নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অবিস্মরণীয় অবদান আমাদের ইতিহাসে আরেক অনালোচিত অধ্যায়। এ জনপদের মুক্তিসংগ্রামের প্রতিটি পর্বে আদিবাসীদের সক্রিয় অংশগ্রহণ আমাদের শোষণ, বঞ্চনার লড়াইকে শুধু প্রাণিতই করেনি, শাণিতও করেছে। ইংরেজ বিরোধী আন্দোলন, পাকিস্তানের বহুবিধ বঞ্চনার বিরুদ্ধে সরব প্রতিবাদ, প্রতিরোধ, সর্বোপরি বাংলা নামে একটি দেশের আত্মপ্রকাশের সংগ্রামে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অবিস্মরণীয় সক্রিয় অংশগ্রহণ মুক্তির সুবাতাস প্রবাহের স্বপ্ন আর প্রত্যাশাকে প্রসারিত ও জাগ্রত করে তুলেছিল। ইতিহাসের নিরপেক্ষ বিচারে দেখা যাবে, ইংরেজবিরোধী বৃহত্তর সশস্ত্র সংগ্রামের সূত্রপাত এই আদিবাসীদের হাত ধরেই হয়েছে। সূর্যসেন, লোকনাথ বল, প্রীতিলতার ব্রিটিশবিরোধী সশস্ত্র অভ্যুত্থান পরিকল্পনায় আদিবাসীদের আত্মত্যাগ অনেক বেশি অনুপ্রেরণা হিসেবে যে কাজ করেছে তা আজ আর বলার অপেক্ষা রাখে না। এখানে আমরা ইংরেজ পর্ব, পাকিস্তান পর্ব এবং বাংলার মুক্তিসংগ্রাম পর্ব- এই তিন পর্বে বিভক্ত আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অবিস্মরণীয় অবদানকে স্মরণ করার চেষ্টা করব।
দুই. ইতিহাসে লেখা আছে, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৭৬০ সালে মীর কাশেমের কাছে বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার নবাবী হস্তান্তর করে। মীর কাশেম এরই প্রতিদান হিসেবে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে চট্টগ্রাম, বর্ধমান, মেদেনীপুর অঞ্চলের রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব প্রদান করে। পার্বত্য চট্টগ্রামও সেইসঙ্গে কোম্পানির অধীনে চলে যায়। বহুবিধ শোষণের জাঁতাকলে নিষ্পেষিত হতে হতে পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীরা ১৭৭৬ সালের মাঝামাঝি সময়ে প্রথম বিদ্রোহ ঘোষণা করে। চাকমা রাজা শের দৌলত এবং তারই সেনাপতি রামু খাঁ এই বিদ্রোহের নেতৃত্ব প্রদান করেন। এ সময় ইংরেজ সরকার ইজারাদার এবং ব্যবসায়ীদের রক্ষার্থে সৈন্য পাঠালেও কোনো লাভ হয়নি। অবশেষে ইংরেজ সরকার বিদ্রোহ দমনে আদিবাসীদের জন্য পাহাড়ে খাদ্যদ্রব্য সরবরাহ বন্ধ করে দেয়। এ অবস্থায় আদিবাসীরা বশ্যতা স্বীকারে বাধ্য হয়। চাকমা বিদ্রোহের পরে ময়মনসিংহের গারো পাহাড়ের আদিবাসীরা আবার বিদ্রোহ করে। উনিশ শতকের শুরুতে গারো পাহাড়ের এই আদিবাসী বিদ্রোহ হাতি খেদা বিদ্রোহ নামে ইতিহাসে পরিচিতি লাভ করে। অনেক হাজং, গারো এই বিদ্রোহে শহীদ হন। বলা বাহুল্য যে, তৎকালীন ইংরেজ শাসকগোষ্ঠী জমিদারদের এই নিপীড়নের প্রধান সহায়ক হিসাবে কাজ করেছিল। পাঁচ বছর কাল বিদ্রোহ চলার পর ধীরে ধীরে থেমে যায়। গারো জাতিগোষ্ঠীর লোকসকলের মধ্যে ১৮০২ সাল নাগাদ এক ব্যাপক গণজাগরণ লক্ষ্য করা যায়। এসময় গারো নেতা ছাপাতি স্বাধীন গারো রাজ্য প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। কিন্তু এই উদ্যোগ অচিরেই ব্যর্থ হয়ে যায়। ১৮২৫ সালের দিকে টিপু গারোর অনুসারীরা জমিদারদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। টিপুর নেতৃত্বে গারো বিদ্রোহীরা এ সময় শেরপুরে নতুন গারো রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে। টিপুর নেতৃত্বে প্রথম গারো বিদ্রোহ ব্যর্থ হলেও ইংরেজ শাসকগোষ্ঠীর ভিত নড়ে উঠেছিল। বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলে ছোট-বড়, এখানে ওখানে মিলিয়ে ১৮৮২ সাল পর্যন্ত মোট আরো ছয়বার বিদ্রোহ সংঘটিত হয়। ১৮৫৫ সাল থেকে ১৮৫৭ সাল পর্যন্ত সংঘটিত সাঁওতাল বিদ্রোহ ভারত উপমহাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের অন্যতম আলোচিত ঘটনা। দীর্ঘদিনের সঞ্চিত ক্ষোভের বিস্ফোরণ আগ্নেয়গিরির অগ্নিৎপাতের মতো ছড়িয়ে পড়েছিল অচিরেই। ইংরেজ সরকার নানাভাবে চেষ্টা করেছিল বিদ্রোহ দমন করতে। কিন্তু সক্ষম হয়নি।
বাংলাদেশের আদিবাসীদের বিভিন্ন সময়ের এসব বিদ্রোহ আপাত দৃষ্টিতে ব্যর্থ মনে হলেও এগুলোই সেদিন ভারতবর্ষে ইংরেজ শাসনের ভিত্তিমূলে চরম আঘাত এনেছিল। ঐতিহাসিক সুপ্রকাশ রায়ের মতে, এসব বিদ্রোহ ‘ভারতের যুগান্তকারী মহাবিদ্রোহের অগ্রদূত স্বরূপ।’ বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রথম প্রস্তুতিমূলক পদক্ষেপ। এরপরেই তো গোঁজামিলপূর্ণ পাকিস্তান নামের অদ্ভুত রাষ্ট্রের পথচলা শুরু।
তিন. পাকিস্তান পর্বের এক বিশাল আন্দোলন হলো তেভাগা আন্দোলন। এ আন্দোলনের মূলেও ছিল আদিবাসীদের নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সীমাহীন সাহস আর বীরত্বপূর্ণ অংশগ্রহণ। ইংরেজ শাসনের শেষ ভাগে এসে তেভাগা আন্দোলন শুরু হলেও শেষ হয় পাকিস্তান সৃষ্টির পর। কিন্তু এই তেভাগা আন্দোলন ব্রিটিশ সৃষ্ট দুই দানব জমিদার এবং মহাজনদের শোষণের বিষ দাঁত অনেকাংশে নড়বড়ে করে দিলেও উপরে ফেলতে পারেনি। তবে তেভাগার জোয়ারে পাকিস্তানের নড়বড়ে ভিত্তিমূলে ঘুণ ধরাতে সক্ষম হয়েছিল একথা নিশ্চিত বলা চলে।
বহুজাতিক এই দেশে ‘…বাঙালি ছাড়াও অর্ধশতাধিক জাতিগোষ্ঠীর মানুষ যারা কখনো আদিবাসী, কখনো উপজাতি, কখনো ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীসহ বিভিন্ন অভিধায় অভিহিত। অস্তিত্বে জড়িয়ে থাকা, চেতনায় মিশে থাকা প্রতিবাদের ভাষা দিয়ে ইতিহাসের অধ্যায়ে অধ্যায়ে সংগ্রামী মহাকাব্যের এ স্রষ্টারাই ভারতবর্ষে বিদেশি শাসকদের বিরুদ্ধে ১ম বিদ্রোহ করেছিল। সন্ন্যাসী বিদ্রোহ (১৭৬০-১৮০০), গারো বিদ্রোহ (১৭৭৫-১৮০২), চাকমা বিদ্রোহ (১৭৮০-১৮০০), খাসি বিদ্রোহ(১৭৮৩), ময়মনসিংহের কৃষক বিদ্রোহ(১৮১২-১৮৩০), সাঁওতাল বিদ্রোহ (১৮৫৫-১৮৫৭), মুন্ডা বিদ্রোহ (১৮৫৭), তেভাগা বিদ্রোহ (১৯৪৬-১৯৪৭), টংক বিদ্রোহ, নাচোল বিদ্রোহ প্রভৃতির পথ ধরেই তাদের সমুখে আসে মুক্তিযুদ্ধ (১৯৭১)্।’
চার. বিগত চার দশক জুড়ে বহুজাতিক বাংলাদেশের আত্মপ্রকাশ লগ্নে মুক্তির সংগ্রামে বাঙালির একক অবদান বিশেষভাবে আলোচিত হয়ে আছে। তারপরও নিত্য শুনতে পাচ্ছি, মুক্তিসংগ্রামে বাঙালির একক অবদানের অনেকটুকু আজো অনুন্মোচিত রয়ে গেছে। তাহলে কি বাঙালি ব্যতীত অন্যদের অবদান ইতিহাসের মহাফেজখানায় বস্তাবন্দি হয়ে থাকবে?
বাংলাভাষাভাষী না হয়েও বাঙালির সঙ্গে একত্রে মিলেমিশে বাংলা নামের দেশ প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে মুষ্টিবদ্ধ হাত শূন্যে তুলে, নির্মমতার নিষ্ঠুরতম শিকার হয়ে, রক্তের অক্ষরে সবুজ জমিনে লাল রঙের সূর্যাঙ্কিত স্বাধীন, সার্বভৌম পতাকা বিশ্ব দরবারে উত্তোলন করে যে ইতিহাস রচনা করেছে, তার কি কোনো মূল্যায়ন হবে না এই জগৎ সংসারে? সেদিনের সেই বিশাল কর্মযজ্ঞে আদিবাসীদের বীরত্বপূর্ণ অংশগ্রহণ ইতিহাসের মহাকাব্যে এখনো অগ্রন্থিত হয়ে আছে। এসব কথা অচিরেই হারিয়ে যেতে পারে। কারণ স্বাধীনতার চল্লিশ বছর এক অর্থে বেশি না হলেও কম না।
একাত্তরে বয়সের কারণে মায়ের আঁচলের নিচে লুকিয়ে শত্রুর বাঙ্গার অতিক্রম করলেও মনে পড়ে মানিকছড়ির মং রাজা (মারমা রাজা) মং সেইনের কথা। একাত্তরের উত্তালদিনে ভারতে শরণার্থী হওয়ার প্রাক্কালে ঠাকুরদাদার পরিচয় সূত্রে মানিকছড়ির রাজবাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলাম। প্রতিদিন শত শত মানুষ তার আশ্রয়ে থেকেছে, খেয়েছে এবং নিরাপদে ভারতে পারি জমিয়েছে। ‘মং রাজা মং প্রæ সেইন সক্রিয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। যুদ্ধকালে মানিকছড়ি রাজবাড়িতে আশ্রয় শিবির এবং ফিল্ড হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা, মুজিবনগর সরকারকে অর্থ-সহায়তা ছাড়াও মুক্তিযোদ্ধাদের নিজের কয়েকটি গাড়ি এবং ত্রিশটির বেশি আগ্নেয়াস্ত্র প্রদান করেছেন। এরপর তিনি ত্রিপুরার সাব্রুম এবং সেখান থেকে পরিবার-পরিজন নিয়ে রূপাইছড়ি শরণার্থী শিবিরে অবস্থান গ্রহণ করেন। এ সময় তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র প্রশিক্ষণের কাজে নিয়োজিত হন। এরপর নিরাপত্তার খাতিরে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ তাকে আগরতলা পাঠিয়ে অনারারি কর্নেল উপাধি দেয়। এ সময় তিনি আখাউড়া অপারেশনসহ বেশ কয়েকটি সফল অপারেশনে পুরোভাগে থেকে বীরত্বপূর্ণ যুদ্ধ করেন।’
চাকমা রাজা ত্রিদিব রায়ের মুক্তিযুদ্ধের তীব্র বিরোধিতার কথা স্মরণে রেখেও বলতে হয় চাই, চাকমা জাতিগোষ্ঠীর বেশিরভাগ সদস্যের যথেষ্ট ইতিবাচক ভূমিকা ছিল। পাকিস্তানের প্রতি চাকমা জাতিগোষ্ঠীর বিশেষ ক্ষোভের কারণ ছিল কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ। চাকমা রাজপরিবারের সদস্য কে কে রায় একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছিলেন। আদিবাসী নেতা মানবেন্দ্র লারমার ভূমিকাও ছিল ইতিবাচক। ‘১৯৭১-এর মার্চ মাসে রাঙামাটি জেলা সদরে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়েছিল রাঙামাটি সরকারি কলেজের তৎকালীন ছাত্রনেতা গৌতম দেওয়ান এবং সুনীল কান্তি দে এর নেতৃত্বে।’
‘১নং সেক্টরের আওতায় সর্বপ্রথম ৫ মে ২৫ সদস্যবিশিষ্ট পার্বত্য চট্টগ্রামের মুক্তিযোদ্ধা দল গঠন করা হয়। এই দল গঠনের নেতৃত্ব দেন হেমদা রঞ্জন ত্রিপুরা। এটি পরবর্তীতে একটি পূর্ণাঙ্গ কোম্পানি হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। শ্রী ত্রিপুরাকে কোম্পানি কমান্ডার হিসেবে নিযুক্ত করা হয়।’ এজন্য অবশ্য মূল্যও দিতে হয়েছে তাদের। অনেক পাহাড়ি মা-বোনকে জোরপূর্বক ধরে নিয়ে ধর্ষণ, নির্যাতন করা হয়। অনেককে নিষ্ঠুরভাবে হত্যাও করা হয়।
খাসিয়া নারী কাকাত হেনইঞ্চিতাকে আমরা ভুলে গেছি। কিন্তু ভুলব কি করে কাঁকন বিবিকে। আজকের কাঁকন বিবি তো সেই খাসিয়া নারী কাকাত হেনইঞ্চিতা। এক পাকিস্তানি মেজর নাকি তাঁকে বলেছিল, ‘একেতো বাঙালি মনে হয় না। মনে হয় অন্য জাত।’
মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ের ওয়েব সাইটে আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা নেই। রাখাইন মুক্তিযোদ্ধা ইউ কে চিং বীরবিক্রমকে বলা হয়েছে মৃত। ওয়েব সাইটের বীর বিক্রম তালিকায় লেখা আছে- ‘মরহুম নায়েক সুবাদার ইউ কে চিং বীরবিক্রম।’ ‘প্রত্যক্ষ লড়াইয়ে মুক্তিবাহিনী হয়ে গারোবা লড়েছেন, সাঁওতালরা লড়েছেন। ইস্ট পাকিস্তান পুলিশ এবং ইপিআরের সদস্য যেসব আদিবাসী ছিলেন তারা লড়েছেন। এদের মধ্যে মারমা, মুরং, গারো, খাসিয়া, লুসাই সব গোষ্ঠীর লোক ছিলেন। ছিলেন চাকমরাও।’ ইপিআর সদস্য রমণী রঞ্জন চাকমা, হেমরঞ্জন চাকমা, খগেন্দ্র চাকমা, অ্যামি মারমা যুদ্ধে শহীদ হন। উখ্য জিং মারমা মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য বীরবিক্রম উপাধিতে ভূসিত হন। বিমলেন্দু দেওয়ান, ত্রিপুরা চাকমা, বরেন ত্রিপুরা, কৃপাসুখ চাকমা, আনন্দ বাঁশি চাকমাসহ প্রায় ২০/২২ জন সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারী ভারতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।
‘রাজশাহীর গোদাগাড়ী থানাতেই ৬২ জন আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধার তালিকা পাওয়া যায়।…দিনাজপুর জেলার ওঁরাও ও সান্তালদের ১০০০ জনের সমন্বয়ে বিশাল মুক্তিবাহিনী গড়ে তোলা হয়েছিল। ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, শেরপুর, নেত্রকোনা এলাকার গারো, হাজং, কোচ জনগোষ্ঠীগুলো থেকে প্রায় পনেরশ আদিবাসী মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। ১১৫ জন ছিল শুধু হালুয়াঘাট এলাকা থেকেই। বিষ্ণুপ্রিয়া মনিপুরীদের মধ্যেই কমপক্ষে ৫০ জনের অধিক সক্রিয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন। অনেকে জীবন দিয়েছেন দেশের জন্য, তাদের মধ্যে গিরিশ সিংহ ও ভুবন সিংহ উল্লেখযোগ্য। সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ জেলার ৮৩টি বাগান এলাকার আদিবাসী ও চা জনগোষ্ঠীর কমপক্ষে ৬০২ জন শহীদ, আহত ৪৩, নির্যাতিত ৮৩ এবং ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন অনেকে। মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল পুরো বাগানের কর্মী, কর্মকর্তা এবং সাধারণ জনগণ।’
পাঁচ. আদিবাসীদের গণহত্যা, বাড়িঘর জ্বালানো, লুটপাট, আদিবাসী নারী ধর্ষণ সবই হয়েছিল। অনেকক্ষেত্রে এদের হিন্দু ভেবে এসব হত্যা, ধর্ষণ, লুটতরাজ চালানো হয়েছিল। কিন্তু এসবের কোনো কিছুই বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসে লিপিবদ্ধ হয়নি। এ কারণেই কিন্তু বাংলার মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাস চার দশক পরও পূর্ণতা পাচ্ছে না। ইতিহাসের আলোকোজ্জ্বল দৃষ্টি এখানে না পড়লে অরণ্যচারী, প্রকৃতির সন্তান আদিবাসীদের খুব বেশি ক্ষতি না হলেও জাতি হিসেবে আমরা অকৃতজ্ঞ হিসেবে পরিচিত হয়ে থাকব। এক্ষণে এসে পার্বত্য চট্টগ্রামের ইংরেজ কমিশনার ক্যাপ্টেন লিউইন ইংরেজ শাসকগোষ্ঠীর উদ্দেশে যে মন্তব্য করেছিলেন, তা আজো প্রাসঙ্গিক মনে করে পরিশেষে উল্লেখ করতে চাই- ‘এই পাহাড়গুলোকে আমরা যেন কেবল আমাদের নিজ স্বার্থেই শাসন না করি, আমরা যেন কেবল এই পাহাড় অঞ্চলের অধিবাসীদের স্বার্থেই, তাহাদের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য বিধানের নিমিত্তই তাহাদের শাসনকার্য পরিচালনা করি। সভ্যতাই সভ্যতা সৃষ্টি করে- সভ্যতা সভ্যতারই ফল, ইহাই কারণ নহে। এখানে প্রয়োজন একজন দরদী মানুষের, কঠোর আইনের নহে। শাসন-কার্যে যোগ্যতা সম্পন্ন কোনো কর্মচারীকে এই পাহাড়িয়া মানুষগুলিকে শাসনের জন্য নিয়োগ করিতে হইবে।’ আজকের দিনেও এটাই আমাদের কাম্য।
©somewhere in net ltd.