নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

রোমেল রহমান এর ব্লগ

রোমেল রহমান

রোমেল রহমান › বিস্তারিত পোস্টঃ

শক্তি প্রয়োগের রাজনীতি এবং দেখামাত্র গুলি করার নির্দেশ

০৪ ঠা ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ রাত ১০:২০

বাংলার আকাশে আবার দুর্যোগের ঘনঘটা দেখা দিযেছে। উদার আকাশে কালো ধোঁয়া , সবুজ জমিন আজ রক্ত সিক্ত। রাজন্য ও অমাত্যবর্গ কথা বলছেন হুমকির ভাষায়। জনগণের স্বাভাবিক জীবনযাত্র হচ্ছে ব্যহত। প্রচার মাধ্যমে ধূর্ততা আর মিথ্যার অবাধ প্রকাশ বিবেকবান ও সচেতন মানুষকে করছে ক্ষুব্ধ। এই পরিবেশকে কেউ বলছে স্বাধীনতার পক্ষের শক্তির সাথে বিপক্ষের শক্তির লড়াই । কেউ বলছে গণতন্ত্রকামী জনগণের সাথে স্বৈরশক্তির লড়াই। আসলে কি তাই ? স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি বলে যাঁরা নিজেদের জাহির করছেন ১৯৭১ সালে তাদের ভূমিকা নিয়ে অনেক প্রশ্ন রয়েছে। প্রখ্যাত মুক্তিযোদ্ধা ডাঃ জাফরুল্লাহ চেীধুরী এদের একজনের নাম সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করে বলেছেন ঐ ব্যক্তি হানাদার বাহিনীর ক্যাম্পে মুরগী সরবরাহের ব্যবসা করেছে ঐসময়। মুক্তিযোদ্ধা মুহম্মদ ইসমত একজন বড় নেতা (বর্তমানে) সম্পর্কে বলেছেন এই নেতার পিতাও ১৯৭১ সালে একজন বড় নেতা ছিলেন। সুজানগর এলাকায় পাকিস্তানী মিলিশিয়াদের প্রতি ‘আর সি এল গান’ দিয়ে গোলা ছোড়ার সময় উক্ত গানের পিছন থেকে উদ্গীরিত গ্যাসের আঘাতে একজন মুক্তিযোদ্ধার চোখ ও মুখ আহত হয়। তাঁর চিকিৎসার জন্য তাকে নিয়ে মুহম্মদ ইসমত কলকাতা যান। ঐ সময় কুষ্টিয়া মুক্ত হয়েছিল, প্রথমে সেখানে গেলে নূর আলম জিকু একটি টয়োটা জীপ মুহম্মদ ইসমতকে দেন। ব্যারাকপুর হয়ে ইসমত কলকাতা যান এবং নুরুন্নাহার সামাদের সহায়তায় মাড়োয়ারী হাসপাতালে উক্ত যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধার চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। সেখান থেকে ফেরার সময় আবদুর রব বগা মিয়ার সহায়তায় ইসমত সাহেব ঐ বড় নেতার সাথে দেখা করেন। সৌজন্য সাক্ষাৎ শেষে দেশে রণাঙ্গনে ফেরার সময় বড় নেতার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়–য়া ছেলেকে তার সাথে রণাঙ্গনে যেতে অনুরোধ করেন। সঙ্গে সঙ্গে নেতার স্ত্রী নিজ পুত্রের হাত ধরে কাছে টেনে নেন এবং বলেন ‘ না , ওর গায়ে গুলি লেগে যাবে’। নেতার পুত্র (বর্তমানে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তি বলে উচ্চ কন্ঠ) নিজের বাবা মায়ের সাথে কলকাতার বাসাতেই রয়ে যান , বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত তিনি কলকাতার ঐ বাসা থেকে বের হন নাই। মুহম্মদ ইসমত ফিরে আসেন রণাঙ্গনে।

স্বাধীনতা উত্তর কালে গঠন করা হলো দলীয় সরকার। বাংলার স্বাধীনতা অর্জনের সংগ্রামের ইতিহাস একদিনের নয়। ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবের মাধ্যমে ভারতের পূর্বাঞ্চলের মুসলমান সংখ্যাগরিঠ অঞ্চল নিয়ে পৃথক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব এতদাঞ্চলে বসবাসকারী মুসলমান ও তফসিলি সম্প্রদায়ের মধ্যে ব্যাপক আশা আকাংখার সৃষ্টি করে। এই প্রস্তাবের মাধ্যমে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষমুক্ত স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রত্যয় ব্যক্ত করা হয়েছিল। এ প্রসঙ্গে এই প্রস্তাবে বলা হয়ঃ ‘এই ইউনিট ও অঞ্চলগুলিতে সংখ্যালঘিষ্ঠদের স্বার্থ সর্বতোভাবে রক্ষার ব্যবস্থা শাসনতন্ত্রে থাকবে এবং তা করা হবে তাদের সাথে পরামর্শ করে।’ এই প্রস্তাব মতো ১৯৪৭ সালে স্বাধীন রাষ্ট্র বাস্তবায়িত হয় নাই। দিল্লী প্রস্তাব মতো মুসলমান ও তফসিলি সম্প্রদায় অধ্যুষিত অঞ্চল নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় পাকিস্তান। এই পাকিস্তানে বাংলার জনগণ অধিকারের প্রশ্নে বৈষম্যের শিকার হয়। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের অধিকাংশই পাকিস্তান রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যে যতটুকু অধিকার পাওয়া যায় ততটুকু নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে চেয়েছেন। ব্যতিক্রম ছিলেন ছাত্র নেতা সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক ও কাজী আরেফ আহমেদ। এরাই গোপন সংগঠন ‘নিউক্লিয়াস’ গঠন করে স্বাধীনতার আন্দোলনকে ধাপে ধাপে এগিয়ে নিয়ে যান। ইনাদের কর্মকান্ডের বিষয় শেখ মুজিবকে জানানো হলে তিনি শেখ ফজলুল হক মনি ও তোফায়েল আহমেদকে ‘নিউক্লিয়াসে’র সাথে সংযুক্ত করতে বলেন। এই ‘নিউক্লিয়াস’ই মুক্তিযুদ্ধের সকল কর্মকান্ডকে নিয়ন্ত্রণ করে। এরাই গঠন করে ‘মুজিব বাহিনী’। শত্রুমুক্ত দেশে বে-সামরিক প্রশাসন ইনারাই সাফল্যের সাথে চালু করেন। পাকিস্তানের কারাগারে মুক্তিযুদ্ধকালে বন্দি ছিলেন ‘বঙ্গবন্ধু’। তিনি মুক্ত হয়ে বৃটেন ও ভারত হয়ে দেশে ফিরে আসেন। এই নিউক্লিয়াসের সদস্যদের নিয়ে গঠিত হয়েছিল ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ’ ( BLF)। এই পরিষদের চার নেতা সিরাজুল আলম খান, শেখ ফজলুল হক মনি, আবদুর রাজ্জাক ও তোফায়েল আহমেদের সাথে ১৯৭২ সালের জানুয়ারী মাসে বঙ্গবন্ধুর বৈঠক হয়। এই নেতাদেরকে বঙ্গবন্ধু দেশ পরিচালনার জন্য সুপারিশমালা দিতে বলেন। জানুয়ারী মাসেই কিন্তু বঙ্গবন্ধু দলীয় সরকার গঠন করেন। ফেব্রুয়ারী মাসের শেষ দিকে সিরাজুল আলম খান ১৫-দফা সুপারিশমালা বঙ্গবন্ধুর কাছে পেশ করেন। এই সুপারিশমালায় ছিল : বঙ্গবন্ধু থাকবেন সকল দলের উর্ধে এবং তাঁকে কেন্দ্র করে বাঙালী জাতির চেতনা বিকাশের ধারা প্রবাহিত হবে, এজন্য প্রয়োজনবোধে তিনি রাজধানীর বাইরে অবস্থান করবেন; জাতীয় বিপ্লবী সরকার গঠন; মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া সকল দল ও গ্রুপের প্রতিনিধিদের নিয়ে ‘সংবিধান প্রণয়ন কমিটি’ গঠন; জাতীয় পর্যায়ে ‘রেভল্যুশনারি গার্ড বাহিনী’ গঠন; নিবর্তনমূলক পুলিশ বাহিনীর বদলে ‘আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী গঠন’; উচ্চ শিক্ষার সুযোগ সবার জন্য উন্মুক্তকরণ; ব্রিটিশ-পাকিস্তানী আমলের ধারাবাহিকতায় ‘ক্যাডার’ বা ‘গোষ্ঠি’ দ্বারা জনপ্রশাসন পরিচালনার পদ্ধতি রদ করে তদস্থলে মুক্তিযুদ্ধের সময় যারা জেলা-মহকুমা-থানা পর্যায়ে কমান্ডারের দায়িত্বে ছিলেন তাদের উপর জনপ্রশাসনের দায়িত্ব অর্পণ ; সর্ব নিম্ন ও সর্বোচ্চ বেতনের অনুপাত অনধিক ১:৭ স্থির করা ; সমবায় ভিত্তিক অর্থনীতি চালু করা ইত্যাদি। বঙ্গবন্ধু এই সুপারিশমালা সম্বলিত পত্র নিজ দেরাজে রেখে দেন। আওয়ামী লীগের অনেক প্রভাবশালী নেতা এর বিরোধীতা করেন। এ প্রসঙ্গে সিরাজুল আলম খানের কাছে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন : ‘ আমার মনে হয় না এটা সম্ভব হবে। আমার দলের অনেকেই এটা পছন্দ করবে না।’ গণভবণের সবুজ চত্বরে এক সন্ধ্যায় সিরাজুল আলম খানের কাঁধে হাত রেখে হাঁটতে হাঁটতে বঙ্গবন্ধু বলেন ‘পারলাম না রে সিরাজ’। বঙ্গবন্ধুর এই না পারার মধ্য দিয়েই মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশ গড়ার দাবীর অপমৃত্যু ঘটে।

এখানে একটি কথা বলা যায় যে ১৯৬৬ সালে শেখ মুজিব ৬-দফা কর্মসূচী ঘোষণা করলে মওলানা আবদুর রশিদ তর্কবাগিশ, আতাউর রহমান খান, শাহ আজিজুর রহমান, আবদুস সালাম খান, মশিউর রহমান সহ প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতাগণ এর তীব্র বিরোধীতা করেন। আওয়ামী লীগ দ্বিধা বিভক্ত হয়ে যায়। আওয়ামী লীগ নেতাদের মধ্যে এম এ আজিজ ছিলেন ৬-দফার পক্ষে। সিরাজুল আলম খানের নেতৃত্বাধীন নিউক্লিয়াস এই ৬-দফা দাবীর প্রতি দ্ব্যর্থহীন সক্রিয় সমর্থন জ্ঞাপন করে। ইনারাই এগিয়ে নিয়ে যান আন্দোলন। সাফল্যের বর মাল্য শেখ মুজিবের কন্ঠে শোভিত হয়। তিনি হন ‘বঙ্গবন্ধু’। এই নিউক্লিয়াস এর কর্মসূচীর মধ্য দিয়েই গড়ে ওঠা সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে বাংলাদেশ অর্জন করে স্বাধীনতা। বঙ্গবন্ধু হন ‘জাতির জনক’। এই পরীক্ষীত সহযোদ্ধাদের সুপারিশমালা বঙ্গবন্ধু গ্রহণ করলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশ গড়ে উঠতো।আজকের এই সংকটের উদ্ভব হতো না।


আজ দেশের মানুষের জান মাল ইজ্জতের নিরাপত্তা নাই। ১৯৭২ সাল থেকে দলীয় সরকার গঠনের ধারাবাহিকতায় দেশ আজ ক্ষমতা দখলের লীলাভ’মিতে পরিণত হয়েছে। উদ্ভব হয়েছে ব্যক্তিতন্ত্র, জেলাতন্ত্র ও পরিবার তন্ত্রের। ক্ষমতা কুক্ষীগত করার জন্য নীতি নৈতিকতাকে দেওয়া হচ্ছে বিসর্জন। ভোট কারচুপি করে আমলাদের কেউ কেউ বড় পদ হাসিল করেছে এবং সুবিধা নিতে বিত্ত বৈভবের মালিক হয়েছে। নৈতিকতা ও বিবেকবোধ বিসর্জন দিয়ে , জনগণকে বেকুফ ভেবে কিছু কিছু বুদ্ধিজীবী-সাংবাদিক ক’ট প্রশ্ন তুলে ‘আলাপচারিতা’ অনুষ্ঠানে বসে জনগণের উদ্দেশ্যে জ্ঞান বিতরণ করছেন, শিক্ষাবিদদের কেউ কেউ এভাবেই বিদেশ গমনের সুযোগ করে নিচ্ছেন। তাই সব দিক বিবেচনা করে ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার জন্য ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’র ধারক বাহকের লেবাস পড়ছে। এদের সারিতে হানাদার বাহিনীর ক্যাম্পে মুরগী সরবরাহের ব্যবসাকারী, মুক্তিযুদ্ধকালে গায়ে গুলি লাগার ভয়ে মায়ের নিরাপদ আঁচল তলে আশ্রয় গ্রহণকারী এবং এরূপ ব্যক্তিরাই আছেন। তারাই সরব কন্ঠে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নের অংগীকার ব্যক্ত করছেন। এরাই ভিন্নমত পোষণকারীদের রাজনৈতিক কর্মকান্ড প্রতিহত করতে চায় , প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের বক্তব্য সহ্য করতে নারাজ। এভাবেই রাজনীতিতে প্রাদুর্ভাব ঘটেছে শক্তি প্রয়োগের। এই শক্তি প্রয়োগ করতে যেয়েই হুমকি দেওয়া হচ্ছে ‘বুকে’ গুলি করার। ‘শৃংখলা বাহিনী’র কতিপয় প্রধান হাত উচিয়ে রাজনীতিবিদদের মতো হুমকি মূলক ভাষায় বক্তৃতা করছেন। সংবিধান ও আইনে এরূপ হুমকি ও দম্ভ প্রদর্শনের অনুমোদন নাই। সংবিধানের ৩১ অনুচ্ছেদে সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করা হয়েছে, ‘.....আইনানুযায়ী ব্যতীত এমন কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাইবে না, যাহাতে কোন ব্যক্তির জীবন, স্বাধীনতা, দেহ, সুনাম বা সম্পত্তির হানি ঘটে।’ দন্ড বিধিতে ‘ব্যক্তিগত প্রতিরক্ষার’ বিধান আছে কিন্তু সেখানে নরহত্যার ঢালাও অধিকার দেওয়া হয় নাই। আত্মরক্ষার সুযোগ গ্রহণের বিষয়টাকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনে সান্ধ্য আইন (Carfew) জারির ক্ষমতা জেলা ম্যাজিষ্ট্রেটকে দেওয়া হয়েছে, এখানেও গুলি ছোড়ার ক্ষমতা কাউকে দেওয়া হয় নাই। কোন কোন রাজন্য ও আমাত্যবর্গ এরূপ হুমকি বা ঘোষণা দিয়ে সংবিধান লংঘন ও শপথ ভঙ্গ করেছেন। কোন কোন ‘শৃঙ্খলা বাহিনী’র প্রধান এ ধরনের বক্তৃতা করে ও ঘোষণা দিয়ে ‘সরকারী কর্মচারী শৃ্খংলা ও আপীল বিধিমালা’ অনুসারে ‘অসদাচারণ’ করেছেন। এরূপ কার্য করার এখতিয়ার ‘পুলিশ আইন’ , ‘মহানগর পুলিশ আইন’ বা ‘বাংলাদেশ পুলিশ প্রবিধানমালা’(PRB)তেও এদেরকে দেওয়া হয় নাই।এদের কারোই আর উল্লেখিত পদে অধিষ্ঠিত থাকার নৈতিক অধিকার নাই। এই শাসন ব্যবস্থা জনগণের নিরাপত্তা বিধান ও আশা আকাংখা পূরণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। এ থেকে পরিত্রাণের জন্য জনগণকে একত্রিত হয়ে জন কল্যাণমুখি শাসন ব্যবস্থা প্রণয়ন করা অত্যন্ত জরুরী। এ লক্ষ্যে জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলতে হবে জনগণকেই।

লেখকঃ সাবেক জেলা ও দায়রা জজ। বর্তমানে এ্যাডভোকেট বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট , হাইকোর্ট বিভাগ, ঢাকা এবং বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে আইনের অধ্যাপক। [email protected]

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.