![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
বাঙালী জাতির আত্ম-চেতনার স্ফুরণ ঘটে ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে। শহিদদের স্মৃতির প্রতি বাৎসরিক শ্রদ্ধা জানানোর আচার আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে আত্ম-চেতনা ক্রম বিকশিত হতে থাকে।ভাষা আন্দোলনে অন্যান্য সংগঠন তো বটেই, গুরুত্বপূর্ণ সাহসী ভূমিকা রেখেছিল ছাত্র সমাজের তৎকালীন একমাত্র সংগঠন ‘পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র লীগ’। ১৯৪৮ সালের ৪ঠা জানুয়ারিতে আত্ম প্রকাশকারী এই ছাত্র সংগঠনের মূল নীতি ছিল, ‘শিক্ষা, শান্তি, প্রগতি’। বাঙালী জাতির আত্ম চেতনাকে আরো বিকশিত করে মুক্তি সংগ্রামের দুর্গম পথ পাড়ি দিতে নকিব ও নিশান বরদারের ভুমিকা পালন করে ‘পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র লীগ’। ৮ই ফালগুনের অনুষ্ঠান পালন করতে গিয়ে এই ছাত্র সংগঠন প্রতি বৎসর প্রকাশ করতো স্মরণিকা। ৮ই ফাল্গুনের ভোরে করতো প্রভাত ফেরী , শহিদ মিনারে সমবেত হয়ে গ্রহণ করতো শপথ। শুধু কেন্দ্রীয় ভাবেই নয়, মফস্বলেও পালিত হতো এ সব অনুষ্ঠান, শাসক মহলের রক্ত চক্ষু উপেক্ষা করে। পাবনা শহরও পিছিয়ে ছিল না এসব অনুষ্ঠান পালনের ক্ষেত্রে । বিংশ শতাব্দীর সপ্তম দশক ( অর্থাৎ ১৯৬১ খ্রিঃ থেকে ১৯৭০ খ্রিঃ পর্যন্ত )এর শেষার্ধে ‘শহিদ দিবস’ এর কাক ডাকা ভোরে যখন পাবনার গোটা শহরবাসী গভীর ঘুমে নিমগ্ন , সেই সময় তাদের ঘুম ভাঙতো জাগরণী গান শুনে , ‘মৃত্যুকে যাঁরা তুচ্ছ করিল ভাষা বাঁচাবার তরে, আজিকে স্মরিও তারে, / যে রক্তের বাণে ইতিহাস হলো লাল, মৃত্যুর বাণে জীবন জাগে বিশাল ,/ সেই আত্মার ঘরে ঘরে , আজিকে স্মরিও তারে, / কোথায় বরকত কোথায় সালাম, সারা বাঙলা কাঁদিয়া ফিরিছে ভাষা বাঁচাবার তরে/ ......।’ আবদুল হামিদ সড়কের নির্জনতা ভেদ করে খালি পায়ে প্রভাত-ফেরী করছে ছাত্রলীগের কর্মীরা । মিছিলের পুরোভাগে গলায় হারমোনিয়াম ঝুলিয়ে নিয়ে গান গাইছেন গোলাম সরওয়ার খান সাধন। ছাত্র লীগের একনিষ্ঠ কর্মী।
পাবনায় শহিদ দিবসের সারা দিনে ছাত্র লীগ আয়োজিত সকল সাংস্কৃৃতিক অনুষ্ঠানের মূল রূপকার ও সংগঠক গোলাম সরওয়ার খান সাধন। পাবনা সরকারী এডওয়ার্ড মহাবিদ্যালয়ের বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র।তিনি ১৯৬৮-১৯৬৯ শিক্ষা বর্ষে পাবনা সরকারী এডওয়ার্ড মহাবিদ্যালয় ছাত্র সংসদের আমোদ প্রমোদ সম্পাদক ছিলেন। গোলাম সরওয়ার খান সাধনের গান আর সাংগাঠনিক তৎপরতা পাবনার গোটা ছাত্র সমাজকে উজ্জিবিত করে বাঙালী জাতীয়তাবাদে, উদ্বুদ্ধ করে মুক্তির লাল সূর্যকে রাহু মুক্ত করার সংগ্রামে। ১৯৭০ সনে ডাকসু ( ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ ) নির্বাচনে জয়ী হয় ছাত্র লীগ। অভিষেক অনুষ্ঠানে নব নির্বাচিত সহ-সভাপতি আ,স,ম, আবদুর রব বলেন ,‘আমাদের সামনে একটি নতুন মানচিত্র, নতুন ভূখন্ড, নতুন পতাকা ।’ স্বাধীন বাংলার পতাকা এরপর ছাত্র লীগের সকল মিছিলে বহন করা হতো। পাবনা শহরে জেলা স্কুলের পাশে মন্টুর দোকানে বিশাল আকৃতির এই পতাকা প্রতিদিন উত্তোলন করা হতো। এই পতাকাকে পরিচিত করানোর জন্য গোলাম সরওয়ার খান সাধন নিজেই গান লিখলেন ‘ রক্ত সূর্য মাঝে সোনালী চিত্র আঁকা , আমার দেশের সবুজ পতাকা.....।’ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে দরদ ভরা কন্ঠে তিনি গাইতেন স্বরচিত এই গান।
এ ভাবেই চলতে থাকে দিন, এগিয়ে যায় মুক্তির কাফেলা। বাঙালীর মুক্তি সনদ ৬-দফা সম্বলিত ১১-দফার দাবীতে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোলে আন্দোলন , সে আন্দোলন রূপ নেয় গণ-অভ্যুত্থানের। রক্ত অশ্রু মাখা সে গণ-অভ্যুত্থানে বিজয়ী হয় জনগন। অনুষ্ঠিত হয় নির্বাচন। বাঙালী জনগন ৬-দফা ,১১-দফা দাবী আদায়ের লক্ষ্যে ঐক্যবদ্ধ হয় বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে। কিন্তু বাঙালীর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের শেষ হয় না। সমস্ত আপোষকামীতার বুকে লাথি মেরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনে স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলন করেন ডাকসুর সহ-সভাপতি জনাব আ,স,ম, আবদুর রব। বঙ্গবন্ধু ডাক দেন ‘অহিংস অসহযোগ আন্দোলন’এর । পাবনায় এই আন্দোলনের সকল কর্মকান্ডে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন গোলাম সরওয়ার খান সাধন। ১৯৭১ সালের ২৩ শে মার্চ তারিখে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহ্বানে সারা বাঙলায় ( তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ) প্রতিটি ভবনে উত্তোলিত হয় রক্তসূর্য মাঝে সোনালী চিত্র আঁকা স্বাধীন বাঙলার সবুজ পতাকা। ঐদিন সকালে বাঙলাদেশের বিশাল পতাকা নিয়ে মিছিল বের করে ছাত্রলীগ। সামনে হারমোনিয়াম গলায় ঝুলিয়ে গোলাম সরওয়ার খান সাধন । কন্ঠে,‘ও আমার দেশের মাটি, তোমার পরে ঠেকাই মাথা’ গান । গোটা শহরবাসী সামিল হয় এই মিছিলে।
শুধু জনগনকে উদ্বুদ্ধ ও উজ্জিবিত করার কাজেই নয় , পাশাপাশি স্বাধীনতার আন্দোলন ও সংগ্রামেও আত্ম নিয়োগ করেন গোলাম সরওয়ার খান সাধন । শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। গোলাম সরওয়ার খান সাধন পিছিয়ে থাকেন নাই। গলার হারমোনিয়াম রেখে হাতে তুলে নেন আগ্নেয়াস্ত্র। অংশ নেন মুক্তি যুদ্ধে। বরন করেন শাহাদাত। স্বাধীনতার ঊষা লগ্নে রক্ত সূর্যের আলোক আভায় অবগাহন করার সুযোগ হয়নি গোলাম সরওয়ার খান সাধনের। তিনি প্রিয় জন্মভূমির কোলে গভীর চির শান্তির ঘুমে শায়িত। ছাত্র জনতা শ্রদ্ধা জানায় এই বীর মুক্তি যোদ্ধাকে, তাঁকে চির স্মরণীয় করে রাখতে চায় । আমাদের আগামীর সন্তানেরা যেন গোলাম সরওয়ার খান সাধনের মতো হয় , এটা ছাত্র জনতার ঐকান্তিক কামনা।
গোলাম সরওয়ার খান সাধন মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণের সময়ে ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের স্নাতকোত্তর পূর্বভাগ শ্রেণীর ছাত্র। এর আগে তিনি পাবনা সরকারী এডওয়ার্ড মহাবিদ্যালয় থেকে পাস কোর্সে বি,এসÑসি পাশ করেন। তিনি উক্ত মহাবিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের আমোদ প্রমোদ সম্পাদক পদে নির্বাচিত হয়ে সাফল্য ও সুনামের সাথে দায়িত্ব পালন করেন। মুক্তির প্রথম প্রহরে তাই পাবনার ছাত্র জনতা এই মহান মুক্তি যোদ্ধাকে চিরস্মরনীয় করে রাখতে ব্রতী হয়। পাবনা সরকারী এডওয়ার্ড মহাবিদ্যালয়ের নতুন নামকরণের জন্য প্রস্তাব করা হয় ‘ শহিদ গোলাম সরওয়ার খান সাধন সরকারী মহাবিদ্যালয় ’। উক্ত মহাবিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের তৎকালীন সহ-সভাপতি অখিল রঞ্জন বসাকের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ছাত্র সংসদের সভায় সর্ব সম্মতিক্রমে এই প্রস্তাাব গৃহীত হয়। ছাত্র সমাজের সাধারণ সভাতেও এই প্রস্তাব সমর্থিত হয়।এ বিষয়ে বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া শুরু হয়, অধ্যক্ষ শীব প্রসন্ন লাহিড়ী এবং তাঁর উত্তরসূরী অধ্যক্ষ অমরেন্দ্র নারায়ণ চৌধুরী এ বিষয়ে মন্ত্রণালয় তথা সরকারের সাথে বিধি মোতাবেক যোগাযোগ করেন। মুক্তি যুদ্ধের ফলশ্রুতিতে গড়ে উঠা সরকারের কাছে এই বীর মুক্তি যোদ্ধার স্মৃতিকে চির জাগরুক করে রাখার প্রস্তাব বাস্তবায়নের আবেদন করা হয়, আশ্বাসও পাওয়া যায়। অন্ধকারের কীটেরা নেপথ্যেই তাদের গণবিরোধী কার্যক্রম চালিয়ে থাকে, এখানেও কারা যেন নেপথ্যে বাধ সাধে । ফলে ঐ প্রস্তাব আর আলোর মুখ দেখে নাই।
আমরা মুক্তি যোদ্ধা ও শহিদদের শ্রদ্ধা অর্পণ করতে কথার ফুলঝুরি ছড়াতে কার্পণ্য করি না, কিন্তু কাজের কাজ কতটুকু করি? যদি করতাম তাহলে কি শহিদ গোলাম সরওয়ার খান সাধনের নামে পাবনার ঐতিহ্যবাহী মহাবিদ্যালয়ের নামকরণের প্রস্তাব ৪৩ (তেতাল্লিশ) বৎসর ধরে অনিশ্চয়তার মাঝে ঝুলে থাকতো ? দিন যতই গড়াচ্ছে সম্ভাবনার দুয়ার ততই রুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। এ দায়ভার কে বইবে ? তা বাস্তবায়িত হলে নতুন প্রজন্ম মহাবিদ্যালয়ে পদার্পন করেই জানতে পারতো তাদের বীর দেশপ্রেমিক পূর্বসূরীর কথা, তারাও ব্রতী হতো দেশপ্রেমে।
গোলাম সরওয়ার খান সাধন, এ দেশের ঘরে ঘরে মুক্তি সনদ তোমারই রক্তে লেখা হয়েছে, তোমার আত্মদান বৃথা যায় নি, কিন্তু আমরা সেই ঝান্ডা সমুন্নত রাখতে ব্যর্থ হয়েছি। আমাদের নৈতিকতায় আজ চির ধরেছে, দূরদর্শীতার অভাব আমাদের প্রতি পদক্ষেপে। আমরা সুবিধাবাদের চোরা বালিতে আটকে গেছি। দোয়া চাওয়া অথবা সহযাত্রী নির্বাচনের ক্ষেত্রে আমরা বাছ বিচার করতে ভুলে গেছি। তুমি আমাদের ক্ষমা করো। আর্শীবাদ করো এদেশের নতুন প্রজন্ম যেন তোমার মতো হয় , তারা যেন অনৈতিকতা, অদূরদর্শীতা, সুবিধাবাদের বস্তা পচা জঞ্জালকে পায়ে দলে সমুন্নত করতে পারে সেই সবুজ পতাকা, যাতে আঁকা রয়েছে রক্ত সূর্য। ঐ রক্ত সূর্য আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় তোমাকে এবং তোমার মতো অগণিত শহিদকে।
লেখক: সাবেক জেলা ও দায়রা জজ । বর্তমানে এ্যাডভোকেট বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট , হাইকোর্ট বিভাগ , ঢাকা এবং বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগের অধ্যাপক। [email protected]
©somewhere in net ltd.
১|
১৪ ই ডিসেম্বর, ২০১৪ দুপুর ১২:৩৬
খেলাঘর বলেছেন:
পড়েছি