নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

রোমেল রহমান এর ব্লগ

রোমেল রহমান

রোমেল রহমান › বিস্তারিত পোস্টঃ

যদি ট্রেনটা বিলম্ব না থাকতো

২২ শে অক্টোবর, ২০১৪ সন্ধ্যা ৭:৪৮

উপমহাদেশে জাতিগত সমস্যা প্রকট হয়ে উঠে ১৯২০ সাল থেকে। লালা লাজপৎ রায় , বাল গঙ্গাধর তিলক প্রমুখ নেতাগন দাবী করেন যে ইংরেজদের মতো মুসলমানরাও ভারত বর্ষে বিদেশী (ম্লেচ্ছ)। তাই ইংরেজদের সাথে সাথে মুসলমানদেরকেও ভারতবর্ষ থেকে বিদায় নিতে হবে। তাদের এই বক্তব্যের সাথে একমত হতে পারেন নাই দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ, নেতাজী সুভাষ বসু প্রমুখ নেতৃবৃন্দ। ‘বাংলা চুক্তির’ মাধ্যমে তারা সাম্প্রদায়িক বিভেদ নিরসনে প্রয়াসী হন। তিলক ও পন্ডিত মদন মোহন মালব্য প্রমুখের তীব্র বিরোধীতার কারণে এই চুক্তি সফলতার মুখ দেখতে পারে নাই। গান্ধিজীও এই চুক্তি বাস্তবায়নের ব্যাপারে আগ্রহী ছিলেন না। এমন কথাও বলা হয়েছিল যে এই চুক্তির মাধ্যমে মুসলমানদের ‘ঘুষ’ দেওয়া হয়েছে। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের মৃত্যুর পর এই চুক্তি বাস্তবায়নের পথে আর এগুতে পারে নাই। ‘নেহেরু রিপোর্ট’ও মুসলামানদের প্রতি রাজকীয় বঞ্চনা নিরসনে ব্যর্থ হয়। ‘হিন্দু মুসলমান মিলনের অগ্রদূত’ বলে খ্যাত ‘কায়েদে আজম’ মুহম্মদ আলী জিন্নাহও বাস্তবতার আলোকে মুসলমানদের প্রতি বৈষম্য নিরসনে ১৪ দফা দাবী উত্থাপন করেন। ঘোষিত হয় ‘সাম্প্রদায়িক রোয়েদাদ’। তারপরও সাম্প্রদায়িক বৈষম্য নিরসনের মাধ্যমে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি গড়ে উঠে নাই। তাই মুসলমানদের জন্য স্বাধীন আবাস ভ’মি কায়েমের দাবী ক্রমেই উচ্চকিত হতে থাকে। তারই ফলশ্রুতিতে ১৯৪০ সালের ২৩ শে মার্চ তারিখে নিখিল ভারত মুসলীম লীগ লাহোর অধিবেশনে মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল নিয়ে পৃথক রাষ্ট্র সমূহ গঠনের প্রস্তাব গ্রহণ করে। এই প্রস্তাবই ‘লাহোর প্রস্তাব’ নামে খ্যাত। উপমহাদেশের রাজনীতি এই ঐতিহাসিক প্রস্তাবকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হতে থাকে। হোসেন শহীদ সোরাওয়ার্দী, শরৎ বসু, আবুল হাশিম, কিরণ শংকর রায় প্রমুখ নেতৃবর্গ বাংলাকে অখন্ড রেখে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র গঠনের আন্দোলন শুরু করেন। এই মতকে ঘিরে বাংলার মানুষের মাঝে গড়ে উঠে ঐক্য। বাঙালী জনগণ সাম্প্রদায়িক বিভেদ পরিহার করে জাতি রাষ্ট্র গঠনের আন্দোলনে শরিক হয়। কায়েদে আজম মুহম্মদ আলি জিন্নাহ এই রাষ্ট্র গঠনের ব্যাপারে তাঁর সম্মতির কথা জানান হোসেন শহিদ সোহরাওয়ার্দীকে। একই প্রস্তাব নিয়ে গান্ধিজীর কাছে যান শরৎ বসু। সমর্থন তো পানই নাই বরঞ্চ তাঁর কাছ থেকে তিরস্কৃত হয়ে ফিরে আসেন শরৎ বসু। এই অখন্ড বাংলা প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব গ্রহণযোগ্য নয় মর্মে কিরণ শংকর রায় বরাবর পত্র লিখে জানিয়ে দেন পন্ডিত জওহর লাল নেহেরু। এই পত্রটি সাম্প্রতিককালে বিভিন্ন পত্রিকায় পুনঃপ্রকাশিত হয়েছে। এভাবেই অখন্ড বাংলায় স্বাধীন ও সার্বভৌম জাতিরাষ্ট্র গঠনের উদ্যোগ ব্যর্থ হয়। সাম্প্রায়িকতার বিষবাষ্পে বাংলার আকাশ বাতাস দূষিত হয়ে যায়। ১৯৪৬ সালের মুসলীম লীগের দিল্লী অধিবেশনে মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল নিয়ে একাধিক রাষ্ট্রের বদলে একটি রাষ্ট্র গঠনের প্রস্তাব করেন। তা গৃহীত হয়। ‘কেবিনেট মিশনের’ প্রস্তাবে মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল নিয়ে দুইটি এবং বাকী অঞ্চল নিয়ে আর একটি ইউনিট গঠন করে ভারতবর্ষে ফেডারেল রাষ্ট্র গঠনের কথা বলা হয়। মুসলীম লীগ ‘মন্দের ভালো’ বলে এই প্রস্তাব গ্রহণ করে। কংগ্রেস সভাপতি মওলানা আবুল কালাম আজাদ ( ফিরোজ বখত) এই প্রস্তাবের সমর্থক ছিলেন। কিন্তু তাঁর উত্তরসূরী কংগ্রেস সভাপতি পন্ডিত জওহর লাল নেহেরু এই প্রস্তাবের ঘোর বিরোধীতা করেন। পন্ডিতজী বিরোধীতার সাথে সাথে ইংরেজদেরকে ভারত ছাড়ার নির্দেশ দেন। ইংরেজদের বিরুদ্ধে কংগ্রেস শুরু করে ‘ভারত ছাড়’ আন্দোলন। ১৯৪৬ সালের ১৬ই আগষ্ট তারিখে মুসলীম লীগ সারা ভারতে প্রত্যক্ষ কর্মপন্থা দিবস (Direct Action Day) পালনের আহ্বান জানায়। এই দিনে বাংলার রাজধানী কোলকাতাসহ সারাদেশে জঘন্য সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়। দাঙ্গার ভয়াবহ চিত্র থেকে এটা স্পষ্ট হয়ে উঠে যে মুসলমানদের স্বাধীন আবাসভ’মি প্রতিষ্ঠার দাবী পূরণ করা না হলে উপমহাদেশ থেকে মুসলমানেরা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। যেমন হয়েছিল স্পেনে। অতএব দিল্লী প্রস্তাবের ভিত্তিতে ভারত বিভাগের দাবীতে মুসলীম লীগ অনড় গ্রহণ করে। এই দাবী মেনে মেনে নেবার সিদ্ধান্ত নেয় বৃটিশ রাজ। বিভক্ত হয় ভারত। সৃষ্টি হয় পাকিস্তান নামের নতুন রাষ্ট্র। বিভক্ত বাংলার পূর্বাংশ এবং বিভক্ত আসামের সিলেট জেলা নিয়ে গঠিত হয় ‘পূর্ব বাংলা ’ প্রদেশ। ১৯৫৬ সালে গৃহীত হয় পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র। পাকিস্তানের পশ্চিমাংশের সিন্ধু, বেলুচিস্তান, পূর্ব পাঞ্জাব ও উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ নিয়ে গঠিত হয় পশ্চিম পাকিস্তান প্রদেশ আর পূর্ব বাংলাকে নিয়ে গঠিত হয় পূর্ব পাকিস্তান প্রদেশ। পাকিস্তানের উভয় অংশের জনগণের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব ও সংহতির দিক বিবেচনা করে আইন সভা সহ অন্যান্য ক্ষেত্রে সংখ্যা-সাম্য নীতি গ্রহণ করা হয়। আইন সভায় অর্ধেক সদস্য নির্বাচিত হয় পূর্ব পাকিস্তান থেকে এবং বাকী অর্ধেক নির্বাচিত হয় পশ্চিম পাকিস্তান থেকে। রাষ্ট্রপতির ক্ষেত্রেও বিধান করা হয় এক মেয়াদে পূর্ব পাকিস্তান থেকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হলে পরবর্তী মেয়াদে রাষ্ট্রপতি হবেন পশ্চিম পাকিস্তানের বাসিন্দা। গভর্নর জেনারেলের ক্ষেত্রেও এর আগে এটা পালিত হয়েছে। যেমন প্রথম গভর্নর জেনারেল হন কায়েদে আজম মুহম্মদ আলী জিন্নাহ (করাচী), তাঁর ইন্তেকালের পর এই পদে মনোনীত হন খাজা নাজিম উদ্দিন (ঢাকা)। তার পর গোলাম মুহম্মদ (পাঞ্জাব) এবং তারপর মেজর জেনারেল ইসকান্দার মির্জা এই পদে নিযুক্ত হন। তবে ইসকান্দার মির্জা পূর্ব পাকিস্তানের বাসিন্দা পরিচয়ে এই পদ পেলেও এ নিয়ে বিতর্ক ছিল। তাকে শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক পূর্ব পাকিস্তানের বাসিন্দা বলে স্বীকার করায় এই বিতর্ক আর বেশী দূর আগায় নাই। তবে বে-সামরিক ও সামরিক বিভাগে চাকুরী সহ অন্যান্য ক্ষেত্রে এই সংখ্যা-সাম্য নীতি অনুসরন করা হয় নাই। ফলে পূর্ব পাকিস্তানের বাসিন্দাগণ রাষ্ট্রীয় অধিকার থেকে বঞ্চিত হতে থাকে। এ থেকে মুক্তি লাভের জন্যই ১৯৬২ সালেই সিরাজুল আলম খান , কাজী আরেফ আহমেদ ও আবদুর রাজ্জাক স্বাধীন জাতি রাষ্ট্রগঠনের জন্য গঠন করেন ‘নিউক্লিয়াস’। ১৯৬৬ সালে ৬-দফা প্রস্তাব উত্থাপন করেন শেখ মুজিবুর রহমান। এই দাবী আওয়ামী লীগের নেতৃবর্গ তখন গ্রহণ করেন নাই। তাই বিভক্ত হয় আওয়ামী লীগ। আবদুস সালাম খান , শাহ আজিজুর রহমান, আতাউর রহমান খান প্রমুখ নেতা এই প্রশ্নে দ্বিমত পোষন করেন। ছয় দফা পন্থি আওয়ামী লীগ ও পি ডি এম (Pakistan Democratic Movement-PDM) পন্থি আওয়ামী লীগ নামে দুটি রাজনৈতিক সংগঠন কাজ করতে থাকে। ছয় দফা পন্থি আওয়ামী লীগের প্রতি সমর্থন দেয় সিরাজুল আলম খানের নেতৃত্বাধীন ‘নিউক্লিয়াস’। ফলে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের সমর্থনে ছয় দফা দাবী বাংলার গ্রাম গঞ্জে আলোচিত হতে থাকে। ছয় দফা প্রশ্নে আওয়ামী লীগের বিভক্তি ছাত্রলীগেও প্রভাব ফেলে ছিল। আল-মুজাহিদী , ফেরদৌস আহমেদ কোরেশীর নেতৃত্বে বিভিন্ন সময়ে ছাত্রলীগ বিভক্ত হলেও তারা সাধারন ছাত্রসমাজের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি। নিউক্লিয়াসের সক্রিয় সমর্থন ও কার্যক্রমের কারণে ৬-দফা দাবীর পক্ষে ব্যাপক জনমত গড়ে উঠে। যারা ৬-দফার বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিল তারা রাজনৈতিক অঙ্গনে করুণার পাত্র হয়ে যায়। কনভেনশন মুসলিম লীগের সরকার অত্যাচার নির্যাতন শুরু করলে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীগণ কারারুদ্ধ হন। তা সত্ত্বেও আন্দোলনের গতি থাকে অপ্রতিরোধ্য। সিরাজুল আলম খান তাঁর লাল রংএর সেই মটর সাইকেল নিয়ে ঢাকার এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত সফর করে জনগণকে আন্দোলনে সম্পৃক্ত করতে থাকেন। তাঁর সাথে ছিলেন কাজী আরেফ আহমেদ, আবদুর রাজ্জাক, শেখ ফজলুল হক মনি, তোফায়েল আহমেদ, আ স ম আবদুর রব, শাহজাহান সিরাজ প্রমুখ ছাত্র নেতৃবৃন্দ। ৬-দফা ও ১১-দফার আন্দোলন সফল হয়। গণ-অভ্যূত্থানে পতন হয় কনভেনশন মুসলিম লীগ সরকারের। পাকিস্তানের ক্ষমতা গ্রহণ করে প্রধান সেনাপতি জেনারেল আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খানের নেতৃত্বাধীন সামরিক জান্তা। সামরিক সরকার ঘোষিত Legal Frame Work এর ভিত্তিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের এবং পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে আওয়ামী লীগ। ক্ষমতা হস্তান্তর না করায় এবং জনগণের উপর ব্যাপক হামলা করায় প্রতিরোধ গড়ে তোলে বাংলার জনগণ। শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধের সশস্ত্র সংগ্রাম পর্ব। আপোষকামীতা আর রাজনৈতিক সুবিধাবাদ যাতে এই যুদ্ধকে বিপথে পরিচালিত করতে না পারে সেজন্য সিরাজুল আলম খান , কাজী আরেফ আহমেদ, আবদুর রাজ্জাক, শেখ ফজলুল হক মনি, তোফায়েল আহমেদ, আ স ম আবদুর রব, শাহজাহান সিরাজ গড়ে তোলেন মুজিব বাহিনী। যুদ্ধে পরাভ’ত হয় হানাদার বাহিনী। পৃথিবীর মানচিত্রে স্বাধীন দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে বাংলাদেশ। মুজিব বাহিনীর নেতৃবৃন্দ দেশের শাসন ব্যবস্থা গ্রহণ করে। দেশের আইন শৃংখলা প্রতিষ্ঠা করতে ও সুশাসন কায়েম করতে তারা পদক্ষেপ গ্রহণ করে। এই কার্যক্রমে ছেদ পড়ে যখন বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে লন্ডন , দিল্লী , কলকাতা হয়ে দেশে ফিরে কায়েম করেন দলীয় শাসন। ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় একদিন স্বাধীনতার রূপকার সিরাজুল আলম খান বললেন যদি ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের ঘটনা বলী অন্যভাবে ঘটতো তাহলে কি হতো । ইয়াহিয়া খান যদি বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর পদ গ্রহণ করে সরকার পরিচালনার আহ্বান জানাতেন , তাহলে বঙ্গবন্ধু তাতে সাড়া দিতেন। তিনি কিন্তু প্রচলিত আইন কানুন অনুসারেই দেশ চালাতেন। তাতে জনগণের ভাগ্যের আদৌ কোন পরিবর্তন হতো না। ইয়াহিয়া খান তা না করায় ঘটনাবলী ভিন্ন খাতে প্রবাহিত হয়। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। বিজয়ের পর বঙ্গবন্ধু বাংলার মসনদে বসলেন। তিনি দেশ পরিচালনা করলেন সেই সাবেক আইন-কানুন অনুসারেই। বৃটিশ ও পাকিস্তানের ধারাবাহিকতা বজায় রেখে সচিবালয় ও আদালতের কার্যক্রম চলতে থাকলো। অফিস আদালতে অনুসৃত হতে থাকলো উপনিবেশিক আমলের পোষাক ও আচার আচরণ। তাহলে জনগণ যে নয়মাস ধরে যুদ্ধ করলো, বরণ করলো শাহাদাত, মেয়েরা অপমানিত হলে, বাড়ি ঘর ফসল আগুনে পুড়লো, এর বিনিময়ে তারা কি পেলো ? তাহলে মার্চ /১৯৭১ মাসে পাকিস্তানের ক্ষমতা গ্রহণ আর জানুয়ারী/১৯৭২ মাসে স্বাধীন বাংলার ক্ষমতা গ্রহণের মধ্যে পার্থক্য কোথায় ? এই দলীয় সরকার গঠনের কারণে বাংলার শ্রমজীবী কর্মজীবী পেশাজীবী জনগনের মুক্তি অর্জন হয়ে গেলো সুদূর পরাহত। সে কারণেই মুক্তিযোদ্ধাগণ আবার নেমে এলো রাজপথে। দাবী উঠলো মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহনকারী দল ও রাজনৈতিক শক্তি সমূহকে নিয়ে জাতীয় বিপ্লবী সরকার গঠনের। এই সরকার গঠন করা হলে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে গড়ে উঠা জাতীয় ঐক্যকে কাজে লাগিয়ে জনগণের উপর চেপে থাকা শোষণের শৃঙ্খল ভাঙা যেতো। কায়েমী স্বার্থবাদীদের পতন হতো। তা না করে পেটোয়া বাহিনী সৃষ্টি করে প্রতিবাদী মুক্তিযোদ্ধাদের দমন পীড়ন আর হত্যার পথ বেছে নেওয়া হলো। জনপদে তো নয়ই কারাগারেও তাদের নিরাপত্তা ছিল না। পাবনায় কারারুদ্ধ ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল মান্নান শেখর, বাদশা, শফিক ও স্বপন। ১৯৭৩ সালের বর্ষাকালে একদিন প্রচার করা হলো তারা জেল থেকে পালিয়েছে। এর পর তাদের লাশ পাওয়া গেলো। রাজশাহীতে গনকন্ঠের সাংবাদিক সেলিমের উপর রক্ষী বাহিনী গাড়ি তুলে দিয়ে তাকে হত্যা করে। সেলিম তো সড়ক দ্বীপের উপর দাঁড়িয়ে তাঁর পেশাগত দায়িত্ব পালন করছিল। সারা দেশের চিত্র ছিল এটাই। ১৯৭৩ সালে পাবনাতেও একইভাবে হত্যার রাজনীতি শুরু হয়। রসায়নে সম্মান শ্রেণীতে রাজশাহী কলেজে ভর্তি হই ঐ সালে। পরিস্থিতি ভালো নয় তাই বগুড়ায় গিয়েছি বোনের বাড়িতে , রমজান মাসের ছুটিতে। ঈদের আগে পাবনায় যাব মা-বাবা ভাইবোনদের সাথে ঈদ করার জন্য। তুষারও নিরাপত্তার কারণে সিরাজগঞ্জ ছেড়ে বগুড়ায় আসে তার মামা বাড়িতে। তার মামা অধ্যাপক হামিদুল হক আমার দুলাভাই। আমার বাড়ি যাবার প্রস্তুতিতে তুষারের মন খারাপ। আমি চলে গেলে সে প্রায় নিঃসঙ্গ হয়ে যাবে। পৌনে পাঁচ বৎসরের ভাগিনা রুশোও আমাকে ছাড়তে নারাজ। বোন দুলাভাইও আমাকে পাবনা যেতে দিতে ভরসা পাচ্ছেন না। তবুও রওনা হলাম। রেল ষ্টেশনে আমার সাথে দুলাভাই, ভাগিনা রুশো ও তুষার আসলেন। বগুড়া থেকে সকাল আটটায় ট্রেন, এই ট্রেনে চড়ে যেতে হবে সান্তাহার। সেখান থেকে বেলা ১১-৩০ মিনিটে রকেট ট্রেনে চড়ে যেতে হবে ঈশ্বরদী। সেখান থেকে বাসে চড়ে যেতে হবে পাবনা। বেলা ০৯-৩০ মিনিট পর্যন্ত অপেক্ষা করেও বগুড়ায় ট্রেন পেলাম না। ট্রেনের এই বিলম্বের কোন কারণও জানাতে পারলো না স্টেশন মাস্টার। কত ক্ষণ পরে ট্রেন আসবে তাও তিনি বলতে পারলেন না। ঐ দিন এই অবস্থায় সান্তাহারে গিয়ে রকেট পাওয়া যাবে না এটা নিশ্চিত হওয়া গেলো। তাই সকলের অনুরোধে ঐ যাত্রার উদ্যোগ বাতিল করলাম। ঠিক হলো পরদিন যাবো। তুষার টিকেটটা ফেরত দিয়ে দিল। দুলাভাইসহ তাদের বাসায় ফিরে আসলাম। বোন খুব খুশী , আমি তাঁদের সাথে আরও একদিন থাকবো বলে। দুপুরের খাবারের আগে ডাক পিওন এলো। আমাকে একটা চিঠি দিল। খামে ভরা চিঠিটি দিয়েছে আমার অনুজ প্রতিম সহচর আবদুল লতিফ মাখন। সে সংক্ষিপ্ত ভাষ্যে আমাকে পাবনা যেতে নিষেধ করেছে। কারণ মুজিববাদী গুন্ডা বাহিনী ও রক্ষী বাহিনী ভাড়ালা গ্রামে অতি প্রত্যুষে হামলা চালিয়ে হত্যা করেছে মাছুদ আলী খান বাবলু ( কাচারী পাড়া ), আশরাফ আলী কানু ( গোবিন্দা ) এবং ফারূক ( কুটি) ( বরিশাল)কে। এরা সকলেই মুক্তিযোদ্ধা এবং জাসদ রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিল। জাসদ নেতা মুহম্মদ ইকবাল ( নিউক্লিয়াসের কনিষ্ঠতম সদস্য) ও নুরুল ইসলাম সেখানে ছিল। গুন্ডাদের হামলা হলে আধা আলো ,আধো অন্ধকারে তারা দৌড়ে পালাতে সক্ষম হন। পদ্মা নদীর তীরের জেলেরো এই বীরমুক্তি যোদ্ধাকে তাদের নৌকায় লুকিয়ে রাখে। পরে তারা কৌশলে তাদেরকে নিরাপদ গন্তব্যে পৌছে দেয়।ওরা উক্ত তিনজনকে খুন করেই ক্ষান্ত হয় নাই। লাশের উপরে বেয়নেট চার্জ করেছিল । মাছুদের লাশে মোট ৪৮ (আটচল্লিশ) টা বেয়নেটের আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গিয়েছিল। আমি ছিলাম পাবনা জেলা শাখা ছ্রাত্রলীগের সাধারন সম্পাদক এবং দৈনিক গণকন্ঠের পাবনা প্রতিনিধি। আমারও সন্ধান করা হয়েছে। পরিবারের সদস্যদের গতিবিধির উপর নজরদারী করছে তা বোঝা যাচ্ছে। তারা আমাকে কোন পত্র দিলে সেটা হবে বিপদের কারণ । তাই আব্বার অনুরোধে মাখন ভিন্ন একটি ডাকঘরে গিয়ে আমাকে এভাবে সতর্ক করে পত্র দেয়। আমি পাবনা যাবার কর্মসূচী বাতিল করি। দীর্ঘ প্রায় এক বৎসর পাবনা যাওয়া থেকে বিরত থাকি। সেদিন মুহম্মদ ইকবাল কোনভাবে বেঁচে গেলেও তাঁর পিছু ওরা ছাড়ে নাই। তিনি ঢাকার গ্রীন রোডে অবস্থান করতে থাকলে সেখানে তাঁর উপর গুন্ডা বাহিনী আবার হামলা করে। তাঁকে ধাওয়া করে নিয়ে যায় বুড়গঙ্গা পর্যন্ত। জনগণের প্রতিরোধে গুন্ডারা এবারও ব্যর্থ হয় তবে পুলিশ তাঁকে গ্রেফতার করে। ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত তাঁকে কারাগারে থাকতে হয়। বীর মুক্তিযোদ্ধা আনোয়ার হোসেন ১৯৭৩ সালের জাতীয় নির্বাচনে ঈশ্বরদী-আটঘড়িয়া থেকে জাসদ মনোনীত প্রার্থী ছিলেন। তাকেও হত্যার উদ্দেশ্যে গুরুতর জখম করা হয়। হাসপাতালে নেবার পথে পাবনা এডওয়ার্ড কলেজের সামনে তাকে ঐ গুন্ডারা পুনরায় ছুরিকাঘাত করে। এ পরিস্থিতি ছিল সারা দেশে। নিজ বাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল , জেল খানা কোথায়ও মুক্তিযোদ্ধাদের নিরাপত্তা ছিল না। কি দোষ ছিল আমাদেরও । দাবী করা হয়েছিল জাতীয় বিপ্লবী সরকার গঠন করে সদ্য স্বাধীন দেশকে গড়ে তোলার। উপনিবেশিক আমলের আইন কানুন, অফিস আদালতের আচার আচরণ, উৎপাদন ও বন্টন পদ্ধতি বদলে ফেলে তা স্বাধীন দেশের উপযোগী করে গড়ে তোলা। এ সব দাবী উত্থাপনের জন্যই উৎপীড়নের স্টীম রোলার চালানো হয়। কায়েম করা হয় সন্ত্রাসের রাজত্ব। লক্ষ্য ছিল ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাষ্ট্রীয় সম্পদ লোপাট করে বিত্ত বৈভব বাড়ানো। তা কি হয়েছে ? ইতিহাস আপন গতিতেই এগিয়ে যায়। অর্বাচীন শাসকেরা বিদায় নেয় করুনভাবে। এর কোন ব্যত্যয় সচরাচর দেখা যায় না।

লেখক: সাবেক জেলা ও দায়রা জজ। বর্তমানে এ্যাডভোকেট বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট , হাইকোর্ট বিভাগ, ঢাকা এবং বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে আইনের অধ্যাপক।
[email protected]

মন্তব্য ১ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (১) মন্তব্য লিখুন

১| ২৩ শে অক্টোবর, ২০১৪ রাত ১:৩৫

মুকতোআকাশ বলেছেন: প্রথমেই আপনার ধন্যবাদ প্রাপ্য এই কারনে যে অনেক লুকায়িত ইতিহাস,অনেক সত্য ঘটনা আপনি অকপটে বলেছেন,যা আজকাল কেউ বলেনা। তবে দুটি বিষয়ে আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করব।
“ তবে বেসামরিক ও সামরিক বিভাগে চাকুরি সহ অন্যান্য অনেক ক্ষেত্রে এই সংখ্যা সাম্য নীতি অনুসরণ করা হয় নাই। ফলে পূর্ব পাকিস্তানের বাসিন্দা গন রাষ্ট্রীয় অধিকার থেকে বঞ্চিত হতে থাকে”। এপর্যন্ত ঠিক আছে।কিন্তু”এ থেকে মুক্তি লাভের জন্যই ১৯৬২ সালে সিরাজুল আলম খান,কাজী আরেফ আহমেদ ও আব্দুর রাজ্জাক স্বাধীন জাতি রাষ্ট্র গঠনের জন্য গঠন করেন নিউক্লিয়াস”।
হ্যা তারা স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের চিন্তা করে ছিলেন ঠিকই। কিন্তু তা তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের ৯৫% মানুষের চিন্তা চেতনার তোয়াক্কা না করে। নিউক্লিয়াস স্বপ্ন দেখেছিলেন একটি ধর্মনিরপেক্ষ সমাজতান্ত্রিক দেশ গঠনের। যা, এ দেশের জনগণের আশা আকাঙ্ক্ষা ও চিন্তা চেতনার সাথে সামঞ্জস্য পূর্ণ ছিল না।
স্বাধীনতা যুদ্ধের আর একটি অত্যন্ত গুরুত্ব পূর্ণ ঘটনা বেমালুম ভুলে গেছেন। সেটি হচ্ছে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা। আপনারা কেউই কক্ষনো কাউকে বলেননি যে এটি সত্য ছিল। বরং আপনারা হাটে ঘাটে মাঠে গিয়ে মানুষের কাছে বলেছেন যে এটি মিথ্যা মামলা। আপনাদের কথা বিশ্বাস করেই জনগণ ৬৯ এর গন আন্দোলন করে ছিল। জনগণ কখনই একটি সমাজতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র গঠনের জন্য আন্দোলন করেনি। তাই জনগণ আওয়ামী লীগ কে ভোট দিয়ে বিজয়ী করে। তারা ১৯৭১ সালের ২২শে মার্চ পর্যন্ত একটি স্বাধীন দেশের কথা চিন্তা করেনি। ধর্মনিরপেক্ষ সমাজতান্ত্রিক দেশ তো দুরের কথা। ২৩শে মার্চের নগ্ন, বর্বরোচিত, ইতিহাসের জঘন্যতম সামরিক হামলার শিকার হয়ে স্বাধীনতার সিদ্ধান্ত নেয় এ দেশের সাধারণ মানুষ। যে দেশের ৯৫% মানুষের চেতনার বিপরীত চেতনায় দেশ স্বাধীন হয় সে দেশের মানুষ তো বহুধাবিভক্ত হবেই। কেনান জনগণের জন্য দেশ স্বাধীন হয় নাই। স্বাধীন হয়েছে৫% মানুষের স্বার্থ রক্ষার জন্য।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.