নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

বাংলাদেশ আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা...

বাংলাদেশ আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা...

রেজা ঘটক

ছোটগল্প লিখি। গান শুনি। মুভি দেখি। ঘুরে বেড়াই। আর সময় পেলে সিলেকটিভ বই পড়ি।

রেজা ঘটক › বিস্তারিত পোস্টঃ

মাইক মানে উৎপাত, চাই মাইকের উৎখাত!!!

০৩ রা সেপ্টেম্বর, ২০১৬ বিকাল ৪:৪১

ছোটবেলায় কাউকে বিরক্ত করার জন্য আমরা কাগজ দিয়ে মাইক বানাতাম! আমাদের মত ছোকরাদের সেই কাগজের মাইকের উৎপাতে চরম বিরক্ত হয়ে একসময় মুরব্বিদের কানে নালিশ আসতো। নালিশ আসলে আমরা হাতেনাতে কিছু বালিশ পেতাম। সেই বালিশের পোড়ানিতে দীর্ঘদিন আমরা এই মাইক মাইক খেলা অটোমেটিক ভুলে যেতাম।

কিন্তু চৈত্র সংক্রান্তির মেলার সময় মাইকের মত দেখতে প্লাস্টিকের বাঁশি দেখলেই আমরা আবার বালিশের কথা ভুলে সেই বাঁশি কিনতাম। নতুন বাংলা বছরের প্রথম কয়েক দিন সেই প্লাস্টিকের বাঁশি দিয়ে সবার জন্য চরম অশান্তি সৃষ্টি করার পর একসময় সেই বাঁশি বড়দের কেউ ভেঙ্গে দিতেন। আমাদের মাইক নিয়ে খেলার বাসনা তখন বছরের বাকি সময়ের জন্য আড়াল হতো।

দক্ষিণ আফ্রিকার জনপ্রিয় বাঁশি'র নাম ভুভুজেলা বাঁশি। ছোটবেলায় আমরা বৈশাখী মেলা থেকে যেটা কিনতাম তারচেয়ে ভুভুজেলার নলটা অনেক বেশি লম্বা। শব্দও বেশি জোড়ালো। এই ভুভুজেলা বাঁশির সামনের দিকটা দেখতে ঠিক মাইকের মত। সম্প্রতি বাংলাদেশে এই ভুভুজেলা বাঁশির উৎপাত বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে।

গ্রামের হাটবাজারে আমরা ছোটবেলায় দেখতাম একটা বিশেষ চোঙার সাহায্যে ফেরিওয়ালা চট করেই হাজার মানুষের ভিড়ে আমাদের মত ছোকরাদের দৃষ্টি আকর্ষন করতেন। আমরা হাটে গেলে প্রায় পুরোটা সময় ওই ফেরিওয়ালার নানান কিসিমের লেকচার শুনে ব্যাপক বিনোদন নিয়ে তারপর বাড়ি ফিরতাম। ওই ফেরিওয়ালার হাতে যে চোঙাটা থাকতো, ওইটার সামনের দিকটাও দেখতে ঠিক মাইকের মত। শব্দ জোড়ালো আকারে বিচ্ছুরণের জন্য চোঙার পরিবর্তিত রূপ আসলে এখনকার মাইক। এখন অবশ্য ফেরিওয়ালারা পুলিশের মত হ্যান্ড-মাইক ব্যবহার করেন। এছাড়া ফিল্মের শ্যুটিংয়ের সময় মানুষ ঠেকাতে এই হ্যান্ড-মাইকের জনপ্রিয়তা রয়েছে।

সুইডিশ নোবেল কমিটি প্রতিবছর পদার্থবিদ্যায় নতুন নতুন আবিস্কারের জন্য নোবেল পুরস্কার দেয়। কিন্তু মাইক আবিস্কার করার জন্য এখন পর্যন্ত কাউকে পুরস্কার না দিয়ে সুইডিশ নোবেল কমিটি মাইকের বহুব্যবহার ও প্রয়োজনের দিকটাকে কিছুটা হলেও অবমূল্যায়ন করেছে বটে!

গ্রামের হাটবাজারগুলোতে হাটের দিন একটা বিশেষ শব্দ হয়। এটাকে হাটের শব্দ বলা হয়। হাটের শব্দ থেকে প্রতিটি শব্দের আলাদা অর্থ আজ পর্যন্ত কোনো নাদান আলাদা করতে পারেননি। তবে হাটে যদি একটা মাইক থাকে, তাহলে দূর থেকে সেই মাইকে ভেসে আসা শব্দকে খুব সহজেই আলাদা করা যায়। যেমন- ভাইসব, হাট করা শেষে বাড়ি যাবার সময় হাকিম শিকদারের আশ্চার্য মলম নিয়ে যেতে ভুলবেন না। হাকিম শিকদারের আশ্চার্য মলম একবার লাগালেই কাজ হয়।

অর্থ্যাৎ দূরের মানুষকে বা একসঙ্গে অনেক মানুষ কিছু জানাতে চাইলে মাইকের ব্যবহার বেশ জনপ্রিয়। ইদানিং অবশ্য সাউন্ড সিস্টেম আর বড় বড় সাউন্ড বক্স মাইকের বাজারে কিছুটা জায়গা দখল করেছে। কিন্তু সেটা বেশিরভাগ ইনডোরে। আউটডোরে এখনো মাইক অপ্রতিদ্বন্দ্বি। শব্দ দূষণের জন্য এই মাইক এখন শহরের সবচেয়ে দুষ্ট আইটেম। জনসভা থেকে শুরু করে বিভিন্ন বিজ্ঞাপন মাইকের মাধ্যমে প্রচার করে মানুষের শ্রবণইন্দ্রিয়ের বারোটা বাজিয়ে দিচ্ছে।

বাংলাদেশে ২০০৬ সালে প্রণীত শব্দদূষণ নীতিমালা অনুযায়ী, আবাসিক এলাকায় সকাল ৬টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত সর্বোচ্চ শব্দসীমা হলো ৫৫ ডেসিবেল এবং রাত ৯টা থেকে সকাল ৬টা পর্যন্ত ৪৫ ডেসিবেল। একই ভাবে, নীরব এলাকার জন্য এই শব্দসীমা যথাক্রমে সর্বোচ্চ ৫০ ও ৪০ ডেসিবেল, মিশ্র এলাকায় ৬০ ও ৫০ ডেসিবেল, বাণিজ্যিক এলাকায় ৭০ ও ৬০ ডেসিবেল এবং শিল্প এলাকায় ৭৫ ও ৭০ ডেসিবেল সর্বোচ্চ শব্দসীমা নির্ধারণ করা হয়েছে। এর উপরে শব্দ সৃষ্টি করা দন্ডনীয় অপরাধ। কিন্তু আমাদের দেশে এই বিধিমালা একদমই মানা হচ্ছে না।

একটি বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় এবং একটি বেসরকারী সংগঠনের পরিচালিত গবেষণায় দেখা যায়, ঢাকা শহরের সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল এলাকায় শব্দদূষণ মাত্রা ১০২ ডেসিবেল, মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকায় ৯৩ ডেসিবেল, বাংলামোটর এলাকায় ৯২ ডেসিবেল, সদরঘাট এলাকায় ৮৮ ডেসিবেল, ফার্মগেট এলাকায় ৯৩ ডেসিবেল, শাহবাগ এলাকায় ৮৬ ডেসিবেল, মহাখালী এলাকায় ৯৪ ডেসিবেল, ধানমন্ডি আবাসিক এলাকায় ১০১ ডেসিবেল, তেজগাঁও শিল্প এলাকায় ৯৫ ডেসিবেল, গুলিস্তান এলাকায় ৯২ ডেসিবেল এবং স্কয়ার হাসপাতাল এলাকায় ১০৪ ডেসিবেল। যেখানে সবোর্চ্চ শব্দসীমা যত তার দ্বিগুণ শব্দ দূষণ করা হচ্ছে।

শব্দ দূষণের কারণে উচ্চরক্ত চাপ, মাথাধরা, অজীর্ণ, পেপটিক আলসার, অনিদ্রা ও ফুসফুসে সহ নানা রকম মানসিক সমস্যার সৃষ্টি হয়। অতিরিক্ত শব্দ দূষণে শিশুদের বুদ্ধিমত্তা নষ্ট হয়, সন্তান সম্ভাবনা মায়েদের যে কোনো ধরনের উচ্চ শব্দ মারাত্মক ক্ষতিকর। যানবাহনের শব্দ দূষণে ষ্ট্রোকের ঝুঁকি বহুমাত্রায় বেড়েছে। এভাবে শহরে মাত্রারিক্ত শব্দদূষণের কারণে আগামী প্রজন্ম হারাচ্ছে শ্রবণশক্তি। চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের মতে, যদি টানা ৮ ঘন্টা ৯০ থেকে ১০০ ডেসিবেল শব্দ প্রতিদিন শোনা হয়, তাহলে ২৫ বছরের মধ্যে শতকরা ৫০ জনের বধির হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

শহরে গাড়ির হর্ন, কলকারখানার শব্দ, ইঞ্জিনের শব্দ ইত্যাদিকে ছাড়িয়ে মাইক রয়েছে শব্দ দূষণের এক নম্বর স্থানে। ইদানিং শব্দ দূষণ ছাড়াও মাইকের ব্যবহারে নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বা উসকানি। নানান কিসিমের মিথ্যা প্রপাগাণ্ডা ছড়াতে মাইককে যত্রতত্র ব্যবহার করা হচ্ছে। মাইকের এই যত্রতত্র ব্যবহারের সবচেয়ে ভয়ংকর দিকটি হলো মসজিদের মাইক এসব কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে।

২০১২ সালে মসজিদের মাইকে মিথ্যা প্রপাগান্ডা চালিয়ে রামু'র বৌদ্ধ পল্লী জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছিল। ২০১৩ সালে সাঈদীকে চাঁদে দেখা যাওয়ার গুজব ছড়িয়ে বগুড়ায় তাণ্ডব চালানো হয়েছিল। ফটিকছড়িতে 'বড় হুজুরকে তুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে' এমন গুজব ছড়িয়ে আওয়ামী লীগের মিছিলে ভয়ঙ্কর তাণ্ডব চালানো হয়েছিল। নারায়ণগঞ্জের মাদানিনগর মাদ্রাসার মাইক ব্যবহার করে পুলিশের উপর আক্রমণ করা হয়েছিল। কিছুদিন আগে আলোড়ন তুলেছিল মসজিদের মাইক ব্যবহার করে নারায়ণগঞ্জে শিক্ষক নাজেহালের ঘটনা। আর গতকাল শুক্রবার মসজিদের মাইক ব্যবহার করে সিলেটের ইস্কর মন্দিরে হামলা করার ঘটনাটি ঘটে।

সুতরাং মাইকের শব্দ দূষণের পাশাপাশি মাইকে মিথ্যা প্রপাগাণ্ডা চালিয়ে সন্ত্রাসী হামলা বা দাঙ্গা লাগানোর মত প্রবণতা ইদানিং বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশে মাইকের ব্যবহার নিয়ে কোনো আইন আছে কিনা আমি জানি না। যদি থেকেও থাকে সেই আইনের বাস্তবে কোনো ব্যবহার যে নাই, তা দিবালোকের মত সত্য। মাইকের এই যে অপব্যবহার করছে একটি গোষ্ঠী, তারা কাদের প্রশ্রয়ে এটা করার দুঃসাহস পাচ্ছে?

আমাদের রাজনৈতিক নেতারা দীর্ঘদিন ধরে জনসভায় মাইকে চিৎকার করে ভাষণ দেবার যে প্রাকটিস করে আসছেন, সেখানে সেই চিৎকারের নানান কিসিমের অর্থ আছে। কোনো সুস্থ লোক অমন চিৎকার করতে গেলে তার পাছা দিয়ে জিনিস বের হয়ে যাবার কথা। মাইকের ব্যবহার জনপ্রিয় করতে আমাদের নেতারা ভূমিকা রাখছেন। আর এটাকে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে ব্যবহারের জন্য আরেকটি গোষ্ঠী দক্ষতার সঙ্গে ব্যবহার করছে।

মাইক নিয়ে প‌্যাচাল পাড়তে গিয়ে এখন আমার নিজেরই মাথা ধরে আসছে। মাইকের ব্যবহার নিষিদ্ধ হওয়া উচিত। একুশ শতকের সভ্যতায় মাইকের ব্যবহার একটি বড় ধরনের অপরাধ। এটি রাষ্ট্র করুক, কোনো প্রতিষ্ঠান করুক, কোনো রাজনৈতিক দল করুক, কোনো ধর্মীয় সম্প্রদায় করুক, কোনো ব্যক্তি করুক বা যে কোনো ভাবেই করা হোক না কেন, মাইক ব্যবহার করা একটি প্রকাশ্যে অপরাধ করার মত ব্যাপার। আমি বাংলাদেশে মাইকের ব্যবহারে সম্পূর্ণ নিষেধাজ্ঞা চাই। একজন রোগীর কাছে মাইক হলো ভয়ংকর একটা নরক।

প্রতিদিন আমাদের শ্রবণইন্দ্রীয় নষ্ট হচ্ছে। আমরা ধীরে ধীরে একটি বধির জনগোষ্ঠীর স্বপ্নের রাষ্ট্রের বাস্তবায়ন করছি যেন! মাইকের ব্যবহার বন্ধ না করলে সেই রাষ্ট্রই ধীরে ধীরে বধির হয়ে যাবার আশংকা রয়েছে। অতএব সাধু সাবধান।

....................................
৩ সেপ্টেম্বর ২০১৬

মন্তব্য ১ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (১) মন্তব্য লিখুন

১| ০৩ রা সেপ্টেম্বর, ২০১৬ বিকাল ৫:৩৫

আহলান বলেছেন: মাইকের অমাইক ব্যবহার .... !

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.