নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

কমজান্তা দার্শনিক

কমজান্তা দার্শনিক › বিস্তারিত পোস্টঃ

ণতুন বআড়ি

১৬ ই মে, ২০১৯ রাত ১১:৫১

রাস্তাটার নাম স্প্রুস ড্রাইভ। পিচঢালা রাস্তা- তরতর করে উঠে গেছে পাহাড়ের উপরে। এই এলাকার প্রতিটা রাস্তাই কোনো না কোনো গাছের নামে। অলিভ ড্রাইভ, বার্চ স্ট্রিট, সিডার ড্রাইভ। কোনো এক বৃক্ষসখা নগরবিদ হয়তো ছিল নামকরণের দায়িত্বে- তাই এমন সব গেছো-নাম।

স্প্রুস ড্রাইভের চড়াই ধরে উঠতে উঠতে একসময় থামতে হবে।কারণ এরপর আর যাবার জায়গা নেই। ডেড এন্ড। ওরা অবশ্য ডেড এন্ড বলে না! ফরাসী কেতায় আদর করে ডাকে "কাল দ্য স্যাক"। এখানে আছে গাড়ি ঘুরিয়ে নেবার জন্য একটা চওড়া গোলচত্বর। তবে গাড়ি ঘুরানোর আগেই আপনার মাথা ঘুরে যাবে। কারণ, এই কাল দ্য স্যাক এর পরেই শুরু হয়েছে ঘন জংগল। ডানে-বাঁয়ে-সামনে, উত্তর- দক্ষিণ - পশ্চিম জুড়ে শুধু গাছ আর গাছ। ছোট গাছ, মাঝারি গাছ, বড় গাছ। গোটা এলাকাজুড়ে নানারকমের কনিফার আর বার্চ-এর ছড়াছড়ি। তিনহাজার একরের সাজানো জঙ্গল ভিক্টোরিয়া পার্কের সীমানা শুরু হয়েছে এইখানেই । সেই জংগলের মাঝে বিশাল লন নিয়ে লাজুকভাবে দাঁড়িয়ে আছে চমৎকার একটা হলদে ইটের একলা একা বাড়ি।

বাড়িটা আমাদের বাড়ি।

বাড়ি কেনার ভূতটা আমাদের মাথায় চাপিয়েছে শিপু ভাই। দেশে যেমন থাকে, খালাতো ভাই, ফুপাতো ভাই কিংবা পাড়াতো ভাই, গ্রামতুতো ভাই- তেমনি প্রবাসে আমাদের থাকে "দেশাতো" ভাই। মানে কাছাকাছি এলাকায় থাকা কোনো বাংলাদেশী ভাই। শিপু ভাই হলো তেমনি এক দেশাতো ভাই- থাকেন আমাদের পাশের শহর নিউ গ্লাসগোতে। তো, বলা নেই, কওয়া নেই- দুম করে গতবছর ঊনি একটা বিরাট বাড়ী কিনে ফেল্লেন । তারপর কাঁধ থেকে ভূতটা নামিয়ে পাচার করে দিলেন তাজিম ভাই'র ঘাড়ে। এরপর একাঁধ-ওকাঁধ হয়ে, অ্যান্টিগনিশের আরো তিনজনের মাথা খেয়ে ভূতটা সওয়ার হলো আমার ঘাড়ে। ভূতের কিল খেয়ে সাথে সাথে ফোন দিলাম শিপু ভাইকে- ঊনার টিপস নিয়ে পরদিন আমিও বাজারে বেরিয়ে পড়লাম বাড়ি কেনার জন্য। নানা ঘাটের জল খেয়ে একদিন দুম করে কিনে ফেল্লাম এই জংগলবাড়ী।

আসলে বাড়ী না বলে এটাকে ছোটখাট একটা র‌্যাঞ্চও বলা যায়। দুই পাশে যত্ন করে ট্রিম করা স্প্রুস গাছের সারি. মাঝখানে পিচঢালা লম্বা ড্রাইভওয়ে। একশোগজ মতো পেরুলেই র‌্যাঞ্চার স্টাইল বাংলো । বাসায় কোনো নামফলক নেই- কারণ, এখনো কোনো অফিসিয়াল নাম দিইনি। সেদিন দেখলাম ফেসবুকের এক গ্রুপে কোন ভুলে কে যেনো সাজেশন চেয়েছিল কি নাম দেয়া যায় বাড়ির। পাঁচমিনিটেই কমেন্টবক্সটা কমেন্টে সয়লাব অদ্ভূতুড়ে নামের আইডিয়া দিয়ে। সেই নাম পাবলিক প্লেসে উচ্চারণের উপায় নেই। দেখেই শিখেছি- নাম চেয়ে পোসট করা আর গুঁফোমুখে কাঁঠাল খাওয়া একই বিড়ম্বনা। তাই নিজের মতো করে নাম রেখেছি- "অরণ্যবিলাস"। নামটা ক্লিশে, একেবারে খেলো শোনায়, তবু, আপাতত এইটাই নাম। অন্তত 'জাফর-কুটির' কিংবা "ফারহানা-ভিলা' টাইপ নামের থেকে সরেস- কি বলেন?

বাই দ্যা ওয়ে, বাড়ীর রং নিয়ে ডিটেইলসে যাব না। কারণ, হলুদটা কেমন হলুদ, ভদ্রস্থ ভাষায় আমার বোঝানোর উপায় নেই। নাহ্, রাধাচূড়ার হলুদ না। সোনালু পাতার মিষ্টি হলুদ রংও নয়। কেমন যেন মাখনরঙা হলুদ। তিনদিন ব্রাশ না করে হলদে হয়ে যাওয়া দাঁতের রংটা যেমন হয়, ঠোঁটকাটা কেউ হয়তো ঐ হলুদের সাথেও তুলনা দিতে পারে। । তা দিকগে, আপনার রং বিষয়ক জ্ঞান যদি বেনীআসহকলা-র চাইতে বেশী হয়, তাহলে বলবো, এটা আসলে হলুদ নয়- "বেইজ কালার"। টু বি অনেস্ট, চারিদিকের এই ঘনসবুজের মাঝে এমন একটা বাড়ির রং "বেইজ কালার" না হলে মানাতোই না।

সদর দরজার হাতলটা মোচড় দিলেই দরোজা খুলে যাবে। এলাকাটা মোটামুটি নিরাপদ হওয়ায় দরোজা শুধু ভেজিয়ে রাখা হয় রাত পর্যন্ত। ভেতরে ঢুকতেই, আমি জানি, রুপালি রঙের ঝালর দেয়া ঝলমলে ঝাড়বাতি দু'টো আপনার নজর কেড়ে নেবে। আর সোজা তাকালেই দেখা যাবে বিশাল এক কাঁচের স্লাইডিং ডোর । এরপরে দরোজা পেরিয়ে চোখ চলে যাবে খয়েরি রঙ এর ওক কাঠের ডেক-টার দিকে। ওদিকে এক পা দু'পা এগুনোর আগেই শুনবেন থপ থপ শব্দ। আধোবোলে বাবা বাবা বলতে ছুটে আসছে আমার দুই লক্ষ্মিসোনা, চাঁদের কণা। আমির খানের "রাঙ দে বাসন্তি" টাইপ লম্বাচুলের শ্যামলারঙা দাঁতফোকলা পিচ্চিটা হলো ফাইজান- আমার বাপসোহাগী ছেলে। আর ডান গালে টোল ফেলে দুষ্টুচোখে খ্যাট খ্যাট করে হাসতে থাকা পিচ্চিটা হলো রুপান্জেল- আমার আদরখেকো মেয়ে। গতরে শক্তি থাকলে দুজনকেই এক সাথে কোলে তুলে নিয়ে ডেক-এ গিয়ে বসতে পারেন।

ডেক-এ কিছুক্ষণ বসার পর মনে হতে পারে আর বসে থাকার মানে হয় না-একটু আশপাশটা ঘুরে দেখা যাক। তাহলে এক্ষুণি বেরিয়ে পড়ুন- পুরো দুই একরের জায়গা, তাই গোটা এলাকা পায়চারি করতে বেশ খানিকটা সময় লেগে যাবে।

সদর দরোজা দিয়ে বেরোতে গেলেই টানা বারান্দা। বারান্দার চারকোনায় চারটে ফুলের প্লান্টার ঝুলছে। সোজা তাকালে দূরেএএএএএএ, অন্নেক দূরে চোখে পড়বে একসারি এলোপাহাড় আর মেলো পাহাড়। সেই এলোমেলো পাহাড়গুলো নিয়েই অনস্লো মাউন্টেন এলাকা। শীতের তীব্র তুষারপাতের সময়ে গিন্নির ডিটেকটিভ চোখ এড়িয়ে আমি যাই সেখানে ঘুরতে। জায়গাটা অজপাড়াগাঁ। রাস্তা এখনো পাকা হয়নি- নুড়ি বিছানো গ্রাভেল রোড। তাই সব এলাকা সাফসুতরো করে তুষারকর্মীদের এখানে পৌঁছাতে গোটা একদিন লেগে যায়। তার আগেই আমি সেরে নিই আমার অ্যাডভেঞ্চার। ঝকঝকে রাস্তায়তো আর অ্যাঅ্যাডভেঞ্চার হয়না। পাহাড়ি খাড়া রাস্তার চড়াই। তারমধ্যে কোমরসমান আলগা তুষারের পরৎ। চাকা হড়কাতে হড়কাতে আমার ফোরহুইলার স্পোর্ট ইউটিলিটি গাড়িটা নিয়ে উঠে যাই একেবারে চূড়ায়। তারপরে বরফ-পিচ্ছিল রাস্তায় ভাসতে ভাসতে নামি পাহাড় থেকে। গাড়ীর বেয়াড়া চাকারা তখন আমার কথা শুনতে চায়না।পিছলে নেমে পড়তে চায় পাশের খাদে। নামতে নামতে শুধু মাঝিসুলভ দক্ষতায় দাঁড় সামলে ডিরেকশন ঠিক রাখার পালা।

এই অ্যাডভেঞ্চার করতে গিয়েই একদিন পড়লাম বিপদে। বাইরে মাইনাস পনেরোর হাঁড়জমানো ঠান্ডা। গাড়ি আটকে আছে অনস্লো মাউন্টেনের নির্জন পাহাড়ে। একটার পর একটা রোডসাইড সাপোর্ট সার্ভিসে কল করে যাচ্ছি। কোথায় আটকে আছি জানার পরে"স্যরি ফর ই্য়্যু " বলে সবার দু:খ প্রকাশের হিড়িক- তবে কে্উ আসতে রাজি নয় এমন নির্জন জায়গায়। শেষমেষ এলো একজন, কিন্তু আমায় বাঁচাবে কী? তার গাড়িটাও আমার মতো আটকে পড়লো তুষারের ফাঁদে। ততক্ষণে সন্ধ্যা নেমে আসছে। ঝিরি ঝিরি শুরু হয়েছে তুষার পড়া। তাপমাত্রা নেমে যাচ্ছে হিমাংকের নিচে, আরো নিচে। ফুয়েল পুড়িয়ে গরম রাখছি গাড়ী। ভেতরে চুপচাপ আমি ।পাশে বসে রোডাসাইড সাপোর্টের লোকটা- নিশ্চিত, মনে মনে আমাকে অভিশাপ দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আর কতক্ষণ? গাড়ীর ফুয়েল ফুরিয়ে আসার আগে রক্ষা না পেলে জমে যেতে হবে তীব্র শীতে। হেঁটে বাড়ী ফিরবো, সেই উপায়ও নেই। এরপর?

বাদ দিন, আজ থাক সে প্যাঁচাল। অন্যকোনোদিন শোনাবো কীভাবে রক্ষা পেলাম সেই শীতল নরকের হাত থেকে। এই ফাঁকে বরং ঘুরে দেখুন আমাদের বাড়িটা।

একটু এগিয়ে গেলে বাড়ির পশ্চিম পাশে টুপ করে টিলার মত নেমে যাওয়া এলোপাহাড়ী জায়গাটায় আছে কুলু কুলু বয়ে যাওয়া পাহাড়ী জলধারা। বাংলায় হলে বলতাম ছড়া, ছড়ি কিংবা ঝিরি । সেইটার নামেই হ্য়তো এলাকার নাম হয়ে যেতো লাউয়া-ছড়া, খাগড়া-ছড়ি কিংবা লেমু-ঝিরি। এইখানেও এমন হয়। ব্রুক, স্ট্রিম, ক্রিক কিংবা নদীর নামে নাম হয় এলাকার। শেরব্রুক, টেইলর ক্রিক, হর্সস্ট্রিম এমন কত জায়গা। আমাদের এলাকাটার নামও নদীর নামে- স্যামন রিভার।কিন্তু ঝিরিটা নাম-গোত্রহীন।এই ঝিরি কি ব্রুক, স্ট্রিম নাকি ক্রিক?

গায়ে গতরে সবচে' ছোট ঝিরিকে বলে ব্রুক, একটা কদম ফেলেই ব্রুক পার হওয়া যায়। তারচে এক সাইজ বড় জিনিসটা হলো স্ট্রিম- সেটা পেরুতে হালকা দৌড়ে এসে একটা লাফ দিতে হবে। আর লাফাতে গেলে যদি ক্যাঁক করে প্যান্টের তল্লি খুলে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে, তাহলে সেটার নাম ক্রিক। তাই পানিতে গোড়ালি অবধি পা ভিজিয়ে ক্রিক পেরুনোটাই দস্তুর- নদীর ইমিডিয়েট ছোট ভাই বলে কথা।

তো, সাইজ অনুযায়ী আমাদের ঝিরি-টাকে মোটামুটি ব্রুক বলা যায়। ব্রুকটায় কমবেশী সবসময়ই পানি থাকে- একেবারে খটখটে শুকনো মৌসুম না হলে আর কি। টলটলে পানিটা অলস পায়ে ঢলতে ঢলতে পৌঁছায় এলাকার আরেক পাশের নদী স্যামন রিভার-এ। ঝিরি পেরুতে গিয়ে প্যান্ট হারানোর ঝুঁকি নেয়া যায়, মান হারানোর ঝুঁকি নিয়ে লাভ নেই। তাই ঝিরির উপর দেয়া আছে ছোট্ট একটা কাঠের সাঁকো -সাঁকো পেরিয়ে একটু এগুলেই ম্যাপল-তলা। ওখানে গোটা পাঁচেক বড় বড় ম্যাপলের গাছ আছে। শুনেছি শতেক রকমের ম্যাপল আছে দুনিয়ায়- কানাডায় আছে গোটা বিশেক। আমাদের ম্যাপলের জাতটা কি আমার জানা নেই। আমার ভাল্লাগে রেড ম্যাপল- তাই দু'টো রেড ম্যাপলের চারা এনে লাগয়েছি। কানাডায় সুগার ম্যাপল এর জাতটা হলো সেরা। সেই ম্যাপলের গাছ চুঁই্য়ে পড়ে মিষ্টি রস- দেখতে একেবারে আমাদের খেজুরের রসের মতো। তবে স্বাদের তফাৎ আকাশ-পাতাল।কোনটা আকাশ আর কোনটা পাতাল, সেটা আজকে নাইবা বল্লাম!

ম্যাপল-তলায় আপনি একটা হ্যামক ঝুলিয়ে গা এলিয়ে দিতে পারেন। শুয়ে শুয়ে পড়তে পারেন আমার বুকশেল্ফ থেকে তুলে আনা কোনো একটা বই। ঝিরির কুলকুল শব্দ শুনতে শুনতে জীবনানন্দ, ওয়ারড্সওয়ার্থ কিংবা কোলরিজ পড়ার জন্য খাসা জায়গা এটা। আর বই পড়তে না চাইলে গায়ে ছায়া ছায়া অন্ধকার জড়িয়ে, কানে হেডফোন গুঁজে সারেন্ডার করতে পারেন প্রকৃতির কাছে। শুনতে পারেন জন ডেনভারের "সুইট সারেন্ডার'

"Sweet, sweet surrender,
Live, live without care
Like a fish in the water,
Like a bird in the air"

এমন জায়গার সাথে এই গানটাই যায়। অবশ্য আপনি যদি অতটা রোমান্টিক না হন, কি আর করা! কাগজ কলম নিয়ে বসে যেতে পারেন ডিফারেনশিয়াল ক্যালকুলাসের অংক করার জন্য।

এইদিকটায় অনেক্ষণ হলো। ততক্ষণে আপনার জন্য পাঠিয়ে দিয়েছি এক বাটি চানাচুরভাজা আর এক কাপ আগুন গরম আদা-লেবুর চা। চা-টা হাতে নিয়ে চলুন বাড়ির পেছনটায় যাই। এইদিকে আর বসে কাজ নেই। কারণ চোখেমুখে ধোঁয়া লাগবে। লাকড়ির চুলাটা জ্বালানো হচ্ছে। সেই আগুনে বেগুন পোড়ানো হবে-পোড়া বেগুনের ভর্তা হবে, লাউ আর কুঁচো চিঙড়ির সালুন হবে, একগাদা রসুনের কোয়া দিয়ে লইট্যাশুঁটকির ভুনা হবে আর সবশেষে গোটা গোটা গরম মশলা দিয়ে একটা বড় পাতিলে সর্ষের তেলে রান্না হবে "ভিল"- মানে কচি গরুর হাড়-মাংস। আমাদের বাসায় এলে কারো আবার মুখে কিছু না দিয়ে ফিরে যাবার নিয়ম নেই।

বাড়ির পেছনে যে ফাঁকা জায়গা ছিল, সেখানে এবার আবাদ করেছি। গায়কপাখি নাসিফ ভাই মৎস্যবিদ- ঊনার ডক-পোস্ট-ডক সব ঐ বিষয়েই। কিন্তু চাষবাষটাও ঊনি ভাল বুঝেন। ঊনিই আমাদের কনসালট্যান্ট। তার পরামর্শে ওখানে লকলকিয়ে বেড়ে ওঠছে লাউয়ের চারা, কুমড়ো গাছের ডগা, পালংশাকের পাতা- আরো কত কি।এর মধ্যে একদফা মূলাশাকেরও ফলন তুলেছি। যদিও ঐ তেতোশাক মুখে তোলার জো ছিল না, আমরা খেয়েছি একেবারে অমৃতের মত চেটেপুটে।

বাগানের পেছন দিয়ে হেঁটে একটু এগুলেই চোখে পড়বে পুকুরটা। পুকুরের কাকচক্ষু জল গাছের ছায়ায় কালো হয়ে থাকে। বৃষ্টিবিকেলে গোটাদুই মদ্দা নীলশির হাঁস এখানে সাঁতার কাটতে আসে। কখনো কখনো একজোড়া কানাডা গুজ-কেও ওরা দাওয়াত দিয়ে নিয়ে আসে। কদাচিৎ একটা মুখচোরা ফেজেন্টপাখি আসে প্রাত:ভ্রমণে - রঙীন পাখা দুলিয়ে পাখিটা টুক টুক করে নেচে নেচে হেঁটে বেড়ায়। এছাড়াও আছে আরো অন্তত ডজনখানেক টাইপের বুনোপাখি। আমিতো আর পক্ষীবিদ সলিম আলি নই- তাই কোনোটাই চিনে উঠতে পারি না।

পুকুরের উত্তরপাড়জুড়ে ঘাসে ছাওয়া বিশাল সবুজ মাঠ। সাইজে সত্যি সত্যিই একটা স্টেডিয়ামের সমান। মাঠের পাশে বিশাল ঘোড়াশাল। এই ঘোড়াশালে অনায়াসে চারটে ঘোড়া নেচে-কুঁদে বেড়াতে পারবে। কিন্তু, এখনো ঘোড়ারোগে ধরেনি। কারণ, কানাডিয়ান ঘোড়াদের শুধু খাওয়ালেই হয় না- নিয়ম করে পেডিকিওর, মেনিকিউর না করলে কিংবা রিল্যাক্সিং মাসাজ না দিলে ওরা ডিপ্রেশনে পড়ে যায়। আজকাল ফেসবুকে আসারই সময় হয় না, ঘোড়া সামলাবো কখন?

ঘোড়া নেই বটে, তবে আমাদের মাঠে সাদা রঙের লেজ নাচিয়ে চরতে আসে হোয়াইট টেইল জাতের বুনো হরিণের পাল। শীত চলে গেছে। তাই ওদের বিচ্ছিরি ধূসর মোটা পশমগুলোও খসে বেরিয়ে পড়েছে চকচকে সোনালি রং। শরীরের বাড়তি মেদ ঝরে গিয়ে একেকটা যেন এখন স্লিম ফিগারের কোক-এর বোতল। বাহারি শিংওয়ালা জোয়ান ছেলে হরিণদের বলা হয় বাক। শিঙের থাকে শাখা শিং, উপশাখা শিং- বাড়তেই থাকে দিনে দিনে, কিন্তু তাই বলে ওরা কাউকে গুঁতোতে যায় না। ডো বলা হয় মায়া মায়া চেহারার তরুনী হরিণিদের। আর বাচ্চা হরিণকে বলা হয় ফণ। আমাদের এলাকায় একটা বাক আর গোটাপাঁচেক ডো ছিল। দু'টো ডো এই সামারে বাচ্চা দিয়েছে। বিকেলবেলা দুই ফন-ছানাকে নিয়ে ওরা যখন বেড়াতে আসে আর ছানা-দুটো যখন ছাগলের তিননাম্বার বাচ্চার মতো এলোমেলো লাফাতে থাকে- মনে হ্য় স্বর্গের একটা টুকরো বোধহয় পথভুলে নেমে পড়েছে আমাদের আঙিনায়। আমরাও মাঝে মাঝে ওদের সাথে খেলতে নেমে যাই। মানুষ দেখে যে ভয় পাওয়া উচিৎ ব্যাপারটা ওরা এখনো ধরতে পারেনি- আমারাও ওদের বলিনি । তাই পোষা প্রাণীর মতই আমাদের গায়ে এসে ঢলাঢলি করে মায়াবী চোখের বোকা বোকা হরিণগুলো।

এইদিকেই ক'টা বড়সড় হোয়াইট বার্চ আছে। সেখানে দুইটা দোলনা টানিয়েছি আমাদের ছানাপোনাদের জন্য। একটা লাল, একটা নীল। সাথে একটা বড়দের সুইংও আছে। এই সুইংটায় দুলে দুলে খানিক জিরিয়ে নিন। তারপরে আমরা বরং ট্রেইলে যাব। বাড়ীর পেছন থেকেই শুরু হয়েছে একটা ট্রেইল। সেই ট্রেইলে একটু ট্রেকিং না করলে হয়? বেশী না, পাঁচ-সাতমিনিটের জংগুলে হাঁটা পথ পেরুলেই পাবেন একটা বিশাল লেক। টাউন অফ ট্রুরু-র রিজার্ভয়ার। গোটা ট্রুরো শহরের পানির জোগান এইখান থেকেই যায় । খোঁজ নিতে হবে, এই লেকে কায়াক চালানোর অনুমতি আছে কীনা। তারপরে নাহয় একদিন কায়াক নিয়ে নেমে পড়বো লেকে। নয়তো যখন ধুমিয়ে শীত পড়বে, তখন আসবেন। বরফজমা লেকটা হেঁটে পেরুনো কিন্তু সেইরকম একটা অ্যাডভেঞ্চার হবে। সারাজীবন বলে বেড়ানোর মতো অ্যাডভেঞ্চার। আর আপনার যদি ক্রস-কান্ট্রি স্কিইং ভাল্লাগে, তাহলেতো কথাই নেই।

এতক্ষণ ঘুরতে ঘুরতে জানি আপনার ক্ষিধেটা চাগাড় দিয়ে উঠেছে। চলুন ফেরা যাক। সন্ধে নেমে আসছে। এইসময় কালো ভালুকের দল ঘোরাঘুরি শুরু করে। এই জংগলে ইদানীং কেউ ভালুক দেখেছে শুনিনি- কিন্তু আমাদের পাশের এলাকা ডেবার্ট-এ এবছর খুব ভালুকের উৎপাত। দু'-চারটা পথভুলে এখানে চলে আসবেনা নিশ্চয়তা কী? এই জংগলে নেকড়ের ছোটভাই "কয়োটি" ধরা পড়েছে মাত্র ক'বছর আগে। আমি মেছোবাঘ আর রেকুন মাঝেমাঝেই দেখি। শুধু এই জংগলে কোনো ভূত থাকে কীনা বলতে পারছি না। সাবধানের মার নেই। তাড়াতাড়ি পা চালাতে হবে।

সন্ধে হতেই ঝিঁ ঝিঁ পোকার দল বক বক করে মাথা খাওয়ার আয়োজন করে। বাকস্বাধীনতার দেশ বলে গলাটিপে ওদের থামিয়ে দিতে পারিনা। দুয়েকটা খুচরো জোনাকপোকা জ্বলতে শুরু করে ম্যাপলতলার দিকে। পুকুরে ক'টা গোল্ডফিশ ছাড়াও আছে শ'খানেক সোনাব্যাঙ। কেন জানি সন্ধেবেলাটাতেই ওদের ঘ্যাঙরঘ্যাঙ করা চাই। এইসব উৎপাতের মাঝেই বাগানে পানি দেয়ার ঝাঁঝরিতে ধুয়ে নিন হাতমুখ। লাকড়ির চুলার আগুন তখনো জ্বলছে । লগপোকার দিয়ে নেড়েচেড়ে উসকে দিন আগুনটা। প্লেটে তুলে নিন বেহেশতী খাবার। এরপর সিনথেটিক পাটি বিছিয়ে বসে পড়ুন ম্যাপল তলায়।

আজ পূর্ণিমা রাত। পেটশান্তি করে আমরা নাহয় একদফা চন্দ্রগ্রস্থ হব। মৃদু শব্দে ব্যাকগ্রাউণ্ডে বাজিয়ে দেবো রড্রিগো আর গ্যাব্রিয়েলার "তামাকুন"। ততক্ষণে চাঁদের আলোচ্ছাসে আকাশ ভেসে যাবে। ভেসে যাবে ঘরদোর। সর্বোচ্চ বিপৎসীমা অতিক্রম করে সেই জাদুকরি আলোর ঢল ভাসিয়ে নেবে বন-বাদাড় আর ঘাসের ঝোপ-জংগল। আর দুনিয়ার সকল সুখের বিজ্ঞাপনি মডেল হয়ে আমরা তখন সাঁতার কাটতে থাকবো রূপালী চাঁদের নরম আলোয়।

মন্তব্য ৭ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (৭) মন্তব্য লিখুন

১| ১৬ ই জুলাই, ২০১৯ রাত ৯:২০

করুণাধারা বলেছেন: এই দারুন লেখাটা চোখে পড়ল না কেন বুঝতে পারছি না! আমার না হয় চোখে পড়লো না, কারো চোখে পড়লো না কেন? আপনার লেখা কি প্রথম পাতায় যায় না?

অবশ্য পোস্টকে দারুন বলা যায় কেউ কিনা বুঝতে পারছি না। শুধু শব্দ দিয়ে কি ছবি আঁকা যায়! এত চমৎকার জায়গা, পাহাড়, ছড়া, হলুদ বাড়ি, ছানাপোনা, হ‍্যামক- মেমোক, কিছু ছবি তো দেওয়া দরকার ছিল!!! আবার পুরো পোস্টের কোথাও বানান ভুল পেলাম না, শিরোনামে এমন অদ্ভুত বানান ভুল কি শখ করে করলেন?

যাহোক খুব ভালো লেগেছে পোস্ট। লাইক দিলাম। লিখতে থাকুন।

১৮ ই জুলাই, ২০১৯ রাত ১০:৩৪

কমজান্তা দার্শনিক বলেছেন: ১। নাহ!থম পাতায় যায় না।
২। এই ব্লগ মূলত বাংললা লেখার জন্য , লেখা ড্রাফট করার জন্য ব্যাবহার করি।
৩। লেখা ভাল লেগেছে জেনে ভাল্লাগলো।
#সস্তা_গদ্য
#JAFAR_SADEK
দিয়ে আরো কিছু পুরনো লেখা পাবেন, চাইলে পড়তে পারেন
৪। বানান ভুল দেখার পরেও কী ভেবে পুরো পোস্ট পড়লেন সেটা ভাবছি। হুম, অনেকটা ইচ্ছেকৃত ভুল, চাইনি কেউ পড়ুক।

২| ০৭ ই আগস্ট, ২০১৯ রাত ১১:০৩

মাহের ইসলাম বলেছেন: সুন্দর লিখেছেন।
কয়েকটা শব্দ বুঝতে সমস্যা হয়েছে, আমার ।
সম্ভবত ফন্ট প্রব্লেমের কারণে।

ভালো থাকবেন, শুভ কামনা রইল।

৩| ২৯ শে ডিসেম্বর, ২০২০ রাত ২:৪৯

অধীতি বলেছেন: একদম সরল ভাষায় সাবলীল করে লিখেছেন। মুগ্ধ হবার মত আপনার পছন্দ আর কল্পনা। এরকম একটা বাড়িতে বসে এরকম লেখা সুখকর।

০৬ ই জুন, ২০২১ সকাল ৮:২৬

কমজান্তা দার্শনিক বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ।

৪| ০৬ ই সেপ্টেম্বর, ২০২২ সন্ধ্যা ৭:৩৪

সাহাদাত উদরাজী বলেছেন: লিখুন।

৫| ২১ শে অক্টোবর, ২০২২ রাত ১০:০০

অপ্‌সরা বলেছেন: ণতুন বআড়ি

সামু ফোনেটিকে লিখলে এমন সমস্যার সমাধান হবে মনে হয়।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.