![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
প্রায় ছয় শত বৎসর আগের কথা । ভারতবর্ষের রাজধানী দিল্লীর কর্মব্যস্ত রাজপথ। নাগরিকেরা যার যার প্রয়োজন মতো চলাফেরা করছে। হঠাৎ একটি মত্ত হস্তী ছুটতে শুরু করলো রাজপথে। সবাই নিজ নিজ মতো আত্মরক্ষার্থে নিরাপদ আশ্রয় খুজে পেতে ত্র্যস্ত ব্যস্ত। একটি শিশু তার শঙ্কিত শশব্যস্ত মায়ের নিরাপদ কোল থেকে পড়ে গেল বিপদ সঙ্কুল রাজপথে। মায়ের আর্তচিৎকারে বাতাস ভারাক্রান্ত। কিন্তু কেহই শিশুটিকে উদ্ধার করার জন্য এগিয়ে আসছে না। হঠাৎ এক ব্যক্তি নিজের জীবন বিপন্ন করে এগিয়ে গেল শিশুটিকে উদ্ধার করতে । ঐ ব্যক্তির নিরাপত্তা নিয়েও পথচারীরা নিজেদের নিরাপদ অবস্থানে থেকে চিৎকার করতে লাগলো। কিন্তু উক্ত ব্যক্তি তার সংকল্পে অটল। সে উদ্ধার করে আনলো বিপদাপন্ন শিশুটিকে। পরিচয় নিয়ে দেখা গেল শিশুটি একজন মেথরের সন্তান। এইরূপ একটি মেথরের সন্তানের জীবন রক্ষার জন্য নিজের জীবন বিপন্ন করে এগিয়ে যাওয়া নিতান্তই বোকামীর কাজ বলে পথচারীরা উক্ত উদ্ধারকারী ব্যক্তিকে ভৎর্সনা করতে লাগলো। কিন্তু তাতে পরোয়া না করে উদ্ধারকারী ব্যক্তি জানালো শিশুটির মূল পরিচয় সে একজন মানব সন্তান । সে ভারতবর্ষের একজন প্রজা । তাই শিশুটির জীবন রক্ষার জন্য এগিয়ে যাওয়া কোন বোকামি ছিলনা। পরিচয় নিয়ে জানা গেল উদ্ধারকারী ব্যক্তি আর কেহই নন, তিনি ভারতবর্ষের সম্রাট জহির উদ্দিন মহম্মদ বাবর। মহান সম্রাট তাঁর প্রজাদের অবস্থা জানার জন্য ছদ্মবেশে বের হয়ে ঘটনাক্রমে এই উদ্ধার কাজ করেন। এতে মুগ্ধ হয়ে তাঁর কাছে আত্মসমর্পন করে চৌহান নামে এক ছদ্মবেশী ঘাতক। চৌহান জানায় যে সে সম্রাট বাবরকে খুন করার জন্য দীর্ঘদিন ধরে ছদ্মবেশে ঘুরছিল। মানবতার প্রতি সম্রাটের অকৃত্রিম ও কার্যকর আস্থা , প্রজাপ্রীতি ও মানুষের প্রতি মমত্ববোধ দেখে তার খুনের নেশা কেটে গেছে। এই সম্রাটের উত্তরসূরী সম্রাট নূর উদ্দিন মহম্মদ জাহাঙ্গীরের কাছ থেকে সনদ নিয়ে ভারতবর্ষে বাণিজ্য করতে শুরু করে ‘ ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী ’। কালক্রমে তাদের সাধ জাগে মানদন্ডকে রাজদন্ডে পরিনত করার। বাংলা( ঐ সময় বিহার ও উড়িষ্যাও বাংলার অর্ন্তভুক্ত ছিল )র স্বাধীন নবাব সিরাজ-উদ-দৌলাকে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে পরাভুত ও খুন করে ‘ ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী’। একই ভাবে মহিশূরের রাজা টিপু সুলতানও পরাভুত ও নিহত হন ‘ ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী ’ বাহিনীর হাতে। প্রথমে তারা মোঘল সম্রাটের বশ্যতা স্বীকার করে সনদ নিয়ে শাসন কাজ হাতে নিলেও পরবর্তীতে দিল্লীর সিংহাসনের প্রতিও তাদের নজর পড়ে। গর্জে উঠেন সিপাহসালার বখত খান , ঝাঁসীর রাণী লক্ষ্মীবাঈ , বাংলার সৈনিক মঙ্গল পান্ডে। শুরু হয় স্বাধীনতার সংগ্রাম। ইংরেজদের ভাষায় সিপাহী বিদ্রোহ। আবার জয়ী হয় ইংরেজরা। দিল্লীর সিংহাসনে অধিষ্ঠিত সম্রাট বাবরের শেষ উত্তরসূরী সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরের সকল পুত্রকে একযোগে রাজপ্রাসাদের মধ্যে খুন করে ইংরেজরা। সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরকে রেঙ্গুনে নির্বাসন দেওয়া হয়। ভারতবর্ষ জুড়ে শুরু হয় ইংরেজদের একচ্ছত্র শাসন শোষণ ও লুন্ঠন। তারা গ্রহণ করে ভাগ করে শাসন করার নীতি। শুরু হয় সাম্প্রদায়িকতা। মুসলমানেরা হতে থাকে নিগৃহীত। তাদের অস্থিত্ব হতে থাকে বিলীন। এগিয়ে আসেন স্যার সৈয়দ আহম্মদ। মুসলমানদেরকে সচেতন করার জন্য তাদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন ,‘ যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে না পারলে দুনিয়া থেকে মুছে যাবে তোমার চিহ্ন ।’ তিনি আলীগড়ে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করেন। মুসলমানদের জ্ঞান চর্চা , বিদ্যা অনুশীলন ও অধিকার আদায়ের প্রধান কেন্দ্র হয়ে দাঁড়ায় এই আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়। নবাব খাজা সলিমুল্লার উদ্যোগে মুসলমানদের অধিকার আদায়ের সংগঠন ‘ নিখিল ভারত মুসলীম লীগ ’ আত্মপ্রকাশ করে ঢাকায় বুড়ীগঙ্গার তীরে ১৯০৬ সালে। মহাকবি আল্লামা ইকবালের চিন্তার অনুসরনে ভারতবর্ষের নিপীড়িত মুসলমানদের জন্য স্বাধীন আবাসভূমি গঠনের দাবী উচ্চকিত হতে থাকে। কারণ উগ্র সাম্প্রদায়িক নেতা বাল গঙ্গাধর তিলক ,স্বামী শুদ্ধানন্দ বলতে শুরু করেন মুসলমানেরাও ইংরেজদের মতো ভারতবর্ষে বিদেশী । তাই ইংরেজদের সাথে সাথে মুসলমানদেরকেও ভারতবর্ষ ছাড়তে হবে। স্পেনের মুসলমানদের মতো ভারতবর্ষের মুসলমানদের একই পরিনতি বরণ করতে হবে কিনা এই আশঙ্কা ভারতবর্ষের সে যুগের মুসলমান নেতাদের চিন্তিত করে তোলে। ১৯৪০ সালের বসন্তকালে মুসলীম লীগের লাহোর অধিবেশনে বাংলার প্রধান মন্ত্রী এ,কে ফজলুল হক পাকিস্তান প্রস্তাব উত্থাপন করলে তা সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। তাতে ভারতবর্ষের পূর্ব ও পশ্চিম প্রান্তের মুসলমান প্রধান অঞ্চল নিয়ে দুটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছিল , তাতে আরো বলা হয়েছিল এই দুই রাষ্ট্রের মধ্যে থাকবে নিবিড় ভ্রাতৃত্ব বন্ধন। ঐ সময়ই উৎফুল্ল জনতা এই প্রস্তাব উত্থাপনকারী এ,কে ফজলুল হককে ‘ শেরে বাংলা ’ খেতাবে ভূষিত করেন। ১৯৪৬সালে মুসলীম লীগের দিলী অধিবেশনে বাংলার তৎকালীন প্রধান মন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর প্রস্তাবক্রমে ভারতবর্ষের মুসলমানদের জন্য একটি রাষ্ট্র গঠনের প্রস্তাব গৃহীত হয়। অধিকার আদায়ের এই সব আন্দোলন সংগ্রামে মুসলমান ছাত্ররাও সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছে ।
বিদ্যার্থীর দোয়াতের কালি শহীদের লোহু অপেক্ষা শ্রেয়। যে বিদ্যার্জনের লক্ষ্যে শিক্ষাঙ্গনে প্রবেশ করে সেই হচ্ছে ছাত্র। শিক্ষাঙ্গনের প্রকৃতি ও রকম কাল থেকে কালান্তরে পরিবর্তিত হয়ে থাকে। তা সত্ত্বেও যুগে যুগে এই ছাত্র-যুব সমাজ সকল দেশে দেশ জাতি ও জনগণের মুক্তির সংগ্রামে গুরুত্বপূর্ণ অবিস্মরণীয় ভূমিকা রেখেছে। বাংলাদেশে বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে এই ছাত্র সমাজই রাজনীতিতে নতুন মাত্রা যোগ করে। শিক্ষাঙ্গনের নিয়ম শৃঙ্খলার কারণে ঊনবিংশ শতাব্দীতে ছাত্রদের রাজনীতি চর্চ্চার সুযোগ ছিল না। উপনিবেশিক শাসকের অধীনে চাকুরী লাভ করাই ছিল সে যুগের সকল সামাজিক শ্রেণীর ছাত্রদের অভিলাষ। জাতীয়তাবাদী আন্দোলন শুরু হলে ভারতীয় কংগ্রেসের উদ্যোগে ‘নিখিল বঙ্গীয় ছাত্র এসোসিয়েশন’ প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯২৮ খ্রিষ্টাব্দে। প্রমোদ কুমার ঘোষাল ও বীরেন্দ্র নাথ দাস যথাক্রমে এর সভাপতি ও সম্পাদক ছিলেন। যাদবপুর জাতীয় প্রকৌশল বিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন বীরেন্দ্র নাথ দাস ; তিনি ‘ছাত্র’ নামীয় একটি পত্রিকার সম্পাদকও ছিলেন। ‘ নিখিল বঙ্গীয় ছাত্র এসোসিয়েশন’ এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন পন্ডিত জওহরলাল নেহেরু এবং এতে অতিথি বক্তা ছিলেন নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু। গঠনতন্ত্রে লিখিত না থাকলেও ‘নিখিল বঙ্গীয় ছাত্র এসোসিয়েশন’ ছিল ভারতীয় কংগ্রেসের ছাত্র সংগঠন। ঐ সময়ে মুসলমান অভিভাবকেরা তাদের পোষ্যদের রাজনীতি থেকে দূরে রাখতেই পছন্দ করতেন। মুসলমান রাজনীতিবিদগণও এ বিষয়ে একই মনোভাব পোষন করতেন। কিন্তু ভারতীয় কংগ্রেসের অনুপ্রেরণায় ‘ নিখিল বঙ্গীয় ছাত্র এসোসিয়েশন’ গঠিত হলে ঢাকার মুসলমান বুদ্ধিজীবীগণ মুসলমানদের নিজস্ব একটি ছাত্র সংগঠন প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। এই লক্ষ্যে ১৯৩০ সালের ১২ই জুলাই তারিখে মুসলমান ছাত্রদের একটি সম্মেলন ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুহম্মদ শহীদুল্লাহ (পরবর্তীকালে ডঃ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ)কে মুসলমান ছাত্রদের নিয়ে একটি ছাত্র সংগঠন গড়ার দায়িত্ব দিয়ে এই সম্মেলনে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এর প্রেক্ষিতে ১৯৩২ খ্রিষ্টাব্দে ‘ নিখিল বঙ্গীয় মুসলীম ছাত্র এসোসিয়েশন ’ আত্মপ্রকাশ করে। ছাত্রদের রাজনীতিতে অংশ গ্রহণ না করার বিঘোষিত লক্ষ্য নিয়ে আত্মপ্রকাশ করলেও মুসলমান রাজনীতিবিদগণই এই ছাত্র সংগঠন পরিচালনা করতেন। মুসলমান রাজনীতিবিদগণ এই মুসলমান ছাত্র সংগঠনের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট ছিলেন। তাই দেখা যায় ‘টেইলর হোষ্টেলে’র ছাত্রগণ মুসলীম লীগের প্রতি এবং ‘কারমাইকেল হোষ্টেলে’র ছাত্রগণ কৃষক প্রজা পার্টির প্রতি তাদের আনুগত্য প্রকাশ করে। যদিও উভয় হোষ্টেলের ছাত্রগণই ‘ নিখিল বঙ্গীয় মুসলীম ছাত্র এসোসিয়েশন ’ এর সমর্থক ও সদস্য ছিল। ১৯৩৭ সালের নির্বাচন মুসলমান ছাত্রদের এই বিভক্তি আরো স্পষ্ট করে তোলে। কায়েদে আজম মুহম্মদ আলী জিন্নাহ ১৯৩৭ সালে সর্ব ভারত ভিত্তিক ‘ নিখিল ভারত মুসলীম ছাত্র ফেডারেশন’ নামে মুসলমান ছাত্রদের নিয়ে একটি ছাত্র সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৩৭ সালের নির্বাচনের আগে ছাত্রদের মধ্যে রাজনৈতিক প্রভাবযুক্ত সংগঠনের প্রতি আগ্রহ খুবই কম ছিল। এই নির্বাচনের সময় থেকে সারা বাংলায় কায়েদে আজম মুহম্মদ আলী জিন্নাহর নেতৃত্বাধীন মুসলীম লীগের ব্যাপক বিস্তৃতি ঘটতে থাকে। মুসলমান ছাত্রগণও এই মুসলীম লীগ নেতৃত্বের প্রতি আকৃষ্ট ও আগ্রাহান্বিত হতে থাকে। ১৯৩৮ সালে ‘ নিখিল বঙ্গীয় মুসলীম ছাত্র এসোসিয়েশন ’ এর নাম পরিবর্তন করে ‘মুসলীম লীগ’ নামের সাথে মিল রেখে ‘ নিখিল বঙ্গীয় মুসলীম ছাত্র লীগ ’ রাখা হয় । পুনর্গঠিত এই ‘ নিখিল বঙ্গীয় মুসলীম ছাত্র লীগ ’ এর সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন যথাক্রমে ঢাকার আবদুল ওয়াসেক ও যশোরের শামছুর রহমান। ঢাকার নবাব পরিবারের পৃষ্ঠপোষকতাপুষ্ট এই ছাত্র সংগঠন পূর্ব বাংলার ছাত্রদের ব্যাপক সমর্থন লাভ করে। এই ছাত্র সংগঠন পাকিস্তান আন্দোলনে ছাত্রদের ব্যাপক সম্পৃক্তি ঘটায়। ( তথ্য সূত্র ঃ বাংলা পিডিয়া ; নবম খন্ড ; পৃষ্ঠাঃ ৪৪২ ও ৪৪৩ , বাংলাদেশ এসিয়াটিক সোসাইটি কর্তৃক ২০০৩ সালে ইংরাজি ভাষায় প্রকাশিত )।
১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর এই ছাত্র সংগঠনের নেতৃত্বের বিরুদ্ধে সুবিধাবাদ , প্রতিক্রিয়াশীলতা ও বাংলা ভাষার বিরোধিতার অভিযোগ উঠে। তাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু সংখ্যক নেতৃস্থানীয় ছাত্র একটি নতুন ছাত্র সংগঠন প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। নবগঠিত ‘ পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগ ’ এর অস্থায়ী সাংগাঠনিক কমিটি নিম্ন বর্ণিত সদস্যদের নিয়ে পঠিত হয়।
নাইমউদ্দিন আহমদ বি এ সম্মান আহ্বায়ক ( রাজশাহী ) , আবদুর রহমান চৌধুরী বি এ (বরিশাল , দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া যুব সম্মেলনে পাকিস্তান প্রতিনিধি দলের নেতা) , আবদুল কুদ্দুস চৌধুরী বি এ সম্মান (চট্টগ্রাম) , শেখ মুজিবর রহমান বি এ (ফরিদপুর), আজিজ আহমদ বি এ ( নোয়াখালী ) , আবদুল আজিজ এম এ (কুষ্টিয়া) , সৈয়দ নূরুল আলম বি এ (মোমেনশাহী ), আবদুল মতিন বি এ ( পাবনা ) , দবিরুল ইসলাম বি এ (দিনাজপুর) , মফিজুর রহমান (রংপুর) , অলী আহাদ ( ত্রিপুরা ) , নওয়াব আলী (ঢাকা ) , আবদুল আজিজ ( খুলনা ) , নূরুল কবীর ( ঢাকা সিটি ) ।
তাঁরা নতুন ছাত্র সংগঠনের প্রয়োজনীয়তা লক্ষ্য নীতি ও উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করে একটি সার্কুলার প্রচার করেন। তার মূল অংশ নিম্নরূপ:
‘ .... ইন্টার মিডিয়েট কম্পার্টমেন্টাল পরীক্ষোত্তীর্ণ ছাত্রদিগকে ভর্তি করিবার ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চরম উদাসীনতা দেখাইয়াছে , পূর্ব পাকিস্তানে নবাগত ছাত্রদিগের পড়াশুনা ও বাসস্থানের বন্দোবস্ত করিয়া দিতে সরকার পূর্ণ গাফেলতি করিতেছে ; বেপরোয়াভাবে রিকুইজিশন দিয়া সরকার সুপ্রতিষ্ঠিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি দখল করিয়া লইয়াছে; প্রাইমারী শিক্ষা ব্যবস্থা বানচাল হইয়া যাইবার পথে ; বাংলা ভাষাকে শিক্ষার বাহন , রাষ্ট্রভাষা এবং আদালতের ভাষা বলিয়া ঘোষণা করিতে বিশ্ববিদ্যালয় ও সরকার অস্পষ্ট ও সন্দেহজনক অভিমত প্রকাশ করিয়াছে; সরকারের উদাসীনতা এবং পরিচালনার অব্যবস্থাপনার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংসের পথে আসিয়া পৌছিয়াছে ; রাষ্ট্রভাষারূপে বাংলা যেন স্থান না পায় তজ্জন্য ভীষণ ষড়যন্ত্র চলিতেছে এবং নূতন নোট , ষ্ট্যাম্প , খাম , পোষ্ট কার্ড , মনি অর্ডার ফরম , মুদ্রা ও অন্যান্য জিনিস হইতে সমস্ত পাকিস্তানের জনসাধারণের বৃহত্তর অংশের ভাষা হিসাবে বাংলাকে বাদ দেওয়া হইয়াছে। অন্যদিকে পূর্ব পাকিস্তানের নৌ-বাহিনী পরীক্ষায় উর্দূতে টেষ্ট করিবার ছলনায় পূর্ব বাংলার যুবকদের বাদ দেওয়া হইতেছে। ইংরাজীর পরিবর্তে উর্দূর জুলুম আমাদের ঘাড়ে চাপিতে বসিয়াছে । বিমান . নৌ ও স্থল বাহিনীতে পূর্ব পাকিস্তানের নাগরিকদের পুরোপুরি বাদ দেওয়া হইতেছে। ....... আমাদের অতীত অভিজ্ঞতা এই যে ছাত্র নেতাগণ বরাবর পেশাদার নেতাদের অঙ্গুলী হেলনে পরিচালিত হইয়া স্বাধীন নিষ্কলুষ ছাত্র সমাজের উপর কলঙ্ক লেপন করিয়াছেন। কিন্তু স্বাধীনতা অর্জনের পর আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির আমূল পরিবর্তন হওয়া প্রয়োজন। মন্ত্রীসভা বা বিরোধী দলের হস্তে ক্রীড়া পুত্তলি হওয়া আমাদের নীতি নয় বরং দলীয় রাজনীতির ব্যাপারে সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ ও সম্পর্কহীন থাকিয়া পূর্ব পাকিস্তানে বিভিন্নমুখী প্রতিভা সৃষ্টি এবং উদ্ভূত জাতীয় সমস্যাগুলির উপর গঠনমূলক আন্দোলন সৃষ্টি করাই আমাদের উদ্দেশ্য। সরকারের জনকল্যাণকর কর্মপদ্ধতির প্রতি আমাদের সক্রিয় সাহায্য ও সহানুভূতি থাকিবে কিন্তু সরকারের জন ও ছাত্র স্বার্থ বিরোধী কর্মপন্থাকে আমরা রুখিয়া দাঁড়াইব। পক্ষান্তরে বাধ্যতামূলক ফ্রি প্রাইমারী শিক্ষার ব্যাপক ব্যবস্থা , বিনা খেসারতে জমিদারী ও বর্গা প্রথার উচ্ছেদ , নানাবিধ কারিগরি শিক্ষার সুবন্দোবস্ত, পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক শিক্ষার সুবন্দোবস্তের জন্য সামরিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গঠন , ডাক্তারী ও ধাত্রীবিদ্যা প্রসারের জন্য উন্নত ধরনের নূতন কারিকুলামের দাবী , দুর্নীতি , স্বজনপ্রীতি , মুনাফাকারীর ও চোরা কারবারীর সমূলে বিনাশ এবং ইসলামী ভাবধারায় শিক্ষা প্রসারের জন্য আমাদের এই প্রস্তাবিত নব প্রতিষ্ঠান কাজ করিয়া যাইবে। ’ ( তথ্য সূত্র ঃ বদরুদ্দীন উমর রচিত পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি / প্রথম খন্ড/ নভেম্বর ১৯৭০ / পৃষ্ঠা: ১৮৭ থেকে ১৮৯ )।
এই ছাত্র সংগঠনই কালক্রমে ‘ পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ ’ নামধারন করে। বিঘোষিত লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের প্রতি অবিচল আস্থা রেখে মূলনীতি কমিশন বিরোধী আন্দোলন , আইয়ুব খানের সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলন , ১৯৬২ সালে শিক্ষা আন্দোলন , ১৯৬৬ সালের ৬-দফা আন্দোলন , ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থান এবং ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রণী ভূমিকা রেখেছে ছাত্র লীগ। বাঙালী জনগণের পরিপূর্ণ মুক্তির লক্ষ্যে স্বাধীনতা অর্জনের জন্য এই ছাত্রলীগের নেতা সিরাজুল আলম খান , ক্জী আরেফ আহমেদ ও আবদুর রাজ্জাক ‘নিউক্লিয়াস ’ গঠন করে ; পরবর্তীতে এঁদের সাথে যুক্ত হন শেখ ফজলুল হক মনি , তোফায়েল আহমেদ প্রমুখ। এই নিউক্লিয়াসের সাথে প্রথম থেকেই যুক্ত ছিলেন আ স ম আবদুর রব , শাহজাহান সিরাজ, মমতাজ বেগম , শিরিন আকতার , হাসানুল হক ইনু , মুহম্মদ ইকবাল , সা কা ম আনিছুর রহমান খান প্রমুখ।এদের নেতৃত্ব পরিকল্পনা ও কর্মসূচীর ভিত্তিতে ছাত্রলীগের সকল কর্মকান্ড আন্দোলন সংগ্রাম পরিচালিত হতে থাকে । ১৯৬৯ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে মুক্ত করে বঙ্গশার্দূল শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘বঙ্গবন্ধু’ খেতাবে ভূষিত করে চরম দুঃসাহসে ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি দিয়ে স্বাধীনতার আকাঙ্খার কথা জনমনে ছড়িয়ে দিয়েছে এরাই। স্বাধীন বাংলার জাতীয় সঙ্গীত হিসাবে ‘আমার সোনার বাংলা ......’ গানটি এরাই নির্বাচিত করেছে । স্বাধীন বাংলার পতাকার নকশা এরাই তৈরী করেছে এবং ‘জয় বাংলা বাহিনী’ গঠন করে সার্জেন্ট জহুর দিবসে কুচকাওয়াজের সময় বঙ্গবন্ধুকে সালাম দিয়ে তাঁর হাতে তুলে দিয়েছে স্বাধীন বাংলার পতাকা। সমস্ত আপোষকামিতার মুখে লাথি মেরে ১৯৭১ সালের ২রা মার্চ তারিখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনে পতাকা উড়িয়ে বজ্র নির্ঘোষে উচ্চারণ করেছে আর ৬-দফা নয় ; এবারের দাবী এক দফা , বাংলাদেশের স্বাধীনতা। পরদিন ৩রা মার্চ তারিখে ছাত্র সমাবেশে পাঠ করেছে স্বাধীনতার ইশতেহার। মুক্তিকামী জনগণের উপর গুলিবর্ষণ করে আলোচনার জন্য আগত পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান ও তার সমমনা বাঙালী-অবাঙালী নেতাদের উদ্দেশ্য করে এরাই আওয়াজ তুলেছে , ‘সব কথার শেষ কথা ; বাংলাদেশের স্বাধীনতা’। ছাত্র লীগের আপোষহীন রক্তক্ষয়ী অবিরাম আন্দোলন সংগ্রামের ফসল বাংলার স্বাধীনতা।
স্বাধীনতার পর এই ছাত্র সংগঠনের নামকরণ করা হয় ‘ বাংলাদেশ ছাত্রলীগ’। স্বাধীনতার পরবর্তীকালে এই ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সকল রাজনৈতিক দল ও শক্তিকে নিয়ে জাতীয় সরকার গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছিল , যদিও সে সময় তা গ্রহণ করা হয় নাই। আজকে বিবেচনা করার সময় এসেছে ঐ প্রস্তাব কতটুকু সুদূরপ্রসারী দূরদৃষ্টি সম্পন্ন ছিল। শ্রেণী সংগ্রাম ত্বরান্বিত করে সামাজিক বিপ্লবের মাধ্যমে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রত্যয় ১৯৭২ সালে ব্যক্ত করা হলে এই ছাত্র সংগঠন দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ে। তবুও শিক্ষা শান্তি প্রগতির মশাল নিয়ে ছাত্রলীগের পথ চলা থেমে যায় নাই। নৈতিকতাকে সর্বোতোভাবে সমুন্নত রেখে জন ও ছাত্র কল্যানমুখী কার্যক্রমকে এগিয়ে নেবার ক্ষেত্রে ছাত্রলীগের অগ্রযাত্রা সফল হোক। কাঁপতে থাকুক স্বৈরাচারী গণবিরোধী গোষ্ঠি। চিরদিন প্রজ্জ্বলিত থাকুক শিক্ষা শান্তি প্রগতির আলোকবর্তিকা । উড্ডীয়মান থাকুক এর বিজয় নিশান । ৬৬ বৎসরে পদার্পনকারী বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কাছে এটাই আজ জনগণের কামনা।
বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রে উদ্দীপ্ত বাংলাদেশ ছাত্রলীগ বর্তমানে পেশা ভিত্তিক প্রতিনিধি নিয়ে দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট পার্লামেন্ট গঠন, দেশকে আটটি প্রদেশে বিভক্ত করা , প্রশাসন ও সুপ্রীম কোর্টের বিকেন্দ্রীকরণ , দুই জোটের বাইরে তৃতীয় ধারা সৃষ্টির আন্দোলন করে যাচ্ছে। ছাত্রলীগ দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে ১৯৭২ সালে প্রনীত সংবিধানের ত্রুটির কারণেই দেশের জনগণ স্বাধীনতার সুফল ভোগ করতে পারে নাই; রাজনীতি হয়েছে ব্যক্তিগত ও পারিবারিক সম্পদ অর্জনের হাতিয়ার; রক্ষী বাহিনী ও পেটোয়া মুজিববাদী গুন্ডা বাহিনীর হাতে নিহত হয়েছে প্রায় ৬৭হাজার মুুক্তযোদ্ধা; নিহত হয়েছেন দুজন রাষ্ট্রপতি; নিহত হয়েছেন সেক্টর কমান্ডার জেনারেল মঞ্জুরসহ তিনজন সেক্টর কমান্ডার; মুক্তিযুদ্ধকালে পশ্চিম পাকিস্তানে আয়েশে অবস্থানকারী সেনাকর্মকর্তা গ্রহণ করেছে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা আর তার অধীনে মন্ত্রীত্ব গ্রহণ করেছেন মুক্তিযুদ্ধের উপ-সর্বাধিনায়ক, তাও আবার স্বাধীনতা বিরোধী ও মুক্তিযুদ্ধের সক্রিয় বিরোধীতাকারী রাজনৈতিক নেতাদের সাথে। এ থেকে পরিত্রাণের জন্য ছাত্রলীগ সংবিধানের আমূল সংস্কারের কর্মসূচী ঘোষণা করেছে। স্বাধীনতার রূপকার সিরাজুল আলম খানের ১৪-দফা ও জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (JSD) এর ১০ কর্মসূচীর ভিত্তিতে শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তনের লক্ষ্যে ছাত্রলীগ আন্দোলন সংগ্রাম করে যাচ্ছে। এরা কোন রাজনৈতিক দলের নিয়ন্ত্রণে থাকার পক্ষপাতী নয়। ছাত্রলীগ (অদলীয়) নামে এই সংগঠনটি কাজ করে যাচ্ছে।
আরেকটি ধারা ১৯৭২ সালে মুজিববাদ প্রতিষ্ঠার প্রত্যয় ব্যক্ত করে। এদেরই একটা অংশ ১৯৭৪ সালে তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক শফিউল আলম প্রধান ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (রাকসু) এর সহ-সভাপতি ফজলুর রহমান পটলের নেতৃত্বে ‘আমরা আছি যেখানে , মুজিব আসো সেখানে ’ শ্লোগান দিয়ে আওয়ামী রাজনীতিতেই সক্রিয় থাকলেও তারা পরবর্তীকালে আওয়ামী সংশ্রব পরিত্যাগ করে। অপর অংশ সভাপতি মনিরুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বে আওয়ামী রাজনীতিতে সক্রিয় থাকে এবং এরাই এক দলীয় বাকশাল রাজনীতির সাথে যুক্ত হয়। কালের ধারাবাহিকতায় মনিরুল হক চৌধুরী আওয়ামী রাজনীতি পরিত্যাগ করলেও উক্ত ছাত্র সংগঠনের খন্ডিতাংশ বর্তমানে ক্ষমতাসীনদের সাথে সংশি¬ষ্ট থেকে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার আন্দোলন করে যাচ্ছে। এদের কর্মকান্ডই বর্তমানে পত্র পত্রিকায় ব্যাপকভারে প্রচারিত হচ্ছে।
লেখক: সাবেক জেলা ও দায়রা জজ । বর্তমানে এ্যাডভোকেট বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট, হাইকোর্ট বিভাগ, ঢাকা এবং বে-সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগের অধ্যাপক। [email protected]
০৪ ঠা জানুয়ারি, ২০১৫ রাত ১০:২০
রোমেল রহমান বলেছেন: শুকরিয়া।
©somewhere in net ltd.
১|
০৪ ঠা জানুয়ারি, ২০১৫ সকাল ৯:৩৪
নিলু বলেছেন: অনেক ইতিহাস পড়লাম