![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
বিভিন্ন ধরণের জলাশয়ে নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে, উপযোগী আকারের খাঁচা স্থাপন করে অধিক ঘনত্বে বাণিজ্যিকভাবে মাছ উৎপাদনের প্রযুক্তি হলো খাঁচায় মাছ চাষ। আমাদের দেশে সাম্প্রতিক সময়ে খাঁচায় মাছ চাষ নূতন আঙ্গিকে শুরু হলেও বিশ্ব অ্যাকুয়াকালচারে খাঁচায় মাছ চাষের ইতিহাস অনেক পুরোনো। খাঁচায় মাছ চাষের সূচনা হয় চীনের ইয়াংঝি নদীতে আনুমানিক ৭৫০ বছর আগে। আর প্রায় দুইশত বছর আগে কাম্পুচিয়ায় খাঁচায় মাছ চাষ শুরু হয়, যেখানে জেলেরা মাগুর মাছকে বাঁশের খাঁচায় মজুদ করতো বাজারজাত করার লক্ষ্যে। প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতার কারণে আধুনিক কালে খাঁচায় মাছ চাষ ক্রমাগতভাবে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।
খাঁচায় মাছ চাষে বিশ্ব সম্প্রদায়ঃ বাংলাদেশে ‘খাঁচায় মাছ চাষ’ নূতন হলেও এশিয়ার কিছু দেশ যেমন চীন, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন, ভিয়েতনাম এবং নেপালে এর প্রচলন বেশ প্রাচীন। এশিয়ার অন্যান্য দেশের চেয়ে বাংলাদেশ খাঁচায় মাছ চাষের ক্ষেত্রে অনেক পিছিয়ে রয়েছে। স্বল্প সময়ের ব্যবধানে এশিয়ার বিভিন্ন দেশ প্রতিযোগিতা মূলকভাবে খাঁচায় মাছ চাষে প্রভূত উন্নতি সাধন করেছে। এদের অধিকাংশই খাঁচায় তেলাপিয়া চাষ করে মূলতঃ আন্তর্জাতিক রপ্তানী বাণিজ্যের জন্য।
খাঁচায় মাছ চাষের উপযোগী স্থান নির্বাচনঃ খাঁচা স্থাপনের জন্য স্থান নির্বাচন দুইটি বিষয় গুরুত্ব সহাকারে বিবেচনা করতে হবে। প্রথমতঃ জলাশয়ের প্রকৃতি দ্বিতীয়তঃ পরিবেশগত প্রভাব।
জলাশয়ের প্রকৃতিঃ জলাশয়ের প্রকৃতির মধ্যে তিনটি প্রধান নিয়ামক (Factor) কে বিবেচনায় নিয়ে জলাশয় নির্বাচন করতে হবে- পানির গুনাগুন, পানির গভীরতা, পানির স্রোত বা প্রবাহমাত্রা
১। পানির গুণাগুণঃ
পানির গুণাবলীর মধ্যে তাপমাত্র, দ্রবীভূত অক্সিজেন, পি.এইচ., অ্যামোনিয়া অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এছাড়াও নাইট্রোজেন, মুক্ত কার্বনডাইঅক্সাইড, ফেনল, তৈল জাতীয় উপাদান বিবেচনায় রাখতে হবে। মাছ চাষের জন্য পানির উপযোগী তাপমাত্রা ৩০ ডিগ্রী সেলসিয়াস থেকে ৩৬ ডিগ্রী সেলসিয়াস। গভীর পুকুরের ক্ষেত্রে উপরের দিকে উষ্ণ পানির স্তর ও নীচের দিকে শীতল পানির স্তর এভাবে বিভক্ত হয়ে থাকে, গরমকালে এই দুই স্তর মিশ্রিত হয় না। ফলে কম অক্সিজেন ও অধিক অ্যামোনিয়ার করণে পুকুরের তলদেশে পানির গুনগত মান ক্ষুন্ন হয়। তবে সমস্ত পুকুরে তাপমাত্রার সাম্যতায় ফিরে আসে।
ভিন্ন ভিন্ন প্রজাতির মাছের দৈহিক বৃদ্ধি ভিন্ন ভিন্ন তাপমাত্রায় ভালো হয়। শীত প্রধান এলাকার মৎস্য প্রজাতিগুলোর জন্য উপযোগী তাপমাত্রা ১৫ থেকে ২৭ ডিগ্রী সেলসিয়াস আর উষ্ণ অঞ্চলের মৎস্য প্রজাতিগুলোর জন্য উপযোগী তাপমাত্রা ২৯ থেকে ৩২ ডিগ্রী সেলসিয়াস। পুকুরের ন্যায় প্রবাহমান পানির ক্ষেত্রেও তাপমাত্রার সীমা প্রত্যাশিত।
মাছের দৈহিক বৃদ্ধির জন্য দ্রবীভূত অক্সিজেন গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। পরিমিত দৈহিক বৃদ্ধির জন্য পানিতে ৬ পি.পি.এম. এর উর্ধ্বে দ্রবীভূত অক্সিজেন থাকা প্রয়োজন। পুকুরে খাঁচা স্থাপনে বিষয়টি অতি-সংবেদনশীল । প্রবাহমান জলাশয়ে পানির ঘূর্ণায়মান প্রবণতার (Rolling Tendency) কারণে দ্রবীভূত অক্সিজেন মাত্রা অনেকটাই নিরাপদ মাত্রায় বিরাজ করে। যদি মজুদ ঘনত্ব অস্বাভাবিক না হয় তবে প্রতিনিয়ত পানি প্রবাহমান হওয়ার কারনে খাঁচায় দ্রবীভূত অক্সিজেনের সমস্যা সৃষ্টি হয় না ।
এসিডিটির মাত্রা পরিমাপের স্কেল কে পি.এইচ. বলা হয় যার সীমা ১ থেকে ১৪। ৭ মানের পি.এইচ. প্রশমিত অবস্থা, ৭ এর নীচে এসিডিক ও ৭ এর উপর ক্ষারীয় অবস্থা নির্দেশ করে। মাছ চাষের জন্য প্রত্যাশিত পি.এইচ. মাত্রার সীমা হলো ৬.৫-৯.০। পুকুরের ন্যায় উন্মুক্ত জলাশয়েও খাঁচা স্থাপনে পানির পি.এইচ. এর এ মাত্রা প্রত্যাশিত। পুকুরের ক্ষেত্রে তলদেশের পঁচনশীল পদার্থের কারনে কার্বন-ডাই-অক্সাইড বৃদ্ধি পেয়ে পি.এইচ. মান হ্রাস পায়। কিন্তু প্রবাহমান জলাশয়ে তলদেশে এ ধরণের জৈব পদার্থ জমে থাকার সম্ভাবনা থাকে না বিধায় পি.এইচ. মাত্রায় কোন তাৎক্ষণিক পরিবর্তন আসে না।
অ্যালকালিনিটি জলীয় পরিবেশের পি.এইচ. এ তাৎক্ষণিক উঠানামাকে নিয়ন্ত্রণ করে। এটাকে পানিতে কার্বনেট (CO3) ও বাইকার্বনেট (HCO3) এর পরিমান দ্বারা পরিমাপ করা হয় যা মোট CaCO3 এর মাত্রায় প্রকাশিত হয়। মাছ চাষে ১২০-১৪০ পি.পি.এম. মাত্রায় অ্যালকালিনিটি আদর্শ বলে বিবেচিত হয়। প্রবাহমান বা মুক্ত জলাশয়ের অ্যালকালিনিটি পারিপার্শ্বিক মাটির অ্যালকালিনিটি দ্বারা প্রভাবিত হয়। জলাশয়ে অ্যালকালিনিটি চুন প্রয়োগ করে বাড়ানো যায় যা প্রবাহমান পানিতে খাঁচায় মাছ চাষের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয়।
পানিতে আয়নিত (NH3) এবং অনায়নিত (NH4)-এই দুই রূপে অ্যামোনিয়া অবস্থান করে যার সমষ্টিই হলো মোট অ্যামোনিয়া নাইট্রোজেন। অনায়নিত অ্যামোনিয়া মাছের জন্য অত্যন্ত বিষাক্ত। অ্যামোনিয়ার মাত্রা বিশেষকরে অনায়নিত ক্ষতিকর অ্যামোনিয়া পানির পি.এইচ. ও তাপমাত্রার সাথে সরাসরি সম্পর্কিত। স্থির পানিতে খাঁচার নীচে বর্জ্য থেকে অ্যামোনিয়া মারত্বক ক্ষতিসাধন করতে পারে। নিয়মিত খাঁচার পরিচর্যা মাধ্যমে অ্যামোনিয়া নিম্নমাত্রার দ্রবীভূত অক্সিজেনের ক্ষতিরোধ করা সম্ভব। প্রবাহমান পানিতে খাঁচায় মাছ চাষের ক্ষেত্রে অ্যামোনিয়া সচরাচর ক্ষতিকর অবস্থায় পৌঁছাতে পারে না।
২। পানির গভীরতাঃ
যেহেতু খাঁচায় মাছ চাষের জন্য জলাশয়ের ধরনের ব্যাপ্তি বিস্তার অর্থাৎ একেবারে স্থির পানিতে পুকুর থেকে শুরু করে স্রোতশীল প্রবাহমান নদীতেও খাঁচা স্থাপন করা যায়। কাজেই সর্বক্ষেত্রেই পানির গভীরতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যেখানে পানির গভীরতা যেমন সেখানে খাঁচার উচ্চতা বৃদ্ধি করে কার্যকরী উৎপাদন এলাকা বাড়ানো সম্ভব। তবে সবক্ষেত্রেই লক্ষ্যণীয় হলো খাঁচার তলদেশ ও জলাশয়ের তলদেশের মধ্যকার দূরত্ব। এ দূরত্ব যত বেশী হবে জলাশয়ের তলদেশের কাঁদার প্রভাব থেকে খাঁচার অভ্যন্তরীন পরিবেশকে মুক্ত রাখা তত বেশী সহজ হবে ।
স্থির পানি তথা পুকুরের বেলায় যেহেতু পানি পরিবর্তিত হয় না ফলে তলদেশের কাঁদা ও খাঁচা থেকে আসা মাছের বর্জ্য পদার্থ মাছকে প্রভাবিত করে। তাই খাঁচা যত উপরের দিকে থাকবে ততই মাছের জন্য উপযোগী স্বাভাবিক পরিবেশে পুকুরে খাঁচা স্থাপন করলে পুকুরের তলদেশ থেকে খাঁচার তলদেশের মাঝে নূন্যতম ৩ ফূট বা ১ মিটার দূরত্ব নিশ্চিত করা উচিত।
আর প্রবাহমান পানিতে যদিও বর্জ্য জমে গ্যাস দ্বারা ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা কম তথাপি এক্ষেত্রে ন্যূনতম ২ফুট ব্যবধান থাকা আবশ্যক। এতে পানির সঠিক প্রবাহ বাঁধাগ্রস্থ হবে না।
যে সকল নদীতে জোয়ার-ভাটার কারণে পানি উঠানামা করে সেখানে পানি উঠানামার মধ্যে উচ্চতার তারতম্য বিবেচনায় আনতে হবে। ভাটার সময় যখন পানির উচ্চতা হ্রাস পায় তখনও যেন খাঁচার তলদেশ ও জলাশয়ের তলার কাঁদার মধ্যকার ব্যবধান ২ ফুটের নীচে না নামে।
৩। পানির স্রোত বা প্রবাহমাত্রাঃ
যদিও পুকুরে একেবারে স্থির পানিতে খাঁচা স্থাপন করে সফলভাবেই মাছের উৎপাদন সম্ভব। কিন্তু বাণিজ্যিকভাবে খাঁচা পরিচালনার জন্য প্রবাহমান পানির গুরুত্ব অপরিসীম। প্রবাহমান পানি একদিকে যেমন সার্বক্ষণিক খাঁচার বাইরে থেকে ভিতরের পানি পরিবর্তনের মাধ্যমে মাছের অক্সিজেন সরবরাহ নিশ্চিত করে। অন্যদিকে খাঁচার আভ্যন্তরীন বর্জ্যগুলোকে দ্রুত অপসারনে কার্যকরী ভূমিকা রাখে।
পানি প্রবাহের তীব্রতা আবার নেতিবাচক প্রভাবও লক্ষণীয়। অত্যাধিক তীব্র মাত্রার প্রবাহের কারনে খাঁচার অবয়ব/আকার সঠিক থাকে না ফলে খাঁচার অভ্যন্তরে বাসোপযোগী স্থান কমে যায়। আবার অত্যাধিক স্রোতের প্রতিকূলে সাঁতরাতে গিয়ে মাছের দৈহিক শক্তির অপচয় হয়। নদীতে ৪-৮ ইঞ্চি/সেকেন্ড মাত্রার প্রবাহে খাঁচা স্থাপন মাছের জন্য উপযোগী, তবে প্রবাহের এ মাত্রা ১৬ ইঞ্চি/সেকেন্ড এর বেশী হওয়া সমীচীন নয়। জলাশয়ের পানির গুণাগুণের উপর খাঁচার প্রভাব সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিবেচ্য বিষয়। মাত্রাতিরিক্ত বর্জ্য পদার্থ ও অব্যবহৃত খাদ্য খাঁচার তলদেশে জমে জৈব পচনশীল পদার্থের পরিমান ক্ষতিকর পর্যায়ে পৌঁছাতে পারে। ফলে পানির গুণগতমান খর্ব করতে পারে। যেখানে আগে থেকেই তলদেশের পরিবেশে কারণে জৈব পচনশীল পদার্থ বেশী সেখানে খাঁচা স্থাপন করতে গেলে বিষয়টি বিবেচনা করতে হবে।
অন্যদিকে পরিবেশের যে সকল উপকরণ খাঁচায় মাছ চাষের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলে তার মধ্যে নৌযান চলাচল অন্যতম। খাঁচা নদীর এমন অংশে স্থাপন করতে হবে যাতে কোনক্রমেই নৌ চলাচলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি না করতে পারে।
খাঁচা স্থাপনের স্থান এমন হওয়া প্রয়োজন যাতে মাছ চুরি হওয়ার সম্ভাবনা না থাকে এবং সামাজিক শত্রুতার বশবর্তী হয়ে কেউ খাঁচা কেটে না দেয়।
খাঁচা স্থাপনের স্থানটি নির্ধারনের ক্ষেত্রে লক্ষ্য রাখতে হবে যাতে প্রতিকুল আবহাওয়া যেমন বন্যা, জলোচ্ছাস, নিম্নচাপ ইত্যাদি খাঁচা, স্থাপনাকে ক্ষতিগ্রস্ত না করতে পারে। স্থানটির পাড়ের অংশ কিছুটা উঁচু হওয়া ভালো যাতে প্রতিকূল বায়ুপ্রবাহ স্থাপনাকে আঘাত হানতে না পারে। খাঁচা স্থাপনের ক্ষেত্রে শিল্প এলাকা যেখান থেকে কলকারখানার বর্জ্য নিঃসৃত হয়ে নদীতে আসে এবং নদীর পানিকে কলুষিত করে এ ধরনের অঞ্চল পরিহার করতে হবে।
জালের খাঁচায় মাছের চাষঃ
যাদের পুকুর নেই মাছ চাষ আজ আর তাদের জন্য সমস্যাই নয়। জালের খাঁচায় মাছ চাষের আদর্শ ক্ষেত্রই হচ্ছে নদী-নালা, খাল-বিলসহ উন্মুক্ত জলাশয়। যেখানে প্রবল গ্রোত নেই অথচ আছে পানির স্বাভাবিক প্রবাহ। মাছ চাষের জন্য উত্তম জায়গা হচ্ছে এমন উৎসগুলো। মশারির মোত বিশাল আকারের জাল প্রবহমান পানিতে ডুবিয়ে চারকোণা বেধেঁ তাতে ২’’- ৩’’ সাইজের পোনা ছেড়ে মাস চারেক লালন-পালন কলে পুকুরে যে উৎপাদন পাবেন তার অন্তত বিশগুণ বেশি পাবেন এখানে। স্বভাবতই প্রশ্ন আসতে পারে, বেশি উৎপাদনের কারণ কি? উত্তর হচ্ছে: পুকুরের পানি বদ্ধ আর এখানকার পানিতে সব সময়ই স্বাভাবিক প্রবাহ আছে। তাই এখানকার পানিতে অক্সিজেনের পরিমাণ পুকুরের চাইতে অনেক বেশি যা মাছের বৃদ্ধির জন্য সহায়ক। পুকুরে মাছকে সরবরাহকৃত খাবারের উচিছষ্ট এবং মাছের মল জমে পানি কিছুটা হলেও দূষিত করে, এখানে সে সুযোগ নেই। সরবরাহকৃত খাবারের উচ্ছিষ্ট এবং মাছের আবর্জনা জালের সরু ফাঁক দিয়ে প্রবাহিত পানিতে চুয়ে যায় যার ফলে পানি সব সময়ই বিশুদ্ধ থাকছে। পুকুর বদ্ধ হওয়ার জৈব খাবারের পরিমাণ কম। এখানে জৈব খাবার উৎপাদনের সুযোগ অনেক বেশি যা মাছের স্বাভাবিক বৃদ্ধির জন্য সহায়ক। এরকম অনেক উদাহরণ দাঁড়করানো যাবে জালের খাঁচায় মাছের চাষকে জনপ্রিয় করার জন্য।
খাঁচায় মাছ চাষের সুবিধাঃ
দেশের ব্রহ্মপুত্র, পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, হালদা, সুরমাসহ অধিকাংশ নদ-নদীর বাঁকে এ ধরনের মৎস্য চাষ সম্ভব। তবে এ ক্ষেত্রে পানি দূষণমুক্ত, খরগ্রোতমুক্ত এবং শত্রুমুক্ত হওয়া প্রয়োজন। নদীতে খাঁচায় মাছ চাষ করলে সহজেই প্রবহমান নদীর পানি পাওয়ার পাশাপাশি প্রাকৃতিক উৎস্য থেকেও অনেকটা খাবার পাওয়া যায়। এ ক্ষেত্রে পুকুর খনন ও তৈরির অতিরিক্ত খরচ কমে যায়। যেকোনো সময়ই খাঁচার সংখ্যা বৃদ্ধি করে খামার সম্প্রসারণ সম্ভব। নদীর প্রবহমান পানিতে প্রচুর অক্সিজেন থাকায় মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। এ ছাড়া খাঁচার মাছের বর্জ্য পানির স্রোতে অন্যত্র চলে যায়, ফলে পানি দূষিত হয় না। যদিও খাঁচা তৈরিতে কিছু খরচ হয়, তথাপি ভূমির মালিকানা সমস্যা, ভূমি ক্রয় এবং ভূমির ব্যবহার থেকে রেহাই পাওয়া যায়। ফলে ওই জমি কৃষিকাজে ব্যবহার করা সম্ভব।
খাঁচা কোথায় বসাতে হবেঃ
খাঁচা যে কোনো মাপের হতে পারে। ১ বর্গ মি. (২ হাত- ২হাত প্রায়) বা ৫ বর্গ মি. ১০,৫০ বা ১০০.৫০ বর্গ মি. মাপের। এই খাঁচা বড় পুকুরেও বসাতে পারেন। তবে সেখানে সমস্ত পুকুরের আয়তনের মাত্র ৫ ভাগ অথবা ১০ ভাগ ব্যবহারকরতে পারবেন ভালো উৎপাদন যেমন প্রতি ঘনমিটারে (২ হাত- ২হাত - ২হাত প্রায়) ১০ কেজি থেকে ১৫ কেজি। আপনি পেতে পারেন ৪/৫ মাসে । সেখানে খাঁচা বসাতে হবে চলমান খোলা পানিতে। যেমন বর্ষা মৌসুমে যে সমস্ত এলাকা ডুবে যায়, সেখানে অথবা নদীর বাঁকে যেখানে গ্রোত থাকে খুব কম। খাঁচা বসাতে পানির গভীরতা থাকতে হবে সর্বনিম্ন ১.২ মি. বা ৪৬ ইঞ্চি তবে সর্বস্ব পানির উচ্চতায় কোনো হিসাব নেই। পানি যতই বৃদ্ধি পাক খাঁচার কোনো অসুবিধা নেই। খাঁচা বসাতে খাঁচার মাপে উপরে একটা বাঁশের ফ্রেম তৈরি করতে হবে এবং চার কোণায় বাঁশ পুঁতে শক্ত করে বেঁধে দিতে হবে। পানি বাড়লে খাঁচা তুলে উপরে করে দেবেন, পানি কমলে খাঁচা নিচু করে দেবেন। খাঁচার ওপর খোলা এবং ৫ দিকে জাল এবং পানির উপরে ১ ফুট উঁচু রাখতে হবে।
এই খাঁচা কিসের তৈরিঃ
তিন বা চার ইঞ্চি থেকে এক ইঞ্চি ফাঁস আকারের মূল পলিথিলিন জাল বা এইচডিপি জাল, খাদ্য আটকানোর বেড় তৈরির জন্য পলিয়েস্টার কাপড়, নাইলনের দড়ি, এক ইঞ্চি জিআই পাইপ, ভাসমান খাঁচার জন্য পিভিসি ব্যারেল বা ড্রাম, খাঁচা স্থির রাখার জন্য অ্যাঙ্কর ও বাঁশ। এই জালের খাঁচা এক বিশেষ ধরনের পলিথিন জাতীয় সুতা থেকে তৈরি। এই জাল সাধাণত গিরাবিহীন মেশিনে তৈরি করা হয়। আবার আপনি চাইলে গিড়া দিয়ে হাতেও তৈরি করে নিতে পারেন। বর্তমানে বিদেশ থেকে আমদানি করা ঐ জাল বাজারেও পাওয়া যায়। এই পলিথিন সুতার জালের সুবিধা হল, এই জাল কাঁকরায় কাটতে পারে না, পানিতে পচে না। বছরে দুটি ফসল তোলা কোনো সমস্যা নয়। বর্ষা মৌসুমে বিলে আবার শীত মৌসুমে খালে।
খাঁচা তৈরি প্রথমেই জিআই পাইপ দ্বারা সাধারণত (দৈর্ঘ্য ২০ ফুট × প্রস্থ ১০ ফুট × উচ্চতা ৬ ফুট) বা (দৈর্ঘ্য ১২ ফুট × প্রস্থ ১০ ফুট × উচ্চতা ৬ ফুট) সাইজের আয়তকারের ফ্রেম তৈরি করতে হবে। ওই ফ্রেমের প্রতিটি কোণে ১০ ফুট উচ্চতাবিশিষ্ট একটি করে জিআই পাইপ ঝালাই করে বসিয়ে দিতে হবে। এরপর ফ্রেমের চারপাশে জাল বেঁধে দিতে হবে। প্রতি দুই ফ্রেমের মধ্যে তিনটি করে প্লাস্টিকের ড্রাম স্থাপন করে পানিতে সারিবদ্ধভাবে ফ্রেমগুলো স্থাপন করতে হবে এবং প্রয়োজনীয় সংখ্যক নোঙর দিয়ে খাঁচাটি পানির নির্দিষ্ট স্থানে বসাতে হবে। এ ক্ষেত্রে জিআই পাইপের স্থলে বাঁশও ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে সে ক্ষেত্রে স্থায়িত্বকাল কম হয়।
খাঁচার কী কী মাছের চাষ করা যায়ঃ
খাঁচায় কিন্তু সব ধরনের মাছের চাষ করা যায় না বা ভালো উৎপাদন পাওয়া যায় না। নিমণলিখিত মাছ সমূহ খাঁচায় চাষ করলে ভালো ফল দেয়: বিদেশী ঘাওর, নাইলোটিকা, রাজপুঁটি, কার্প প্রজাতি, পাঙ্গাশ।
এই সমস্ত মাছের গড় উৎপাদন ৪/৫ মাসে প্রতি ঘনমিটার ৫/১৫ কেজি।
কী মাপের পোনা ছাড়তে হবেঃ
পোনা সব সময়ই বড় সাইজের ছাড়া ভালো। এতে সুবিধা হল চাষকালীন সময় কম লাগবে, আবার মুত্যুর হারও কম হবে। পোনা যত বড় সাইজের পাওয়া যায় তত আপনার জন্য লাভজনক। তবে ২ থেকে ৩ ইঞ্চি এর কম হলে চলবে না। কারণ জালের ওপর নির্ভর করে পোনা ছাড়তে হবে।
প্রতি ঘনমিটারে কত পোনা ছাড়বেন এর কোনো সুনিদির্ষ্ট নিয়ম নেই। আসল কথা হল আমি কী মাছ ছাড়ব, কত বড় করে কতদিনে বাজরে বিক্রি করব, যেমন ধরুন- নাইলোটিকা মাছের চাষ করব। বাজারে বিক্রিযোগ্য সাইজ ১০০ গ্রাম। আমি উৎপাদন করব প্রতি ঘনমিটারে ১০ কেজি। সেখানে পোনা ছাড়ব প্রতি ঘনমিটারে ১০০টা + ৫% ধরে নিব মারা যাবে। তেমনিভাবে যদি আফ্রিকান মাগুর ছাড়তে চাই এবং লক্ষ্যমাত্রা প্রতি ঘন মি. ১৫ কেজি এবং প্রতিটা মাছের গড় ওজন ২৫০ গ্রাম। তবে সেখানে পোনাছাড়তে হবে ৬০টা + ৫%।
খাঁচায় মাছের কী কী খাদ্য দিতে হবেঃ
প্রাণী মাত্রই খাদ্য দরকার। খাদ্য ছাড়া কোনো প্রাণী বাঁচে না। খাঁচায় অধিক ঘনত্বে মাছ থাকে বিধায় তা প্রয়োজনের সবটুকু খাদ্য আপনাকে বাইরে থেকে দিতে হবে। যদিও চলমান বা খোলা পানিতে কিছু উদ্ভিদ ও প্রাণীকণা সব সময়ই আসে। তবে তা যথেষ্ট নয়। অনেক অনেক বিল বা খাল এলাকায় কোনো মৌসুমে প্রচুর উদ্ভিদ কণার জন্ম হয় যে অল্প ঘনত্বে মাছ ছেড়ে বিনা খাদ্যেই প্রতি ঘন মি. ৪/৫ মাসে ৫/৭ কেজি মাছ উৎপাদন করা যায়। তবে সুষম খাদ্য হিসাবে মাছকে দৈনিক ২/৩ বার খাবার দিতে হবে। এখানে থাকবে প্রাণিজ আমিষ, যেমন- শুটকি মাছ শামুকের মাংস অথবা গরু-ছাগলের রক্ত অথবা মাংসের ছাটি অথবা গরু-ছাগলের নাড়িভুড়ি ইত্যাদি। দ্বিতীয়ত খৈল। যে কোনো খৈল, সরিষা, তিল নারকেল বাদাম সয়াবিন, তিসি, তুলা ইত্যাদি। উচ্ছিষ্ট ভাত। এছাড়া প্রচুর ঘাস খায় নাইলোটিকা, গ্রাস কার্প ও রাজপুঁটি। বর্ষাকালে আমাদের দেশের নিম্ন বিলাঞ্চল ভারে থাকে নানা ধরনের ঘাস। এ সমস্ত ঘাসের মধ্যে নরম ঘাস, যেমন- রাইদা, ইছাদল, পোটকা প্রভৃতি। সুষম খাদ্য তৈরি করতে দিতে হবে শটকি অথবা যে কোনা প্রাণিজ আমিষ ১০-৩০%, খৈল ২০-৪০%, গমের ভুষি/মিহি কুঁড়া ২০-৫০% তার সাথে ৫% চিটাগুড় ও ৫-১০% সসত্মা দামের আটা ও ০.৫% ভিটামিন। খাবার তৈরি করারসময় একটুকু পানি মিশাবেন যেন খাবারটা মাখতে মাখতে সাবানের মতো শক্ত বলে পরিণত হয়। মাছ সেই বল থেকে কামড় দিয়ে খাবার নেবে। যদি খাদ্য ও পানি ভালোভাবে মিশে শক্ত বলে পরিণত না হয় তবে খাদ্য পানিতে গুলে যাবে। মনে রাখতে হবে তৈরি বল ১৫-২০% মিটার পর্যন্ত পানিতে যেন না গলে। এভাবে খাদ্য তৈরি করে বাঁশের ঝুড়িতে করে খাঁচার মধ্যে পানির ১ হাত নিচে ঝুলিয়ে রাখতে হবে। মাছ ৫-১০ মিনিটের মধ্যে সমস্ত খাদ্য শেষ করে ফেলবে।
দৈনিক কী পরিমাণ খাদ্য দিতে হবেঃ
মাছ তার দৈহিক ওজনের গড়ে ৩-৫% খাদ্য খায়। তবে ১ গ্রাম থেকে ২০ গ্রাম পর্যন্ত পৌছতে ১০-২০% পর্যন্ত খাদ্য খায় এবং এই সময় তবে বাড়তিও বেশি হয়। গড় সুষম খাদ্য দিয়ে ১ কেজি মাছ উৎপাদন করতে ২/৩ কেজি খাদ্য দরকার হয়। হবে খাবারের সাথে সাথে কাঁচা গোবর, মুরগীর বিষ্ঠা ও প্রচুর ঘাস দিলে খাদ্য খরচ অনেক কমে যায়।
উৎপাদন কেবল খাঁচায় চাষ করলে অল্প মূলধনে, অল্প সময়, অল্প খরচে অধিক উৎপাদন সম্ভব হয়। উন্নত বিশ্বে বিজ্ঞানীরা আজ প্রতি বর্গমিটা প্রতি মাসে ১০ কেজি মাছ উৎপাদন এ হিসাবে দাঁড়ায় প্রতি বিঘায় মাসে ১০ মেট্রিক টন বা ১০ হাজার কেজি। এর মধ্যে স্থায়ী খরচ ৬ হাজার ৫শ' টাকা বাদ দিলে মোট মুনাফা ১৯ হাজার ৬শ' ৫০ টাকা প্রতি খাঁচায় প্রতি ৩/৪ মাসে। খাঁচায় মাছ চাষ করতে রাত-দিন সব সময় দারোয়ান অবশ্যই থাকতে হবে। ককৈনা অল্প জায়গায় এত অধিক মাছ থাকায় চুরির সম্ভাবনা বেশি। বাস্তব অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে এই চাষ বাংলাদেশে অধিক লাভজনক।
আয়-ব্যয়ঃ
খাঁচা তৈরির সম্ভাব্য খরচ ও মাছের উৎপাদন ২০ ফুট দৈর্ঘ্যের একটি খাঁচা তৈরিতে খরচ হয় প্রায় ১৬ হাজার টাকা, যা চার-পাঁচ বছর স্থায়ী হয়। মাছের আকার ৩০০ থেকে ৪০০ গ্রাম হলেই বিক্রির উপযোগী হয়, আর এ ক্ষেত্রে সময় লাগে মাত্র ছয় মাস। এ ক্ষেত্রে প্রতি ঘনমিটারে কমপক্ষে ৩০ কেজি মাছ উৎপাদিত হয়ে থাকে। সাধারণত চাষকৃত পোনার ওজন ১০ গ্রাম হয়ে থাকে। তবে এ ক্ষেত্রে আকারে বড় অর্থাৎ ২০ থেকে ৩০ গ্রাম ওজনের পোনা চাষ করলে সর্বোচ্চ উৎপাদন পাওয়া যায়। খাঁচা তৈরি, পোনার মূল্য, খাদ্য, শ্রমিক ও অন্যান্য খরচ বাদ দিয়ে প্রতি ১০টি খাঁচা থেকে প্রতি ছয় মাসে কমপক্ষে এক লাখ ১০ হাজার টাকা আয় করা সম্ভব।
সম্ভাবনাঃ
পতিত জমিতে (নদী, হাওর, বিল) মাছের উৎপাদন সাধারণ জমিতে স্থাপিত খামারের তুলনায় প্রায় ১৩ গুণ বেশি হয়। সাধারণ পুকুরে বা খামারে এক একরে যে পরিমাণ মাছ চাষ করা যায় সেই পরিমাণ মাছ উৎপাদনের জন্য খাঁচায় মাত্র ১৮০ ঘনমিটার জায়গাই যথেষ্ট। খাঁচায় যেখানে প্রতি হেক্টরে তিন লাখ কেজি মাছ উৎপাদন সম্ভব, সেখানে পুকুরে বা খামারে প্রতি হেক্টরে মাত্র ২৩ হাজার কেজি মাছ উৎপাদন হয়ে থাকে। বর্তমানে দেশের মাছের চাহিদা প্রতি বছরে প্রায় ৩০ লাখ টন। খাঁচায় মাছ চাষ করলে এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে মাত্র ১০ হাজার হেক্টর জমিই যথেষ্ট, যা আমাদের দেশের পতিত মোট নদ-নদীর পানির মাত্র শতকরা ০.২৫ ভাগ।
তথ্য: তথ্য আপা প্রকল্প
©somewhere in net ltd.