেখেছি, এখনও খুঁজে পাচ্ছি না। আমার কাছে বাবা'র একটিমাত্র সাদা কালো ছবি আছে। সেই ছবি'র দিকে আমি কত ঘণ্টা যে অকারণে তাকিয়ে থাকি। বাবার সঙ্গে অনেক বিষয়ে কতবার যে মত বিনিময় করি। আমাদের সেসব কথা কোথাও লেখা হয় না। রেকর্ড করা হয় না। কোনো ভাষায় সেসব কথা কোথাও অনুবাদ করাও হয় না। কিন্তু আমাদের সেই বিনিময়ের ভাবানুবাদের ভেতর আমার নিজের জন্য একটা বিশাল শান্তনা কাজ করে। বাবাকে মনে পড়লেই আমার কল্পনায় তার সুস্পষ্ট ছবি ভেসে ওঠে। সেই ছবির সঙ্গেও আমার অনেক না বলা কথা হয়। নতুন-পুরানা অনেক সমস্যা নিয়ে মত বিনিময় হয়। উদানিং মাঝে মাঝে পালিয়ে যাবার নির্দেশ পাই বাবার কাছ থেকে। আবার মনে হয় আমি বুঝি ভুল ব্যাখ্যা করছি এসবের। পালিয়ে আমি আর কোথায় যাব? কে আমাকে আশ্রয় দেবে? কিংবা আমি পালাব কেন? হোয়াই? নাকি এসব আমার মনের অজান্তে একটা কুহেলীকা তৈরি করছে!
আমাদের মত যাদের বাবা নেই, তাদের কী কোথাও পালিয়ে গেলেও বাবার সঙ্গে আর দেখা হবে? যাদের বাবা নেই তাদের শান্তনা দেবার ভাষাও আমার জানা নেই। কী বলে আমি তাদের শান্তনা দেব। বাবা যে সন্তানের কাছে কতটা আপনজন, তা আমি কীভাবে বুঝাই। সেই আপন মানুষটি যখন পৃথিবী ছেড়ে চলে যায়, অজানা এক রহস্যপুরীতে যিনি বাকি জীবনের জন্য উধাউ হন, তার দেখা পাওয়া কী এত সহজ? বাবা হারানো সেই বন্ধুকে আমি আর কিবা বলতে পারি। কোন শান্তনার বাণীতে আমার বন্ধু'র মন ভালো হবে, বলো? সেই ভাষা, সেই বাক্য, সেই দরদ কী আমি জানি! শুধু জানি, বন্ধু'র বাবা হারানোর কষ্ট যে কত বেদনার, সেই অতলান্ত বেদনাময় সময়ে আমার না জানা ভাষা, আমার না উচ্চারিত বাক্য, আমার শোকানুভূতি কী আসলে কোনো কাজে লাগবে? বাবাকে হারিয়ে অন্তরের গভীরে যে শূন্যতা তৈরি হয়, সেই শূন্যস্থান তো কোনো ভাষা, কোনো বাক্য, কোনো কলিজার টানে পূরণ হবার নয়। যা আমিও বুঝি। বাবাকে হারিয়ে আমিও যে ১৯টি বছর ধরে এখনও নিঃস্ব। সেই নিঃস্বতার কোনো পরিসীমা নেই। সেই অসীম অনন্ত শূন্যতা পূরণের কোনো নিয়মও আমার জানা নেই রে বন্ধু।
গত বছর বন্ধু হুমায়ুনের বাবা মারা গেল। সেদিন হুমায়ুন ওর বাবা'র স্মৃতিচারণ করতে করতে হঠাৎ সময়টা খুব ভারী করে তুলেছিল। আমি হুমায়ুনের কথার কোনো জবাব দিতে পারিনি। একটা বোবা কষ্ট কেবল আমার ঘাড় থেকে সারা শরীরে বিদ্যুতের মত ছড়িয়ে গেল। আমি সত্যি সত্যি কোনো কথা বলতে পারিনি। প্রসঙ্গটা উঠেছিল আরেক বন্ধু জাফরের বাবা মারা যাবার পর। পরে পটিয়া থেকে জাফর ফেরার পর আমরা আবার জাফরের মুখে বাবা হারানোর ঘটনার স্মুতিচারণ শুনি। তখনও আমি জাফরকে কোনো শান্তনার বাণী শোনাতে পারিনি। কেবল একটা বোবা কষ্ট আমার ভেতরটা তোলপাড় করে তুলেছিল। এ বছর ফেব্রুয়ারি মাসে বন্ধু নজরুল কবীরের বাবা মারা যায়। তখনও নজরুলকে আমি কী বলে শান্তনা দেব, সেই ভাষা খুঁজে পাইনি। সেদিন সন্ধ্যায় বাংলা একাডেমি'র বইমেলায় বন্ধু আলফ্রেড খোকন এসে বিস্তারিত শোনালো। বলল, নজুরুলের বাবা'র জানাজা পড়ে মেলার দিকে আসলাম রে। মনটা ভালো নেই। বন্ধু'র বাবা মারা গেলে মন যে ভালো থাকার কথা নয় রে বন্ধু।
সেদিন রাতে মুকুলকে ফোন করেও আমি কোনো শান্তনা বাণী খুঁজে পাইনি। আমি বারবার বাবা হারানো বেদনায় কাতর হয়ে হয়ে যেন একটা অবুঝ বোকা মানুষে পাল্টে যাই। বাবা হারানোর কষ্ট আসলে কাউকে বোঝানো যায় না। যাদের বাবা নেই হয়তো কেবল তারাই সেই বোবা কষ্টের কিছুটা অনুধাবন করতে পারবে। আজ আসমানীকেও আমি কোনো শান্তনা দিতে পারিনি। হঠাৎ এমন অপ্রস্তুত বাবা হারানোর খবরে আমার ভেতরে একটা তোলপাড় শুরু হয়। একটা অবুঝ ঘোর লাগে। আমি ভাষা হারিয়ে ফেলি। বারবার তখন আমার বাবার কথা মনে পড়ে। বাবার সঙ্গে স্মৃতিগুলো স্ন্যাপশটের মত ঝাঁক বেধে একেএকে সামনে আসে। কোনটা রেখে আমি কোনটা দেখব। এভাবে একটা অচেনা অবুঝ ঘোরলাগা তৈরি হয় আমার ভেতর। বাবাকে হারানো এক অব্যক্ত বোবা কান্নার ঘোরলাগা সেই মুহূর্তেরও কোনো ব্যাখ্যা আমার কাছে আসলে নেই।
হয়তো কোনো দিন যদি চিল হয়ে উড়ে উড়ে আকাশের ওই গহীন অসীমে খুঁজে খুঁজে বাবাকে আবার পাওয়া যেত, বাবার সঙ্গেই সেই ঘোরলাগা বোবা সময়ের তখন বিনিময় করতে পারতাম। কিন্তু সেই সুযোগ কী আমাদের আছে? আমরা কী কেউ কখনো চিল হয়ে অসীম আকাশের অনন্ত নিসীমে হারিয়ে যেতে পারব? খুঁজে বের করতে পারব আমাদের হারানো বাবাকে? আমরা কেবল দূর থেকে একটাই কামনা করতে পারব, বাবা তুমি যেখানে থাকো, আকাশের ওই নীলিমার যেখানেই তুমি মিশে থাকো না কেন, তুমি শান্তিতে থেকো বাবা। তুমি মন খারাপ করে থেকো না বাবা। শুধু এই সত্য জেনো, একদিন আমিও তোমার কাছে নীলাকাশের ওই অসীম শূন্যতার মাঝে বিলীন হব। তখন আবার আমাদের দেখা হবে। অনেক কথা হবে। তখন তুমি তোমার জমানো সব কথা আমাকে বোলো। আমিও তখন অন্তরে জমানো সব কথা তোমাকে বলব বাবা। অবশ্যই বলব বাবা। না বললে যে আমি শান্তি পাব না। বাবা, তোমার সাথে যে এখনও আমার অনেক কথা বলার বাকি!!
............................
২০ ডিসেম্বর ২০১৫
২১ শে ডিসেম্বর, ২০১৫ রাত ১২:৪৩
রেজা ঘটক বলেছেন: আপনার বাবা'র জন্য আমার অন্তরের শুভ কামনা রইল।
২| ৩১ শে ডিসেম্বর, ২০১৫ দুপুর ১:৩৫
ফেলু ব্যোমকেশ বলেছেন: খুব ভাল লাগল।আমি নতুন ব্লগার দোয়া করবেন
৩| ০৮ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ রাত ১১:০৬
এম.এ.জি তালুকদার বলেছেন: ১৯৯৮ সালে আমি ইংরেজী অনার্স ১ম পর্ষের ফাইনাল পরীক্ষা দেয়ার পর পরই সড়ক দূর্ঘটনায় আমার আব্বা মারা যান। তারপর অনার্স পড়া শিকায় উঠলো। আমার বাবার দূর্ঘনার স্থলে পরে থাকা তার পায়ের একটা নাগরা জুতা এখনও অতি যত্নে রেখে দিয়েছি। হায়রে, আব্বার করুন মৃত্যূ; হায়রে দরদের বিচ্ছেদের স্মৃতি!!!!!!!!!!!!!!!!!
©somewhere in net ltd.
১| ২১ শে ডিসেম্বর, ২০১৫ রাত ১২:০৯
আজমান আন্দালিব বলেছেন: হৃদয় ছুঁয়ে গেল। আমার বাবা অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে আছেন। দোয়া করবেন।