![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
হরতাল শব্দটি মূলত গুজরাটি । এর আভিধানিক অর্থ ‘সমস্ত কর্মীর অথবা প্রায় সমস্ত কর্মীর এমন ধর্মঘট যাতে স্বাভাবিক জীবন যাত্রা ব্যহত হয়।’ (মাঘ ১৪১৬ / জানুয়ারী ২০১০ এ প্রকাশিত বাংলা একাডেমী ইংরাজি-বাংলা অভিধান)।
আমাদের দেশে রাজনৈতিক দাবী আদায়ের জন্য সরকারের উপর চাপ সৃষ্টির লক্ষ্যে হরতাল পালিত হয়। বৃটিশ আমল থেকেই এটা পালিত হয়ে আসছে। ১৯৪৬ সালের ১৬ই আগষ্ট তারিখে নিখিল ভারত মুসলীম লীগ প্রত্যক্ষ কর্মপন্থা দিবস পালন করে। এই দিনের হরতালে পক্ষ-বিপক্ষের মধ্যে ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ হয়। এর ফলে বৃটিশ সরকার ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবের অনুসরণে দিল্লী প্রস্তাবের ভিত্তিতে উপমহাদেশ বিভক্ত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে প্রণয়ন করে পূর্ব পাকিস্তান (বর্তমানের বাংলাদেশ)কে পূর্ণ স্বায়ত্ব শাসন দেবার দাবীতে আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান ৬-দফা দাবী উত্থাপন করেন। আইয়ুব খানের নেতৃত্বে মুসলীম লীগ ( কনভেনশন) সরকার এই দাবী মানতে অস্বীকার করে। সেই সাথে অস্ত্রের ভাষা প্রয়োগ ও গৃহ যুদ্ধের হুমকি দেয়। ১৯৬৬ সালের ৭ই জুন তারিখে আওয়ামী লীগের ডাকে সারা পূর্ব পাকিস্তানে পালিত হয় সর্বাত্মক হরতাল। পুলিশের গুলিতে শাহাদাত বরণ করেন শ্রমিক মনু মিয়া। এর ফলে উক্ত সরকারের ভিত্তি নড়ে যায়। ১৯৬৯ সালে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ১১-দফা দাবী আদায়ের আন্দোলন ও ‘গণতান্ত্রিক সংগ্রাম পরিষদ’(ডাক) এর গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলন শুরু হলে একাধিক দিন হরতাল পালিত হয়। আসাদুজ্জামান , মতিউর রহমান মল্লিক , সাজেন্ট জুহুর, ডঃ জোহা, আবদুস সাত্তার প্রমুখ শাহাদাত বরণ করেন। এর ফলে মুসলীম লীগ ( কনভেনশন) সরকারের পতন ঘটে। ১৯৭১ সালের ১লা মার্চ তারিখে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আগা মুহম্মদ ইয়াহিয়া খান জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন এবং ৩রা মার্চ তারিখে অনুষ্ঠিত্য জাতীয় পরিষদের উদ্বোধনী অধিবেশন বাতিল করার ঘোষণা দেন। ঐ দিনই পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ ব্যথিত হৃদয়ে ক্ষুব্ধ মনে নেমে আসে রাজপথে। ২রা মার্চ তারিখে ঢাকায় স্বতস্ফ’র্ত হরতাল পালিত হয় এবং ঐ দিনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অংগনে অনুষ্টিত ছাত্র জনসভায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র-সংসদের তৎকালীন সহ-সভাপতি আ স ম আবদুর রব কালচে সবুজ জমিনের মাঝে রক্তলাল সূর্যের মাঝে সোনালী রংএর মানচিত্র আঁকা পতাকা উড়িয়ে দেন, সেটাই হলো স্বাধীন বাংলার পতাকা।৩রা মার্চ তারিখে সারা বাংলায় হরতাল পালিত হয়। ঐ দিন পল্টন ময়দানে ছাত্র জনসভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উপস্থিতিতে ছাত্র লীগের সাধারন সম্পাদক শাহজাহান সিরাজ পাঠ করেন স্বাধীনতার ইশতেহার। এই ইশতেহারেই বলা হয় ‘আমার সোনার বাংলা ....’ গানটি হবে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলা দেশের জাতীয় সংগীত। এই হরতাল ও ঘটনাবলীর মাধ্যমেই পাকিস্তানের অখন্ডতা লুপ্ত হয়। অনিবার্য হয়ে যায় বাংলার স্বাধীনতা।স্বাধীনতা উত্তর কালে মুক্তিযোদ্ধাদের তরফ থেকে দাবী করা হয় মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে গড়ে উঠা অভ’তপূর্ব জাতীয় ঐক্যকে কাজে লাগিয়ে দেশ গড়ে তোলার লক্ষ্যে মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণকারী সকল দল ও শক্তিকে নিযে ‘জাতীয় বিপ্লবী সরকার’ গঠনের। এই দাবী প্রত্যাখ্যাত হয়ে গঠিত হয় দলীয় সরকার। ফলে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের বিরাট অংশের সম্পর্কের অবনতি ঘটে। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের আহ্বানে সারা দেশে বিভিন্ন সময়ে পালিত হয় সর্বাত্মক হরতাল। ১৯৭৪ সালের ২০শে জানুয়ারী ও ৮ই ফেব্রুযারী তারিখের হরতাল সরকারের অবস্থা অনেক নাজুক করে দেয়। এই আমলে সিরাজ সিকদারের নেতৃত্বাধীন সর্বহারা পার্টির আহ্বানেও পালিত হয় হরতাল। এই সব হরতাল সরকারের স্বাভাবিক রাষ্ট্র পরিচালনার কাজ বাধাগ্রস্থ করে।যার জন্য জারী করতে হয় জরুরী অবস্থা। ১৯৭৬ সালের ২১ শে জুলাই তারিখে কর্নেল আবু তাহের বীর উত্তমকে ফাঁসি দিলে এর প্রতিবাদে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল ও তার সংযোগী সংগঠন সমূহ ৩১ শে জুলাই তারিখে হরতালের ডাক দেয়। সারাদেশ জুড়ে এই দিনে পালিত হয় সর্বাত্মক হরতাল।এই হরতালও জেনারেল জিয়ার নেতৃত্বাধীন সামরিক সরকারকে বিরাট চ্যালেঞ্জের মাঝে ফেলে দেয়। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)এর সরকারের বিভিন্ন কর্মকান্ডের প্রতিবাদে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল কর্তৃক আহুত হরতাল পালিত হয় বিভিন্ন সময়ে দেশ জুড়ে। হরতালে ভাংচুর হওয়া সরকারী গাড়ি ও অন্যান্য রাষ্ট্রীয় সম্পদ জনগণকে দেখিয়ে সরকার জনগণের সহানুভ’তি লাভের চেষ্টা করে। তা সত্ত্বেও এসব হরতালের কারণে বিএনপি সরকারও জনগণের মাঝে সমালোচনার মুখে পড়ে। জেনারেল হোসেন মুহম্মদ এরশাদের শাসন আমলে ১৯৮৭ সালের ১০ই নভেম্বর তারিখে বিএনপি, আওয়ামী লীগ ও জামাতে ইসলামী বাংলাদেশের পারস্পরিক সমঝোতার ভিত্তিতে আহুত হরতাল পালিত হয়। এর কারণেই জাতীয় পার্টির সরকারের ভিত্তি নড়ে উঠে এবং রাষ্ট্রপতি এরশাদ এর মাত্র কিছু দিন পরেই জাতীয় সংসদ ভেঙ্গে দেন। নতুন নির্বাচন হলেও উক্ত তিনটি দল নিজ নিজ প্লাট ফরমে থেকে পারস্পরিক সমঝোতার ভিত্তিতে ঐ নির্বাচন বয়কট করে। শুরু হয় হরতাল ও আন্দোলন। এই সময়ই হরতালে ক্ষয়ক্ষতির কথা বলা হয়। হরতালকে ‘ভয়তাল’ বলে আখ্যায়িত করা হয়।১৯৯০ সালের শেষের দিকে হরতালের পর হরতাল দিতে থাকে উক্ত তিনটি দলের পৃথক পৃথক নেতৃত্বাধীন তিনটি জোট। জাতীয় পার্টি সরকারের পতন হয়। ‘ডকট্রিন অব নেসেসিটি’র কথা বলে তিন জোটের সম্মতিক্রমে উপরাষ্ট্রপতি পদ গ্রহণ করেন তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমেদ। তারপর রাষ্ট্রপতি এরশাদ পদত্যাগ করলে বিচাপতি সাহাবুদ্দিন গ্রহণ করেন রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব।এটা সংবিধানসম্মত ছিল না। সে জন্য পরবতীতে সংবিধান সংশোধন করতে হয়। বিএনপি সরকারের আমলে অধ্যাপক গোলাম আযমের নাগরিকত্বের প্রশ্নে হরতাল পালিত হয়। এই সরকারের শেষ দিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবীতে হরতাল পালিত হতে থাকে। প্লাট ফরম আলাদা থাকলেও এসব হরতালের জন্য যুগপৎ ভাবে ডাক দেয় আওয়ামী লীগ, জামাতে ইসলামী , জাতীয় পার্টিসহ অন্যান্য দল।অবশেষে তত্ত্বধায়ক সরকারের বিধান সংবিধানে সংযোজিত হয়। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেও বিভিন্ন দাবীতে বিএনপি, জাতীয় পার্টি , জামাতে ইসলামীর আহ্বানে পালিত হয় হরতাল। ২০০৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা কে হবেন এই প্রশ্নে আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টিসহ অন্যান্য দলের আহ্বানে হরতাল পালিত হয় । এর ভয়াবহতা সবাইকে শিহরিত করে।
প্রাগুক্ত হরতালের ঘটনাবলী কমবেশী সহিংসতার মাধ্যমেই পালিত হয়েছে। সারা বিশ্বজুড়ে হরতাল দাবী আদায়ের বা দাবী সম্পর্কে জনমত গঠনের স্বীকৃত মাধ্যম। তবে এই উপমহাদেশেই এটা এজন্য ব্যাপকভাবে পালিত হয়ে আসছে বৃটিশ আমল থেকে। হরতালের মাধ্যমে জনগণের বহু গুরুত্বপূর্ণ অধিকার অর্জিত হয়েছে, তা উপরের ঘটনাবলী বিশ্লেষন করলেই উপলব্ধি করা যায়। তবে এর সহিংসতা ও ভয়াবহতা নাগরিকদের সব সময়ই উদ্বিগ্ন করে।
গণ প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৭ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে,‘ জনশৃংখলা ও জনস্বাস্থ্যের স্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তি-সংগত বাধা নিষেধ সাপেক্ষে শান্তিপূর্ণভাবে ও নিরস্ত্র অবস্থায় সমবেত হইবার এবং জনসভা ও শোভাযাত্রায় যোগদান করিবার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের থাকিবে।’ ৩৯ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে,‘(১) চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার নিশ্চিয়তা দান করা হইল। (২) রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, বিদেশী রাষ্ট্রসমূহের সহিত বন্ধুত্বপূর্ন সম্পর্ক , জনশৃংখলা , শালীনতা বা নৈতিকতার স্বার্থে কিংবা আদালত অবমাননা, মানহানি বা অপরাধ সংঘটনে প্ররোচনা সম্পর্কে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধা-নিষেধ সাপেক্ষে (ক) প্রত্যেক নাগরিকের বাক ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারের , এবং (খ) সংবাদ ক্ষেত্রের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা হইল।’
এই অধিকারের সূত্রেই হরতাল করার অধিকার নাগরিকদের রয়েছে। তবে তা পালন করতে হবে শান্তিপূর্ণভাবে , নিরস্ত্র অবস্থায় এবং দাঙ্গা হাঙ্গামা পরিহার করে। এ ক্ষেত্রে হরতাল আহ্বানকারী এবং বিরোধীতাকারী উভয় পক্ষেরই সমান দায়িত্ব রয়েছে। খন্দকার মোদাররেশ এলাহী বনাম বাংলাদেশ মামলায় {২১(২০০১) বিএলডি(হাইকোর্ট)৩৫২ এবং ৫৪ ডিএলআর ৪৭-৬৬} মাননীয় আদালত সিদ্ধান্তে আসেন যে হরতাল একটি গণতান্ত্রিক, রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক অধিকার তা আহ্বানকারীকে শান্তিপূর্নভভাবে এবং কোন অবৈধ পন্থা গ্রহণ ব্যতীত পালন করতে দিতে হবে । এর বিরোধীতাকারী এতে বাধা দিতে পারবে না। তা করতে গিয়ে আইন-শৃংখলা ভঙ্গকারীর ব্যাপারে কার্যক্রম গ্রহণের বিধান ফৌজদারী কার্যবিধি ও দন্ডবিধিতে রয়েছে। হরতালে বাধা দেওয়া বা বিরোধীতা করার সময় সহিংসতা বা দমননীতির আশ্রয নেওয়া যাবে না।হরতাল বাঞ্চাল করার জন্য কোন প্রকার প্ররোচনা বা উসকানি দেওয়া , হস্তক্ষেপ করা , বৈরী আচরণের মাধ্যমে হরতাল বিরোধী কার্যক্রম চালানো যাবে না। ক্ষমতাসীন দল হরতালের সমালোচনা করলেও বিরোধী দল হরতালকে সমর্থন করে এবং হরতালের পন্থা গ্রহন করে। তাই হরতাল ভালো কি মন্দ তা রাজনৈতিক দলগুলোর দৃষ্টিভঙ্গির উপর নির্ভর করে।
হরতাল সম্পর্কে রাজনৈতিক মতবিরোধ নিস্পত্তির জন্য সকল রাজনৈতিক দলের ঐক্যমতের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা দরকার। এরূপ ঐক্যমত্যই হরতাল কেন্দ্রিক সহিংসতা , ব্যক্তিগত ও রাষ্ট্রীয় ক্ষতি এবং নাগরিকদের প্রাণহানির ঘটনা থেকে জাতিকে মুক্ত করতে পারবে।
লেখকঃ সাবেক জেলা ও দায়রা জজ । [email protected]
©somewhere in net ltd.