নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ভাবতে ভালবাসি, সেই ভাবনা যদি কোনো ঘটনায় মিলে যায় তবে তাকে লিখতে ভালবাসি! সেই লেখায় যদি কেউ বিন্দুমাত্র উপকৃত হয় তবে তাতেই আমার খুশি, আমি লেখাকে ভালবাসি।

দর্পণের প্রতিবিম্ব

প্রেমিকার চিরশত্রু

দর্পণের প্রতিবিম্ব › বিস্তারিত পোস্টঃ

পরস্পর | পঞ্চম পর্ব - তৃষ্ণার্ত সময়

১৯ শে নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:০০




"যা আমার করার কথা ছিল, সেটা আমি করতে পারি নি। কারণ যা হবার কথা ছিল সেটা হয় নি। পৃথিবীর কোথাও যদি প্রজাপতি তার ডানা ঝাপটায় তবে অন্য কোথাও ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হতে পারে যাকে আমরা বাটারফ্লাই ইফেক্ট নামে জানি! আমরা প্রজাপতি হয়ে যে যার মত ডানা ঝাপটে যাচ্ছি, জানি না কোথায় তুফান জমা হচ্ছে আর কখনই বা আসবে! অথবা আদৌও আসবে কিনা! ভয় জমা হচ্ছে আমার মনে, আমার বাহুতে যিনি মাথা রেখে ঘুমাচ্ছে তার মনে, আমাদের সবার মনে! ভয় আমাদের সাহস জোগায়, জোগায় সচেতনতা! সেই সাথে ভয় আত্মবিশ্বাসকে জাগতে দেয় না। আমার পাশে আনিকা এবং শহরের অপর প্রান্তে থাকা তানজিল, ভয়ের মাঝে জীবন চলছে তাদের, আমাদের সকলের।"


ঘড়ির কাটায় রাত ৭.৪৭ মিনিট,
নাস্তা নিয়ে বাসায় এল রাজীন। তানজিল বলল, "ফ্রেশ হয়ে নেন, চা অলমোস্ট রেডি।"
বারান্দায় নীরবে বসে আছে দুজন। তানজিল একটু কাশি দিয়ে বলল, "আব্বু আম্মুর কোনো খোঁজ পেলেন?"
উত্তরে রাজীন বলল, "সেটা তো সেদিনই পেয়েছি কিন্তু আমার সোর্স কোনো তথ্য দিতে পারি নি।" সে হালকা স্বরে বলল, "কত বছর হয়ে গেল আম্মু আব্বুর কথা শুনি না! চেহারা দেখি না! খুব ইচ্ছা করছে তাদের কাছে যাওয়ার।"
রাজীন বলল, "আমার সোর্স যদি কোনো বার্তা নিয়েও আসে তবুও আপনার যাওয়া মুশকিল! কারণ আপনার নামে জিডি করা আছে যা এতদিনে মামলায় পরিণত হয়েছে!"
"তো আব্বুকে কোনোভাবে খবর দিন যেন জিডি প্রত্যাহার করে নেয়!” রাজীন একটু হেসে বললো, "ধরে নিন উনি গেলেন প্রত্যাহার করার জন্য, তো কারণ কি দেখাবেন?"
রাজীন আবারও বললো, "তানজিল, আমি আপনার আত্মমর্যাদার কথা খুবই চিন্তা করি। আমরা এই বাসায় থাকতে পারছি কারণ আমরা বলেছি আমরা বিবাহিত। ধরে নেন, কেউ জেনে গেল আমরা বিবাহিত নই, ভাবতে পারেন কি হবে আমাদের সাথে? ৯০% মানুষ গোটা পুলিশকে তাদের সবচেয়ে বড় দুশমনের নজরে দেখে! তাদের এই রাগ-ক্ষোভ আমাদের উপর দিয়ে বয়ে যাবে! আমি আপনাকে সেফ রাখতেই এতসব রিস্ক নিয়ে যাচ্ছি। আপনার ছোট্ট একটু ভুল কিংবা অস্থিরতা, আপনাকে এবং আমাকেও ডুবিয়ে দিবে! তাই একটু ধৈর্য্য আপনার কাছে আমি প্রত্যাশী। খারাপ সময় মানুষকে শক্তিশালী করে তোলে। আমি চাই আপনি আরও শক্তিশালী হোন৷ নিখোঁজ হওয়া কেস কখনও প্রত্যাহার হয় না। আদালতের কাছে বারবার সময় চায় পুলিশ! দুটো রাস্তা, সত্য বলা এবং মান ইজ্জতের পরওয়া না করা আর দ্বিতীয়টা ধামাচাপা বা আষাঢ়ে গল্প শুনিয়ে কেস ক্লোজ করে দেয়া৷ আপনি যেটা চান সেই মোতাবেক আমি আগাবো৷"
তানজিল কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না। তবুও বলল, "যদি বলি যা হয়েছে সেটা আমি বলতে চাই না এবং মামলা প্রত্যাহার করতে চাই?"
"আপনাকে কারণ বলতেই হবে।"
তানজিল চোখ মুছে নিয়ে বলল, "ঠিক আছে ভেবে দেখি।"


ওসি জামশেদ চোখ বন্ধ করে গুনগুনিয়ে গান গাচ্ছেন। পরবর্তী প্রমোশনের পথে আর কোনো বাধা নেই তার। বারীর সিন্ডিকেট পুরোটাই ভেঙে তছনছ হয়ে গেছে। এসব ভেবেই মুচকি হাসি দিয়ে যাচ্ছেন তিনি৷ এমন সময় হাবিব এসে দরজায় নক দিলেন, "স্যার আসবো?"
"আ.. ও হ্যা কি? কি দরকার?" স্বপ্নে একরকম হারিয়ে গিয়েছিলেন তিনি! "স্যার, উনাকে এনেছি!"
"কাকে এনেছো?" বিস্মিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন।
"মানে স্যার আরাফাত, আপনি বলেছিলেন না?" হাবিব মনে করিয়ে দিল। "ওহ হ্যা! নিয়ে এসো।"
আরাফাতকে সামনে বসালেন, জিজ্ঞেস করলেন, "আপনাদের বলেছিলাম এলাকা ত্যাগ না করতে তারপরও আপনারা অন্যত্র কেন গেলেন?"
আরাফের মুখটা মলিন হয়ে গেল এবং বললো, "আমি ভেবেছিলাম আমার মেয়েটার কোনো খবর পেয়েছেন! আপনি কোনো খবর পান নি তাই না?"
"প্রশ্নটা আমি আপনাকে করেছি, উত্তর দিন। উলটা প্রশ্ন কেন করছেন?" শাসিয়ে জিজ্ঞেস করলেন জামশেদ! আরাফ বললেন, "কি উত্তর দিবো? আড়াই বছর হল তার কোনো খবর নেই! ওদিকে ওর মা ভেবে বসে আছে হয়তো মেয়েটাকে সাথে নিয়ে যাবো আমি!"
"আহ্র........ তারে ধরে নিয়ে আসাটাই ভুল হয়েছে। এরে ধরে জেলে ভরে দাও।" রেগে গেলেন জামশেদ। আরাফ বললেন, "এরপর কি মুক্ত হবো আমরা?"
জামশেদের ধৈর্য্যের বাধ ভেঙে গেল! আরাফের কলার ধরে বসা থেকে টেনে নিয়ে হাটা দিলেন জামশেদ! শুন্য একটা কারাগারে তাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলেন জামশেদ! থানার সকলেই অবাক হয়ে দেখতে থাকলো ঘটনাটা! এলাহি এতক্ষণ বাহিরে ছিল। সেলের সামনে এসে জামশেদকে বলল, "স্যার, স্যার! কি হয়েছে? ঠাণ্ডা হোন প্লিজ!" এলাহি সেলের ভিতরে তাকাতেই চিনে গেল আরাফকে! জামশেদ রেগে আগুন হয়ে আছেন! বললেন, "এলাহি, ইচ্ছামত পিটা এরে! নিজেই নিজের মেয়েরে গায়েব করে এখন নাটক করতেছে! উলটা করে ঝুলায় দে আর মার শুরু কর!"
জামশেদের অনুসারী জহির এসে বলল, "স্যার আমি, তারেক আর তুহিন যাই? কি বাইর করতে হবে শুধু সেটা বলেন।" "কথা বাইর কর, ওর মেয়ে কই আছে তার উত্তর বাইর কর।"
"জ্বি স্যার! তুহিন, তারেক! আয় এদিকে।" জামশেদ চলে গেলেন। এলাহি পিছু পিছু এসে বলল, "স্যার এভাবে মারলে যদি সে মারা যায় তবে সবাই বিপদে পরে যাবো স্যার! বুঝার চেষ্টা করেন স্যার!"
জামশেদ কোনো কথা শুনলেন না এবং বললেন ও না!একটুপর চিৎকার শোনা গেল! এলাহি আবারও নিজেকে অদৃশ্য শেকলে বাধা এক অসহায় মানুষ ভেবে চলে গেল সিকিউরিটি রুমে! যাওয়ার সময় শুনতে পেল জামশেদ বলছেন, "মুখে কাপড় পেঁচিয়ে দে তারেক!"


"তো এসব হচ্ছে? আজ কয়দিন হল বন্দী আছেন তিনি?" রাজীন জিজ্ঞেস করলো৷ "দুই দিন!"
"এটা তানজিলকে কোনো ভাবেই জানানো যাবে না। আনিকাকে বলেছিস?" এলাহি উত্তরে বলল, "পাগল নাকি আমি? দেখ ভাই, আমি কপাল জোরে আনিকাকে পাইছি, কোনো অবস্থাতেই তাকে আমি হারাতে পারবো না। তানজিলকে যত তাড়াতাড়ি পারিস ওর বাড়ি রেখে আয়!"
"হুম... তাহলে বল জামশেদ স্যারকে, তার বাবাকে ছেড়ে দিতে?" "দেখ এটা মজা করার সময় নয়.."
রাজীন বলল, "মজা করছি না, এখন যদি দিয়ে আসি তাহলে তোমার স্যার হয়তো পুরো গুষ্টি ধরেই মামলা দিয়ে দিবেন! বলা যায় না, ভরসা নাই। শোন, আমি আমার তরফ থেকে চেষ্টা করেই যাচ্ছি!"
এলাহি বলল, "তাহলে আরেকটা কাজ কর, বিয়ে করে নে তানজিলকে...!"
"হ্যালো! কি বললি? মাথা খারাপ....!" কল কেটে দিয়েছে এলাহি৷
বাসায় পৌছে বরাবরের মতই চা নিয়ে সামনাসামনি বসে আছে রাজীন এবং তানজিল। রাজীন প্রস্তাব রাখলো, "চলেন কাল আশেপাশের থেকে কোথাও ঘুরে আসি?" তানজিল কিছু না বলে চায়ে চুমুক দিয়ে যাচ্ছে। রাজীন বলল, "তানজিল আমি বুঝতে পারছি আপনার মনের অবস্থা, কিন্তু...." রাজীন দেখলো অন্যান্য দিনের চেয়ে তানজিল আজ মলিন হয়ে আছে! রাজীন জিজ্ঞেস করল, "আপনি ঠিক আছেন তানজিল? অসুখ মনে হচ্ছে! মাথা ব্যাথা?"
"হুম না মানে, কিছু না। ঠিক আছি।" রাজীন এর বিশ্বাস হচ্ছে না। সে বলল, "নাহ আপনার মুখ বলছে আপনি অসুস্থ৷ কিছু মনে করবেন না..." এই বলেই প্রথমে কপালে হাত রাখলো! বেশ গরম! তারপর আবার কবজি ধরে দেখলো! একই, বেশি গরম! "এত জ্বর আর আপনি একবারও জানান নি আমাকে!" রাজীন উঠে থার্মোমিটার খুঁজতে শুরু করলো৷ অনেক খোজাখুজির পেল সে৷ তানজিলকে বললো, "আসেন, বিছানায় শুয়ে পরেন এবং রেস্ট করেন। আপাতত আপনার জ্বর মেপে নিই!"
তানজিল বলল, "না না! আমি নিজের খেয়াল নিজেই রাখতে পারবো৷" থার্মোমিটার তার জিহবার নিচে রেখে রাজীন বলল, "জ্বি অবশ্যই! আমি সেটার নমুনা দেখে ফেলেছি৷"
কিছুক্ষণপর জ্বর মেপে দেখলো ১০৩ এ থেমেছে! এত জ্বর দেখে রাজীন দেরি না করে ফার্মেসীতে যাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে গেল। বের হওয়ার সময় বলল, "আরাম করেন, দরজা বাহির থেকে লাগিয়ে দিব নে।"


"স্যার আসবো?" তুহিন অনুমতি চাইলো। "হুম, কি দরকার?"
তুহিন বলল, "স্যার ওই যে গতকালের লোকটা, তাকে যদি আজও মারি তবে মরেই যাবে স্যার! আর মার খেয়ে শরীরে জ্বর বাধিয়ে নিয়েছে!"
জামশেদ রাগে কলম রেখে বলল, "কোথাও শান্তি নেই! ঘরে বউয়ের ঘ্যানঘ্যানানি আর থানায় আসলে এটা সমস্যা ওটা সমস্যা..... আ..........!"
তিনি জিজ্ঞেস করলেন, "কেমন জ্বর? মাপছো?"
"নাহ স্যার, থার্মোমিটার নেই!" কথাটা শুনেই রক্তগরম চোখে তাকালো তুহিনের দিকে তাকালেন জামশেদ! তুহিন ভয়ে বলল, "সমস্যা নেই স্যার আমি যাচ্ছি ডিসপেনসারিতে!" জামশেদ ধমক দিয়ে বলল, "থামো..."
আবারও বললেন, "আচ্ছা যাও, সাথে নাপা বা এইচ প্লাস যা পাও নিয়ে এসো, বিলসহ... আর কাল সন্ধ্যার পর তাকে ছেড়ে দিও।"
"জ্বি স্যার, পৌছে দিয়ে আসবো?" তুহিনের সরল জিজ্ঞাসা! জামশেদ রেগে বললেন, "না না! বাসায় গিয়ে ঘুম পারিয়ে দিয়ে আসিস... যা চোখের সামনে থেকে... গাধা পালছি এই থানায় একেকটা!"

জ্বর কমে যাওয়ার নাম গন্ধই নেই! তানজিলের পাশেই বসা আছেন রাজীন। থেমে থেমে কাশি উঠছে তানজিলের। রাজীন জিজ্ঞেস করলো, "অনেক টেনশন করছেন?"
সে কাশতে কাশতে উত্তর দিল, "না, এমনিই হয়তো!"
"আমার বাবারও এমন জ্বর হয়েছিল একবার, জ্বরের কারণে আবল-তাবল কথা বথাবার্তা বলছিল। কিছু জিজ্ঞেস করলেই বলতো কিছু না, কোনো কিছু হয় নি আমার! একদমই ঠিক আছি! বুঝতে দিত না কি নিয়ে চিন্তা বা দুশ্চিন্তায় ছিলেন সে! কিন্তু সেসব চিন্তাভাবনা জ্বর বলে দিত! আপনিও তাই করছেন আমার সাথে!"
তানজিল কোনো কথা বলল না৷ চোখ বন্ধ করে শুয়ে রইলো৷ রাজীন আবারও জিজ্ঞেস করলো, "কিছু খেয়ে নেন? ভাল লাগবে।" আবারও কাশতে কাশতে জানালো, "স্বাদ পাচ্ছি না, খেলেই বমি হবে। তারচেয়ে এমনই থাকি৷"
রাজীন একদমই জোরাজুরি করলো না খাবারের বিষয়ে। দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে জিজ্ঞেস করলো, "যেদিন আপনি আপনার মা বাবার সাথে দেখা করবেন, কেমন লাগবে? যে বাড়িতে এত যুগ মিলেমিশে ছিলেন সেখানে তারা নেই!"
"কেমন লাগবে? আমার জানা নেই! সবকিছু ঠিক মত যদি চলতো, যদি আমার নসিব ওখানে না থাকতো তাহলে আজ আমি ৩য় বর্ষের আইবিএর ছাত্রী হতাম। জীবন আরও সুন্দর হতো!" আবারও কাশি শুরু হল তানজিলের। রাজীন জিজ্ঞেস করলো, "সুন্দর জীবন কি এখন নেই?" তানজিল মলিন মুখেও হেসে দিল! "আপনি না খুব বাস্তববাদী মানুষ? ইমোশনাল হচ্ছেন কেন?"
অন্যদিকে তাকিয়ে উত্তর করলো রাজীন, "ইমোশনাল ছিলাম না, প্র‍্যাক্টিকাল এর ভুল মতবাদের উপর জীবন চলছিল পূর্বের থানা পর্যন্ত। আমাকে একাকীত্বের গভীরে ঠেলে দিয়েছে! আমার দোয়ার ঝুলির মধ্যে হয়তো তিনি একটা দোয়া খুব জলদি কবুল করেছেন, সেটা একাকীত্ব!"
একটু থেমে আবার জিজ্ঞেস করলো, "তানজিল একটা প্রশ্ন করতে পারি?" কিন্তু কোনো জবাব পেল না! রাজীন তাকিয়ে দেখে সে ঘুমিয়ে পরেছে! রাজীন উঠল না সেখান থেকে। চুপচাপ বসে রইলো। ঘড়িতে তাকিয়ে দেখে রাত ১টা বাজে! রাজীন মনে মনে বলল, "ঘুম এসেছে ঠিকই কিন্তু ঘুম স্থানী হবে না। ঘন্টা দুই পর জেগে উঠবেন।" রাজীন বসেই রইল সেখানে। তানজিলের ক্লান্ত চেহারার দিকে তাকিয়ে আছে সে। এভাবেই তাকিয়ে থাকতে থাকতে কখন তার চোখ ঘুমে ঢলে পরেছে নিজেও জানে নি!
ফরজের আযানে ঘুম ভেঙে যায় তানজিলের। মনে মনে বলছে, "আর কতদিন তার এখানে এভাবে থাকতে হবে.. উনার এই উপকার কি দিয়ে শোধ করবো? আর উনিই বা এত উপকার কি জন্য করছে?" এসব ভেবে পাশে তাকিয়ে দেখে রাজীন বসে বসেই ঘুমিয়ে আছে! দিন রাতের সমস্ত ক্লান্তি যেন রাজীনের চেহারায় ফুটে উঠেছে! দেখতে দেখতে আকাশ আলোকিত হওয়া শুরু হল। তানজিল এখনও বেশ অসুস্থ! একটু উঠতে চেষ্টা করলো এবং তাতে পাশে থাকা গ্লাস মেঝেতে পরে গেল। স্টিলের গ্লাস, মেঝেতে আওয়াজ করেই যাচ্ছে কিন্তু তানজিল সে পর্যন্ত পৌছাতে পারছে না! রাজীনের ঘুম ভেঙে গেল শব্দে! ঘাড় বেশ ব্যাথা হয়েছে তার। ঝাপসা চোখ প্রথমে বুঝতে পারে নি কি হচ্ছে। কয়েক সেকেন্ডে যখন সব পরিষ্কার হয়ে এল, রাজীন তানজিলের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো, "তানজিল, কি হয়েছে? দেখি কপালটা..." হাত রেখে খেয়াল করলো আরও গরম হয়ে আছে শরীর! তানজিল বলল, "আমি বাথরুমে যাওয়ার জন্য...."
"আসেন আমি পৌছে দিচ্ছি, ভরসা করেন" রাজীন তাকে ধরে ধীরে ধীরে দরজার সামনে নিয়ে এল৷ রাজীন বলল, "একটু অপেক্ষা করেন আমি পানি রেডি করে দিচ্ছি!" তানজিল যতক্ষণ ভিতরে ততক্ষণে রাজীন থার্মোমিটার থেকে জ্বর নামিয়ে নিল। বিছানায় শুইয়ে দিয়ে আরও একবার জ্বর মেপে দেখে ১০৪! রাজীন মনে মনে বলল, "মাথায় পানি ঢালতে হবে কিন্তু ফ্লোরিং বিছানায় কিভাবে কি করবো বুঝতে পারছি না।"
নিজের বালিশ গুলো দিয়ে কোনোরকমভাবে মাথাটা যেন উপরে থাকে সেই ব্যবস্থা করে নিল রাজীন। আস্তে আস্তে শুরু করলো পানি ঢালা। অবস্থান যেমন থাকা দরকার তেমন না হওয়ায় পানি কানে এবং তার আশপাশে দিয়ে গলা এবং ঘাড়ে চলে যাচ্ছে! তারপরও যতটুকু সম্ভব করে যাচ্ছে রাজীন। তানজিল প্রলাপ বকা শুরু করেছে! প্রতিটা কথাই অস্পষ্ট তার! রাজীন প্রচণ্ড রকম ঘাবড়ে যাচ্ছে! মাঝে মধ্যেই জিজ্ঞেস করছে, "তানজিল আপনি জেগে আছেন?" কিংবা "আরাম লাগছে নাকি ঠাণ্ডা নাকি গরম লাগছে?"
কিন্তু কোনো প্রশ্নের উত্তর সে স্পষ্ট দিচ্ছে না! এভাবে ১০-১৫ মিনিট যথাক্রমে পানি ঢালতে লাগলো সে। রাজীন খেয়াল করে দেখলো পানি কান এবং গলায় আর যাচ্ছে না! শিখে ফেলেছে কিভাবে ভাল করে পানি ঢালতে হয়। কিছুক্ষণপর পানি ঢালা থামালো সে। বালতি মগ দূরে রেখে গামছা এনে তানজিলের চুল মুছে দিতে লাগলো। ছোট ফ্যানটা এমনভাবে সেট করলো যেন শুধু চুলেই বাতাস লাগে! রাজীন ক্লান্ত হয়ে আর জেগে থাকতে পারছে না৷ সর্বশেষ জ্বর মেপে দেখল ১০০ তে নেমেছে। একটু স্বস্তি নিয়ে ছোট ফ্যান বরাবর মাথা রেখে বালিশ ছাড়াই ঘুমিয়ে পরলো সে! ফ্যানের শব্দ কিংবা সূর্যের হালক আলো কোনো কিছুই দুজনের ঘুমকে ভাঙাতে পারছে না৷


শাল মুড়ে বাইরে চেয়ারে বসে আছেন আরাফ। বৃষ্টির দিনের ঠাণ্ডা আবহাওয়া আরাফের শরীর কাপিয়ে দিচ্ছে। হাজতের দুইদিনের অত্যাচারে জ্বরসহ শরীরে প্রচন্ড ব্যাথা জন্ম দিয়েছে। তানজিলের মা খবর পেয়েই বাড়িতে এসেছেন। তিনি বললেন, "তাহলে উনারাই তোমাকে সন্দেহ করলো তানজিলের নিখোঁজে?"
আরাফ কেঁদে বললেন, "আমার আর কারও কাছে কিছু চাওয়ার নেই। চল একটা ঠেলাগাড়ি করে হলেও এইখান থেকে চলে যাই৷"
"থানায় কি একজনও ভাল মানুষ নেই? কিংবা তোমার পরিচিত?" আরাফ উত্তরে বললেন, "ভাল মানুষ? ওখানের কনস্টেবল আমাকে বলে ওসি জামশেদের সাথে পয়সা দিয়ে মিটমাট করে নিতে! সে যদি এমন হয় তাহলে জামশেদ কেমন ভেবেছো? আগের ইন্সপেক্টর কামাল, সেও খারাপ ছিল কিন্তু জামশেদের মত লম্পট ছিল না।"
আরাফের শরীর কাপতে শুরু করে যখন থানার কথা পরে! আত্মীয়স্বজন এবং প্রতিবেশীদের কানাঘুঁষায় এর দুদিন পর, আরাফ চলে যান তাদের ভাড়া বাসায়।


এক সপ্তাহ পর,
"আমাদের খালি হাতেই রওনা দিতে হবে তানজিল! ব্যাগপত্র নিয়ে গেলে কেউ ই বিশ্বাস করবে না আপনি পালিয়ে এসেছেন।" তানজিল মেনে নিল। এক কাপড়েই রওনা হল বাসা থেকে। নিচে নেমে রাজীনের চোখ পরলো টু-লেট এর বোর্ডটায়, তুলে নিয়ে গেটের সামনে টাঙিয়ে দিল৷ কেয়ারটেকার দেখে জিজ্ঞেস করলেন, "স্যার কি বাসা ছেড়ে দিচ্ছেন নাকি?"
রাজীন উত্তরে বললো, "নাহ রে ভাই! এই যে আপনার ভাবি, উনাকে বাসায় রেখে আসবো, তাই এত বড় বাসায় আমি একা! পুরা বাসা ভাড়া নেয়া আমার সহ্য হবে না।" বলেই হাসতে লাগলো রাজীন আর কেয়ারটেকার! তিনি সালাম দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, "ভাবি এতদিন থাকলেন অথচ দেখলাম না আর একবার এই গরিবকেও কোনো কাজে মনে করলেন যে!" তানজিল কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না! রাজীনের দিকে তাকালো কিন্তু কোনো ইশারা পেল না! বলল, "আসলে ভাই, আমি তার সাথে ঘুরতেই পছন্দ করি আর বাইরে বের হতে ভাল লাগে না...!" "আ... ঠিক আছে রওনা দিই তাহলে আর আপনি ভাড়াটিয়া/ব্যাচেলর খুঁজতে থাকেন৷ আসি!" কেয়ারটেকারও সালাম জানিয়ে তাদের বিদায় জানালো।
হাটতে হাটতে তানজিল বলল, "আপনি ভালই মিথ্যা বানিয়ে বলতে পারেন!"
তার দিকে তাকিয়ে হালকা হাসি দিয়ে রাজীন বললো, "হাহ হা, আপনি শিখিয়েছেন আমাকে!" অবাক হয়ে তানজিল প্রশ্ন করল, "বারে! আমি কিভাবে শেখালাম?"
"আপনাকে বেশ প্রানবন্ত লাগছে আজ!!! বাড়ি যাওয়ার খুশি?" তানজিল উত্তরে বলল, "অবশ্যই! কিন্তু আমার না খুব খারাপ লাগে আনিকার জন্য! বেচারির মা বাবা কেউ ই নেই দুনিয়াতে! এলাহি ভাই ছাড়া৷ এতটা ভালবাসতে পারে কেউ তাও নাকি সেটা এতগুলো বছরের ব্যবধানে! আর আপনি? প্র‍্যাক্টিকাল হতে গিয়ে একা হয়ে গেছেন! এসব মানা যায়?"
রাজীন খেয়াল করে দেখলো যে তানজিল তার ঘরে নিশ্চুপ ছিল আর আজকের মুক্ত তানজিলের মাঝে আকাশ পাতাল ফারাক!
তানজিল আবারও বলল, "আজকের যাত্রা আমার মনে হচ্ছে দীর্ঘতম যাত্রা! কখন দেখবো মা বাবাকে? আমার সহ্য হচ্ছে না!"

ভোরের আলোয় দুরের গাছগাছালির উপরের আকাশে সোনালী রঙ এনেছে এবং সেই সাথে বাসও ছুটে চলছে দ্রুত গতিতে৷ রাজীন চোখ কচলে পাশে তাকাতেই দেখে তানজিল বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে! রাজীন জিজ্ঞেস করল, "আরে আপনি জেগেছেন?"
তানজিলের মগ্নতা ভেঙে গেল! বলল, "ঘুমাইছিই বা কবে? সেই থেকে জাগ্রত আমি! রাস্তা শেষ হচ্ছে না কেন?"

অবশেষে যাত্রা শেষ হল। তানজিল জিজ্ঞেস করলো, "এখানে থেকে কি হাটার রাস্তা নাকি অটো বা রিক্সা নিতে হবে?" "আপনি কি চান?" রাজীনের প্রশ্ন!
"আমি উড়ে যেতে চাই...!" হেসে দিল তানজিল! রাজীন বলল, "রিক্সা নিলে তাড়াতাড়ি পৌছাবো কিন্তু আমি চাই আমরা হেটে যাবো, সমস্যা হবে?"
তানজিলের অনিচ্ছা সত্বেও রাজীনের সাথে হাটা শুরু করলো। দশ মিনিটের চেয়ে কিছু সময় বেশি হাটার পর রাজীন থেমে গেল! তানজিলকে বলল, "তানজিল আমরা চলে এসেছি!!"
তানজিল কেঁদে ফেললো! জিজ্ঞেস করলো, "কোথায়? কোন বাসা?" রাজীন ছোট একটা কাগজ ধরিয়ে বলল, "এটায় লেখা আছে, একটু দূর গেলেই দেখতে পাবেন।"
"হ্যাঁ তো চলেন! থামলেন কেন?"
রাজীন উত্তর দিল, "আমার গন্তব্য এটুকুই, বাকি যা আছে এটা আপনার রাস্তা! আমার সোর্স এর বাইরে আমাকে যেতে নিষেধ করেছে কিন্তু আপনার জন্য এটা সেফ।" তানজিল অশ্রুসিক্ত চোখ মুছে নিয়ে বলল, "আমাকে এত কাছাকাছি এনে আপনি চলে যাবেন? যে মানুষটা অচেনা-অজানা আমাকে সাত আট মাস নিরাপদে রেখেছে তার সাথে আম্মু আব্বুর সাথে দেখা করিয়ে দিতাম!"
রাজীন অনেকটা আবেগী হয়েছে! আবেগ সংযত রেখে বলল, "আমি আপনার স্মৃতিতে আজীবন থাকবো এবং আমার কাছে আপনিও। শুভ কামনা তানজিল, নতুন জীবনের জন্য।"
তানজিল বলার মত কোনো ভাষা খুঁজে পাচ্ছে না। শুধু বলল, "আপনি ঠিক করলেন না! ভাল থাকবেন, দোয়া করবেন, আসি।" হাটা শুরু করলো সে।
রাজীন আবারও ডাক দিল তাকে! তানজিল থেমে গেল। রাজীন বলল, "আমার নম্বর আপনার কাছে আছে। পৌছানো মাত্রই জানাতে ভুলবেন না। আর যেকোনো প্রয়োজনে যোগাযোগ করবেন।" তানজিল ইশারায় বুঝালো, "ঠিক আছে।"
হাটা শুরু করলো তানজিল। রাজীন ঠায় দারিয়ে আছে! একটুপরই অন্য রাস্তায় চলে গেল তানজিল। রাজীনও হাটতে শুরু করলো মহাসড়কের দিকে। মনে মনে বলল, "এত লম্বা রাস্তা, এবার একা কিভাবে শেষ হবে?" ভাবতেই গলা শুকিয়ে এল রাজীনের!


"বাসা নম্বর ২৯, হা এটাই!" গেটের সামনে দারানো তানজিল। তালা ঝুলানো গেটে তিন চারটা সুইচ, কোনটা বাজাবে বুঝতে পারছে না। "কেউ না কেউ তো আসবেই!" এই ভেবে একটা সুইচ চাপলো সে। কিছুক্ষণ পর এক বয়স্ক মহিলা এল নিচে, জিজ্ঞেস করলেন, "কাকে চাই? কার কাছে এসেছেন?"
অপরিচিত মহিলা তাই তানজিল সালাম দিয়ে বলল, "আমার নাম মাইশা, আমি আরাফাত সাহেবের কাছে এসেছি, আমার প্রতিবেশী ছিলেন তারা একসময়। আর দুঃখিত আন্টি, আমি আসলে উনার বাসা কয়তলায় সেটা জানি না তাই আন্দাজে আপনার বাসার বেলটায় বাজালাম!"
মহিলা গেট খুললেন না, বরং বললেন, "ঠিক আছে আপনি ওখানেই থাকেন, আমি আরাফাত সাহেবকে ডেকে পাঠাচ্ছি!"
মহিলা উপরে চলে গেলেন৷ কিছুক্ষণ পর কথাবার্তা শুনতে পেল তানজিল। কিন্তু বুঝতে পারছে না কে কি বলছে, ক্রস টকিং হলে যা হয়! "মাইশা নাম বললেন না? আমি চিনি, আচ্ছা আমি দেখছি আপনি বাসায় যান, আমি দুঃখিত।" তানজিল স্পষ্ট শুনতে পেল তার বাবার কণ্ঠ! দ্রুতই চোখে পানি চলে এল তার! পিছনে ফিরে দারিয়ে চোখ মুছে নিল সে।
"মাইশা মা, কেমন আছো তুমি আর এত সকালে যে?" এই বলে গেট খুলে দিলেন আরাফ৷ তানজিলের কথা বের হচ্ছে না মুখ থেকে! চোখ মুখ মুছে সামনাসামনি দারালো তানজিল। আরাফ জিজ্ঞেস করলেন, "বাসার সবাই ভাল আছে?"
এবার স্কার্ফটা সরিয়ে নিল তানজিল! আরাফ তখনও খেয়াল করে নি, তিনি গেট সম্পূর্ণ খুলছিলেন৷ তানজিল বলল, "আব্বু..!" আরাফ তাকালেন, তিনি বিশ্বাস করতে পারছেন না নিজের দৃষ্টিকে! সামনে দারিয়ে আছে তানজিল! তানজিল জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করলো! আরাফ "আল্লাহু আকবর" বলতে শুরু করলো দফায় দফায়! "তানজিল, মা আমার, আল্লাহ তোমার দরবারে লাখ লাখ শুকরিয়া, আল্লাহ...!" একসাথে কাঁদতে শুরু করলেন দুজন। আরাফ বললেন, "তোর মাকে ডাকি..!" তানজিল বলল৷ "আব্বু, বাসায় চলো, আম্মুকে দেখবো আমি।"
কান্নার এক উৎসবে মেতে উঠেছে তারা তিনজন! তানজিলের মা বাবা ফোন নিয়ে শুরু করে দিলেন আত্মীয়-স্বজনদের খবর দেয়া! দেখতে দেখতে সবাই জেনে গেল তানজিলকে পাওয়া গেছে! খাওয়ার টেবিলে বসে ভাতে হাত দিতেই কেঁদে ফেললো তানজিল! সেই কান্না দেখে তার মা কেঁদে ফেললেন আর বললেন, "কি হলো, খেয়ে নে.. আরও অনেক কিছু করবো আজ!" তানজিলের মনে হল সেসব দিনের কথা! সেই অসম্মান, নির্যাতন...!
স্বাভাবিক হয়ে খাবার খাওয়া শুরু করলো। আরাফ বললেন, "আমার ঘর আজ পরিপূর্ণ! আমার আর কিচ্ছু চাওয়ার নেই!" মা-বাবা দুজনই বসে রইলো তানজিলের দুই পাশে, বড় তানজিলকে সেভাবেই খেতে দেখছে যেভাবে ছোট বয়সের তানজিলকে তারা খেতে দেখতেন! বাবা গ্লাসে পানি ভরে দিচ্ছেন, আর মা ভাত আর তরকারি দিচ্ছেন প্লেটে! সাড়ে তিন বছর পর তারা একসাথে, একই ছাদের নিচে, একই টেবিলে বসা!


খুব লম্বা সফর ছিল আজ! একাকী এবং নিরবতার সফর। কথা বলার কেউ ছিল না এবং রাজীনের অপেক্ষার মেসেজও এল না ফোনে! রাজীন বুঝতে পেরেছে তানজিল ঠিকমতো পৌছেছে বাসায়৷ তার মেসেজ বা কল না করা এটাকেই বুঝায়। দরজা খুলেই ভিতরে থাকা প্রকার নিস্তব্ধতা কানে এল রাজীনের। তানজিলের রুমে গিয়ে দেখে মনে হল এই বুঝি সে চা নিয়ে আসবে! পুরোটা বাসা তানজিল অস্তিত্বের প্রমাণ দিচ্ছে! ক্ষুধায় পেট মোচড় দিয়ে উঠছে তার! রুমে থাকা মুড়ি আর চানাচুর নিয়ে বারান্দায় চলে গেল রাজীন। তানজিলের ওড়নাটা দরিতে মেলে দেয়া আছে। একটু একটু মুড়ি আর চানাচুর খাচ্ছে আর তানজিলের সাথে সেসব দিনের কথা মনে পরছে! ক্লান্ত শরীর এবং চোখ ভাঙা ঘুম রয়েছে তবুও চোখ বন্ধ করলে ঘুম আসে না রাজীনের! এদিক ওদিক পাশ বদলিয়েও ঘুম আসছে না। ব্যর্থ হয়ে বিছানা থেকে উঠে গেল রাজীন! ভেবে পাচ্ছে না কি করবে সে৷ এত এত কাজ রুমে কিন্তু কোনো কাজেই মন দিতে পারছে না!


দুদিন পর,
সকাল ১১টা,
জামশেদের রুমের সামনে রাখা বেঞ্চে বসে আছেন আরাফ এবং তানজিল। গতকাল রাতেই আরাফ থানায় কল করে জানিয়ে দিয়েছেন আর সেই সুবাদে জামশেদ অতি সত্বর থানায় যেতে বলেছেন৷ ভিতর থেকে একজন এসে বললেন, "আপনাদের ভিতরে ডেকেছেন স্যার।"
জামশেদ তাদের বসতে বললেন, "কোথায় ছিলে তুমি? তোমার আব্বু আম্মু কত টেনশনে ছিল জানো? আমরাও কত চাপে ছিলাম জানো?"
জামশেদের প্রতিটি প্রশ্নে রাগে শরীর জলছে তানজিলের! মানুষ এতটা নীচ কিভাবে হতে পারে ভেবে পাচ্ছে না! বলল, "আঙ্কেল, আই মিন স্যার আমি আব্বুর করা জিডি প্রত্যাহার করতে চাই।"
জামশেদ কলম রেখে বললেন, "তানজিল আসলেই আপনার মেয়ে! স্বভাবগত মিল রয়েছে ভালই!"
রাগে চোখ বন্ধ করে ফেললো তানজিল। একটুপর বলল, "স্যার, আপনার কাছে আপনি মুল্যবান না হলেও থানার কাছে আপনার সময় অনেক দামী। প্লিজ, আমাকে নির্দেশনা দিন, আমি আর কোনো হয়রানি, ভীতি কিংবা ভয় নিয়ে থাকতে চাই না। এটাও চাই না আমার কারণে আপনি বা আপনার দল আর কোনো চাপের মধ্যে থাকুন!"
ভাল রকমের অপমান করে ফেললো তানজিল সেটা জামশেদ বুঝতে পেরেছে কিন্তু কিছু বলতে পারছে না কারণ রুমে আরও অনেকেই আছে! জামশেদ ভেবে নিয়েছিল এত সহজে ছাড়বে না তাদের কিন্তু সেটা হচ্ছে না৷ জামশেদ যেটাই বলছে তানজিলের কাছে সেটারই জবাব আছে! আশেপাশে থাকা দুই তিনজন মনে মনে প্রচণ্ড খুশি জামশেদের নাস্তানাবুদ অবস্থা দেখে! তানজিলকে বললেন, "ঠিক আছে, ওই যে বসা হামিদ, তার কাছে স্টেটমেন্ট দিয়ে যান।"
তানজিল হামিদের দিকে তাকালো, জামশেদকে জিজ্ঞেস করলো, "স্যার, স্টেটমেন্ট কি আমি দিবো নাকি আব্বু দিবেন?"
"আপনাকে দিতে হবে।" তানজিল উত্তরে বলল, "থানায় কোনো মহিলা অফিসার নেই? আমার স্টেটমেন্ট লেডি অফিসার/স্টাফ নেয়ার কথা না?"
দরজার আড়ালে আরও কয়েকজন দারিয়ে গেছে। থমথমে পরিবেশে ভিতরের কথোপকথন বাইরে অনায়াসে শোনা যাচ্ছে! জামশেদ শেষে বললেন, "আপনাকে লেডি অফিসারের কাছে নিয়ে যাবে আর আরাফাত সাহেব আপনি হামিদের কাছে যান, যদি সমস্যা না হয়...! এরপর এক সপ্তাহ পর আসবেন, দেখা করে যাবে।"
সকলেই নিজের কাজে মনোযোগ দিল। স্টেটমেন্ট রেকর্ড শেষে বেশিরভাগ থানার স্টাফদের নজর তানজিলের দিকে! তারা ভাবছে, "কে এই বাপ আর মেয়ে যে জামশেদ স্যারকে সিমেন্টে জমিয়ে দিয়েছে!"
জামশেদ বসে বসে চিন্তা করছে আর নিজেকেই প্রশ্ন করছে, "কে হতে পারে? যার এসকল দাবার চাল জানা আছে! কে এই ঘোড়া যার ছ্যাঁচড়া চালে মন্ত্রী নাজেহাল! খুব চেনা, কারণ এটা আমাদেরই কেউ! কে এই গাদ্দার, বিশ্বাসঘাতক মীর জাফর!"


বাসস্ট্যান্ডের দিকে হাটতে লাগলো আরাফ ও তানজিল৷ আরাফ জিজ্ঞেস করলেন, "তুই ওভাবে ইন্সপেক্টরের সাথে কথা বলার সাহস পেলি কিভাবে? আমি তো বেশ ভয় পেয়েছিলাম!" কিছু ভাবতে গেলেই পুরানো দিন মনে পরে! সেই সাথে আসে অশ্রু! চোখ মুছে তানজিল কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, "ভয় পেয়ে কি লাভ আব্বু? ভয়ই একমাত্র দুর্বলতা যার জন্য সাহসের জন্ম হয়!"
"আব্বু, অনেক বছরপর এলাকায় আসলাম, মাইশার সাথে দেখা করতে যেতে পারি না?"
আরাফ উত্তরে বললেন, "ওখানে যেতে ইচ্ছা করে না তানজি, তাছাড়া মাইশা বাসার বাইরে হয়তো, কি যেন একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে এখন! জগন্নাথ না জাহাঙ্গীরনগর ঠিক খেয়াল নেই! আচ্ছা চল, বললি যখন, থাকলে দেখা হবে নে।"

তানজিল উপস্থিত হল ঠিকই, তবে আপ্যায়ন পেল না! জানতে পারলো চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে এখন৷ ফেরার পথে তানজিল তার নতুন নম্বর দিয়ে এল। মাইশার বাসায় ব্যবহারে বুঝতে পেল তাদের যাওয়া আশা করে নি মাইশার পরিবার। তানজিল জিজ্ঞেস করলো, "আব্বু, আমার জন্যেই এমন হল, ঠিক না? তাদের উপরও ঝড়ের ঝাপটা বয়ে গেছে?"
"যদি আসলেই বন্ধু হয়ে থাকে তবে কল করবে। না হলে মাইশা কোনোদিন জানতেও পারবে না তুই এসেছিলি! ওর কাছে তুই হারিয়ে যাওয়া বন্ধুই থেকে যাবি! আর কেউ আছে দেখা করার মত? না থাকলে চল বাসায় যাই।"
"না, সোজা বাসা!"
সে ভাবতে লাগলো, যখন এত বিশ্বস্তই মুখ ফিরিয়ে নিল সেখানে আনিকার কাছে কিভাবে যাই যেখানে নিরাপত্তার ঝুকি উকি দিয়ে আছে! থানায়ও দেখা গেল না এলাহি ভাইকে! থাক, ভাগ্যে থাকলে আবারও একসাথে হতেও পারি!


"আজ থানায় তানজিল ও তার বাবা এসেছিল।" কথাটা শুনতেই আনিকা জিজ্ঞেস করলো, "সত্যি? দেখা হয়েছিল তোর সাথে? কেমন আছে সে? কেমন দেখলি?"
এলাহি বলল, "দেখা হয় নি, শুনেছি। তানজিল তো থানায় এসেছিল, কিন্তু জান আমার বের হচ্ছিল। ইচ্ছা হল একবার দেখা করি। পরেই মনে হল শিকারী শকুনের আনাগোনা অনেক চারপাশে।"
আনিকা সামনে দারিয়ে বলল, "আচ্ছা, তুই এমন অদ্ভুত মানুষ কেন? দিনের পর দিন আমাকে মোটিভেশনাল ভাষণ দিয়ে নিজেই ডিপ্রেশনে চলে যাস! তোর কারণে এবং তুই সাথে আছিস তাই আমি মনোবল পাচ্ছি, তানজিল আমাকে সাহস দিয়েছে বাঁচতে চেষ্টা করার জন্য আর তোর জন্যেই আমি নতুন ভাবে বাঁচতে শুরু করছি। আমার সবকিছু তুই কিন্তু তোকে দেখছি আমার জন্য বেশি দুশ্চিন্তায় থাকিস! আমাকে সাহস জুগিয়ে, দৃঢ মনোবল দিয়ে তুই এমন দুর্বল হয়ে পরলে আমরা কিভাবে বিপদ মোকাবিলা করবো?"
অল্প অশ্রুতে এলাহির চোখ ভিজে গেল! সে বলল, "আনিকা, পূর্বে আমি কেয়ারলেস জীবন যাপন করতাম। ভয়-ভীতি পেতাম খুবই কম!"
"তারমানে বলতে চাস আমি তোকে ভয়ে রেখেছি?" আনিকা তেজি জিজ্ঞাসা!
"আরে না না, তা হবে কেন? আমি সবই বুঝি। তবুও...." আবারও চোখ মুছে নিল এলাহি। এলাহির দুহাত ধরে বলল, "এলাহি, আমি তোর সাহস হতে চাই, যেমনটা এতগুলো মাসে তুই আমার পাশে দারিয়ে সাহস জুগিয়েছিস, আমিও তোর জন্য সেটা হতে চাই৷ সুযোগ দিবি? এলাহি আবারও চোখ মুছে নিল৷
"আহহা কি মুশকিল! আমার দিকে তাকা এলাহি, দেখ আমাকে।" এবার এলাহির চোখ মুছে দিল আনিকা৷ এলাহি বলল, "যা হবার তা হয়েছে কিন্তু আর যেন কিছু না হয় এটাই ভাবতে থাকি আমি!" আনিকা নিজের চোখও মুছে নিল, "শোন, আর কাঁদবি না, আমাকে কথা দে তুই সর্বদাই প্রস্তুত যেকোনো কিছুর জন্য! ওকে?" এলাহি ধীর স্বরে বলল, "হুম।"
"এভাবে না, আমার হাতে হাত রেখে বল তুই প্রস্তুত..!" এলাহি সেটাই করলো এবং আনিকার দিকে তাকিয়ে জানিয়ে দিল সে প্রস্তুত।
"That's my man! আচ্ছা শোন, চল না কাল বিকেলে, আমি আর তুই হাটতে বের হই? তুই বাসায় এসে আমাকে নিয়ে যাবি, আমি কিন্তু একা বের হব না, ওকে?"
এলাহি ফিক করে হেসে দিল! সাথে হেসে দিল আনিকা! এই হাসিই তো একে-অপরকে বাঁচতে শিখিয়েছে।


একে একে তিনটি মাস অতিক্রম হল। শীত আবারও তার আগমণ অগ্রিমভাবে জানিয়ে দিচ্ছে পাহাড়ি এলাকায়। সন্ধ্যা নামার আগে আগে শুরু হয় সাদা মেঘ আর শুভ্র কুয়াশার মিলন! চোখ জুড়ানো দৃশ্য যা সবাই দেখতে পায় না। একমাত্র চেকপোস্ট সংলগ্ন এলাকার এই দূর্গম প্রান্তেই এই নাজারা দেখতে পাওয়া যায় যা এখন রাজীন দেখছে! বিজিবির একটা দলের সাথে পুলিশের একটা দলের যৌথ ট্রেনিং ও মনিটরিং চলছে বেশ কিছুদিন ধরে। উদ্দেশ্য সীমান্ত এলাকায় নজরদারি এবং নিরাপত্তা বৃদ্ধি করা। দুই সপ্তাহের এই ট্রেনিংয়ে রাজীন বেশ ভাল কাজ করেছে এবং সিনিয়রদের নজরে এসেছে। অভূতপূর্ব এই ফলাফলে রাজীনের কার্যরত থানায় ব্যাপক সারা ফেলেছে! শুরু থেকেই ওসি হেলাল এবং এসআই সজীব, রাজীনকে বেশ সন্দেহের চোখে দেখতেন। রাজীন সেটা ভাল করেই জানে কিন্তু গুরুত্ব দেয় না। তার ধ্যান এখন সেইসব দিন বারবার চোখের সামনে দেখা। কোনোকিছু না বলে তানজিলকে মনে রেখেছে রাজীন। তাই ক্যাম্প থেকে কিছুটা দূরে ফোন হাতে নিয়ে বসে আছে। মনের চাওয়া, যদি একবার ফোন করতো কিংবা ভুল করে ফোন করে কেটে দিত! কিন্তু তানজিল সেই যে কবে বাড়ি গিয়েছে তারপর থেকে আর কোনো যোগাযোগ নেই। এলাহিকেও একবারের জন্য জিজ্ঞেস করে নি তানজিল কোথায় আছে, কেমন আছে ইত্যাদি!


নতুন করে কিছু গাছ এনেছে তানজিল। সারাটাদিন বাসায় বসা, কাজ করার মত কিছু নেই, না আছে কোনো বন্ধু-বান্ধব যার সাথে কথা বলে কিংবা দেখা করে সময় কাটানো যাবে। কথা বলার মত ছিল মাইশা, সেও এখন দূর! তাই প্রতিদিন বিকেল হওয়ার একটু আগে এসেই গাছগুলোকে পানি দেয়া শুরু করে তানজিল। একজন আছে যার সাথে কথা বলা যায়, রাজীন! ফোন নম্বর মুখস্থ থাকা সত্বেও সেভ করে রেখেছে অন্য নামে। কয়েক দফা ফোন করতে গিয়েও ফোন করেনি তানজিল। একরকম চাপা রাগ, অভিমান এবং অজানা বিড়ম্বনা কাজ করে যখনই রাজীনকে ফোন করতে চায়! নিজের মনের কষ্ট, আবেগ ভাগাভাগি করার একমাত্র ব্যক্তি আনিকা, সবাই আজ এত কাছে থেকেও কত দূরে এবং অদৃশ্য দেয়ালে বন্দী!


"স্যার শুনেছেন রাজীনের ফলাফল? সে তো অনেক জোয়ানদেরও পিছে ফেলেছে!" এস আই সজীব জিজ্ঞেস করলেন ওসি হেলালকে! তিনি চেয়ারে হেলান দিয়ে বললেন, "শুনছি। বুঝতে পারছি না গর্ব করবো নাকি হিংসা করবো! সাবেক পুলিশ সুপারও এই ছেলেকে নিয়ে বেশ গর্ব করে কারণ পূর্বের থানায় অধীনস্থ এলাকার ভোট ডাকাতি হতে দেয় নি তবে কেন্দ্রে আর ভোট গ্রহণ হয় নি! তারই বছর দেড়েক এর মধ্যে ওখানের ওসি কামাল সাসপেন্ড, তারপর জেলে!"
একটুপর আবারও বললেন, "যাও তো, রাজীনের ফাইলটা নিয়ে এসো। কোন কোন গুন আছে তার মাঝে আবারও একটু দেখি!"

সজীব ফাইল এনে দিল৷ ওসি একেকটা পৃষ্ঠা বেশ মনোযোগ দিয়ে পড়া শুরু করলেন। "লেখাপড়ায় তো খুব একটা ভাল না! দেখি আর কি আছে?"
খেলার ঘরে দেখলেন, উল্লেখ আছে ফুটবল। আরও খুঁজে দেখলেন, উল্লেখ আছে দৌড়ে জেলা ভিত্তিক রেকর্ড! সজীব জিজ্ঞেস করল, "স্যার, মা বাপ কি করে ওর?"
"ওর বাপ মা দুইজনই মৃত! মায়ের মৃত্যু হইছে ১২ সালে, কিডনি জনিত রোগে আর বাপ মারা গেছে পাঁচ বছর হল, হার্টের রোগে!"
হেলাল মনে মনে বললেন, "দেখি তো অভিভাবকে কার নাম দেয়া?" দেখলেন লেখা আছে এনামুল আহসান, সম্পর্কে মামা হন!
ট্রেইনিং এর অংশে দেখা শুরু করলেন। লং রেঞ্জ শ্যুটিং এ ২য় অবস্থান! পুলিশ স্পোর্টস সেশনে ফুটবল চ্যাম্পিয়ন! এছাড়াও আছে সাতার, দৌড় এবং যুদ্ধক্ষেত্রের মার্কও বেশ ভাল, কেস এসিস্ট ৩টা!
"এসব নিয়ে এজন্যেই গর্ব করে! লেখাপড়ায় ডাব্বা কিন্তু ফিজিক্যালি ফিট!" এই বলে ফাইলটা টেবিলে ছুড়ে দিল। তিনি আবারও বললেন, "লাভ নাই এতসব স্কোর করে! দিনশেষে পকেট ভারি তো সম্মানও ভারি! এবার ফেরত আসুক, থানায় বসিয়ে রাখবো৷"
এস আই সজীব ফাইলটা নিয়ে বলল, "স্যার, সে আমাদের জন্য একরকম থ্রেট! উপর মহল থেকে আপনার বা আমার বা আমাদের ব্যাপারে যেকোনো কিছু ভ্যারিফাই করবার একমাত্র সাক্ষী এই রাজীনই হবে! এরচেয়ে.. এরচেয়ে দেখেন কোন থানায় স্টাফ কম! বুঝতেই তো পারছেন...!"
ওসি হেলাল ইশারা বুঝে বললেন, "হুম! পাহাড় তো দেখলো তাহলে আর কি বাকি আছে?"
"দুর্গম কোনো এক এলাকা? নদী তীর কিংবা কক্সবাজার?" সজীব হালকা হেসে বললো।


--- ধন্যবাদ | ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন ---

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.