নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

গবেষক, পাঠক ও লেখক -- Reader, Thinker And Writer। কালজয়ী- কালের অর্থ নির্দিষ্ট সময় বা Time। কালজয়ী অর্থ কোন নির্দিষ্ট সময়ে মানুষের মেধা, শ্রম, বুদ্ধি, আধ্যাত্মিকতা ও লেখনীর বিজয়। বিজয় হচ্ছে সবচেয়ে শক্তিশালী চিন্তার বিজয়।

*কালজয়ী*

সভ্যতার উৎকর্ষ শুরু মানুষের মেধা, শ্রম, বুদ্ধি, আধ্যাত্মিকতা ও লেখনীর মাধ্যমে। ক্রম উন্নয়নের ধারায় শিক্ষা-ক্ষেত্রে কলমের কালীর রং কখনো কালো, কখনওবা সাদা। প্রাথমিক যুগে আবক্ষ শক্ত ভিত্তিতে (ব্লাকবোর্ডে) লিখতে ব্যবহৃত হত সাদা চক যা এখনো বিদ্যমান। বর্তমানে সাদা বোর্ডে কালো মার্কার কলম ও কালো বোর্ডে সাদা মার্কার কলম। কি-বোর্ডে সাদা-কালো অক্ষর বাটন নব প্রযুক্তির অবদান। Believes in the ultimate potential of Human Mind……

*কালজয়ী* › বিস্তারিত পোস্টঃ

শিক্ষাক্ষেত্রে নয়া ক্লাসিক্যাল অর্থশাস্ত্র বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়াদের জন্য অশনি সঙ্কেত

০৭ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ রাত ৮:১৫

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সাম্প্রতিক ছাত্র-আন্দোলনের কারনে যে বিষয়টা সামনে চলে আসে তা হচ্ছে গ্রাম কিংবা মফস্বলের গরীব মেধাবী ছাত্ররা উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে পারবে কি না। কেননা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে বেতন ফি বৃদ্ধির প্রসঙ্গ গ্রাম কিংবা মফস্বলের ছাত্র-ছাত্রীদের সাথে সম্পর্কিত। এটা আমরা জানি যে বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে আসা ছাত্রছাত্রীদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশই আসে মধ্যবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে। এই পরিবারগুলো তাদের সন্তানদের পড়াশুনার জন্য রাষ্ট্রীয় ভর্তুকি ও সামাজিক পৃষ্ঠপোষকতার উপর বহুলাংশে নির্ভরশীল। অনেক সময়ই আমাদের পিতামাতা অন্যের থেকে ধার দেনা করে আমাদের পড়ালেখার জন্য অর্থের যোগান দেন। আর রাষ্ট্র কম টাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ তৈরি করে দিয়ে পড়ালেখা অব্যাহত রাখতে সহায়তা করে। রাষ্ট্র এখানে ছাত্র বা পরিবার গুলোর জন্য অভিভাবক হিসেবে কাজ করে। যেখানে ছাত্র-ছাত্রী তাদের শিক্ষাজীবন শেষ করে এই রাষ্ট্রেরই দেখভাল করার দায়িত্ব নেয়। রাষ্ট্রের দেখভাল মানে পরবর্তিতে রাষ্ট্র চালানোর জন্য দক্ষমানব সম্পদ গড়ে তোলা যারা কিনা তাদের পরবর্তী জেনারেশন তৈরি করবে। এমতাবস্থায় রাষ্ট্রীয় ভর্তুকি হ্রাস করার অর্থ হল গরীব মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীদের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ হ্রাস করা। আমাদের সামনে কিছু উদাহরণও রয়েছে। যেমন, নোয়াখালি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভাগ আছে ৪টি। বেতন ও ভর্তি ফি হলো ২০২০০ টাকা এবং সেমিস্টার ফি বাবদ দিতে হবে ৫০০০ টাকা। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনে বলা হয়েছে: বার্ষিক পরিচালনা ব্যয় নিরিখে বেতন-ফি নির্ধারন করা হবে। রাষ্ট্রীয় ভর্তুকী ক্রমশঃ তুলে নেয়া হবে এবং পঞ্চম বছর হতে শতভাগ ব্যয়ভার বিশ্ববিদ্যালয়কে বহন করতে হবে(আরশাদ আলী) ।; এভাবে উচ্চশিক্ষার চূড়ান্ত বাণিজ্যিকীকরন করা হচ্ছে। যার ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে সরাসরি গ্রাম থেকে আসা ঐ ছাত্রটি যার বাবা কৃষক কিংবা যার অভিভাভক বলতে আগে ছিল রাষ্ট্রীয় সুবিধা। বিশ্বব্যাংকের পরামর্শক্রমে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে রাষ্ট্রীয় সুবিধা হ্রাস করার পক্ষে। সেজন্য তারা তাদের তৎপরতা অব্যাহত রেখেছে। এমতাবস্থায় বিশ্বব্যাংকের পরামর্শ আমাদের দেশের জন্য কতটুকু সুফল বয়ে আনবে তা পর্যালোচনা জরুরি হয়ে পড়েছে।



উচ্চ শিক্ষার কৌশলপত্র ও ইউজিসি



বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে বেতন ফি বাড়ানো হলে ছাত্র আন্দোলন হয়। কোন কোন শিক্ষাবিদ এই আন্দোলনকে সমাজতন্ত্রের মন্ত্রে দীক্ষিত বলে তুলে ধরেন। আবার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আন্দোলনকে শিবিরের হাতে চলে যাওয়ার বিষয় প্রচার করেন। এই দুই ধরণের বক্তব্যেরই উদ্দেশ্য হচ্ছে মূল ইস্যুকে আড়াল করা। আর তা হচ্ছে উচ্চশিক্ষার বাণিজ্যিকীকরনের মাধ্যমে সাম্রাজ্যবাদী আধিপত্যকে নিশ্চিত করা। এই ছাত্র আন্দোলনের সম্ভাবনাকে মাথায় রেখে কৌশলপত্রের চার পর্বে উচ্চশিক্ষার ‘সংস্কার’ বাস্তবায়নের পরামর্শ দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন (ইউজিসি)।; প্রস্তাবিত চার পর্ব হচ্ছে: প্রাথমিক পর্ব ২০০৬-২০০৭, স্বল্প মেয়াদী ২০০৮-২০১৩, মধ্য মেয়াদী ২০১৪-২০১৯ ও দীর্ঘ মেয়াদী ২০২০-২০২৬।; এই চার পর্ব আকারে করার উদ্দেশ্য হল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় গুলোকে ধীরে ধীরে প্রাইভেটাইজেশনে পরিণত করার বাধা দূর করা। কিন্তু মাঝে মাঝেই ছাত্র আন্দোলন এই উদ্দেশ্যকে নস্যাৎ করে দেয়। ফলে ওয়ার্ল্ড ব্যাংক ও আইএমএফের আরেকটি গুরুত্বপুর্ন পরামর্শ হল ছাত্ররাজনীতিকে ধীরে ধীরে সংকুচিত করা। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনায় ছাত্রলীগকে ব্যবহার করে তারই আঞ্জাম দেয়া হয়েছে। যেখানে ছাত্ররাজনীতিকে কলঙ্কিত ও পারস্পরিক জিঘাংসাপুর্ণ করে উপস্থাপন করা হয়েছে। আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার সামনে চলে এসেছে।



বস্তুত ওয়ার্ল্ড ব্যাংক ও আইএমএফ চায় না যে তাদের নিয়মনীতির বিরুদ্ধে কোন কার্যকলাপ অব্যাহত থাকুক। আর এটা যদি ছাত্র-রাজনীতিকে সামনে রেখে হয় তবে তা আরও ভয়ানক। তাই তারা সহিংসতা ও অপকার্যকলাপকে সামনে এনে ছাত্ররাজনীতি বন্ধের সুপারিশ করে। তারা এযুক্তি দিতেও ভুল করে না যে, পাশ্চাত্যের বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে তো ছাত্র রাজনীতি নেই। তারা কি উন্নয়নে উচ্চে উন্নীত হয় নি ? কিন্তু তারা এটা বলে না যে, তাদের ঐ শিক্ষাপদ্ধতি কেবলমাত্র অভিজাত কিংবা বিত্তবান শ্রেণীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ। তাই এই কৌশলপত্র প্রগতিশীল ছাত্ররাজনীতি বন্ধেরও সুপারিশ করে। যার কারণ তারা অন্যত্র উল্লেখ করে যে, ছাত্ররাজনীতির কারণে বেতন ফি বৃদ্ধি করতে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়।



ইউজিসির এই সুপারিশ প্রণয়নকারীদের মধ্যে অধিকাংশই হলো বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি, শিক্ষক, ব্যবসায়ী, আমলা ও এনজিও সম্পর্কিত ব্যক্তিবর্গ। এদের অধিকাংশেরই শ্রেণী অবস্থান আগে ভিন্ন থাকলেও পরিবর্তিত অবস্থানের মধ্যেই তারা থাকতে আগ্রহী হন। তাদের এই অবস্থান পাশ্চাত্যের অর্থনৈতিক উন্নয়ন দর্শনকে আমাদের মত দেশগুলোতে প্রমোট করতে আগ্রহী। তাদের এই শ্রেণী পরিবর্তন বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গির উন্নয়নের ফলেই সম্ভব হয়েছে। এখানে শ্রেণী অবস্থান শ্রেণী চেতনা তৈরি করে নি। বরং শ্রেণী চেতনা নির্ধারিত হয়েছে বস্তুবাদী দর্শনের নিরিখে। তাই বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি, শিক্ষক, ব্যবসায়ী, আমলা ও এনজিও সম্পর্কিত ব্যক্তিরা এখানে বস্তুবাদী দর্শন ও পাশ্চাত্যের কর্পোরেট পুঁজিবাদী উন্নয়ন নোশন বিস্তারের কাণ্ডারি হিসেবে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন।



এই কৌশলপত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ আয় বৃদ্ধিকে গুরুত্বারোপ করে। যার মর্মকথা হল বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে রাষ্ট্রীয় ভর্তুকির হার হ্রাস করা। আর ভর্তুকি হ্রাস করা হলে আয় বৃদ্ধির উপায় হিসেবে ছাত্র-ছাত্রীদের কাছ থেকে বেতন হিসেবে গৃহীত অতিরিক্ত অর্থ আসবে। তখন বেতন বাড়ানোটা আবশ্যক হিসেবে দেখা দেবে। তাই এই কৌশলপত্র নিশ্চিত করে যে, উচ্চশিক্ষায় রাষ্ট্রীয় ভর্তুকী ধাপে ধাপে ৫০ শতাংশ হ্রাস করা হবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে অভ্যন্তরীণ খাত থেকে বাকী ৫০ শতাংশ ব্যয় বহন করতে হবে। এ আয় বাড়ানো হবে প্রধানত ছাত্রদের বেতন ফি বাড়িয়ে। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের জমি, ভবন লীজ দিয়ে, চত্বর ভাড়া দিয়ে, ক্যাফে, সাইবার ক্যাফে, বই ইত্যাদির দোকান দিয়ে, সান্ধ্য কোর্স চালু করে ও এলামনাইদের কাছ থেকে বাজেটের অর্থ সংগ্রহ করা হবে। এর ফলে যা হবে তা হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষকদের গবেষণার হার হ্রাস পাবে। যেখানে টাকা বা অর্থের সম্ভাবনা আছে সেখানেই ছুটবেন শিক্ষকেরা। এর ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বাভাবিক শিক্ষার পরিবেশ ব্যাহত হবে।



সান্ধ্য কোর্স চালুর ব্যাপারে অনেকেই বয়স্কদের সান্ধ্যকালীন স্কুলের কথা বলেন। বয়স্কশিক্ষার প্রসঙ্গ এনে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সান্ধ্যকালীন শিক্ষার পক্ষে যুক্তি দেন। কিন্তু তারা একথা ভুলে যান যে, বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র-ছাত্রীরা মেধার সাক্ষর রেখে ভর্তি হন। প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় (প্রতিটি সিটের বিপরীতে থাকে প্রায় ৩৫-৪০ জন প্রার্থী) উত্তীর্ণ হয়ে তারা বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তি হন। যদি সান্ধ্যকালীন কোর্সের মাধ্যমে অপেক্ষাকৃত কম মেধাবীদের সুযোগ করে দেওয়া হয় তবে চাকরির বাজারে যে বৈষম্য তৈরি হবে তা তারা বেমালুম ভুলে যান। কেননা যে ছাত্র প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে সার্টিফিকেট পেল আর যে ছাত্র টাকার জোরে সান্ধ্যকালীন কোর্সে ভর্তি হয়ে সার্টিফিকেট পেল দুইটা কি করে সমান হয়। এই বৈষম্য আপনি কি করে ঘুচাবেন। আপনি বলতে পারেন সান্ধ্যকালীন কোর্সেও প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার আয়োজন করা যায়। কিন্তু সান্ধ্যকালীন কোর্স খোলাই তো হয়েছে অর্থ কামানোর জন্য। সেখানে আপনি কি করে অর্থ উপার্জনের আকাঙ্ক্ষা থেকে শিক্ষকদের নিবৃত্ত করবেন। এইভাবে আপনি যদি তাদের অর্থের নেশা থেকে নিবৃত্ত করতে যান তখন আপনিও নিগৃহীত হবেন। তাই এযুক্তি কখনই ধোপে টেকে না যে, অর্থের নেশা কাজ করবে না। আর যেই শিক্ষকেরা দিনের বেলার ক্লাস, পরীক্ষা ঠিকমত নিতে চান না তাদের জন্য সান্ধ্যকালীন কোর্সের বোঝা যে দিনের বেলার ছাত্রদের জন্য দুর্ভোগ ডেকে আনবে না একথা বলা যায় না। তখন দিনের বেলার ছাত্রদের জন্য ক্লাস, পরীক্ষা সবকিছুতেই বিলম্ব হবে। আমাদের বিভাগে এখন সান্ধ্যকালীন কোর্স নেই। এতেই ক্লাস পরীক্ষায় বিলম্ব হচ্ছে। আর যদি সান্ধ্যকালীন কোর্স চালু হয় তখন বিলম্ব আরও বেশি হবে। আর একবার সান্ধকালীন কোর্স চালু হয়ে গেলে তা বন্ধ করাও কঠিন হয়ে যাবে। তাই এই কোর্স চালুর আগেই প্রতিবাদ, প্রতিরোধ জরুরি।



নয়া ক্লাসিক্যাল অর্থশাস্ত্র, বিশ্বব্যাংক ও উচ্চশিক্ষার কৌশলপত্র



বিশ্বব্যাংকের প্রাতিষ্ঠানিক বিশ্বাস কাঠামো, বিশ্লেষণ পদ্ধতি ও নীতিমালার মূল ভিত্তি হচ্ছে নয়া ক্লাসিক্যাল অর্থশাস্ত্র। নয়া ক্লাসিক্যাল অর্থশাস্ত্রের গোঁড়া অবস্থানে রয়েছে ‘অস্ট্রিয়ান ও শিকাগো স্কুল অফ থট’। ৭০ এর দশকের পর থেকে বিশ্ব অর্থনীতিতে নয়া ক্লাসিক্যাল ধারার অনুপ্রবেশ ঘটে। এখানকার তাত্ত্বিকদের মধ্যে রয়েছেন এল মাইসেস, ফ্রেদারিক হায়েক, মিল্টন ফ্রেডম্যান। তারা নয়া ক্লাসিক্যাল অর্থশাস্ত্রকে মতাদর্শ মুক্ত বিজ্ঞান বলে মনে করেন। এই অর্থশাস্ত্র মুক্তবাজার অর্থনীতিতে দৃঢ়বিশ্বাসী। তারা যে বিষয়গুলোর অবসানের জন্য গুরুত্বারোপ করেন তা হচ্ছে, (১) বিদেশী সংস্থা সমূহের উপর কর, (২) বিনাবেতনে শিক্ষা, (৩) সামাজিক নিরাপত্তা, (৪) খাদ্য ও ওষুধের বিশুদ্ধতার জন্য সরকারের নিয়ন্ত্রণ, (৫) প্রাকৃতিক দুর্যোগে সরকারের প্রকল্প, (৬) নূন্যতম মজুরি আইন (ফ্রেডম্যান; ১৯৬২, ১৯৯০)।(আনু মুহাম্মাদ)।



মিল্টন ফ্রেডম্যান শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতে ব্যয়ের জন্য মার্কিন সরকারের কঠোর সমালোচক। পুঁজিবাদ ও বাজারের স্বাধীনতার ব্যাপারে ফ্রেডম্যান এতই আপসহীন যে, যুক্তরাষ্ট্রকেও তিনি ৪০ ভাগ সমাজতন্ত্রী বলে মনে করেন। যুক্তরাষ্ট্র নিজেও সেবাখাতে ব্যয় করতে আগ্রহী নয়। কিন্তু তারা সেবাখাতে ব্যয় বাড়িয়েছে সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নকে মোকাবেলা করতে গিয়ে। কেননা সোভিয়েত ইউনিয়নে তখন রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সেবাখাতের অস্তিত্ব ছিল। কিন্তু ফ্রেডম্যান সেটাও মানতে রাজি নন। তারা মনে করেন, মানুষের আচরণের মূলকথা আসলে বিনিময়। যেহেতু সকল মানবিক আচরণের মূল হচ্ছে বিনিময়, সুতরাং শিক্ষা-দীক্ষা স্বাস্থ্য সকল খাতে ব্যয়ের উদ্দেশ্য হবে সম্পুর্ণ বিনিময়ের উপর ভিত্তি করে। অর্থাৎ শিক্ষা গ্রহণের জন্য শিক্ষার্থীরা ভর্তি হবেন তাদের শিক্ষা গ্রহণের সম্পুর্ণ অর্থ পরিশোধের ভিত্তিতে। শিক্ষা ও অর্থ বিনিময় হবে বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে। এখানে কোন নিরঙ্কুশ সেবার অস্তিত্ব থাকবেনা। কিন্তু আমাদের মত দেশগুলোতে শিক্ষা একটি মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃত। এখানে কখনই শিক্ষা শুধুমাত্র বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে স্বীকৃত ছিল না। এর একটি সেবামূলক দিক সবসময়ই ছিল। আর তা হচ্ছে রাষ্ট্রীয়ভাবে ভর্তুকি প্রদান করে গ্রামের দরিদ্র মেধাবী ছাত্রদের শিক্ষার সুযোগ করে দেওয়া। উচ্চশিক্ষার পথ প্রশস্ত করার জন্য শিক্ষা বৃত্তি প্রদান। খাদ্যের বিনিময়ে শিক্ষা কর্মসূচি। এটা যেমন প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে তেমনি উচ্চ শিক্ষায়ও ভর্তুকি আকারে বিদ্যমান। ফলে শিক্ষা সমাজের সকল শ্রেণীর মানুষের জন্য সুযোগ হিসেবে দেখা দিয়েছে। তাই একথা আপনি বলতে পারবেন না যে, গ্রামের ঐ দরিদ্র ছেলেটির বা মেয়েটির উচ্চ শিক্ষার কোন প্রয়োজন নেই।

বিশ্বব্যাংক যেহেতু নয়া ক্লাসিক্যাল অর্থশাস্ত্রের নোশন দ্বারা পরিচালিত, সুতরাং নয়া ক্লাসিক্যাল অর্থশাস্ত্রের ধরন বিশ্লেষণের উপর নির্ভর করবে এটি আমাদের মত দেশগুলোর সামাজিক উন্নয়নের জন্য প্রতিভূ হিসেবে কাজ করবে কিনা। নয়া ক্লাসিক্যাল অর্থশাস্ত্র সমাজকে বিবেচনা করে কিছু হিসেবি ব্যক্তির সমষ্টি হিসেবে যাদের সামাজিক দায়বদ্ধতার হার নেই বললেই চলে। এরা সমাজের মানুষের মধ্যে অব্যাহত কৃত্তিম উপযোগ বা প্রয়োজন তৈরিতে ব্যস্ত। কেননা কৃত্তিম প্রয়োজন তৈরি হলে মুনাফা বৃদ্ধি করা সহজ হয়। তাই তারা সামাজিক সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের পরিবর্তে মুনাফা বৃদ্ধি করে এমন ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের সম্প্রসারণ করছে। যাতে করে মুনাফার সর্বোচ্চকরন সম্ভবপর হয়। মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্ক এখানে অর্থের মাপকাঠিতে বিচার্য হয়। শিক্ষা, স্বাস্থ্য প্রভৃতি সেবার বিনিময় হবে অর্থের ভিত্তিতে, মানবিকতার ভিত্তিতে নয়। ফলে মুনাফা বৃদ্ধি করা তাদের জন্য আবশ্যক হিসেবে দেখা দেয়। আমাদের মত দেশগুলোতে যেখানে শিক্ষা একটি মৌলিক মানবাধিকার হিসেবে স্বীকৃত, তা সীমাবদ্ধ হয়ে পড়বে মুষ্টিমেয় কিছু মানুষের হাতে। শিক্ষা তখন আর সার্বজনীন থাকবে না। শিক্ষা হয়ে পড়বে বিত্তবান শ্রেণীর বিলাসিতার হাতিয়ার। ফলে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ যারা নিপীড়িত, নির্যাতিত, শোষণের স্বীকার তারা বিত্তবান শ্রেণীর শোষণের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো ছাড়া পথ পাবে না।



সামাজিক প্রতিষ্ঠানের (স্কুল,কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, হাসপাতাল) অস্তিত্ব সমাজের মানুষের কাছে শুধুমাত্র অর্থের মাপকাঠিতে বিচার্য হয় না। বরং এর একটি মানবিক ও সেবামূলক দিক রয়েছে। মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্ক এখানে শুধুমাত্র পারস্পরিক আদান প্রদানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। মানুষ মানুষের পাশে এসে দাড়ায়, সাহায্যের হাতকে প্রসারিত করে, রাষ্ট্র ভর্তুকি দেয়, সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের সম্প্রসারণ করে যা বাংলাদেশে ঐতিহ্যগত মূল্যবোধ হিসেবে স্বীকৃত ছিল। যেখানে ধর্মশাস্ত্রের গুরুত্বের অস্তিত্বকে অনস্বীকার্য বলে গণ্য করা হত। কিন্তু তাও আর থাকবে না যদি শিক্ষাক্ষেত্রে নিওলিবারেল পলিসি তথা নয়া ক্লাসিক্যাল অর্থশাস্ত্রের বাস্তবায়ন শুরু হয়।



ইউজিসির কৌশলপত্রের সবচেয়ে ক্ষতিকর দিকটি হলো উচ্চ শিক্ষার বিষয়বস্তু নির্ধারণের ক্ষেত্রে কর্পোরেট পুঁজিবাদ, সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্র ও বিশ্বব্যাংকের পরামর্শকৃত কারিকুলামকে প্রাধান্য দেওয়া। বহুজাতিক পুঁজির স্বার্থে কেবল ব্যবসায়, তথ্যপ্রযুক্তি, কম্পিউটার ও প্রকৌশল শিক্ষা তথা কর্পোরেটধর্মী বিজ্ঞান ও ব্যবসায় শিক্ষার উপরই গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। কলা বা মানবিক বিষয়গুলোকে গৌণ বলে বিবেচনা করা হয়েছে। তারা সাম্রাজ্যবাদী মুক্তবাজার অর্থনীতির ধারণা শিক্ষাক্ষেত্রে প্রয়োগ করে ইতিহাস, দর্শন, সমাজবিজ্ঞান এবং সাহিত্য ও শিল্পকলার মত বিষয়গুলোতে পড়তে ছাত্রদের নিরুৎসাহিত করছে। যাতে তাদের কর্পোরেট স্বার্থ অক্ষুণ্ণ থাকে। কিন্তু আমরা জানি, একটি জাতির স্বাধীন বিকাশ ছাড়া কোন সমাজের বৈষয়িক ও আত্মিক অগ্রগতি সাধিত হতে পারে না। আর মানুষের স্বাধীন বিকাশের জন্য প্রয়োজন ইতিহাস, দর্শন, সাহিত্য, সমাজবিজ্ঞান এবং শিল্পকলার মত বিষয়গুলোর শিক্ষা। একজন ছাত্র যখন তাঁর দেশের ইতিহাস সম্পর্কে জানে তখন সে জানতে পারবে যে, ঔপনিবেশিক আমলে কারা আমাদের মত দেশগুলোতে লুটতরাজ আর আগ্রাসন, হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল। আমাদের উপর নিপীড়নমূলক অবৈধ শাসন জারি রেখেছিলো। ফলে তখন ঐ ছাত্রের মনে লুটপাট আর আগ্রাসনকারীদের সম্পর্কে নেতিবাচক ধারনা তৈরি হবে। আর এটা কখনই চাইবে না পাশ্চাত্যের সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রগুলো(ব্রিটেন, আমেরিকা)।; তাই তারা আমাদের মত তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে শিক্ষা কার্যক্রমে তাদের আনুগত্যের বিষয়টিকে গুরুত্ব দেয়।



কলা বা মানবিক বিষয়গুলোর সাথে সামাজিক দায়বদ্ধতার একটি সম্পর্ক রয়েছে। আর বিজ্ঞান ও ব্যবসায় শিক্ষার সাথে বহুজাতিক পুঁজিবাদী কোম্পানি ও সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রগুলোর কর্পোরেট উন্নয়ন দর্শনের সম্পর্ক রয়েছে। ফলে এখানকার শিক্ষার মধ্যে বিজ্ঞান ও ব্যবসা শিক্ষায় বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর স্পন্সরশিপ সবচেয়ে বেশি। বিশ্বব্যাংকের পরামর্শের মধ্যে এও রয়েছে যে, কলা বা মানবিক বিষয়গুলোর চেয়ে কর্পোরেটধর্মী ব্যবসায় ও বিজ্ঞান শাখায় গুরুত্ব বাড়াতে হবে। যাতে করে পুঁজিবাদী অর্থনীতি ও কর্পোরেট কোম্পানির জন্য সেবাদাস তৈরি করা যায়। আর এই সেবাদাসেরা কাজ করবে বৈশ্বিক পুঁজির উন্নয়নের জন্য। তখন আসলে বিজয়ী হবে সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রগুলো। যারা চায় আমাদের মত তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোকে নিজেদের আধিপত্যের অধীনে রাখতে। ফলে যে বিষয়টা সামনে চলে আসে তা হচ্ছে, বিশ্বব্যাংক প্রতিষ্ঠার একটি পলিটিক্যাল নোশন রয়েছে। আবার আমেরিকা হচ্ছে বিশ্বব্যাংকের সবচেয়ে বেশি অর্থায়নকারী রাষ্ট্র। ফলে বিশ্বব্যাংকের পলিসির মধ্যে আমেরিকার সূক্ষ্ম স্বার্থ নিহিত রয়েছে। আর তা হচ্ছে বিশ্বব্যাপী রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তার করা। এই আধিপত্য সুনিশ্চিত হয়ে ওঠে শিক্ষা-ব্যবস্থাকে বিশ্বব্যাংকের পরামর্শক্রমে সাজানোর মধ্য দিয়ে।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.