নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

রোমেল রহমান এর ব্লগ

রোমেল রহমান

রোমেল রহমান › বিস্তারিত পোস্টঃ

তাহলে বিচারকেরা কিভাবে বিচার করবেন

০৩ রা মে, ২০১৫ সকাল ৭:১৫

মধ্যাহ্ন বিরতির পর বিচারক আসন গ্রহণ করলেন। চাঞ্চল্য সৃষ্টিকারী মামলার রায় ঘোষণা করবেন বিজ্ঞ সহকারী দায়রা জজ/ বিশেষ ট্রাইব্যুনাল-৫। খ্রিষ্টান যুবক জোনাথন ঢালী ও তার সঙ্গীদের বিরুদ্ধে ‘খানকা শরীফে’ বোমাবাজী করার অভিযোগ। নামটা ‘খানকা শরীফ’ হলেও ইসলামী শরিয়ত ও তমুদ্দুনের সাথে এর সম্পর্ক অত্যন্ত ক্ষীণ। মাগরিবের ওয়াক্তে ঢোল বাজিয়ে উচ্চস্বরে গান গাওয়ার সাথে সাথে বিশেষ ভঙ্গিতে এখানে নাচানাচি করা হয়। এ নিয়ে স্থানীয় মুসুল্লীদের সাথে খানকাওয়ালাদের বিরোধ চরমে উঠে। বিক্ষুব্ধ জনতা এর প্রতিবাদ জানায় এবং দেওয়ানী আদালতে প্রতিনিধিত্বমূলক মামলা দায়ের করে। ‘খানকা শরীফে’র কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। পাশেই খ্রিষ্টান পল্লী।এদের সম্পত্তির প্রতি নজর (বদ নজর বলাই ঠিক হবে) পড়ে খানকাওয়ালাদের। কিন্তু খ্রিষ্টান পল্লীর বাসিন্দাগণ তাদের বাস্তুু ভিটা বিক্রি করতে রাজি নয়।এ নিয়েও ঠান্ডা মনকষাকষি চলছে খ্রিষ্টান পল্লীর বাসিন্দাদের সাথে খানকাওয়ালাদের।এই অবস্থার মধ্যেই খানকাওয়ালাদের এজাহার মতে মামলা দায়ের হলো সোনাডাঙা থানায়। আসামীদের মধ্যে রয়েছে স্থানীয় মুসল্লীদের তরুন ও যুবক সন্তানেরা এবং খ্রিষ্টান পল্লীর জোনাথন ঢালীসহ অন্যান্যরা। বিজ্ঞ বিচারক সাক্ষ্য প্রমাণ গ্রহণ করে উভয় পক্ষের সওয়াল জবাব শুনেছেন। আসামী পক্ষ দাবী করেছে আদতে এরূপ কিছু ঘটে নাই। খানকাওয়ালারা একই সাথে স্থানীয় মুসুল্লীদের বিরুদ্ধে ফৌজদারী মামলা দিয়ে বাগে এনে প্রতিনিধিত্বমূলক দেওয়ানী মামলা প্রত্যাহার করাতে চায় আবার খ্রিষ্টান পল্লীর বাসিন্দাদের ভিটে-মাটি থেকে উচ্ছেদ করে তা দখল করে খানকা সম্প্রসারিত করতে চায়। এক ঢিলে দুই পাখি মারার উদ্যোগ। আজ রায় ঘোষণার দিন। এজলাসে উৎসুক জনতার ভিড়, তবুও পিন পতন নিরবতা বিরাজমান। বিজ্ঞ বিচারক ভাবগম্ভীর শান্ত ও দৃঢ় কন্ঠে রায় ঘোষণা করলেন। আসামীদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ সন্দোতীতভাবে প্রমাণিত না হওয়ায় তাদের সকলকে বে-কসুর খালাস দেওয়া হলো। হাসি ও আনন্দের ছটা ছড়িয়ে পড়লো সবার মাঝে। প্রৌঢ়া মার্গারেট কাগুজীও ছিল দর্শকদের মাঝে, তার সাথে ছিল খ্রিষ্টান পল্লীর মেয়েরা। মার্গারেটকে অন্য মেয়েরা একটা টুলের উপর দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল, যাতে সে বিজ্ঞ বিচারককে দেখতে পারে। রায় শুনে সে তার গলায় ঝুলানো ‘ক্রস’ চিহ্নটাতে চুমা দিল, তার বুকে ও কপালে ঠেকালো এরপর দুই হাত জোড় করে বিচারকের উদ্দেশ্যে উচ্চস্বরে বললো ‘ঈশ্বর তোমার মঙ্গল করুণ”। ভেঙে গেলো নিস্তব্ধতা। বিজ্ঞ বিচারক এজলাস ত্যাগ করে খাস কামড়ায় চলে গেলেন। আসামীদের মুক্ত করে দিল আর্দালী আবুল কাশেম । তারা স্বজনদের সাথে নিজ নিজ বাসস্থানে চলে গেলো। যাত্রা পথে সকলের মুখে উচ্চারিত হতে থাকলো বিজ্ঞ বিচারকের জয়গান।

দায়রা জজ আদালতে দূর-দূরান্ত থেকে আবাল-বৃদ্ধ-বণিতারা এসেছে। আজ জামাল উদ্দিন ওয়াকফ এস্টেটের মোতোওয়াল্লী আবদুস সাত্তার ও তার শিশু কন্যা মৌসুমী হত্যার রায় ঘোষণার দিন। খুনের এই মামলাদি দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন কারণে নিষ্পত্তির অপেক্ষায় আছে। বেশ কয়েকজন দায়রা জজ ইতিমধ্যে এই জেলায় তাঁদের কার্যকাল শেষ করে পরবর্তী কর্মস্থলে চলে গেছেন। কিন্তু এই মামলার নিষ্পত্তি হয় নাই। আসামীরাও একে একে জামিনে মুক্ত হয়ে গেছে। এদের একজন ‘ইউনিয়ন পরিষদ’-এর চেয়ারম্যানও নির্বাচিত হয়েছে। জেলা পর্যায়ে প্রশাসনের সকল কর্মকর্তার সাথেই তার উঠাবসা। গড়ে উঠেছে সখ্যতা। স্থানীয় জনগণ ভাবতে শুরু করেছে বিচারও শেষ হবে না। আসামীরাও আর সাজা পাবে না। এই পরিস্থিতিতেই আজ মামলাটির পূর্ণাঙ্গ শুনানী শেষে রায় ঘোষণা করলেন দায়রা জজ। নুরু চেয়ারম্যানসহ তিনজনের মৃত্যুদন্ড, অপর সাতজনের যাবজ্জীবন কারাদন্ড। সেই সাথে সকল আসামীর জরিমানা। অপ্রত্যাশিত রায়। কড়া পুলিশ প্রহরায় সাজাপ্রাপ্ত আসামীদের নিয়ে যাওয়া হলো জেলখানায়। খবর মুহূর্তের মধ্যে বিদ্যুৎগতিতে ছড়িয়ে পড়লো সারা শহরে। আনন্দোচ্ছল জনতা দলে দলে আসতে লাগলো আদালত ভবনের দিকে। পুলিশ কর্তৃপক্ষ তৎপর হয়ে উঠলো বিচারবৃন্দ ও আদালত ভবনের নিরাপত্তার কথা ভেবে। তাদের এই উদ্বেগ অমূলক বলেই প্রতিভাত হলো কিছুক্ষণের মধ্যে। শহরের বিশিষ্ট নাগরিকেরা জানালেন জনতা এসেছে দায়রা জজ মহোদয়কে শ্রদ্ধা জানাতে, ভালবাসার অর্ঘ নিবেদন করতে। কোন বিশৃংখলা হবে না। হলোও তাই । দায়রা জজের বাঙলোতে ফেরার পথে রাস্তার দুধারে দল-মত-ধর্ম-বর্ণ নিবিশেষে জনতা দাঁড়িয়ে গেলো, কারো হাতে ফুল, কারো কন্ঠে জয়ধ্বনী। দায়রা জজের গাড়ি এগিয়ে গেলো বাঙলোর পথে। নিরুদ্বেগ দায়রা জজ দেখলেন জনতা হাত নেড়ে তাঁকে জানাচ্ছে অভিবাদন। বিচারক হিসেবে এর উত্তর জানানোর সুযোগ তার নাই, তিনি এসব দৃশ্য শুধু অবলোকন করলেন।

লালপুর উপজেলা থেকে বদলী হয়ে নতুন কর্মস্থলে চলে গেছেন ‘মুনসেফ’ সাহেব। এর মধ্যে কয়েকবার তাঁর কর্মস্থলের পরিবর্তন হয়েছে। বর্তমান কর্মস্থলে যাবার জন্য তাকে কয়েক ঘন্টা যাত্রা বিরতি করতে হলো গোপালপুরে। তাঁর আমলের উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তারা না থাকলেও কর্মচারীদের অনেকেই আছে। তাঁর যাত্রা বিরতির খবর পেয়ে সকলেই তার সাথে সৌজন্য সাক্ষাতে মিলিত হলো। তিনি সকলের সাথে কুশল বিনিময় করলেন, স্মৃতিময় ‘উপজেলা কমপ্লেক্স’ ঘুরে ঘুরে দেখলেন। তিনি কতকটা স্মৃতিকাতর হয়ে গেলেন। শেষ হয়ে গেলো যাত্রা বিরতির সময়। তিনি গাড়িতে উঠবেন এ সময় দূর থেকে এক ব্যক্তি উচ্চস্বরে, ‘স্যা...আ...র ’ বলে চিৎকার করে ডাকলো। লুঙ্গি পাঞ্জাবী পরিহিত শ্মশ্রুমন্ডিত পঞ্চাশোর্ধ লোকটি হাত উঁচিয়ে দৌড়ে আসছে। ওর নাম জালাল উদ্দিন। স্থানীয় একজন গরিব কৃষক। কৃষি কাজের পাশাপাশি ‘চিনি কলে’ সে ‘মৌসুমী’ শ্রমিকের কাজ করে। খাস জমি চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত নিয়ে কলার আবাদ করেছে। এই জমির উপর একজন স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তির নজর পড়ে। প্রভাবশালী ব্যক্তি ‘চিনি কল’ কর্তৃপক্ষ ও উপজেলা প্রশাসনকে প্রভাবিত করলে জালালকে জমির দখল ছেড়ে দিতে বলা হয়। সামরিক শাসনের যুগ। ঐ প্রভাবশালী ব্যক্তির প্রচন্ড দাপট সকল দফতরে, কারণ সামরিক শাসকদের সাথে তার উঠাবসা ও দহরম মহরম আছে। জমির দখল রাখা জালালের জন্য দায় হয়ে গেলো। কোন কর্মকর্তাই তাকে নিজ সম্পত্তি রক্ষার ব্যাপারে আইনসম্মতভাবে সহায়তা করতে এগিয়ে এলো না। সে দেওয়ানী আদালতে প্রতিকার প্রার্থনা করে মামলা দায়ের করলো। বিজ্ঞ মুনসেফ শুনানী শেষে এবং দলিল-দস্তাবেজ পর্যালোচনায় মামলার রায় দিলেন। জালাল তার মামলায় ডিক্রি পেলো। প্রভাবশালী ব্যক্তির প্রভাব, অনুরোধ, অনুনয়, প্রচ্ছন্ন হুমকি কোন কিছুই আদালতের উপর প্রভাব ফেলতে পারে নাই। অসহায় জালাল জীবনে আশার আলো দেখতে পায়। সে ভাবতে থাকে করুণাময় রিজিকদাতা নিরাপত্তাদাতা আল্লাহ তাকে সীমালংঘনকারীদের জুলুম থেকে হেফাজত করেছেন। সে আরো ভাবতে থাকে ‘মুনসেফ’ সাহেব যেন আল্লাহর প্রতিনিধি। অন্যান্য নাগরিকেরা যারা প্রভাবশালী ঐ ব্যক্তি ও তার বশংবদ কর্মকর্তাদেরকে ভীতির চোখে দেখতো, তাদেরও চোখ খুলে গেলো এই রায়ের মর্ম জেনে। গোটা উপজেলাবাসী উপলব্ধি করলো আইন ও ন্যায়নীতির উর্ধে কেউ নয়। জালাল তার হৃদয়ে শ্রদ্ধার আসনে অভিসিক্ত করে ‘মুনসেফ’ সাহেবকে। আজ দীর্ঘদিন পর ‘মুনসেফ’ সাহেবের আগমনের খবর শুনে সে দৌড়ে আসে একনজর দেখতে ও শ্রদ্ধা নিবেদন করতে। ‘মুনসেফ’ সাহেবের সামনে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে সে বলতে থাকে,‘স্যার, আপনার রায়ের বিরুদ্ধে ওরা আপীল করেছিল জজকোটে, সাব-জজ সাহেব ওদের আপীল না-মঞ্জুর করে দেন। তারপর ওরা হাইকোর্টে গেলে সেখানেও আপনার রায়ই বহাল থাকে।’ বলে অঝোর ধারায় কানতে থাকে জালাল। ‘মুনসেফ’ সাহেব নিজেও আবেগাপ্লুত হয়ে যান। আবেগ সামলে নিয়ে জালালকে সৎ জীবন যাপন করা ও আল্লাহর ইবাদতে নিমগ্ন হয়ে দিনগুজরান করার পরামর্শ দেন। এভাবে জালালকে তিনি সান্ত¦না দেন। সময় কারো জন্য থেমে থাকে না।‘মুনসেফ’ সাহেবেরও গাড়ির সময় হয়ে যায়। তিনি বিদায় নেন পুরাতন কর্মস্থলের আবেগঘন স্মৃতি নিয়ে। জালাল ও উপজেলার কর্মকর্তা-কর্মচারীগণ এবং উপস্থিত স্থানীয় জনতা শ্রদ্ধাবনত দৃষ্টিতে নির্নিমেষে তাকিয়ে থাকে যতক্ষণ ‘মুনসেফ’ সাহেবকে বহনকারী গাড়িটি দৃষ্টির আড়ালে চলে না যায়।

প্রাগুক্ত ঘটনাবলী আমাদের মাঠ পর্যায়ের বিচারাঙ্গনে প্রতিনিয়ত ঘটমান ঘটনাবলীর এক ক্ষুদ্র অংশমাত্র। অধস্তন আদালতের বিচারকেরা এভাবে আবহমানকাল থেকে তাঁদের বৈচারিক (Judicial) দায়িত্ব সততা, নিষ্ঠা, দায়িত্বশীলতার সাথে ভয়ভীতি, রক্তচক্ষু, লোভ, প্রলোভন দ্বিধাহীন চিত্তে উপেক্ষা করে পালন করে আসছেন। এসব ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে, তবে ব্যতিক্রম কখনো মূলধারার উপরে প্রাধান্য বিস্তার করতে পারে না। অধস্তন আদালতের বিচারকেরা উপরিল্লিখিত অদম্য সাহস পেয়েছেন নীতিবোধ, সংবিধান ও আইন থেকে। সংবিধানের ‘ষষ্ঠ ভাগ’-এ বিচার বিভাগ সম্পর্কিত বিধানাবলী বর্ণিত হয়েছে।অধস্তন আদালত সম্পর্কিত বিধানাবলী বর্ণিত হয়েছে ২য়পরিচ্ছেদ-এ। ১১৬ক অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে ,‘এই সংবিধানের বিধানাবলী সাপেক্ষে বিচার-কর্মবিভাগে নিযুক্ত ব্যক্তিগণ এবং ম্যাজিষ্ট্রেটগণ বিচারকার্য পালনের ক্ষেত্রে স্বাধীন থাকিবেন।’ উক্ত ভাগের ১ম পরিচ্ছেদে সুপ্রীম কোর্ট সম্পর্কিত বিধানাবলী বর্ণিত হয়েছে। এর ১০৯ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে,‘হাইকোর্ট বিভাগের অধস্তন সকল আদালত ও ট্রাইব্যুনালের উপর উক্ত বিভাগের তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণ-ক্ষমতা থাকিবে।’ এরপরই ১১২ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে,‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রীয় সীমানার অন্তর্ভূক্ত সকল নির্বাহী ও বিচার বিভাগীয় কর্তৃপক্ষ সুপ্রীম কোর্টের সহায়তা করিবেন।’ সংবিধানের তৃতীয় ভাগে মৌলিক অধিকার সংক্রান্ত বিধানাবলী বর্ণিত হয়েছে। ৩১ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে,‘আইনের আশ্রয়লাভ এবং আইনানুযায়ী ও কেবল আইনানুযায়ী ব্যবহারলাভ যে কোন স্থানে অবস্থানরত প্রত্যেক নাগরিকের এবং সাময়িকভাবে বাংলাদেশে অবস্থানরত অপরাপর ব্যক্তির অবিচ্ছেদ্য অধিকার এবং বিশেষতঃ আইনানুযায়ী ব্যতীত এমন কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাইবে না, যাহাতে কোন ব্যক্তির জীবন, স্বাধীনতা, দেহ, সুনাম, বা সম্পত্তির হানি ঘটে।’ ৩২ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে ,‘আইনানুযায়ী ব্যতীত জীবন ও ব্যক্তিস্বাধীনতা হইতে কোন ব্যক্তিকে বঞ্চিত করা যাইবে না।’ এই সাথেই ৩৩ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে,‘(১) গ্রেপ্তারকৃত কোন ব্যক্তিকে যথাসম্ভব শীঘ্র গ্রেপ্তারের কারণ জ্ঞাপন না করিয়া প্রহরায় আটক রাখা যাইবে না এবং উক্ত ব্যক্তিকে তাঁহার মনোনীত আইনজীবীর সহিত পরামর্শের ও তাঁহার আত্মপক্ষ-সমর্থনের অধিকার হইতে বঞ্চিত করা যাইবে না। (২) গ্রেপ্তারকৃত ও প্রহরায় আটক প্রত্যেক ব্যক্তিকে নিকটতম ম্যাজিস্ট্রেটের সম্মুখে গ্রেপ্তারের চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে (গ্রেপ্তারের স্থান হইতে ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে আনয়নের জন্য প্রয়োজনীয় সময় ব্যতিরেকে) হাজির করা হইবে এবং ম্যাজিস্টেটের আদেশ ব্যতীত তাঁহাকে তদতিরিক্তকাল প্রহরায় আটক রাখা যাইবে না।’ এভাবে প্রত্যেক নাগরিকের সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে জীবন যাপন করার অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। একজন বিচারকের সাফল্য ও গৌরবের মাপকাটি হচ্ছে ন্যায়বিচার করতে তাঁর প্রজ্ঞা ও দক্ষতা। তিনি কতজনকে সাজা দিয়েছেন বা কতজনকে খালাস দিয়েছেন বা কতজনকে জামিন দিয়েছেন বা কতজনকে হাজতে পাঠিয়েছেন বা কতটি মামলায় নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন বা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে তিনি কতখানি পরাক্সমুখ এসব দিক বিবেচনা করে কখনো কোন বিচারকের বিচারকর্মের মান নির্ণয় করার সুযোগ নাই। তাঁর মূল্যায়ন হয় বিচার কর্মে তিনি অনুরাগ বা বিরাগের মনোভাব পরিত্যাগ করে ন্যায়নীতি, আইন ও সাক্ষ্য প্রমাণাদির চুলচেরা বিচার বিশ্লেষণ পূর্বক সকল প্রকার প্রভাব প্রতিপত্তির উর্ধে উঠে সিদ্ধান্তে উপনীত হয়ে রায় ঘোষণা করার দিক বিবেচনার মাধ্যমে।

নাগরিকদের অবাধ বিচরণ, বাক ব্যক্তি ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা বিধান করেছে সংবিধান। তাদের মান মর্যাদার হেফাজতের নিশ্চয়তা বিধানও সংবিধানই করেছে। এভাবে নাগরিকদের মৌলিক অধিকার ভোগের বিষয়ে সংবিধান যেমন নিশ্চয়তা বিধান করেছে তেমনি এর সীমারেখাও টেনে দিয়েছে। সেটাও দেওয়া হয়েছে নাগরিকদের মৌলিক অধিকার ভোগের ক্ষেত্রে সমতা বিধানের স্বার্থে। কোন নাগরিককে ‘মৌলিক অধিকার’ থেকে বঞ্চিত করা যায় না। তবে কেহ যদি আইন ভঙ্গ করে বা অপরাধ করে তাহলে তাকে আটক রাখার বিধান রয়েছে। এই আটক রাখার আদেশ দেবার একমাত্র এখতিয়ার বিচারকের। পুলিশের নয়। পুলিশের দায়িত্ব তথ্য-উপাত্ত ও সাক্ষ্য প্রমাণাদি আলামতসহ আদালতে উপস্থাপন করা। এসব কিছু বিচার বিশ্লেষণ করে বিচারক সিদ্ধান্ত নেবেন অভিযুক্ত ব্যক্তিকে সাজা দেওয়া হবে , না কি খালাস দেওয়া হবে। সাজা দেওয়া হলে তা কিরূপ হবে। পুলিশ এখানে কোন হস্তক্ষেপ করার অধিকার রাখে না। কোন আসামীকে গ্রেফতারের অবাধ ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে পুলিশকে। ফৌজদারী কার্যবিধির ৫৪ ধারা মোতাবেক কোন ব্যক্তিকে যুক্তিসংগত কারণে পুলিশ গ্রেফতার করতে পারে। কিন্তু জেলখানায় পাঠাতে পারে না। ২৪ ঘন্টার বেশী আটকও রাখতে পারেনা। জেলখানায় পাঠাবার হুকুম দেবার একমাত্র এখতিয়ার বিচারকের। পুলিশ গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিকে গ্রেফতার করার চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে ম্যাজিস্টেটের সমক্ষে হাজির করবে এবং গ্রেফতার করার কারণ ম্যাজিস্টেটের কাছে বর্ণনা করবে। উভয় পক্ষের বক্তব্য শ্রবণ করে এবং প্রাপ্ত সাক্ষ্য প্রমাণাদি ও আলামত (যদি থাকে) বিচার বিশ্লেষণ করে ম্যাজিস্ট্রেট সিদ্ধান্ত নেবেন গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিকে আটক রাখা হবে কিনা। পুলিশের কাছে কোন সাক্ষীর বক্তব্য (ফৌজদারী কার্যবিধির ১৬১ ধারা অনুসারে) বিচারের সময় সাক্ষ্য হিসাবে গ্রহণ করা হয় না। কোন আসামীকে ফৌজদারী কার্যবিধির ১৬৪ ধারা মতে দোষস্বীকারোক্তির জন্য প্রথম শ্রেনীর বৈচারিক ম্যাজিস্ট্রেট(Judicial Magistrate, First Class) এর সমক্ষে হাজির করা হলে সংশ্লিষ্ট আসামীকে ম্যাজিস্ট্রেট জানিয়ে দেন যে তিনি একজন ম্যাজিস্টেট, পুলিশ নন। তার কাছে দোষস্বীকার করতে আসামী বাধ্য নয়। আসামী দোষস্বীকার করুক বা না করুক তাকে আর পুলিশের কাছে পাঠানো হবেনা। এইসব বিষয় জানিয়ে দেবার পর আসামীকে চিন্তাভাবনা করার সময় দেওয়া হয়। এই পর্যায়ে আসামীকে যেখানে রাখা হয় তার আশে পাশে পুলিশ থাকবে না। যদি আসামী চিন্তাভাবনা শেষে দোষস্বীকার করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে তাহলে তার উক্ত স্বীকারোক্তি ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক লিপিবদ্ধ করার সময় সেখানে বা তার আশে পাশে কোন পুলিশ সদস্য থাকবে না। উপরিউক্ত স্থান সমূহে যদি পুলিশ বাহিনীর কোন সদস্য থাকে তাহলে বিচারের সময় উক্ত স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে আসামীর বিপক্ষে কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যাবে না। এইভাবে সংবিধান ও আইনের মাধ্যমে বিচারক ও পুলিশের এখতিয়ার ও কার্যক্রমের সীমা নির্দিষ্ট ও নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। বন্দুকের দ্বারা কলম নিয়ন্ত্রিত হবে না। বরঞ্চ কলমের দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত হবে বন্দুক। মাও-সে-তুং এর এ সংক্রান্ত বক্তব্যের মর্মার্থ এই যে রাজনীতির দ্বারাই বন্দুক নিয়ন্ত্রিত হবে, যে বন্দুক রাজনীতির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় না সেটা ডাকাতের বন্দুক। এ বিষয়গুলো নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। গত ৪ঠা বৈশাখ ১৪২২ বঙ্গাব্দ মোতাবেক ১৭ই এপ্রিল ২০১৫ খ্রিঃ শুক্রবার ঢাকা থেকে প্রকাশিত দৈনিক ‘প্রথম আলো’ পত্রিকায় প্রকাশিত খবরের সূত্রে বিষয়গুলোর পুনরোক্তির প্রয়োজন হয়ে পড়ে। খবরে বলা হয় বৃহত্তর সিলেটের তিনজন বৈচারিক (Judicial) ম্যাজিস্ট্রেটের জামিন সংক্রান্ত আদেশে ক্ষুব্ধ হয়ে পুলিশের পক্ষ থেকে উক্ত বিচারকদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয়েছে। কোন বিচারকের বিচার সংক্রান্ত কাজের কারণে তার বিরুদ্ধে নির্বাহী বিভাগের কেহ কোন অভিযোগ দায়েরের এখতিয়ার রাখে না। এরূপ আদেশ দ্বারা সংক্ষুব্ধ কোন ব্যক্তি বা কর্তৃপক্ষ আইনে বর্ণিত পদ্ধতি অনুসরণ করে আপীল দায়ের করতে পারে। আপীল আদালতেই শুধু মাত্র সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি বা কর্তৃপক্ষ সংশ্লিষ্ট বৈচারিক আদেশ কেন যথার্থ নয় এবং কেন তা বাতিল করা হবে সে সম্পর্কে নিবেদন পেশ করতে পারে।

ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশের কাজের মধ্যে যাতে সমন্বয়ের অভাব দেখা না দেয় সেজন্য ‘পুলিশ ম্যাজিস্ট্রেসী’ বৈঠকের বিধান রয়েছে। নিয়মিত এই বৈঠক করার জন্য ফৌজদারী বিধি ও আদেশাবলী (Criminal Rules and Orders) এবং সুপ্রীম কোর্টের আদেশে সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। তবে খবরে বর্ণিত মতে অভিযোগ পেশের অধিকার পুলিশের নাই। এরূপ অভিযোগের কথা এর আগেও শোনা গেছে। এ ধারা চলতে থাকলে আইনের শাসন ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা দুটোই বিঘ্নিত হবে। আইনের শাসন ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা পরস্পর অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। বিচারকগণ যদি বন্দুকের ভয়ে চাকুরী ও জীবনের নিরাপত্তার অভাব অনুভব করেন তাহলে তাদের দ্বারা স্বাধীনভাবে বিচার কার্য পরিচালনা ও সম্পাদন করা সম্ভব হবে না। এরূপ ক্ষেত্রে আইনের শাসন ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতার অন্তর্নিহিত শক্তি লোপ পাবে। দেশ হয়ে যাবে ‘মগের মুল্লুক’। আলোচ্য অভিযোগের খবর তাই সকল নাগরিকের জন্য উদ্বেগজনক।

লেখকঃ সাবেক জেলা ও দায়রা জজ । বর্তমানে অ্যাডভোকেট বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট , হাইকোর্ট বিভাগ, ঢাকা এবং বে-সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগের অধ্যাপক।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.