নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

কমজান্তা দার্শনিক

কমজান্তা দার্শনিক › বিস্তারিত পোস্টঃ

ৎরন্টো

২০ শে জুন, ২০১৮ রাত ১২:২৯

দুই বিল্ডিং এর চিপায় দাঁড়িয়ে সুখটান-টা দিই। এরপর এগলিংটনের সদর রাস্তায় এসে সেঁধিয়ে যাই ভীড়ের মাঝখানে। এই ভীড় আপনা থেকেই আমাকে ঠেলে নিয়ে যায় সাবওয়ে স্টেশন। বিকেল চারটা। আপিস ছুটি হয়েছে। সুতরাং আবাল-বৃদ্ধ-বণিতার গন্তব্য একটাই। পহেলা বৈশাখে ঢাকা ভার্সিটি ক্যাম্পাসের মত চারিদিক থই থই। মাটির তলার স্টেশন একেবারে লোকে লোকারণ্য। মাটির নিচে এত্তো লিকের অক্সিজেনের সোর্স কী- এই বিষয়টা এখটু জানা দরকার। ঢাকা শহরেতো আমার মাটির ওপরেই কেমন হাঁসফাঁস লাগতো।

পকেট থেকে আলগোছে একটা ডাবলমিন্ট বের করে মুখে পুরে দিই। তারপর চুপচাপ চিবুতে থাকি নিকোটিনের বদবু তাড়াতে। এখানে সিগারেট বড় মংগা। ট্যাক্স-টুক্স দিয়ে এক প্যাকেট বেনসনের দাম পড়ে যায় সাড়ে সতেরো টাকা । আমার এক ঘন্টার রোজগার থেকেও খানিক বেশী। তাই চিপে চুপে খাই। ডেইলি একটা- খুব বেশী হলে দুই। সাথে বাড়তি খরচ ডাবলমিন্ট। বাড়ী গিয়ে বউয়ের হাতে প্যাঁদানি খাওয়ার চেয়ে এই ডাবলমিন্ট খাওয়া ভাল। ডাবল মিন্ট খেতে খেতে মুখে হাওয়া টানলে কেমন শীত শীত লাগে।আহ! ফিলিংস! ছোট বাচ্চাদের মত মুখ গোল করে ফুস ফুস হাওয়া টানি দু-চারবার। পাশের বুড়ি অদ্ভূত চোখে তাকায়। বোঝার চেষ্টা করে, সদ্য পাবনা-ফেরত কীনা। বুঝে উঠতে পারে না। জামা-জুতোর ভাঁজ দেখে বোঝার উপায় নেই।আমি বুড়ির দিকে তাকিয়ে আমার ট্রেডমার্ক বোকা বোকা হাসিটা দিই।বুড়ি আরো কনফিউজড হয়ে যায়।

কনফিউজড হওয়াই ভাল। মাথার স্ক্রু টাইট আছে বুঝলে ঠাকুরমার ঝুলি খুলে বসবে। প্রথমে ওয়েদার ফোরকাস্ট দিয়ে শুরু করবে। এরপর জিজ্ঞেস করবে ইন্ডিয়ান কীনা। তবে উত্তরের জন্য ওয়েট করবে না। শুরু করবে নিজের গল্প।ইন্ডিয়ান কারি ওর পছন্দ, তবে খেলে পেট নেমে যায়। হানিমুনে তাজমহল দেখতে যাবার প্লান ছিল, কিন্তু বরফে পিছলে বুড়োর পা মচকে যাওয়ায় সে যাত্রা ক্যান্সেল হয়েছিল....। তারপরের প্রসংগ ট্রুডোর ছোট ছেলেটা তাজমহলের সামনে কেন বাঁদরামো করলো । এরপর সেখান থেকে গল্প এসে থামবে নিজের একমাত্র ছেলের বাঁদরামির বয়ানে।

ছেলেটা এডমন্টন থাকে। যদিও ওর সাথে দেখা হয় না তিন বছর, কিন্তু প্রতি মাদার্স ডে-তে ছেলে ফোন করে নিয়ম করে। বুড়িও প্রতি বছর নিয়ম করে ছেলের প্রিয় স্ট্রবেরী জ্যাম বানায়। হাফ ডজন ম্যাসন জারে জ্যাম ভরে গালে হাত দিয়ে ওয়েট করে ছেলের জন্য। ইন কেইস ছেলে সারপ্রাইজ দেয়। দিনশেষে জ্যামের ঠিকানা সিনিয়র হাউজিং এর গার্বেজ বিন। গল্পের এই পর্যায়ে এসে বিজ্ঞাপন বিরতি। "এক্সকিউজ মি" বলে বুড়ি ক্লিনেক্সের ট্যিসু বের করবে।চশমা খুলবে। চোখটা একটু মুছবে। এরপর ফ্যাঁৎ ফ্যাৎ করে নাক ঝেড়ে নোংরা ট্যিসু মুচড়ে আবার ভরে দেবে লাল টুক টুক মাইকেল কর-এর ব্যাগে। তারপরে ততোধিক রংচঙা লিপস্টিক বের করে ঠোঁটে মাখবে একবার।এরপরে আবারো পূর্ণোদ্যমে ছোটাবে কথার তুবড়ি। কী, এইটুক শুনেই হাঁসফাঁস লাগছে? আমারো লাগে। তাই সাবওয়েতে যদ্দুর সম্ভব হিউম্যান ইন্টারএ্যাকশন এড়িয়ে চলি। বুড়ো-বুড়িদেরতো অবশ্যই।

ট্রেন পাল্টাতে ইয়ং এ নামি। এইখানে নামা মানেই লেটের খাতা। কারণ কিছুই না- গানপাগলামি। সেরা সব বাজিয়েদের ডেরা এই স্টেশনে। আমার ভাল্লাগে "চেলো"। ঐ যে বেহালার মতো দেখতে মানুষ সমান জিনিসটা- ঐটা। মংগোলিয়ান চেহারার ছেলেটা বাজায় ভালো। ওর নামটা ভুলে গেছি। তবে চিনি দু'জন দু'জনকে। দেখা হলেই দু'জনে চোখ মটকাই। হাল্কা হাসি বিনিময় হয়। আর সব বাজনা থুয়ে লোকটা তখন জি মাইনরে ধরে শোপিনের সোনাটা (যাহ দুষ্টু! যেটা ভাবছেন সেটা নয়! এটা Chopin's Sonata! একটা মিউজিক কম্পোজিশন!) । ও জানে, ঐটা আমার ফেভারিট। কথা দিয়েছে একদিন মোরিকোন এর কম্পোজিশন শোনাবে। গুড ব্যাড আগলির থিম-মিউজিকটা। এখনো শোনায়নি। ওটার জন্য মানিব্যাগের কোনায় দশ ডলারের বেগুণী প্লাস্টিক নোট টা আলাদা করে রেখেছি- যেদিন শোনাবে, খুশিমনে ওর হাতে গুঁজে দেবো । আমার জন্য একটু বেশীই হয়ে যায় টাকাটা। কিন্তু কী আর করা! পেতেছি সমূদ্রশয্যা, শিশিরে কী আর ভয়?

আজকাল টাকাপয়সার একটু টানটানি যাচ্ছে। আরেকটু খুলে বল্লে, জমার খাতা তলানিতে এসে ঠেকেছে। গতবছর গোঁফে তা দিতে দিতে ইউএসএ থেকে কানাডা ঢুকেছিলাম। সাথে মোটা অংকের ইউএস ডলার। কানাডার কানাগলি তখনো চেনা হয়নি। তাই ভাবেসাবে আকবর বাদশাহ্-র কেরদানি। দুইমাস কোনো অড জবও খুঁজিনি। ভেবেছিলাম, এইতো, ভালো চাকরিটা পেলাম বলে। বেলা বোসের ওয়েটিং লিস্ট থেকে অনেক আগেই কাটা গেছে আমার নাম। তাই বেলা বোস এখন আমার সাথেই, কানাডায় ।ও এসে ঢুকলো রায়ারসনের একটা ব্রিজিং প্রোগ্রামে- পাস করলেই চাকরি রেডী। এমন সময়ে সিনেমার সাসপেন্স দৃশ্যের মত টপাটপ পট পরিবর্তন- বেজমেন্টের টেম্পোরারি বাসা পাল্টে একটু ভাল বাসায় উঠতেই খরচের ধাক্কা, অকস্মাৎ প্রেগনেন্ট হয়ে বউ আমার ফুলটাইম হাসপাতালে ভর্তি, গোটা পাঁচেক জব ইন্টারভিউ থেকে হাতে হারিকেন নিয়ে ফিরতে হলো -এটসেটরা এটসেটরা।

অবশেষে দিল্লির সিংহাসন থেকে ধপ করে পড়লাম টরন্টোর মাটিতে। ঢুকে পড়লাম একটা কলসেন্টারে ।মিনিমাম পেমেন্টের জব। তখন বুঝলাম ট্যাক্স কাকে বলে! সিপিপি কী জিনিস! হেলথ আর ইআই কেটে কত ঢোকে অ্যাকাউন্টে। ও দিয়ে বাসা ভাড়া আর ইউটিলিটিজই হয় না ভালমতো। তাই জবের পরেও হড় হড় করে জমা টাকা বেরিয়ে যেতে লাগলো। একার রোজগারে সে ধ্বস থামানো দায়।

ধ্বসে-টসে বল এখন সাইড লাইনের বাইরে। এমন বিপদে পরিচিত লোকজন ভরসা। গোটা শহরে চিনিইতো মাত্র গন্ডাখানেক লোক। অবশ্য অনেক চিনলেও কী? বেশীরভাগের অবস্থাই "যায় যায় দিন"। তারপরেও আরিফ ভাইকে বলে রেখেছি - হুট করে আপদ হলে যেন একটু পাশে থাকে। টরন্টোতে মোড়ে মোড়ে পে-ডে লোনের কারবার দেখি। মানিমার্ট, ক্যাশ ফর ই্য়্যু, আরো কী সব। এখন বুঝি ওদের ব্যাবসা কোত্থেকে আসে। দু'দিন পর আমাকেও ওদের কাছেই যেতে হবে।

লোকে বলে একটা অড জব করে এখানে হয় না। কিন্তু আমি আরেকটা জবে ঢুকিনি। বউকে সময় দিতে হয়। রাঁধাবাড়া, ঘরকন্না তো আছেই, সাথে বাড়তি সময়টা ইনভেস্ট করি চাকরির আবেদনে।আসুক ফেইলিউর, ওটা যে পিলার অফ সাকসেস- সেটাতো ছোটবেলা থেকে মুখস্ত করছি। স্প্রেডশীটে টুকে রাখি পিলারের মাপজোঁক। লাস্ট যেবার দেখেছিলাম, পিলার সংখ্যা ৪১৭ পেরিয়ে গেছে। ও দিয়ে গোটা চারটা পদ্মাসেতু হয়ে যায়। কিন্তু চাকরি হয়নি। তবু থামিনি, চালিয়ে যাচ্ছি।

তবে কী, আজকাল আর পারি না। হাঁপিয়ে গেছি। শোপিন শুনে আধখানা হাঁপানি কাটে। বাকী আধখানা হাঁপানি কাটানোর জন্যে আমি হাঁটি। খোলা হাওয়ায় হাঁটলে আমার স্ট্রেস কমে। স্ট্রেস কমানোর আরো দুয়েকটা গোপন ফর্মূলা আছে। সে কথা থাক না গোপন। মেইন স্ট্রিট নেমে হাঁটি টেইলর ক্রিকের পথে। সেই ফাঁকে বিসিসিবি-র গ্রুপে একটা ঢুঁ মারি। পে-ডে লোন নিয়ে কার কী অভিজ্ঞতা জানা দরকার।হাঁটতে হাঁটতেই পৌঁছে যাই ঝিরি ঝিরি বয়ে চলা ক্রিকের পাড়ে। সেখানে পোঁছাতেই একটা ফোনকল।

আজকাল আমি ফোন ভয় পাই। বিশেষত: দেশের ফোন। হুট করে বাসা থেকে আসতে পারে দু:সংবাদ। বন্ধুরা কেউ কেউ ফোন করে আইয়েল্টস ছাড়া কানাডা আসার শর্টকাট তরীকা জানতে চায়। যদিও বিয়ে থা করেছি বলে ঘটক পাখি ভাইদের কন্টাক্ট লিস্টে আমার নাম নেই, তারপরেও কারো কারো আব্দার অন্যরকম। যেমন জলিল চাচা।ফোন দিয়ে কুশল বিনিময়ের পর ঊনার আলাপ গড়ায় আখিরাতের আলাপে। এরপর এলাকার বার্ষিক ছালানা জলসায় মাত্র হাজারখানেক ডলার ঢেলে আমার পরকালের পথটা মোলায়েম করে ফেলার হুলুস্থুল অফারও দেন তিনি। তবে এই ফোনটা দেশের ফোন নয়। ক্যানাডিয়ান নাম্বার।

ফোন ধরতেই ওপারে কোনো ক্যানাডিয়ান মহিলার হাসিখুশি গলা। নাম্বার চিনিনা। তবে উচ্ছাসে মনে হয় ক্রেডিট কার্ড বেচার ধান্দা। "হাই! গুড আফটারনুন!"
"গুড আফটারনুন, জাফার! মনে পড়ছে আমাকে? আমি গ্রেস!"
ছাত্রজীবনে গ্রেস নামে একজনকেই চিনতাম। সুনীলের সেই সুবর্ণ কংকন পরা ফর্সা রমনী। আমার বউয়ের দু'চোখের বিষ! ও না'তো? মনের অজান্তেই ভয়ে ভয়ে চোখ বুলিয়ে নিই আশপাশ।
"ওহ! গ্রেস! এই নামে তো চিনি দুয়েকজনকে! তুমি কোন গ্রেস? আমাকে একটু হেল্প করতে পারো নিশ্চিত হওয়ার জন্য!"
আমাকে হেল্প করে গ্রেস। জানায় কবে আমাদের আলাপ হয়েছিল। মাস দু'য়েক আগে একটা জবের ইন্টারভিউ করেছিল ও আমাকে। এরপর অপেক্ষা করতে বলে সব চুপচাপ। এদ্দিনে রেফারেন্স চেক-টেক শেষ হলো। ওডের এইচ আর নাকি একটু স্লো। আজকে আমাকে ফোন করেছে আমাকে অভিনন্দন জানানোর জন্য। জানতে চায় কবে জয়েন করতে পারবো!

ও মাই গুডনেস! আমার স্বপ্নের চাকরি। স্বপ্নের এম্প্লয়ার। রাজী মানে? এমন একটা চাকরির জন্যাইতো গত এক বছর থেকে ল্যাপটপের কীবোর্ড ঠুকে যাচ্ছি। ঘটনার আকস্মিকতা আমাকে হকচকিয়ে দেয়। একবার মনে হলো বলি, কালকেই জয়েন করতে পারবো। তারপরে মনে পড়ে সৈয়দ সাহেবের উপদেশ।গুর্বে কুশতন শব ই আওয়াল- বাসর রাতেই বেড়াল মারতে হয়। হালকা ভাব নিয়ে বলি, আমাকে ভাবতে হবে। আজকে রাতটা আমি ভাবতে চাই। পরদিন জানাবো আমার ডিসিশন। পরদিন দশটায় আবার ফোন করবে বলে বিদায় নেয় গ্রেস। আমার বুক ঢিব ঢিব করে- ভাব নিয়ে ভুল করে ফেল্লাম না তো? ধুস! যা হয় হবে।

ফোনের স্ক্রিণে তাকাই একবার। তখনো স্ক্রিণে ভাসছে বিসিসিবির পোস্ট অপশন। বাংলা হরফে আমার পে-ডে লোন বিষয়ক প্রশ্নের মুসাবিদা। চট করে ওটা মুছি। লিখে ফেলি নতুন দুই লাইনের পোস্ট-

"ডিয়ার বিসিসিবিয়ানস! একটা ভাল গাড়ী কিনবো ভাবছি! এসইউভি! অল হুইল ড্রাইভ। ভি সিক্স পছন্দ। ২০১৮ মডেলের। কোনটা কিনলে ভাল হয়?"

জানি, দিলখোলা বিসিসিবিয়ানরা এখনই সুপরামর্শের ঝড় তুলে ফেলবে । তা'ই হয়। ফোনটা পকেটে রাখতেই ঠুং ঠুং করে বাজতে শুরু করে ফেসবুক নোটিফিকেশনের আওয়াজ। আওয়াজতো নয়, যেন জীবন নাটকের ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক। জানি, পোস্ট দেখে আমার বউটা এখনই কল দেবে একবুক টেনশন নিয়ে। অতি অভাবের ভবিষ্যৎ শংকায় আমার মাথা খারাপ হয়ে গেল কীনা, সেই টেনশন। কল দিক! ওয়েট করি ওকে সারপ্রাইজ নিউজটা দেব বলে।

এই ফাঁকে লাইটারের ডগায় দ্বিতীয়বার নেচে উঠে জ্বলজ্বলে আগুনের শিখা।

মন্তব্য ১ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (১) মন্তব্য লিখুন

১| ১১ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৮ রাত ১১:৪৩

সনেট কবি বলেছেন: বেশ।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.