নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

অন্ধ ছেলে, বন্ধ ছেলে, জীবন আছে জানলায় পাথর কেটে পথ বানানো, তাই হয়েছে ব্যর্থ | মাথায় ক্যারা, ওদের ফেরা ...যতোই থাক রপ্ত নিজের গলা দুহাতে টিপে বরণ করা মৃত্যু...

রুফতি তাহসিন

রুফতি তাহসিন › বিস্তারিত পোস্টঃ

মন্ত্র

১১ ই মার্চ, ২০১৭ রাত ৮:২০

১।কিছু একটা যে করতেই হবে সেটা টের পেলাম আচমকা দুপুরে। যখন নিজেকে খুঁজে পাওয়া গেল হুড নামানো জ্যম ক্লান্ত রিকশাতে। একা, অবশ্যই।

সন্ধ্যে হবে হবে বিকেলে নরম বিছানায় ঘুম ভাঙলে যেমন দিনক্ষণ গুলিয়ে যায়, মাথার ভেতরে নৈশব্দ ফেটে গিয়ে অস্বস্তি মেশানো ভালোলাগা নিয়ে জেগে উঠি- এই জনারণ্যে খুব নিঃশব্দে আমি সম্বিৎ পেলাম। পুরনো কথা যেন কিচ্ছু মনে নেই, সান্ত্বনা পুরষ্কারের মতন বুকটা ভারী অথচ খালি খালি।

স্মৃতি ফিরল খানেক বাদে, আবার ফিরলও না। গভীর সন্দেহ ধাক্কা দিতে লাগল, আমি যাকে আমি বলে ভাবছি- সে কি সত্যিই আমি! নাকি চিরকাল ধরে শুধু জন্মেই যাচ্ছি একের পর এক পথচলতি জ্যামে আটকানো রিকশাতে? যানবাহনে? আমার এই একাকীত্ব, এ কি একজন্মের সঞ্চয়? হতে পারে ? কখনো?

নিজের হাত পায়ের দিকে তাকিয়ে নিশ্চিত হলাম। আচ্ছা, আমরা যে কথায় কথায় বলি “শরীর কিছু না , শরীর কিচ্ছু না” , অথচ শেষমেশ শরীরটাই বোধহয় একমাত্র – যা কিছু নিজের সেই লিস্টে।

চেনা চেনা দীর্ঘঃশ্বাসের মতন হাতের রেখার দিকে তাকিয়ে দাবদাহ টের পেলাম। আচ্ছা, যাচ্ছিটা কোথায় আমি? শিউরে উঠলাম। বিড়বিড় করে আউড়ে নিলাম আমার মন্ত্রখানা।

২।

সমস্যাটা আসলে আমারই। আমিও বুঝি। কেউ যখন এসে বলে, আহারে! কি যে দুঃখে আছি... তিনদিন মুখে ঘাঁ, খাইতে পারি না- আমার হাসি পায়। রাগ হয়। কাউকে বলতে পারি না রাত তিনটার সময় ইনহেলার হাতে দেয়ালে ঠেস দিয়ে ‘আরেক দফা’র অপেক্ষা করতে কেমন লাগে, সামান্য দৌড়ালে পরে ফোঁপানির মতন শব্দ হয়- নিজেকে ঘেন্না লাগে যে কত কেউ জানে না। জন্ম থেকেই শ্বাসের কষ্ট, অথচ আজো অভ্যেস হল না। ইনহেলার টেলার মাদকের মতন লাগে আমার কাছে- রোজ ডোজ না বাড়ালে আর কাজ করতে চায় না যেন। ঝরঝর করে জল ঝরে চোখ দিয়ে, নিজেকে আরো ঘেন্না করে ফেলি আমি।
বিশাল বাড়িতে নিজের বাবা মা ভাই মেশানো বাতাসে কি কঠিন একটু একান্ত নিজের জায়গা পাওয়া, সুখ নয় শান্তি নয় - সামান্য স্বস্তির জন্যে নিজের ভেতরের তোলপাড় যারা না অনুভব করেছেন তারা এই দুঃখী মানুষকে চেনেন না।

এখন আমি একা একটা ভাড়া বাসায় থাকি। সারাঘরে নিজের গায়ের গন্ধ-জানি, টের পাই না। বিড়ির উৎকট গন্ধটাই নাকে আসে। আজকাল চিন্তা টিন্তাও করতে পারি না ভালো করে। বিড়ি ধরিয়ে বসে থাকি। একা। বাসার উল্টোদিকের দোকানদারটাও বোধহয় আমাকে দেখতে পারে না। ওই মাছঅলাটা, সেই মাস্তান মতন ছেলেটা- লিস্টটা বড়ই হবে। এলাকায়, গলিতে সবসময় একটা অদৃশ্য চোখ যেন ঘৃণা ভরে দেখে যাচ্ছে আমাকে। নাকি বিতৃষ্ণায়?

রোজ দুপুরে আমার একলা লাগে। দুপুরবেলা আমি বাড়ি, এই চেনা নিঃসঙ্গতা ছেড়ে বেরই। এরকমই এক আচমকা দুপুরে আমি টের পেলাম আমি রিকশাতে বসে থাকতে ভালবাসি। যে রাস্তায় জ্যাম পড়বে সেই রাস্তায় রিকশাতে বসে জ্যাম দেখি। একসময় বাড়ি ফিরে আসি। এরমধ্যে বুয়া- যার সাথে আমার কখনো কোন ফিজিক্যাল ঘটেনি, আমাকে দেখলে ভূত দেখার থেকেও চমকে যায়, এসে রেঁধে আর ঘর ঝাট দিয়ে চলে যায়। আমার গল্পের বই পড়তে আর ভালো লাগে না, এককালে লাগত ভেবে হাসি পায়। পায়ও না। হাসতে কেমন লাগে ভুলে গেছি। কাঁদতে কেমন লাগে মনে নেই, শুধু রোজ রাতে শরীরের কষ্টে চোখে জল গড়ায়। একে কান্না বলে না। হাসি নেই, কান্না নেই- পেয়েছি মন্ত্র। বিড়বিড় করে, যখন খুশি তখন- আমার আছে মন্ত্র!

আমি , একজন মানুষ, আহসান হাবীব, সাক্ষ্য দিচ্ছি আমাকে যে, আমি বেঁচে আছি। উদ্দেশ্য নেই, ফোকাস নেই যে আগুন জ্বলবে- শুধু বেঁচে থাকা।

৩।
ক্যাম্পাস বন্ধ। ভিসির অপসারনের দাবিতে আন্দোলন চলছে, হল ভ্যাকান্ট। আমার কোথাও যাওয়ার ইচ্ছে নেই। বাসাতেই আছি, বাড়ি যাই নি। যাওয়ার মতন নেইও অবশ্য। তাও মা যদ্দিন ছিল সে ই চিল্লাচিল্লি করে বাসায় নিয়ে যেত। কোনকালেই কারো সাথে খুব ভাব-ভালোবাসা ছিল না। আর সবাই যেরকমভাবে মা'কে ভালবাসত, আমি বাসতাম না। কত রাত মা আমাকে ধরে কাঁদতে কাঁদতে ঘুমাতে পারে নি- কত রকম কষ্ট মানুষের- সেসব কিছু আমাকে স্পর্শ করত না। বিরক্ত হতাম। বাড়িতে প্রতিনিয়ত চলতে থাকা নানান ঝড়ে দুর্বলতম প্রতিপক্ষ আমার অসহায় মা। আমি তো নই। হেরো লোককে ভালবেসে লাভ কী- মা কে আমি ভালবাসিনি। তার অসহায়ত্ব, হেরে যাওয়া এইসবের প্রতি চিরকাল রাগ করেছি। মা জানেও। তবু, ওরও কোথাও কেউ ছিল না- একমাত্র আমি ছিলাম যে কিছুটা দুর্বল... অত আঘাত টাঘাত করে না। অথচ, সবচেয়ে দুর্বল মানুষটা যাকে ধরে বাঁচে সে তো আর মানতে পারে না ব্যপারটা- আত্মসম্মানে লাগে। সুতরাং বাড়ির বাকিদের ভয় করতাম, ঘৃণা করতাম আর, মা'কে অবজ্ঞা।

আজকে মা'র কথা এত আসছে কেন? মৃত্যু দিবস টিবস নাকি? মহিলার জন্মদিন কবে আমি কেন, সে নিজেও জানত কি না আমার সন্দেহ আছে। মৃত্যুদিনটা অবশ্য সব্বাই জানি। লোকে বলে হৃদক্রিয়া বন্ধ হয়ে মৃত্যু। তা মানুষ মরে গেলে হৃদযন্ত্র ক্রিয়া করে না ই বটে!

মা'কে ভালবাসিনি কখনো...মাঝেমধ্যে দুঃখ হয় ওর জন্য। একমাত্র সেই ছিল আমার জ্বর হলে যায় আসত। না, জ্যোতিষী ছিল না সে, পলে পলে গায়ে হাত দিয়ে দেখলে সে আপনিও পারতেন! কি যে বিরক্ত লাগে... জ্বরের ভাব দেখলেই হাজার বকবক! নাহ, সেসব মিস ফিস করি না খুব একটা- এমনই অকিঞ্চিৎ ভালবাসা দিয়ে ঘিরে থাকত আমার মা। ভালবাসাকে বিরক্তি হিশেবে ফিরে পাওয়ার দারুণ প্রতিভা নিয়ে জন্মেছিল মহিলা।
তখন সদ্য মন বিগড়েছে, মৃত্যুর পরের জীবন নিয়ে ঘোর সন্দেহ। মা'কে অপদস্থ করবার এ আরেক হাতিয়ার। তুখোড় বাগ্মীর মতন একের পর এক যুক্তি দিয়ে যাচ্ছি, অসহায়ের মতন শুনে যাচ্ছে মা। শেষমেশ আর্তনাদের মত বলল, এত কষ্টের কোন প্রতিদান নাই! কিচ্ছু নাই! এও হয়?

তখন একবার বুকে ধাক্কা দিয়েছিল কিছু একটা। দুনিয়ার সবার দুঃখ কষ্ট সমান- এই থিওরীতে আর যে ই হোক আমি তো আস্থাবান নই! প্রবল মায়া আচ্ছন্ন করে দিল প্রৌঢ়ার প্রতি।
মোবাইলে যখন শুনলাম মা'র খবরটা- প্রথম মাথায় এসেছিল ওরই একটা গল্প। একবার ভাত খেয়ে উঠে যাচ্ছি, প্লেটে পড়ে আছে অল্প কিছু দানা। মা বলল, "ওই কয়টা ভাতে একটা মুরগীর বাচ্চার পেট ভরে যায়!"
শুনে আবার খেতে বসে যাই নি যদিও, খানিকক্ষণ কেমন কেমন করেছিল ভেতরটা।
সেদিনকে কেন এত রেখে এই কথা ই মাথায় এল জানি না- মরাবাড়ি (নিজের বাড়ি বলতে ইচ্ছে করে না) পৌঁছে আবার মনে পড়ল। সেইসাথে চারিদিকে চেনা চেনা লোকজনকে দেখে হাসি পেল।
একটা চেয়ারে দেখলাম বাবা, যথাসাধ্য গম্ভীর। দুপক্ষেরই থেকে আত্মীয় এসেছে.. দুঃখী মানুষের জন্যে কাঁদবার লোক থাকে না- এমনকি টাকা পয়সা থাকলেও থাকে না! দুঃখী মানুষ মাত্রেই হেয়, ইনফেরিয়র- এবং "হয়তো মানুষটা ভালোই,কিন্তু আমার কেউ না"। সব লোকজন বেশ বিব্রত... কেউ কান্নাকাটি না করলে শান্তনা দেয়ার ছল করে যেটুকু দায়িত্ব পালন করার তাও তো দায় হয়ে যায়। এমনই অপমানের মধ্যে পড়ে ছিল শান্ত চুপচাপ ছোট্টখাট আমার মা। বিনা চিকিৎসায় মরে যাওয়া কোটিপতির বৌ। কেবলই মনে হচ্ছিল মা কোন অসুখে মরেছে, কাউকে জানায়নি। সে বেচারি ভেবেছিল সব সত্ত্বেও বুঝি কেউ খেয়াল করবে, রোজকার জীবনযাপনে তীব্র ব্যথা লুকিয়েছে ও যাতে কোন ঝামেলা সইতে না হয় কাউকে। কিংবা...
চোখের নিচে কালশিটে পড়া মা'র মুখের দিকে তাকালাম.... কত অভিমান নিয়ে কবরে যাচ্ছে এই শরীর! কত অনির্বচনীয় কষ্টের ইতিহাসের সমাধি হবে আজ! মা'র দুঃখগুলোর অনেকটা তো আমারও ছিল... নিজেকে আপন না ভাবতে শিখে বড় বেঁচে গেছি- সেইভাবে ছোঁয় না। এই অসহায় মহিলা একা গুমরে মরেছে চিরকাল।
সেদিন খুব করে টের পেলাম মা'কে ভালবাসি। এই জন্মদুঃখিনীকে বড়ো ভালবাসি।

৪।

মা'র কথা মনে পড়ে আচ্ছন্ন হয়ে শুয়ে ছিলাম। বাইরে প্রথাগত বসন্ত এসেছে।
চেষ্টাচরিত্র করে নিজেকে ঠেলে দিলাম রাস্তায়। বিড়বিড় করে নিজের মন্ত্র পড়ে এগুচ্ছি মানুষের ভীড়ে। যেন মানুষের ওই ওইখানটাতে কেউ বুঝি দেবদূত পাবো, কিছু একটা ঘটবে। মানুষের হাতেই বুঝি জাদুর কাঠি, আমার দিন ভালো যাবে!

রাস্তায় নেমে দেখি উৎসব করে ওরা রাস্তা সারাচ্ছে। উত্তপ্ত পিচ থেকে ধোঁয়া উড়ে যাচ্ছে। উৎসব সাইডে রেখে রাস্তা পার হলাম। চায়ের দোকানের ক্যারম বোর্ড সচল। এক খুকী বাবার সাথে এসেছিল বোধহয়, এখন বসে বসে বাশির সাথে লাগানো বেলুনে ফুঁ দিয়ে হাসছে। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে দেখলাম। ওর ম্যাচিং ড্রেস বোনও এসে গেল দেখছি- বেলুনে মন নেই তার, সে দোকানদারের কাছে বায়না জুড়েছে কোন খাবার নিয়ে। ওদের পেরিয়ে গেলাম। স্টেশন। ট্রেন নেই এখন।
তখন আমার হঠাত করে অনেকদিনের উলটে রাখা গল্পের বইটার কথা মনে হল। ইচ্ছে হল বাড়ি গিয়েই ওটা সোজা করে দেব, কে জানে পাতা টাতাও বুঝি বেঁকে গেছে। জানলায় শুকাতে দেয়া কাপড়টা?
"ধুস!"
আমি মাথায় দু'হাত দিয়ে চাপ দিলাম। শুধুমাত্র আমার ইশারার অভাবে হয়তো হাতছাড়া হয়েছিল কোন হাতাকাটা রাজকন্যে। ময়মনসিংহ জং লেখা যে কোনাটায়- একগাদা ময়লা, সেখানে তার ভাই রোজ পেচ্ছাপ করে। নানান রকমের। অত কিছু কে দেখতে যায়- দু'টো ছোঁড়া ভিক্ষে চাইতে এসেছিল। আর ট্রেনটাও আসতে দেরী করছে।
আমি একটু জোরে আউড়ালাম আমার মহার্ঘ মন্ত্র: "খানকির ছেলেদের জানবি মুড ফুড নিয়ে কোন চুদুরবুদুর নেই। আচে খালি মজা।"

মন্তব্য ০ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.