নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

যা মনে আসে তাই লিখি।

স্বর্ণবন্ধন

একজন শখের লেখক। তাই সাহিত্যগত কোন ভুল ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।

স্বর্ণবন্ধন › বিস্তারিত পোস্টঃ

মউত বাহানা খুঁজতা হ্যায়

০৩ রা মার্চ, ২০২৫ রাত ১২:৩৯


'মউত বাহানা খুঁজতা হ্যায়'
চুলে কাঁচি চালাতে চালাতে ধরে আসা গলায় বলে উঠলেন ভদ্রলোক। উনার পারকিনসন ডিজিসের লক্ষণ চলে এসেছে কিছুদিন হলো। হাত কাঁপে। কিন্তু তারপরেও হাতকে নিয়ন্ত্রণ করা শিখে নিয়েছেন। মানুষকে টিকে থাকতে হলে কতো কিছুই না শিখতে হয়!
'আতিফ ভাই মারা গিয়েছে বলেছি আপনাকে?'
আমি মাথা নাড়লাম। বেশ কিছুদিন পর এসেছি শহরে, আমার জানার কথা নয়।
পাশের চেয়ার ফাঁকা। আগে এখানে আতিফ ভাই কাজ করতেন। মুখে কথা বলতেন কম, চোখে মুখে পৃথিবীর প্রতি জমিয়ে রাখা বিতৃষ্ণা। যে কোন কাজে এই ভদ্রলোকের বিরোধিতা করে তিনি বেশ আনন্দ পেতেন অথবা পারস্পরিক বিরোধিতা করা তাদের অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল। কয়েক যুগের একসাথে কাজ কারবার। এরকম অভ্যাস হয়ত তাদের অলিখিত শর্ত ছিল। যেটা অন্যদের সাদামাটা চোখে স্রেফ ঝগড়া মনে হতে পারে, প্রকৃতপক্ষে সেটাই হয়ত তাদের যোগাযোগের আরামদায়ক উপায় ছিল। মানুষের ভাষার ব্যাকরণ আছে কিন্তু যোগাযোগের উপায়ের হয়ত ধরাবাঁধা নিয়ম হয়না। এটা নিতান্তই পারস্পরিক মিথষ্ক্রিয়ার ফল।
'এখন খুব একা লাগে জানেন। একাকীত্ব খুব যন্ত্রণার, সেটা বাসায় হোক কিংবা কাজে!' - বলে কিছুক্ষণ নীরবে আনমনে বাহিরের দিকে তাকিয়ে থাকলেন ভদ্রলোক। উনার সাদা কালো মেশানো রুপালী চুল বাতাসে উড়ছে। চলচ্চিত্রের একটুকরো দৃশ্যের মতো। আহা একাকীত্ব মানুষকে গ্রাস করে নেয়া মহামারী। শৈশব থেকে মানুষের কতো প্রয়াস খেলার সাথী খোঁজা, কৈশোরে বন্ধু খোঁজা, যৌবনে প্রেম, বিয়ে! সবকিছুর শেষেও তো সে একা থাকে, একা হয়ে যায়। ভদ্রলোকের সচেতন প্রয়াসে নিয়ন্ত্রণে রাখা হাতের কাঁপুনি আবার শুরু হলো। আমি নীরবতা ভাংগলাম।
'কিভাবে মারা গেলেন উনি?'
'কয়েকদিন আগে এক্সিডন্টে পায়ের পাতায় আঘাত পেয়েছিলেন, বাসায় রেস্টে ছিলেন। কয়েকদিন পর হুট করে রাতে.....'
'অহ!'
'আঘাত তেমন বেশি ছিলনা'- উনি স্বগোতক্তি করলেন।
তারপর আমার দিকে ফিরে বললেন- 'কিন্তু জানেন কি ভাইসাব, মউত বাহানা খুঁজতা হ্যায়!'
তিনটি শব্দ। মহাবিশ্ব চরাচরে মানুষের কাছে সবচেয়ে সত্য গল্পটা তুলে ধরল যেন। সত্যিই তো মৃত্যু বাহানা খুঁজতে থাকে। সামান্য অজুহাতে অথবা অজুহাত ছাড়াই এসে হাজির হয়। আশেপাশে কতো মানুষ ভোজবাজির মতো হাওয়া হয়ে যাচ্ছে। এই যে একদিন বেঁচে আছি এটাই তো লটারিতে নাম উঠার মতো ব্যাপার। পৃথিবীর সবথেকে মূল্যবান লটারি যার র‍্যাফেল ড্র প্রতি মুহূর্তেই হচ্ছে। আপনি জীবিতদের দলে থাকবেন নাকি মৃতদের দলে! কারা বেশি ভাগ্যবান এটা বলা মুশকিল। আমার মতো সাধারণ মানুষের কাছে পৃথিবীর রুপ, গন্ধ, সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য আরেকটা দিন পাওয়াই প্রকৃতির কাছে থেকে পাওয়া সর্বোচ্চ উপহার। আবার সক্রেটিস এর মতো বিজ্ঞ দার্শনিকদের এর কাছে জীবন-মৃত্যুর ধারণা ভিন্ন। হেমলক হাতে নিয়ে উনি বলতে পারেন- 'I to die, and you to live. Which of these two is better only God knows.' হয়ত এই লটারির ফলাফল পূর্বনির্ধারিত। কিন্তু অংশগ্রহণ বাধ্যতামূলক। সেটা সক্রেটিস হোন, সম্রাট সিকান্দার হোন কিংবা বুদ্ধ হোন।
আয়নায় আমার বন্য দাঁড়ি-গোঁফ হালকা হয়ে আসছিল। চুলের পাঁকের দিকে তাকিয়ে প্রতিবারের মতো হতাশ হয়ে বললেন- 'এ জীবনে আপনার চুলের পাঁক সোজা করতে পারলাম না।'
আমি বরাবরের মতো হেসে বললাম- 'যেমন আছে তেমনই থাক, প্রকৃতি যা দেয় সেটাই মেনে নিতে হয়!'
তিনি আবার আনমনা হলেন- 'সবাই তো মানতে পারেনা ভাইসাব! এই না মানা থেকেই তো দুনিয়া জোড়া অস্থির হট্টোগোল। আপনি মণিকর্ণিকা ঘাটে গিয়েছেন বারাণসী শহরে?'
আমি মাথা নাড়লাম।
'ওখানে হিন্দুদের মরদেহ আনা হয়। ওদের বিশ্বাস ওখানে দাহ করলে স্বর্গপ্রাপ্তি হয়। শবের সারি শুয়ে থাকে সিরিয়ালে। লম্বা সিরিয়াল পাওয়া কঠিন। কার শব নেই সেখানে কোটিপতি থেকে শুরু করে কৃষক। কিন্তু কাউকে আলাদা করে চেনা যায়না। সবাই এক কাতারে সারি সারি শুয়ে আছে। এ দৃশ্য একবার দেখলে ভোলা যায়না। মরণ সবাইকে সমান করে দেয়। মাঝের সময়টা শুধু শুধু লাফালাফি!'
টানা বলে গেলেন কথাগুলি। এখন তাকে কোনভাবেই নরসুন্দর মনে হচ্ছেনা। ভাসা ভাসা চোখ, রুপালী চুল কার্ল মার্ক্সের মতো সাদা পাকা দাঁড়িতে মনে হচ্ছে যেন প্রাচীন গ্রীক সোফিস্ট এর সাথে কথা বলছি। আসলে সব মানুষই তো দার্শনিক। কেউ বলে কেউ বলেনা। কেউ লিখে কেউ গুছিয়ে লিখতে পারেনা।
'জানেন মুসলমান হোক, হিন্দু হোক সবার মাসে একবার হলেও গোরস্থানে, শ্মশানে যাওয়া উচিত'- মতামত দিলেন উনি।
আমি জিজ্ঞাসু চোখে তাকালাম।
'ওটা এক অন্য জগত। ওখানে একটা আলাদা অনুভব হয় যা ভাষায় বোঝানো যায়না। মৃতের দুনিয়া আমাদের মনে করিয়ে দেয় এই দুনিয়া কতো ক্ষণস্থায়ী। এই সত্য মানুষ ভুলে যায় বলে বিশৃংখলা করে। তাই ঔষধের মতো মনে করিয়ে দিতে এই সফর জরুরি!'
হ্যা রবীন্দ্রনাথ ও লিখেছেন 'মরণ রে তুঁহু মম শ্যামসমান' মনে মনে ভাবলাম। মৃত্যুর আলিংগন অবশ্যম্ভাবী জেনেই হয়ত তাকে শ্যামের মতো কাছে টানতে চেয়েছেন।
আমি কিছু বললাম না। মৃত্যু সংক্রান্ত আলোচনা আমাদের বিষন্ন করে দেয়। সবকিছু অর্থহীন লাগে।
ঘোলা কাঁচ দিয়ে বাহিরে তাকালাম। সব গতিশীল। মানুষ ছুটছে। ফুটপাতে একটা ছেলে আয়েশী ভংগিতে সিগারেট টানছে। পর্বতপ্রমাণ অপেক্ষা নিয়ে একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কিছুটা ঘোরলাগা স্বাভাবিক দৃশ্য। একটা লাল রঙ এর প্রাইভেটকার ব্রেক কষতে গিয়ে হঠাত ফুটপাতের একদিকে উঠে গেলো। সিগারেট হাতে ছেলেটি ওই মুহূর্তেই বামপাশে সরে গেলো এক ঝটকায়। এই কয়েক সেকেন্ডের ব্যাপার। খুব সামান্য ব্যাবধানে ছেলেটি বাঁচার লটারি পেয়ে গেলো। ওইখানে ভিড় জটলা জমছে। আমি ঘাড় সোজা করলাম..... চুল কাটা শেষ করতে হবে।
ভদ্রলোক বললেন- 'ছেলেটার কপাল ভালো বলতে হবে। কিন্তু মরণের বাহানার শেষ নাই। আবার নতুন বাহানায় আসবে! মউত বাহানা খুঁজতা হ্যায়!'
Seventh Seal মুভিতে নাইট যখন মৃত্যুকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন সে কে, তখন মৃত্যুর উত্তর ছিল- 'I am Death. I have long walked by your side. Are you prepared?'
কি তীক্ষ্ণ শৈল্পিক অভিব্যক্তি। সে আমাদের সাথেই হাঁটছে। যে কোন সময় যে কোন বাহানায় চলে আসবে সামনে।

মন্তব্য ২ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ০৩ রা মার্চ, ২০২৫ রাত ৩:০০

ধুলোপরা চিঠি বলেছেন:



টং দোকানের ধর্মীয় গল্প।

২| ০৩ রা মার্চ, ২০২৫ সকাল ১০:১১

রাজীব নুর বলেছেন: মৃত্যু বড় অদ্ভুত।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.