![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
সংবিধানের ৮৭ অনুচ্ছেদ মতে প্রত্যেক অর্থ-বৎসর সম্পর্কে উক্ত বৎসরের জন্য সরকারের অনুমিত আয় ও ব্যয়-সংবলিত একটি বিবৃতি সংসদে উপস্থাপিত হবে। এই বিবৃতিকেই সাধারণ ভাষায় ‘বার্ষিক জাতীয় বাজেট’ বলা হয়ে থাকে। আভিধানিকভাবে বাজেট অর্থ : ব্যক্তিগত বা প্রশাসনিকভাবে তৈরী বার্ষিক রাজস্ব আয় ও ব্যয়ের আনুমানিক হিসাব ও বরাদ্দ।
সংবিধানের ৮৪ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে : (১) সরকার কর্তৃক প্রাপ্ত সকল রাজস্ব , সরকার কর্তৃক সংগৃহীত সকল ঋণ এবং কোন ঋণ পরিশোধ হইতে সরকার কর্তৃক প্রাপ্ত সকল অর্থ একটি মাত্র তহবিলের অংশে পরিণত হইবে এবং তাহা “সংযুক্ত তহবিল” নামে অভিহিত হইবে। (২) সরকার কর্তৃক বা সরকারের পক্ষে প্রাপ্ত অন্য সকল সরকারী অর্থ প্রজাতন্ত্রের সরকারী হিসাবে জমা হইবে।
এই অর্থের নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে সংবিধানের ৮৫ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে : সরকারী অর্থের রক্ষণাবেক্ষন, ক্ষেত্রমতো সংযুক্ত তহবিলে অর্থ প্রদান বা তাহা হইতে অর্থ প্রত্যাহার কিংবা প্রজাতন্ত্রের সরকারী হিসাবে অর্থ প্রদান বা তাহা হইতে অর্থ প্রত্যাহার এবং উপরি-উক্ত বিষয় সমূহের সহিত সংশ্লিষ্ট বা আনুষঙ্গিক সকল বিষয় সংসদের আইন দ্বারা এবং অনুরূপ আইনের বিধান না হওয়া পর্যন্ত রাষ্ট্রপতি কর্তৃক প্রণীত বিধি সমূহ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হইবে।
প্রজাতন্ত্রের সরকারী হিসাবে প্রদেয় অর্থ সম্পর্কে সংবিধানের ৮৬ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে : প্রজাতন্ত্রের সরকারী হিসাবে জমা হইবে- (ক) রাজস্ব কিংবা এই সংবিধানের ৮৪ অনুচ্ছেদের (১) দফার কারণে যেরূপ অর্থ সংযুক্ত তহবিলের অংশে পরিণত হইবে, তাহা ব্যতীত প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত কিংবা প্রজাতন্ত্রের বিষয়াবলীর সহিত সংশ্লিষ্ট কোন ব্যক্তি কর্তৃক প্রাপ্ত বা ব্যক্তির নিকট জমা রহিয়াছে, এরূপ সকল অর্থ; অথবা (খ) যে কোন মোকদ্দমা, বিষয়, হিসাব বা ব্যক্তি বাবদ যে কোন আদালত কর্তৃক প্রাপ্ত বা আদালতের নিকট জমা রহিয়াছে, এরূপ সকল অর্থ।
সংযুক্ত তহবিলের উপর দায় সম্পর্কে সংবিধানের ৮৮ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে : সংযুক্ত তহবিলের উপর দায়যুক্ত ব্যয় নি¤œরূপ হইবে ঃ (ক) রাষ্ট্রপতিকে দেয় পারিশ্রমিক ও তাহার দপ্তর সংশ্লিষ্ট অন্যান্য ব্যয়; (খ) (অ) স্পীকার ও ডেপুটি স্পীকার , (আ) সুপ্রীম কোর্টের বিচারকগণ (ই) মহা হিসাব-নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক, (ঈ) নির্বাচন কমিশনারগণ, (উ) সরকারী কর্ম কমিশনের সদস্যদিগকে দেয় পারিশ্রমিক; (গ) সংসদ, সুপ্রীম কোর্ট , মহা হিসাব-নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের দপ্তর, নির্বাচন কমিশন এবং সরকারী কর্ম কমিশনের কর্মচারীদিগকে দেয় পারিশ্রমিকসহ প্রশাসনিক ব্যয়; (ঘ) সুদ, পরিশোধ-তহবিলের দায়, মূলধন পরিশোধ বা তাহার ক্রম-পরিশোধ এবং ঋণ-সংগ্রহ ব্যপদেশে ও সংযুক্ত তহবিলের জামানতে গৃহীত ঋণের মোচন-সংক্রান্ত অন্যান্য ব্যয়সহ সরকারের ঋণ-সংক্রান্ত সকল দেনার দায়; (ঙ) কোন আদালত বা ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক প্রজাতন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রদত্ত কোন রায়, ডিক্রি বা রোয়েদাদ কার্যকর করিবার জন্য প্রয়োজনীয় যে কোন পরিমাণ অর্থ ; এবং (চ) এই সংবিধান বা সংসদের আইন-দ্বারা অনুরূপ দায়যুক্ত বলিয়া ঘোষিত অন্য যে কোন ব্যয়।
এই আয় ও ব্যয় সংক্রান্ত ‘আর্থিক বিবৃতি’ সম্পর্কিত পদ্ধতি সম্পর্কে সংবিধানের ৮৯ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে : (১) সংযুক্ত তহবিলের দায়যুক্ত ব্যয়-সম্পর্কিত বার্ষিক আর্থিক বিবৃতির অংশ সংসদে আলোচনা করা হইবে, কিন্তু তাহা ভোটের আওতাভুক্ত হইবে না। (২) অন্যান্য ব্যয়-সম্পর্কিত বার্ষিক আর্থিক বিবৃতির অংশ মঞ্জুরী-দাবীর আকারে সংসদে উপস্থাপিত হইবে এবং কোন মঞ্জুরী-দাবীতে সম্মতিদানের বা সম্মতিদানে অস্বীকৃতির কিংবা মঞ্জুরী-দাবীতে নির্ধারিত অর্থ হ্রাস-সাপেক্ষে তাহাতে সম্মতিদানের ক্ষমতা সংসদের থাকিবে। (৩) রাষ্ট্রপতির সুপারিশ ব্যতীত কোন মঞ্জুরী দাবী করা যাইবে না।
‘সংযুক্ত তহবিল’ ও ‘সরকারী হিসাবে’ অর্থের উৎস শ্রমজীবী কর্মজীবী ও পেশাজীবী জনগণ কর্তৃক সরকার ও সরকার নিয়েজিত কোন কর্তৃপক্ষকে দেয় অর্থ। এটা রাজস্ব, কর বা অন্য যে কোন আকারে দেওয়া হয়ে থাকে। সরকার যে ঋণ গ্রহণ করে সেটাও পরিশোধ করা হয় জনগণের কাছ থেকে প্রাগুক্ত মতে প্রাপ্ত অর্থ থেকে। তাই ‘বার্ষিক আর্থিক বিবৃতি’তে শ্রমজীবী কর্মজীবী পেশাজীবী জনগণের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোই প্রাধান্য পাবার কথা। জাতীয় সংসদে এগুলো নিয়েই এ প্রসঙ্গে আলোচনা হবে। বাস্তবে আমরা বাজেট আলোচনায় এর প্রতিফলন খুব কমই দেখে থাকি। এসব আলোচনায় প্রতিপক্ষের জীবিত ও প্রয়াত নেতা নেত্রীদের নিয়ে যে সব আলোচনা হয় তা অনেক সময়ই শালীনতার সীমা ছাড়িয়ে যায়। পাশাপাশি আবার নিজ দলীয় জীবিত ও প্রয়াত নেতা নেত্রীদের স্তুতি গাওয়া হয়, এটাও আবার প্রায় সকল সময়ই বাস্তবতার মাত্রা ছাড়িয়ে যায়। দুঃখজনক হলেও সত্য এই সব গীবত ও স্তুতি সংবিধান মোতাবেক অপ্রাসংগিক হবার কারণে বক্তাদের সতর্কও করা হয় না, মাইকও বন্ধ করা হয় না। এই সব আলোচনাগুলো কার্য বিবরণী থেকে বাদও দেওয়া হয় না। আইন সভায় যিনি উপস্থিত নাই এবং আত্মপক্ষ সমর্থন করার সুযোগ বা পরিবেশ নাই তাদের নিয়ে আইন সভায় আলোচনা করার বিষয়ে ‘কার্য প্রণালী বিধি’তে নিষেধ রয়েছে। এই বিধি নিষেধ উপেক্ষা করেও আলোচনা হতে দেখা যায়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় সাম্প্রতিককালে জাতীয় সংসদে স্বাধীনতার রূপকার সিরাজুল আলম খান সম্পর্কে আলোচনা হয়েছে। এই আলোচনায় এই মহান নেতা সম্পর্কে কিছু নেতিবাচক কথা বলা হয়েছে। সংবিধান ও কার্যপ্রণালী বিধির ১৬ অনুচ্ছেদ অনুসারে জাতীয় সংসদে এরূপ আলোচনা করার সুযোগ ছিল না। এরূপ আলোচনার জন্য ইতিপূর্বে কোন নোটিশও দেওয়া হয় নাই। এরূপ আলোচনার সময় সিরাজুল আলম খানকে সংসদে উপস্থিত থাকার জন্য আমন্ত্রণও জানানো হয় নাই। তাই এই আলোচনা সংসদের আলোচনা বলে গৃহীত হতে পারে না। এটা বন্ধ করার জন্য স্পীকার মহোদয় কোন বাধা দেন নাই। সংসদের কার্যবিবরণী থেকে বাদ দিয়েছেন বলে এখন পর্যন্ত কোন তথ্য জানা যায় নাই। এই ঘটনা মুক্তিযোদ্ধাগণসহ দেশের শ্রমজীবী কর্মজীবী পেশাজীবী তথা সর্বস্তরের জনগণকে ব্যতিত করেছে।
বাজেট নিয়ে আলোচনার সময় মূল বিষয়ের চাইতে অন্য বিষয় নিয়েই আলোচনা হয়েছে। গ্রামীণ জনগণ বলতে গেলে নাগরিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত। এই সকল বিষয় নিয়ে যা আলোচনা হয়েছে , তা না হবারই শামিল। গ্রামাঞ্চলের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সমূহ নানা সমস্যায় জর্জরিত। তার কারণে এসব প্রতিষ্ঠান থেকে মেধাবী ছাত্রছাত্রীগণ ভালো ফলাফল করতে পারে না। পরীক্ষার ফলাফল ঘোষিত হলে দেখা যায় রাজধানীর উচ্চবিত্তদের সন্তানেরাই দুই আঙ্গুল উচিয়ে প্রচার মাধ্যমে আনন্দ উল্লাস করছে। দুই আঙ্গুল দিয়ে তারা কি বোঝায় তা তারা নিজেরাই হয়ত জানে না। রাজধানীর হাতে গোনা কয়েকটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক শিক্ষিকাগণ তাঁদের ছাত্রছাত্রীদের কৃতিময় ফলাফল দেখে নিজেদের সফলগাঁথা জাহির করেন প্রচার মাধ্যমে। এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সাধারণ কৃষক শ্রমিক মধ্যবিত্ত নি¤œবিত্ত জনগণের সন্তানদের প্রবেশাধিকার নাই। এমনকি উপজেলা পর্যায়ে যাঁরা উচ্চ পদে সরকারী চাকুরী করেন তাদের সন্তানেরাও এসব প্রতিষ্ঠানে সাধারনত প্রবেশাধিকার পায় না। কর্মস্থলে মান সম্মত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান না থাকায় এসব কর্মকর্তাগণ পড়েন বিপাকে। তারা তাই রাজধানীতে পদায়নের জন্য সারাক্ষণ চেষ্টা তদবির করতে থাকেন। হাল আমলে কোন কোন ক্যাডার সার্ভিসের সদস্যগণ সম্মিলিতভাবে তাদের সমিতির মাধ্যমে রাজধানীতে তাঁদের সন্তানদের জন্য মানসম্মত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। এতে তাঁদের কতিপয়ের সন্তানেরা মানসম্মত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়ালেখার সুযোগ পাচ্ছেন। ঐ সব কর্মকর্তাগণ উপজেলায় নিজ কর্মস্থলে অবস্থান করলেও তাঁদের পরিবার পরিজন থাকেন রাজধানীতে। এর ফলে কর্মকর্তাগণ বাড়তি খরচের সম্মুখিত হচ্ছেন এবং এই খরচ জোটাতে গিয়ে তারা নানারূপ সমালোচনার সম্মুখিন হচ্ছেন। আর রাজধানীকে গ্রহণ করতে হচ্ছে বাড়তি জন সংখ্যার চাপ। মহাসড়কগুলো ব্যস্ত থাকছে পরিবহনের কাজে। উপজেলা পর্যায়ে মানসম্মত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থাকলে এই সব কর্মকর্তাগণ নিজ কর্মস্থলেই পরিবার পরিজন নিয়েই থাকতেন। তাতে উপজেলা সম্বৃদ্ধ হতো, রাজধানী বাড়তি জনসংখ্যার ভার থেকে মুক্ত হতো । কর্মকর্তাগণ কর্মস্থলে সাপ্তাহিক ছুটির দিনেও অবস্থান করার কারণে ঢাকাগামী যানবাহনের যাত্রী সংখ্যা কমে যেতো। উপজেলার বাসিন্দাগণ তাদের সমস্যার বিষয়ে সমাধানের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কাছে পেয়ে উপকৃত হতো। বাজেট আলোচনায় উপজেলা পর্যায়ে মান সম্মতভাবে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কার্যকরী ভাবে সচল করার জন্য প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত ও তা বাস্তবায়নের জন্য মঞ্জুরীর প্রস্তাব নিয়ে আইন সভায় কোন কার্যকরী আলোচনা হয় নাই।
নাগরিকদের স্বাস্থ্য সেবা প্রদান রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। এই সুযোগ উপজেলার বাসিন্দাদের জন্য নাই বললেই চলে। প্রতিটি উপজেলাতেই ‘উপজেলা স্বাস্থ্য প্রকল্প’ রয়েছে। এখানে ডাক্তার নার্স উন্নত মেশিন পত্র সবই আছে । নাই শুধু এগুলোর জনগণকেন্দ্রীক ব্যবহার। ডাক্তারদের প্রায়ই হাসপাতালে পাওয়া যায় না। তাদেরকে প্রেষণে কাজ করতে হয় ঢাকায় কোন অভিজাত হাসপাতালে। যন্ত্রপাতি পরিচালনার জন্য উপযুক্ত ‘কুশলী’ নাই। প্রয়োজনীয় ‘জেল’, ‘এক্স-রে প্লেট’ এগুলোও সময়মতো সবক্ষেত্রে থাকে না। ঔষধপত্রও সবার প্রয়োজনে পাওয়া যায় না। আর্থিক বরাদ্দ যা আসে তার সবটুকু খরচ করা যায় না। রটনা আছে যে এই অর্থের মোটা অংশ পাঠিয়ে দেওয়া হয় ঢাকার কোন অভিজাত হাসপাতালের জন্য। এতদ সংক্রান্ত প্রস্তাবও গ্রহণ করতে হয় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে। তবে স্বাস্থ্য প্রকল্প সম্পর্কে যারা পদক্ষেপ নিতে পারেন তারা চিকিৎসা সুবিধার প্রায় সবটুকুই পান। সাধারণ মানুষ একটা ‘প্যারাসিটামল’ পায় কি না সন্দেহ। হাসপাতাল প্রাঙ্গন থাকে নোংরা। বলা হয় প্রয়োজনীয় লোকবল ও উপাদানের অভাবে পরিচ্ছন্ন রাখা সম্ভব হয় না। যারা নীতি ও নৈতিকতা নিয়ে হাসপাতালে কাজ করতে আসেন তাঁরা এইসব সংকটের কারণে সাধারণ মানুষকে চিকিৎসা সেবা দিতে পারেন না। তারাও অসহায়ত্বের মাঝে চাকুরী করে যান। তাঁদের শিক্ষা দক্ষতা ও যোগ্যতা রয়েছে কিন্তু উপযুক্ত পরিবেশ ও আনুক’ল্যেও অভাবেই তাঁরা শত আন্তরিকতা সত্ত্বেও রোগীদের প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সেবা দিতে পারেন না। দলবাজির কারণে তাঁদের উপযুক্ত পদায়ন, উচ্চতর প্রশিক্ষণ, পদোন্নতি হয় না। অসহায়ের মতো তাদেরকে পড়ে থাকতে হয় মফস্বল শহরে , তাই তাঁরা ভাগ্যের সন্ধানে হন বিদেশমুখি। ঢাকা মহানগরের বাইরে চিকিৎসা সেবার এই অবস্থার কারণে যাদের সামর্থ আছে তারা চিকিৎসার জন্য চলে যান ঢাকায়। যাদের তা নাই তারা অদৃষ্টের উপর ভরসা করে দিনগুজরান করেন। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য আইন সভায় কার্যকরী ও ফলপ্রসু কোন আলোচনার সূত্রপাতও হয়নি। আমাদের দেশের চিকিৎসকগণ বিদেশে গিয়ে চিকিৎসা সেবায় সুনাম অর্জন করছেন। দেশে তাদের সে সুনাম প্রতিষ্ঠার জন্য কার্যকরী উদ্যোগ নিতে আইন সভার নিরবতা সকলেরই চোখে পড়লেও তার নিরসনের কোন পদক্ষেপ নাই।
বন্যা আমাদের জাতীয় সমস্যা। এর সমাধান জরুরী। প্রাচীন কালে বাঁধ নির্মাণ করে ‘আল’ বেঁধে বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও নিজেদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হতো। এখন অবশ্য তা করা হয় না, তবে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ নির্মাণ করা হয়। পাবনার ফরিদপুর উপজেলায় নির্মিত এইরূপ বাধঁসহ যতগুলো বাঁধ তৈরী হয়েছে তাতে একদিকে বন্যার পানি নিয়ন্ত্রিত হয়েছে অন্য দিকে পানির প্রকোপ বেড়েছে এবং ফসল তলিয়ে যাচ্ছে বন্যার পানিতে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় যে উক্ত বাঁধের কারণে বণওয়ারীনগরের ফসলী জমি এবং বাড়ি-ঘর বন্যার পানি থেকে রক্ষা পেলেও বড়াল নদীর উত্তর পাড়ে পার-ফরিদপুরের ফসলী জমি ও বাড়ি-ঘর সবই বন্যার সময় তলিয়ে যায়। কৃষকেরা বঞ্চিত হয় ফসল থেকে। দক্ষতা , আন্তরিকতা ও দূরদর্শিতার অভাবে একই উপজেলার বাসিন্দাগণ বন্যা নিয়ন্ত্রণ সুবিধা থেকে বঞ্চিত। বরইবাড়িয়ার বিল, গাজনার বিল এলাকা ঐ বাধের কারণে প্লাবিত হয়। আধা পাকা ধান তলিয়ে যায় বন্যার অথৈ জলে। আইন সভায় অনেক আলোচনা হলেও এই প্রসংগ নিয়ে কোন আলোচনা ও সিদ্ধান্ত হয়নি।
কৃষিই আমাদের জীবিকার প্রধান অবলম্বন। কৃষি কাজের জন্য প্রয়োজন সার বীজ কীটনাশক প্রভৃতি। বর্তমানে এসবই আসে বিদেশ থেকে। অনেক সময়ই এসব বীজে অংকুরোদম হয় না। সার ও কীটনাশক ব্যবহারের কারণে প্রাকৃতিক পরিবেশ ও ভারসাম্য নষ্ট হয়। এর প্রভাবে মাছের প্রজাতি বিলীন হচ্ছে। ঐ সব সার ও কীটনাশক খাদ্যের মাধ্যমে মানুষের দেহে প্রবেশ করছে, মানুষের জীবনী শক্তি বিনষ্ট হচ্ছে। বিভিন্ন রোগের প্রাদুর্ভাব হচ্ছে। পঞ্চাশ বৎসর আগেও কৃষকেরা সার ও কীট নাশক ব্যবহার করে নাই। তারা নিজেরাই বীজ উৎপাদন সংরক্ষণ ও ব্যবহার করেছে। উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য ব্যবহার করেছে গোবর পচা সার। পেঁচা ইদুর দোয়েল শালিক কাজ করেছে কীট নাশকের। রাত্রে জমিতে মশাল জ্বালিয়ে রাখার মধ্য দিয়ে ফসল পাহারা দেওয়া হয়েছে , এতে ক্ষতিকর পতঙ্গগুলোও বিনষ্ট হয়েছে। নদীর মাছগুলোও রাসায়নিকের কুপ্রভাব থেকে মুক্ত থেকেছে। এসব ফসলজাত খাদ্য খেয়ে মানুষ সুস্থ থেকেছে , নিরোগ ও সুন্দর জীবন যাপন করেছে। আজ তা নাই কেন ? বীজ সার ও কীটনাশকের জন্য অধিকাংশ ক্ষেত্রে আমরা বিদেশের উপর নির্ভরশীল। আমাদের কৃষি ব্যবস্থা এভাবে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে বিদেশ থেকে। এই পরিবেশ থেকে মুক্ত হয়ে স্বনির্ভর দেশ গড়ার জন্য আইন সভায় কোন আলোচনা ও সিদ্ধান্ত হয় নাই।
কৃষি জমির মালিকানা ও ব্যবস্থাপনায় প্রকৃত কৃষকের কোন নিয়ন্ত্রণ নাই। পূঁিজ নির্ভর হওয়ায় কৃষকেরা ধীরে ধীরে জমি বিক্রয় করতে বাধ্য হচ্ছে। তারা ছিন্নমূল হয়ে কাজের সন্ধানে আসছে রাজধানীতে। পোষাক শিল্পসহ বিভিন্ন শিল্প কারখানায় মেয়ে পুরুষ কাজ করছে। এখানে উপযুক্ত মজুরী তারা পায় না। নিজেদের ক্ষুন্নিবৃত্তির আপাত সমাধান হলেও সন্তানদের শিক্ষার অভাব থেকেই যাচ্ছে। রোগে চিকিৎসার নেবার আর্থিক সামর্থ্য নাই। এই সমস্যাগুলোকে জন কল্যাণ ও উন্নয়ন মুখি কার্যক্রমের মাধ্যমে সমাধানের কোন প্রস্তাব আইন সভায় উত্থাপিত ও আলোচিত হতে বড় একটা দেখা যায় না। গ্রাম উজার হচ্ছে, গ্রামবাসী শহর মুখি হচ্ছে এবং মানবেতর জীবন যাপন করছে। প্রতিকারের জন্য কোন উদ্যোগ নাই। ইতিহাসের বিতর্ক দ্বারা এর সমাধান হয় ন্ া
মহানগরের বাসিন্দাদের দৈনন্দিন জীবনের ময়লা আবর্জনা প্রতিনিয়ত ফেলা হচ্ছে শহরতলীতে। এই সব অস্বাস্থ্যকর আবর্জনা গ্রামবাসীর নিত্যদিনের জীবনকে করছে রোগ ও দুর্দশাগ্রস্ত। পথচারীদেরকে এর জন্য পড়তে হচ্ছে বিব্রতকর অবস্থায়। এর প্রতিকারের জন্যও বাস্তবিক কোন পদক্ষেপ গ্রহণের উদ্যোগ নাই। এ ক্ষেত্রে আইন সভার নিরবতা লক্ষণীয়।
বার্ষিক আর্থিক বিবৃতিতে প্রাগুক্ত সমস্যাগুলো চিহ্নিত করা হয় নাই। প্রতিকারের জন্য উদ্যোগ নেবার বিষয়ে আলোচনা হয় নাই। দেশ হয়ে যাচ্ছে আমদানী নির্ভর। এই নির্ভরতা থেকে উত্তরণের জন্য কোন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত হয় নাই। আমদানীর কারণে গ্রামবাসী জনগণ ক্রমেই নিঃস্ব থেকে নিঃস্বতর হচ্ছে। আমদানী সংশ্লিষ্টরা অবশ্য লাভবান হচ্ছেন। তারা বাস করছেন মহানগরে, সকল অত্যাধুনিক নাগরিক সুবিধাসহ। তারা দেশের রাজনীতিকেও নিয়ন্ত্রণ করছেন। নির্বাচনে অর্থের যোগান এখান থেকেই আসে। আইন সভায় বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে সপক্ষে বিপক্ষে আলোচনা হয় কিন্তু চাটার দল, কায়েমী স্বার্থবাদী মহল, শোষকদের সুস্পষ্টভাবে চিহ্নিত করে তাদের খপ্পর থেকে দেশবাসীকে মুক্ত করার জন্য কোন আলোচনা ও পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয় না। বঙ্গবন্ধু প্রতিটি থানায় ম্যাজিষ্ট্রেট আদালত স্থাপনের অঙ্গীকার করে অবিলম্বে তা বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন সে অঙ্গীকারপূরণ ও প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের কোন পদক্ষেপ ‘মুজিব সেনা’রা গ্রহণ করে নাই। একই ভাবে বলা যায় জেনারেল জিয়াকে নিয়েও সপক্ষে বিপক্ষে অনেক আলোচনা হয়েছে আইন সভায় কিন্তু ‘খাল কাটা কর্মসূচী’ ‘গ্রাম সরকার’ প্রতিটি থানায় (বর্তমানে উপজেলা) সরকারী উদ্যোগে আদর্শ স্থানীয় মাধ্যমিক স্কুল ও উচ্চ মাধ্যমিক মহাবিদ্যালয়, আদর্শ হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেবার জন্য কার্যকরী সিদ্ধান্ত নেবার জন্য কোন আলোচনার সূত্রপাত করা হয়নি। ঈশ্বরদীতে চিনি ভবন স্থাপনে জেনারেল জিয়ার অঙ্গীকার ও সদিচ্ছা বাস্তবায়নের জন্যও কোন উদ্যোগ নেবার লক্ষ্যে আইন সভায় কোন আলোচনা হয়নি। তাহলে বার্ষিক আর্থিক বিবৃতি নিয়ে যে সব আলোচনা হলো তার সুফল জনগণ কি ভাবে পাবে ! আইন সভায় ‘বার্ষিক আর্থিক বিবৃতি’ নিয়ে সর্বমোট কত ঘন্টা আলোচনা হয়েছে এবং এর কত ঘন্টা প্রয়াত নেতাদের স্তব গাঁথা ও গীবত চর্চা হয়েছে, কত ঘন্টা নেতা নেত্রীদের স্তুতি গাওয়া হয়েছে আর কত ঘন্টা প্রাগুক্ত বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা হয়েছে তার হিসাব নিলেই সব কিছু স্পষ্ট হয়ে যাবে।
বার্ষিক আর্থিক বিবৃতি আইন সভায় উত্থাপনের সাথে সাথে আমরা দেখি পক্ষে বিপক্ষে বিবৃতি পাল্টা বিবৃতি দেওয়া হয়। ঐ বার্ষিক আর্থিক বিবৃতি পড়া ও পর্যালোচনার জন্য কম পক্ষে যে সময় প্রয়োজন তার আগেই এসব প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা হয়। অনেক সময় রাস্তায় মিছিল হয় , ভাংচুর করা হয় গাড়ি। এর কোনটার সাথেই জনগণের সম্পর্ক নাই। এসব করা হয় আমদানী নির্ভর ব্যবসায়ের স্বার্থে। এর থেকে সুবিধাপ্রাপ্ত কায়েমী স্বার্থবাদী মহল এসব প্রতিক্রিয়ার নেপথ্য কুশীলব ও প্রয়োজনীয় অর্থের যোগানদাতা। তারা তাদের লাভ লোকসান হিসাব করেন এই বার্ষিক আর্থিক বিবৃতি থেকে। সাধারণ মানুষ এসব থেকে বাস্তবিক অর্থে কিছুই পায় না। যদিও ‘সংযুক্ত তহবিল’ ও ‘সরকারী হিসাবে’ অর্থের উৎস শ্রমজীবী কর্মজীবী ও পেশাজীবী জনগণ কর্তৃক সরকার ও সরকার নিয়েজিত কোন কর্তৃপক্ষকে দেয় অর্থ এবং এভাবে গঠিত তহবিল থেকেই বার্ষিক আর্থিক বিবৃতিতে ব্যয় বরাদ্দের হিসাব নিকাশ করা হয়। এভাবেই যে জনগণ রাষ্ট্রের মূল চালিকা শক্তি তারাই দিনে দিনে হচ্ছে বঞ্চিত। অবহেলিত থেকে যাচ্ছে গ্রামীণ জনপদ। তাই বার্ষিক আর্থিক বিবৃতি গ্রামীন জনগনের জীবনে কোন প্রাণ চাঞ্চল্য সৃষ্টি করতে পারছে না, জনপদগুলোও হচ্ছে না কর্মমূখর কর্মচঞ্চল। শাসন ব্যবস্থার মৌলিক পরিবর্তন ছাড়া এ থেকে পরিত্রাণের কোন পথ নাই । সুন্দর সম্বৃদ্ধশালী দেশ গড়তে , হক-ইনসাফ ভিত্তিক সমাজ গড়তে , মানুষের মতো বেঁচে থাকার পরিবেশ তৈরী করতে এই মৌলিক পরিবর্তনের লক্ষ্যেই আমাদেরকে এগিয়ে যেতে হবে।
লেখক: সাবেক জেলা ও দায়রা জজ। বর্তমানে এ্যাডভোকেট বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট , হাইকোর্ট বিভাগ, ঢাকা।
২৩ শে আগস্ট, ২০১৪ সন্ধ্যা ৬:৩৪
রোমেল রহমান বলেছেন: আপনাকে অনেক মোবারকবাদ।
©somewhere in net ltd.
১|
২১ শে আগস্ট, ২০১৪ রাত ১১:৪৬
রোকন রকি বলেছেন: লেখাটা বেশ গুরুত্বপূর্ন।