![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
২০১৩ সালের ‘পিতা-মাতার ভরণপোষণ’ নামে একটি আইন পাস হয়েছিলো। এ আইনে বলা হয়েছে, প্রত্যেক সন্তানকে তাঁর মা-বাবার ভরণপোষণ দিতে হবে। কোনো মা-বাবার একাধিক সন্তান থাকলে সে ক্ষেত্রে সন্তানেরা নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করে তাঁদের ভরণপোষণ নিশ্চিত করবেন। আর তা না করলে তাঁদের শাস্তি পেতে হবে।
যে জাতি আসলে মানুষিক ভাবে উন্নত নয় সে জাতি কখনো একটা উন্নত রাষ্ট্র উপহার দিতে পারে না। আর সেটার প্রমান আমরা বাংলাদেশীরা। পিতা মাতার ভরণ পোষণ নামে যে আইনটি করে হয়েছিলো সেটার যথাযথ প্রয়োগ থাকলে বোধ করি আজ বৃদ্ধাশ্রম বলে কোন শব্দ থাকতো না। ২০১৩ সালের পর আজ ২০১৬ আতিবাহিত হচ্ছে। আমার জানা মতে এই কয় বছরে দেশের ভেতরে আরো বেসকিছু বৃদ্ধাশ্রম গড়ে উঠেছে। আমাদের দেশে নতুন আইন তৈরি হতে যেমন সময় লাগে না ঠিক তেমনি সেই আইন ভঙ্গ করতেও সময় লাগে না। আইনের সঠিক প্রয়োগ হলে আজ নিশ্চয় দেশের ভেতরে বৃদ্ধাশ্রম বলে কিছু থাকতো না। আইনে বলা আছে বাবা মায়ের অসম্মতিতে কোন ভাবেই তাদের কে সন্তানদের কাছ থেকে আলাদা করে রাখা যাবে না। কিন্তু বর্তমানে যত অসহায় বাবা মায়েরা বৃদ্ধাশ্রমে বসবাস করছে তাদের বেসির ভাগই মনের উপর জোর করে সেখানে থাকছে। এবং ওইসব কুলাঙ্গার সন্তানেরাই তাদের কে সেখানে থাকতে বাধ্য করছে। অথচ ২০১৩ সালের পরে এই চিত্র দেখার কথা ছিলো না। আইনে এটাও বলা আছে কোন ভাবে যদি প্রমানিত হয় যে সন্তান তাদের বাবা মায়ের কোজ নিচ্ছে না তাহলে তাদের কে এক লাখ টাকা জরিমানাসহ কারা ভোগ করতে হবে।
বাংলাদেশের আইন শুধু কাগজে কলমেই সিমাবদ্ধ। বাস্তবতা একেবারেই ভিন্ন। যে বাবা মা তার সন্তানদের নিজে না খেয়ে কোলে পিঠে করে মানুষ করেছে সেই বাবা মাকে বৃদ্ধ বয়সে ভরণ পোষণ করাতে বাধ্য করার জন্য দেশে আইন হয়! এটা যেমন লজ্জার ঠিক তেমনি সেই কুলাঙ্গার সন্তানেরা সেই আইন ও অবমাননা করে অসহায় বাবা মায়ের বৃদ্ধাশ্রমে রেখে কোন খোঁজ নেয় না। একটা জাতির জন্য এর থেকে বড় লজ্জার আ কি হতে পারে।
নতুন নুতন আইন করেই যে দায়বন্ধতা কেটে যায় এই সংস্কৃতি থেকে অবশ্যই আমাদের কে বের হয়ে আসতে হবে। যাঁদের জন্য এ আইন, সেই বয়স্ক ব্যক্তিদের আইনটি সম্পর্কে জানাতে হবে। আইন তৈরি করেই সরকারের দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। আইন তৈরির পরে জনগণকে তা অবহিত করতে হবে। গেজেট পাস মানেই জনগণকে জানানো হলো, তা নয়। জনগণকে আইন সম্পর্কে জানানো ও আইন মানতে উদ্বুদ্ধ করতে সরকারের পক্ষ থেকে পদক্ষেপ নিতে হবে। আমাদের দেশের বৃদ্ধ বাবা-মায়েরা যদি জানতে পারেন যে তাঁদের পক্ষে এমন একটি আইন রয়েছে, তা হলে অনেকেই আইনের আশ্রয় নেবেন। কাজেই গণমাধ্যমগুলোতে এই আইন সম্পর্কে বেশি বেশি প্রচার চালাতে হবে। তা না হলে এই আইন কাগুজে আইন হয়েই থাকবে।
বৃদ্ধাশ্রমে থাকা অসহায় বাবা মাসহ যত বয়স্ক মানুষেরা আজ সন্তান থেকে আলাদা বসবাস করছে খোঁজ করলে দেখা যাবে তাদের সবারই সন্তান আছে এবং সেই সন্তানেরা তাদের কোন ভাবেই খোঁজ খবর নিচ্ছে না। আবার এই বয়স্ক মানষদের আইনত সহায়তা করার জন্য ও বাংলাদেশে তেমন কোন সংঘ বা সংস্থা তৈরি হয়নি।
জাতি হিসেবে আমরা কতটা বড় মনের সেটা এই ধরনের অবস্থা দেখলেই বোঝা যায়। যে জাতি তার পিতা মাতা কে সম্মান করতে জানে না সে জাতি কখনোই উন্নত করতে পারে না। আজ যারা বৃদ্ধ তারা নিজেদের জীবনের সকল সময়, ধন সম্পদ বিনিয়োগ করেছিলেন সন্তানের জন্য, নিজের জন্য রাখেননি কিছুই। কিন্তু বৃদ্ধ বয়সে সন্তানের কাছ থেকে এর একটি ক্ষুদ্র অংশও তারা পাচ্ছেন না। কখনও দেখা যায় সন্তান তার নিজের পরিবারের খরচ যোগাতে হিমশিম খাচ্ছে, তাই পিতা-মাতাকে মনে করছে বোঝা। নিজে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে একটু ভাল থাকার জন্য বাবা-মার ঠাঁই করে দিয়েছেন বৃদ্ধাশ্রমে। আবার এমনও দেখা যায় যে সন্তানের টাকা পয়সার অভাব নেই, কিন্তু পিতা-মাতাকে নিজের কাছে রাখার প্রয়োজন বোধ করছেন না, বা বোঝা মনে করছেন। হয় নিজেই পাঠিয়ে দিচ্ছেন বৃদ্ধাশ্রমে, নয়ত অবহেলা দুর্ব্যবহার করে এমন অবস্থার সৃষ্টি করছেন যেন তাদের পিতা-মাতা নিজেরাই সরে যান তার সাধের পরিবার থেকে। কেউ কেউ আবার এমনও বলেন, তার টাকার অভাব না থাকলেও সময়ের অভাব আছে, পিতা-মাতাকে দেখভাল করা বা তাদের সঙ্গে কথা বলার মতো পর্যাপ্ত সময় তার নেই। তাই বাবা বা মা একা একা নির্জন থাকার চেয়ে বৃদ্ধনিবাসে অন্যদের সঙ্গে একত্রে সময় কাটানোই তাদের জন্য ভালো। একবার বৃদ্ধনিবাসে পাঠাতে পারলেই যেন সকল দায়মুক্তি। এভাবে নানা অজুহাতে পিতা-মাতাকে দূরে সরিয়ে দেয়া হচ্ছে। অনেক নামী-দামী বুদ্ধিজীবী, শিল্পী, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, শিক্ষক, চাকরিজীবী যারা এক সময় খুব বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী ছিলেন, বৃদ্ধ বয়সে এসে নিজের সন্তানের দ্বারাই অবহেলা ও বঞ্চনার শিকার হয়ে বৃদ্ধাশ্রমের স্থায়ী বাসিন্দা হতে বাধ্য হচ্ছেন। অনেক সন্তান বা আত্মীয়-স্বজন আর তাদের কোন খবরও নেন না। তাদের দেখতে আসেন না, এমনকি প্রয়োজনীয় টাকা-পয়সা বা জিনিসপত্রও পাঠান না। বাড়িতে কোন অনুষ্ঠানে বা ঈদের আনন্দের সময়ও পিতা-মাতাকে বাড়িতে নেন না। এমনও শোনা যায়, অনেকে পিতা বা মাতার মৃত্যুশয্যায় বা মারা যাবার পরও শেষবার দেখতে যান না। বৃদ্ধনিবাসের কর্তৃপক্ষই কবর দেয়া বা যে কোন শেষকৃত্য করার সকল ব্যবস্থা করেন, অথচ তার প্রিয় সন্তানরাই কোন খবর রাখেন না। হয়তো এটাই নিয়তি।
কিন্তু আমাদের দেশের আইন তো সে কথা বলে না। আইনের সঠিক প্রয়োগ হলে নিশ্চয় বৃদ্ধাশ্রম শব্দটা আমাদের দেশে থাকার কথা নয়। আমি বিশ্বাস করি আমাদের দেশে যে পরিমান আইন আছে সেটার যদি সঠিক প্রয়োগ সম্ভব হয় তাহলে বাংলাদেশ বিশ্বের বুকে মাথা উচু করে দাড়াতে পারবে। কিন্তু তার জন্য আগে আমাদের দেশের মানুষের মানুষিকতার পরিবর্তন দরকার। মানুষিকতা বড় হলে তখন এই সব আইন ও লাগবে না। আইন তৈরি করেই সরকারের দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। আইন তৈরির পরে জনগণকে তা অবহিত করতে হবে। গেজেট পাস মানেই জনগণকে জানানো হলো, তা নয়। প্রতিদিন দু চারটা আইন করে কাগজ না ফুরিয়ে একটা আইন করে তার যথাযথ প্রয়োগ আগে নিশ্চত করে তারপর নতুন আইনের কথা ভাবুন। আর সেটাই দেশ ওজাতির জন্য মঙ্গল হবে।
আইন তৈরি করার মধ্যেই যদি দায়িত্ব শেষ হয়ে যেতো তাহলে আজ দেশে এত অসহায় বাবা মা তাদের সন্তানদের কাছ থেকে দুরে থাকতো না। দেশের ভেতরে বৃদ্ধাশ্রমের এত ভীড় দেখা যেতো না। অসহায় বাবা মায়ের দির্ঘশ্বাসে পৃথিবীর বাতাশ ভারি হতো না, কেঁপে উঠতো না! দেশের ভেতরে এইসব কুলাঙ্গার সন্তান বাবা মাকে দুরে রেখে বসবাস করতে পারতো না।
বৃদ্ধাশ্রম কামনা করি না। কামনা করি বাবা মায়ের শেষ ঠিকানা হোক তার সন্তানদের আবাস স্থল। প্রতিটা বাবা মা তার সন্তানদের পরম যত্নে বেঁচে থাকবে মৃত্যর আগ পর্যন্ত। আমাদের মনে রাখা উচিত আজ যিনি সন্তান, তিনিই আগামীদিনের পিতা কিংবা মা। বৃদ্ধ বয়সে এসে মা-বাবারা যেহেতু শিশুদের মতো কোমলমতি হয়ে যায়, তাই তাদের জন্য সুন্দর জীবনযাত্রার পরিবেশ তৈরি করাই সন্তানের কর্তব্য। আর যেন কখনো কোনো পিতা-মাতার ঠিকানা বৃদ্ধাশ্রম না হয়, সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। তাদের জন্য তৈরি করতে হবে একটা নিরাপদ ও সুন্দর পৃথিবী।
©somewhere in net ltd.