নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

রোমেল রহমান এর ব্লগ

রোমেল রহমান

রোমেল রহমান › বিস্তারিত পোস্টঃ

ইকবাল ভাইকে যেমন দেখেছি

১৬ ই জানুয়ারি, ২০১৬ রাত ৮:১৯

আমি তখন বরগুনার জেলা ও দায়রা জজ। ২০০৫ খ্রিষ্টাব্দ। জানুয়ারী মাস। ১৯ তারিখ। বন্ধুবর ডাঃ মনোযার-উল-আজীজের টেলিফোন। প্রথমেই তিনি জিজ্ঞেস করলেন,‘ আনিছ, তুই কি পাবনার কোন খবর রাখিস ?’ বললাম , ‘কি হয়েছে ?’ তিনি আমাকে যে খবর দিলেন তা শোনার জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম না। কিছু দিন আগেই ইকবাল ভাইয়ের সাথে মোবাইল ফোনে আমার কথা হয়েছে। তিনি ঈদুল ফিতর উৎযাপনের জন্য পাবনা যাচ্ছিলেন, আমি বরগুনায় নিজ বাঙলো সংলগ্ন দীঘির ঘাটে বসে বড়শি দিয়ে মাছ ধরা দেখছিলাম। সেখানে ডেপুটি কমিশনার ফারুক আহমেদ ও কর্নেল সাহেবও ছিলেন। পরিবেশটা ছিল আনন্দঘন। মাছ ধরার পর পছন্দসই মাছগুলো পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছিল রান্না ঘরে তা সুন্দর করে ভেজে আমাদের পরিবেশন করা হচ্ছিল। আমরা তা খাচ্ছিলাম আর খোশ গল্প করছিলাম। এই পরিবেশে ইকবাল ভাইকে ঈদের শুভেচ্ছা জানাবার জন্য ফোন করলাম। তিনি জানালেন যে তিনি ঈদ উৎযাপনের জন্য পাবনা যাচ্ছেন। কুশল বিনিময় হলো। পরে আবার কথা হবে । এভাবেই তখনকার মতো কথা শেষ হলো। এরপর বেশ কিছুদিন যোগাযোগ হয়নি। মনোয়ার যে খবর দিল তা শুনে হতভম্ব হয়ে গেলাম। মনোয়ার জানালো ইকবাল ভাই ‘ লাইফ সাপোর্টে’ বেশ কিছুদিন থাকার পর ইন্তেকাল করেছেন ( ইন্না লিল্লাহ ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজেউন)। ঢাকা থেকে লাশ পাবনায় আনা হয়েছে এবং পাবনা ‘টাউন হল’ ময়দানে ‘নামাজে জানাজা’ শেষে তাঁকে আরিফপুর গোরস্থানে দাফন করা হয়েছে। পাবনা ( সিরাজগঞ্জসহ) জেলার ‘মুজিব বাহিনী’ প্রধান হিসেবে তাঁর লাশ জাতীয় পতাকা দিয়ে মুড়িয়ে দেওয়া হয়। ‘গার্ড অব অনার’ প্রদান করা হয়। মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ-ঔঝউএর অগনিত নেতা-কর্মী-সমর্থকগণসহ পাবনার সর্বস্তরের মানুষ তাঁর প্রতি নিবেদন করে শ্রদ্ধা। জনগণের এই ¯েœহ, শ্রদ্ধা , ভালবাসায় সিক্ত হয়ে ইহধাম থেকে বিদায় নিয়েছেন ইকবাল ভাই। বরগুনার দীঘির ঘাটে বসে মোবাইল ফোনে তাঁর সাথে আমার শেষ কথা হয়। মনে পড়ে অনেক কথা।

ব্যক্তিগতভাবে তিনি আমার খালাত ভাই। বয়সে বড়। তাই সব সময়ই সমীহজনিত একটা দূরত্ব ছিল ছোট বেলায়। তিনি ছিলেন ভালো ফুটবল খেলোয়াড়। খেলতে গিয়ে তাঁর হাত ভেঙে গিয়েছিল। একটি স্টিলের পাত দিয়ে তা জোড়া লাগান হয়েছিল। পরবতীকালে এ নিয়ে একটা মজার ঘটনা ঘটে । একটি দূতাবাসে প্রবেশ করার সময় এলার্ম বেজে উঠে। নিরাপত্তা কর্মীরা বললো তার কাছে কোন ধাতব বস্তু লুক্কায়িত আছে। সারা দেহ তারা তল্লাশী কওে কিছুই পেলো না। নিরাপত্তা কর্মীরা নাছোড়বান্দা ইকবাল ভাইকে তারা ভিতরে ঢুকতে দেবে না। এই অবস্থায় ইকবাল ভাইয়ের মনে পড়লো তাঁর হাতের কথা । তিনি একথা নিরাপত্তাকর্মীদের জানালেন। নিরাপত্তাকর্মীগণ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ইকবাল ভাইয়ের কথার সত্যতা নিশ্চিত হয়। অতঃপর তাঁরা ইকবাল ভাইকে দূতাবাসে প্রবেশ করতে দেয়। পরবর্তীতে আমরা যখন খোশগল্প করতাম তখন এ প্রসঙ্গ উঠলে এ নিয়ে রসাত্মক আলোচনা আমরা উপভোগ করতাম।

পাবনা জেলা স্কুল থেকে ইকবাল ভাই ১৯৬৫ খ্রিষ্টাব্দে এস এস সি পাশ করেন। অতঃপর নেত্রকোনায় কলেজে এইচ এস সি শ্রেণীতে ভর্তি হন। এই সময় তিনি তৎকালীন ‘পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগে’র রাজনীতির সাথে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হন। ঐতিহাসিক ৬-দফা আন্দোলনে তিনি অংশ গ্রহণ করেন। উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় পাশ করার পর তিনি ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। বি-ফার্ম বা ফার্মেসী বিভাগে। এই সময় তিনি সিরাজুল আলম খান, আ স ম আব্দুর রব, তোফায়েল আহমেদ, আনোয়ার হোসেন মঞ্জু প্রমুখ নেতৃবৃন্দের সান্নিধ্যে আসেন। বাংলাদেশকে পূর্ণ স্বাধীন করার জন্য সিরাজুল আলম খান কর্তৃক গঠিত গোপন সংগঠন ‘ নিউক্লিয়াসে’র সাথেও তিনি যুক্ত হন। ঐ সময় তিনি ছিলেন ‘নিউক্লিয়াস’এর কনিষ্ঠ সদস্য। পড়াশুনার ফাঁকে ফাঁকে তিনি রাজনৈতিক তৎপরতা চালিয়ে যেতে থাকেন। এই সুবাদে সিরাজুল আলম খান , কাজী আরেফ আহমেদ, আবদুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ, আ স ম আবদুর রব প্রমুখ নেতৃবৃন্দের সান্নিধ্যে আসেন। সিরাজুল আলম খান ঐ সময় বাংলার পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে গড়ে তুলেছিলেন গোপন সংগঠন ‘নিউক্লিয়াস’। মুহম্মদ ইকবাল ছিলেন ‘নিউক্লিয়াসে’র কনিষ্ঠতম সদস্য। আহমেদ রফিক, আকবর মজিদ , আবদুস সাত্তার লালু, আতাউল হক হকু, রফিকুল ইসলাম বকুল , আবদুল মজিদ ( বেবী ইসলাম) , মখলেছুর রহমান মুকুল , সোহরাব উদ্দীন সোবা, মুহম্মদ নাসিম, ফজলুর রহমান পটল, অখিল রঞ্জন বসাক, গোলাম সারোয়ার খান সাধন, সাহাবুদ্দিন চুপ্পু প্রমুখ ছাত্র নেতৃবৃন্দের সাথে তাঁর ছিল সার্বক্ষণিক যোগাযোগ। শিক্ষার জন্য পাবনার বাইরে থাকলেও পাবনার উক্ত ছাত্র নেতৃবৃন্দের সাথে যোগাযোগ রেখে তিনি বাংলার পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জলের লক্ষ্যে ‘নিউক্লিয়াস’এর সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে নিরলস কাজ করে গেছেন। তিনি ১৯৬৬ সালের ৬-দফা আন্দোলন এবং ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থানে সক্রিয় অংশ গ্রহণ করেন। এই সময়ে পাবনা শহরে গোপালপুরস্থ তাঁর পৈত্রিক নিবাস ‘হামিদা ভিলা’ ছিল সকল আন্দোলন সংগঠন ও পরিচালনা মূল কেন্দ্রস্থল। ১৯৬৯ সালের মার্চ মাসে পাবনা টাউন হল ময়দানে বিশাল ছাত্র জনসভা অনুষ্ঠিত হয়, এই সভায় অংশ গ্রহণ করতে পাবনায় আসেন তোফায়েল আহমেদ, আ স ম আবদুর রব, নূরে আলম সিদ্দিকী , শাহজাহান সিরাজ, আবদুল কুদ্দুস মাখন, স্বপন কুমার চৌধুরী প্রমুখ শীর্ষ ছাত্র নেতৃবৃন্দ। তাঁরা সকলেই এই বাড়িতে আতিথ্য গ্রহণ করেন। তিনি ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশ গ্রহণ করেন। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে তিনি স্বাধীনতার ইশতেহারসহ ‘বঙ্গবন্ধু’র ৭ই মার্চের ভাষণের টেপ রেকর্ড এবং স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা পাবনায় নিয়ে আসেন। পাবনা জেলা স্কুলের মাঠে এই ইশতেহার ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের মাঝে বিতরণ করা হয় এবং ‘বঙ্গবন্ধু’র রেকর্ড করা ভাষন বাজিয়ে শুনানো হয়। ছাত্র নেতা আবদুস সাত্তার লালু, রফিকুল আসলাম বকুল, বেবী ইসলাম, মখলেছুর রহমান মুকুল, অখিল রঞ্জন বসাক, ফজলুল হক মন্টু , গোলাম সরোয়ার খান সাধন, সাহাবুদ্দিন চুপ্পু, আনিছুর রহমান কামাল প্রমুখের সঙ্গে জেলা স্কুলের মাঠে মুক্তিযুদ্ধের নিয়মিত প্রশিক্ষণ কর্মসূচী পরিচালনা করেন। তার ¯েœহময়ী মাতা হামিদা খাতুন ছুনু মহিলাদের নিয়ে ঐ সময়ে জেলা স্কুলের মাঠে নিয়মিত বৈঠক করতেন। উক্ত ইশতেহার মাহলাদের মাঝে বিতরণ করেন ও ‘বঙ্গবন্ধু’র ভাষন বাজিয়ে শুনান; সেই সাথে আসন্ন মুক্তিযুদ্ধে পাবনার মেয়েদের করণীয় সম্পর্কে নিদের্শনা দেন। তিনি তাঁর সন্তানতুল্য ছাত্র নেতৃবৃন্দের কাছে ‘খালাম্মা’ বলেই সম্বোধিত ও সম্মানীত ছিলেন। পাবনা ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে আক্রান্ত হলে হানাদার বাহিনী ২৬ তারিখের প্রত্যুষে প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য মোঃ আমিন উদ্দিন. ন্যাপ (পিকিংপন্থী) নেতা ডাঃ অমলেন্দু নারায়ন দাক্ষী ও বিশিষ্ট ব্যবসায়ী সাঈদ তালুকদারকে ধরে নিয়ে গিয়ে হত্যা করে। একই দিনে শালগরিয়ায় বুলবুল নামে ‘পাবনা ইসলামী মহাবিদ্যালয়ে’র ছাত্রকে গুলি করে হত্য। মুহম্মদ ইকবাল ও তার উক্ত সঙ্গীদের যৌথ নেতৃত্বে সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তুলেন। তাদের সাথে পাবনার ডেপুটি কমিশনার ও পুলিশ সুপারসহ সরকারী কর্মকর্তা কর্মচারীগণ একাত্মতা প্রকাশ করেন এবং অস্ত্রাগার খুলে দেন। টি এন্ড টি ভবনে শিবির স্থাপনকারী হানাদার বাহিনীর সদস্যদের ২৭ তারিখে ভোরে পরাস্থ করে পাবনা মুক্ত করা হয়। পরবর্তীকালে পাবনা শত্রু কবলিত হলে মুহম্দ ইকবাল ভারতে গমন করেন। তোফায়েল আহমেদসহ নেতৃবৃন্দের সাথে মিলিত হন। স্থির হয় তিনি দেরাদুনে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেবেন। এই সময় একজন প্রভাবশালী নেতা তার পরিজনদেরকে শত্রু কবলিত পাবনা থেকে ভারতে নিয়ে যাবার জন্য অনুরোধ করেন কিন্তু দেশের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকেই তিনি তখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বলে স্থির করেন এবং উক্ত প্রভাবশালীর অনুরোধ পালনে সবিনয়ে অপারগতা প্রকাশ করেন। এতে ঐ প্রভাবশালী নেতার বিরাগভাজন হন মুহম্মদ ইকবাল। এরজন্য পরবর্তীকালে বহুবার ঐ নেতার কারণে অনেক দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে। মুহম্মদ ইকবাল দেরাদুনে প্রশিক্ষণ শেষে তার বাহিনী নিয়ে দেশে প্রবেশ করেন। তাঁর নির্ভুল রণকৌশলের কাছে পরাজিত হয় হানাদার বাহিনী। সাতবাড়িয়া অঞ্চল শত্রুমুক্ত হয়। বিজয় অর্জনের পর সাতবাড়িয়াতে আনুষ্ঠানিকভাবে পতাকা উত্তোলন করার সময় তাঁর অনুরোধে স্থানীয় শিক্ষক হিরোজ মাস্টার স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করেন। একে একে সুজানগরসহ গোটা পাবনা মুক্ত হয়। ‘মুজিব বাহিনী’র প্রধান হিসেবে তিনি পাবনা জেলার প্রশাসনের দায়িত্ব গ্রহণ করেন । এই দায়িত্ব তিনি সফল ও সুনামের সাথে ১৯৭২ সালের এপ্রিল পর্যন্ত পালন করেন। শহরে শিবির স্থাপন করে হত্যা করে শহরতলী ময়লাগাড়িতে লাশ ফেলে রাখা, যুবতী মেয়ে ও তাদের অভিভাবকদের ভয় দেখিয়ে তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিবাহ করতে/ দিতে বাধ্য করা, গরিব ও ক্ষতিগ্রস্থদেও মাঝে ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ না করে তা আত্মসাৎ করা, ত্রাণের কম্বল আত্মসাৎ করে কোট বনিয়ে পরিধান করার ঘটনা অহরহ ঘটতে থাকলে তিনি তার প্রতিবাদ করেন এবং প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। ‘জাতীয় বিপ্লবী সরকার ’ গঠন না করে বঙ্গবন্ধু কর্তৃক দলীয় সরকার গঠন করা হলে তিনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশ গড়ার অঙ্গীকারে অটল থাকেন। ১৯৭২ সালের ৩১ শে অক্টোবর তারিখে ‘জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল’ গঠনে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভ’মিকা রাখেন। পাবনায় রবিউল ইসলাম রবি ও আহমেদ জামিলকে আহ্বায়ক এবং মখলেছুর রহমান মুকুল, খায়রুজ্জামান বাবু , অখিলর্ ঞ্জন বসাকসহ মুহম্মদ ইকবালকে সদস্য করে জাসদ পাবনা কমিটি গঠিত হয়। ১৯৭৩ সালে জাতীয় সংসদের প্রথম নির্বাচনে তিনি জাসদের প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্ধিতা করেন। আওয়ামী লীগ প্রার্থী বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুর রব বগা মিয়া আকস্মিক সড়ক দুর্ঘচনায় মৃত্যুবরণ করলে ৭ই মার্চ তারিখের নির্বাচন স্থগিত হয়। ৪ঠা এপ্রিল তারিখে নির্বাচন হয়। জনগণের মাঝে ব্যাপক সাড়া জাগায় মুহম্মদ ইকবালের প্রার্থীতা। কিন্তু প্রশাসনিক বিভিন্ন চাপ এবং অপকৌশলের কারণে নির্বাচনের ফলাফলে জনগণের আশা-আকাংখার প্রতিফলন ঘটে নাই। এরপর অত্যাচারের স্ট্রীম রোলারের মাত্রা বাড়িয়ে দেয় স্বৈর সরকার। ঢাকার গ্রীন রোডে তার পৈত্রিক বাসভবন ‘শিরিন ভিলা’ও এই সময়ে আন্দোলন ও সংগ্রামের অন্যতম কেন্দ্রে পরিণত হয়। সিরাজুল আলম খান, মেজর এম এ জলিল, আ স ম আবদুর রব, শাহজাহান সিরাজ, মুহম্মদ শাহজাহান, রুহুল আমিন ভ’ইয়া , কর্নেল আবু তাহের, মনিরুল ইসলাম( মার্শাল মনি) , এ বি এম শাহজাহান প্রমুখ নেতৃবৃন্দ আন্দোলন সংগ্রামের প্রয়োজনে এই বাড়িতে অনেকবার মিলিত হয়েছেন। অক্টোবর মাসে ভাড়ালায় তার উপর রক্ষী বাহিনী ও মুজিববাদী গুন্ডা বাহিনী হামলা চালায়। তিনি ও নুরুল ইসলাম জেলেদের সহযোগিতায় কোন রকমে বেঁচে গেলেও মাসুদ আলী খান বাবলু , আশরাফ আলী কানু ও ফারুক (কুটি) শাহাদাত বরণ করে। এরপর ঢাকার গ্রীন রোডের বাড়িতে আবার তার উপর হামলা হয়, তিনি গুলিবিদ্ধ অবস্থায় গ্রেফতার হন। তাকে ১৯৭৭ সালের এপ্রিল পর্যন্ত কারারুদ্ধ থাকতে হয়। এর মধ্যে প্রাগুক্ত প্রভাবশালী নেতার কালো হাত সক্রিয় ছিল বলে প্রকাশ। এরই মধ্যে একদলীয় ‘বাকশাল’ শাসনের অবসান হয়েছে। সারাদেশে প্রায় ৬৭ (সাতষট্টি) হাজার মুক্তিযোদ্ধা খুন করার দায়ে অভিযুক্ত ‘রক্ষী বাহিনী’কে ‘ক্লোজ’ করা হয়েছে। স্থগিত রাখা সংবিধান কিভাবে পূণর্বহাল বা চালু করা হবে এ নিয়ে সারা দেশে চলছে আলাপ-আলোচনা। এরূপ পরিস্থিতিতে ‘পৌরসভা’ নির্বাচন ঘোষণা করা হলো। দলীয়ভাবে না হলেও দলীয় প্রভাব এড়ানো যায়নি। দলীয় কর্মকান্ড নিষিদ্ধ ছিল। এ অবস্থায় পাবনার ‘জাসদ’ নেতাকর্মীদের মাঝে আস্থা অর্জনকারী বীরেশ মৈত্র পাবনা পৌরসভার চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী হলেন। ‘জাসদ’এর এইসব নেতাকর্মীদের সকলেই ‘বিপ্লবী গণ-বাহিনী’ ও ‘জেলা সাংগঠনিক কমিটি’ (ডি ও সি) এর কর্মতৎপরতার সাথে যুক্ত ছিল। সাংগাঠনিক সিদ্ধান্ত না হলেও মানসিক থেকে ইঁনাদের প্রতি সহানুভ’তিশীল ছিল। আমি তখন রসায়ন শাস্ত্রে সম্মান পরীক্ষা দিয়ে পাবনা এসেছি। ‘জাসদ’ এর নেতাকর্মীগণ প্রশ্ন পৌরসভা নির্বাচনে ‘জাসদ’এর ভ’মিকা কি হবে। ‘জাসদ’ , ‘সিওসি’ ও ‘বিপ্লবী গণ-বাহিনী’র কর্মকান্ড পরিচালনা ও বাস্তবায়নের জন্য যাদের সাথে মৃত্যু-ঝুকিঁ মাথায় নিয়ে কাজ করেছি তারা আমাকে আহ্বান জানালো বীরেশ মৈত্রের পক্ষে কাজ করার জন্য। কিন্তু দলীয় সিদ্ধান্তের অভাবে এরূপ কাজে অনেক প্রশ্ন উঠবে, দ্বিধা-দ্বন্ধের উদ্ভব হবে। ইকবাল ভাই সদ্য কারামুক্ত, তাঁর স্বাস্থের অনেক ক্ষতি হয়েছে। তাঁর পক্ষে এই নির্বাচনে আত্মনিয়োগ করা কষ্টকর। তিনি পাবনায় আসলে তার সাথে আমি একান্তভাবে মিলিত হলাম। তিনি বীরেশ মৈত্রের পক্ষে আমাকে সর্বাত্মকভাবে কাজ করার অনুরোধ করলেন। জানতে চাইলাম কেন । তিনি বললেন আমরা এতোদিন যত কর্মকান্ড চালিয়েছি , তার দ্বারা জনগণের কাছে কতটুকু পৌছেছি তা যাচাই ও পরিমাপ করা দরকার। বীরেশ মৈত্র একজন স্কুল শিক্ষক, সৎ ব্যক্তি। তিনি ছিপছিপে দেহের অধিকারী। কাউকে জাঁকজমক সহকারে আপ্যায়ন করার আর্থিক সঙ্গতি নাই। তিনি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ভুক্ত। এরূপ একজন মানুষকে সামনে নিয়ে আমরা জনগণের কাছে ভোট চাইবো। আমরা নিজেদের এতোদিনের কর্মকান্ড দিয়ে জনগণের আস্থা অর্জন করে থাকলে অবশ্যই তিনি জিতবেন। না জিতলে আমরা নিজেদের কাজের মূল্যায়ন করে ভুল শুধরে নিতে পারবো। আমি ইকবাল ভাইয়ের সাথে একমত হলাম। সাংগাঠনিকভাবে বীরেশ মৈত্রের পক্ষে ‘জাসদ’এর সর্বস্তরের নেতা কমীগণ আত্মনিয়োগ করলো বীরেশ মৈত্রের পক্ষে । তাঁর নির্বাচনী প্রতীক ছিল ‘রেডিও’। নির্বাচনী ‘লিফলেট’টা আমি লিখে দিলাম। মুকুল ভাই ( মখলেছুর রহমান) নির্বাচনী কৌশল ও তা পরিচালনার দায়িত্ব পালন করলেন। মাহবুবুল কবীর তারেক, রাজ্জাকুল ইসলাম আজাদ, আবুল কাশেম উজ্জ্বল, সোলেমান, বিদ্যুৎ, রশিদ, মোজাম্মেল হক কবীর, ফিরোজ খান রঞ্জু, ফেরদৌস খান গেদামনি, সাইদুল ইসলাম খান মুন্নু, আল-মাহমুদ নিটু , মোনেম, নান্নু, তীতু , সুমন , রহিম , রিংকু প্রমুখ এই নির্বাচনে অক্লান্ত পরিশ্রম করেন। নানাবিধ অপ-প্রচার সত্ত্বেও বীরেশ মৈত্র বিজয়ী হন। ‘জাসদ’ জনগণের হৃদয়ে স্থান পেয়েছে এটা এখানে প্রমাণিত হলো।

প্রকাশ্য রাজনীতি নিষিদ্ধ থাকায় ইকবাল ভাই সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের মাধ্যমে ‘জাসদ’এর রাজনৈতিক বক্তব্য প্রচারের কৌশল গ্রহণ করেন। তিনি গঠন করলেন ‘অরণি সাংস্কৃতিক শিবির’ । আহ্বায়কের দায়িত্ব দিলেন আমাকে। পাবনা সরকারী এডওয়ার্ড মহাবিদ্যালয় ছাত্র-সংসদের ‘সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সম্পাদক’ পদে ইতিপূর্বে দায়িত্ব পালন করায় এই ক্ষেত্রে আমার পরিচিতি ছিল। সমমনা শিল্পীদের নিয়ে প্রতিদিন আমরা ‘রিহার্সেল’ দেওয়া শুরু করলাম। আমাদের বিষয় ছিল ‘গণ-সঙ্গীত’। প্রলয় চাকী, মলয় চাকী, আহসান জান চৌধুরী, উত্তম কুমার দাস , শ্যামল কুমার দাস প্রমুখ এই সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে অগ্রণী ভ’মিকা রাখে। প্রস্তুতি শেষে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হলো। কোন মিলনায়ন বা উন্মুক্ত মাঠে নয়। চলমান মঞ্চ তৈরী করে আয়োজন করা হলো এই অনুষ্ঠানের। বড় ট্রাকে সমস্ত সাজ-সরঞ্জাম নেয়া হলো, শিল্পী ও নেতা কর্মী সংগঠকগণ উঠলেন। ইন্দারা পট্টি, টাউর হলের সামনে, লাইব্রেরী বাজার, পোষ্ট-অফিসের মোড়, মুজাহিদ ক্লাবের মোড়সহ শহরের বিভিন্ন স্থানে ট্রাক থামানো হলো । সংক্ষিপ্ত বক্তৃতা দিলাম। তারপর শুরু হলো গণ-সঙ্গীত পরিবেশন। শিল্পীদের সাথে ইকবাল ভাইও কন্ঠ মেলালেন। ‘জগতের লাঞ্ছিত ভাগ্যহত জাগো, জাগো অনশন বন্দি ওঠ রে যত ....’, ‘নভেম্বরের ডাক শোন হাতে নাও রক্ত নিশান.... ’ , ‘ ফুল খেলবার দিন নয় অদ্য, ধ্বংসের মুখোমুখি, মুখোমুখি আমরা...’, ‘ আমরা করবো জয়, আমরা করবো জয় নিশ্চয় একদিন....’ । এভাবে সারা শহরে চলমান মঞ্চে গণ-সঙ্গীত পরিবেশনের মাধ্যমে জনগণের মধ্যে ব্যাপক সাড়া জাগে। তরুন-তরুনীরাও উদ্বুদ্ধ হয়। সংগঠনের ব্যাপক বিস্তৃতি ঘটে। বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রে উদ্দীপ্ত বাংলাদেশ ছাত্রলীগ পাবনায় ১৯৭২ সাল থেকেই অত্যন্ত শক্তিশালী সংগঠন ছিল । ‘বাকশালী’ নির্যাতনে তাদের প্রকাশ্য কার্যক্রম সীমিত হয়ে পড়েছিল। এই কার্যক্রমের ফলে ছাত্রলীগের প্রকাশ্য কার্যক্রম আরো বেগবান হয়।

১৯৮৮ সালে তিনি জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন। পাবনায় চিকিৎসা মহাবিদ্যালয় স্থাপন সহ উন্নয়ন কার্যক্রমে অনেক কর্মসূচী গ্রহণ করেন। এরপরবর্তীতে তার স্ত্রী, পিতা ও মাতার মৃত্যু ও ভাতিজা আসিফ রানার অকাল মৃত্যুতে অত্যান্ত শোকাহত হন। তিনি নিজেও অসুস্থ হয়ে পড়েন। ২০০৫ সালের ১৮ই জানুয়ারী তারিখে তিনি চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইন্তেকাল করেন। শ্রমজীবী কর্মজীবী পেশাজীবী জনগণের মুক্তির লক্ষ্যে তিনি সব কিছু বিসর্জন দিয়ে কাজ করে গেছেন। তার স্বজন ও সহযোদ্ধারাই তার আরব্ধ কাজ সম্পন্ন করার লক্ষ্যে এগিয়ে চলেছেন।

পাবনার গোপালপুরে এবং ঢাকার গ্রীন রোড়ে ইকবাল ভাইয়ের পৈত্রিক বাড়ি দুটোই ছিল ‘জাসদ’ ও ‘ছাত্রলীগে’র নেতা কর্মী সমর্থকদের পারস্পরিক যোগাযোগের অঘোষিত কেন্দ্রস্থল। তাই এই দুটি বাড়ির প্রতি তাদের সকলেরই রয়েছে অকৃত্রিম মমত্ববোধ। সেই সাথে ইকবাল ভাইয়ের পিতা ডাঃ মুহম্মদ ইসাহাক ও মাতা বেগম হামিদা বেগম শুনু এর প্রতি রয়েছে অফুরন্ত শ্রদ্ধাবোধ। এসব স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে সকলেই আবেগ প্রবণ হয়ে যান। ডঃ আহসান আলি এ প্রসঙ্গে বলেন ছাত্রজীবনে অবসর সময়টুকু তিনি ইকবাল ভাইদের বাড়িতেই কাটাতেন। খালাম্মা ও খালুজানের ¯েœহ আদর আপ্যায়ন ছিল আন্তরিকতাপূর্ণ। ডঃ আহসান ‘জাসদ’ নেতাকর্মীদের কাছে ‘সাগরদা’ নামে পরিচিত। তাঁর বাড়ি চাঁপাই নবাবগঞ্জ। আম ছাড়াও এই জেলা ‘কালাই রুটি’র জন্য বিখ্যাত। ইকবাল ভাইকে এই রুটি খাবার জন্য সাগরদা দাওয়াত দেন। ‘কালাই রুটি’ অত্যন্ত তৃপ্তি সহকারে খেয়ে সাগরদাকে বললেন আবার রুটি খাবার জন্য আসবেন। এরপর কিন্তু ইকবাল ভাই আর সাগরদার বাসায় যেতে পারেন নাই। আর কখনো যাবেনা ‘কালাই রুটি’ খেতে। প্রসঙ্গ উঠলেই অনেক আপসোস করে এই স্মৃতিচারণ করেন। ইকবাল ভাই অগণিত মানুষের হৃদয়ে আসন গেড়ে নিয়েছিলেন। এটা তার একটি উদাহরণ।

তাঁর প্রয়াণের একাদশ বৎসর অতিক্রান্ত হতে যাচ্ছে। তার স্মৃতি জাগরুক আছে শ্রমজীবী কর্মজীবী পেশাজীবী জনতার মাঝে। তাঁর বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করি।

লেখকঃ সাবেক জেলা ও দায়রা জজ । বর্তমানে সদস্য বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট আইনজীবী সমিতি এবং বে-সরকারী সংস্থার কর্মকর্তা।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.