নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

এই যে আছি ....থাকবো না তো.....সময় হলে সঙ্গে যাবার....কেউ যাবে কি? কেউ যাবে না.....কেউ যাবে না-....।আমি তো নই কারো চেনা।

রৌদ্র নীল

রৌদ্র নীল › বিস্তারিত পোস্টঃ

১৪৫৩- ফাতিহ সুলতানের কনস্ট্যান্টিনোপল জয় ও ইসলাম বনাম ক্রিশ্চিয়ানিটি

২৪ শে সেপ্টেম্বর, ২০২০ সকাল ১১:৫২



পর্ব-৪

বাইজেন্টাইনরা সমুদ্রের উপকূলের কাঠ, চুনাপাথর এবং মার্বেল কাজে লাগিয়ে গড়ে তুলেছিল শক্তিশালী এক শহর। বসফরাসের স্রোতের সাথে ভেসে আসত হাজার রকমের মাছ। ইউরোপীয় মাটি আর আনাতোলিয়ার মালভূমির উর্বর নিম্নভূমিতে জলপাই তেল, ভুট্টা এবং ওয়াইন প্রচুর পরিমাণে উৎপাদন করা হত। এই জায়গায় যে সমৃদ্ধ শহরটি উঠেছিল তার মালিকানা ছিল রোমান সম্রাটের। আর অধিবাসী গ্রীক ভাষী লোকদের বসতিগুলির জাঁকজমকে তাদের আভিজাত্য ফুটে উঠত। কনস্ট্যান্টাইনের রাস্তাগুলি ছিল অনেক মজবুত, নান্দনিক দালান, উদ্যান, কলাম এবং শহরের খিলানগুলিতে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত হতে থেকে লুট করে আনা মূর্তি এবং স্মৃতিফলক ছিল। এসব মূর্তির কিছু ছিল পৌত্তলিকদের আর কিছু ছিল খ্রিস্টানদের। (সম্ভবত গ্রীক ভাস্কর লিসিপোসের তৈরি আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের ঘোড়া সহ ব্রোঞ্জ মূর্তিটিও এখানেই ছিল), কনস্ট্যান্টিনোপলকে বলা চলে মার্বেল এবং রঙবেরঙের পাথরের শহর। এসবের মূল্য অনায়াসে এখানকার সোনা এবং উজ্জ্বল মোজাইক থেকে বেশি ছিল। শহরটির জনসংখ্যা ছিল প্রায় ৫০০০০। ব্যবসার কাজে বা পূর্ব রোমান সাম্রাজ্যের সম্রাটকে শ্রদ্ধা জানাতে আসা দর্শনার্থীরা এ শহরের রূপে অবাক হয়ে যেতেন। মধ্যযুগের অন্ধকারে ঢাকা ইউরোপের বার্বারিয়ানদের কাছে এ ছিল "বিশ্বের সবচেয়ে আকাঙ্ক্ষিত শহর"। একাদশ শতাব্দীতে আসা পরিব্রাজক চার্ট্রেস ফুলচারের প্রতিক্রিয়াটি যুগে যুগে বহু মানুষের কানে বাজবে: "কী সুন্দর শহর , কতই না সুদৃশ্য, সারি সারি গীর্জা আর সহস্র শ্রমিকের ঘামে গড়ে উঠেছে শহরের প্রশস্ত প্রাসাদগুলো। বিশাল রাস্তা, স্বর্ণ ও রূপা, ফ্যাশন সচেতন শহরবাসী এবং উপসনালয়গুলি সবই এই শহরকে করেছে সবার থেকে আলাদা। বন্দরে রাখা জাহাজগুলোর দিকে তাকিয়ে মনে হয় -পৃথিবীর মানুষের আকাঙ্খিত কি নেই এখানে?"

বাইজান্টিয়াম কেবল রোমান সাম্রাজ্যের শেষ উত্তরাধিকারী ছিল না, পৃথিবীর প্রথম খ্রিস্টান জাতি ও ছিল এরাই। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই রাজধানীটি স্বর্গের মত করে সাজানো হয়েছিল। তাদের কাছে যীশুর বিজয়ের এক বহিঃপ্রকাশ হিসাবে কল্পনা করা হত এ শহরকে। পাশাপাশি তখনকার খ্রিস্টানরা বাইজেন্টাইনের সম্রাটকে, পৃথিবীতে ঈশ্বরের সহকারী হিসাবে বিবেচনা করত। যীশুর উপাসনা সব জায়গাতেই স্পষ্ট ছিল: গীর্জার উত্থিত গম্বুজগুলিতে, ঘণ্টা এবং কাঠের তৈরি ক্রুশ, টেম্পলগুলো, বিপুল সংখ্যক সন্ন্যাসী এবং নানকে দেখা যেত। রাস্তায় ও দেয়ালের চারপাশে কুচকাওয়াজ শোনা যেত। প্রার্থনার অবিরাম ঘন্টাধ্বনি শোনা যেত। খ্রিস্টীয় অনুষ্ঠানগুলোতে ধর্মপ্রাণ নাগরিক এবং তাদের সম্রাট যোগ দিতেন। উৎসব, ভোজের দিনে শহরে আলাদা পাহারা বসানো হত। খ্রিস্টানদের সব পবিত্র স্মৃতি এখানে এনে জমা করা হয়েছিল। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত হতে সংগ্রহ করা পবিত্র স্মৃতিচিহ্নগুলো পশ্চিমের খ্রিস্টানদের কাছে ছিল হিংসার বস্তু। তাদের কাছে ব্যাপটিস্ট জনের কাঁটার মুকুট, ক্রুশের পেরেক এবং যীশুর সমাধির পাথর, মহাপুরুষদের ধ্বংসাবশেষ এবং এক হাজার অন্যান্য অলৌকিক জিনিসপত্র ছিল। এগুলো হয় সোনায় মোড়ানো ছিল নতুবা ছিল মূল্যবান পাথরে বাঁধানো। অর্থোডক্স খ্রিস্টানরা মোজাইক এবং রঙিন পাথরের মধ্যে আলো ফেলে এক পবিত্র বিচ্ছুরণের কারসাজি দেখাত। এতে সাধারণ খ্রিস্টানরা ঐশ্বরিক পূর্বাভাসের রহস্য ভেবে মুগ্ধ হত। এ যেন স্বর্গীয় গোলকের রূপক দিয়ে ইন্দ্রিয়কে বিমুগ্ধ করার জন্য পরিকল্পিত গোলকধাঁধা।

১৩৯১ সালে এক রাশিয়ান দর্শনার্থী এখানে এক রাজকীয় রাজ্যাভিষেক দেখতে এসেছিলেন । তিনিএসময় এসব কারসাজি দেখে তাজ্জব হয়ে যান। সৈন্যরা সম্মান দেখাতে, রাজকীয় সিংহাসন নিয়ে এত ধীরে ধীরে অগ্রসর হয়েছিল যে সিংহাসন বহনকারী দরজা থেকে প্ল্যাটফর্মের দিকে যেতে তিন ঘন্টা সময় নেয়। মাথা থেকে পা পর্যন্ত বর্মে আচ্ছাদিত বারোজন সৈন্য সম্রাটকে বহন করে নিয়ে গিয়েছিল। তাদের কারো চুল ছিল লাল, কারো ছিল কালো। রূপোর হাতল লাগানো আর মণিমুক্তোখচিত সিংহাসন বেদীতে বসানোর পর সম্রাটের মাথায় মুকুট পরানো হয়। সে মুকুটে ছিল নীলকান্তমণি, জহরত আর দামী হেরাল্ডের কারুকাজ।... এরপর শুরু হয় সম্রাটের মঙ্গল কামনায় স্তুতি পাঠ। এমন বর্ণনা আর কোথায় পাওয়া যাবে?

শহরের মাঝখানে একটি শক্তিশালী জাহাজের মতো নোঙ্গর করা ছিল সেন্ট সোফিয়ার প্রকান্ড গির্জা, যা সম্রাট জাস্টিনিয়ান তৈরি করেছিলেন মাত্র ছয় বছরে। ৫৩৭ সালে জনসাধারণের জন্য এটি খুলে দেয়া হয়। প্রাচীন বিশ্বের সবচেয়ে অসাধারণ স্থাপত্য ছিল এই গির্জা, যার তুলনা শুধু এর সাথেই সম্ভব।

জাঁকজমকপূর্ণ বিশাল গম্বুজটি প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছে ছিল এক অদম্য অলৌকিক সৃষ্টি । প্রোকোপিয়াস বলেছিলেন, "মনে হচ্ছে, কোন পেশীবহুল রাজমিস্ত্রির তৈরি নয় বরং স্বর্গ হতে মাটিতে ফেলা হয়েছে এটি এত বিশাল জায়গা জুড়ে ছড়িয়ে আছে। প্রথমবারের মতো এটি দেখলে যে কেউ বাকরুদ্ধ হয়ে যায়। চার একর জুড়ে বিস্তৃত এর ছাদ, স্বর্ণের মোজাইক দিয়ে সজ্জিত । তা দেখতে এতই উজ্জ্বল পল সিলেনটিয়েরির মতে, "

এর চমকানো স্বর্ণালী আলোর স্রোত যে কোন লোকের চোখকে ধাঁধিয়ে দেয়, আবার দেখার দুঃসাহস খুব কম লোকই করতে পারে ।

অপরদিকে এর রঙিন মার্বেল পাথরের গঠন একে কাব্যিক নিদর্শনে পরিণত করেছে। তার দেখে মনে হয় যেন কেউ "নক্ষত্রের গুঁড়ো ছড়িয়ে দিয়েছে... আর ফেনিল দুধ যেন ঝলমলে কৃষ্ণ পৃষ্ঠের উপরে ছড়িয়ে পড়েছে ... নীল সমুদ্রের জলরাশি অথবা পান্না পাথরের মতো এর গায়ের রং, কিংবা বলা চলে ঘাসের উপর ছড়িয়ে থাকা নীল কর্নফ্লাওয়ার, যার যেখানে সেখানে ছড়িয়ে আছে জমাট বাঁধা তুষার খন্ড। "

দশম শতাব্দীতে কিয়েভের থেকে আসা লোকজন সেন্ট সোফিয়ার রূপে এতটাই মুগ্ধ ছিল যে, রাশিয়া অর্থোডক্স ক্রিশ্চিয়ানিটির দিকে ঝুঁকে পড়ে এবং সে সম্পর্কে তাদের মন্তব্য ছিল: “আমরা জানতাম না আমরা স্বর্গের মধ্যে আছি নাকি পৃথিবীতে। কারণ পৃথিবীতে এমন কোনও চোখ ধাঁধানো সৌন্দর্য নেই এবং কীভাবে এর বর্ণনা করতে হয় তা আমরা পুরোপুরি ভুলে গিয়েছিলাম। আমরা কেবল জানি যে সেখানে ঈশ্বর, মানুষের মধ্যে বাস করেন। ”

খ্রিস্টধর্মের এই আদিরূপের পুরোটা ঘিরে আছে ঝকমকানি আর চমকপ্রদতা, যা ইসলামের বিচ্ছিন্ন সাদাসিদে বিশুদ্ধতার বিপরীত চিত্র। ইসলাম ধর্মে একজন মরুভূমির দিগন্তের বিমূর্ত সরলতার প্রস্তাব দিয়ে গেছেন, এমন উপাসনার পথে ডেকেছেন, সূর্যের আলোকে যেমন সবসময় কাছে পাওয়া যায়; এ ধর্মের স্রষ্টাকে পেতেও তেমনি কোন আনুষ্ঠানিকতা লাগে না ,
অপরদিকে অর্থোডক্সির পুরোটা জুড়ে জাঁকজমক- চিত্র, রঙ, সংগীত, রহস্যের বিমুগ্ধ রূপক আর আড়ম্বরতার মধ্য দিয়ে আত্মাকে স্বর্গের পথ দেখানো হয়। তাদের একটাই মিল, দু ধর্মেরই লক্ষ্য নিজস্ব স্রষ্টার দর্শনে বিশ্বকে রূপান্তর করা।

বাইজেন্টাইনরা তাদের আধ্যাত্মিক জীবনকে এতটাই কট্টর করে ফেলেছিল যা পরবর্তী খ্রিস্টীয় জগতের কোন অঞ্চলে আর খুঁজে পাওয়া যায় না। সাম্রাজ্যের স্থিতিশীলতা, বিভিন্ন সময়ে অবসর নেওয়া সেনা অফিসারদের ধর্মালয়গুলোতে সরাসরি হস্তক্ষেপের কারণে হুমকির মুখে পড়েছিল। পথে ঘাটে যে কেউ ধর্মীয় জ্ঞান বিতরণ করত এবং তা নিয়ে মারামারিও লেগে যেত। এক ভ্রমণকারী বিরক্ত হয়ে এ সম্পর্কে লিখেছেন “সমস্ত শহরটি ধর্মবিশারদ শ্রমিক ও ক্রীতদাস দিয়ে ভর্তি” । “আপনি যদি কোনও লোককে টাকা ভাঙাতে দেন তবে সে আপনাকে বলবে বলতো পুত্র (যীশু) কীভাবে পিতার (ঈশ্বর) থেকে আলাদা হতে পারে? আপনি যদি একটি রুটির দাম জিজ্ঞাসা করেন, তবে সে যুক্তি দিবে তুমি কি বলতে চাচ্ছো পুত্র পিতার চেয়ে কম? যদি আপনি জানতে চান যে গোসলের পানি পাওয়া যাবে কিনা তার প্রশ্ন হবে আপনি আপনাকে বোঝান তো পুত্র কিভাবে কিছু হতেই তৈরি হয়নি? ” " যীশু খ্রীষ্ট কি একজন নাকি অনেকজন ছিলেন? পবিত্র আত্মা কি কেবল পিতা নাকি পিতা ও পুত্র দুইজন থেকেই সৃষ্টি হয়েছিল? মূর্তিগুলি কি শুধুই মূর্তি বা নাকি পবিত্র ? "

এগুলি সাধারণ কোন প্রশ্ন ছিল না: হয় শহরের লোকেরা পুরোপুরি ধর্মভীরু ছিল নাহয় তারা ধর্ম নিয়ে বিভ্রান্তিতে ছিল। তাই উত্তর খুঁজত। গোঁড়া ও ধর্মবিরোধী বিষয়গুলি সাম্রাজ্যের জন্য গৃহযুদ্ধের মতো ভয়াবহ হয়ে গিয়েছিল। শহরের মানুষের মধ্যে আসলে কোন একতা ছিল না।

বাইজানটাইন খ্রিস্টধর্মের পৃথিবী ছিল অদ্ভুত । সমস্ত কিছু ঈশ্বরের দ্বারা নির্ধারিত মনে করা হত এবং কোনও ধরণের দুর্ভাগ্য, কোন ছোটখাটো ক্ষতি থেকে একটি বড় অবরোধের মুখোমুখি হওয়া পর্যন্ত, ব্যক্তিগত বা সম্মিলিত পাপের পরিণতি হিসাবে ধরা হত। তাদের বিশ্বাস ছিল সম্রাটকে ঈশ্বর নিয়োগ দেন। আবার কোন কারণে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে যদি সম্রাটকে সিংহাসন হতে নামানো হত যেমন - ষড়যন্ত্রকারীদের দ্বারা তাকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে অথবা ঘুমের ঘোরে ছুরিকাঘাত করা হয়েছে কিংবা ঘোড়ার পিঠে পিছন হতে শ্বাসরোধ করা হয়েছে বা নির্বাসনে পাঠানো হয়েছে - (কারণ সাম্রাজ্যের অস্থিরতা ছিল ), এগুলোকেও ধরা হত ঈশ্বরের ইচ্ছা। উল্টো তারা ভাবত সম্রাট নিষ্পাপ ছিল না, তাঁর অনেক লুকানো পাপ ছিল। তিনি জনগণকে এতদিন বোকা বানিয়েছেন । তাই শাস্তি পেয়েছেন।

বাইজেন্টাইনরা কুসংস্কারে প্রচন্ড বিশ্বাস করত। ভবিষ্যদ্বাণী ছিল তাদের বিশ্বাসের প্রধান অস্ত্র। সম্রাটরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতেন। তাই নিজেদের মনমত বাইবেল থেকে তাদের ভাগ্যে কি আছে খুঁজতেন। প্রায়শই পাদ্রিরা সম্রাট বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করত। অন্ধবিশ্বাস একদম বাড়াবাড়ির পর্যায়ে চলে গিয়েছিল। নবম শতাব্দীতে একজন আরব দর্শনার্থী সেনা অভিযানের অগ্রগতি সম্পর্কে রিপোর্ট করতে গিয়ে ঘোড়া ব্যবহারের এক কৌতূহলী ব্যবহার দেখেছেন :

“ গির্জার কাছাকাছি লাগাম পড়ে থাকতে দেখি। একটি ঘোড়া ছেড়ে দেয়া হয়, লোকেরা বলাবলি করছিল: 'যদি ঘোড়াটি লাগাম মুখে নেয়, তাহলে আমরা ইসলামের বিরুদ্ধে বিজয় অর্জন করবো।' যদি ঘোড়া কখনও লাগামের কাছে এসে, নাক দিয়ে শুঁকে, আবার ফিরে যেত, তখন লোকেদের চেহারা মলিন হয়ে যেত, তারা বলাবলি করতে থাকত "পরাজয় খুব কাছাকাছি"। "

যাই হোক, এতকিছুর পরও শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বাইজান্টিয়াম এর রাজধানী ছিল সূর্যের মতো উজ্জ্বল, যার আলো ছড়িয়ে পড়েছিল সারা বিশ্বে। এর মুদ্রা, এর মূল্যবান সম্পদ এতটাই বেশি ছিল যে মধ্য প্রাচ্যের সোনার মান নির্ধারিত হত এর সাথে তুলনা করে। মুসলিম বিশ্বে এটি কেবল রোম নামে পরিচিত ছিল এবং এর প্রতি সবার আকর্ষণ ছিল। বলকান ও হাঙ্গেরির সমভূমি থেকে কিংবা রাশিয়ার বনাঞ্চল ও এশিয়ান স্টেপস থেকে বিভিন্ন উপজাতি হুনস, গথ, স্লাভ এবং গিপিডস, তাতার , তুর্কি বুলগার এবং বন্য পেচনেগস সবাই বাইজেন্টাইনের অধীনস্থ রাজ্যে ঘুরে বেড়াত। সম্রাজ্যটি একদিকে ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল, অন্যদিকে ইতালি থেকে তিউনিস পর্যন্ত ছড়িয়েছিল। তবে প্রতিবেশীদের সাথে বিবাদের জন্য কখনো এর সীমানা প্রসারিত, কখনো সংকুচিত হত। তাই আজীবন এর মানচিত্রের কোন না কোন প্রান্ত কুঁকড়ানো থাকতোই।

বাইজান্টিয়াম এমন এক সাম্রাজ্য যেখানে যুদ্ধ ছিল চিরস্থায়ী। কনস্টান্টিনোপলের অবস্থান ইউরোপ এবং এশিয়ার মাঝে হওয়ায় দুদিক থেকেই কেউ না কেউ আক্রমণ করতই। তাদের মধ্যে সবচেয়ে সবচেয়ে বেশি আগ্রহী ছিল আরবরা। ৬২৬ সালে পার্সিয়ান এবং আওভাররা এসেছিল। বুলগাররা অষ্টম, নবম এবং দশম শতাব্দীতে বারবার এসেছিল। ৯৪১ সালে আসে রাশিয়ান যুবরাজ ইগোর। গ্রীকদের কাছে একদিকে ছিল বাইবেল আরেক দিকে ছিল হোমারের "ট্রয়নগরী জয়ের মহাকাব্য"। বুঝাই যাচ্ছে, আধ্যাত্মিকতা ও কুসংস্কার দুইটাই তাদের মন দখল করে রাখত। শহরের দেয়াল রক্ষণাবেক্ষণ করা ছিল নাগরিকের দায়িত্ব। কুমারী মেরীকে ভাবা হত শহরের রক্ষক; সঙ্কটের সময়ে তাঁর মূর্তিগুলিকে সামনে রেখে প্যারেড করা হত৷ ৭১৭ সালের অবরোধের সময় কুৃমারী মেরীই শহরটিকে রক্ষা করেছিল বলে তাদের বিশ্বাস ছিল। কোরআন নিয়ে মুসলমানদের যেমন আত্মবিশ্বাস ছিল ঠিক একই রকম আত্মবিশ্বাস তাদেরও ছিল। স্থল প্রাচীরের বাইরে শিবির স্থাপনকারী অথবা অবরোধকারী সেনাবাহিনীর কেউই তাদের মানসিক ও বাস্তবিক এ প্রতিরক্ষাগুলিকে কখনো ভাঙতে পারেনি। দুর্গকে আঘাত করার প্রযুক্তি, সমুদ্র অবরোধের জন্য নৌ সম্পদ এবং নাগরিকদের না খেয়ে থাকতে পারার ধৈর্য্য সবকটির কাছেই বিরোধী পক্ষ হেরে যেত।

শহরের অবকাঠামো, সাম্রাজ্যের শক্তি এবং সঙ্কটের মুহুর্তে নেতাদের সৌভাগ্য অথবা কাকতালীয় ঘটনা পূর্ব রোমান সাম্রাজ্যর নাগরিকদের মধ্যে অপরাজেয় মনোভাব সৃষ্টি করেছিল। তবুও আরব অবরোধ তাদের মনে কিছুটা ভয় পাইয়ে দিয়েছিল। ইসলামকে অন্য শত্রুদের থেকে তারা আলাদা ভাবে দেখত। তখনকার এক লেখক ইসলামকে অ্যাপোক্যালিপ্সের চতুর্থ পশু হিসাবে ঘোষণা করেছিলেন, তার মতে "পৃথিবীর চতুর্থ রাজ্য হবে, সমস্ত রাজ্যের মধ্যে সবচেয়ে বিপর্যয়কর, যা পুরো পৃথিবীকে মরুভূমিতে রূপান্তরিত করবে।" এবং একাদশ শতাব্দীর শেষের দিকে, ইসলামই বাইজান্টিয়ামের উপর দ্বিতীয় ধাক্কাটি দেয়। তা এতটাই অনাকাঙ্খিত ছিল যে সেই সময়ে কেউই এর তাৎপর্যটি যথেষ্টভাবে উপলব্ধি করতে পারেনি। (চলবে)

মন্তব্য ৬ টি রেটিং +৪/-০

মন্তব্য (৬) মন্তব্য লিখুন

১| ২৪ শে সেপ্টেম্বর, ২০২০ দুপুর ২:১৮

রাজীব নুর বলেছেন: আপনি হয়তো মুসলিম। তাই পোষ্টে মুসলিমদের বড় করে দেখিয়েছেন।

২৫ শে সেপ্টেম্বর, ২০২০ রাত ১০:২২

রৌদ্র নীল বলেছেন: রাজীব নুর ভাই এখানে আমার কথা না। যাদের quote করা হয়েছে একজন হলেন বিখ্যাত খ্রিস্টান ধর্মবিশারদ সেন্ট গ্রেগরী অব নিসা। তিনি কনস্ট্যান্টিনোপলের কুসংস্কার নিয়ে সরব ছিলেন। কয়েকবারই কনস্ট্যান্টিনোপলের কাউন্সিলে যোগদান করেন। তখন তিনি তার বক্তৃতায় কুসংস্কার নিয়ে এই কথাগুলো বলেন। ঘোড়া সংক্রান্ত ঘটনাটা
"Constantinople: The Iconography of a Sacred City", by Philip Sherrard থেকে নেয়া। আমি নিরপেক্ষ থাকারই চেষ্টা করেছি প্রথম থেকেই। শুরুতেই বলেছি কুসংস্কার দুই ধর্মবিশ্বাসেই আছে, থাকবে। আগের পর্বগুলোতে কিন্তু খ্রিস্টান রণকৌশলেরও ব্যাপক প্রশংসা করেছি। হয়ত সামনের লেখাগুলোতে তুর্কীদের অনেক বিতর্কিত ব্যাপারগুলো সামনে আসবে। তখন আবার ধার্মিক মুসলিম যারা তারা মানতে পারবে না।

২| ২৪ শে সেপ্টেম্বর, ২০২০ দুপুর ২:২০

সাড়ে চুয়াত্তর বলেছেন: ভালো লাগছে। পরের পর্বও পড়ার ইচ্ছা রাখি।

২৫ শে সেপ্টেম্বর, ২০২০ রাত ১০:২৩

রৌদ্র নীল বলেছেন: ধন্যবাদ আপনাকে।

৩| ২৪ শে সেপ্টেম্বর, ২০২০ রাত ৯:০৩

শেরজা তপন বলেছেন: বরাবরের মতই চমৎকার! ইতিহাস পড়ে মজা পাই- লিখে যান

২৫ শে সেপ্টেম্বর, ২০২০ রাত ১০:২৩

রৌদ্র নীল বলেছেন: ধন্যবাদ আপনাকে।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.