![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে , আমি ও সেই দলের সমর্থক হয়ে যাই ।
গত শনিবারের হেফাজতে ইসলামের মতিঝিল সমাবেশের পর দেশ-বিদেশ থেকে আমার অনেক পরিচিত জন নিয়মিত প্রশ্ন করছেন, বাংলাদেশ কি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার নতুন তালেবানি রাষ্ট্র হতে যাচ্ছে? এখন থেকে কি দেশের মানুষকে আফগানিস্তানের মতো তোরাবোরা গুহায় বাস করতে হবে? এর মধ্যে আমার এক সাবেক সহকর্মী সপরিবারে দেশ ছাড়লেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের একটি নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি পেয়েছিলেন অনেক আগে। এত দিন যাননি। ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের আমার সেই সহকর্মী বলতেন, মুক্তিযুদ্ধে আমার পিতা জীবন দিয়েছেন। সেই দেশ ছেড়ে তো যেতে পারি না। ২০০১ সালের নির্বাচনের পর বাড়িভিটা হারিয়েছেন। সহ্য করে নিয়েছেন, আবার সুদিন এলে তা ফেরত পাবেন এই আশায়। তাঁর মেইল পেলাম কদিন আগে। শেষ পর্যন্ত দেশটা ছাড়তেই হলো। আসার সময় কাউকে বলে আসতে পারেননি বলে সহকর্মী ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন। গত ৪০ বছরে এমনভাবে এই দেশ ছেড়েছে আমার অনেক পরিচিত জন।
বাংলাদেশে কত ছাত্র কওমি মাদ্রাসায় পড়ে তার সঠিক হিসাব পাওয়া মুশকিল। একবার ফজলুল হক আমিনী বলেছিলেন ৫০ লাখ। হাটহাজারীর কওমি মাদ্রাসাটি ওহাবি মাদ্রাসা বলে পরিচিত যদিও, এটির প্রাতিষ্ঠানিক নাম হচ্ছে ‘আল-জামিয়াতুল আলিয়া দারুল উলুম মইনুল ইসলাম মাদ্রাসা’। প্রতিষ্ঠাকাল ১৯০১ সাল। বাংলাদেশের বৃহত্তম এই মাদ্রাসাটি এ দেশের হাজার হাজার অনিয়ন্ত্রিত কওমি মাদ্রাসা নিয়ন্ত্রণকারী তিনটি মাদ্রাসার একটি। এই নিয়ন্ত্রণকারী মাদ্রাসাগুলোকে বলা হয় বেফাকুল মাদ্রাসিল। অন্য দুটির একটি চট্টগ্রামের পটিয়ায় এবং তৃতীয়টি ঢাকার লালবাগে ফজলুল হক আমিনীর মাদ্রাসা। আমিনী অনেক আগেই বিএনপির হাত ধরে রাজনীতিতে প্রবেশ করেছিলেন, সাংসদও হয়েছিলেন। হাটহাজারী মাদ্রাসার কেউ রাজনীতিতে খোলাখুলিভাবে প্রবেশ করেননি যদিও, এখন মাদ্রাসার পরিচালনা বোর্ডের একাধিক সদস্য জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত বলে অভিযোগ আছে। ছাত্রদের একটি বিরাট অংশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। এই মাদ্রাসায় মধ্যপ্রাচ্য থেকে প্রচুর পরিমাণে ফান্ড এলেও চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীরাও এখানে নিয়মিত বড় অঙ্কের অর্থ চাঁদা দেন। আবার এই ব্যবসায়ীদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ আওয়ামী লীগ ঘরানার। তাঁদের একটা বিশ্বাস আছে, এই মাদ্রাসা সব সময় আওয়ামী লীগের পক্ষে ছিল। যদিও এই আসনে সর্বশেষ আওয়ামী লীগ নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছিল ১৯৭৩ সালে। বিজয়ী প্রার্থী আবদুল ওহাব এক শ ভাগ সৎ, যোগ্য, নির্লোভ, নিরহংকারী আপাদমস্তক রাজনীতিবিদ ছিলেন। মাঠের লাঙলটা সযত্নে তুলে রেখে সংসদ অধিবেশনে যোগ দিতে আসতেন। একাত্তরের সাকা চৌধুরীর দক্ষিণ হস্ত পর্যন্ত এখান থেকে একাধিকবার সাংসদ নির্বাচিত হয়েছেন। তবে এই এলাকায় আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে অনেক উন্নয়নমূলক কাজ হয়েছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ও হাটহাজারীতে প্রতিষ্ঠিত।
এই মাদ্রাসাকেন্দ্রিক হেফাজতে ইসলামের জন্ম ২০১০ সালে, যখন সরকার নতুন শিক্ষানীতি প্রণয়ন করল। অনেক কওমি মাদ্রাসার কর্তাব্যক্তি ও জামায়াতপন্থী ব্যক্তি এই শিক্ষানীতির মধ্যে অনেক ইসলামবিরোধী বিষয় আবিষ্কার করলেন। যখন নতুন নারীনীতি সংসদে গৃহীত হলো, এটাও তাঁদের কাছে গ্রহণযোগ্য হলো না। হাটহাজারী মাদ্রাসার শিক্ষক-ছাত্ররা চট্টগ্রাম শহরে এসে প্রতিবাদ সভা করার চেষ্টা করলে পুলিশের বাধার মুখে তা পণ্ড হয়ে যায়।
মাদ্রাসার আমির বা বড় হুজুর আল্লামা শাহ আহমদ শফীর বয়স এখন নব্বইয়ের কাছাকাছি। তিনি বয়সের ভারে অনেকটা ন্যুব্জ। এই মাদ্রাসার সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ১০ বছর বয়স থেকে, যখন তিনি এখানে ছাত্র হিসেবে ভর্তি হন। যাঁরা এই মাদ্রাসা থেকে পাস করে গিয়েছেন, তাঁদের সঙ্গে মাদ্রাসার একটা যোগাযোগ আছে। এটি বেশ চাতুর্যের সঙ্গে জামায়াত সরকারবিরোধী আন্দোলনের স্বার্থে ব্যবহার করেছে। দলটি বেশ কিছুদিন ধরে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচারের মুখোমুখি যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের মুক্তির জন্য আন্দোলনের নামে সন্ত্রাস সৃষ্টি ও ভয়াবহ সব নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড করেও যখন সুবিধা করতে পারছিল না, তখন তারা এই হেফাজতের শরণাপন্ন হয়েছে। তাদের নেতা সাঈদীর ফাঁসির হুকুম হলে তারা চাঁদে সাঈদীকে দেখা গেছে—এই বানোয়াট ও অসত্য তথ্য ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেশে ব্যাপক হাঙ্গামা সৃষ্টি করে। তারপর বলে শাহবাগে যারা গণজাগরণ চত্বর পরিচালনা করে, তারা নাস্তিক এবং ব্লগে তারা মহান আল্লাহ তাআলা ও হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর নামে কুরুচিপূর্ণ বক্তব্য লিখে অপপ্রচার করেছে। শাহবাগের তরুণ প্রজন্ম বারবার বলার চেষ্টা করেছে এমন কোনো কাজ তারা করেনি। কিন্তু কে শোনে কার কথা। আরও দুঃখজনক হচ্ছে, এই ভিত্তিহীন গুজবটি খোদ বিরোধীদলীয় নেতাও সমর্থন করে আগুনে ঘি ঢাললেন। এই কথাগুলো বড় হুজুরের কাছে পৌঁছে গেল। তিনি তাঁর সভা পারিষদদের প্ররোচনায় জামায়াতের এই পাতা ফাঁদে পা দিয়েছেন বলে হাটহাজারী ও চট্টগ্রামের অনেকে জানিয়েছেন। যে মাদ্রাসার ছাত্রদের পত্রিকা পড়া নিষেধ, টিভি দেখা নিষেধ, তারা ব্লগ বুঝবে, তা বিশ্বাসযোগ্য নয়।
চট্টগ্রামের বাইরে আগে হেফাজতের কোনো শাখা-প্রশাখা না থাকলেও রাতারাতি দেশের প্রায় সবগুলো কওমি মাদ্রাসায় হেফাজতের জন্ম হলো। সরকার ৬ এপ্রিল ঢাকার বাইরে থেকে লংমার্চ করে তাদের ঢাকায় আসতে বাধা দিয়ে তাদের ব্যক্তিগত এবং দেশের জানমালের নিরাপত্তা বিধান করেছে, এটা স্বীকার করতে দ্বিধা নেই। কারণ, এত বিশাল সমাবেশে যেকোনো মুহূর্তে একটা বড় ধরনের নাশকতামূলক দুর্ঘটনা ঘটানো খুব সহজেই সম্ভব ছিল। এবং সেটি হয়তো ঘটাত হেফাজতের বাইরের কেউ। তখন পুরো দায়দায়িত্ব বর্তাত সরকারের ওপর। এর ফলে জামায়াত-বিএনপি জোট হরতাল আর নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডের বাইরে সরকারবিরোধী আন্দোলনে যে গতি আনার চেষ্টা করছে, তাতে হয়তো কিছুটা সফল হতো। ৬ তারিখ ঢাকার মতিঝিলে হেফাজতের ব্যানারে কয়েক লাখ কওমি মাদ্রাসার ছাত্র, শিক্ষক, মসজিদের ইমাম, জামায়াত, বিএনপি, ছাত্রশিবির, ছাত্রদলের কর্মী সমবেত হয়েছিলেন। সমাবেশে হেফাজত তাদের ১৩ দফা দাবিনামা পেশ করেছে, যা মোটামুটি বাংলাদেশকে একটি তালেবানি রাষ্ট্র বানানোর চেষ্টা। এই কর্মসূচির প্রতি আবার সমর্থন জানিয়েছেন বিএনপি ও জাতীয় পার্টির নেতারা। বাংলাদেশকে একটি তালেবানি রাষ্ট্র বানানোর স্বপ্ন কিছু পথভ্রষ্ট মানুষ অনেক দিন ধরে লালন করছেন। এঁদের মধ্যে সিলেটের মাওলানা হাবিবুর রহমান অন্যতম। অনেক আগেই তিনি প্রশ্ন করেছেন আফগানিস্তানে যদি আলেম-ওলামারা রাষ্ট্র পরিচালনা করতে পারেন, বাংলাদেশে কেন তাঁরা পারবেন না? তিনি নিজে আফগানিস্তানে গিয়ে তালেবানদের সঙ্গে যুদ্ধ করেছেন এবং ওসামা বিন লাদেনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। তিনি হয়তো জানেন না, এখন আফগানিস্তান কোনো আলেম-ওলামা শাসন করেন না। আফগানিস্তান শাসিত হয় আমেরিকান কামান আর বন্দুক দিয়ে। তিনিও সম্ভবত চান বাংলাদেশেও এমনটা ঘটুক।
হেফাজতের ঘোষিত ১৩ দফার অনেক দফাই বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটির মৌলিক কাঠামোতে আঘাত করবে এবং এগুলো সবই সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। দুর্ভাগ্যজনক হচ্ছে, আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বেশ দৃঢ়তার সঙ্গে বললেন, তাদের এই ১৩ দফা বিবেচনা করা হবে। অবশ্য পরে প্রধানমন্ত্রী বিবিসির সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে যথার্থই বলেছেন, যেসব দফা আমাদের রাষ্ট্রীয় মূল কাঠামো এবং সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক, সেসব দফা মানার কোনো সুযোগ নেই। হেফাজত তা মানে না। এখন তারা শরিয়াহ আইন বলবৎ করতে চায়। ১৩ দফার একাধিক দফাই নারীর স্বার্থবিরোধী। আমাদের সংবিধান বিসমিল্লাহ দিয়ে শুরু হয়েছে। তার পরও তারা সন্তুষ্ট নয়। তারা নারীনীতির বাতিল চায়, কারণ তারা নারীকে তার প্রাপ্য অধিকার দিতে চায় না। যে শিক্ষানীতি গণ্যমান্য ইসলামি চিন্তাবিদদের মতামতের ভিত্তিতে প্রণীত হয়েছে, তা-ও তাদের পছন্দ নয়। নারীদের অবাধ বিচরণ, একসঙ্গে কর্মক্ষেত্রে গমন, কাজ করা, স্কুল-কলেজ আর বিশ্ববিদ্যালয়ে একসঙ্গে পড়ালেখা করা তাদের দৃষ্টিতে হারাম। যদিও তাদের অনেকের ছেলেসন্তান এই কাজটি করে থাকেন। মোমবাতি জ্বালানোর মতো একেবারেই একটি ধর্মনিরপেক্ষ কাজও তারা সহ্য করবে না। এর অর্থ তাদের ১৩ দফা বাস্তবায়িত হলে সিলেটের হজরত শাহজালাল (রহ.) অথবা চট্টগ্রামের হজরত শাহ আমানত (রহ.) দরগায় কেউ মোমবাতি প্রজ্বালন করতে পারবেন না।
যেহেতু ১৩ দফাকে বিএনপি সমর্থন করেছে, তাদের একজন নীতিনির্ধারকের কাছে জানতে চাইলাম আগামীবার তাঁরা তাঁদের নেত্রীর আসনে কাকে মনোনয়ন দিচ্ছেন? তিনি অনেকটা আকাশ থেকে পড়ে জানতে চাইলেন কেন হঠাৎ এই প্রশ্ন? বলি, এই প্রশ্ন শুধু নেত্রীর বেলায় নয়, এই প্রশ্ন সাংসদ পাপিয়া, মনিসহ আরও যাঁরা আছেন, তাঁদের বেলায়ও প্রযোজ্য। কারণ, ১৩ দফায় সমর্থন দেবেন আর মহিলারা সংসদ নির্বাচন করবেন, তা তো হয় না। জবাবে তিনি বললেন, ‘আরে ভাই, ওগুলো হলো স্রেফ মাঠের রাজনীতি।’ দেখি, এখন হেফাজত তাঁদের মোনাফেক বলে কোনো গালমন্দ করে কি না। সবশেষে প্রশ্ন, আওয়ামী লীগ কেন হেফাজতের ১৩ দফা বাস্তবায়ন করার দায়িত্ব নেবে? আগামী নির্বাচনে তারা এই ১৩ দফা ইশতেহার হিসেবে ঘোষণা করে ৩০০ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করুক। সমর্থন পেয়ে সরকার গঠন করলে নিজেরাই তা না হয় বাস্তবায়ন করুক। এর মধ্যে অন্তত কিছুদিন দেশটা শান্তিতে থাকুক না।
আবদুল মান্নান: সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
Click This Link
©somewhere in net ltd.