নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
প্রেমিকার চিরশত্রু
"কিছু কিছু জিনিস কখনই নিজস্ব নিয়ন্ত্রণে থাকে না। সেটার উৎকৃষ্ট উদাহরণ হল জীবন! তিলে তিলে গড়ে উঠা কোষের বিভাজনের শরীরে এতগুলো সময় ব্যয় করে মানুষ এক জীবনের এক ধাপ থেকে আরেক ধাপে এগিয়ে যায়। শুধু সময় ব্যয়েই নয়, সাথে থাকে অনেকগুলো মানুষের বুনা স্বপ্ন, দিনরাত করা পরিশ্রমের সাধনা৷ জীবনে বড় ভুল কেউই করে না, আমাদের ছোট ছোট ভুল গুলোই জীবনে বড় ঝড় হয়ে সামনে দারিয়ে যায়! বুঝতে পারা যায় না এসব ভুল একত্র হতে হতে এত বড় মাশুল চাইতে আসে! জীবনটায় যদি কেউ সুযোগ দিত যেকোনো একটা ভুল শুধরে নেয়া যাবে, তবুও আমরা মানুষ, দ্বিধায় এবং চিন্তায় পরে যাবো এই ভেবে যে কোন ভুল ছেড়ে কোন ভুলকে শুধরাবো? অতএব, টাইম ট্রাভেল এর থিওরি যদি কখনও বাস্তবে রুপ নেয় তবুও নিজেদের ভুল আমরা শোধরাতে পারবো না।"
এমনই চিন্তা ভাবনায় মশগুল হয়ে আছে কয়েকজন। নিজেদের স্থান থেকে বসে বসে চিন্তা করছেন যদি তখন এমনটা না করতাম, এটা করতাম ইত্যাদি ইত্যাদি! এই ভাবনার ঘোর এক এক করে ভাঙতে যাচ্ছে! শুরুতেই তানজিল,
"তানজি, কি করছিস?"
"আরে আব্বু, এসো! আমি লিখালিখি করছি। এটা আর গাছে পানি দেয়া ছাড়া আর কিই বা করার আছে?"
আরাফাত কিছুটা সংকোচবোধ করছেন৷ তানজিল জিজ্ঞেস করলো, "নিশ্চিত তোমার মনে কোনো প্রশ্ন আছে আমাকে জিজ্ঞেস করার, নির্দ্বিধায় জিজ্ঞেস কর।"
"তানজি, জীবনে তিন বছরেরও বেশি সময় আমাদের সবার উপর দিয়ে ঝড় বয়ে গেছে। স্বপ্ন, আশা, লক্ষ্য ইত্যাদি তছনছ হয়ে গিয়েছে। নতুন করে স্বপ্ন দেখার কোনো সুযোগ নেই!"
তানজিল আন্দাজ করতে পারছে তবুও নিশ্চিত হওয়ার জন্য বলল, "আব্বু, সরল ভাষায় বল কি বলতে চাও!"
"আমি তোমার জীবনের লক্ষ্য জানতে চাই।"
তানজিল খাতা রেখে দিয়ে বলল, "আমি বোধ হয় বুঝতে পেরেছি আব্বু!" "আমারও তাই মনে হচ্ছে।"
তানজিল বলল, "আমাদের কাছে এখন টাকা পয়সার ব্যাপক অভাব। আল্লাহর কাছে শুকরিয়া যে এত ঝড় ঝাপটায় আমরা এখন পর্যন্ত সুস্থ আছি।"
"আল্লাহ তায়ালারই রহমত।"
তানজিল বলল, "আব্বু, আমার কোনো স্বপ্নই পুরণ করা কিংবা হওয়া, কোনো অবস্থার মধ্যে নেই! লেখাপড়া আর কি করবো বল? আমি সকলের বিরুদ্ধে লড়তে লড়তে ক্লান্ত!"
আরাফাত জিজ্ঞেস করলেন, "উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বে?" তানজিল বলল, "আমি নিজে নিজে কিছু করতে পারি? যেমন ধর, টিউশনি? ছোট খাটো কোনো চাকরি? ডেস্ক জব বা রিসিপশানিস্ট? ধীরে ধীরে টাকা পয়সা জমিয়ে দেখি জীবনে কি করা যায়!"
আরাফাত চশমা পরে নিলেন, জিজ্ঞেস করলেন, "আচ্ছা তুমি যেখানে পালিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলে সেখানের ব্যাপারে আমাদের কিছু জানাবে না? চিন্তা হয় যে!"
তানজিল একথা শুনেই ডান হাত লুকিয়ে মুষ্টিবদ্ধ করে নিল! মনে মনে বলল, "আব্বু সেসব যদি আমি জানাই তবে আমি তোমাদের হারিয়ে ফেলতে পারি! এটা হতে দিবো না!" তানজিল বলল, "আল্লাহ তায়ালা খুব সুন্দর আর অকল্পনীয় ব্যবস্থা নসিবে রেখেছিলেন! যেই ছিল, তোমরা তার জন্য দোয়া কর। দুনিয়ায় আজও ভাল মানুষ আছেন।"
আরাফাত চলে গেলেন রুম থেকে। তানজিল কিভাবে এবং কোথায় কাঁদবে বুঝতে পারছে না! উপায়ন্তর না পেয়ে সোজা চলে গেল ছাদে। আরাফাতকে বলে গেল গাছে পানি দিতে যাচ্ছে! যতটা সম্ভব নিঃশব্দে কাঁদছে তানজিল! কারও সাথে কথা বলা দরকার তার! কিন্তু এখন একমাত্র রাজীনই আছে যার সাথে যোগাযোগ করা যায়। কিন্তু সেই সংকোচবোধ, চাপা অভিমান, অব্যক্ত রাগ বারবার থামিয়ে দিচ্ছে তাকে!
"সময় হল তোমার? আমার সাথে দেখা করার?"
সাবেক ওসি কামাল জিজ্ঞেস করলেন তার সহধর্মিণী সুলতানাকে৷ "অন্যায় তুমি করেছো এতে সন্দেহ নেই আমার। একটাই দুঃখ, বিশ্বাস আর ভরসা কোনটাই অবশিষ্ট রাখো নি!"
"আমারই অপরাধ, আমি চাইলেই তখন যেভাবে অবস্থা যাচ্ছিল যেতে দিতে পারতাম কিন্তু নিজেকে চিনতে জানতে দেরি করে ফেলছি! তবে আমি বেরিয়ে আসবো, তুমি দেখো৷" সুলতানা চোখ মুছে বলল, "বেরিয়ে কি করবে? তুমি বেকুসুর খালাস পাবে না৷ রেপুটেশন যা ছিল সেসব তো আগেই শেষ! ছেলে মেয়েরা স্কুলে যেতে চায় না। ছোট বয়সেই যদি এমন মানসিক আঘাত পেতে থাকে তবে ভবিষ্যতে তো তোমাকে তারা মানতে চাইবে না!"
"আমি এখন বুঝি সেটা, একটু কষ্ট কর। আমি ভাল পিতা হয়েই ফেরত আসবো, শেষ বারের মত ভরসা রাখো।"
এরমধ্যে একজন স্টাফ এসে বললেন, "ম্যাডাম, আপনার সময় শেষ, প্লিজ বেরিয়ে আসুন!"
কোনোরকম আর কথা না বলে সোজা বের হয়ে গেলেন সুলতানা। কামাল কিছুক্ষণ ঠায় দারিয়ে রইলো লোহার খাঁচা ধরে। মনে মনে বলল, "বারী সাহেব, শুধু বের হতে দেরি, যে ঘরেই বা যে গর্তেই থাকো না কেন, গলা ধরেই বের করবো তোমায় আর তোমার বাকি সদস্যদের। তোমার কথায় মজলুমের উপর অনেক জুলুম করে ফেলেছি, আরেকটা সুযোগ পেলে শুধরে নিবো নিজেকে।"
রাত ৯টা,
ডিউটি শেষে এলাহি বাসায় ফিরলো। ভিতরে ঢুকতেই দরজা লাগিয়ে এলাহিকে ধরে দেয়াল ঘেষে দার করিয়ে আনিকা জিজ্ঞেস করলো, "ফোন বের কর, কতবার কল করছি দেখ!"
এলাহি ফোন বের করলে দেখলো ১৫টা মিসড কল! "সরি, খেয়াল করি নি!"
"আচ্ছা? তাহলে বল আজকের দিনে স্পেশাল কি আছে?" এলাহি মনে মনে বলল, "এটা কি ভুলে যাওয়ার বিষয়?" এলাহি বলল, "মানুষ দুর্ঘটনায় প্রিয় মানুষ হারায়, আর আমি দুর্ঘটনায় তোকে পেয়েছি আর কিছু দরকার জীবনে? সুস্থতা আর সুখই আমার চাই যেটা তুই পূর্ণ করছিস।" আনিকা অপলক তাকিয়ে আছে এলাহির দিকে। একপর্যায়ে কেঁদে ফেললো সে! কাঁদতে কাঁদতে বলল, "সরি, আজ আমি ভয়ে ভয়ে ছিলাম। সন্ধ্যায় একটু ঘুমিয়েছিলাম আর খুব বাজে স্বপ্ন এসেছিল, তখন থেকেই ভয় কাজ করছে!" এলাহি চোখ মুছে দিল। কিছুক্ষণ জরিয়ে ধরে রাখলো একে অপরকে। এলাহি ফিসফিস করে বলল, "আমি যে আজকের জন্য উপহার কিনতে পারি নি! খুব খুজেও কিছু পাই নি!" আনিকা বলল, "দরকার নেই আমার, তুই আছিস আমি তাতেই খুশি! ইট'স এনাফ। শুকরিয়া।"
এলাহি পরম যত্নে আনিকার মাথায় হাত বুলাতে থাকলো। ভাবতে লাগলো জীবনে আর পাওয়ার আছে? কিছুই না। কিন্তু এই পাওয়া হারিয়ে গেলে সবকিছুই তছনছ হয়ে যাবে৷ এলাহি জিজ্ঞেস করলো, "সারা রাত কি এভাবেই দারিয়ে থাকবি আর জড়িয়ে ধরে রাখবি?"
হেসে দিয়ে আনিকা জিজ্ঞেস করল, "কেন? ভাল লাগছে না?"
"আমার পেটের ক্ষুধা সহ্য হচ্ছে না যে!" আনিকা এলাহির হাত থেকে ব্যাগ নিয়ে বলল, "হাত মুখ ধুয়ে আয়, খাবার রেডি, আমি টেবিলে আনছি।"
খাবার খেয়ে এলাহি বসে পরলো ল্যাপটপ নিয়ে৷ বরাবরের মত নেট লাইন বন্ধ করে দিয়ে ফাইল রেডি করতে থাকলো। কুরিয়ারে আসা অডিও এবং আরও প্রমাণাদি সাজানো শুরু করলো সে। সমস্ত ফাইল সাজানোর পর এলাহি অন্য নম্বর থেকে কল করলো সোর্স টিপুকে৷ জানিয়ে দিল ফজরের নামাজে মসজিদে দেখা করতে।
কাজ শেষ করে আনিকাকে ডেকে বলল, "যেহেতু আজ তোকে পাওয়ার বার্ষিকী, আয় সফট মিউজিকের রিদমে স্লো ডান্স করি?" আনিকা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো, "কি কি কি? তুই, সফট মিউজিক আর স্লো ডান্স? পারিস?"
"সত্যি বলতে, পারি না কিন্তু তুই আছিস না? আর কেই বা দেখছে? এবং কয়েকদিন পর আমাদের বিবাহবার্ষিকী, তখন না হয় আবার করবো? তো আয় শুরু করি, বেশ লম্বা ইন্সট্রুমেন্টাল রেডি করেছি!"
ধীরে ধীরে তাল মিলিয়ে দুজন দুজনকে ধরে স্লো ডান্স শুরু করলো। এলাহি বলল, "জানি হচ্ছে না, তো কি হয়েছে, মানিয়ে নিই?" আনিকা চোখ বন্ধ করে আছে। নিচু স্বরে বলল, "I don’t care, আমি আয়নায় দেখছিই না! সাথে আছিস, আমার স্বস্তি এটাই! এবং আমি তোকে ভালবাসি, নিজের প্রাণের চেয়েও বেশি! আজকের চেয়ে আগামীকাল আরও বেশি ভালবাসতে চাই!" এলাহি জিজ্ঞেস করলো, "কি হয়েছে তোর?"
এলাহিকে বাকি কিছু বলতে না দিয়ে বলল, "Shhhhh! কোনো কথা বলিস না। আজ আমাকে বলতে দে, তুই শুধু শুনবি।"
ঘন্টাখানেক আনিকা নিজেই অনেক কথা বলল এলাহিকে। সেসব কথা জানালো যা সে বহু বছর ধরে লুকিয়ে রেখেছিল। এলাহি তার সমস্ত কথাই শুনলো। সারাদিনের ডিউটি আর এখনের দীর্ঘ সময়ের স্লো ডান্স তার পায়ে ব্যাথার জন্ম দিয়েছে। আনিকা ছাড়ছেই না তাকে। যেভাবে নাচ শুরু করেছিল সেটা ঘন্টা পেরিয়ে একই রকম আছে!
দুই সপ্তাহ পর,
জেলে অপেক্ষা করছেন ওসি জামশেদ। আজকের সমস্ত কাজ ফেলে জামশেদ দ্রুত চলে এলেন জেলখানায়। সকালের এক ফোনেই তার দুনিয়া কেঁপে উঠেছে। চেয়ারে বসার সাথে সাথেই কল এল ফোনে। ওপাশ থেকে বলল, "জরুরি কথা আছে, অন্য নম্বরে কল করেন৷"
জামশেদ নিজেকে স্বাভাবিক রেখে থানা থেকে বের হয়ে অন্যের ফোন থেকে কল করলেন, "আপনার নামের ফাইল হেডকোয়াটারে পৌছেছে। তদন্ত শুরু হবে শীঘ্রই। মনে হচ্ছে না কাউকে ডেকে কাজ হবে! এখানে যেহেতু পৌছেছে, বাকি ডিপার্টমেন্টে পৌছানোর খুব সম্ভবনা আছে!"
এসব শুনে বেশ ঘাবড়ে গেলেন তিনি! কে করতে পারে এসব বুঝে উঠতে পারছে না৷ হাওলাদার কে কল করতে পারছে না কারণ কল ট্রেস হওয়ার সম্ভবনা অনেক। কোনো সমীকরণ মিলাতে না পেরে তিনি সোজা চলে এলেন জেলখানায়, কামালের সাথে কথা বলতে! বিশেষ অনুমতি নিয়ে দেখা করতে এসেছেন তিনি। একটুপর কামাল হাজির হলেন। কামাল বললেন, "আমার চোখ আজ কাকে দেখছে! বিশ্বাস হচ্ছে না!"
জামশেদ বললেন, "কেন করছেন এসব? কি লাভ পাচ্ছেন?" কামাল কিছুটা অপ্রস্তুত এসব শোনার জন্য!
"কি করছি, কি লাভ আমি ধরতে পারছি না আপনার কথা, সোজা লাইনে আসেন।"
তিনি রেগে বললেন, "কামাল সাহেব, না জানার অভিনয় করবেন না!" কামাল পাল্টা উত্তর দিলেন, "জেলে আমার সময় এত সুখেও কাটছে না যে নাটক করবো, আমার সময় তো বরবাদ করেই দিয়েছেন, আর কি চান? চললাম আমি, আসি!"
কামাল কয়েক কদম যেতেই জামশেদ বললেন, "থামেন, তাহলে ডিল করি? এক সত্যের বদলে আরেক সত্য?"
কামাল ফেরত এসে বললেন, "আপনি শুরু করবেন।"
"আপনাদের উপর হামলা করেছে তালুকদারের লোক। এবার আপনি?" কথাটা শুনেই কামালের ভ্রান্ত ধারণা ভেঙে গেল। কামাল বললেন, "আমি আপনার ব্যাপারে কোথাও কিছু বলি নি!"
কামালের কথা জামশেদ বিশ্বাস করলেন না৷ জামশেদ আবারও বললেন, "ডিল হয়েছে আপনার সাথে আমার।" "আপনার এক সত্যের মাঝেই আমি সকল সত্য পেয়েছি! আমি নাটক বা মিথ্যা কোনটাই বলছি না! ধরে নিন যার জন্য আজ আমি এই সেলে, আপনিও তার কারণেই আসবেন এখানে৷ সময় কম আপনার হাতে, কাজে লাগান, আসি!"
কামাল সালাম দিয়ে ভিতরে চলে গেল৷ জামশেদ বুঝে নিল কামাল আসলেই সত্য বলছে। আবারও ভাবছেন সেই ঘোড়া কে হতে পারে যার প্রতিটা চালে মন্ত্রী নাজেহাল হচ্ছে! জামশেদ থানায় ফিরে এলেন, রেজিস্ট্রি খাতা বের করে বিগত এক সপ্তাহের সবার সাইন আর এন্ট্রি টাইম দেখতে লাগলেন কিন্তু সন্দেহজনক কিছুই পেলেন না! নিজের কমপ্লেইন্ট এর খবর সহকর্মীদের জানানো মানে টেনশনকে আরও একধাপ এগিয়ে নিয়ে আসা। জামশেদ চুপচাপ রুমে গিয়ে চেয়ারে বসে পরলেন৷ আর ভাবতে লাগলেন বিগত একমাসে কার কার সাথে কথা আর দেখা সাক্ষাৎ করেছেন।
১৭ই ডিসেম্বর,
তানজিলের ডায়েরি লেখার অভ্যাস নেই৷ ডায়েরি কিনে বিলাসিতায় পা দেয়ার চেয়ে একটা খাতা বানিয়ে নিয়েছে সে। তারিখ দিয়ে বিস্তারিত না লিখে খুব সংক্ষেপে কয়েক লাইনে মনের কথা লিখে রাখে৷ এমনই একদিন বিকেলে যখন ম্লান হয়ে বসে খাতার পৃষ্ঠা বাতাসে উল্টে যাওয়া দেখছিল তখনই বেল বাজলো! দরজা খুলতে যেতে চাইলে আরাফাত মানা করেন। কিছুক্ষণ পর আরাফাত এসে বলল, "তানজি, আনিকা নামের একজন তোকে খুঁজছে, আমি ড্রয়িং রুমে বসতে..." তানজিল শুনেই আর দেরি করলো না! যত দ্রুত সম্ভব উঠে এল। ড্রয়িং রুমে এসেই দেখে আনিকা এবং এলাহি বসে আছে। তানজিল মনের কষ্ট আর চেপে রাখতে পারলো না। একে অপরকে জড়িয়ে ধরলো! যতটা সম্ভব চাপা কান্নায় নিজেকে সীমাবদ্ধ রেখেছে তানজিল। জিজ্ঞেস করলো, "বছর বানিয়ে দিলে আমাকে দেখতে! এত দেরি করলে কেন?"
আনিকা বলল, "সরি রে, মাফ করে দে! কান্না থামা। দেখি তোকে, কেমন আছিস।" তানজিলের মা জিজ্ঞেস করলো, "তোমরা গল্প কর, আমি চা নাস্তা নিয়ে আসি।"
এলাহি বলল, "আপনি আর আংকেল থানায় এসেছিলেন কিন্তু আমি ছিলাম না, দেখা করতে পারি নি। পরে শুনেছি আপনারা এসেছিলেন।" এলাহি আরাফাতের সামনে দারালো। তিনি বললেন, "আমি আপনাকে মনে হয় থানায় দেখেছি?"
"জ্বি আংকেল, আমি কনস্টেবল এলাহি আর সে আনিকা, আমার স্ত্রী। আমি কয়েক দফায় ওসি স্যারকে আপনাদের করা মামলা নিয়ে কথা বলেছি কিন্তু তিনি আমাকে পাত্তাই দেন নি!"
আরাফাতের মনে থানার প্রতিটা সদস্যের প্রতি রাগ জমে আছে। আরাফাত কথা বললেন না। তানজিলের খুঁশিকে প্রাধান্য দিয়ে তিনি চুপ করে থাকলেন। এলাহি বিষয়টা খেয়াল করেছে। স্বাভাবিকভাবেই এলাহি মেনে নিয়েছে। তানজিল বলল, "আম্মু, চা-নাস্তা তৈরি হলে ডাক দিও, আমি তাদের নিয়ে ছাদে যাচ্ছি!" মা বাবা দুজনই খেয়াল করলো তানজিল আজ বেশ চঞ্চল হয়ে আছে! এক বছরে আজ প্রথম তারা তানজিলকে এত হাসিখুশি দেখলেন।
ছাদে তিনজন বসে আছে। তানজিল আজ মন খুলে অনেক কথা বললো আনিকা আর এলাহির সাথে। আনিকা বলল, "আজ তোকে দেখতে আসার একটা খাস উদ্দেশ্য ছিল।" "কি?"
আনিকা বলল, "আমাদের ঘর আলো করে অতিথি আসছে!" তানজিল কথাটা শুনেই খুশিতে আনিকাকে জড়িয়ে ধরলো৷ "অনেক অনেক শুভকামনা আপনাদের!"
আনিকা কেঁদে ফেললো! তানজিলের হাত ধরে বলল, "আমি কি করে যে তোর এত বড় ঋণ শোধ করবো... তোর সাথে দেখা না হলে হয়তো আমি সেখানে আজও থেকে যেতাম! আমার বিশ্বাস হয় না আমি এখন একজন নারী, স্ত্রী এবং মাতৃত্বের মর্যাদা নিয়ে জীবনযাপন করছি! প্রতিবার জায়নামাজে তোর জন্য দোয়া করি।" এলাহি বলল, "তানজিল, আপনার ব্যাপারে আমি আনিকার কাছ থেকে শুনেছি। কত বাধা আর কষ্টকর পথ পারি দিয়েছেন সেটা আমি বুঝতে পারি। আমাদের দোয়া আপনার জন্য, আপনি যেন বেস্ট একজন জীবনসঙ্গী পান৷ আপনার জীবনে খুশি কানায় কানায় পূর্ণ থাকুক।"
তানজিল কিছুটা মলিন হাসি দিয়ে বলল, "জীবনসঙ্গী? জীবনটাই ভালভাবে চলছে না সেখানে সঙ্গী? জানি না কপালে কি আছে!" আনিকা বলল, "আরে, কি আছে মানে? রাজীন ভাই আছে না?"
তানজিল ঘাবড়ে গেল। নিজেকে ঠিকঠাক রেখে বলল, "একবার নিজেও খবর নিল না, কাউকে দিয়ে খবর জানতেও চাইলো না! কি পাথর হৃদয়ের মানুষ সে!" আনিকা বলল, "বাসায় আসার পর তুই নতুন ফোন আর সিম কিনেছিস, রাজীন ভাই কিভাবে তোর খোঁজখবর নিবে যদি তুই ফোন নম্বর শেয়ার না করিস?"
তানজিলের হিসাব মিলেছে। রাজীন বলেছিল, "আমার নম্বর আপনার কাছে আছে।" আনিকা বলল, "তোর চোখ, সম্পূর্ণ চেহারা বলছে কেমন ভাবে মনে করিস রাজীন ভাইকে! চল, কল কর আমার সামনে।"
"এখন কল করলে আম্মু-আব্বু কি ভাববে? এরচেয়ে রাতে একাকী কল করলে ভাল হয়। নিরিবিলি কথা বললাম!"
তানজিলকে জোর করলো না আনিকা। এদিকে দিনের আলো ফুরিয়ে এসেছে। আনিকা বললো, "যাই রে আজ, তোর সাথে দেখা করে ভাল লাগলো।"
তানজিল বলল, "যাই মানে? খাওয়া দাওয়া না করে আমি ছাড়বো না আপনাদের। আর আনিকাকে আজ আমার সাথে রেখে দিব৷ এই এক বছরে আজকের বিকেলের আড়াই ঘন্টা আমার সবচেয়ে সুন্দর সময়৷" এলাহি বলল, "তানজিল, কিছু মনে করবেন না। আঙ্কেল আমাকে এখানে সহ্য করতে পারছে না! আমার পুলিশ পরিচয়টা উনাকে খুবই কষ্ট দিচ্ছে। থানায় উনার খুবই খারাপ সময় কেটেছে এবং আমাদের সবার নিরাপত্তার কথা ভেবে আমিও উনাকে খুব একটা উপকার করতে পারি নি! আমি এও জানি আপনি আমাদের বিষয়ে বাসায় কিছু জানান নি। আপনার বাবা আমার উপর রাগ করবেন এটা স্বাভাবিক, আমি সেভাবেই নিয়েছি। তাই আমাদের চলে যাওয়াই উত্তম!"
"ঠিক এভাবেই রাজীন আমাকে বাসা থেকে একটু আগেই ছেড়ে দিয়েছিল। হয়তো সেদিন সে সঠিক ছিল। ধন্যবাদ আনিকা, এলাহি ভাই আমার পরিবারকে এত কাছ থেকে বুঝার জন্য। আব্বু জানে আপনারা আমাদের কাজে আসেন নি কিন্তু আমি জানি আপনারা এই তানজিল আর আনিকাকে কোথাথেকে উদ্ধার করেছেন! ইচ্ছে হয় সবই বলে দিই, জানুক সবাই!"
সেদিনের মত তারা চলে গেল। তানজিল বেশ খুশি মনে বাসার বিভিন্ন কাজে নিজেকে ব্যস্ত করে ফেলেছে। গুনগুনিয়ে গান গেয়ে সমস্ত কাজ নিজ হাতে নিয়েছে। রাতের খাবার টেবিল তিনজন হাসি আড্ডায় সময় কাটালো৷ বাবা মা দেখতে পেল পুরানো তানজিলকে তারা ফিরে পেয়েছে! হাসিখুশি, প্রাণবন্ত, চঞ্চল! তারা তানজিলের খুশি আর হাসি মাখা মুখ দেখে থানার, এলাকার এবং অন্যান্য কষ্ট ভুলতে শুরু করেছেন! সবই একরাতে ঠিক হয়ে গেল শুধু রাজীনকে কল করা হল না! তানজিল ভুলে যায় নি, সংকোচবোধ তাকে আবারও আটকে দিয়েছে বরাবরের মতই!
বেলা ১২টা,
আদালত প্রাঙ্গণে বেশ ভীড় আজ! চার বছরের মত চলতে থাকা সাবেক ওসি কামালের চার মামলার তিনটাতে তিনি বেকুসুর খালাস পেয়েছেন। অর্থ কেলেঙ্কারি, সম্পদ আত্মসাৎ এসব মামলায় তার বিরুদ্ধে শক্ত মজবুত প্রমাণ, সাক্ষী পাওয়া যায় নি! শুধুমাত্র একটি মামলায় দায়িত্ব গাফিলতির কারণে জরিমানা হয়েছে! কামাল বেশ খুশি আজ। চোখ বেয়ে কান্না এসে পরেছে তার! ছেলে-মেয়েদের ধরে কেঁদে যাচ্ছেন তিনি! নিচে নামতেই সামনে এসে পরে এলাহি! চোখের ঈশারায় কামাল এলাহিকে ধন্যবাদ জানালেন। এলাহি নিজেও খুশি! এই স্থানে নেই শুধু ওসি জামশেদ এবং কনস্টেবল রাজীন!
জামশেদ থানায় বসে নিউজ চ্যানেল দেখছেন আর অপেক্ষায় আছেন নিজের সাসপেন্ড লেটার হাতে পাওয়ার। পাপের তালিকা অনেক লম্বা তার৷ তখনই মনে পরলো, "বারী এবং বাকি হাতগুলো লাপাতা! দেশের বাইরে আছে। এখানে আছে তালুকদার এবং হাওলাদার। জেল থেকে বের হল কামাল, তাহলে একমাত্র এই তালুকদার এবং হাওলাদারই আছে যার দিকে সন্দেহ যাচ্ছে! এদের সাথে একমাত্র লেনদেন এবং ওঠাবসা। তাহলে মোটামুটি কনফার্ম এরাই। কামালের জামিনে তালুকদার এবং হাওলাদার এ দুই ভাইয়ের চেহারা দেখা দরকার! আমি গেলেই বুঝতে পারবো।" দেরি করলেন না জামশেদ! ড্রাইভার নিয়ে সোজা চলে গেলেন দুই ভাইয়ের ঠিকানায়।
রাত ৯টা,
পাহাড়ে নিরাপত্তা এবং শৃঙ্খলা আগের চেয়ে উন্নত হয়েছে। মেজর রশিদ রাজীনকে জিজ্ঞেস করলেন, "তুমি এবং তোমাদের যারা যারা ছিলে, সবাই অসাধারণ কাজ করেছো।"
"প্লেজার স্যার! আমার দায়িত্ব এবং শপথের বিষয়, আমি কোনোদিন পিছুপা হবো না৷" রাজীনের কথা শুনে তিনি বললেন, "এই স্পিরিটই চাই! এনিওয়ে, আজ থেকে তোমার ডিউটি এখানে শেষ। কাল তুমি থানায় ডিউটি করবে৷"
"রজার।"
অস্ত্র এবং অন্যান্য সামগ্রী জমা দিয়ে নিজের সামগ্রী নিয়ে ট্রাকে উঠে পরলো রাজীন। পাহাড়ের এই সৌন্দর্য্যটা বেশ মন কেড়েছে তার৷ সৌন্দর্যের মাঝে লুকিয়ে থাকা ভয়ানক বিপদকেও সে আনন্দে উপভোগ করেছে। থানায় পৌছে একটা চিঠি পেল সে। যেহেতু আজ ডিউটি নেই তাই চিঠি নিয়ে চলে এল বাসায়। প্রতিটি রুম ভাড়া হয়েছে এবং কোলাহল বাসার প্রতিটা রুমেই। নিজের রুমে ঢুকে বারান্দায় চলে গেল সে। মোবাইল চালু করলো এবং চিঠিটা বের করলো। পড়তে শুরু করলো। অর্ধেকটা পড়েই মন উদাস হয়ে গেল তার! আরও একটা ট্রান্সফার! হাতে তিন দিন সময়। অথচ রুম ভাড়াসহ যাবতীয় টাকা পরিশোধ করেছে সে আর আজ হাতে ট্রান্সফার লেটার। চিঠিটা খামে ঢুকিয়ে ফোন হাতে নিল। ঘড়িতে রাত ১১টা বাজে, অনেক মেসেজ এসেছে সিম কোম্পানি থেকে। বেশ কয়েকটি মিসড কল মেসেজ। এক এক করে কথা বলতে শুরু করলো। মামা, দুইজন বন্ধু, এবং কয়েকটা বন্ধ নম্বর। শেষ নম্বরটায় কল করলো কিন্তু রিসিভ হল না৷ ফোন পাশে রেখে সেখানেই বসে থাকলো। চিঠিটা বের করে আবারও পড়তে শুরু করলো, এবারের ডিউটি কক্সবাজারের এক দুর্গম থানায়! এমন সময় ফোন বেজে উঠল। রাজীন রিসিভ করে সালাম দিল কিন্তু কোনো উত্তর পেল না! জিজ্ঞেস করলো, "কে বলছেন? হ্যালো?"
"কেমন আছেন?" কথাটা শুনেই রাজীন টানটান হয়ে বসলো, স্ক্রিনে তাকালো, আওয়াজ পরিচিত! নিচু আওয়াজে জিজ্ঞেস করলো, "কে? তানজিল?"
কতদিন পর একে অপরের কণ্ঠ শুনলো তারা! ওপাশ থেকে তানজিল চুপ করে আছে! ওপাশ থেকে আবারও জিজ্ঞেস করলো, "হ্যালো তানজিল?"
চোখ মুছে তানজিল বলল, "সেদিন ওভাবে ছেড়ে দিলেন কেন আমাকে?" রাজীন কিছু বলছে না।
তানজিল বলল, "একটাবার খবরও নিলেন না কোনোভাবে!"
"কিভাবে মাফ চাইলে আমাকে ক্ষমা করবেন?" রাজীন জানে ভুল তানজিলের তবুও নিজেকেই দোষী বানিয়ে নিল। তানজিল বলল, "আপনি কোনো ভুল করেন নি, প্রথমে আমিই ভুলে গিয়েছিলাম আপনাকে জানাতে! প্রতিদিনই বারবার চেষ্টা করেও রাগ অভিমানে কল করি নি। এবার আর সহ্য হল না, আর কত?"
রাজীনও চোখ মুছে বলল, "জানেন আমি উদাস মনে বসে আছি, যেতে ইচ্ছা করছিল না! কিন্তু এখন আমি ঠিক আছি! যেতে পারবো।" তানজিল ঝাঁঝালো কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো, "যাবেন মানে? কোথায়? আবারও হারাবেন?"
"আরে না না, আমি গত দুই মাস বিজিবির সাথে যৌথ মিশনে সপ্তাহব্যাপী টার্মে বর্ডারের কাছাকাছি ডিউটিতে ছিলাম। আজই আমার ডিউটি শেষ হল। থানায় গেলাম আর চিঠি পেলাম নতুন কর্মস্থলের। তাই উদাস ছিলাম।"
এভাবেই কথা চলতে থাকলো কয়েক ঘন্টা! তানজিলের হৃদয়ে বড় একটা বোঝা জেকে বসে ছিল যেটা আজ নেমে গিয়েছে! তানজিল অনেক কথা শেয়ার করে ফেললো, এলাহি, আনিকা, থানায় কি হয়েছিল, মাইশা আরও অনেক কিছু, সেই সাথে রাজীনও! দুজনেই বুঝতে পারলো একে অপরকে কতটা দরকার তবুও কথায় জানালো না কেউ! দুরত্ব কেটে গেল, সংকোচ কাটে নি।
১১ই জানুয়ারি,
ভোরের কনকনে ঠাণ্ডায় বাইরে বসে আছেন ওসি জামশেদ। হাতে সাসপেন্ড হওয়া চিঠি এবং মাথাভর্তি চিন্তা নিয়ে প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে রয়েছেন। পালিয়ে যাবেন নাকি ধরা দিবেন বুঝতে পারছেন না। আজ এক সপ্তাহ হল, গ্রেফতার করার জন্য কেউ আসে নি। রাতেই আসার কথা তাই সারাটা রাত তিনি জেগে থাকেন৷ যেসকল প্রমাণ নিজের জন্য জোগাড় করেছেন তাতে তার কোনো উপকারে আসবে না। এভাবেই চিন্তা করতে করতে সকাল ৮টা বাজিয়ে দিলেন এবং রুমের ভিতরে চলে গেলেন।
ঘন্টা তিনেক ঘুমিয়ে আবারও বাইরে এলেন৷ চেয়ারে বসতেই দেখেন একটা প্যাকেট দরজার পাশে রাখা! দ্রুত প্যাকেটটা হাতে নিয়ে বিভিন্নভাবে নাড়িয়ে চারিয়ে দেখলেন। হালকা প্যাকেট, খুবই সাবধানে খুললেন। ভিতরে আছে দুইটা সিডি এবং কয়েকটা ফাইল! ছোট একটা কাগজও বের হল! কাগজটাই প্রথমে পড়তে শুরু করলেন,
"জানি আপনার মত লোক নিজের কাজেও আসবেন না তারপরও সবাই দ্বিতীয় সুযোগের অধিকার রাখে। এটা আপনার জন্য দ্বিতীয় সুযোগ। পথভ্রষ্ট হয়ে যাবেন? তবে আপনার বাকি কেচ্ছা-কাহিনী আমাদের নিকট লিপিবদ্ধ রয়েছে৷"
সমস্ত কিছু নিয়ে রুমে ঢুকে গেলেন তিনি। দরজায় লাগানো সিসিটিভি ক্যামেরার ভিডিও দেখলেন৷ ছোট একটা ছেলে প্যাকেটটা রেখেছে। ভিডিওটা কপি করে খুবই ফেক মেইলে সেভ করে নিলেন৷ এবার পড়তে শুরু করলেন ফাইলের সমস্ত পাতায় খুটিনাটি যা আছে সব। বাঁচার শেষ চেষ্টা।
বিকাল ৫টা,
তানজিলের বাসায় বেল বাজলো। আরাফাত বাসায় না থাকায় তানজিল চলে গেল গেট খুলতে। নিচে নেমে যাদের দেখতে পেল তাদের জন্য তানজিল মোটেও প্রস্তুত ছিল না!
"মা তানজিল, কেমন আছো তুমি? আব্বু-আম্মু আছে?"
তানজিল গেট খুলে দিল। সালাম দিয়ে বলল, "জ্বি আংকেল, আল্লাহর রহমতে সবাই ভাল আছেন। আপনারা ভাল আছেন?"
"হ্যা আমরাও ভাল আছি। তুমি ছেড়ে দাও, গেট আমি চাপাচ্ছি।"
তানজিল তাদের নিয়ে বাসায় চলে আসলো। বাসায় এসেছেন তানজিলের সেই দুঃসম্পর্কের চাচার পুরো পরিবার! চাচা, চাচী, তপু এবং পুষ্প। তারা সবাই সোফায় বসে পরলেন। চাচা জিজ্ঞেস করলেন, "আরাফাত ভাই নাই নাকি বাসায়?" তানজিলের মা জানালেন, "ওষুধ কিনতে গেল৷ আসতেছে কিছুক্ষণের মধ্যে!" তপু জিজ্ঞেস করলো, "কেমন আছো তানজিল? ওকে চিনতে পেরেছো? পুষ্প?"
তানজিল মনে মনে বলল, "ছ্যাঁচড়ামি করা কমে নি এর!", "জ্বি মনে হচ্ছে চিনতে পেরেছি।"
সবাই বেশ হাসি মজা করছে শুধু তানজিল ছাড়া। ইতোমধ্যে আরাফাত এলেন। তাকে দেখেই তানজিলের চাচা জামাল আনন্দে বললেন, "এই যে আরাফাত ভাই এসে গেছেন! আসেন আসেন, আপনার অপেক্ষাতেই আপনার বাসায় বসে আছি!" সকলেই বসে খোশগল্পে মেতে উঠেছে। পাশে তানজিল দারিয়ে আছে। চাচি বললেন, "আরে তানজিল আমার পাশে এসে বসো।" এক প্রকার জোর করে টেনেই তানজিলকে পাশে বসালেন। তানজিল কিছু বুঝে উঠতে পারছে না তাদের মতিগতি! এদিকে চাচি তানজিলের তারিফে বাক-বাকুম করেই যাচ্ছে! তানজিলের মা বললেন, "আপনারা বসেন, আমি চা নিয়ে আসি।" মোক্ষম সুযোগে তানজিল উঠে দারিয়ে বলল, "আরে আম্মু তুমি বস, গল্প কর! আমি ওদিকটা দেখছি।" তপুর মা তখনই বললেন, "আরে মা তানজিল তুমি একা যাবে কেন? এই পুষ্প, যা ওর সাথে! কাজে হাত লাগা!" পুষ্প উঠে তানজিলের সাথেই চলে গেল।
তানজিলের একেবারেই সহ্য হচ্ছে না এদের ভাবসাব। কোনো একটা মতলবে এসেছে সেটা নিশ্চিত! এদিকে ছ্যাচড়া তপু সুযোগ পেলেই রান্নাঘরে উকি দিচ্ছে যা তানজিল কয়েকবার খেয়াল করেছে! অভিভাবক বৃন্দের কথাবার্তাও বেশ উৎফুল্লতায় চলছে। তানজিলের পাশে পুষ্প, তানজিল ভাবলো একেই পরীক্ষা করা যাক। জিজ্ঞেস করলো, "তোমার কাপে চিনি কেমন দিবো? কম না বেশি?" বেশ আহ্লাদী কণ্ঠে বলল, "আমার জন্য বেশি আর ভাইয়ার জন্য মিডিয়াম!"
"কোন ক্লাসে পড় এখন?" "আমি এইটে পড়ি। আর ভাইয়ার পড়ালেখা শেষ। কি যেন হ্যা, মাস্টার্স শেষ। তিনমাস হলো চাকরি করছে।" তানজিল পুষ্পকে যেই প্রশ্নই করুক পুষ্প নিজের কথার সাথে তপুর কথাও জানিয়ে দিচ্ছে! তানজিল বুঝতে পেরেছে তপু এই পুষ্পকেও অক্ষরে অক্ষরে শিখিয়ে দিয়েছে কি কি বলতে হবে!
চায়ের ট্রে টেবিলে রেখে সবাইকে চা দিল। সবার সাথে সৌজন্যতা দেখালেও তপুর সাথে কোনোরকম কথা তো দূরে থাক, তাকিয়েও দেখে নি সে! তানজিল বলল, " আব্বু-আম্মু, তোমরা কথা বল, আমি আমার গাছগুলোয় পানি দিয়ে আসি। এমনিতেই আজ পানি দিতে দেরি করে ফেলেছি! ঠিকাছে আংকেল, আন্টি? আমি একটুপরই আসছি।"
এই বলে দ্রুত সেখান থেকে বের হয়ে পানির পাত্র নিয়ে সোজা ছাদে চলে গেল তানজিল।
এদিকে ফোন বেজেই যাচ্ছে তপুর। বারবার কেটে দিচ্ছে তাও কল করেই যাচ্ছে! তপু আরাফাতকে জিজ্ঞেস বলল, "সরি আংকেল, আসলে আর্জেন্ট কল আসছে বারবার! আমি একটু বাইরে গিয়ে কথা বলে আসি? নিচে তো গেট তালা তাহলে কি ছাদে যেতে পারবো?" "হা বাবা, যাও যাও! আর্জেন্ট কলে কথা বলাই দরকার!"
ছাদে পায়চারী করছে তানজিল। বারবার ভাবছে কেন তারা এসেছে, কি কারণে এসেছে! এমন সময়, "আরে আপনি তো পানির ট্যাঙ্ক খালি করে দিবেন!" ট্যাপ বন্ধ করার কথা ভুলেই গিয়েছিল সে! পরে তাকিয়ে দেখে তপু পানি বন্ধ করছে! সহ্য সীমার বাইরে চলে যাচ্ছে তানজিলের ধৈর্য্য! তপু আবারও জিজ্ঞেস করলো, "আপনি গাছে পানি দিচ্ছেন না যে?" তপুর ফোনে আবারও রিং বেজে উঠলো! এবার সে ফোন সাইলেন্ট মুডে রেখে দিয়ে বলল, "তো, পানি দিতে আসেন নি? এটা বাহানা ছিল?"
তানজিল বাম হাতটা ওড়নার আড়ালে মুঠ করে রাখলো। রাগে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য এটা করে থাকে সে। এবার তানজিল জিজ্ঞেস করলো, "আপনি ছাদে এলেন? কোনো খাস দরকারে নিশ্চিত?" "জ্বি জ্বি, এসেছি আর্জেন্ট ফোনে কথা বলার জন্য!"
তানজিল বলল, "হা তো কথা বলেন।" তপু বলল, "নাহ সমস্যা নেই! আপনি কেমন আছেন? আংকেলের কাছ থেকে শুনলাম আপনার নিখোঁজ হওয়াটা! কষ্টও পেলাম অনেক!" এসব শুনে তানজিল কিছুটা ভীত হয়ে গেল৷ নিজেকে ঠিক রেখে জিজ্ঞেস করলো, "আমি ফোন নিয়ে আসি নি, আপনার ফোন থেকে একটা আর্জেন্ট কল করা যাবে?" তপু খুশি হয়ে বলল, "জ্বি অবশ্যই!"
আনলক করে তানজিলকে ফোনটা দিল তপু। তানজিল কল লিস্টে ঢুকে দেখলো নয়টা মিসড কল পুষ্পের নম্বর থেকে! সন্দেহ একেবারেই ঠিক হলো। ফোনটা ওভাবেই হাতে রেখে তপুকে প্রশ্ন করলো, "কি বলতে চান সোজা লাইনে বলে দিন। ঘুরানো প্যাঁচানো আমার একদমই সহ্য হয় না।"
"ঠিক বুঝতে পারলাম না!" তপু বলল। ফোনটা ফেরত দিয়ে বলল, "আপনাদের বাসায় কেউ কারও সাথে মুখে কথা বলেন না, ফোনে ফোনে কথা হয় আপনাদের?"
"জ্বি?" "আপনার ফোনে পুষ্পের মিসড কল, তাও নয়টা! সেটাও কয়েক মিনিটে? কি জন্য এসেছেন বাসায়?" তপু বুঝে ফেলেছে কেন তানজিল ফোন চেয়েছিল! কথা বের হচ্ছে না তপুর মুখ দিয়ে! তারপরও বলল, "আসলে আপনার মা বাবার কাছে আপনার সাথে আমার বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছি। আমার ইনকামও ভাল। আপনার যেকোনো খায়েশ মেটানোর সক্ষমতাও আছে আমার এবং আমি জানি আপনি আমাকে ভাল করেই জানেন। আমাদের প্রথম সাক্ষাৎ আমার মনে আছে এবং আশাকরি আপনারও। এতক্ষণে হয়তো আমার মা বাবা আপনাদের প্রস্তাব দিয়েই দিয়েছে!"
তানজিলের শরীর কাপছে এবং নিঃশ্বাসও বেড়েছে! এবার দুই হাত ওড়নার আড়ালে ঢেকে নিল। খুবই কষ্টে মৃদু হেসে জিজ্ঞেস করলো, "ওহ আচ্ছা, এই বিষয়! তা আপনি উত্তর এখানে জানবেন? না সবার সামনে?"
তপু বেশ অবাক হল! বলল, "আমি কি হ্যা ধরে নিতে পারি? আমার মনে হচ্ছে আপনার মত আছে!"
"আপনি সবার সাথে বসেন, আমি পানি দিয়ে আসছি। দুইটা তিনটা গাছ বাকি আছে মাত্র।"
তপু চলে গেল। ছাদে রাখা একটা চেয়ারে বসে পরলো তানজিল। মাথা ব্যাথা, কান্না আর শরীরের কাপুনি, সব মিলিয়ে মুহূর্তেই তানজিল অসুস্থবোধ করছে। বুঝে নিল রক্তচাপ অনেক নিচে নেমে গেছে! সবার আগে ট্যাপ ছেড়ে কয়েকবার মুখ ধুয়ে নিল। শীতের বিকেল, ছাদের এক কোণায় রাখা ভাঙা আয়নায় নিজের চেহারা অর্ধেক দেখতে পাচ্ছে। সাথে এটাও দেখতে পাচ্ছে গাল, কপাল থেকে ধোয়া বের হচ্ছে!
"তো ভাই আরাফাত, এটা আমার আর আপনার ভাবির ইচ্ছা। একে একটা পূর্ণাঙ্গ রুপ দিতে চাচ্ছি। আপনার কি মতামত?"
তানজিলের মা-বাবা দুজনই একে অপরের দিকে তাকালো। কেউ ই বুঝতে পারছে না কি বলবে। আরাফাত বললেন, "জামাল ভাই, আপনি খুব সুন্দর প্রস্তাব দিলেন এজন্য শুকরিয়া। কিন্তু এখনই যদি আমাদের উত্তর জানতে চান তাহলে মুশকিল হবে আমাদের জন্য!" জামাল আশ্বাস দিয়ে বললেন, "আমার বাসায় যেদিন আপনার তানজিল এসেছিল, সেদিনই আমি নিজের মেয়ের মতই দেখতে শুরু করছি। তাছাড়া ঝড় ঝাপটা যা গেল তাতে নিজেদের জন্য আরও কঠিন সময় নিয়ে এসেছে! বুঝতেই তো পারছেন।"
এরমধ্যে তপু চলে এল৷ জামাল জিজ্ঞেস করলেন, "কথা শেষ? আমরা তোমার আর তানজিলের বিয়ের কথাই বলছিলাম।"
তপু বলল, "যা আপনারা ভাল মনে করেন। আপনাদের সিদ্ধান্তেই আমি রাজি।"
কিছুক্ষণ পর তানজিলও এল৷ তপুর মা আবারও তাকে পাশে বসালেন। জামাল আবারও বললেন, "আমার ছেলে শুরুতে এসএস ব্যাংকে ট্রেইনি অফিসারে ঢুকেছে, এখন বেতন ষাট হাজার। ট্রেইনিং শেষ হলেই নব্বই হাজার বেতন হয়ে যাবে! এরচেয়ে ভাল আর কি হতে পারে?"
তপুর মা বললেন, "দেখেন ভাই, মেয়ের জীবনে দুর্ঘটনা এসেছিল সেটা যে কারও জীবনে আসতে পারে। কিন্তু যে কেউ মন বড় করতে পারে না।"
তানজিল পাশে বসে সবই শুনছে। চোখে চোখে ভাসছে তার পুরানা দিনের ঘটনাগুলো! কানে গুনগুন করছে, কেউ ডাকছে, "তানজিল, তানজিল!"
একটু অন্যমনস্ক হয়েছিল সে! "জ্বি.. জ্বি আব্বু?"
"তোমার চাচা চাচি তোমার জন্য তপুর সাথে বিয়ের প্রস্তাব এনেছেন। তোমার ইচ্ছাটাও জানা জরুরি। বল।"
তানজিল তাদের তিনজনের দিকে তাকালো। একেকজনকে একেক রকমের রাক্ষস মনে হচ্ছে তার! জামাল হেসে বললেন, "আরে, তোমার মত ই তানজিলের মত! তোমার শিক্ষাই তো তোমার মেয়ের মাঝে। আমাদের পক্ষ থেকে আমরা রাজি। বল কবে আংটি পরিয়ে দিবো?" তানজিল মা বাবার দিকে তাকালো। তাদের চেহারায় একটা বিড়ম্বনার ছাপ রয়েছে বলে মনে হল! তানজিল সাহস করে বলল, "আমার কিছু বলার আছে।"
"মা যদি তোমার হ্যা হয় তবে বলার দরকার নেই। আমরা দিন তারিখ নিয়ে আলাপ করি? কি বলেন আরাফাত ভাই?" জামাল বললেন।
তানজিল উঠে সবার দৃষ্টিসীমার সামনে দারিয়ে বলল, "আলহামদুলিল্লাহ আংকেল, আপনার ছেলের মাঝে সবই ঠিকঠাক আছে শুধুমাত্র নৈতিকতা ও কমনসেন্সের প্রচুর ঘাটতি এবং অভার কনফিডেন্সে ভরপুর! আমি আপনার ছেলেকে আগাগোড়াই ভালভাবে চিনি এবং এটা আজ দিয়ে দ্বিতীয়বার বললাম উনাকে কিন্তু উনি আমাকে ঠিকমত জানেন না। আপনার ছেলের গর্ববোধ তার বিদ্যাপীঠ, কোথায় চাকরি করেন আর কতটাকা ইনকাম করেন এসব। উনার নিজের কোনো পারসোনালিটি নেই তাই আমার তরফ থেকে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান।"
উপস্থিত সবাই একে অপরের দিকে কয়েকবার তাকালো। তানজিল আবারও বলল, "আন্টি আপনি বললেন মন বড় করার কথা, আপনাদের মন অনেক বড় তাই আপনাদের মত বড় মনওয়ালা এবং আপনাদের লেভেলে মিল খায় এমন কোথায় উনার প্রস্তাব নিয়ে যান। আমার লেভেলে উনার জন্য কোনো স্থান নেই!"
কেউ কিছু বলতেই পারছে না! তপু রেগেমেগে বলল, "ওহ আচ্ছা, তুমি এখনও কাজলকে ভালবাসো? আমি ভাবলাম এসব বেশিদিন টিকে না!"
তানজিলের পায়ের নিচ থেকে জমিন সরে যাচ্ছে এমন অবস্থা! তানজিল মা বাবার দিকে তাকালো, তারাও তানজিলের দিকে তাকালো! এসব কিছুই তারা জানে না! তানজিল নিজেকে আর নিয়ন্ত্রণ করতে পারলো না৷ সোফায় বসে থাকা তপুকে তানজিল তার ডান হাত দিয়ে শরীরের সমস্ত শক্তিতে চড় বসিয়ে দিল! এতটাই জোরে লেগেছে যে তপু কানে কিছু শুনতে পারছিল না কয়েক সেকেন্ড! উপস্থিত সবাই বসা থেকে দারিয়ে গেল! হাত পা কাঁপছে রাগে এবং তানজিল বলল, "অভার-কনফিডেন্স!!! আংকেল, আপনার ছোট মেয়েও একসময় বিয়ের উপযুক্ত হবে৷ ছেলে দেখার আগেই যাচাই করে নিবেন আপনার ছেলের গুণাবলি যেন সেই ছেলের মাঝে না থাকে। আজকের মত আসতে পারেন। আসসালামু আ'লাইকুম।"
তানজিল নিজের রুমে চলে গেল। এখনও তার হাত-পা শরীর কাঁপছে। ড্রয়িংরুমে কি হচ্ছে সেসবে ধ্যান নেই তার। সমস্ত আওয়াজ অস্পষ্টভাবে কানে আসছে তানজিলের। গাল বেয়ে বেয়ে অশ্রু জামায় পরছে। ইচ্ছা করেই মুছছে না সে! হঠাৎ মনে হল, পূর্বে কাজলকে করা অপমান তাকে এমন স্থানে পৌছে দিয়েছিল যেটা তানজিলের দিন রাতের ঘুম আজও ভাঙিয়ে দেয়! এবার তেমনই অপমান করলো তপুকে! ভাবছে, এবারও কি তাহলে তেমন কিছুই হতে চলেছে?
--- ধন্যবাদ | ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন ---
©somewhere in net ltd.
১| ১২ ই ডিসেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৫:৩২
রাজীব নুর বলেছেন: ভালো লিখেছেন।