নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

রোমেল রহমান এর ব্লগ

রোমেল রহমান

রোমেল রহমান › বিস্তারিত পোস্টঃ

রাজনীতিতে নৈতিকতা এবং দায়িত্বশীলতা

১০ ই মার্চ, ২০১৫ রাত ১১:৪৯

‘রাজনীতি’ শব্দটি আমাদের দেশের আপামর জনগণের কাছে খুবই পরিচিত। দেশ যারা পরিচালনা করেন এবং এসব বিষয়ে চিন্তা ভাবনার সাথে সাথে তা বাস্তবায়নের অনুশীলন করেন তারা ‘রাজনীতিবিদ’ নামে পরিচিত।এই পরিচিতির কারণেই ‘রাজনীতি’ শব্দটি এত পরিচিত। রাষ্ট্র পরিচালনার সাথে সম্পৃক্তির কারণে ‘রাজনীতি’ বলতে কি ধরণের কর্মকান্ডকে বুঝানো হয় তা নিয়ে দেশে বিদেশে মনীষীগণ গবেষণা করেছেন এবং তা এখনো অব্যাহত আছে। মূলত ‘উৎপাদন ও বন্টনের বিজ্ঞানই হচ্ছে রাজনীতি’।ফরাসী দার্শনিক ‘শা শিমো’ এভাবেই রাজনীতিকে সংজ্ঞায়িত করেছেন। এ প্রসঙ্গে মাও-সে-তুং বলেছেন ‘একটি সমাজের মূল ভিত্তি হলো অর্থনীতি, তারই ঘনীভ’ত প্রকাশ হলো রাজনীতি’। আমাদের দৈনন্দিন জীবন যাপনের সাথে রাজনীতির সম্পৃক্তি তাই অপরিসীম। জনগণ তাদের ব্যক্তিগত পারিবারিক সামাজিক অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে রাজনীতিবিদদের নির্দেশনা গ্রহণ ও অনুসরণ করে।

বৃটিশ শাসন আমলে ভারতবর্ষের মুসলমানদের ‘ম্লেচ্ছ’ ( অর্থাৎ বহিরাগত) বলে উল্লেখ করে ভারতবর্ষ থেকে বিতাড়িত করার ঘোষণা দেন বাল গঙ্গাধর তিলক, লালা লাজপৎ রায় প্রমুখ উগ্র হিন্দুবাদী নেতৃবৃন্দ (এ চেতনা তাদের উত্তরসূরীদের মধ্যে এখনও জাগরূক )। মুসলমান রমনীদের প্রতি কালিমা লেপন করে ‘দুর্গেশ নন্দিনী ’ উপন্যাস লিখেন বঙ্কিম চন্দ্র চট্টপাধ্যায়। সরকারী চাকুরী ক্ষেত্রে ধর্মীয় বিবেচনায় মুসলমানদেরকে বঞ্চিত করা হতে থাকে। পরিস্থিতির মুকাবিলায় দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ মুসলমানদের প্রতি বঞ্চনার অবসান ঘটিয়ে হিন্দু মুসলমানদের নিয়ে ঐক্যবদ্ধ দেশ গড়ার প্রত্যয়ে মুসলমান নেতাদের সাথে চুক্তি সম্পাদন করেন। যা ইতিহাসে ‘বাংলা চুক্তি’ নামে খ্যাত। একই লক্ষ্যে কাজ করেন কায়েদে আজম মুহম্মদ আলি জিন্নাহ । এজন্য গোপাল কৃষ্ণ গোখলে তাঁকে ‘হিন্দু মুসলমান মিলনের অগ্রদূত’ বলে অভিহিত করেন। সরোজিনী নাইডু কবিতা লিখে জিন্নাহ সাহেবের এই উদোগকে অভিনন্দন জানান। বঙ্কিম চন্দ্র চট্টপাধ্যায়ের উক্ত উপন্যাসের জবাবে ইসমাইল হোসেন সিরাজী রচনা করেন ‘রায় নন্দিনী’ উপন্যাস। সাইমন কমিশন ১৯২৮ সালে ভারতের ভবিষ্যৎ শাসনতন্ত্রের রূপরেখা পেশ করার জন্য পন্ডিত মতিলাল নেহেরুকে সভাপতি ও পন্ডিত জওহরলাল নেহেরুকে সম্পাদক করে কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটি কর্তৃক প্রদত্ত প্রতিবেদন ‘নেহেরু রিপোর্ট’ নামে খ্যাত। এতে কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক আইনসভায় মুসলমানদের প্রতিনিধিত্ব সংক্রান্ত দাবীকে স্বীকৃতি দেওয়া হয় নাই। রাজকীয় শাসন ব্যবস্থায় মুসলমানদের প্রতি বৈষম্য নিরসনের জন্য তাদেও স্বতন্ত্র প্রতিনিধিত্বের এই দাবী ছিল খুবই যৌক্তিক। সেই পরিস্থিতিতে মুহম্মদ আলী জিন্নাহ ১৪-দফা দাবী ইংরেজ শাসকদের কাছে পেশ করেন। আল্লামা ইকবাল উপমহাদেশের মুসলমানদের জন্য স্বতন্ত্র আবাসভ’মি প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব করেন। এ কে ফজলুল হক (পরবর্তীকালে ‘শের-ই-বাংলা উপাধীতে ভূষিত) ১৯৪০ সালে উপমহাদেশের মুসলমান অধ্যুষিত অঞ্চলগুলি নিয়ে (এ লক্ষ্যে প্রয়োনীয় ক্ষেত্রে অঞ্চল পুনর্বিন্যাস করে) একাধিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব উত্থাপন করেন। যা ঐতিহাসিক ‘লাহোর প্রস্তাব’ নামে খ্যাত। নেতাজী সুভাষ বসু উভয় সম্প্রদায়ের অধিকার সমূহকে স্বীকৃতি দিয়ে স্বাধীনদেশ গড়ার লক্ষ্যে কাজ করতে চাইলেও তাঁকে ছাড়তে হয় কংগ্রেস সভাপতির পদ। সাম্প্রদায়িকতার ডামাডোলে ভারতবর্ষের জনগণের জীবন যখন বিপর্যস্ত এবং বাংলাকে খন্ডিত করার উদ্যোগ চলছিল সেই সময়ে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শরৎ বসু, আবুল হাশিম, কিরণ শংকর রায় প্রমুখ নেতৃবৃন্দ অখন্ড বাংলা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তাঁদের সে উদ্যোগ মহনদাস করমচাঁদ গান্ধি ও জওহরলাল নেহেরুর সমর্থনের অভাবে সফল হয় নাই। পাকিস্তান রাষ্ট্রে রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে বিতর্ক উঠলে ‘তমদ্দুদ মজলিস’সহ ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দ আন্দোলন শুরু করেন। পাকিস্তান রাষ্ট্র কাঠামোতে বাংলার জনগণের অধিকার প্রতিনিয়ত সর্বক্ষেত্রে ক্ষুন্ন হতে থাকলে সিরাজুল আলম খান, কাজী আরেফ আহমেদ ও আবদুর রাজ্জাক স্বাধীন বাংলা কায়েমের লক্ষ্যে গোপন সংগঠন ‘নিউক্লিয়াস’ গঠন করে কার্যক্রম চালিয়ে যেতে থাকেন। শেখ মুজিবুর রহমান (পরবর্তীকালে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত) উক্ত বৈষম্য ও বঞ্চনা নিরসনের জন্য ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে ফেডারেল রাষ্ট্র গঠনের জন্য ৬-দফা দাবী উৎথাপন করেন। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে গড়ে উঠা জাতীয় ঐক্য বিনষ্ট করে স্বাধীনতা উত্তরকালে দলীয় সরকার কায়েম করা হলে মেজর এম এ জলিল, আ স ম আবদুর রব, শাহজাহান সিরাজ প্রমুখ নেতৃবৃন্দ গণ আন্দোলন গড়ে তোলেন। প্রাগুক্ত সকল ক্ষেত্রে নেতাদের নির্দেশিত পথে জনগণ অগ্রসর হয়েছে, প্রয়োজনে অর্থ সম্ভ্রম জীবন সবই দিয়েছে। তারা এভাবে বিদেশী শাসক শোষক, দেশীয় স্বৈরশাসক, অপশক্তির গণবিরোধী কার্যক্রম রুখে দিয়েছে। তাই রাজনীতিবিদেরা জনগণের হৃদয়ে লাভ করেছে শ্রদ্ধার আসন। কিন্তু এই শ্রদ্ধার আসন রাজনীতিবিদদের কেউ কেউ বহাল রাখতে পারেন নাই। রাজনৈতিক ক্ষমতাকে ইনারা জনগণের জীবন জীবিকার উন্নয়নে বাস্তব অর্থে প্রয়োগ না করে, তা নিজের পরিবার পরিজন ও স্বজনদের ভাগ্য উন্নয়নের কাজে প্রয়োগ করেছেন। গড়ে তুলেছেন সম্পদের পাহাড়। সরকারী খাস জমি ইজারা নিয়ে গড়েছেন খামার। মালিক হয়েছেন শিল্প কারখানার। খুলেছেন ব্যাংক বীমা সহ বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান। গড়েছেন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এসব করতে গিয়ে কাগুজে সমবায় সমিতি, অছি পরিষদ গঠন করেছেন ; এর সবই নামমাত্র । মালিক ও একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী কিন্তু একজনই। সেই সাথে তারা চেষ্টা করেছেন রাজনৈতিক ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করে রাখতে। তা করতে গিয়ে কোন কোন সময় নৈতিকতা পরিহার করতে দ্বিধা করেন নাই। এটা করতে গিয়ে রাজনীতিবিদদের সমস্ত মর্যাদা লুটিয়ে দিয়েছেন ধূলায়।

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরপরই সারা দেশে আওয়াজ উঠলো রাষ্ট্রের উচ্চ পদাধিকারী রাজনীতিবিদ নিজে দুর্নীতিগ্রস্থ না হলেও তাঁর স্বজনদের প্রতি দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে তারঁ নিকটাত্মীয়রা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপপ্রয়োগ করে সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলে। কোন রাজনৈতিক পদাধিকারী বাড়ি নির্মাণ করেছেন মার্বেল পাথর দিয়ে। এসব রটনায় মানুষ বিশ্বাস স্থাপন করে। নির্বাচনে মুসলীম লীগের ভরাডুবি ঘটে। যুক্তফ্রন্টের যাঁরা আসেন তারাও নিজেদের উত্তম ও সৎ শাসক বলে জনগণের আস্থা অর্জনে ব্যর্থ হন। যা সেনা বাহিনীকে সুযোগ করে দেয় রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা গ্রহণ ও শাসনতন্ত্র বাতিলের। দুই পয়সার পোস্ট কার্ডে চিঠি লিখে দুর্নীতি দমন করার প্রতিশ্রুতি দিলেও জনগণ হতাশ হয়। দুর্নীতির মাধ্যমে সিনেমা হল প্রতিষ্ঠার খবর জনগণকে ক্ষুব্ধ করে তোলে। সামরিক শাসকেরা দুর্নীতির বিলুদ্ধে অভিযান চালিয়ে জনপ্রিয়তা অর্জন করে। ঘৃণা নিক্ষেপ করে দুর্নীতিপরায়ন রাজনীতিবিদদের। এতো অভিযানের মধ্যেও আবু হোসেন সরকার (কৃষক শ্রমিক পার্টি, KSP) ও আতাউর রহমান খান (আওয়ামী লীগ) এর বিরুদ্ধে তারা দুর্নীতির কোন অভিযোগ খাড়া করতে পারে নাই। ইঁনারা দুজনে বিভিন্ন সময়ে পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্য মন্ত্রীর পদ অলংকৃত করেছিলেন। কিন্তু তাঁদের মন্ত্রী সভার অনেক সদস্যই দুর্নীতির দায়ে সাজা প্রাপ্ত হন এবং উচ্চ আদালতে আপীলেও তা বহাল থাকে। সাজা ভোগ করে মুক্তি লাভ করেন। একজন এরূপ নেতা তার দুর্নীতি লব্ধ অর্থ নিজ দলীয় একজন নেতার কাছে গচ্ছিত রাখেন, আমানতদার এই নেতা ছিলেন একজন ঠিকাদার। ক্ষমতা হারিয়ে প্রমোক্ত নেতা দুর্নীতির দায়ে কারারুদ্ধ হন। মুক্ত হবার পর আমানতদার নেতার কাছে গচ্ছিত অর্থ ফেরত চাইলে আমানতদার নেতা তা দিতে অস্বীকার করেন। আমানতদার নেতা এরই মধ্যে শহরের প্রাণকেন্দ্রে বিশাল বাসভবন নির্মাণ করেন। আমানতদার নেতার অস্বীকৃতির কারণে উভয়ের মধ্যে বিরোধের সৃষ্টি হয়। এ নিয়ে শালিশ দরবার হলে তা গোটা শহরে জানাজানি হয়। এরূপ নেতা ক্ষমতায় থাকাকালে একজন নব্য ব্যবসায়ীর কাছেও টাকা গচ্ছিত রাখেন। এই টাকায় ব্যবসা করে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী সেই পাকিস্তান আমলে কোটি টাকার মালিক হয়ে যান। যা ঐ আমলে চোখ ধাঁধানো বিষয় ছিল। ব্যাংক সূত্রে এটা প্রকাশ পায় । শহরের লোকেরা ঐ ব্যবসায়ীর নামের আগে ‘কোটি’ বিশেষণ যুক্ত করে দেয়। এই নামেই তিনি পরিচিতি লাভ করেন।

এক ব্যক্তি কালেকটরেট ভবনে নিম্নমান সহকারী পদে চাকুরী করতেন। স্বাধীনতার অব্যবহিত পূর্বকালে রাজনীতিতে অংশ নিয়ে তিনি নেতা হয়ে যান। মাথায় সাদা টুপি পাঞ্জাবী পাজামা পরিধান করে রিক্সায় চড়ে শহরে ঘুরতেন। ‘জয় বাংলা’ বলে সালাম দিতেন। স্বাধীনতা-উত্তরকালে জেলায় লবনের সংকট দেখা দিলো। খোজ নিয়ে নেতৃবর্গ দেখলেন ঐ জেলার জন্য বরাদ্দকৃত লবনের পারমিট উক্ত ( ‘জয় বাংলা’ বলে সালাম দানকারী ) নেতা নিয়েছেন এবং উচ্চ মূল্যে চট্টগ্রামেই তা বিক্রয় করে দিয়েছেন। এতে তিনি মোটা অংকের অর্থ আয় করেছেন। ঐ বছরই তিনি হজব্রত পালন করেন। শহরবাসী তাকে ‘নুনে হাজী’ খেতাবে ভূষিত করে।

বন্যা খড়া প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় বিপন্ন জনগণকে সহায়তা করা আমাদের দেশে একটি রেওয়াজ। প্রত্যেকেই নিজ নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী বিপন্ন মানুষদের সাহায্য সহায়তা দিয়ে থাকেন। কিছু কিছু সমাজ সেবক এবং রাজনীতিবিদ সাধারণ জনগণের কাছ থেকে এজন্য সাহায্য সামগ্রী সংগ্রহ করে তা দুঃস্থ ও বিপন্ন মানুষের মধ্যে বিতরণ করেন। একজন বিদগ্ধ রাজনৈতিক কর্মী জানান ১৯৮৮ সালে বন্যায় সময় তিনি দলীয় নেতার নির্দেশে এভাবে সাধারণ জনগণের কাছ থেকে চাঁদা সংগ্রহ করেন। প্রতিদিন এই চাঁদা সংগ্রহকারী ‘টিমে’র প্রত্যেক সদস্যকে তিন বেলা খাবারসহ কিছু হাতখরচ দেওয়া হতো সংগৃহীত চাঁদা থেকে। চাঁদা সংগ্রহের কাজ শেষ হলে সুদৃশ্য ব্যানার টাঙিয়ে প্রচার মাধ্যমকে প্রাধান্য দিয়ে ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ করা হয় বন্যাপীড়িত জনগণের মাঝে। দুদিন এরূপ বিতরণের পরে ত্রাণ বিতরণ কর্মসূচীর সমাপ্তি টানা হয়। সংগৃহীত চাঁদার প্রায় কোটি টাকা নেতার কাছে রয়ে যায়। কর্মীদের অভিযোগ ঐ টাকা নেতা আত্মসাৎ করেছেন। এ নিয়ে কর্মীদের সাথে নেতার বিরোধ শুরু হয়। এক পর্যায়ে তারা নেতার উপর হামলা করে বসে। মারাত্মক আহত হওয়ায় নেতার জীবন বিপন্ন হয়। তাকে নিয়ে যাওয়া হয় বিদেশে। চিকিৎসার খরচের টাকা উৎস নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে এজন্য সাহায্য তহবিল খোলা হয় । বিশ্বস্থ ও অনুগতদের মাধ্যমে নেতাই ঐ তহবিলে সাহায্য(?) হিসাবে টাকা জমা দেন, দেশের বিভিন্ন জেলায় ব্যাংকের বিভিন্ন শাখায়। এভাবে আত্মসাৎকৃত টাকা সাহায্য হিসাবে পাওয়া বলে দাবী করেন।

রাজনীতিবিদদের কেউ কেউ পদ পাবার পর পরই সকল ক্ষেত্রেই নিজ প্রভাব প্রয়োগ করেন। শিক্ষা বোর্ডের একজন চেয়ারম্যান সম্পর্কে রটনা আছে যে তিনি ঈদ , নববর্ষ বা এরূপ কোন পর্বে এইসব পদাধিকারী রাজনৈতিক নেতাদের বাড়িতে গিয়ে মূল্যবান উপঢৌকন বিতরণ করেন। সাংবিধানিক পদে অধিষ্ঠিত কোন কোন নেতা তা সন্তুষ্ট চিত্তে গ্রহণ করেন। ফলে উক্ত চেয়ারম্যান বে-পরোয়াভাবে দুর্নীতিগ্রস্থ হয়ে যান। দুর্নীতির অভিযোগ কোন কাজে আসে না। একজন আইনজীবীকে নিয়ম বর্হিভূতভাবে দুইটি বিলে ৫৭(সাতান্ন) লক্ষ টাকা চেক দেবার অভিযোগ কোন প্রতিকার দিতে পারে না। শিক্ষাঙ্গনের এই ক্ষেত্রে দুর্নীতি এই ভাবে প্রশ্রয় পায়।

আইনী সহায়তা দেবার কার্যক্রম জেলা ও দায়রা জজের তত্ত্বাবধানে ও কর্তৃত্বে পরিচালিত হয়। ‘আইগত সহায়তা প্রদান কমিটি’র মাধ্যমে জেলা ও দায়রা জজ এই কার্যক্রম পরিচালনা করেন। ডেপুটি কমিশনার, পুলিশ সুপার, মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা, কারা-তত্ত্বাবধায়ক, জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক, সরকারী উকিল, পাবলিক প্রসিকিউটর, বে-সরকারী সংস্থাসহ বিভিন্ন সরকারী দপ্তরের অনেকইে এই কমিটির সদস্য। বরাদ্দকৃত অর্থ কমিটির সিদ্ধান্ত ও অনুমোদনক্রমে জেলা ও দায়রা জজ এবং জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক যৌথ দস্তখতে এই অর্থ ব্যয় করেন। সৈকতের একটি জেলায় এই কার্যক্রমের বিষয়ে একটি সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। জেলা ও দায়রা জজের সভাপতিত্বে এই অনুষ্ঠানে মাননীয় মন্ত্রী মহোদয় এবং দুজন যুগ্ম-সচিবসহ বিশিষ্টজনেরা অংশ নেন। দু’জন রাজনীতিবিদ আমন্ত্রিত না হলেও মন্ত্রী মহোদয়ের সাথে এই অনুষ্ঠানে যোগ দেন। তারা অনুষ্ঠানের এক পর্যায়ে জানতে চান এই ‘কমিটি’র নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে ‘জাতীয় সংসদ সদস্য’দের রাখা হয় নাই কেন। এটা বিচার বিভাগ সম্পর্কিত ব্যাপার তাই এখানে রাজীতিবিদদের সংশ্লিষ্ট করা সমীচীন নয়। তাতে তাঁরা সন্তুষ্টু তো হলেনই না বরঞ্চ রাগান্বিত হলেন। তাঁদের বক্তব্য যেখানে বিদেশ (মূলত কানাডা ) থেকে এতো অর্থ ব্যয় হবে সেখানে জাতীয় সংসদের সদস্যদের কর্তৃত্ব কেন থাকবে না। তারা যুগ্ম সচিবদ্বয়ের মর্যাদা নিয়ে কটাক্ষ করতেও ছাড়লেন না। মন্ত্রী মহোদয় এর যুৎসই জবাব দিয়ে বললেন সকল অর্থনৈতিক কাজেই তো তাঁরা থাকেন, এখানেও তাদের কেন থাকতে হবে। এরপর তারা দুজন অনুষ্ঠান ত্যাগ করে চলে গেলেন। বলা প্রয়োজন এই রাজনীতিবিদদ্বয় পরস্পর বিরোধী দুই রাজনৈতিক দলের নেতা। এরূপ অনেক উদাহরণই দেওয়া যাবে ।

অর্থনৈতিক কর্মকান্ড যেখানে সেখানে রাজনীতিবিদগণের অনেকেই থাকতে ভালবাসেন। এ নিয়ে অনেক প্রশ্ন উঠলেও তারা তাদের তৎপরতায় বে-পরোয়া। বিচার অঙ্গনও এ থেকে মুক্ত থাকতে পারে নাই। দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের একটি জেলায় জঙ্গীদের বিচার শেষ হওয়ার প্রাক্কালে একদিন জেলা ও দায়রা জজের এজলাসে আইনজীবীদের গমনে বাধা দিলেন একজন আইনজীবী-রাজনীতিবিদ। তিনি ঐ জেলায় একটি রাজনৈতিক দলের সাধারন সম্পাদক। প্রায় দেড় ঘন্টা পর বেলা ১১-০০ মিনিটের সময় তারা এজলাসে প্রবেশ করে আদালতের কাজে অংশ নিলেন। কারণ জানতে চাইলে উক্ত আইনজীবী-রাজনীতিবিদ জানালেন যে তাদের নির্বাচনী অঙ্গীকার ছিল আদালতের কাজ বেলা ১১-০০ মিনিটে শুরু করার ব্যবস্থা করা। কিন্তু উক্ত জেলায় বিচারকগণ বেলা ০৯-৩০ মিনিটে এজলাসে উঠেন এবং বিচার কার্য করেন। সুপ্রীম কোর্টের নির্দেশ রয়েছে বিচারকগণ নিজ নিজ দফতরে আসবেন সকাল ০৯-০০ মিনিটে এবং এজলাসে উঠে বিচার কার্য করবেন বেলা ০৯-৩০ মিনিট থেকে অপরাহ্ন ০৪-৩০ মিনিট পর্যন্ত, দুপুর ০১-৩০ মিনিট থেকে দুপুর ০২-০০ মিনিট জোহরের নামাজ ও মধ্যাহ্ন ভোজের বিরতি থাকবে। বিচারকগণ এই সময়সূচী অনুসরণ করতেন। এর পরিবর্তন ঘটাতে পারলে এ্যাডভোকেট-রাজনীতিবিদ একটা কৃতিত্ব পেতেন। গর্ব করে বলতে পারতেন আদালত তার কথায় চলে। এতে সাধারণ আইনজীবীদের মাঝে তার প্রভাব প্রতিপত্তি বাড়তো। এছাড়াও তার আরো উদ্দেশ্য ছিল বিচারকদের মাঝে একটু ভয় ধরিয়ে দেওয়া , তা হাসিল হলে বিচারক যদি জঙ্গীদের সাজা প্রদান করা থেকে বিরত থাকতেন বা নমনীয় হতেন তাহলে এই নেতা ও তার দল তৎকালীন ক্ষমতাসীন দলকে জঙ্গীদের পৃষ্ঠপোষক বলে দোষারোপ করতে পারতেন। এভাবে তারা ঐ ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তুলতে পারতেন। কিন্তু সাহসী বিচারকগণ সুপ্রীম কোর্ট কর্তৃক নির্ধারিত সময়সূচী পূর্ববৎ অনুসরণ করতে থাকেন। জঙ্গীদের বিচার শেষে অভিযুক্তদের সর্বোচ্চ সাজায় দন্ডিত করেন। এতে জঙ্গীদের মনোবল ভেঙে যায় এবং দু’এক দিনের মধ্যেই তাদের শীর্ষ নেতাগণ ধরা পড়ে।

দেশে বেকারত্ব দ্রুত বাড়ছে। এই অবস্থায় আইনানুগভাবে নিয়োগ না দিয়ে কাগজে কলমে নিয়ম অনুসরণ করা হয়েছে দেখিয়ে রাজনীতিবিদের দেওয়া তালিকা মোতাবেক নিয়োগ দিতে হয়। না হলে নিয়োগ দানকারী কর্মকর্তার ঝক্কি ঝামেলার অন্ত থাকে না। অভিযোগ রয়েছে নিয়োগের তালিকা আসে ঢাকা থেকে। অধস্থন আদালতে ইদানিং এই নিয়োগ কমিটিতে মন্ত্রণালয়ের একজন প্রতিনিধি কাজ করেন। জেলা পর্যায়ে নিয়োগের এইসব কার্যক্রম জেলা ও দায়রা জজের কর্তৃত্বে ও তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হয়, কিন্তু মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধির সিদ্ধান্ত তাকে মেনে নিতে হয় বলে রটনা রয়েছে। যদিও মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি পদ মর্যাদা বিবেচনায় জেলা ও দায়রা জজের অনেক অনেক নীচে। যে সমস্ত জেলা ও দায়রা জজ এই সিদ্ধান্ত মানতে পারেন নাই তাদেরকে বরণ করতে হয়েছে করুণ পরিণতি । এই সব অবস্থা দেখে অনেক বিচারক নিয়োগ সংক্রান্ত এসব কমিটি থেকে নিজ নিজ নাম প্রত্যাহার করে নিয়েছেন বিবেকের তাড়নায়। এখানেও সাংবিধানিক পদে অধিষ্ঠিত রাজনৈতিক নেতার নির্বাচনী ওয়াদা কাজ করে বলে প্রকাশ।

রাজধানীর নামী দামী বিদ্যালয় তো বটেই মফস্বল শহরের বিদ্যালয়গুলোতেও ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক নেতার সহায়তা ব্যতীত সন্তানদের ভর্তি করা কঠিন কাজ। হাসপাতালে সুষ্ঠু চিকিৎসা পেতে গেলেও একই পরিস্থিতির সম্মুখিন হতে হয়। অভিভাবক বা ভুক্তভোগীকে (যেরূপ প্রযোজ্য) এরূপ আনুক’ল্য পেতে অনুসরণ করতে হয় বিশেষ পদ্ধতি। এটা চরম সত্য হলেও সরাসরি বলা সমীচীন নয়। রাজনৈতিক আশীর্বাদ ও সুপারিশ ছাড়া উচ্চপদ প্রাপ্তি বা পদোন্নতি সম্ভব নয়। এই আশীর্বাদ ও সুপারিশ করার আগে ক্ষমতাধর রাজনীতিবিদ জানতে চান ও নিশ্চিত হতে চান সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি তার দলভুক্ত লোক কিনা। পদ বজায় রাখতে গেলেও একই পদ্ধতি অনুসরণ করতে হয়। তাইতো আমরা দেখি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাবিদগণও রাজপথে এসে পথসভায় বক্তৃতা করেন। কেউ আবার সারা সময় ধরে বিভিন্ন চ্যানেলে ‘আলাপচারিতা’ অনুষ্ঠানে জ্ঞানগর্ভ কথা বলেন । অপরদিকে শ্রেণীকক্ষে ছাত্রছাত্রীগণ পাঠ গ্রহণ করতে এসে শিক্ষককে না পেয়ে ফিরে যায়। মেধার বিকাশ তাই বাধাগ্রস্থ হচ্ছে। সরকারী বিভিন্ন দফতরে মেধাবীরা চাকুরী থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এতে ঐসব দফতর হচ্ছে ক্ষতিগ্রস্থ। সমস্ত প্রতিষ্ঠান এভাবে মেধাবী শূণের পথে ধাবিত হচ্ছে। এসব কারণে জনগণ অরাজনৈতিক সরকারকে পছন্দ করে। বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমেদকে অসাংবিধানিকভাবে দেশের উপ-রাষ্ট্রপতি পদে নিয়োগ দিয়ে তাকে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব প্রদানের পথ সুগম করা হয়েছিল। তিনি কিন্তু জনপ্রিয় ছিলেন। দেশ ও জাতির সংকটকাল বলে উল্লেখ করে যারাই দেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা গ্রহণ করেছে তারা প্রত্যেকেই এসব কারণে পেয়েছে জনপ্রিয়তা।

যিনি বা যারা সাংবিধানিক পদে অধিষ্ঠিত হয়ে দেশ পরিচালনা করবেন, প্রতিষ্ঠানগুলোকে জনকল্যাণমূলক কাজে গতিশীল ও বেগবান করবেন তাদেরকে অবশ্যই নৈতিকতা ও দায়িত্বশীলতার অনুসরণীয় প্রতীক হতে হবে। ‘কুতুব মিনার’, ‘তাজমহল’, ‘লালবাগ কেল্লা’ উপমহাদেশের গৌরবময় ঐতিহ্যের প্রতীক হিসাবে দাঁিড়য়ে আছে। পক্ষান্তরে ‘শাহবাগ হোটেল’, ‘হোটেল ইলিসিয়াম’, ‘জনতা টাওয়ার’ ঘোষণা করছে ক্ষমতাসীন রাজনীতিবিদদের দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির কলংক-কথা। স্বাস্থ্য খাতে জনস্বার্থ বিবেচনা না করে ব্যবসায়ীক স্বার্থে কেনাকাটার নামে শত কোটি টাকা লোপাটে বাধা সৃষ্টির পরিকল্পনায় সহযোগিতা না করায় পদ্মা-যমুনা-ইছামতি বিধৌত জেলায় সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক-কর্মকর্তা হেনস্তা হন। এসব ঘটনা বিস্তারিত বিবরণসহ গণ-মাধ্যমে প্রকাশিত ও প্রচারিত হলেও সাংবিধানিক পদাধিকারী রাজনীতিবিদ থাকছেন ধরাছোয়াঁর বাইরে। যারা দুর্নীতি দমনের দায়িত্ব পালন করছেন তাদের নিজেদের স্বনামীয় ও বেনামীয় সম্পদ বাড়ছে হু হু করে, অপ্রতিহত গতিতে ; জনগণ এটাই বলছে। এর সবই হচ্ছে কতিপয় রাজনীতিবিদের ছত্রছায়ায়। এ সব রটনা আজ সর্ববিদিত। প্রাগুক্ত উদাহরণসমূহ সুস্পষ্টভাবে দেখিয়ে দিচ্ছে বর্তমান আমলে দেশ পরিচালনার রাজনীতিতে নৈতিকতা ও দায়িত্বশীলতার সংকট প্রকটরূপ ধারণ করেছে। তাই আজ জনগণ অসহনীয় দুর্ভোগে নিপতিত হয়েছে। এ থেকে পরিত্রাণ পেতেই হবে। সেজন্য শাসনব্যবস্থায় আনতে হবে কার্যকরী মৌলিক গুণগত পরিবর্তন। ১৯৭২ সালে দলীয় সরকার কায়েমের মধ্য দিয়ে যে শাসন ব্যবস্থা চালু করা হয়েছিল তার বিষফল আজ আমরা ভোগ করছি। কোন আবেগ বা দুর্বলতার বশবর্তী হয়ে নয়, অতীতমুখি রোমান্টিকতা নয়, আমাদেরকে এগুতে হবে বর্তমানের বাস্তবতার আলোকে। শ্রমজীবী কর্মজীবী পেশাজীবী জনগণের সুন্দর, ন্যায়পরায়নতা সম্পন্ন, অধিকারের সুসমতা মন্ডিত সমাজ গঠনের লক্ষ্যেই সর্বসম্মতভাবে প্রণয়ন করতে হবে নতুন শাসন ব্যবস্থা।

লেখকঃ সাবেক জেলা ও দায়ৃরা জজ । বর্তমানে এ্যাডভোকেট বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট , হাইকোর্ট বিভাগ, ঢাকা এবং বে-সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগের অধ্যাপক।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.