নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

সাংবাদিক ও লেখক

রিজভী

https://www.facebook.com/Rizvibd

রিজভী › বিস্তারিত পোস্টঃ

মেহেরজান : ইতিহাস পুনঃনির্মাণের ডিসকোর্স

০১ লা ফেব্রুয়ারি, ২০১১ রাত ১০:৫৩

ইতিহাস নির্মাণের কোন বিষয় নয়। ঘটমান প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে ইতিহাস সৃষ্টি হয়। তবে ব্যক্তি বা গোষ্ঠী নিজের প্রয়োজনে ইতিহাসকে পুনঃনির্মাণ করতে পারে। আর এই পুনঃনির্মাণের প্রক্রিয়া যখন মূল ইতিহাসকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে তখনই তা আলোচনার ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। ইতিহাস পুনঃনির্মাণের এই প্রক্রিয়া সাধারণত মন্থর গতিতে ঘটে। রাষ্ট্র-যন্ত্র ইতিহাস পুনঃনির্মাণের ক্ষেত্রে অনেক সময় মূল ক্রিয়ানক হিসেবে কাজ করে। আবার রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় ব্যক্তি বা গোষ্ঠীও অনেক ক্ষেত্রে ‘সুনির্দিষ্ট’ ও ‘উদ্দেশ্যেমূলক’ কারণে ইতিহাসকে পুনঃনির্মাণ করে। ফলে বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় পুনঃনির্মিত ইতিহাসটি তখন ডিসকোর্স হিসেবে অধ্যয়ন করা জরুরী হয়ে দাঁড়ায়। এক্ষেত্রে সাম্প্রতিক সময়ে (২১ জানুয়ারি, ২০১১) মুক্তিপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র ‘মেহেরজান’ কিভাবে ইতিহাসকে পুনঃনির্মাণ করেছে সেটি আলোচনা দাবি রাখে।



মেহেরজান ছবির উপজীব্য : তরুণ চিত্র নির্মাতা রুবাইয়াত হোসেন পরিচালিত ‘মেহেরজান’ চলচ্চিত্রটি ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়কালের প্রেক্ষিতে নির্মিত হয়েছে। চলচ্চিত্রটির মূল উপজীব্য যুদ্ধ ও ভালোবাসা। একজন পাকিস্তানি বেলুচ সেনার সঙ্গে বাংলাদেশী কিশোরী মেহেরের যুদ্ধকালীন সময়ে গড়ে ওঠা প্রেমের বিভিন্ন দৃশ্যপট ও ঘটনাপ্রবাহ আমরা এই চলচ্চিত্রে দেখতে পাই। এছাড়া চলচ্চিত্রে উঠে এসেছে ১৯৭১ সালে মুসলিম লিগ, ছাত্র ইউনিয়ন, মুক্তিবাহিনী, শান্তি কমিটি প্রভৃতির কয়েকটি নমুনায়ন। নির্মাতা তার চলচ্চিত্রকে বাস্তবতার সঙ্গে ফোক-ফ্যান্টাসির সংমিশ্রণ বলে আখ্যায়িত করেছেন। (দৈনিক প্রথম আলো:২৬ জানুয়ারি, ২০১১; পৃষ্ঠা-১৩) তবে পরিচালকের ভাষ্য ছাপিয়ে চলচ্চিত্রটির বির্তকের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে মুক্তিযুদ্ধের সময়কালের যে বিভিন্ন প্রাসঙ্গিকতা পরিচালক তার চলচ্চিত্রে তুলে এনেছেন, সেগুলোর অধিকাংশই পরিচালক নিজের মতো করে রিপ্রেজেন্ট করেছেন। (দৈনিক প্রথম আলো:২৬ জানুয়ারি, ২০১১; পৃষ্ঠা-১২)।



মেহেরজান ছবির কাহিনী : প্রথমেই মেহেরজান ছবির কাহিনী সংক্ষেপে বলে নেয়া যাক, এতে করে পাঠকদের মনে চলচ্চিত্রটি সম্পর্কে সম্যক ধারণা জন্ম নেবে। মেহেরজান ছবিটিতে দুটি ভিন্ন ভিন্ন সময়, দুটি ভিন্ন প্রেক্ষাপট, দুটি ভিন্ন সামাজিক অবস্থান উপস্থাপিত হয়েছে। পরিণত বয়সের ভাস্কর নিভৃতে শহরে বসে শিল্প চর্চা করছেন। আবার তিনি পুরনো ডায়েরির পাতা খুললেই পুরনো সময়ে ফিরে যান। ফিরে যান ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের সময়ে। সারাহ নামের এক যুদ্ধশিশু মায়ের সন্ধানে এসে আবিষ্কার করে অতীতকে। মেহেরকে সে দাঁড় করিয়ে দেয় অতীতের সামনে। মেহেরের খালাতো বোন নীলার গর্ভে জন্ম নেওয়া যুদ্ধশিশু সারাহকে অতীতের ঘটনা খুলে বলে মেহের। এই বয়ানের মধ্য দিয়ে মেহের তার অতীতকে আবার দেখে। ৭১ এর উত্তাল সময়ে বাবা-মার সঙ্গে ঢাকা ছেড়ে গ্রামে নানার বাড়িতে আশ্রয় নেয় মেহের। বিছানায় শুয়ে শুয়ে কিংবা কাত হয়ে সে ডায়েরি লেখে। ডায়েরির পাতায় তুলে রাখে যুদ্ধাকালীন সময়ের স্মৃতি। একসময় পাকিস্তানী বাহিনীর হাতে নির্যাতিত খালাতো বোন নীলা উপস্থিত হয়। নীলা আত্মগ্লানিতে না ভুগে প্রতিশোধের উপায় খোঁজে। যুদ্ধের উত্তাল সময়ে মেহের গ্রামময় ঘুরে বেড়ায়। পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে ধরা পড়ার আশঙ্কা থেকে তাকে বাঁচায় পলাতক এক পাকিস্তানী বেলুচ সেনা। আহত সৈন্যটির প্রতি মেহের দূর্বল হয়ে পড়ে। শত্রুপক্ষের সেনা হওয়া সত্ত্বেও ওয়াসিমকে শুশ্রুষা করে ভালো করে তোলে মেহের। ওয়াসিমের প্রেমে পড়ে যায় মেহের। কিন্তু শত্রুপক্ষের একজন সেনাকে ভালোবাসার অপরাধে পারিবারিক বাধার সম্মুখীন হয় সে। ওয়াসিমকে মুক্তিযোদ্ধারা আটক করে রাখে। এক রাতের আঁধারে ওয়াসিমকে নৌকায় উঠিয়ে বিদায় জানায় মেহের। কিন্তু ওয়াসিমকে সে কখনোই ভুলতে পারে না। তবে মেহেরের মনে পাকিস্তানি সেনাকে ভালোবাসার যে হিনমন্যতা ছিল তা যুদ্ধশিশু সারাহ কাটিয়ে দেয় এবং মেহের তার ভালোবাসার প্রতি আস্থার প্রকাশ ঘটায় ভাস্কর্য নির্মাণের মাধ্রমে যেটি ছবির শেষ দৃশ্যে দেখানো হয়। গৎবাঁধা ব্যাখ্যায় এটিই হলো মেহেরজান ছবির কাহিনীর সারসংক্ষেপ।



মেহেরজান ছবিতে যেভাবে ইতিহাসকে পুনঃনির্মাণ করা হয়েছে : মোটাদাগে মেহেরজান ছবিতে ৭১’র মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে পুনঃনির্মাণের বিষয়টিকে ৩টি প্রাসঙ্গিকতায় বিভক্ত করে আলোচনা করা হলো।



১. মুক্তিযোদ্ধাদের সংসারী হিসেবে নির্মাণের ডিসকোর্স : মেহেরজান ছবিতে ৩ ধরণের মুক্তিযাদ্ধাকে পরিচালক নির্মাণ করেছেন। প্রথমজন, মেহেরের খালাত ভাই। সে মেহেরকে ভালোবাসে। ছবিতে দেখানো হয়, সে সবাইকে জানিয়ে যুদ্ধে গেলেও কিছুদিন পরই যুদ্ধ থেকে ফিরে আসে। কারণ হিসেবে তিনি তার মাকে বলেন, ‘মা আমি মরতে চাই না। আমি বিয়া করতে চাই!’ দ্বিতীয়জন, মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার। সে খাজাসাবের এলাকায় তার দলবল নিয়ে আশ্রয় নিয়েছে। খাজাসাবের কাছে সে এ্যাকশনের অনুমতি চায়। কিন্তু খাজাসাহেব তাকে অনুমতি দেন না। আর তৃতীয়জন হিসেবে আরেক মুক্তিযোদ্ধাকে দেখানো হয়েছে, যে খাজাসাহেবের মেয়েরে মানসিক বিকারগ্রস্থ মেয়েকে বিয়ে করে সংসারি হতে চায়। ছবিতে তার সংলাপ ছিল এরকম যে- ‘যুদ্ধে যুদ্ধে আমি ক্লান্ত!’ অর্থাৎ, এই ৩ ধরণের মুক্তিযোদ্ধার মাধ্যমে পরিচালক তুলে ধরতে চেয়েছেন যে, মুক্তিযুদ্ধের সময় এই ৩ ধরণের মুক্তিযোদ্ধা ব্যতিত অন্য কোন ধরণ খোঁজাটা অমূলক! তবে বাস্তব হলো বিভিন্ন দলিল-দস্তাবেজ ঘেঁটে দেখা যায়, মুক্তিযোদ্ধাদের অধিকাংশই পরিবার-পরিজন ও সংসারের মায়া ফেলে যুদ্ধে গিয়েছেন। অথচ মেহেরজান ছবিতে মুক্তিযোদ্ধাদেরকে ‘সংসারী’ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে।



২. যুদ্ধের সময় শান্তিপূর্ণ পরিবেশের ডিসকোর্স : মেহেরজান ছবিতে পাকিস্তানী সেনার সঙ্গে গ্রামের বিভিন্ন স্থানে মেহেরের ঘুরে-বেড়ানো ও প্রেমের দৃশ্য দর্শকদের মনে এই উপলব্ধিই জাগ্রত করে যে, স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় দেশে শান্তিপূর্ণ অবস্থা বিরাজমান ছিল! অথচ যুদ্ধের বিভীষণ অবস্থার বিভিন্ন দৃশ্যপট আমরা শহীদ জননী জাহানারা ইমামের ‘একাত্তরের দিনগুলো’ ও জহির রায়হানের ‌'স্টপ জেনোসাইড'-এ দেখতে পাই। সেখানে দেখা যায়, শুধু শহরাঞ্চলেই নয়, বরং প্রত্যন্ত গ্রামের মানুষদেরকেও দিন-রাত সবসময়ই পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আক্রমণের জন্য সতন্ত্র থাকতে হয়েছে। এক কথায় বললে, বাংলাদেশের এমন কোন শান্তিপূর্ণ স্থানের অস্তিত্ব আদৌ ছিল না, যেমন মেহেরজান ছবিতে দেখানো হয়েছে।



৩. পাকিস্তানী সেনাকে হিরো ও মুক্তিযোদ্ধাকে ভিলেন নির্মাণের ডিসকোর্স : মেহেরজান ছবির কাহিনীতে দেখানো হয়, মেহেরকে ভালোবেসে বিয়ে করতে চায় তার খালাতো ভাই। অন্যদিকে কিশোরী মেহের ও পাকিস্তানি সেনা ওয়াসিম একে অন্যকে ভালোবাসে। তাদের ভালোবাসার বাধা হয়ে দাঁড়ায় মেহেরের খালাতো ভাই। সে ওয়াসিমকে বন্দী করে নিয়ে আসে ও হত্যা করতে চায়। তখন মেহের তার নানা ও বাবার কাছে কাকুতি-মিনতি করে ওয়াসিমের প্রাণ ভিক্ষা চায়। মেহেরের নানা ওয়াসিমের হত্যা রোধ করেন। এর পরের দৃশ্যেই দেখানো হয় খালাত ভাই মেহেরকে বলছে, ‘আমি জেনুইনলি তোমাকে ভালোবাসি।’ এমন সময় মেহের তার গালে একটি চড় দেয়। এই দৃশ্যের মাধ্যমে হিরো হিসেবে ওয়াসিমকে প্রতিষ্ঠা ও ভিলেন রূপে মেহেরের খালাতো ভাইকে চিত্রিত করা হয়েছে। অর্থাৎ মুক্তিযোদ্ধাদের বিপরীতে পাকিস্তানী সেনাকে ধনাত্মক হিসেবে পরিচালক তার ছবিতে নির্মাণ করেছেন। অথচ মুক্তিযুদ্ধের মূল ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে, মুক্তিযোদ্ধাদের অধিকাংশই স্ত্রী ও প্রেমিকাকে ফেলে যুদ্ধে গিয়েছেন, যেটি মেহেরজান ছবিতে অনুপস্থিত।



মেহেরজান ছবিতে ইতিহাসের পুনঃনির্মাণ ছাড়াও সংলাপ ও পোষাক নির্বাচনের অসংগতি চোখে পড়ার মতো। এছাড়া কাহিনীর বিন্যাসের ক্ষেত্রে ধারাবাহিকতা রক্ষা করা হয়নি। অপ্রাসঙ্গিকভাবে সমকামিতার বিষয়টি টেনে আনার চেষ্টা করেছেন পরিচালক। তবে এই আলোচনাটিতে সে সকল বিষয়গুলোর দিকে না গিয়ে ইতিহাসের পুনঃনির্মাণের ক্ষেত্রে মেহেরজান কিভাবে ডিসকোর্স হয়ে উঠেছে কেবল সেটি নিয়েই আলোকপাত করা হয়েছে।





[ দৈনিক বাংলাবাজার পত্রিকার উপ-সম্পাদকীয়তে আজ (১ ফেব্রুয়ারি, ২০১১) প্রকাশিত ]

মন্তব্য ২ টি রেটিং +৩/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ০৭ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১১ ভোর ৪:২৬

মাহফুজুল হক হান্নান বলেছেন: চমৎকার লেখাটির জন্য ধন্যবাদ। পড়লাম এবং জ্ঞান আহরণ করলাম। কেমন আছ ছোট ভাই। দোয়া রইল।

১৪ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১১ দুপুর ১২:০০

রিজভী বলেছেন: ধন্যবাদ হান্নান ভাই।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.