নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

কালের পথে আমরা সবাই পথিক। পথিক চলে যাবে, শুধু রেখে যাবে তার চিহ্ণ।

সাব্বির হুসাইন শাওন

স্থপতি/শিক্ষক

সাব্বির হুসাইন শাওন › বিস্তারিত পোস্টঃ

আমাদের তপনদা...

২৩ শে অক্টোবর, ২০১৬ দুপুর ১২:১৯

‘...পড়ন্ত বিকেল তপনদার দোকান...এক কাপ চা...পরম তৃষ্ণা আহা....’ ‘শিরোনামহীন’র জনপ্রিয় গান ‘ক্যাফেটেরিয়ার’ কথা একটু পরিবর্তন করে গিটারের তালে তালে গাইছিলেন ইমন,শুভ,সাব্বির, আরিফ সহ অনেকে। স্থান তপনদার দোকান। কথার পরিবর্তনের যথার্থতায় হাততালি দিল শ্রোতারা। এরমধ্যে গায়ক গান বন্ধ করে হাক ছাড়লেন ‘তপনদা তৃষ্ণা পাইছে, এককাপ চা’। পাশ থেকে আরও হাক আসে..তপনদা শরবত, তপনদা সিঙ্গারা, তপনদা কফি। দিচ্ছি দাদা, এইতো দাদা.... তপনদা যন্ত্রের মত চা,কফি শরবত বানাতে থাকেন, তবু এতটুকু অধৈর্য্য হন না, মুখে লেগে থাকা অমলিন হাসিটুকু সরে না। এই হচ্ছে আমাদের তপনদা, তপনদার দোকান, টিএসসি বিহীন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি। আড্ডা গান আর মানুষে মানুষে মেলবন্ধনের পরম স্থান।
১৯৯০ সালের কথা। বাংলাদেশ বেতার খুলনার উচ্চশক্তি প্রেরণ কেন্দ্রের জমি অধিগ্রহণ করে নির্মিত হচ্ছে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম একাডেমিক ভবন। শতশত শ্রমিক কাজ করছেন। কিন্তু শহর থেকে দূরে ফাঁকা মাঠ আর জলা-জঙ্গলে ঘেরা এই জায়গার আশেপাশে কোন চা-নাস্তার দোকান নেই। বসতবাড়িই যেখানে খুঁজে পাওয়া দুস্কর চা-নাস্তার দোকান তো দূরপয়মন্ত। তবে চা-নাস্তার দোকান আছে এক কিলোমিটার দূরে গল্লামারী বাজারে। শ্রমিকরা তাই চা-নাস্তা খেতে গল্লামারী যাচ্ছেন, আর এতে নষ্ট হচ্ছে প্রচুর সময়। বিষয়টি ভাবাল প্রজেক্ট কন্ট্রাক্টর আব্দুল মতিনকে। সমাধান খুঁজতে লাগলেন তিনি। গল্লামারীরই এক চায়ের দোকানে তখন মাত্র ২৫ টাকা মাসিক মাইনেতে কাজ করত তপন কুমার পাল। বয়স মাত্র তের। ছেলেটার চেহারা আচার ব্যবহার মুগ্ধ করল আব্দুল মতিনকে । একদিন কাছে ডাকলেন। কিছু টাকা দিয়ে বললেন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে দোকান দিতে। কাজের আকালের মধ্যে বহুকষ্টে গল্লামারীর এই চায়ের দোকানে কাজ পেয়েছিলেন পাঁচ ভাইয়ের অভাবী সংসারের তপন। নিজের দোকান দেবার এই সুযোগ পেয়ে তাই এক কথায় রাজি হয়ে গেলেন। কিন্তু কতই বা তার বয়স? তবু সাহস হারালেন না। আব্দুল মতিনের দেওয়া টাকায় চুলা কেতলী কিনে ক্যাম্পাসে ছোট্ট একটি চায়ের দোকান দিলেন। সেই শুরু তারপর সবার স্নেহের তপন থেকে তপনদা, আর মহিরুহ হয়ে ওঠা সেই ছোট্ট দোকানটি এখন টিএসসি বিহীন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি।
রাত তখন নয়টা। ক্যাম্পাসের অন্যান্য ঝুপড়ি দোকান গুলো অনেক আগেই বন্ধ হয়ে গেছে। ক্যাম্পাস ফাঁকা হতে শুরু করেছে। তপনদাও দোকান বন্ধ করবেন, ঠিক এই মুহুর্তে হাজির হলাম, বললাম শুধু চা নয় চায়ের সাথে গল্পও চাই। তপনদা হাসলেন, সেই মহাপবিত্র হাসি। দু কাপ চা তৈরি হল। চারপাশে ঝিঝি পোকার চিৎকার। তপনদা শুরু করলেন তার দোকানের টিএসসি হয়ে ওঠার গল্প।
‘ছোড বাচ্চা মানুষ আমি। কিভাবে কী করব বুঝে উঠতে পারতিছিলাম না। তারপরও সাহস হারালাম না। ছোড এট্টা দোকান কিনে মাল তুললাম। রাত হলি আশপাশ সব ফাঁকা হয়ে যাত। সাপ-খোপের ভয় ছিল। আবার দোকান ছাড়ে নড়তিও পারতাম না। দুইবার দুকান ছাড়ে বাড়ি গিছি আসে দেখি দুকান চুরি হয়ে গেছে। আবার ধার দিনা করে মাল তুলতাম। সারারাত একা এই ফাঁকা জাগায় দুকানে শুয়ে কাটাতাম’ বলতে বলতে তপনদার কন্ঠ ধরে এল। একমুহুর্তের মধ্যে যেন তিনি চলে গেছেন ৯০-৯১ সালের সেই কষ্টের দিনগুলিতে। এতকষ্টের পরও কেন দোকান আকড়ে থাকলেন? ‘নিজির দুকান দাদা, স্বাধীনতার লোভ সামলানো বড় দায়’। তপনদার নির্বিকার উত্তর। তবে কষ্টের দিন শুধু যে ঐ সময়ই ছিল তা নয়।গল্পে গল্পে উঠে এল আরও অনেক কষ্টের কথা, অভিমানের কথা। এ পর্যন্ত ছয়বার তাকে উচ্ছেদ করেছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। সর্বশেষ উচ্ছেদ এই তো সেদিন দশ মাস আগের কথা। কিন্তু ছাত্রদের প্রতিবাদ আর কিছু শিক্ষকের সহায়তায় বারবারই হার মেনেছে কর্তৃপক্ষ। তবে তার উপর এতবার উচ্ছেদের খড়গ নেমে এসেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীর ‘কল্যাণে’। দাদা দেখালেন প্রায় বারটি খাতার বিশাল বান্ডিল। সবই এইসব কর্মচারীদের বাকির হিসাব। যখনই চাইতে গেছেন তখনই তার উপর নেমে এসেছে টাকা চাওয়ার ‘অপরাধের’ শাস্তি । যে মানুষটির সামনে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি ইট গাথা, যার বানানো এককাপ চা না খেলে অনেক ছাত্রেরই সারা দিনটা ম্যাজম্যাজে হয়ে যায় সেই মানুষটিই মাঝে মাঝে হয়ে যান বিশ্ববিদ্যালয়ের অবাঞ্ছিত কেউ। অভিমানে আবেগে গলা ধরে আসে তপনদার ‘একবার খুব অভিমান হল। ভাবলাম আর দুকানদারি করব না। চলে যাব। কিন্তু দাদা এই ভার্সিটির মায়া ত্যাগ করতি পারি নে। ছাত্ররা আমায় এত ভালবাসে, এই মায়া ছাড়ে যাব কী করে।’ তাই তো, ভালবাসার তো বন্ধন ছিন্ন হবার নয়। এ বন্ধন ছিন্ন করবেন কীভাবে তপনদা? তপন দা শোনাতে থাকেন ছাত্রদের গল্প, বন্ধন আর ভালবাসার গল্প। ‘পুরন ছাত্ররা গাড়িতে করে আসে, তপনদা বলে জড়িয়ে ধরে, চোখে জল ধরে রাখতি পারি নে দাদা, এরা কত কষ্ট করেছে, সারা মাস বাকী খেয়েছে, বাড়িরতে টাকা আসলি টাকা দিয়েছে , কোনদিন এদের কাছে টাকা চাইনি, আজ এরা কতবড় মানুষ।’ এই মানুষ হবার প্রক্রিয়ায় তপনদার ভূমিকাই বা কম কিসে? তপনদা আর তপনদার দোকান ছিল বলেই না সমকালীন অর্থনীতি রাজনীতি নিয়ে চায়ের কাপে ঝড় তোলে ছাত্ররা, বসে কবিতার আসর, গানের আসর, সংগঠনের সাপ্তাহিক সভা, পাঠচক্রের আড্ডা, একটি তপনদার দোকান মর্যাদা পায় টিএসসি’র। ২২ বছর ধরে তপনদা এই ক্যাম্পাসে। কখনও কি চলে যাবেন দাদা? তপনদা উত্তর খোঁজেন কিন্তু পান না।
সময় হয় ওঠার। তপনদার বয়স এখন চৌত্রিশ। বিয়ে করবেন না দাদা? করি করি করে করেই ফেলি প্রশ্নটা। তপনদা হাসেন। আরেকটি নতুন বন্ধনে জড়ানোর লাজুক হাসি। মেয়ে দেখা চলছে। সামনের ফাল্গুনে তপনদার বিয়ে।

মন্তব্য ৩ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (৩) মন্তব্য লিখুন

১| ২৩ শে অক্টোবর, ২০১৬ রাত ৮:১২

সাদা মনের মানুষ বলেছেন: সামহোয়্যারইনে সু-স্বাগতম

২৩ শে অক্টোবর, ২০১৬ রাত ৮:৩৫

সাব্বির হুসাইন শাওন বলেছেন: ধন্যবাদ সাদা মনের মানুষ। সামহোয়্যারইনের সাথে সম্পর্ক পুরনো। তবে এবার আসল নামে আবির্ভূত... :)

২| ২১ শে নভেম্বর, ২০১৬ সকাল ৮:১৩

সাদা মনের মানুষ বলেছেন: ওকে নতুন নামে পথচলা শুরু হোক নব উদ্দমে।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.