নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
প্রেমিকার চিরশত্রু
সত্য, এমনই সত্য যা সবার হজম হয় না। সেই সাথে সবাই সাহস করে বলতেও পারে না৷ সত্যের সাথে জড়িত আছে আমাদের মান-মর্যাদা। মিথ্যার চেয়ে সত্য অনেক বেশি শক্তিশালী। এই সত্য একজন ব্যক্তি ডুবাতে পারে, এই সত্যেই এক ব্যক্তির সাথে একাধিক ব্যক্তিকে ডুবাতে পারে। পাশাপাশি, বাঁচাতেও পারে। কিন্তু মিথ্যা, এর আছে ডুবানোর ক্ষমতা! সত্যকে মিথ্যা বলে চালিয়ে দিলেও সত্য সবকিছু ভেদ করে উপরে উঠে আসে। ঠিক যেমনটা পানিতে ডুব দিলে পানিই আপনাকে উপরে ঠেলতে থাকে!
কামাল তার সত্যটা প্রতিনিয়ত বুঝতে পারছে। তার সাহস হচ্ছে না সেসব মানুষদের কাছে যাওয়ার যারা কামালের জন্য বিভিন্নভাবে নির্যাতন, নিপীড়ন এবং জীবিকা হারিয়েছে! কামাল কারও জমি দখল, অর্থ আত্মসাৎ, বেনামি খুন, অপহরণ এসব কাজে যুক্ত না হলেও তিনি বারীর সাথে আইনের অপব্যবহার করেছেন অনেক! সেসবের জন্য অনেক মানুষ বিভিন্ন ভাবে জুলুমের শিকার হয়েছে৷ কামালের যতটুকু মনে আছে তাদেরই নামের তালিকা করে নিয়েছে৷ যখনই যার নাম মনে হয় তখনই তার নাম তালিকায় লিখে নেন৷ উদ্দেশ্য, মাফ চাওয়া এবং যতটা সম্ভব ক্ষতিপূরণ দেয়া। এদিকে খবর পেল ওসি জামশেদ সাসপেন্ড। ইনকাম ট্যাক্সের রেইড পরেছে তালুকদার এবং হাওলাদারের প্রতিটি ব্যবসায় যার বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান থেকে বিভিন্ন রকমের মাদক এবং স্বর্ণ উদ্ধার হয়েছে! এসব ফ্যাক্টরি এবং অফিসগুলোকে সিলড করে দেয়া হয়েছে৷ সর্বশেষ খবরে দুজনই পলাতক! এটাই কামালের মোক্ষম সুযোগ পূর্বের কর্মস্থলে যাওয়ার।
দুপুর ১২টা,
চোখ খুললো তানজিল। বেশ লম্বা ঘুম দিয়েছে সে। হাতে ভর দিয়ে উঠতে গিয়ে প্রচণ্ড ব্যাথা অনুভব হল তার। আবারও শুয়ে পরলো বিছানায়। হাত চোখের সামনে নিয়ে দেখে ক্যানোলা লাগানো! কিছু বুঝে উঠার আগেই দেখে অনেকগুলো সিলিংফ্যান! আশেপাশে অনেক বিছানা এবং অনেক মানুষ! স্মৃতি হারানো ব্যক্তির মত নিজেকে প্রশ্ন করছে, "এটা কোথায় আমি?" "আরে তানজিল, উঠেছিস! আমি ডাক্তারকে ডাকছি, চুপচাপ শুয়ে থাক!"
বুঝতে চেষ্টা করছে কোথায় এসেছে, নিজেই নিজেকে বলছে, "আসলেই আনিকা আমার সামনে ছিল নাকি! আর ডাক্তার কেই বা কে ডাকতে গেল? এতগুলো বেডের মানে কি! ঘুমালাম বাসায় আর এই অজানা স্থানে কিভাবে আসলাম আমি!"
১৫ ঘন্টা পূর্বে,
প্রচণ্ড মাথা ব্যাথা এবং শরীর খুবই দুর্বল! বারবার সেই দিনগুলোর কথা মনে পরছে! মনে পরছে কাজলের সাথে কাটানো ছোট ছোট বিকেল, গভীর রাত পর্যন্ত কথা বলা। সবই সিনেমার মত মনে পরছে! তপু এসে পুরানো স্মৃতিতে ঝড় তুলে চলে গেল। কোনোভাবেই সে দারিয়ে থাকতে পারছে না। খুব কষ্টে দরজা পর্যন্ত এসে মা বাবাকে ডেকে শরীর ছেড়ে দিয়ে মেঝেতে পরে গেল! আকস্মিক এমন ঘটনায় তারা দুজনই ভয় পেলেন আর ছুটে গেলেন তানজিলের কাছে! শরীর খুব গরম। আরাফাত গেলেন গেট খুলতে, গেট খুলেই একটা অটো ডাক দিলেন। পাশের বাসা থেকে আরও কয়েকজনকে ডেকে তানজিলকে ধরাধরি করে দ্রুত অটোতে তুলে দিলেন৷ সেই সাথে বাড়িওয়ালার কাছে বাসার চাবি দিয়ে দিলেন। সদর হাসপাতালের ইমার্জেন্সিতে নিয়ে গেলে তারা ভর্তি করার জন্য বলে দিলেন। ভর্তি হওয়ার পর যেই প্রতিবেশীরা সাথে এসেছিলেন তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানালেন এবং তারা বিদায় নিলেন। ডিউটি ডাক্তার রক্তের স্যাম্পল নিয়ে নিলেন। স্যালাইন এবং প্রয়োজনীয় ভিটামিন দিতে লাগল নার্স। রিপোর্ট হাতে আসার পর ডাক্তার জানালেন অতিরিক্ত টেনশন এবং ডিপ্রেশনের কারণে ব্লাড প্রেশার অনেক নিচে নেমে গিয়েছিল। আর তানজিল বেশ দুর্বল হয়ে পরেছে। ডাক্তার উপদেশ দিলেন, "উনার খাবারের দিকে নজর রাখবেন। যা করলে বা বললে উনার ভাল লাগবে সেটাই করবেন। সঠিক মাত্রায় ঘুম জরুরি। কিছুতো বড় টেনশন আছে উনার মধ্যে। বন্ধু হয়ে জানার চেষ্টা করুন অথবা যার সাথে কথাবার্তা বলে স্বস্তি অনুভব করে তার মাধ্যমে জানুন৷"
মা বাবা দুজনই সারারাত তানজিলের পাশে ছিলেন। সকাল হতেই প্রথমে তার মাকে বাসায় পাঠালেন। কিছু টাকা আর তানজিলের ফোন আর বাসার চাবি নিয়ে ফের রওনা হলেন হাসপাতালের দিকে। বেডের সামনে এসে দেখে তানজিল তখনও ঘুম! আরাফাতকে জিজ্ঞেস করলেন, "তানজি খুব টেনশন করছে, বড় কিছুই হবে। আমাদের তো তেমন কিছু জানায় না। তাই সেদিন যে মেয়েটা এসেছিল, আনিকা না কি যে নাম তাকে ডাকলে ভাল হয় না?"
আরাফাত তানজিলের দিকে তাকালো৷ হাসি-হাসি মুখটা কেমন মলিন হয়ে আছে! অনিচ্ছা সত্বেও বললেন, "ডাকো তাহলে? নম্বর আছে?"
"ওর ফোন এনেছি, এখানেই থাকবে।" আরাফাত তানজিলের কয়েকটা আঙুল দিয়ে ফোন আনলক করার চেষ্টা করলো। কয়েকবারের চেষ্টায় সহজেই আনলক হয়ে গেল৷ আনিকার নম্বর খুজে ডায়াল করলেন৷ মুহুর্তেই রিসিভ হল এবং বলল, "আরে কেমন আছিস রে?"
"আমি তানজিলের মা বলছি।" তিনি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সব বললেন। শেষে জিজ্ঞেস করতেই যাবে কিন্তু আনিকা বলল, "আন্টি আপনি একদমই চিন্তা করবেন না, আমি আসছি!"
আনিকা পাশে এসে বসল। কপালে হাত রেখে বলল, "কি রে? এত উচিৎ শিক্ষা দিয়ে তুই সোজা হাসপাতালে চলে এলি?" তানজিলের মনে পরছে গত দিনের ঘটনা! আনিকার হাত ধরে জিজ্ঞেস করলো, "কিভাবে পারো সেসব দিন ভুলে যেতে? মনে পরে না?"
আনিকা বলল, "পাগলীরে, বিয়ে কর। সঠিক পার্টনার পেলে সব ভুলে যাবি। আমার প্রায়ই মনে হতো সেসব দিন, নির্যাতন, নিষ্ঠুরতা, অমানবিকতা! ভয়ে কাপতাম, ঘুম ভেঙে যেত, তারপর এলাহি আসে আমার জন্য শান্তি নিয়ে! খুব যত্নে জড়িয়ে ধরে, মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। শুরুতে সবসময় ঘুম পারিয়ে দিত৷ তুই কল্পনাই করতে পারবি না কতটা নিরাপদ লাগে আমার, কি পরিমাণ প্রশান্তি। সেই সাথে মাতৃত্বের স্বাদ পেতে যাচ্ছি। আহহা! এলাহি, আমার সবকিছু। এলাহিকে কখনই হয়তো ততটা ভালবাসতে পারবো না যতটা সে আমাকে ভালবাসে। কেন যে ওই সময়ে আমি এলাহিকে নিছক মনে করতাম। টাকা-পয়সাওয়ালা অনেকেই আসবে তোর জন্য, আপন করে পেতে চাইবে কিন্তু যে তোকে বুঝবে না সেখানে ধন-দৌলত নিয়ে কি করবি? রাজীনকে বিয়ে কর। তোর জন্য এটাই একমাত্র চিকিৎসা, বুঝেছিস?"
"আম্মু-আব্বু কোথায়?" "উনাদের বাসায় পাঠিয়ে দিয়েছি। সারারাত তোর পাশেই ছিল। ফ্রেশ হয়ে আসুক! তোর ক্ষুধা লাগেনি?"
তানজিল মৃদু হেসে বলল, "টেনশন আর ডিপ্রেশন আমাকেই খেয়ে যাচ্ছে, আমি আর কি খাবো?"
আনিকা ফোন হাতে দিয়ে বলল, "ডায়াল করেছি, কথা বল। ভাল লাগবে। আংকেল আন্টির আসতেও অনেক সময় লাগবে৷ তারাও বেশ ক্লান্ত!"
দুপুর ১টা,
হিমছড়ি মহাসড়ক, কক্সবাজার
শীতকাল এখানে টের পাওয়া যায় না তবে প্রচুর বাতাস! প্রচুর যানবাহনে প্রতিদিনই মানুষের ভীর এই সড়কে লেগেই থাকে। এই দুপুরেও মানুষের ভীর কমে নি। এখানেও দুর্গম পাহাড়ে কয়েক সপ্তাহ টহল দিতে হয়েছে৷ সময় সেখানে দ্রুত কাটে না যেমনটা এই হিমছড়ির এলাকায় কাটে। এসব ভাবতে গিয়ে খেয়াল করলো পকেটে ফোন বাজছে। স্ক্রিনে দেখে তানজিলের নাম! মুহূর্তেই খুশি হয়ে গেল রাজীন। রিসিভ করে সালাম জানালো সে। ওপাশ থেকে বলল, "আমি হসপিটালে৷" কথাটা শুনেই রাজীন উঠে দারালো। সরে আসলো বাকি সাথীদের কাছ থেকে৷ "আপনি হসপিটালে? কিন্তু কেন?"
ওপাশ থেকে কান্নার আওয়াজ! কথাই যেন বের করতে পারছে না মুখ দিয়ে!
"হ্যালো, তানজিল? তানজিল শুনতে পাচ্ছেন?"
"রাজীন ভাই, আনিকা বলছি। তানজিল মানসিকভাবে ভেঙে পরেছে৷" এতদিন পর আনিকার সাথে কথা হল কিন্তু খোজখবর নিতে পারলো না কারোরই! আনিকা সমস্ত ঘটনা শুনালো রাজীনকে৷ রাজীনের চোখও একটু একটু অশ্রুতে ভিজতে শুরু করলো৷ অনেক কিছু করার আছে রাজীনের তবুও সে নিরুপায়। কথা শেষে চোখ মুছে নিল সে। ছুটি নেয়ার সুযোগও নেই আর ছুটি মঞ্জুর হলেও যেতে যেতে ছুটি শেষ হয়ে যাবে।
"হাসপাতালে কোন নিয়ম শৃঙ্খলা নেই। যেন মনে হচ্ছে মাছ মাজারে আছি।" তানজিল বলল।
আনিকা মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, "আমি ফোন দিলাম যেন তুই কথা বলিস। আমাকেই যদি সব বলতে হয় তবে তোকে কি জন্য কথা বলতে দিলাম?"
"কি বলবো? বোঝই তো?"
"হ্যা, তা তো বুঝি! আংকেল বা আন্টির সাথে কথা বলবো রাজীন ভাইয়ের ব্যাপারে?" আনিকার জিজ্ঞাসা।
"আরে না না, আব্বু পুলিশ বলতেই সবার উপরে অনেক রেগে আছেন, ক্ষোভ অনেক কিন্তু প্রকাশ করে না। আর রাজীন আমাকে নিয়ে কি ভাবে এটাও জানি না! আর তাছাড়া নতুন টেনশন এখন মাথায়!"
"মানে?" তানজিল বলল, "গতকাল চাচার ছেলেকে থাপ্পড় মেরেছিলাম কারণ কাজলের কথা তুলেছে সে! আব্বু আম্মু কেউই জানেন না ওর বিষয়ে। জিজ্ঞেস করলে কি বলবো?"
"আরে এসব ভাবিস না, তুই যেকোনো বাহানা করে নিস৷ উনি কিছুই জিজ্ঞেস করবে না।" আনিকা আবারও জিজ্ঞেস করলো, "আমি রাজীনের নম্বর নিয়ে কথা বলবো?" তানজিল চুপ করে আছে। আনিকা আবারও বলল, "আরে আমি তোকে জিজ্ঞেস করছি কেন! তোর ভরসায় এবার থাকলে সফল হব না৷" এই বলেই ফোন থেকে নম্বর নিয়ে নিল আনিকা।
কামাল তার পুরানো সোর্সদের কাজে লাগিয়ে বারীর খোঁজ করছে বহুদিন ধরে। অনেকেই জানিয়েছে সে দেশে নেই৷ কিন্তু কামালের বিশ্বাস বারী দেশেই আছে। এদের খুঁজতে খুঁজতে কামাল একজনকে পেল যার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না! কামাল ধরে ফেললো, তালুকদারের সবচেয়ে দরকারি মানুষ, নাম লাকি। কামালের মনে পরলো এই লাকি বারীর হয়ে কাজ করতো৷ তাকে ধরে নির্জন এক এলাকায় নিয়ে অনেক মারধর দেয়ার পর মুখ খুললো। ফোনে রেকর্ড করে নিল লাকির সকল জবানবন্দি। লাকি বলল, "আমার কাছে এতটুকুই ছিল স্যার, বাকি খবর হাওলাদারের সোর্স লিজু, ওর কাছে পাবেন।" কামাল জিজ্ঞেস করলো, "লিজুকে কোথায় পাবো?" লাকি লিজুর ঠিকানা দিল কিন্তু কামাল বললেন, "আমি একা যাবো না, তুই আমাকে নিয়ে যাবি। আর যদি কোনো চালাকি করিস তবে সোজা উপরে পাঠিয়ে দিব। আমারে ভাল করেই চিনিস, ডিউটিতে না থেকেও তোকে খুজতে পারি তবে ভেবে নে যদি পোশাক চলে আসে তাহলে কি হবে? চেহারা ঠিক করে নে, টাকা রাখ, ওষুধ কিনে নিবি। খবরদার, ভুলেও ফোন বন্ধ রাখবি না।"
কামাল ছেড়ে দিল লাকিকে। ঝোপঝাড়ে নড়াচড়া দেখে লাকি ভয় পেয়ে গেল। কামাল বলল, "ভয় পেলি? ওখানে সব আমার সোর্স। সবাই পজিশনে আছে এবং লিজুকে ধরতে এরাও থাকবে। এরাই তোর উপরে নজর রাখবে৷"
তানজিলকে ডাক্তার রিলিজ দিলেন৷ বাসায় এসে তানজিল নিজ রুমে চলে গেল৷ অনেকটা চুপচাপ হয়ে আছে। গোসল সেরে ছাদে গেল গাছে পানি দিতে৷ নিজেই নিজের সাথে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়ে বলল, "আজ থেকে ভুলে যাওয়ার চেষ্টা শুরু। কেউ কথা তুললেও এড়িয়ে যাবো৷" রুমে এসে মা বাবাকে ডাকলো৷ বলল, "আম্মু, আব্বু। আমি খুবই লজ্জিত। সেদিন তপু কিংবা তার মা বাবার সাথে ওভাবে কথা বলা উচিৎ হয় নি। যা করেছি সেটাও উচিৎ হয় নি৷"
তার বাবা একটু হেসে বলল, "যা করেছো সেটা রাফ ছিল কিন্তু ঠিকই ছিল৷ প্রথমে আমি মানতে পারি নি কিন্তু পরবর্তীতে তারা যা বলেছে তাতে আমি বুঝতে পারছি তুমি ঠিকটাই করেছো। কি বল তানজিলের মা?"
"তা নয়তো কি? বিয়ের প্রস্তাব কম, তারা এসেছিল ছেলের তারিফ আর আমাদের অসহায়ত্বকে পুজি করে তাদের হাতে জিম্মি করতে! নাই থাকুক এমন আত্মীয়।"
তানজিল তাদের একসাথে জড়িয়ে ধরলো৷ তিনজনের ছোট্ট সংসার। অনেক অভাব, প্রায়ই ঝড় আসে। কিন্তু মোকাবেলা একসাথেই করে। তানজিল বলল, "আমার খুব ক্ষুধা লেগেছে! পেট কামড়াচ্ছে, খেতে দাও আম্মু!"
আবারও খাবার টেবিলে তিনজন বসে আড্ডায় মেতে উঠলো। যেন কিছুই হয় নি, সব ঠিকঠাক! তারা আবারও প্রস্তুত অনাকাঙ্ক্ষিত মানুষের আবদার ধুলোয় উড়িয়ে দিতে!"
রাত ৯:৫৪ মিনিট,
লাকিকে নিয়ে কামাল এসেছেন লিজুকে ধরতে। লাকি বলল, "স্যার সে আর্মস সাথে রাখে।"
কামাল বললেন, "আমি তোরে সাথে রাখছি। আজ আমার কিছু হলে কিংবা লিজু পালিয়ে গেলে আমার সোর্সদের হাতে তুইও গায়েব হয়ে যাবি।" লাকি ঢেকর চেপে নিল। মনে মনে একটাই দোয়া, লিজু যেন হাতছাড়া না হয়।
"স্যার লিজু বের হচ্ছে।" সোর্সের কথা শুনে কামাল লাকিকে বললেন, "যা আজ নিজের লাক খুজে নে। মনে আছে তো?"
লাকির মন ফাদে পরা পাখির মত ছটফট করছে! হাটতে হাটতে ফোন করলো লিজুকে৷ রিসিভ করেই বলল, "কি রে? কোনো খবর আছে?"
"ফোনে বলা যাবে না, কোথায় আছিস? আমি তোর এলাকায়। দেখা কর, মাঠেই আসতেছি।"
"সোর্স, এলার্ট। কোনোভাবেই পালাতে দেয়া যাবে না। গাড়ি রেডি?" কামালের কমান্ড। "রেডি স্যার।"
কামাল দেখলেন লাকি আর লিজু কথা বলছে। ধীরে ধীরে সকলেই নিজের স্থান পরিবর্তন করে আগাতে লাগলো৷ তখনই সমস্যা বাঁধালো কুকুর! একজন সোর্সকে দেখে এমন ঘেউ ঘেউ শুরু করলো যেটা লিজুর মনে সন্দেহ তৈরি করলো। লাকি বলল, "আরে কি দেখিস? কুত্তার মারামারি কি প্রথম দেখতেছিস?"
"না, সেটা না! কুত্তা একটাই ঘেউ ঘেউ করতেছে!"
কামাল বলল, "সমস্যা হচ্ছে, সবাই এলার্ট, বাম ডান দুইপাশ থেকে আগাও। ড্রাইভার, রওনা দেও!"
রাস্তার দুই পার এবং শহরে প্রবেশ ও বাহির দিকে চারজন লাকি এবং লিজুর দিকে আগাতে শুরু করলো। গাড়িও আগালো সাথে সাথে। লিজু কিছু বুঝে উঠার আগেই সামনে এবং পিছন দিক থেকে দুইজন ধরে মাটিতে শুইয়ে দিল! এমনভাবে ধরে রেখেছে যার জন্য লিজু মাথা নড়াচড়া করতেই পারছে না! নিশ্বাস নিতে পারছে শুধু। বাকি দুজনের একজন এসে মাথায় কাপড় পরিয়ে দিল। আরেকজন হাত পা বেধে নিল৷ গাড়িও একই সময়ে সামনে থামলো এবং খুব দ্রুতই লিজু এবং লাকিকেও তুলে নিল। গাড়ি চলতে শুরু করলো। লিজু হাত পা ছাড়ানোর প্রচুর চেষ্টা করছে। কামাল বললেন, দরি দিয়ে বাধি নি লিজু, জিপ-টাই দিয়ে বাধছি। চামড়া ছিড়বে কিন্তু বাধন ছিড়বে না! ড্রাইভার, নিয়ে চল সেই স্থানে। সোর্স টিম, আমাকে সাহায্য করার জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ। ভাল থেকো সবাই, আউট।"
বিকাল ৪:১০ মিনিট,
গাছে পানি দেয়ার নামে ছাদে গেল তানজিল। আজ ছাদে বাচ্চাদের উপস্থিতি দেখতে পেল। পরেই মনে হল শুক্রবার আজ, স্কুল, টিচার এবং হোমওয়ার্ক থেকে মুক্ত তারা। ছাদের এক কোণায় দারিয়ে ফোন করলো রাজীনকে৷ রিসিভও হল। বেশ কথা হল দুজনের মাঝে। মাঝে তানজিল জিজ্ঞেস করলো, "পাহাড় না সাগর? কার রুপ সৌন্দর্য আপনাকে আকৃষ্ট করে?"
"দুটোই খুব সুন্দর এবং ভয়ানক বিপদজনক! আমি উভয়তেই আকৃষ্ট! পাহাড়ের সূর্যোদয় আর সাগরের সূর্যাস্ত। উভয়ের সাথে রাতের আকাশে তারার ঝলকানি এবং চাঁদের আলো।"
তানজিল চুপচাপ রয়েছে। ওপাশ থেকে রাজীন বলল, "অনেকদিন হল কিছু কথা জমা রেখেছি। বলতে চাই এখন, শুনবেন?"
"অনুমতি চাচ্ছেন?" তানজিলের প্রশ্ন। "কবে সামনে সামনি দেখা হবে তা জানা নাই, তাই আর সহ্য করতে পারছি না।"
একটু হেসে বলল, "তাহলে অনুমতি দিতেই হয়!"
ওপাশ থেকে রাজীন লম্বা নিশ্বাস নিয়ে বলল, "তানজিল, সময়ের সাথে সাথে আমি বুঝতে পারছি আমার জীবনে আপনাকে আমার চাই! I want to marry you! আপনি কি আমার প্রস্তাবে রাজি হবেন?"
তানজিল নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না! সত্যিই কি সঠিকটাই শুনছে? কান্না তো আসছেই সাথে নিরবতাও রয়েছে! রাজীন আবারও বলল, "আপনার যত ইচ্ছা, আকাঙ্ক্ষা, চাওয়া এবং আপনার যত স্বপ্ন সবই আমার স্বপ্ন হবে৷ এটা সঠিক, কোনো যোগ্যতার ভিত্তিতে আমি আপনার বরাবর দাঁড়াতে পারবো না, তারপরও আপনাকে চাই। এখন কিছু বলতে হবে না। কোনোরকম চাপ বা জোরজবরদস্তি নয়, চিন্তা-ভাবনা করে জানান, কোনো তাড়াহুড়ো নেই। আপনার রায় যদি নেতিবাচক হয় তবে দ্বিতীয়বার এমন কথা মুখ দিয়ে বের হবে না, ওয়াদা রইলো। যদি ইতিবাচক হয় তবে অভিভাবকসহ আসলাম এবং একে অপরকে আরেকটু ভালভাবে জানলাম, হুম? আজ এপর্যন্ত, পরবর্তী কলে আপনার ইচ্ছা এবং উত্তরের অপেক্ষায় রইলাম।"
কলটা তানজিল কাটলো না। ওপাশ থেকে রাজীনই কেটেছে। তবুও তানজিল কিছুক্ষণ ফোন কানে ধরে ছিল। আরেকবার যদি শোনা যেত? ফোন এক পাশে রেখে পানির পাত্র নিয়ে গাছে পানি দেয়া শুরু করলো। ছোট বাচ্চারা দৌড়াদৌড়ি বাদ দিয়ে তানজিলকে দেখছে কিভাবে গাছে পানি দেয়। বিষয়টি খেয়াল করে তানজিল বাচ্চাদের দিকে হাসি মুখে অল্প করে পানির ছিটা মারলো। বাচ্চারাও খিলখিল করে হাসি শুরু করলো৷ মানায় না এই বয়সে বাচ্চাদের সাথে খেলা তবুও তাদের সাথে ব্যাটবল খেলতে নেমে পরলো। জীবনের সেই আনন্দটা ফিরে পেয়েছে যার কিছু অংশ এখনও বাকি আছে!
বাসায় ফিরে খাতা কলম নিয়ে বসলো৷ দিন তারিখ দিয়ে লিখলো, "তাকদির আজ খুশি হওয়ার সুযোগ দিয়েছে। খুশি, আনন্দ খুঁজতে মানুষ কত কিছুই না করে! আমি বাদ যাবো কেন?"
একইদিন
রাত ১০:১৫ মিনিট,
"তানজি, কোথায় তুই? টেবিলে আয়।" বাবার ডাক শুনে টেবিলে এসে বসলো সে। তানজিলকে বলল, "কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে। আমি আর তোর মা, আমরা তোকে নিয়ে একটু চিন্তিত।"
"কি ধরনের চিন্তা আব্বু?" আরাফাত বললেন, "সময় নিয়ে। আমি চাচ্ছি যদি তোর মত থাকে তবে পরিচিতদের মাঝে ছেলে দেখতে শুরু করি? তোর জন্য?" তানজিলের মা বললেন, "আমরা তোর খুশি চাই৷ এভাবে বসে থাকলে তপুর মত বিয়ের প্রস্তাব আসতেই থাকবে। আমরা সেটা চাই না!"
"আমি আমার নিজের অবস্থা বুঝতে পারি আব্বু। কিন্তু অচেনা অজানা একটা ছেলেকে বা তার পরিবারকে বিশ্বাস করতে ভয় হয় আমার৷" তানজিলের সরল উত্তরে আরাফাত জিজ্ঞেস করলেন, "আচ্ছা মা, সেদিন তপু কাজল নামের একটা ছেলের কথা বলল? কে সে?"
নিজের সাথে হওয়া প্রতিজ্ঞাকে পরীক্ষা করার সময় এসেছে তানজিলের। স্বাভাবিকভাবে বলতে না চাইলেও সে সেসবই জানালো যেগুলা বলা যায়, যেমন টিজ করার ঘটনা, ফোনে বিরক্ত করার করার ঘটনা ইত্যাদি! আরাফাত বললেন, "হ্যা হ্যা, আমারও মনে পরেছে, কোন এক রাতে সে কল করে উদ্ভট সব কথা বলছিল আমাকে!" তানজিল বলল, "তাই তাকে এভয়েড কর।"
"তাহলে কি তোমার মত আছে? ছেলে খোঁজা শুরু করবো? এটাই একমাত্র রাস্তা এখন জীবন গড়ার৷ হতে পারে এটার সাথেই তোমার স্বপ্নগুলো ধীরে ধীরে পুরণ হল?"
তানজিল বুঝতে পারছে না কি উত্তর দিবে! রাজীনের কথা বলাটা ঠিক হবে কিনা। আরাফাত খেয়াল করলেন তানজিল চিন্তায় ডুবে আছে! তিনি বললেন, "আচ্ছা মা তুই ভেবেচিন্তে আমাকে জানাস।" তিনি উঠে গেলেন৷ তানজিল ভেবে নিয়েছে সে জানাবে রাজীনের ব্যাপারে। হঠাৎই বলে উঠলো, "আব্বু... আমার কিছু বলার আছে!"
আচমকাই এমন কথা শুনে মা বাবা দুজনই একে অপরের দিকে তাকালেন! তারা আবার বসলেন, "হ্যা, বল!" আরাফাত বললেন।
তানজিল একবার বাবার দিকে তাকায় তো আরেকবার মায়ের দিকে! কি বলবে আর কিভাবে বলবে বুঝে উঠতে পারছে না! দীর্ঘ নিশ্বাস নিয়ে মাথা ঝুঁকিয়ে বলল, "আম্মু-আব্বু, আমি একজনকে পছন্দ করি...!"
ঘড়ির কাটার টিকটিক শব্দ সবার কানেই যাচ্ছে। এক প্রকার নিস্তব্ধতা, নিরবতা শুরু হয়ে গেল বাসার মাঝে। তানজিল সাহস পাচ্ছে না মা কিংবা বাবা কারও দিকে তাকাতে। তারাই বা কি ভাবছে সেদিকেও দেখছে না সে!
"ছোট ভাই, গোলাপ কত করে?"
ডিউটি শেষে পুলিশের ড্রেসেই এলাহি উপস্থিত এক ফুলের দোকানে। দরদাম আর কি করবে, পুলিশ দেখে আমতা-আমতা করে কথা বলা শুরু করলো। ছেলেটার ঘাবড়ে যাওয়া দেখে এলাহি প্রশ্ন করলো, "আরে ভাইয়া তুমি এমন ভয়ে ভয়ে কথা বলছো কেন?" ছেলেটার বাবা এসে বলল, "স্যার, স্যার বাচ্চা ছেলে। যদি কোনো ভুল করে থাকে মাফ করে দিন, বলেন কি লাগবে আপনার?"
এলাহি কিছুই বুঝতে পারছে না। কোনো একটা সমস্যা তো আছেই তারপরও বলল, "গোলাপের তোড়া বানিয়ে দিন।" "জ্বি স্যার, এই এদিকে আয়, স্যারের জন্য গোলাপের তোড়া খুব সুন্দর করে বানিয়ে দে৷ স্যার আপনি ভিতরে বসেন।"
এলাহি তাদের এই ব্যবহারটা বুঝতে পারছে না। কেনই বা তারা এমন হাসফাস করছে! তোড়া তৈরি করে এলাহির সামনে দিয়ে দোকানদার বললেন, "স্যার এই নিন, রেডি।" "আহা কি সুন্দর লাগছে! কত হল ভাই?"
"বেশি না স্যার মাত্র ২০০টাকা!" দাম এলাহির হজম হল না। এতগুলো গোলাপ আর মাত্র এই দাম! দাম দিয়ে এলাহি চলে সেখান থেকে৷ কাল থানায় বিষয়টা তুলতে হবে৷ এই ভেবেই বাসার দিকে রওনা হল।
"আজ ফিরতে এত দেরি হল যে?" আনিকার প্রশ্ন।
"আমি আগে ফ্রেশ হয়ে আসি? তারপর তোর সাথে কথা বলি।" এলাহির কথাটা আনিকার ভাল লাগলো না। কিছুটা মন খারাপ হয়ে গেল। যেই এলাহি প্রতিদিন এসেই প্রথমে তার কথার ঝুলি খুলে দিত তার এমন ব্যবহার আনিকা মেনে নিতেই পারছে না!
ফ্রেশ হয়ে এসেই দেখে আনিকা গম্ভীর মেজাজে আয়নার সামনে বসে আছে। এলাহি সামনে এসে জিজ্ঞেস করলো, "আমার আনিকা হঠাৎ এমন গম্ভীর কেন?" আনিকা উত্তর করলো না! হাত ধরতে গেল কিন্তু আনিকা ছাড়িয়ে নিল। পরিস্থিতি বেগতিক, এলাহির মনে হল গোলাপের তোড়ার কথা। উঠে চলে গেল সে। আনিকা আবারও দেখলো এলাহি তাকে এড়িয়ে গেল। অকারণেই কেঁদে ফেলল আনিকা! তোড়া নিয়ে ফিরতেই এলাহি দেখলো আনিকা কাঁদছে! তোড়া পিছনে লুকিয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে বলল, "ভালবাসার জন্য কোনো স্পেশাল দিন হয় না। এলাহি যেদিন আনিকাকে পেয়েছে সেদিন থেকেই ভালবাসা দিবস ভুলে গেছে। এলাহির জীবনে প্রতিদিন বসন্ত নিয়ে আসা একমাত্র ব্যক্তি, আমার প্রিয় মুখ, যাকে দেখেই আমার দিন শুরু হয়, আমার এই নড়বড়ে জীবনের সাথী, আমার পাঁজরের বাকি অংশ আমার আনিকাকে ভালবাসায় সিক্ত একগুচ্ছ গোলাপ উপহার। আগামীকাল সারাদিনই ডিউটি তাই আজ রাত ১২টা বাজার ২ ঘন্টা পূর্বে আমার তরফ এই ছোট্ট সারপ্রাইজ! আপনি কি আমায় মাফ করেছেন?" আনিকা লজ্জামাখা মুখে ফিক করে হেসে দিল। তার নাক টেনে এলাহি বলল, "ভাবিস কিভাবে তোর এই দুচোখে আমি দুঃখকে ভিড়তে দিব হ্যাঁ? সেখানে শুধু আনন্দের অবস্থান। আমার অবস্থান!" তোড়া নিয়ে আনিকা চোখ মুছে বলল, "আমাকে এমনভাবে আগলে রাখার জন্য কি নিবি?"
এলাহি ছোট একটা মোরাতে বসে বলল, "কেমন পাষাণ তুই? ঠাণ্ডা ফ্লোরে বসে আছি তবুও একটু বসতে বললি না!" "ওহ সরি সরি সরি!"
আনিকা উঠতে চাইলে এলাহি তার দুই হাত ধরে বলল, "তোকে আগলে রাখার জন্য কি চাই আমার? তোর হাসি, কেয়ার আর একটুখানি আমায় নিয়ে ভাবা! আর তোর সকল দুঃখগুলো চাই হাওয়ায় মিশিয়ে দিতে। আমি সিনেমা, নাটক দেখি না, তোর সামনে আছে জেনুইন, একমাত্র এলাহি, তোর এলাহি! এসব তার মনের কথা। তার চাওয়া হল আনিকা নামের আমার স্ত্রীর মনের যত দুঃখ সেসব ডাস্টবিনে ফেলে আসা। বিড়াল কুকুর খাক সেসব।"
আনিকা অপলক তাকিয়ে আছে এলাহির দিকে। সে বলল, "আমি যে এভাবে ভালবাসতে পারছি না, বারবার তোর সামনে হেরে যাই!" এলাহি বলল, "হারতে থাক, হারে অন্যরকম আনন্দ আছে!" আনিকা উঠে দাড়ালো। হাতটা এগিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করলো, "ডান্স করবি?"
এলাহি বলল, "পেটে যে প্রচুর ক্ষুধা!" মুহূর্তেই আনিকা রেগে লাল হয়ে বলল, "ধ্যাত, আনরোমান্টিক। যাহ টেবিলে! খাবার রেডি।"
"আরেহ! এতকিছু করার পরও আনরোমান্টিক?"
১৪ই ফেব্রুয়ারি,
বিকাল ৪টা,
ছাদে গাছে পানি দিয়ে রাজীনকে কল করলো। রিসিভ করতেই তানজিল জিজ্ঞেস করলো, "কেমন আছেন?"
"আপনি একটা মানুষ হ্যাঁ? এতদিন লাগালেন কল দিতে!"
তানজিল বলল, "বারে! আমিই কল দিলাম আর আমাকেই কথা শুনাচ্ছেন?"
"তো শুনাবো না? আমি এদিকে ভয়ে ভয়ে আছি! মনে করলাম সেদিন ভুল কিছু বললাম কিনা যার জন্য আপনি যোগাযোগই বন্ধ করে দিলেন!"
"আচ্ছা আচ্ছা, সরি৷" এরপর কিছুক্ষণ নিরবতা চলতে থাকলো। তানজিল আবার জিজ্ঞেস করলো, "কিছু ভুল যাচ্ছেন?" রাজীন উত্তর দিল, "না, কিভাবে জিজ্ঞেস করবো বুঝতে পারছি না।" তানজিল হাসলো এবং জিজ্ঞেস করলো, "আমাকে নিয়ে অনেক চিন্তা আপনার তাই না?" "আরে সে তো অবশ্যই, আপনাকে ভাল..." রাজীন থেমে গেল। মনে মনে ভাবলো সীমা পার করে যাচ্ছে না তো! কথা ঘুরিয়ে অন্যদিকে নিয়ে যাবে কিনা!
ফোনের এপাশে মুচকি হাসা তানজিল, ভাবতে শুরু করেছে রাজীনকে নিয়ে এক নতুন অধ্যায় জীবনের৷ তানজিল বললো, "আমার আব্বু আম্মু আপনাদের দুপুরের দাওয়াত দিয়েছেন, যেকোনো শুক্রবার। আমি আপনার দিন তারিখের অপেক্ষায় থাকলাম এবং ভালবাসা দিবসের শুভেচ্ছা।"
রাজীন কিছু বলবে কিন্তু সে সময়টুকু তানজিল দিল না তাকে। মা বাবা দুনিয়ার মায়া সেই কবেই ত্যাগ করেছেন! দীর্ঘ আটমাসের মত তানজিল ছিল রাজীনের কাছে, অথচ এত গুরুত্বপূর্ণ কথাটাই সে বলতে পারি নি!
পরেরদিন,
দুপুর ১টা
"ভাই এলাহি, সাহায্য কর। আমার সবকিছু শেষ! তানজিলকে আমি নিজের সম্পর্কে এসব বলতেই পারি নি! এখন বলার মত পরিস্থিতিও নেই!" এলাহি বলল, "তুই তোর মামা-মামীকে কিছু টপিক বলবি যেমন, প্রথম কোথায় দেখেছিলি মানে পরিচয়। আর সবচেয়ে নাজুক বিষয়, তানজিল আর লেখাপড়া করতে পারি নি কেন এসব আমরা জানি কিন্তু তোদের অভিভাবকরা জানেন না! তো এটাকেই নিরাপত্তা দিতে হবে। একেবারে পিজিআর এর মত!"
"বুঝতে পারছি, প্রেসিডেন্ট গার্ড রেজিমেন্ট! শোন, তোরা দুইজনও থাকবি, আমরা সাপোর্ট পাবো।"
২২শে ফেব্রুয়ারি,
শুক্রবার, দুপুর ১:৩০
দুজনের স্বপ্ন একসাথে হওয়ার প্রথম বৈঠক আজ! তানজিলের সাথে আছে আনিকা। আয়নার সামনে বসা তানজিলকে জিজ্ঞেস করলো, "কেমন লাগছে? ভয় না খুশি?" "বিশ্বাস হচ্ছে না। সকাল থেকে নিজেকে চিমটি কেটেছি কয়েকবার! " আচ্ছা বাসা এমন শান্ত কেন? রাজীন ওর মা বাবা কোথায়?" "পুরুষদের সবাই নামাজে আর দুই শাশুড়ির গল্প চলছে!"
আনিকা আবারও বলল, "আয় তো, তোকে অল্পস্বল্প সাজিয়ে দিই। এমনিই তোর মেকাপের দরকার হয় না যাকে আমরা জেনুইন সুন্দরী বলি৷" আয়নায় তাকিয়ে সুন্দর একটা হাসি দিল তানজিল। আনিকা বলল, "আজ থেকে তোর সমস্ত দুঃখ কমতে শুরু করবে। বিয়ে না হলে বুঝতাম না জীবন কতটা দামী! সময় কি খেলাই না দেখাতে পারে!"
খাওয়া দাওয়া শেষ সবার। কথার বাক্স সবারই ফাকা হয়ে আছে। তারপরও রাজীনের মামা বললেন, "ভাই এবার আপনার মেয়েকে ডাকেন যদি তৈরি হয়ে থাকে?"
আরাফাত ঈশারা দিলেন মেয়েকে নিয়ে আসতে। তানজিলের মা রুমে গেলেন। সাধারণ সাজসজ্জায় সবার সামনে এল তানজিল! মনের মাঝে বিপদের আশংকা রাজীনের! তবুও তাকালো না তানজিলের দিকে৷ তানজিল বসলো রাজীনের মামীর পাশে।
"মাশাআল্লাহ! ভাই আপনার মেয়েকে আল্লাহ তায়ালা যথেষ্ট দিয়েছেন!" রাজীনের মামী বলল। এদিকে লজ্জায় তানজিল কথা বলছে না এবং ভয়ে রাজীন চুপ করে আছে! তানজিলের বাবা রাজীনকে জিজ্ঞেস করলেন, "এখন কি করো আর কোথায় আছো?"
"জ্বি আংকেল, আমি কনস্টেবল, এখন কক্সবাজারে আছি।" রাজীন এবং এলাহি পরস্পরের দিকে তাকালো৷ মামী তানজিলকে অনেক প্রশ্ন করলেন। তানজিল খুশিমনেই সব উত্তর দিল। মামী জিজ্ঞেস করলেন, "তো মা তানজিল, তুমি আর লেখাপড়া চালিয়ে যাও নি কেন? একজন শিক্ষিত বউ, স্ত্রী, মা বর্তমান সমাজে অনেক জরুরি!"
যার ভয় সেটাই হল! রাজীনের মনে পরলো সে শুধুমাত্র মামাকেই বলেছে এসব প্রশ্ন জিজ্ঞেস না করতে! মামা মামী ছাড়া সকলেই পরস্পরের দিকে একবার করে তাকালো! এই প্রথম তানজিলকে দেখলো রাজীন। তানজিল রাজীনের চোখেমুখে এক প্রকার ভীতি খেয়াল করলো। সে চোখের ঈশারায় আশ্বাস দিল, "চিন্তা করবেন না, আমি ঠিক আছি।" তানজিল উত্তরে বলল, "আন্টি আপনার কথার সাথে আমি শতভাগ একমত। আমারও দৃঢ় ইচ্ছা লেখাপড়া করার৷"
"ঠিক আছে মা বুঝতে পেরেছি।" তানজিলকে থামিয়ে দিলেন রাজীনের মামা৷ তিনি আবারও বললেন, "আমার ভাগ্নের কিছু জানতে চাইলে জিজ্ঞেস করতে পারেন ভাই।"
ভাগ্নে শব্দটা শুনে তানজিল ও তার মা বাবা বেশ অবাক হল! তানজিলের মা অস্পষ্ট স্বরে বললেন, "ভাগ্নে? মানে?"
মামা বললেন, "ওহ আপনারা হয়তো জানেন না! না জানাই স্বাভাবিক!" তিনি সমস্ত ঘটনাই বললেন। তানজিলও অবাক হয়ে শুনলো। সবশুনে আরাফাত বললেন, "ভাই, আপা আপনাদের যদি মেয়েকে আর কোনো প্রশ্ন করার থাকে তবে করুন, না হলে ভিতরে পাঠিয়ে দিই?"
"না, না আমাদের তরফ থেকে কোনো প্রশ্ন নেই।" আনিকাকে বললেন, "আনিকা, তানজিকে নিয়া যাও।"
তারা দুজন উঠে গেল এবং রুমে ঢুকতেই পর্দা ছরিয়ে দরজার পাশে দারিয়ে গেল!
আরাফাত বললেন, "আমাদের ছেলেমেয়েরা একে অপরকে ভালবাসে এবং জীবনসঙ্গী হিসেবে পেতে চায়। কিন্তু একটি শর্ত আছে।"
এলাহি মনে মনে বলল, "চাকরি ছেড়ে দিয়ে অন্য যেকোনো চাকরি নিতে হবে।" এবং এটাই তিনি বললেন!
দরজার ওপাশে থাকা আনিকা তানজিলকে বললো, "জানতাম!" তানজিলের চোখ ছলছল করছে অশ্রুতে!
আরাফাতের শর্ত শুনে রাজীনের মামা বললেন, "ভাই আমি আপনার কনসার্ন বুঝতে পারছি। শুরুতে আমরাও ওর চাকরিতে খুশি ছিলাম না। কিন্তু সে প্রমাণ করে দেখিয়েছে।" আরাফাত বললেন, "আমার ভরসা ওই ইউনিফর্মে নেই কিন্তু রাজীনের উপর আছে আর তাছাড়া যতই বলেন ভাই, দিনশেষে সবাইকে হুকুম পালন করতে হয়।"
পর্দা একটু সরিয়ে তানজিল রাজীনকে দেখলো। পুরোটা সময় রাজীন একটা শব্দও বলে নি! নিস্তব্ধ, বোবা হয়ে বসে ছিল! কথাবার্তার কিছুক্ষণ পরেই তারা উঠে গেলেন। এলাহি গেল তাদের বিদায় দিতে এবং রুমে থেকে গেল আনিকা, তানজিলের নিরবে কাঁদা দেখা ছাড়া কোনো উপায় নেই!
নিচে গাড়িতে উঠার আগে মামাকে নিয়ে একটু দূরে গিয়ে কিছু কথা বলল রাজীন। কথাবার্তা শেষে রাজীন এবং তার মামা আরাফাতের সামনে এল। রাজীন বলল, "আংকেল আপনার কনসার্ন মাথায় রেখে, আপনি যেমনটা চান তেমনটাই হবে। I will quit this job and look for another but promise me, you will give me your daughter's hand."
রাজীন এবং তার মামা মামী চলে গেল। দাড়িয়ে রইলো আরাফাত এবং এলাহি। আরাফাত বললেন, "যে বা যারা আমাদের আজকের অবস্থার জন্য দায়ি, আমি তাদের কখনই মাফ করবো না। পুলিশের উপর আমার বিন্দুমাত্র ভরসা নেই। ধরে নিলাম হাজারে একজন এলাহিই ভাল কিন্তু কিছুই ভাল করতে পারছো না! কি লাভ তাহলে এই ভাল হওয়ার?"
এলাহি বলল, "ভাল করতে পারছি না কিন্তু খারাপ হতে দেই নি! ঠিকই বলেছেন, ভরসা থাকলে আজ রাজীন শর্ত নিয়ে ফেরত যেত না! আর এত কর্মস্থল চেঞ্জ হতো না।"
আবারও এক সপ্তাহ পেরিয়ে গেল৷ গাছে পানি দেয়ার জন্য ছাদে কেউ আসে না! দুপাশে ফোনের অপেক্ষায় বসা কিন্তু কেউই ফোন দেয় না! বারান্দায় দেয়াল ঘেঁষে বসে থাকা তানজিল এবং দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় কিংবা হিমছড়ি মহাসড়কে বালুর বাধের উপর দারিয়ে সূর্যাস্ত দেখা রাজীন, দুজনেই ভাবছে, "যদি সত্যটা জানাতে পারতাম!" ধীরে ধীরে তানজিল এবং রাজীন ফিরে যাচ্ছে তাদের চুপচাপ ছন্দহীন জীবনে!
সকাল ৮টা,
থানায় এলেন নতুন ওসি, নাম বকুল শাহ। শুরুতেই তিনি ডিউটিরত সবাইকে সবার ফাইল উনার টেবিলে রাখতে বললেন এবং যাদের ডিউটি রাতে তাদেরও ফাইল চাইলেন। সমস্ত ফাইল ঘাটাঘাটি করে এস আই, এ এস আই, কনস্টেবলদের ডেকে বললেন, "আমার সম্পর্কে আপনাদের ধারণা দিই। আমার পুরো নাম আহমেদ বকুল শাহ। এরপূর্বে আমি বেনাপোল থানায় ছিলাম। আজ থেকে এই থানায়। আমাকে যেখানের দায়িত্বে নিযুক্ত করা হয় সেখানের চেয়ার টেবিলও চুপচাপ থাকে! কেন আপনাদের এসব বলা? কারণ, কথা কুরিয়ার করবেন না কেউ। কেউ কারও পিছনে লাগবেন না৷ যাকে যেই কাজ দিব, নিষ্ঠার সাথে করে যাবেন, উপরের প্রেশার আমি দেখে নিব। বলে রাখি এটা আমার ১১তম ট্রান্সফার৷ কতদিন এখানে থাকবো সেটা আমি নিজেও জানি না। তাই নেতা এবং নেতার ডান হাত বাম হাত, এসবের পিছে ঘুরবেন না। সবাই যেতে পারেন।"
চাকরির এত বছর পর রাজীনের মনে হল সে একজন সৎ, নিষ্ঠাবান, আদর্শ ব্যক্তির সাথে কাজ করবেন। এখন পর্যন্ত কাউকে মন থেকে সালাম না জানানো রাজীন এই প্রথম গর্ব করে সালাম জানালো।
--- ধন্যবাদ | ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন ---
©somewhere in net ltd.
১| ২২ শে ডিসেম্বর, ২০২৪ সকাল ১১:১৬
রাজীব নুর বলেছেন: তানজিল, রাজন, আনিকা কামাল-- নাম গুলো কমন।