![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
বাংলার জনগণ কখনো কোন বিদেশী অপ-শক্তির কাছে মাথা নত করে নাই। দেশীয় স্বৈর শাসকদেরও বিদায় নিতে হয়েছে জনগণের অবিরাম লড়াইয়ের ফলে। ১৯৬৮ সালে আইউব খান পালন করে ‘উন্নয়ন দশক’। চারিদিকে ঢাক ঢোল বাজিয়ে প্রচার করা হলো আইউব খানের দশ বৎসরের শাসনে সারা দেশে উন্নয়নের জোয়ার এসেছে। কমলাপুর রেল স্টেশন, টিভি স্টেশন, ঈশ্বরদীসহ বিভিন্ন স্থানে বিমান বন্দর, রাজশাহীতে চিকিৎসা মহাবিদ্যালয়, পাবনায় মানসিক হাসপাতাল, পাবনার মালিগাছাসহ পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন স্থানে হেলিপ্যাড স্থাপন করে হেলিকপ্টার সার্ভিস চালু ( পরবর্তীতে যশোরগামী হেলিকপ্টার একটি শকুনের সাথে আঘাত লেগে বিধস্থ হলে ঐ সার্ভিস বন্ধ হয়ে যায়), চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়, ফেঞ্চুগঞ্জ সার কারখানা, কর্ণফুলী কাগজ কারখানা, পাকসী কাগজ কারখানা, খুলনায় নিউজ প্রিন্ট কারখানা, চালনা সমুদ্র বন্দর, খুলনা থেকে ঢাকাগামী ‘সুন্দরবন এক্সপ্রেস’ ট্রেন চালু, নগরবাড়ি-আরিচা ফেরী চালু ও প্রয়োজনীয় সড়ক নির্মাণের মাধ্যমে উত্তর ও দক্ষিণ বাংলার সাথে রাজধানী ঢাকার সড়ক পথে যোগাযোগ স্থাপনসহ উন্নয়নের এন্তার ফিরিস্তি তুলে ধরা হলো জনগণের সামনে। কবি লেখক গায়ক এরাও পিছিয়ে থাকলেন না। আইউব খান ও মোনায়েম খানের স্তুতি বন্দনা করে এই সব কবি লেখকদের লেখা প্রবন্ধ কবিতা দৈনিক খবরের কাগজসহ সাপ্তাহিক মাসিক পত্র পত্রিকায় ছাপা হতে থাকলো। কন্ঠ শিল্পীগণ সুললিত কন্ঠে কোরাস গাইলেন : ঝান্ডা তুলে ধর , কওমী সিপাহসালার, রাহা দেখিয়ে বাড়াও কদম তোমার। চিত্রশিল্পীগণ আইউব খান ও মোনায়েম খানের ছবি এঁকে দেখালেন এসব নেতারা কত জনদরদী। মসজিদ মন্দির গীর্জা প্যাগোডায় দোয়া মোনাজাত প্রার্থনা করা হলো আইউব খান ও তাঁর শাসন আমলের দীর্ঘায়ু কামনা করে। স্কুল কলেজসহ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সমূহে আয়োজিত হলো ‘রচনা প্রতিযোগিতা’, ‘কবিতা লেখা ও আবৃত্তি প্রতিযোগিতা’, ‘সঙ্গীত প্রতিযোগিতা’ সহ াবিভিন্ন প্রতিযোগিতার অনুষ্ঠান। বিজয়ীদের মধ্যে পুরষ্কার বিতরণের জন্য জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হলো। জেলা সদরের অনুষ্ঠানে ডেপুটি কমিশনার মহোদয়, মহকুমা সদরে এস ডি ও মহোদয় এবং থানা সদরে সার্কেল অফিসার ( উন্নয়ন) মহোদয় সস্ত্রীক পদধূলি দিলেন। ছাত্রছাত্রীদের কেউ গাইলো ‘দূর দ্বীপ বাসিনী...’, কেউ আবৃত্তি করলো ‘ গাহি সাম্যের গান, মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই ...’ , কেউ হাস্যরস পরিবেশন করলো । তারপর আগত প্রধান অতিথি : ক্ষেত্র মতো ডেপুটি কমিশনার / সাব-ডিভিশনাল অফিসার ( এস ডি ও )/ সি ও (উন্নয়ন) বক্তৃতা করলেন। তারা বললেন আইউব খানই দেশের উপযুক্ত শাসক, উন্নয়নের জন্যই তাঁর ক্ষমতায় থাকা প্রয়োজন। তিনিই দেশের সার্বিক উন্নয়ন করেছেন এই উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে আইউব খানের বিকল্প নাই। শিক্ষকদের শিখিয়ে দেয়া মতে ছাত্রগণ মুহূর্মুহু করতালি দিয়ে তারস্বরে বললো : ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’, ‘আইউব খান জিন্দাবাদ’। তারপর বেগম মহোদয়া বিজয়ীদের মাঝে বিতরণ করলেন পুরষ্কার। গ্রামে জনপদে আয়োজিত হলো এরূপ অনেক অনুষ্ঠান। ‘হা ডু ডু খেলা প্রতিযোগিতা’, ‘সাঁতার প্রতিযোগিতা’, ‘কৃষি প্রদর্শনী’সহ আরো অনেক প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হলো। সরকারী ভবনসহ অনেক ভবন সজ্জিত করা হলো আলোক সজ্জ্বায়, এটাও ছিল প্রতিযোগিতার বিষয়। বর্নাঢ্য অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বিতরণ করা হলো বিজয়ীদের মধ্যে পুরষ্কার। সাহিত্যিক কবি শিক্ষাবিদ সহ বিশিষ্ট নাগরিকদেরকে ভ’ষিত করা হলো খেতাবে; কেই ‘হেলালী ইমতিয়াজ’, কেউ ‘হেলালী পাকিস্তান’, ‘কেউ হেলালী জুরাত’ কেউ ‘তঘমায়ে পাকিস্তান’, কেউ ‘তঘমায়ে খিদমত’ খেতাবে ভ’ষিত হয়ে আনন্দে আটখানা হয়ে গেলেন। সারা দেশে আনন্দ উৎসবে মাতোয়ারা। লোকে বলাবলি করতে লাগলো আইউব খান ছাড়া উন্নয়ন করার কেউ নাই। উন্নয়নের জন্য আইউব খানকেই থাকতে হবে ক্ষমতায়। তাঁেক ক্ষমতা থেকে সরাতে পারে এমন কোন নেতাও দেশে নাই। এই সময়ই পাবনা জেলা স্কুলের শিক্ষক আব্দুর রহিম সাহেব তাঁর ছাত্রদেরকে শব্দের ব্যবহারের মাধূর্য পড়াতে গিয়ে ক্লাসে বলেছিলেন এ্টা ‘উন্নয়নের দশক (Decade of Devolepment) নয়, এটা অবক্ষয়ের দশক(Decade of Decay)। তিনি এটা বলেছিলেন লে: জেনারেল আজম খানকে উদ্ধৃত করে। আজম খান ঐ সময়ে আইউব খানের তীব্র সমালোচক ছিলেন। যদিও ১৯৫৮ সালে জেনারেল আইউব খান কর্তৃক ক্ষমতা গ্রহণের সময় তাঁর সহযোগী ছিলেন লে: জেনারেল আজম খান। তিনি এক সময় আইউব খান কর্তৃক পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর নিযুক্ত হন এবং পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মাঝে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেন। সেই সময়ের ঘটনা গভর্নর আজম খান এসেছেন পাবনা সফরে। শহরের আব্দুল হামিদ সড়ক দিয়ে তাঁর গাড়ি বহর যাচ্ছে হঠাৎ এক ব্যাক্তি হাত তুলে গভর্নরের গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে গেলো। লোকটির পরনে সাধারণ লুঙ্গি ও গেঞ্জি, পেশায় চা বিক্রেতা তার হাতে এক ছড়ি পাকা শবরী কলা।স্বাভাবিক ভাবেই স্পর্ধিত আচরণ এবং এরূপ আচরণকারীকে নিরাপত্তা রক্ষীদের দ্বারা হেনস্তা হবার কথা; কিন্তু না তার কিছুই হলো না। গভর্নরের নির্দেশে গাড়ি থেমে গেলো। আজম খান লোকটিকে কাছে টেনে নিলেন। গাড়ি থামানোর সংকেত দেবার কারণ জানতে চাইলেন।‘মাননীয় গভর্নর , আপনি আমাদের শহরে এসেছেন এবং আমার দোকানের পাশ দিয়েই যাচ্ছেন, আপনার মতো মহৎ ব্যাক্তিকে আদর আপ্যায়ন করার সুযোগ আমার হবে না, সম্ভাবনাও নাই, তাই আপনার জন্য ভালবাসার নিদর্শন স্বরূপ এই এলাকার প্রসিদ্ধ এই এক ছড়ি পাকা শবরী কলা নিয়ে এসেছি, গ্রহণ করলে আমি খুবই খুশী হবো।’ মূলত এটাই ছিল চা বিক্রেতা আবদুল জলিলের উত্তর। সমস্ত প্রটোকল স্থগিত করে গভর্নর নেমে এলেন গাড়ি থেকে। বুকে জড়িয়ে ধরলেন ক্ষুদ্র চা বিক্রেতা আবদুল জলিলকে। জলিলের অনেক কাকুতি মিনতির পর গ্রহণ করলেন কলা, গভর্নর এবার দশটি টাকা দিতে চাইলেন জলিলকে। কাকুতি মিনতির পালা এবার বদলে গেলো। কলার ‘দাম’ নিতে জলিল বিনয়ের সাথে অপারগতা প্রকাশ করলো। গভর্নর জানালেন দাম নয় ভাইয়ের প্রতি ভাইয়ের সহমর্মিতা ও ভালবাসার নিদর্শন স্বরূপ তিনি এই তওফা দিচ্ছেন জলিলকে। জলিল এবার টাকা নিলো। সালাম বিনিময়ের পর গভর্নর গাড়িতে উঠে নিজ গন্তব্যে রওনা হলেন। তিনি চলে গেলেও পাবনাবাসী মনে শ্রদ্ধার আসনে আসীন হয়ে থাকলেন স্মরণাতীতকাল অবধি।এ কারণেই তাঁর উদ্ধৃতি আবদুর রহিম স্যারের কাছে হৃদয়গ্রাহী হয় এবং তিনি ছাত্রদের পাঠ দেবার সময় উপযুক্ত ক্ষেত্রে তা উদ্ধৃত করেন। একই স্কুলের আরেক জন শিক্ষক আবদুল করিম স্যার ছাত্রদের পাঠ দান করতে গিয়ে বললেন : ‘পাকিস্তান এক আজব রাষ্ট্র। হাজার মাইলের ব্যবধানে অবস্থিত দুই অংশ। ধর্মীয় বিশ্বাসের ক্ষেত্রে উভয় অংশের সংখ্যাগুরু জনগণের মধ্যে মিল থাকলেও খাদ্য অভ্যাস, বিনোদন, অর্থনৈতিক কর্মকান্ড সম্পর্কিত ক্ষেত্রে কোন মিল নাই।’ জনান্তিকে এ ধরণের কথাবার্তা চললেও প্রকাশ্যে উন্নয়ন দশকের উৎসবের ডামাডোল এতটুকুও বাধাগ্রস্থ বা ম্লান হয় নাই। ২৭ অক্টোবর ১৯৬৮ খ্রি; তারিখে ‘বিপ্লব দিবসে’ বর্ণাঢ্য সমাপনী অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ইতি টানা হলো ‘উন্নয়ন দশক’ উদযাপনের অনুষ্ঠানমালার। সবাই বললো ফিল্ড মার্শাল আইউব খানকে পাকিস্তানের ক্ষমতা থেকে সরায় সাধ্য কার। দেশে বিদেশে সর্বত্রই তিনি পরিচিত ও সমাদৃত। শাসন ও উন্নয়ন কাজে জনগনকে সম্পৃক্ত না করে দেশ শাসন করা যায় না এটা আইউব খান ও তাঁর দল কনভেনশন মুসলীম লীগ সেদিন বুঝতে চায় নাই। তারা জানতো না আগামীতে তাঁদের জন্য কি ভাগ্য অপেক্ষা করছে।
উন্নয়ন দশকের এই ডামাডোলের আওয়াজ ও রেশ মিলাতে না মিলতেই পাকিস্তানের উভয় অংশে জ্বলে উঠলো বিদ্রোহের আগুন। তা অপ্রতিরোধ্য গতিতে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়লো। পতন হলো কনভেনশন মুসলীম লীগ সরকারের। পদত্যাগ করলেন আইউব খান। দেশে জারি হলো সামরিক শাসন। ক্ষমতা গ্রহণ করলেন জেনারেল ইয়াহিয়া খান। তিনি নির্বাচন দিলেন কিন্তু গণ প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করলেন না। বাংলার জনগণকে দাবিয়ে রাখার জন্য ‘অপারেশন সার্চ লাইন ’ নামে অভিযান শুরু করলেন। গর্জে উঠলো বাংলা। প্রতিরোধ গড়ে উঠলো গ্রামে গঞ্জে শহরে বন্দরে। বাংলার জনগণের মুক্তির সংগ্রাম নতুন ধাপে উত্তরিত হলো। ‘নিউক্লিয়াসে’র সদস্যরা সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করলেন, তাদের সাথে যুক্ত হলো বাংলার সংগ্রামী জনগণ। ব্যাপক গণহত্যা, নারী ধর্ষণ, গৃহ ও ফসলে অগ্নি সংযোগ করেও জেনারেল ইয়াহিয়া, জেনারেল পীরজাদা, জেনারেল টিক্কা খান জেনারেল নিয়াজী বাংলার মানুষকে মাথা নত করাতে পারে নাই। তারা দেশে বিদেশে চিহ্নিত হলো ‘হানাদার বাহিনী’ নামে। পরাভ’ত হলো পৃথিবীর সেরা সেনাবাহিনী বলে খ্যাত এই হানাদার বাহিনী। এই আত্ম সমর্পনের অনুষ্ঠানে বাংলার সেনাবাহিনীর প্রধান সেনাপতি কর্নেল (পরবর্তীকালে জেনারেল) আতাউল গনি উসমানী উপস্থিত ছিলেন না। কেন ছিলেন না এ প্রশ্ন প্রায়ই উত্থিত হয়। ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলনকারী আ স ম আব্দুর রব জানান যে উসমানী সাহেবের বিমানের উপর হামলা হয়েছিল। যার কারণে তাঁকে জরুরী অবতরণ করতে হয়। তিনি আরও জানান যে ঐ বিমানে ডা: জাফরুল্লাহ চৌধুরী ছিলেন। এ বিষয়ে ডা: চৌধুরীর কাছে জানতে চাইলে তিনি স্বীকার করেন যে তিনি ঐ বিমানে ছিলেন, তাঁদের সাথে আরও ছিলেন বঙ্গবন্ধু তনয় শেখ কামাল, জেনারেল রব, ব্রিগেডিয়ার গুপ্ত এবং সাংবাদিক আল্লামা। তাঁরা ১২ই ডিসেম্বর ১৯৭১খ্রি: তারিখে কুমিল্লায় এসেছিলেন। আত্ম সমর্পনের এই অনুষ্ঠানে প্রাধান সেনাপতিকে অবশ্যই থাকতে হবে মর্মে ডা: চৌধুরী ও শেখ কামাল বার বার অনুরোধ করতে থাকেন এবং এই অনুরোধের সমর্থনে জোরালো যুক্তি তুলে ধরতে থাকেন। কিন্তু প্রবাসী সরকারের প্রধান মন্ত্রী তাজ উদ্দিন আহমেদ সাহেবের কাছ থেকে ‘ক্লিয়ারেন্স’ না পাবার কারণে উসমানী সাহেব ঢাকা যেতে চাননি। ডা: জাফরুল্লাহ চৌধুরীর মতে প্রবাসী সরকার তাদের আগে উসমানী সাহেবকে ঢাকায় যেতে দিতে চাননি। উসমানী সাহেব নিজেও মন্ত্রীর পদমর্যাদাভুক্ত ছিলেন। হযরত শাহ জালাল (রহএর সাথে এদেশে এসেছিলেন উসমানী সাহেবের পূর্ব পুরুষ। সিলেট শত্রুমুক্ত হয়েছে জেনে তিনি সিলেটে যেতে চান। একটি হেলিকপ্টারে করে তাঁরা সিলেটের পথে রওনা হন। ঐ হেলিকপ্টারে দুই জন ভারতীয় পাইলট ছিলেন। সেখানে গিয়ে দেখেন যুদ্ধ চলছে। তাদের বহনকারী বিমান টিকে গুলি করা হয়। জেনারেল গুপ্ত বলেছিলেন একটি বিমান থেকে এই গুলি নিক্ষেপ করা হয়।ঐ সময় পাকিস্তানী বাহিনী আকাশ পথের নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছিল। আকাশে পাকিস্তানী বাহিনীর কোন বিমান ছিল না। গুলিবিদ্ধ হবার কারণে বিমানের তেলের ট্যাংক ছিদ্র হয়ে যায়। জেনারেল রব পায়ে গুলির আঘাত পান এবং তার ‘হার্ট এ্যাটাক’ হয়। ডা: চৌধুরী তাঁকে তাৎক্ষণিক চিকিৎসা দেন। এ ছাড়াও শেখ কামাল, ব্রিগেডিয়ার গুপ্ত এবং সাংবাদিক আল্লামাও কমবেশী আহত হন। উসমানী সাহেব ও ডা: জাফরুল্লাহ চৌুধুরী শুধু অক্ষত ছিলেন। আহতদের সবাইকেই ডা: জাফরুল্লাহ চৌুধুরী তাৎক্ষণিক চিকিৎসা দেন। ফেঞ্চুগঞ্জে বিমানটিকে জরুরী অবতরণ করতে হয়। দুর্ঘটনা কবলিত হবার পর একজন পাইলট জানান যে দশ মিনিটের মধ্যেই হেলিকপ্টারটি বিধ্বস্ত হয়ে যাবে। পাইলটটি এক দুই করে উচ্চস্বরে সময় গণনা করতে থাকেন। সবাই দ্রুত হেলিকপ্টার থেকে নেমে পড়েন। সেদিনের স্মৃতি রোমন্থন করে ডা: চৌধুরী বলেন ‘আমাদের চোখের সামনে মুহূর্তের মধ্যে হেলিকপ্টারটি পুড়ে ছাই হয়ে গেলো’। শত্রুর বিমান জ্বলছে মনে করে আশ পাশ থেকে জনগণ ছুটে এলো কিন্তু তারা যখন দেখলো এবং চিনতে পারলো কর্নেল উসমানীকে ; তখন তারা যারপর নাই আনন্দে জয়ধ্বনি দিল। তারা উসমানী সাহেব ও তার সঙ্গীদের ফেঞ্চুগঞ্জ সার কারখানায় নিয়ে গেলো। এই আক্রমণের উদ্দেশ্য ছিল উসমানী সাহেবকে হত্যা করা। ঐ সময়ে এটা আলোচনায় এসেছিল যে শত্রুমুক্ত হলে ভারতীয় আই সি এস অফিসারদের দ্বারা বাংলাদেশের বে-সামনিক প্রশাসন চালু করা হবে। উসমানী সাহেব এর বিরোধীনা করেন। তিনি মত প্রকাশ করেন যে বাঙালী সি এস পি অফিসারদের অনেকেই মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছে এবং আরো অনেকে অবরুদ্ধ হয়ে আছে। তাদেরকে দিয়েই শত্রুমুক্ত দেশের বে-সামরিক প্রশাসন চালু করা সম্ভব হবে। বিদেশীদের দিয়ে বে-সামরিক প্রশাসন চালু করা হলে দেশের স্বাধীনতা বিপন্ন হবে। এই মত প্রকাশের কারণে তিনি শীর্ষ পর্যায়ের কারো কারো বিরাগ ভাজন হয়ে পড়েন। প্রাগুক্ত তথ্য সমূহের সবটুকুই ডা: জাফরুল্লাহ চৌধুরীর সাথে একাধিকবার ব্যক্তিগত আলাপচারিতা থেকে পাওয়া গেছে। এখানে আরো উল্লেখ করা প্রয়োজন যে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ডা: জাফরুল্লাহ চৌধুরী এবং তাঁর সঙ্গীগণ মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য হাসপাতাল স্থাপন করে মুক্তিযু্েদ্ধ অপরিসীম অবদান রেখেছেন। তাঁর এই চেতনা ও কর্মকান্ড মুক্তিকামী জনগণের কাছে চিরস্মরণীয় হয়ে তো থাকবেই উপরন্তু যুগ যুগ ধরে জনগণের মুক্তির সংগ্রামে প্রেরণার উৎস হয়ে কাজ করবে।
হানাদার বাহিনীকে পরাভ’ত করার পর প্রাথমিকভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের দ্বারাই বে-সামরিক প্রশাসন চালু করা হলো কিছুদিন পরেই তাদের স্থানে বাঙালী কর্মকর্তা কর্মচারীদের বসানো হলো। এ ক্ষেত্রে যথাযথ বাছ বিচার না করায় দেখা গেলো দুর্নীতিবাজরাও প্রশাসনে ঢুকে গেছে। মুক্তিযুদ্ধের অব্যবহিত আগে পাকিস্তানের কেšদ্রীয় সরকার ৩০৩ জন সি এস পি অফিসারকে চাকুরীচ্যূত করে। তাদের বিরুদ্ধে গুরুতর দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ার কারনেই এই ব্যবস্থা নেওয়া হয়। স্বাধীনতার সূর্য সকালে এরাও সাধু সেজে বলে যে বাঙালী হবার কারণেই তাদেরকে চাকুরীচ্যূত করা হয়েছে।এভাবে তারা স্বাধীন বাংলার বে-সামরিক প্রশাসনে ঢুকে পড়ে।এভাবেই চালু হয় বে-সামরিক প্রশাসন; এভাবেই চলতে থাকে ‘শৃঙ্খলা বাহিনী’। আইন-কানুন শাসন পদ্ধতি রয়ে গেলো আগের মতোই। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী তাদের ব্যবসা ও শোষনের স্বার্থেই এদেশে আইন কানুন প্রণয়ন করে তা বাস্তবায়নের জন্য প্রতিষ্ঠা করে কোর্ট কাচারী। বাতিল করে সুলতানী ও নবাবী আমলের আইন কানুন। বৃটিশরাজ ক্ষমতা নিয়ে একই ধারা অব্যাহত রাখে। রাজদরবারের ফারর্সী ভাষাও তারা বদলাতে উদ্যোগী হয়। প্রস্তাব আসে ফার্সী ভাষা বদলালে তদস্থলে চালু করতে হবে বাংলাভাষা। কিন্তু তাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল শোষন এবং শাসন ব্যবস্থাও হবে শোষণের সহায়ক , তাই তারা বাংলার বদলে ইংরেজি ভাষাকেই তাদের উদ্দেশ্য পূরণের জন্য সহায়ক বলে বিবেচনা করে। সেই লক্ষ্যে তারা দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে চালু করে ইংরেজি ভাষা।
পরাধীন আমলের আইন-কানুন, শৃংখলা ও আচরণ বিধি এবং ভাষা নিয়েই দেশী কর্মকর্তাগণ তাদের দায়িত্ব পালন করতে থাকেন। জনগণের সামনে তাঁরা নিজেদেরকে সেবক বলে পরিচয় দিলেও তাদের চাল চলন, আচার আচরণ, রুচিবোধ ও মানসিকতা ইংরেজ ও পাঞ্জাবী শাসকসুলভ। জনগণ তাদের কাছে প্রতিকার চাইতে গেলে তুচ্ছ ভুলভ্রান্তি ধরে ক’ট তর্কের জাল বিস্তার করেন। প্রতিকার প্রার্থীদেরকে আইন কানুন শিখায়, যেন এরাই সকল জ্ঞানের ভান্ডার নিয়ে জনসেবার জন্য বসে আছে। এখান থেকেই সূত্রপাত ঘটে দুর্নীতির। শৃংখলা বাহিনীর কাছে তো আরও কঠিন অবস্থা। পরাধীন আমলে বলা হতো ‘বাঘে ছুলে আঠার ঘা, পুলিশ ছুলে ছত্রিশ ঘা’। নাগরিক সমাজ আজ অসহায়। তাদের কাছ থেকে এই সব শাসকক’ল ও বাহিনীর সদস্যগণ চায় আনুগত্য ও সালাম। সাধারণ নাগরিক তো দূরের কথা, এরা নিজেরা বিশিষ্ট নাগরিকদেরকেও সম্মান করতে পরাক্সমুখ। এদেরকে ভদ্রলোকেরা মানমর্যাদার ভয়ে তাই এড়িয়ে চলে।
ভূ-খন্ড, পতাকা, সঙ্গীত, পাখি, ফল , গাছ, মাছ এগুলো একটি দেশ ও জনগণের পরিচিতি নির্দেশ করে মাত্র। জনগণকে মুক্তি পেতে হলে প্রথমেই অর্থনৈতিক শৃংখল থেকে তাদের মুক্ত করতে হবে। উৎপাদন ও বন্টন সম্পর্কিত বিধান প্রণয়ন করতে হবে শ্রমজীবী জনগণের স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে। উৎপাদনের সাথে যে যতটুকু অবদান রাখে তাকে সেই অনুপাতে লভ্যাংশ দিতে হবে। এজন্য উপযোগী আইন প্রণয়ন করতে হবে। শাসন ও উন্নয়ন ব্যবস্থায় জনগণকে সম্পৃক্ত করতে হবে।
হানাদার বাহিনী বিতাড়ন করে, দেশীয় নাগরিকদের দিয়ে বে-সামরিক শাসন ও বিচার ব্যবস্থা গড়ে তুলে, দেশীয় নাগরিকদের নিয়ে ‘শৃঙ্খলা বাহিনী’ গঠন করে স্বাধীনতা কখনো পূর্ণতা পায় না। এর মাধ্যমে মুক্তির একটি ধাপ অতিক্রান্ত হয় মাত্র। প্রকৃত মুক্তির পথে জনগণকে অব্যাহত গতিতে এগিয়ে যেতে হয়। স্বাধীনতার রূপকার সিরাজুল আলম খান বলে: ‘যে আইন ও বিধির দ্বারা বিদেশী শাসকেরা শাসন করে সে আইন ও বিধিকে বদলিয়ে নিজেদের উপযোগী শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করাই হলো স্বাধীনতার মূল কথা। বিদেশী শাসক বদলিয়ে দেশীয় শাসকদের ক্ষমতায় বসিয়ে ্ঔপনিবেশিক আমলের রাষ্ট্রীয় কাঠামো ও শাসনব্যবস্থা দিয়ে দেশ পরিচালনা করা জনগণের জন্য এক ধরণের পরাধীনতা। যাকে রাষ্ট্র বিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় অভ্যন্তরীণ পরাধীনতা।’
শ্রমজীবী কর্মজীবী পেশাজীবী জনগণের মুক্তির আন্দোলনের পথের আরেকটি সোপান ‘অভ্যন্তরীণ পরাধীনতা’র শৃংখল ভঙ্গের লড়াই। বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত এ লড়াই চলবে।
লেখকঃ সাবেক জেলা ও দায়রা জজ। বর্তমানে এ্যাডভোকেট বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট , হাইকোর্ট বিভাগ, ঢাকা এবং বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে আইনের অধ্যাপক।[email protected]
©somewhere in net ltd.