![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
১
-কি শায়লা বেগম,ঘুম কেমন হল?
-হয়েছে মোটামুটি ভালোই।তুমি এত সকালে?বাসায় যাওনি?
-নাহ।ভাবলাম হসপিটাল থেকে মাত্র রিলিজ করালাম।রাত বিরাতে কি হয় নাহয় আবার।তো শরীর এখন ভালোতো?
-হ্যাঁ বাবা।আর তুমি যা করলে...তোমার মায়ের জন্য আমার হিংসে হয়।অনেক ভাগ্য করলে এমন সন্তানের মা হওয়া যায়।বেচারি বড় অল্প বয়সে চলে গেলেন।
-হয়েছে।রাখেন তো।মা তো মা ই।আপনিও তো আমার মায়ের মতন।ওষুধগুলো সব রেখে যাচ্ছি এখানে।নাস্তা করে খেয়ে নিবেন।আমি আসি এখন কেমন?সন্ধ্যার দিকে একবার আসব আবার।
-এসো বাবা।আজকে না এলেও চলবে।রেস্ট নাও গিয়ে।যা গেলো এ কয়দিন তোমার উপর।
এ কয়দিন তপুর উপর বেশ ভালো পরিশ্রমই গেছে বলা যায়।আজ বাসায় গিয়ে একটা ভাল শাওয়ার নিতে হবে।তারপর যতক্ষণ পারে ঘুমাবে।অফিসে আজ আর যাবেনা।ছুটি নেয়া হয়েছিল দুদিনের।আজ পাঁচদিন হতে চলল।কিভাবে ম্যানেজ করবে সব ভাবতে হবে।আদনান ভাইকে ধরতে হবে এ ব্যাপারে।ঝকঝকে রোদ উঠেছে আকাশে।হাঁটতে ভালো লাগে।শায়লা বেগমের শরীরটাও আগের চেয়ে ভালো।ভদ্রমহিলাকে নিয়ে যা টেনশন হচ্ছিল এ কয়দিন!!
শায়লা বেগম তপুর আপন কেউ নন।পরিচয়ও বেশীদিনের নয়।এই ছয় সাত মাস হবে।নিতুর সাথে ব্রেকআপের পর বেশ বিষণ্ণ কাটত দিনগুলো।প্রায় তিন চার মাস একরকম ঘরে বসেই কাটিয়েছে।কিন্তু বিষণ্ণতার বিলাসিতায়তো আর পেট চলবে না।চাকরী খুজতে গিয়ে মাঝে মাঝেই সুযোগ পেলে এলাকার পার্কটায় সময় কাটাতে আসত।বেঞ্চে শুয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতো।চোখের ইশারায় পুরনো স্বপ্নগুলো মুছে নতুন স্বপ্ন আঁকার চেষ্টা করত।কিছুদিন পরই এক ভদ্র মহিলাকে বসে থাকতে দেখত চুপচাপ।কৌতূহল থেকেই উনার সাথে পরিচিত হওয়া।কথা বলতে বলতেই জানা গেলো উনি থাকেন আশ্রয় ওল্ডহোমে।ছেলে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা।উচ্চপদস্থ হতেই হবে।মায়ের প্রতি এত আয়োজন যার সেতো আর সমাজের ছোট খাটো কেউ হবে না।উনার সাথে পরিচয়ের পর থেকেই নিজের দুঃখ বিলাসিতা দেখে নিজেরই হাসি পায় তপুর।জগতে কত কষ্ট মানুষকে ঘিরে রেখেছে।শায়লা বেগম কখনই মিনিট দশেকের বেশি নিজের কথা বলতে পারেন না।চোখের তারার ওপাড়ের সমুদ্রের নোনা জলরাশি তাকে বলতে দেয়না।তিনি জোরও করেন না।সন্তানের অমঙ্গল ঠেকাতে সব তো তাকেই করতে হবে।তিনি যে মা।
তপুর মা নেই।তাই শায়লা বেগমের সাথে সন্তানের মত সম্পর্ক গড়ে উঠতে সময় লাগেনি তেমন।সুযোগ পেলেই উনার সাথে গল্প করতে ছুটে আসে।প্রথম প্রথম ওল্ডহোমের লোকজন ঢুকতে দিত না।এখন আর ঝামেলা করে না।বরং নতুন কেউ দেখলে ভাবে তপু উনার ছোট ছেলে।হয়ত বিদেশ থেকে এসেছে।বাসা বাড়ি ঠিক করেই মাকে নিয়ে যাবে।একদিন রুম গুছাতে গিয়ে একটা ডায়েরি নজরে পড়ে তপুর।শায়লা বেগম অসুস্থ হবার পর ইচ্ছে করেই ডায়েরিটা নিয়ে এসেছে সে।নিয়াজ সাহেবকে লিখা।নিয়াজ সাহেব শায়লা বেগমের ছেলে।সুযোগ পেলেই নিয়াজ সাহেবের সাথে দেখা করার খুব শখ তপুর।মানুষ সুন্দরের পূজারী।তবু মাঝে মাঝে টাকা খরচ করে চিড়িয়াখানার জন্তুগুলোকে দেখার ইচ্ছেটাতো আসতেই পারে!!
২
তপু বসে আছে নিয়াজ সাহেবের অফিস রুমে।বেশ বড় রুম।মধ্যবিত্ত একটা ফ্যামিলি অনায়াসে সুখের সংসার পাততে পারবে এমন।রুমটা খুব শীতল।তপুর শীত লাগছে।নিয়াজ সাহেব বেশ আরামেই কাজ করছেন।দামী স্যুট যাদের গায়ে থাকে তাদের শীতের চিন্তা নেই।ঘরটা বেশ পরিপাটি।প্রতিষ্ঠানের মার্কেটিং ডিপার্টমেন্টের হেডের রুম এমনই হওয়া উচিৎ।অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে উনার সাথে দেখা করার সুযোগ পাওয়া গিয়েছে।এ নিয়ে চারদিন এসেছে এই অফিসে।তাছাড়া ফোন এ উনার পিএ এর সাথে যোগাযোগ তো আছেই।চশমাটা টেবিলে খুলে রেখে চেয়ারে হেলান দিয়ে বললেন,
-নাউ টেল মি।হাউ ক্যান আই হেল্প ইউ?
-স্যার আপনাদের নতুন মার্কেটিং ক্যাম্পেইনটার জন্য একটা গল্প রেডি করেছিলাম।পেপার থেকে জানতে পারি খবরটা।
ভ্রু কুঁচকে তাকাল নিয়াজ সাহেব।এসব ছোট খাটো ব্যাপারে কান দেয়ার সময় উনার নেই।বিরক্তি মুখে নিয়েই বললেন
-ওকে।টেল মি ইন ব্রিফ।আই হেভ আ মিটিং অন ফোর।ইউ উইল গেট অনলি টেন মিনিটস।
সময় নষ্ট না করেই গল্পটা শুরু করে তপু
গল্পটা দুজনের পরিবারের।মা আর ছেলের।বাবাকে আনছিনা।ছেলের চার বছরের সময় উনি মারা যান।ছোট বাচ্চাকে নিয়ে মা বেশ বিপদে পড়ে।লেখাপড়াটাও খুব একটা করেননি তিনি।অভাবের সংসারে মানুষ হয়েছেন।বিয়ে হয়ে যায় তাড়াতাড়ি।কিন্তু ছেলেকে বড় করতে হবে।অনেক কষ্ট করে একটা চাকরী জোগাড় করলেন।অনেক কষ্ট করে সংসার চলত তার।তবু রাতে ঘুমানোর আগে যখন ছেলে বলত মা কবিতাটা ধরোতো।মুখস্থ করেছি আজ।তখন মায়ের খুশি আর অশ্রুজল বিধাতা ছাড়া কেউ দেখত না।জীবনে অনেক স্বপ্নই তার অপূর্ণ থেকে গেছে।তবু তিনি জানতেন ছেলে একদিন তার সব স্বপ্ন পূরণ করবে।একদিন ছেলেটা পড়ে গিয়ে বেশ ব্যথা পেল।ডাক্তার বলল রক্ত লাগবে।তখন রাতের ৩ টা।মা দিশেহারা প্রায়।অবশেষে নিজের রক্তই দিবেন বললেন।ভদ্রমহিলার হিমোগ্লোবিন তখন ১১.২।ডাক্তার রাজি হচ্ছেন না।কিন্তু সন্তানকে বাঁচানো তার দায়িত্ব।কারণ তার গায়ে যে মা নামের সিলটা লেগে গেছে।পরিশ্রম,সংসারের চিন্তা,ভালো খাবারের অভাবে মায়ের শরীরটা খারাপ হতে থাকে।সন্তানের দিকে চেয়ে বিধাতার কাছে বাঁচার প্রার্থনা করতেন।তার সন্তান অনেক বড় হয়েছে।কিন্তু ভাগ্য বদলায়নি মায়ের।বরং আমি নিশ্চিত তার কাছে সেই সংগ্রামী জীবনটা অনেক সুখের ছিল।মা এখন থাকেন বৃদ্ধাশ্রমে।নিজের আলিসান ফ্ল্যাটে মাকে রাখতে বেশ বাধে সন্তানের।
কথা আর বাড়ায়না তপু।লক্ষ্য করে দেখে এসির মধ্যেও ঘামতে শুরু করেছেন নিয়াজ সাহেব।
-দেখলেন তো ১৯ ডিগ্রির মধ্যে থেকেও ঘেমে গেছেন নিয়াজ সাহেব।ভালো ইমোশন আছে।পাবলিক খাবে।আর আপনাকে বাকি গল্পটা শুনাব না।জ্ঞান বুদ্ধি অনেক আপনার।এ ডায়েরীটায় কিছু কথা লিখা আছে।পড়ে দেখবেন।
৩
মিটিং এর কথা ভুলে যায় নিয়াজ সাহেব।ডায়েরীর পাতাগুলোতে চোখ বুলাতে লাগলেন।কাঁপা কাঁপা হাতের লিখা।তবু স্পষ্ট।এ লিখা দেখেই তো তার অ আ ক খ শিখার শুরু।
১৯.৪.২০১৪
বাবা এখানে তো প্রতি মাসে একবার আসিস তুই।এবার এলে ওদের খুব করে বকে দিসতো।ঘরটা এত নোংরা।বৃষ্টি হলে বারান্দাটা দিয়ে হাঁটাও যায়না।অনেক বলেও এদের দিয়ে ঠিকমতো পরিষ্কার করাতে পারিনা।আমার নিজের শরীরও ভালোনা তেমন।সেদিন ঘোর মুছতে গিয়ে সারারাত কোমর ব্যাথায় ঘুমুতে পারিনি।তুই তো জানিসই আমি একটু ওরকম।ময়লা,অপরিস্কার কখনই সহ্য করতে পারিনা।এসব নিয়ে তোর বাবার সাথে কত ঝগড়া হত।কিরে বাবা বলে দিবিতো?
১৪.৫.২০১৪
খোকা,আজ তোর জন্মদিন ছিল।আমি ভেবেছিলাম তুই আসবি।এখানকার লোকদের সাথে কত তর্ক করে রান্না করেছিলাম।ছোট বেলায় তুই পায়েস খেতে খুব পছন্দ করতি মনে আছে?বড় হয়েও আমার হাতে কত ভাত খেয়েছিস।আজ ভেবেছিলাম তোকে নিজের হাতে খাইয়ে দিব।কিন্তু তুই এলি না।এখন কত ব্যস্ততা তোর।তবে মাঝে মাঝে অবাক হয়ে ভাবি কতটা ব্যস্ত হলে ছেলে মাকে ভুলে যেতে পারে।এটা অভিযোগ না খোকা।অভিমান।ছেলের উপর মা কখনো রাগ করতে পারেনা বোকা।আমি চাই তুই আরও বড় হ,অনেক সুখী হ।
২৭.৬.২০১৪
আচ্ছা বুড়ো বয়সে এ ধরনের খাবার খাওয়া যায়?প্রতিদিন একই নিয়মের খাবার।খেতে এখন আর স্বাদ লাগে নারে বাবা।আচ্ছা কত মেহমানও তো মাঝে মধ্যে আসে তোর বাসায়।এখান থেকে কি আমাকে দুদিনের জন্য নিয়ে রাখা যায়না তোর ওখানে?তুই ই তো এখানে আনার আগে বলেছিলি মাঝেমধ্যেই আমাকে নিয়ে যাবি।আমিতো "বৃদ্ধাশ্রম" এ আছি খোকা।এভাবে বন্দী হয়ে থাকলে কবর আর এ জায়গাটার মাঝে পার্থক্যটা কোথায় বলতে পারিস তুই?
৭.৭.২০১৪
খোকা আমার শরীরটা ভীষণ খারাপ যাচ্ছে এখন।মনে হয় তোর বাবার কাছে যাবার সময় হয়ে এসেছেরে।তোকে তো বড় করলাম।এখন নিজের খেয়াল নিজেই রাখতে পারবি।কিন্তু ঐ মানুষটাকে জীবনে সময়ই দিতে পারিনি।শেষ বেলায় এসে তোকে খুব দেখতে ইচ্ছে করে।একা একা সময় কাটাতে কাটাতে আমি ক্লান্ত।এখানে যারা আছে তাদের সবার মনে অনেক কষ্ট।কিন্তু আমার কোন কষ্ট নেই খোকা।বাবা তুই আসলে অনেক বুদ্ধিমান।পারিবারিক জটিলতাগুলো আঁচ করতে পেরেই আমাকে দূরে সরিয়ে দিয়েছিস।ঠিক করেছিস তুই।অন্যদের থেকে যখন শুনি আসলেই বুঝি চোখের সামনে সেসব দৃশ্য কোন মায়ের সহ্য করা সম্ভব না।সারা আর মাইশা কেমন আছে?দাদুমনির কথা ওরা জিজ্ঞেস করে?জিজ্ঞেস করবে কি করে বল।আমার সাথে তো ওরা মিশতেই পারেনি।আমি আগের যুগের মানুষ।আমার সাথে মেশা কি আর ওদের মানায়।এখানে তপু নামের একটা ছেলে আছে।ইদানিং ওই আমার দেখাশুনা করছে।বড় ভালো ছেলে।চিন্তা করিস না।ওকে চাকরী দিতে বা ওর জন্য কিছু করতে বলবনা তোকে।ছেলেটা এসব করছে দায়িত্ববোধ থেকে।মাকে হারিয়েছিল ছোটবেলায়।তাই মায়ের প্রতি তোর মত এত কর্তব্য পালন ওর সম্ভব হয়নি।
অনেক তো পড়াশোনা করেছিস খোকা।আচ্ছা বলত?মাকে ডাক্তার দেখানো,মায়ের খোঁজ নেওয়া এসব কি সন্তানের দায়িত্ব না?আমি এখানে অনেক কষ্টে আছি।তুই হয়ত না বুঝতে পারিস।কিন্তু আমিতো জানি।সন্তানের যত্ন আত্তির সাথে অন্য মানুষের তুলনা হয়না।সন্তান যখন দিন শেষে বাসায় এসে বলে,'মা তোমার শরীর কেমন?' প্রচণ্ড অসুস্থতার মাঝেও তখন সুস্থতা বোধ হয়।সে কথা তুই বুঝবিনা।এ নিয়ে আফসোস নেই আমার।সন্তান তো অবুঝই হয়।
ডায়েরীর এ অংশটা বেশ বড়।কিন্তু নিয়াজ সাহেবের পক্ষে আর আগান সম্ভব হয়না।যে মায়ের হাহাকারে সৃষ্টিকর্তার আরশ কেঁপে উঠে সেখানে তিনি তো মামুলি একটা মানুষ মাত্র।
৪
ঘরটা বেশ অন্ধকার।এক দিকে একটা জানালা আছে।কিছুটা আলো হয়ত আসে তবে বাতাস আসার কোন উপায় নেই।বিছানাটা ছোট তবে গোছানো।টেবিল আর কাপড় রাখার জায়গাটা কিছুটা এলোমেলো।নিয়াজ সাহেবের কাছে জায়গাটা স্যাঁতস্যাঁতে আর দম বন্ধ হওয়ার মত লাগছে।এখানেই শায়লা বেগম ঘুমিয়ে আছেন এখন।মুখটা বেশ শুকিয়ে গেছে।অসুস্থতার ছাপ স্পষ্ট।নিয়াজ সাহেবের বুকটা কেঁপে উঠছে।চিৎকার করে বলতে চাইছেন মাগো আমায় ক্ষমা করো।আস্তে করে মায়ের পায়ে হাত রাখলেন।অস্পষ্ট স্বরে শায়লা বেগম বলে উঠলেন,'কে খোকা?'
তারপরের দৃশ্য আর আবেগ বর্ণনা করার কোন বর্ণমালা প্রকৃতির জানা নেই...
৫
গাড়ি ছুটে চলছে নিয়াজ সাহেবের বাসার দিকে।পাশে বসে আছেন শায়লা বেগম।নিজেকে এই মুহূর্তে অসম্ভব ভাগ্যবান লাগছে নিয়াজ সাহেবের।অদৃশ্য একটা পাথর বুকের মাঝ থেকে মসৃণভাবে সরে গিয়েছে তার।সুখগুলো আজ আবার ভিড় করবে সেই একই ছায়ানীড়ে,মায়ের ছায়ানীড়ে।
©somewhere in net ltd.