নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
ছোটগল্প লিখি। গান শুনি। মুভি দেখি। ঘুরে বেড়াই। আর সময় পেলে সিলেকটিভ বই পড়ি।
মার্কিন সাহিত্য ইতিহাসে নতুন কাব্যিক মূর্চ্ছনা সৃষ্টির জন্য এ বছর সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেলেন রক-ফোক সংগীতের কিংবদন্তি মার্কিন সংগীতশিল্পী ও প্রথাবিরোধী গীতিকার বব ডিলান। ৭৫ বছর বয়সী এই শিল্পীর প্রকৃত নাম রবার্ট অ্যালেন জিমারম্যান। ১৯১৩ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সাহিত্যে নোবেল পেয়েছিলেন, তখন সুইডিশ নোবেল কমিটি রবীন্দ্রনাথের গীতি-কবিতায় প্রকৃতির মধুর সুর মূর্চ্ছনায় আত্মায় শান্তি বর্ষন করে বলে বর্ণনা করেছিলেন। ঠিক ১০৩ বছর পর এবার আবার গীতি-কবিতার জন্য সাহিত্যে নোবেল পেলেন বিশ্বের অন্যতম ইনফ্লুয়েনসিয়াল মিউজিশিয়ান ও গীতিকার বব ডিলান। ১৯৯৩ সালে মার্কিন ঔপন্যাসিক টনি মরিসনের পর এবার কোনো মার্কিনী সাহিত্যের এই ঐহিত্যবাহী পুরস্কার পেলেন। বব ডিলান সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারের ১১৩তম নোবেল বিজয়ী।
২০১৩ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর বিখ্যাত মার্কিন সাংবাদিক বিল উইম্যান নিউ ইয়র্ক টাইমস-এ 'Knock, Knock, Knockin’ on Nobel’s Door' নামে একটি কলাম লিখেছিলেন। যেখানে বিল উইম্যান গোটা বিশ্বের খ্যাতিমান সাহিত্যিকদের সঙ্গে বব ডিলানের গানকে তুলনা করে বব ডিলানকে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারের জন্য সুপারিশ করেছিলেন। বৃহস্পতিবার স্টকহোমে নোবেল পুরস্কার ঘোষণার পর সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে ১৮ সদস্যের সুইডিশ একাডেমি'র স্থায়ী সেক্রেটারি ও লিটারারি স্কলার সারা দানিউস বলেছেন, 'Mr. Dylan “a great poet in the English-speaking tradition” and compared him to Homer and Sappho, whose work was delivered orally.
৫৪ বছর ধরে বব ডিলান তাঁর এই অভিযাত্রায় প্রতিনিয়ত নিজেকে নতুন করে আবিস্কার করে চলছেন আর সৃষ্টি করছেন নতুন পরিচয়। বব ডিলানের ‘দ্য টাইমস দে আর আ-চেইঞ্জিং’ গানটিকে সারা দানিউস তুলনা করেছেন গ্রিক কবি হোমার আর শ্যাফোর সঙ্গে। সারা দানিউস বলেন, আমরা যদি পাঁচ হাজার বছর পিছনে ফিরে যাই, আমরা হোমার আর শ্যাফোকে পাব। তাঁদের গীতিকবিতা লেখাই হতো গেয়ে শোনানোর জন্য। বব ডিলান সেই একই কাজ করছেন।
১৯৬১ সালে নিউ ইয়র্কের গ্রিনউইচ ভিলেজের ক্লাব ও ক্যাফেগুলোকে অ্যাকুইস্টিক গিটার হাতে প্রথম দেখা যায় বব ডিলানকে। বব ডিলান গুরু মানতেন প্রতিবাদী গানের শিল্পী উডি গুথরিকে। বব ডিলান ড্যাজলিং লিরিকের জন্য খুব কম সময়ের মধ্যেই মার্কিন সংগীত জগতে সবার দৃষ্টি আকর্ষন করেন। ১৯৬৩ সালে বব ডিলানের লেখা “Blowin’ in the Wind” গানটি অ্যালবামে যোগ করে পিটার, পল ও মেরি যে ফোক গ্রুপ তৈরি করেছিলেন, মার্কিন বিলবোর্ড পপ চার্টে এই গানটি তখন রাতারাতি দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছিল।
১৯৬৫ সালে নিউপোর্ট ফোক ফেস্টিভালে বব ডিলান একটি ইলেকট্রিক রক ব্যান্ডে 'পপ অ্যান্ড রোল' টাইপের ভিন্ন ধারার ফোক গান গেয়ে সবার নজর কারেন। কিন্তু ১৯৬৬ সালে নিউ ইয়র্কের উডস্টকে নিজের বাড়ির কাছে এক মটর সাইকেল দুর্ঘটনার পর বব ডিলান পাবলিক প্লেসে গান গাওয়া অনেকটা বন্ধ করে দেন।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য অর্থ সংগ্রহের জন্য নিউ ইয়র্কে বিটলস শিল্পী জর্জ হ্যারিসন, ভারতের বিখ্যাত সেতার শিল্পী পণ্ডিত রবিশঙ্করের অনুরোধে আয়োজন করেছিলেন 'দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশ'। 'দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশ'-এর অনুষ্ঠানে গান গাওয়ার জন্য জর্জ হ্যারিসন বব ডিলানকে ফোন করলে বিনা বাক্য ব্যয়ে বব ডিলান সাড়া দিয়েছিলেন। 'দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশ' অনুষ্ঠানে বব ডিলান মোট ছয়টি গান গেয়েছিলেন। যার মধ্যে "Blowin' In The Wind" গানটি সবচেয়ে জনপ্রিয়। বব ডিলানের এই গানটি বাংলা করে গেয়েছিলেন শিল্পী কবীর সুমন। সেই বাংলা গানের কথাগুলো এমন- কতটা পথ পেরোলে তবে পথিক বলা যায়, কতটা পথ পেরোলে পাখি জিরোবে তার দায়, কতটা অপচয়ের পর মানুষ চেনা যায়, প্রশ্নগুলো সহজ, আর উত্তরও তো জানা।। কত বছর পাহাড় বাঁচে ভেঙে যাবার আগে, কত বছর মানুষ বাঁচে পায়ে শিকল পড়ে; ক’বার তুমি অন্ধ সেজে থাকার অনুরাগে, বলবে তুমি দেখছিলে না তেমন ভালো করে। কত হাজার বারের পর আকাশ দেখা যাবে, কতটা কান পাতলে তবে কান্না শোনা যাবে; কত হাজার মরলে তবে মানবে তুমি শেষে, বড্ড বেশী মানুষ গেছে বানের জলে ভেসে। ' ওই অনুষ্ঠানে ‘ব্লোইং ইন দ্য উইন্ড’ ছাড়াও ডিলান 'এ হার্ড রেইন’স আ-গনা ফল’, ‘জাস্ট লাইক আ ওমেন’সহ মোট ছয়টি গান গেয়েছিলেন। বব ডিলানের 'মি. টাম্বুরিন ম্যান' গানটিরও বাংলা অনুবাদ করে গেয়েছিলেন কবীর সুমন ‘ও গানওয়ালা’ নামে। বব ডিলানের গাওয়া গানগুলো বাংলায় জনপ্রিয় করেছেন শিল্পী কবীর সুমন ও অঞ্জন দত্ত।
১৯৪১ সালের ২৪ মে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মিনেসোটার ডুলুথে সেন্ট মেরি'স হাপাতালে রবার্ট অ্যালেন জিমারম্যান জন্মগ্রহন করেন। বব ডিলান বড় হন ডুলুথ ও হিবিং এলাকায় লেক সুপিরিয়রের পার্শ্ববর্তী মেসাবি আয়রন রেঞ্জ এলাকায়। বব ডিলানের জীবনী লেখকদের গবেষণায় দেখা যায় যে, তাঁর দাদা-দাদী জিগম্যান ও আনা জিমারম্যান ইউক্রেনের ওডেসা থেকে অভিবাসিত হয়েছিলেন ১৯০৫ সালের দিকে, তারপর তাঁরা আমেরিকায় বসতি স্থাপন করেছিলেন। তাঁর মায়ের দাদা-দাদী বেঞ্জামিন ও লিব্বা এডেলস্টেইন ছিলেন লিথুয়ানীয় ইহুদী। ১৯০২ সালের দিকে তাঁরা আমেরিকায় আসেন। ২০০৪ সালে প্রকাশিত বব ডিলানের আত্মজীবনীমূলক বই 'ক্রনিকলস'-এর প্রথম খণ্ডে বব ডিলান লিখেছেন, 'আমার পিতামহীর কুমারী নাম ছিল কিরগিজ। তাঁদের পরিবারের উত্থান হয়েছিল ইস্তানবুলে। আমার পিতামহী বেড়ে উঠেছিলেন তুরস্কের কাগিজমান এলাকায়। আর আমার পিতামহ তুরস্কের কৃষ্ণ সাগর উপকূলবর্তী ট্রাবজন এলাকা থেকে এসেছিলেন।' বব ডিলানের পারিবারিক ইহুদী নাম হলো শাবতাই জিসেল বেন আভ্রাহাম।
বব ডিলানের বাবা আব্রাম জিমারম্যান ও মা বিয়াট্রিস "বেটি" স্টোন ছিলেন ডুলুথ এলাকার ছোট্ট ইহুদি কমিউনিটির সদস্য। ছয় বছর বয়স পর্যন্ত রবার্ট ডুলুথে বসবাস করেছেন। তাঁর বাবা পোলিওতে আক্রান্ত হলে তাঁদের পরিবার তখন হিবিং এলাকায় চলে যায়। যেখানে কাটে রবার্টের শৈশবের বাকী দিনগুলো। রবার্টের ছোটবেলার বন্ধু অ্যাব্রামের ভাষায়, 'ডিলান ছিলেন রূঢ় ও কঠোর স্বভাবের। কিন্তু ওর মা ছিলেন ভারী কোমল ও বন্ধুত্বপূর্ণ স্বভাবের। ছেলে ছিল মায়ের ঠিক উল্টো স্বভাবের।'
যৌবনের অনেকটা সময় বাড়িতে কেবল রেডিও শুনেই কাটিয়েছেন বব ডিলান। শ্রেভেপোর্ট রেডিওতে তখন যে সকল ব্লুজ ও কান্ট্রি সঙ প্রচারিত হতো সেগুলো শুনেই সময় কাটতো বব ডিলানের। ধীরে ধীরে বব ডিলান 'রক অ্যান্ড রোল' সংগীতের দিকে ঝুকে পড়েন। হাই স্কুলে পড়ার সময় বব ডিলান কয়েকটি ব্যান্ড দল গঠন করেছিলেন। তাঁর গঠিত প্রথম ব্যান্ডদল 'দ্য শ্যাডো ব্লাস্টার্স' অবশ্য খুব বেশিদিন টেকেনি। তবে পরবর্তী সময়ে গঠিত ব্যান্ডদল 'দ্য গোল্ডেন কর্ডস' বেশ কিছুদিন টিকেছিল। স্কুলের মেধা বিকাশ প্রতিযোগিতায় বব ডিলানের ব্যান্ডদল 'ড্যানি অ্যান্ড দ্য জুনিয়র্স', 'রক অ্যান্ড রোল ইজ হেয়ার টু স্টে' গানটি এত জোরে গেয়েছিল যে স্কুলের অধ্যক্ষ তখন রেগে মেগে মাইক্রোফোন বন্ধ করে দিয়েছিলেন। বব ডিলান ১৯৫৯ সালে স্কুলের ইয়ার বুকের ক্যাপশান দেন 'লিটল রিচার্ডে' যোগ দেয়া। একই বছর তিনি 'এলস্টন গান' ছদ্মনামে শিল্পী ববি ভি-এর সাথে পিয়ানো বাজিয়ে ও হাততালি দিয়ে দু'বার ডেট করেন।
১৯৫৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে রবার্ট জিমারম্যান ইউনিভার্সিটি অব মিনেসোটাতে ভর্তি হন এবং মিনিয়াপোলিসে বসবাস শুরু করেন। এ সময় থেকে ধীরে ধীরে তিনি 'রক অ্যান্ড রোলে' তাঁর প্রথম দিককার উৎসাহ থেকে আমেরিকান ফোক সংগীতে বিশেষ করে অ্যাকুইস্টিক গিটার ব্যবহৃত এমন সব সংগীতের দিকে আকৃষ্ট হন। ১৯৮৫ সালে এক সাক্ষাৎকারে বব ডিলানে বলেন, 'প্রথম দিকে ওদেতার ফোক সংগীত আমাকে খুব আকৃষ্ট করেছিল। আমি তখন একটি দোকানে তাঁর রেকর্ড শুনতাম। এরপর একসময় আমি আমার ইলেকট্রিক গিটার ও অ্যাম্পলিফায়ার ছেড়ে দিয়ে অ্যাকুইস্টিক গিটারে গান করতে শুরু করি। ওটা ছিল একটি ফ্লাট-টপ গিবসন। এ সময় আমি মিনেসোটা ইউনিভার্সিটির মার্ভিন কার্লিন্সের কাছে গিটার প্রশিক্ষণ নিতাম। এরপর 'টেন ও' ক্লক স্কলার' নামের একটি কফি হাউজে গান গাইতে শুরু করলাম। ওখানে কিছুদিন আমি স্থানীয় ডিঙ্কিটাউন ফোক সংগীতে সক্রিয় ছিলাম। বন্ধুদের থেকে তখন অনেক ফোক সংগীতের অ্যালবাম ধার করতাম।'
ডিঙ্কিটাউনে থাকাকালীন সময়ে রবার্ট জিমারম্যান নিজেকে বব ডিলন নামে পরিচয় দিতে শুরু করেন। নিজের আত্মজীবনীমূলক বই 'ক্রনিকলস'-এ বব ডিলান লিখেছেন, 'বাড়ি থেকে বের হয়ে যাওয়ার পর আমি নিজেকে রবার্ট অ্যালেন নামে ডাকতে শুরু করলাম। এটা শুনলে মনে হতো কোনো স্কটিশ রাজার নাম। আর এই নামটি আমি খুব পছন্দ করতাম। তবে ডাউনবিট ম্যাগাজিন পড়ে জানতে পারলাম ডেভিড অ্যালিন নামে বাস্তবে একজন স্যাক্সোফোন বাদকের অস্তিত্ব রয়েছে। একই সময় ডিলান থমাসের কবিতার সাথেও আমার পরিচয় ঘটে। তখন আমি অনুভব করছিলাম রবার্ট অ্যালিন ও রবার্ট ডিলান থেকে আমাকে অন্তত একজনকে বেছে নিতে হবে। শেষ পর্যন্ত ডিলানকেই আমার পছন্দ হলো। ওই সময়ে অনেক জনপ্রিয় শিল্পীর নামেই বব ছিল। তাই ডিলানের আগে আমি বব যোগ করার সিদ্ধান্ত নিলাম। আর তখন থেকেই আমি রবার্ট জিমারম্যান ছেড়ে বব ডিলান হয়ে গেলাম।'
১৯৬০ সালে কলেজের ফার্স্ট ইয়ার পরীক্ষা না দিয়ে বব ডিলান নিউ ইয়র্ক ঘুরতে বের হলেন। ১৯৬১ সালে তিনি দেখতে যান তাঁর সংগীতের আইডল উডি গুথরিকে। উডি গুথরি তখন হান্টিংটন রোগে আক্রান্ত হয়ে নিউ ইয়র্কের গ্রেস্টোন পার্ক সাইকিয়াট্রিক হসপিটালে ভর্তি ছিলেন। ওই হাসপাতালে তখন বব ডিলানের সঙ্গে পরিচয় হয় আরেক বিখ্যাত সংগীত শিল্পী রামব্লিন জ্যাক ইলিয়টের। ডিলান নিজের প্রথম অ্যালবাম 'ক্রনিকলস' ভলিউম ওয়ান ইলিয়টকে ট্রিবিউট করেন।
বব ডিলানকে বলা হয় Rebel King of the Rock। মার্কিন কিংবদন্তি এই গায়ক-গীতিকার, মিউজিশিয়ান, চিত্রকর ও কবি বিগত পঞ্চাশ বছর ধরে জীবনমুখি গানের ধারায় অন্যতম পথিকৃৎ। ডিলানের গানের কথায় মূলত রাজনীতি, সমাজ, দর্শন ও সাহিত্যিক প্রভাব সুস্পষ্ট। এগুলো তখনকার জনপ্রিয় ধারার অনেকটাই কথিত নিয়ম বহির্ভূত ছিল এবং এ ধারার বিপরীত হিসেবে ধরা হতো বব ডিলানের গানকে। বব ডিলান নিজস্ব একটি সংগীত ধারা প্রসারের পাশাপাশি আমেরিকার বিভিন্ন ঐতিহ্যবাহী সংগীতের প্রতি আকর্ষন অনুভব করেছেন। ফোক বা রক মিউজিকের কথা বললে সেখানে অবশ্যই বব ডিলানের নামটাও আসবে। আমেরিকান লোকগীতি ও কান্ট্রি সঙ, ব্লুজ থেকে রক অ্যান্ড রোল, ইংলিশ, স্কটিশ, আইরিশ লোকগীতি, এমনকি জ্যাজ, ব্রডওয়ে, হার্ড রক এবং গসপেল সঙও গেয়েছেন বব ডিলান। বব ডিলান প্রকৃতপক্ষে একজন কবি, যিনি নিজের কবিতাকে গিটারের আশ্রয়ে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দিতে চেয়েছেন।
বব ডিলানের দ্বিতীয় স্টুডিও অ্যালবাম “The Freewheelin' Bob Dylan” (২৭ মে, ১৯৬৩) এর প্রথম ট্রাক “ব্লোয়িং ইন দ্যা উইন্ড। "Blowin' in the Wind" এবং "The Times They Are A-Changin" গান দুইটিকে নাগরিক অধিকার, মানবতাবাদীতা এবং যুদ্ধবিরোধী আন্দোলনের প্রশংসাগীতি বা জাতীয় সংগীত হিসেবে বিবেচনা করা হয়। 'ব্লোয়িং ইন দ্যা উইন্ড' মানুষের মাঝে প্রতিবাদী ভাবটাকে প্রশ্নের দ্বারা আবদ্ধ করে আরো জাগিয়ে তুলতে উদ্বুদ্ধ করে। এই গানটি সারা বিশ্বের শান্তি, যুদ্ধ এবং মানুষের স্বাধীনতার দাবির কথা বলে। এই গানের প্রত্যেক প্যারার শেষে পুনরাবৃত্ত পঙক্তি বা সুর "The answer, my friend, is blowin' in the wind" নিতান্ত রহস্যময় ও দ্ব্যর্থবোধক। যার মর্মার্থ সমাধান সুস্পষ্ট এবং সংশয়াতীতও হতে পারে অথবা বাতাসের মত অস্পর্শনীয়ও হতে পারে। গানটির আধ্যাত্মিক ও দার্শনিক অর্থ হয়তো আরো সুবিশাল। তাঁর 'লাইক এ রোলিং স্টোন' বিদ্রোহের সঙ্গীত হিসাবে গোটা বিশ্বজুড়ে ব্যাপক পরিচিত।
বব ডিলান তাঁর কবিতার ভেতরে রহস্যময় সুরের সংগীত আর সংগীতের ভেতরে এক অনন্য চিন্তার সাহিত্য ভুবন গড়ে তুলেছেন। যেখানে রাজনীতি, মানবতা, ঐতিহ্য, সারল্য, তারুণ্য, দক্ষতা, প্রেম, প্রযুক্তি, উন্নাসিকতা, প্রথাগত প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা, সৌভ্রাতৃত্ব, তুখোড়পনা, বাউন্ডেলে একসাথে ধরা দেয়। মেহনতী মানুষের দাবিকে বব ডিলান সংগীতে প্রকাশ করেছেন। সারা বিশ্বের যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের সাধারণ ভিকটিমদের কথা বব ডিলানের গানে গানে যতটা সুরের মূর্চ্ছনা ছড়িয়েছে যে, সেখানে তিনি এক নতুন সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছেন। আর সেই দ্রোহ ও প্রতিবাদী গানের জগতে বব ডিলান যেন একক কোনো সম্রাট। মাত্র ১৯ বছর বয়সে একটি কফি হাউজে যাঁর সংগীত ক্যারিয়ারের শুরু, সেই বালকের সবচেয়ে জনপ্রিয় কাজগুলো সৃষ্টি হয়েছে ১৯৬০ সালের পরে। ধীরে ধীরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন সমস্যার অনানুষ্ঠানিক ঐতিহাসিক দলিল হয়ে ওঠে বব ডিলানের গানগুলো।
"Blowin' in the Wind" গানটি নিয়ে এক সাক্ষাৎকারে বব ডিলান বলেছিলেন- ''There ain’t too much I can say about this song except that the answer is blowing in the wind. It ain’t in no book or movie or TV show or discussion group. Man, it’s in the wind—and it’s blowing in the wind. Too many of these hip people are telling me where the answer is but oh I won’t believe that. I still say it’s in the wind and just like a restless piece of paper it’s got to come down some ...But the only trouble is that no one picks up the answer when it comes down so not too many people get to see and know ...and then it flies away I still say that some of the biggest criminals are those that turn their heads away when they see wrong and know it’s wrong. I’m only 21 years old and I know that there’s been too many ...You people over 21, you’re older and smarter".
বব ডিলান সাধারণত গিটার, কিবোর্ড এবং হারমোনিকা বাজিয়ে গান করেন। ১৯৮০-এর দশক থেকে কিছু সংগীতজ্ঞকে সাথে নিয়ে তিনি নিয়মিত বিভিন্ন সংগীত ভ্রমণ করে থাকেন। যা তাঁর ভাষায় "নেভার এন্ডিং ট্যুর" নামে পরিচিত। তিনি অনেক বিখ্যাত শিল্পীর সাথেও একত্রে কাজ করেছেন। যেমন- দ্য ব্যান্ড, টম পেটি, জোয়ান বায়েজ, জর্জ হ্যারিসন, দ্য গ্রেটফুল ডেড, জনি ক্যাশ, উইলি নেলসন, পল সিমন, এরিক ক্ল্যাপটন, প্যাটি স্মিথ, ইউ২, দ্য রোলিং স্টোনস, জনি মিচেল, জ্যাক হোয়াইট, মার্লে হ্যাগার্ড, নেইল ইয়ং, ভ্যান মরিসন, রিঙ্গো স্টার এবং স্টিভি নিকস। যদিও তাঁর ক্যারিয়ারে গায়ক হিসেবেই তিনি বেশি পরিচিত এবং সফল হয়েছেন কিন্তু গীতিকার হিসেবেই তাঁর অবদানকে গোটা বিশ্বে বেশি মূল্য দেওয়া হয়।
বব ডিলান এ পর্যন্ত গ্রামি এ্যাডওয়ার্ড, গোল্ডেন গ্লোব, অ্যাকাডেমি পুরস্কারসহ অনেক পুরস্কার জিতেছেন। এছাড়া রক অ্যান্ড রোল হল অব ফেম, ন্যাশভিল সংরাইটার্স হল অব ফেম এবং সংরাইটার্স হল অব ফেম-এ তাঁর নাম অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। টাইম ম্যাগাজিনে প্রকাশিত বিংশ শতকের শ্রেষ্ঠ ১০০ প্রভাবশালী ব্যক্তির তালিকায় বব ডিলানের নাম রয়েছে। ২০০৪ সালে রোলিং স্টোন ম্যাগাজিনে প্রকাশিত সর্বকালের শ্রেষ্ঠ ১০০ গায়ক তালিকায় 'দ্য বিটলসের' পর বব ডিলান দ্বিতীয় অবস্থান দখল করেছেন।
১৯৯০ সালের জানুয়ারিতে বব ডিলানকে ফরাসি সংস্কৃতি মন্ত্রী জ্যাক ল্যাং 'কমান্ডার দেস আর্টস এট দেস লেটার্স' উপাধিতে ভুষিত করেন। ২০০০ সালে রয়্যাল সুইডিশ অ্যাকাডেমি অব মিউজিক তাঁকে পোলার মিউজিক পুরস্কার প্রদান করে। ২০০৭ সালে বব ডিলানকে সংস্কৃতিতে 'প্রিন্স অব অস্ট্রিয়াস' পুরস্কার প্রদান করা হয়। এর আগে তিনি কয়েকবার নোবেল সাহিত্য পুরস্কারের জন্য মনোনয়ন পেলেও এ বছর (২০১৬) তিনি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেলেন।
১৯৬৫ সালের ২২ নভেম্বর বব ডিলান বিয়ে করেন সারা লাউন্ডসকে। ডিলান ও সারা'র চার সন্তান। জেসে বায়রন ডিলান (জন্ম ৬ জানুয়ারি ১৯৬৬), আন্না লিও (জন্ম ১১ জুলাই ১৯৬৭), স্যামুয়েল আইজাক আব্রাম (জন্ম ৩০ জুলাই ১৯৬৮) ও জ্যাকব ডিলান (জন্ম ৯ ডিসেম্বর ১৯৬৯)। এছাড়া ডিলানের অ্যাডাবটেড সন্তান মারিয়া লাউন্ডস ( সারা'র আগের পরিবারের সন্তান, জন্ম ২১ অক্টোবর ১৯৬১) পরে যিনি মারিয়া ডিলান নামে পরিচিতি পান। বব ও সারা'র মধ্যে ১৯৭৭ সালের ২৯ জুন ডিভোর্স হয়। ১৯৮৮ সালে মারিয়া ডিলান বিয়ে করেন বিখ্যাত সংগীত শিল্পী পিটার হিমেলম্যানকে। 'দ্য ওয়ালপ্লাওয়ার্স' ব্যান্ডদলের লিড সিঙ্গার বব ডিলানের ছেলে জ্যাকব ডিলান। বড় ছেলে জেসে ডিলান একজন ফিল্ম ডিরেক্টর ও সফল বিজনেসম্যান।
১৯৮৬ সালের ৪ জুন বব ডিলান তাঁর ব্যাকআপ সিঙ্গার ক্যারোল ডেনিসকে বিয়ে করেন। তাঁদের সন্তান ক্যারোলিন ডেনিসের জন্ম তাঁদের বিয়ের আগে ১৯৮৬ সালের ৩১ জানুয়ারি। ১৯৯২ সালে ক্যারোল ও ডিলানের মধ্যে ডিভোর্স হয়। তাঁদের এই সন্তানের কথা অবশ্য ২০০১ সাল পর্যন্ত সিকরেট ছিল। ২০০১ সালে বব ডিলানের আত্মজীবনীমূলক বই 'ডাউন দ্য হাই্ওয়ে: দ্য লাইফ অব বব ডিলান' প্রকাশিত হলে সেখানে ক্যারোলিন ডেনিসের বিষয়টি জানা যায়।
বব ডিলানের বিখ্যাত অ্যালবামগুলো হলো- বব ডিলান (১৯৬২), ব্রিংগিং ইট অল ব্যাক হোম (১৯৬৫), হাইওয়ে ৬১ রিভিজিটেড (১৯৬৫), ব্লন্ডে অন ব্লন্ডে (১৯৬৬), ব্ল্যাড অন দ্য ট্রাকস (১৯৭৫), ও মার্সি (১৯৮৯), টাইম আউট অব মাইন্ড (১৯৯৭), লাভ অ্যান্ড থেফট (২০০১), মডার্ন টাইমস (২০০৬)। চলচ্চিত্র নির্মাতা ডিএ পেনেবাকের বব ডিলানের উপর নির্মাণ করেন প্রামাণ্য চলচ্চিত্র 'ডোন্ট লুক ব্যাক (১৯৬৭)। বব ডিলানের লেখা বইগুলো হলো- তারানতুলা (১৯৭১), রাইটিংস অ্যান্ড ড্রয়িংস (১৯৭৩), ডাউন দ্য হাই্ওয়ে: দ্য লাইফ অব বব ডিলান (২০০১), ক্রনিকেলস (২০০৪) এবং নেভার এন্ডিং টুর। এছাড়া বব ডিলানের উপর যে সব ফিল্ম নির্মিত হয়েছে সেগুলো হলো- Dont Look Back / D. A. Pennebaker, 1967; Eat the Document / D. A. Pennebaker, Howard Alk, Bob Dylan, 1971; Pat Garrett & Billy The Kid / Sam Peckinpah, 1973; Renaldo & Clara / Bob Dylan, 1978; The Last Waltz / Martin Scorsese, 1978; Hard to Handle / Gillian Armstrong, 1986; Hearts of Fire / Richard Marquand, 1987; Masked and Anonymous / Larry Charles ; written by Bob Dylan and Larry Charles, 2003; No Direction Home / Martin Scorsese, 2005; I’m Not There / Todd Haynes, 2007; The Other Side of the Mirror : Bob Dylan Live at the Newport Folk Festival, 1963-1965. / Murray Lerner, 2007.
মার্কিন কিংবদন্তি শিল্পী ও গীতিকার বব ডিলানকে এ বছর সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত করে সুইডিশ নোবেল কমিটি বিতর্ক এড়িয়ে নিজেরাই বরং সমৃদ্ধ হয়েছে। এ বছর সম্ভাব্য নোবেল পুরস্কারের সংক্ষিপ্ত তালিকায় যে ৫৬ জন ছিল, সেখানে বব ডিলান ছিলেন না। নোবেল কমিটি এক বিবৃতিতে জানায়, 'বব ডিলান একজন আইকন। সমকালীন সংগীতের ওপর তাঁর প্রভাব অসাধারণ। আর তিনি হয়ে উঠেছেন বিকল্প সাহিত্যের ধারাবাহিক উৎস।' আগামী ১০ ডিসেম্বর স্টকহোমে বব ডিলানের হাতে আনুষ্ঠানিকভাবে তুলে দেওয়া হবে নোবেল পুরস্কার সনদ ও পুরস্কারের ৮০ লাখ ক্রোনার (৯ লাখ মার্কিন ডলার)। জয়তু বব ডিলান। জয়তু মেহনতী মানুষের গান।
...................................
১৪ অক্টোবর ২০১৬
©somewhere in net ltd.